বাস স্টপ

বাস স্টপ

-আপনি বারবার হাতে কি দেখছেন?
-ঘড়ি দেখছি।
-কিন্তু আপনার হাতে তো ঘড়ি নেই।
-আমার হাতে তো সময়ও নেই।

ছেলেটির কাছ থেকে এই উত্তর পেয়ে কিছুটা হকচকিয়ে গেলাম। যাত্রী ছাউনিতে আমার পাশেই বসা ছিল ছেলেটি। হাতে ঘড়ি না থাকা সত্বেও বারবার হাত টা ওইভাবে দেখার জন্য কৌতুহলী হয়ে প্রশ্ন টা করলাম। এমন অদ্ভুত উত্তর শুনে হেসে দিলাম। হাতে ফাইল। হয়ত সার্টিফিকেট ভর্তি। জিজ্ঞেস করলাম

-কোথায় যাচ্ছেন? ইন্টার্ভিউ?
-হ্যা।
-এই নিয়ে কতগুলি ইন্টার্ভিউ দিলেন?
-বেশি না। মাত্র ২০ বার দিয়েছি।
-কি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন?
-এম.এ
-গ্রেট

এরপর ছেলেটা একটা হাসি দিয়ে সামনে তাকিয়ে রইলো। আমি আর কথা বাড়াই নি। ছেলেটার নাম জানতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তার কথা বলায় তেমন একটা আগ্রহ নেই দেখে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো না। আর তাছাড়া ইন্টার্ভিউ এর আগে দুশ্চিন্তা তো হবেই। ওই ছেলেটির হয়ত চোখ ভরা স্বপ্ন ছিলো। একটা ভালো চাকরী, ছয় সাত ডিজিটের বেতন না হলেও মোটামুটি চলে যায় এমন বেতন পাওয়া যায় এমন চাকরী। মনে হচ্ছে আমার মত আরো একটি স্বপ্ন ভেঙে যাবে। ছেলেটির খালি হাতে বারবার সময় দেখার জন্য আর অমন একটি অদ্ভুত জবাব দেবার জন্য ছেলেটির কথা আমার অনেক দিন মনে রয়ে গেল। আরেকদিন দেখা হলে জিজ্ঞেস করবো তার ২১ তম ইন্টার্ভিউ সফল হয়েছে কিনা।

-জ্বি ম্যাম অর্ডার প্লিজ।
-দুই টা কোল্ড কফি।
-ওকে ম্যাম।

অর্ডার টা লিখে নিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন ই নজরে পড়লো কেউ একজন রেস্টুরেন্ট এর বাইরে বসে আছে। মালিকের কড়া নির্দেশ কোনো ভিখারি টাইপের লোক যেন রেস্টুরেন্ট এর বাইরে বসে না থাকে।

-ও ভাই একটু অন্যখানে গিয়ে বসুন। ছেলেটা তাড়াহুড়া করে উঠতে উঠতে বলল
-জ্বি জ্বি উঠছি। ছেলেটাকে দেখে চিনতে ভুল হলো না। এটা বাস স্টপে দেখা হওয়া সেই ছেলেটা।
-আরে আপনি? চিনতে পেরেছেন?
-না তো। আপনি কে? চিনতে না পারাই স্বাভাবিক। বললাম..

-ওইযে বাস স্টপে দেখা হয়েছিলো। আপনার হাতে ঘড়ি না থাকা সত্বেও ঘড়ি দেখছিলেন। এরপর আমি সেটা জিজ্ঞেস করার পর উত্তরে বলেছিলেন আপনার হাতে সময়ও নেই। মনে পড়েছে? প্রশ্নটা করার পর ছেলেটা কেমন একটু লজ্জা পেলো বলে মনে হলো।

-আসলে ভাই হাতে ঘড়ি পড়া আর বারবার সময় দেখার অভ্যাস তো। সেদিন তাড়াহুড়া করে ঘড়ি পড়ে যাই নি। তাই আরকি ভুল করে. ..
-আচ্ছা ঠিক আছে। বুঝতে পেরেছি। ভেতরে এসে বসুন। আগের টেবিলে কোল্ড কফি টা দেওয়ার পর ছেলেটির সামনে এসে বসলাম।
-তুমি করে বলতে পারি তো?
-হ্যা। অবশ্যই।
-এবার বলো সেদিনের চাকরী টা হয়েছিলো? এরপর ছেলেটা হাসলো।
-সেদিনের চাকরী টা হয়ে গেলে কি এখনো ফাইল হাতে ঘুরতাম? টেবিলে রাখা ফাইলের দিকে চোখ গেলো।

-এত রাতে ইন্টার্ভিউ দিয়ে ফিরলে নাকি?
-আরে নাহ। ইন্টার্ভিউ তো সেই কখন শেষ হয়েছে।
-তাহলে এখনো বাসায় ফিরোনি কেন?
-আসলে এবারো চাকরী টা হবে বলে মনে হচ্ছে না। বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করছে না।
-কফি খাবে? ছেলেটা একটু ইতস্তত স্বরে বলল
-সারাদিন কিছু খাই নি। খালি পেটে কফি…
-আচ্ছা তুমি বসো। আমি অন্য একটা দোকান থেকে ওর জন্য কিছু খাবার নিয়ে আসলাম। ও সেসব দেখে বলল

-এসবের কি দরকার ছিল?
-খাও তো।

ও আমার সামনে গোগ্রাসে খাচ্ছে। আমি সামনে বসে ওর খাওয়া দেখছি। কারোর খাওয়ার সময় সামনে বসে থাকা ঠিক না। কিন্তু তারপর ও আমার এই চেয়্যার টা ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করলো না। রেস্টুরেন্ট এ আপাতত কোনো কাস্টমার নেই। ওয়ার্ক আওয়ার ও শেষ। একটু পরেই বের হবো।

একজন কে বাইরের থেকে খাবার এনে রেস্টুরেন্টে বসিয়ে খাওয়ানো জন্য ম্যানেজারের কাছ থেকে অনেক বকা শুনতে হলো। কিন্তু একজন এত তৃপ্তি নিয়ে খেয়েছে এটা ভেবেই ভালো লাগছে। আমি ম্যানেজার কে মাথা নিচু করে স্যরি বললাম। আর যেন এমন টা না হয় তার জন্য সতর্ক করলেন আমাকে। ও আর আমি সেদিনের মত যাত্রী ছাউনিতে বসে আছি। সেদিনের মত আজকে ওর হাত খালি ছিলো না। হাতে খুব সুন্দর একটা ঘড়ি। কিন্তু মজার বিষয় ও আজকে একবারও ঘড়ির দিকে তাকায় নি। হেসে জানতে চাইলাম

-আজকে একবারও ঘড়িতে সময় দেখলে না। ব্যাপার কি? ও বলল
-আজকে আমার হাতে অফুরন্ত সময়। তাই এখন কত সময় হলো তা না জানলেও চলবে।
-বাসায় চলে যাও। বাসার সবাই চিন্তা করছে হয়ত।
-হু

ছেলেটি বাসে চড়ে চলে যাওয়ার পর হঠাৎ মনে হলো আজকেও ছেলেটির নাম জানতে চাওয়া হয় নি। আবার কখনো দেখা হবে কিনা কে জানে!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত