সায়াহ্নে

সায়াহ্নে

অপারেশন থিয়েটার। বাইরে ঘর্মাক্ত শরীরে পায়চারি করছে শিহাব। ভেতরে তার স্ত্রী প্রীতির সিজার চলছে। অপেক্ষা করছে শিহাব, কবে ভেতর থেকে ডাক্তার এসে সুখবরটা দেবে। একজন মহিলা ডাক্তার বের হয়ে এলেন ভেতর থেকে। শিহাব তাড়াতাড়ি সামনে গিয়ে স্ত্রীর কন্ডিশন জানতে চাইলো,

-ডাক্তার আমার স্ত্রীর কী অবস্থা? ভালো আছে তো ও?’ মাস্কের ভেতর থেকে ডাক্তার জবাব দিলো,

-সিজার শুরু হয়েছে। কোনো প্রয়োজন বা কিছু হলে আপনাকে জানানো হবে।’ বলেই ডাক্তার চলে গেল। শিহাব একটা বেঞ্চে বসে পড়লো। টেনশন হচ্ছে তার। স্ত্রী সন্তান দুজনই যেন ভালো থাকে। বেশি টেনশন হচ্ছে স্ত্রীর জন্য। প্রীতিকে সে খুব ভালোবাসে। প্রীতির কারণে সে নিজের পরিবারকেও ছেড়ে চলে এসেছে। প্রীতিকে ওর পরিবার অন্যত্রে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিল বলে একদিন প্রীতি শিহাবের কাছে চলে আসে, তারপর কাউকে না জানিয়ে ওরা দুজন বিয়ে করে নেয়। বউকে নিয়ে শিহাব ঘরে উঠলে বাধা হয়ে দাঁড়ায় ওর বাবা। গর্জন করে ওর বাবা বলে ওঠে,

-তোর স্পর্ধা দেখে আমি অবাক হচ্ছি। আমাদের কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করেছিস, আবার বউকে নিয়ে ঘরে উঠেছিস?

-বাবা, জানানোর মতো অবস্থা ছিল না আমাদের। তোমাদের জানালে তোমরাও মেনে নিতে না। আর আমিও প্রীতিকে হারাতে চাইনি।’ মাথা নিচু করে বলে শিহাব।

-তোর কোনো কথা শুনতে চাই না আমি। তোর সামনে এখন দুটো পথ খোলা আছে’ গলার আওয়াজ আরও বাড়িয়ে দিলেন শিহাবের বাবা। শিহাব মুখ তুলে তাকায় বাবার দিকে। চেহারায় ভীতি স্পষ্ট। বাবা কী বলে শোনার জন্য অপেক্ষা করছে সে। বাবা একটু থেমে বলে উঠলো,

-হয় তুই এই মেয়েকে ছাড়বি, আর নয়তো এই পরিবারকে চিরতরে ছেড়ে যাবি…’

বাবার কথা শুনে আকাশটা যেন ভেঙে পড়লো ওর উপর। চমকে উঠে তাকালো সে বাবার দিকে। তারপর তাকালো পাশে দাঁড়িয়ে তাকা প্রীতির দিকে। প্রীতিও তাকালো শিহাবের দিকে। সে অপেক্ষা করছে শিহাব কী করে দেখার জন্য। শিহাব দ্বিধায় পড়ে গেল। বাবার কোন শর্ত মেনে নেবে সে বুঝতে পারছে না। একবার বাবার দিকে তাকাচ্ছে সে, একবার স্ত্রীর দিকে। তারপর হঠাৎ স্ত্রীর একটা হাত ধরে নরম কণ্ঠে বলে উঠে,

-বাবা, আমাদের জন্য দোয়া করো। যাচ্ছি আমরা।’ বাবাসহ তখন ওর পরিবারের সবার মনটা ভেঙে যায়। ওদেরই ছেলে বাইরের একটা মেয়ের জন্য ওদেরকে ছেড়ে চলে যাবে, এটা তারা ভাবতে পারেনি। কিন্তু প্রীতির চোখে অশ্রু চলে এলো তখন শিহাবের ভালোবাসা দেখে। অশ্রুসিক্ত নয়নে সে চেয়ে থাকে স্বামীর দিকে। শিহাব তার দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে বলে,

-প্রীতি, চলো’

সেদিন ওরা বের হয়ে এসেছিল, তারপর আর দেখা হয়নি পরিবারের সাথে। শিহাবের ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠে। জানালার পাশে সরে এসে ফোন রিসিভ করলো শিহাব। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে একজন মহিলার কণ্ঠ শোনা গেল,

-স্যার, আপনি আজ মামুনকে পড়াতে আসেননি যে?
-আন্টি, আমার স্ত্রী হাসপাতালে। তাই আমি আসতে পারছি না।
-ও আচ্ছা আচ্ছা, তাহলে স্ত্রীর পাশে থাকুন আপনি।

বলেই ওপাশ থেকে কেটে দিলো ফোন। শিহাব জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। শহরের বড় বড় বিল্ডিংগুলো চোখে পড়ে। এখানে অনেকগুলো হয়তো নামীদামি অফিস। প্রীতিকে নিয়ে যখন সে একটা বাসা ভাড়া করে নতুন করে সংসার সাজাতে শুরু করে, তখন এরকম অনেক অফিসে চাকরির জন্য ঘুরাফেরা করেছে, কিন্তু কোয়ালিফিকেশন থাকা সত্ত্বেও চাকরি জুটেনি তার কপালে। শেষে একদিন টিউশনি করা শুরু করে। মামুন তার প্রথম স্টুডেন্ট। মামুনকে যখন সে পড়াতে যেতো বাসায় প্রীতি একা থাকতো। শিহাবের তখন টেনশন হতো প্রীতির জন্য। তাই মামুনকে পড়ানোর ফাঁকে সে মোবাইলটা বের করে প্রীতিকে টেক্সট করে বলে,

-বাসার দরজা ভেতর থেকে লক দিয়ে রেখো। কেউ ডাকলে খুলবে না।’ প্রীতির রিপ্লাই পেতে দেরি হলে শিহাব ফোন দিয়ে দেখতো। কিছুক্ষণ রিং বাজলেই কেটে দিতো। তখন প্রীতি এসে রিপ্লাই দেয়,

-আমার জন্য টেনশন করো না। মন দিয়ে ছাত্রকে পড়াও।
-বাসায় সুন্দরী বউ রেখে এসেছি, টেনশন তো হবেই।
-ইশ!’ দুজনের মাঝে এরকম কথা বলার ফাঁকে মামুনের মা এসে বলে,
-স্যার কিছু মনে করবেন না। পড়ানোর সময় যদি মোবাইলটা পকেটে রাখতেন তাহলে ভালো হতো…’
-জ্বী আন্টি।’ বলে মোবাইলটা ঢুকিয়ে নেয় শিহাব। তারপর মামুনকে পড়া আদায় হয়ছে কি না জিজ্ঞেস করে। মামুন দুদিকে মাথা নাড়ায়।

-মি.শিহাব…’

একজন ডাক্তারের কণ্ঠে ঘুরে তাকায় শিহাব। এতক্ষণ সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে পুরনো কথা ভাবছিল। ডাক্তারের দিকে ফিরতেই ডাক্তার বলে উঠলো,

-আপনার স্ত্রীর জন্য ব্লাডের প্রয়োজন। আপনি কয়েক ব্যাগ ‘O+’ ব্লাড সংগ্রহ করুন দ্রুত।
-জ্বী আমি সংগ্রহ করছি।’ বলেই বেরিয়ে এলো শিহাব হাসপাতাল থেকে। তারপর তার এক বন্ধুকে ফোন দিলো,
-হ্যাঁ মাহফুজ, তোর ব্লাড গ্রুপ O+ না? তোর ভাবীকে একটু ব্লাড দিতে পারবি?
-সরি দোস্ত, আমি তো কিছুদিন আগেই একজনকে ব্লাড দিলাম, এখন দিতে পারবো না।’

শিহাব জানে মাহফুজ কাউকে রক্ত দেয়নি। তবুও সে কিছু বললো না তাকে। নীরবে ফোন রেখে দিলো। আরও একজনকে ফোন দিলো,

-রাকিব, তোর ভাবীর ব্লাড প্রয়োজন। একটু ব্লাড দিতে হাসপাতালে আয় না? আমি তোকে হাসপাতালের লোকেশন টেক্সট করে দিচ্ছি।
-কোন গ্রুপের ব্লাড?’ ওপাশ থেকে জিজ্ঞেস করে রাকিব।
-ও পজেটিভ।
-স্যরি রে দোস্ত, আমারটা বি পজেটিভ ব্লাড।’

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফোন রেখে দিলো শিহাব। রাকিব তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু, সেও মিথ্যে বলবে ভাবতে পারেনি সে। এরপর বেশ কয়েক জায়গায় ফোন করে সে। কিন্তু রক্তের সন্ধান পেল না। শেষে ফেসবুকের বিভিন্ন ব্লাড ডোনেশন গ্রুপে স্ট্যাটাস দেয়, রক্ত প্রয়োজন বলে। নিচে তার ফোন নাম্বার আর লোকেশন দিয়ে দেয়। তারপর অপেক্ষা করতে থাকে কোনো হৃদয়বান ব্যক্তি যোগাযোগ করে কিনা। সারাদিন কিছু খায়নি সে, একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে খাবারের অর্ডার দিলো। প্রীতিকে নিয়ে আলাদা সংসার করার পর থেকে কখনও বাইরে খায়নি সে। সংসারে আয় কম বলে প্রীতি নিষেধ করতো বাইরে খেতে। একদিন সে শখ করে প্রীতিকে বলেছিল,

-চলো আজ আমরা বাইরে ডিনার করবো।’ প্রীতি একটু শাসনের সুরে বলে উঠে তখন,

-কী দরকার শুধুশুধু বাইরে এতগুলো টাকা নষ্ট করার? আমাদের সংসারে কি এতো বেশি আয় যে এতো সৌখিন হতে হবে।

-তোমারও তো ইচ্ছে হতে পারে তাই না? বিয়ের পর বউকে নিয়ে কতজনে কতকিছু করে, কতো জায়গায় ঘুরতে যায়, কতো জায়গায় খেতে যায়। তোমাকে নিয়ে তো আমি কিছুই করতে পারলাম না।

-কিচ্ছু করতে হবে না। তুমি কয়েকটা টিউশনি করে যা টাকা পাও, তাতে আমাদের সংসার ভালোভাবেই চলছে। আমাদের এতো সৌখিন হতে হবে না। সামনে আমাদের বাবু হলে খরচ আরও বাড়বে। কিছু টাকা জমাও।’ স্ত্রীর কথা শুনে চোখ বড় বড় করে তাকালো শিহাব ওর দিকে। দুষ্টুমি করে জিজ্ঞেস করে,

-বাবু আসবে বুঝি?
-হুমম।’ মুখের ভেতর শব্দ করে মাথা নিচু করে ফেলে প্রীতি। লজ্জা পেতে শুরু করে সে হঠাৎ। শিহাব ওর থুতনি ধরে মুখ উপরে তুললে সে চোখ বন্ধ করে ফেলে লজ্জায়।

-সত্যি?’ আবারও জিজ্ঞেস করে শিহাব, যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। প্রীতি চোখ বন্ধ অবস্থায় উপর নিচ মাথা দুলায়। শিহাব শাড়ির উপর থেকে প্রীতির পেটে একবার হাত বুলিয়ে প্রীতিকে বুকে টেনে নেয়। প্রীতিও জড়িয়ে ধরে শিহাবকে। শিহাব প্রীতির কানে কানে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে,

-ছেলে নাকি মেয়ে?’ প্রীতিও ফিসফিস করে জবাব দেয়,
-জানি না।’ হিহিহি করে হেসে ওঠে প্রীতি। খাবার অর্ধেক শেষ হতেই শিহাবের ফোন বেজে ওঠে। অনেক আশা নিয়ে সে ফোন রিসিভ করলো। ওপাশের কথা শুনেই তার মুখে খুশির ভাব ফুটে উঠলো, খুশি হয়ে সে বললো,

-জ্বী জ্বী ভাই, আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমি হাসপাতালে অপেক্ষা করছি আপনাদের জন্য।’ ফোন রেখে দিয়ে হাসপাতালের দিকে হাঁটলো শিহাব। হাঁটতে হাঁটতে ভাবছে সে, চেনা নেই, জানা নেই, অপরিচিত কিছু লোক রক্ত দিতে ছুটে আসছে, অথচ কাছের মানুষগুলোর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না এ সময়। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো শিহাব। রক্ত সংগ্রহ করা শেষ হলে শিহাব রক্তদাতাদের সাথে হ্যান্ডশেক করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। তারপর হেসে বিদায় দেয় ওদের। ওরা চলে গেলে একজন ডাক্তার বের হয়ে বলে,

-মি.শিহাব, আমরা দুঃখিত, অবস্থা খুব ক্রিটিকাল। আমরা মা আর বাচ্চার যেকোনো একজনকে বাঁচাতে পারবো। কাকে বাঁচাতে পারি বলা যায় না। দুজনকে একসাথে বাঁচানো সম্ভব না।’ কথাটা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না শিহাব। এমনটা সে আশা করেনি। নিজের ভেতর যেন সে আর নেই। মাথাটা কেমন যেন করছে। নিজেকে সামলাতে পারছে না। অনেক কষ্টে বলে উঠলো,

-ডাক্তার, আপনারা আমার স্ত্রীকে বাঁচাতে চেষ্টা করুন। বাচ্চাটার সাথে এখনও আমার মেশা হয়নি, ওর মায়া হয়তো কাটিয়ে উঠতে পারবো, কিন্তু আমার স্ত্রী আমার নিশ্বাসে মিশে গেছে, ওর মায়া কাটিয়ে উঠতে অনেক কষ্ট হবে আমার। ও থাকলে হয়তো আমি আবারও সন্তান পাবো, কিন্তু ও না থাকলে কথা শেষ করতে পারলো না শিহাব, নিজেকে সামলাতে না পেরে বসে পড়লো পেছনের বেঞ্চটাতে। ডাক্তার বললো,

-ধৈর্য্য ধরুন। আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করবো।’ বলেই ভেতরে চলে গেল ডাক্তার। শিহাব বেঞ্চে হেলান দিয়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে। চোখের বাধ ভেঙে অশ্রু বের হয়ে আসতে চাচ্ছে। গলা আর ঠোঁট কাঁপছে অশ্রু বের হতে না পেরে। তাদের কোলে বাচ্চা আসবে বলে শিহাব আগে থেকেই বাচ্চার জন্য খেলনা কিনে রেখেছে বাসায়। খেলনাগুলো দেখে প্রীতি খুব খুশি হয়েছিল। শিহাবের কাঁধে মাথা রেখে সে বলেছিল,

-আমাদের বাবু আসলে সারা ঘর সে মাতিয়ে রাখবে। খেলনাগুলো নিয়ে খেলবে, আমি আর তুমিও খেলবো ওর সাথে। তুমি যখন টিউশনিতে যাবে না? তখন আর আমাকে একা থাকতে হবে না বাসায়। তুমিও আর টেনশন করবে না আমার জন্য।’ বলেই মাথাটা তুলে শিহাবের দিকে তাকিয়ে হাসে প্রীতি। শিহাব ওর দুকাঁধে হাত রেখে বলে,

-টেনশন কি আর কমবে? তখনও তো তোমাকে একা থাকতে হবে…
-একা থাকবো কেন?
-আমি আমার সন্তানকে নিয়ে টিউশনিতে যাবো। ওকে আমার কোলে বসিয়ে স্টুডেন্টদের পড়াবো।
-পাগল একটা।’ বলেই প্রীতি হেসে উঠে শিহাবের কাঁধে আবার মাথা রাখে।

-শিহাব…’

বাবার কণ্ঠ শুনেই চমকে উঠে শিহাব। মাথা তুলে তাকায় সে। দেখে বাবা আর মা দাঁড়িয়ে আছে। বেঞ্চ থেকে উঠে বাবাকে জড়িয়ে ধরে সে। আবেগ আর ধরে রাখতে পারে না সে, ‘বাবা বাবা’ বলে কাঁদতে থাকে। পেছনে তার পিঠে হাত বুলাতে থাকে তার মা। এবার শিহাব মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে। বাবা জিজ্ঞেস করে,

-বউমার কী অবস্থা?’ শিহাব চোখ মুছে বলে,
-অবস্থা এখনও জানা যাচ্ছে না। ডাক্তার বলছে যেকোনো একজনকে বাঁচানো যাবে।’
-দোয়া কর, আল্লাহ যেন দুজনকেই সুস্থ রাখেন।’

ভেতর থেকে একজন ডাক্তার বের হয়ে এলেন। মুখের মাস্কটা খুলে শিহাবের সামনে দাঁড়ালেন তিনি। ডাক্তারের চেহারা বিমর্ষ। শিহাবের ভেতরটা কাঁপছে। ডাক্তার যা বলবে তা সে সহ্য করতে পারবে তো? ডাক্তার শিহাবের কাঁধে হাত রেখে বললো,

-আপনার বাচ্চা সুস্থ আছে, কিন্তু…
-কিন্তু কী?
-কিন্তু আপনার স্ত্রীকে বাঁচানো গেল না।

আসলে আপনার স্ত্রী চেয়েছে আপনার সন্তানকে বাঁচাতে, যেন আপনি আপনার সন্তানকে নিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরে যেতে পারেন। আপনি আপনার পরিবারকে যেন ফিরে পান।’
ডাক্তারের কথা শুনে কোনো কথা বের হলো না শিহাবের মুখ দিয়ে। শোকে যেন পাথর হয়ে গেছে সে। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে। তার বাবা মা তাকে ব্যর্থ সান্ত্বনা দিতে লাগলো। শিহাব ধীরে ধীরে হেঁটে স্ত্রীর লাশের পাশে এলো। লাশের উপর থেকে সাদা চাদরটা সরাতেই প্রীতির মায়াবী চেহারাটা ভেসে ওঠলো। চোখ দুটো বন্ধ তার। অনন্তকালের জন্য ঘুমোচ্ছে সে। শিহাব হাঁটুগেড়ে বসে পড়লো লাশের পাশে। প্রীতির একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে কাঁদতে লাগলো। অবশেষে প্রীতির কথাটায় সত্যি হলো। কয়েকদিন আগে ও শিহাবের বুকে মাথা রেখে হঠাৎ করে বলেছিল,

-জানো, কেন জানি মনে হচ্ছে আমি আর বেশিদিন থাকবো না। অনেকেই তো সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায়, আমারও যদি এমন পরিণতি হয়, তুমি নিজেকে একটু সামলে নিও।’ প্রীতির কথা শুনে শিহাব একটা ধমক দিয়ে বলে,

-চুপ! এসব কী কথা? কিচ্ছু হবে না তোমার? ভুলে গেছো আমরা আমাদের সন্তানকে নিয়ে খেলবো বলেছিলাম?
-হুমম… তবুও কেন জানি ভয় হচ্ছে। আমার যদি কিছু হয়ে যায়, তাহলে তুমি আমাদের বাবুকে নিয়ে তোমার পরিবারে ফিরে যেয়ো। তোমার পরিবার আমাকে মানতে পারেনি, তোমার সন্তানকে নিশ্চয়ই মেনে নেবে।

-চুপ করবা তুমি? এভাবে বললে কিন্তু আমার কষ্ট হয়।
-ঠিক আছে আর বলবো না। জড়িয়ে ধরবা আমাকে একটু শক্ত করে? তোমার বুকে মাথা রেখে একটু নিশ্বাস নিতে দাও।’ শিহাব তখন দুহাতে জড়িয়ে ধরে প্রীতিকে।

‘ওয়াও ওয়াও’ করে কেঁদে উঠে শিহাবের সদ্য জন্মানো বাচ্চাটা। দুহাতে বাচ্চাটাকে আলতো করে কোলে তুলে নেয় শিহাব। বাচ্চাটা শান্ত হয়ে যায় তখন। শিহাব চোখ মুছে বাবার সামনে দাঁড়ায়, তারপর জড়ানো কণ্ঠে বলে,

-আমার বিশ্বাস ছিল বাবা, আমি তোমাদের ছাড়লেও একদিন ঠিকই তোমরা আমাকে কাছে টেনে নেবে। সেদিন তোমার দুটি কন্ডিশন থেকে যদি আমি তোমাদেরকেই বেছে নিতাম, তাহলে আমি কখনও প্রীতিকে পেতাম না। আমার এই সন্তানটাকেও আজ পেতাম না। তাই সেদিন আমি প্রীতির হাত ধরেছিলাম। কারণ বাবা তো সন্তানকে পর করতে পারে না। তুমিও নিশ্চয়ই আমাকে পর করবে না, একদিন না একদিন ঠিকই মেনে নেবে আমাদের, এই বিশ্বাসটুকু আমার ছিল। সেদিন প্রীতিকে তোমরা মেনে নিতে পারোনি। আজ আমার সন্তানটাকে কি একটু মেনে নেবে বাবা?’

-ওরে এভাবে বলিস নারে বাপ, আয় আমার বুকে আয়।’ বলেই ছেলেকে জড়িয়ে ধরে শিহাবের বাবা। শিহাবের চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়তে লাগলো প্রীতির হাতের উপর।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত