শাস্তি

শাস্তি

অদ্ভুত অদ্ভুত সব শাস্তির জন্য আমার মা কে আমি ভীষণ ভয় পাই। তবে এটা সত্যি আমার মা আমার গায়ে কোনোদিন হাত তুলে নি এমনকি কোনো আঘাত পর্যন্ত করেন নি। একবার আমার এক ক্লাসমেটের পানির বোতল স্কুলের পাশের ড্রেনটায় ফেলে দিয়েছিলাম। সে এসে আমার মায়ের কাছে বিচার দিয়েছিলো। আমি ভয়ে ভয়ে ছিলাম হয়ত আমাকে মারধোর বা বকাবকি করবে। কিন্তু নাহ, আমার ধারণা কে ভুল প্রমাণিত করে মা ওকে জিজ্ঞেস করেছিলো

-তোমার পানির বোতলটার দাম কত ছিলো খোকা?
-২০০ টাকা।

আমি তখন প্রতিবাদ করে বলতে চাইলাম ওইটা মোটেও ২০০ টাকা না। ৫০ টাকা করে ওইরকম বোতল পাওয়া যায়।
কিন্তু মা আমাকে থামিয়ে দিলেন। পরেরদিন স্কুল থেকে এসেই মায়ের কাছে খাবার চাইলাম। মা আমাকে খাবার না দিয়ে বলল

-জামা টা পাল্টে নাও।
-আমরা কি কোথাও যাচ্ছি মা?
-হ্যা।
-কোথায়?
-তোমার রিয়াজ চাচ্চুর হোটেলে।

আমি তো মনে মনে ভীষণ খুশি। আজকে বাইরে খাবো এই ভেবে। কিন্তু হোটেলে যাওয়ার পর মা যা বললো তাতে আমার চোখের সামনে সব কিছু অন্ধকার দেখতে লাগলাম।

-রিয়াজ ভাই ভালো আছো তো?
-হ ভাবি। আপনি আর অভ্র এইখানে? বসেন বসেন। আমার হোটেলের খাবার একবার খাইলে আর ভুলতে পারবেন না।

-না ভাই। খাওয়ার জন্য আজ আসিনি। আমার ছেলেটাকে তোমার দোকানে এক মাসের জন্য কাজে রাখতে হবে।রিয়াজ চাচ্চু আর আমি দুইজনে হা করে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

-কি বলেন ভাবি? ভাইয়ের তো খুব ভালো ইনকাম । নিজেদের বিশাল বড় বাড়ি। নিজের ছেলেকে হোটেলে কাজে দিচ্ছেন। তাও আবার ১১/১২ বয়স ওর।

-আমি যেটা বলছি সেটাই হবে ভাই। আর এই মাসের জন্য তুমি ওকে ২০০ টাকা বেতন দিবে। তোমার তো হোটেল বয়ের দরকার হয়। ওকে সেই কাজ টাই নাহয় দাও। আমাকে তো তুমি নিজের বোন বলেই ভাবো। বোনের আবদার টুকু রাখো।

-ভাবী, আপনার জন্যে আজ এই দোকান দিতে পারছি। আপনি যা বলবেন তাই হবে। আর ওকে নাহয় ৫০০ টাকাই দিবো।

-না ভাই। ২০০ ই হবে। আর দুপুরের খাবার টা ওকে খাইয়ে দিও। বাসা থেকে খেয়ে আসেনি।

মায়ের এই দরদ দেখে আরো বেশি অভিমান হলো। মনে মনে বলছিলাম ‘আমার খাওয়া নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না।’ এরপর টানা একমাস আমি রিয়াজ চাচ্চুর হোটেলে কাজ করি। স্কুল থেকে ফিরেই হোটেলে চলে যাই। হোটেল থেকেই দুপুরের খাবার দেওয়া হতো। খুব অসহায় লাগতো তখন। মা সবসময় নিজের হাতে খাইয়ে দিতো। সেদিন থেকে নিজের হাতে খাবার খাওয়া শিখে ছিলাম। বাসন কোসন ধোয়া থেকে শুরু করে কাস্টমারের খাবারের অর্ডার নেয়ার কাজ গুলি আমি করতাম। এরপর অর্ডার মত খাবার টেবিল গুলিতে পৌঁছে দিতাম। পরিচিত কেউ যখন আমাকে দেখে বলতো

-আরে ও রায়হান সাহেবের ছেলে না?? এতটুক ছেলেরে হোটেলের কাজ করাইতাসে!!! নিজেগো এত বড় বাড়ি থাকতে বাচ্চা মানুষরে দিয়া হোটেলের কাম করাইতাসে!! ছি ছি! তখন লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে মন চাইতো। অপমানে চোখে পানি এসে যেত। চোখের পানি মুছে অন্য টেবিলের অর্ডার নিতে চলে যেতাম। মাস শেষে রিয়াজ চাচ্চু আমার হাতে ২০০ টাকা দিলো। আমার চোখে আবার জল এসে গেলো। খুশি মনে হাত পেতে ২০০ টাকা নিলাম। আনন্দে দৌড়াতে দৌড়াতে বাসায় আসলাম। আমার জীবনের প্রথম কামাই। বাসায় ঢুকেই মাকে চেঁচিয়ে বলতে লাগলাম,

-মা দেখো আমার প্রথম কামাই। রিয়াজ চাচ্চু আমাকে ২০০ টাকা দিয়েছে। মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। আমি ঠিক করে নিলাম এই টাকা আমি কোনোদিন খরচ করবো না। এটা আমি সারাজীবন যত্ন করে রাখবো।জীবনের প্রথম কামাই বলে কথা!!

-আজকে তোমার সেই বন্ধু টাকে বাসায় আসতে বলবে যার পানির বোতল তুমি ফেলে দিয়েছিলে। আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম
-কেন মা?
-সে আসলেই বুঝতে পারবে।

মনের মধ্যে একটা ভয় ঢুকে গেল। আমার উপার্জনের টাকা কি ওকে দিয়ে দিবে এই ভেবে! সেই বন্ধু টা আসার পর আমার ই চোখের সামনে আমার মা আমার কামাই করা ২০০ টাকা ওর হাতে তুলে দিলো। কতটা কষ্ট করেছি এই টাকার জন্য। আমার পুরো এক মাসের কষ্টের ইনকাম ওকে তুলে দিলো। আমার মনে হচ্ছিলো এর চাইতে আমার হৃদপিণ্ড টা খুলে দিয়ে দিলেও আমার এতটা কষ্ট হতো না।

-কই গো নবাবপুত্তুর? ঘুম কি ভাঙলো?? এখন বাজারে না গেলে বাজারে কি তাজা সবজি পাওয়া যাবে??

সারারাত ঠিক মত ঘুমাতে পারি নি। আমার নিজের সেই বিছানা, কোলবালিশ ফেলে এসে অন্য একটা বিছানায় ঠিক মত ঘুম ও আসে না। এপাশ ওপাশ করেই রাত টা কাটিয়ে দিয়েছি। সকালের দিকে যাও চোখ টা লেগে এসেছিলো তখন ই শাশুড়ির ডাকাডাকি। সবসময় মেয়েরা শশুড়বাড়ি যায়। আমার ক্ষেত্রে উল্টো। বিয়ের তিন মাসের মাথায় আমাকে আমার মা শশুড় বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। ঘুম ঘুম চোখে বাইরে এসে দাঁড়ালাম।

-কি হয়েছে মা? শাশুড়ি মা একটা থলে ধরিয়ে দিয়ে বললেন
-কি কি আনতে হবে লিস্ট থলে তে রাখা আছে। গিয়ে নিয়ে আসো।

এই মহিলা কে আমার একদম অচেনা মনে হচ্ছে। আমার জীবনে এত মমতাময়ী মহিলা আমি দেখিনি। কিন্তু উনার এই রূপ দেখে আমি অবাক হওয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে এসেছি।

-কি হলো? ভাবছো কি? যাও।
-হ্যা হ্যা যাচ্ছি।

সকালে অফিসের জন্য বের হচ্ছি। কিন্তু হাতের কাছে কিছু পাচ্ছি না। ওদিকে রিয়া নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। এমন রাগ হলো যে ওকে ঘুম থেকে তুলে ঠাস করে থাপ্পড় লাগিয়ে দিলাম। মেয়েটা অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আমি ওকে অনেক কথা শুনাচ্ছি ও কোনো জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করে রইলো। মা আমার চেঁচামেচি শুনতে পেয়ে রুমে চলে আসলেন। পুরো ঘটনা শুনতে পেয়ে মা বলল

-তুই অযথাই রাগ করছিস। নতুন ঘর বাড়ি, একটু মানিয়ে নিতে সময় তো লাগবেই। সারাদিন তো কত কাজ ই করে মেয়েটা।

-এই বাড়িতে কোনো কিছুর অভাব আছে?? এরকম বাড়ি জীবনে থাকার কথা চিন্তা করেছে ও। আমার ঘুম ভেঙে যায়। আর ও নবাবজাদির মত ঘুমাতে থাকে। কি এমন কাজ করে শুনি? এরপর মা ঠাণ্ডা গলায় বলল

-আজকে অফিস থেকে এসে ব্যাগ গুছিয়ে নিও। ছোটবেলার মত অবাক হয়ে জানতে চাইলাম
-কেন মা? আমরা কি কোথাও যাচ্ছি?
-আমরা না। তুমি এক মাসের জন্য তোমার শশুড় বাড়িতে বেড়াতে যাবে। রিয়া বলল
-আমিও যাবো মা?
-না। অভ্র একা যাবে।

আমার ছোটবেলায় এক মাস হোটেলে কাজ করার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। বাজারের থলে হাতে নিয়ে শশুড় বাড়ির পথে রওনা দিয়েছি। মনে মনে এই এক মাসে কি কি কাজ শিখেছি তা ভাবছি। ঘর পরিষ্কার করা, কাপড় ধোয়া, অনেক পদের রান্না করা প্রায় সব ই শিখে ফেলেছি। মনে হতে লাগলো এই কাজ গুলি তো রিয়াও আমাদের জন্য করে। ওর ও নিশ্চয়ই এমন ই হয়। দম ফেলবার ফুসরত হয় না। নাহ, এরপর থেকে ওর সাথে কখনো বাজে ব্যবহার করবো না। নিজের আপন বাড়ি ছেড়ে ও অন্য একটা বাড়ি তে এসে থাকছে।

নিজেকে কেমন যেন এই বাড়ির কাজের লোক বলে মনে হতে লাগলো। আমার শশুড় শাশুড়িও আমাকে দিয়ে ভালোই কাজ করিয়ে নিয়েছেন। আজ এক মাস পর নিজের বাড়িতে ফিরে আসছি। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। নিজের বাড়ি ছাড়া অন্য একটা বাড়িতে গিয়ে শান্তিতে একটু ঘুমাতেও পারিনি। তার উপর শশুড় বাড়ির লোকেদের এমন ব্যবহার আমার সহ্য হচ্ছিলো না। শুধু ভাবছিলাম কবে এক মাস শেষ হবে আর বাসায় ফিরে আসবো। কলিংবেল প্রেস করে দাঁড়িয়ে আছি। আম্মু এসে দরজা খুলল। আমাকে দেখে আম্মুর তেমন কোনো উচ্ছ্বাস দেখলাম না। মা আমার পায়ের দিকে তাকিয়ে বলল

-জুতার একি অবস্থা করেছো? কাদা মেখে একাকার অবস্থা। কাল থেকে এক মাস জুতা পড়বে না।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত