আমাকে জোর করে বিয়ে করানোর জন্য মেয়ে খুঁজছে বাবা-মা।শুনেছি একটা মেয়ে নাকি পেয়েও গেছে কিন্তু এখন আমি বিয়ে করতে একদম ইচ্ছুক না তাই আজ বাড়ি থেকে পালিয়েছি।শেষমেশ বন্ধু সাজ্জাদের সাথে চলে এলাম ওদের গ্রামের বাড়ি। অপরিচিত জায়গায় হুট করে চলে এসেছি তাই রাতে ঘুম আসছিলো না তাই কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টেরই পাইনি। গভীর রাতে সাজ্জাদ আমাকে টেনেটুনে উঠে বসিয়ে বললো, “চল আজ খেজুরের রস চুরি করবো।আমি আগামাথা কিছু না বুঝেই চুপিচুপি ওর সাথে চলতে লাগলাম।
একটুপরে সাজ্জাদ গাছে উঠে প্রায় এক হাঁড়ি ছোঁয়া ছোঁয়া খেজুরের রস নামালো। বাহিরে প্রচন্ড শীত তাঁর উপর ঠান্ডা খেজুরের রস খেয়ে মনে হচ্ছিলো আমি যেনো ঠান্ডায় জমে যাচ্ছি তাই খুব দ্রুত বাড়ি ফিরে লেপের নিচে ঢুকে দিলাম এক ঘুম। যখন ঘুম থেকে উঠলাম তখন দেখলাম বেশ সকাল হয়ে গেছে। দাঁত ব্রাশ করতে করতে সাজ্জাদের সাথে একটু হাঁটতে বের হলাম। ফসলি জমির আল বেয়ে আমরা হাঁটতে লাগলাম। দুইপাশে ধানক্ষেত। জায়গাটা সত্যিই মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। আমরা বিভিন্ন কথা বলছি আর হাঁটছি।পিছনে একটা মেয়ে দুইটা ছাগল ছানা নিয়ে হাঁটছে তবে মেয়েটার চেহারা ওতটা খেয়াল করিনি।
একটুপরে হঠাৎ মনে পড়লো রাতে চুরি করে খাওয়া খেজুরের রসের কথা।আমি জোরে জোরে বলেই ফেললাম,
বুঝলি সাজ্জাদ খেজুরের রসটা জোশ ছিলো।আজ রাতে আবারো চুরি করবো। আমার কথা শুনেই মেয়েটা জোরে জোরে হেঁটে সাজ্জাদের সামনে এসে বললো, তাহলে আপনারাই কাল রাতে আমাদের খেজুরের রস চুরি করে খেয়েছেন! আমি এক্ষুনি বাবাকে গিয়ে বলতাছি। মেয়েটার কথা শুনে সাজ্জাদ ভয় পেয়ে বলে উঠলো, চাচাকে বলিস না তপতী, তাহলে আমার মানসম্মান শেষ হয়ে যাবে।আর কখনো তোদের গাছের খেজুরের রস চুরি করবো না। আমি হঠাৎ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, মেয়েটা দেখতে খুব সুন্দর। জোর ভ্রু,লম্বা চুল আর গোল চেহারায় মেয়েটাকে দেখতে অপূর্ব লাগছে। আমি ওদের কথোপকথনে কান না দিয়ে ডাইরেক্ট মেয়েটাকে বলে ফেললাম, “আপনি কিন্তু দেখতে খুব সুন্দরী, একেবারে পরীর মতো।”
আমার কথা শুনে মেয়েটা রেগে আমার দিকে তাকালো। তবে লজ্জায় যে তার চেহারা লাল হয়ে গেলো সেটা আমার চোখ এড়ালো না। মেয়েটা আমার কথা শুনে আর সেখানে এক সেকেন্ডও দাঁড়ায়নি, একদৌড়ে এখান থেকে চলে গেলো। আমার এমন কান্ড দেখে সাজ্জাদ আমাকে বকতে লাগলো। আমি ওকে বললাম, “তুই ভয় পাস কেন? এ কথা ও কখনোই ওর বাবাকে বলবে না।” হলোও তাই। কেউ আর সেদিন বিচার নিয়ে আসেনি।তবে মেয়েটার চেহারা আমার মনে গেঁথে গিয়েছিলো তাই সেদিন কয়েকবার তাদের বাড়ির আশেপাশে টহল দিয়েছিলাম। দুইবার মেয়েটার দেখাও পেয়েছি তবে সে আর সামনে আসেনি,আমাকে দেখা মাত্রই সে ঘরের ভিতর ঢুকে যেতো। বিকেলে সাজ্জাদ হাঁটে গেলো কিন্তু আমার যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল না তাই আমি ক্যামেরা নিয়ে বের হলাম কিছু ছবি তোলার জন্য।
হাঁটতে হাঁটতে একেবারে খাল পাড়ে চলে এলাম।ছবি তুলতে তুলতে হঠাৎ কতগুলো গরুর গোবরের মধ্যে পা পিছলে পড়ে গেলাম। সাঁতার জানি না বিধায় খালেও নামতে পারছিলাম না আবার কেমন যেনো বিদঘুটে গন্ধে বমি আসতে লাগলো।পড়ে গেলাম মহাবিপদে।এরমধ্যে হঠাৎ কতগুলো মেয়ের দল কলসি ভরে পানি নিয়ে তাদের বাড়ির দিকে যাচ্ছিলো। আমাকে এ অবস্থায় দেখে তারা প্রচন্ড রকম হাসতে লাগলো। এরমধ্যে থেকে একটা মেয়ে এসে আমার পায়ে কলসি থেকে পানি ঢেলে দিলো আর আমি কোনরকম পা ধুয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।আসলে এই মেয়েটা ছিলো সেই সকাল বেলার তপতী। এবার আর মেয়েটাকে কিছু বলতে পারিনি এমনকি থ্যাংকস ও না।অতঃপর মেয়েরা তাদের বাড়ির দিকে হেঁটে চলে গেলো।
বিকেলের পর থেকে কেন যেনো মেয়েটার প্রতি আমার ব্যাপক ভালো লাগা সৃষ্টি হলো। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে দেখলাম সবাই উঠোনে আগুন জ্বালিয়ে তার পাশে বসে আছে।আমিও হাত পা গরম করার জন্য সেখানে গিয়ে দাঁড়ালাম। তপতী নামের মেয়েটাও সেখানে ছিলো,সে সাজ্জাদের বোন কুসুমকে ডাকতে এসেছে। হঠাৎ আমাকে দেখে সে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো।আমিও গিয়ে তাঁর পাশে দাঁড়ালাম। একটু পরে সাজ্জাদের ভাবী হাসতে হাসতে বলে উঠলো, “তপতী তো আজকাল বেশ সুন্দরী হয়ে যাচ্ছিস,ব্যাপার কি?” তপতী কিছু বলে না কেবল হাসে।পাশ থেকে আরেক ভাবী বলে উঠলো, ” সুন্দরী হবে না তো কি হবে? তপতী তো আজকাল বড় হয়ে যাচ্ছে কিছুদিন পর বিয়েও দিতে হবে।” এই বলে সবাই মজা করতে লাগলো। তাদের কথা শুনে আমিও হাসতে লাগলাম। হঠাৎ তপতীর দিকে তাকিয়ে বোকা হয়ে গেলাম কারণ এই প্রথম আমাদের চোখাচোখি হলো।
সাজ্জাদদের ধান মাড়াই করে বাড়ি থেকে একটু দূরে রাখা হয়েছে তাই আজ বিকেলে বাহিরে ওরা ছোট একটা ঘর বানালো আর ওখানেই আজ রাতটা ধান পাহারা দেয়ার জন্য থাকতে হবে।অবশেষে আমি আর সাজ্জাদ সেখানে গেলাম। বাহিরে ছিলো হালকা কুয়াশা। রাতে আর বাড়িতে খেতে গেলাম না বরং রাতে কুসুম আর তপতী খাবার নিয়ে এলো।তেমন কথা হলো না ওরা চলে গেলো। একটুপরে ওরা দুজন তপতীদের বাড়ি যাচ্ছিলো।কুসুম আজ ওর সাথে ওদের বাড়ি ঘুমাবে। আমার ব্যাপারটা কিভাবে যেনো সাজ্জাদ বুঝতে পারলো।সাজ্জাদ ওদের ডাক দিলো।সেদিন এই প্রথম সামনাসামনি কোনো মেয়ের সাথে আমার কথা হলো। সেদিন রাতে তপতীকে বলেছিলাম অনেক কথা।লাস্ট কথা ছিলো, “তপতী আমার অপেক্ষায় থাকবে তো?”
তপতী শুধু বলেছিলো, “হুম।” সেদিন তপতীকে বলেছিলাম, “ভুলে যেও না,আমি আবার যেদিন আসবো তোমাকে সাথে করে নিয়ে যাবো।এরকম একটা রাতে আমরা আবারো গল্পে মেতে উঠবো তবে সেদিন তুমি আর আমি একা থাকবো।” এটাই ছিলো তপতীর সাথে আমার শেষ কথা।সকালে হঠাৎ মা ফোন দিয়ে বললো, বাবা খুব অসুস্থ তাই সাথে সাথে চলে এলাম। তপতীর সাথে আর দেখা হয়নি। তারপর বাবা তাঁর কিছুদিন পর মারা গেলো।ধরলাম সংসারের হাল। ব্যস্ততার জালে জড়িয়ে সাজ্জাদের সাথেও তেমন একটা দেখা হতো না। শুনলাম ও নাকি বাহিরে চলে গেছে।আজ কেবল শুধু একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ফিরি আর সেটা হলো, “কেমন আছে সে?
সে কি আজো আমার অপেক্ষায় আছে?” এতটুকু বলেই থেমে গেলো সাজ্জাদ। উপরের ঘটনাটা এতক্ষণ সে বলছিলো তার নববিবাহিতা স্ত্রী সুচন্দাকে।সুচন্দা উৎপলের কথা শুনে এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, “এভাবেই আমাদের জীবন থেকে কিছু প্রিয় মানুষ অপেক্ষার স্রোতে হারিয়ে যায় তবে স্মৃতি হিসেবে গেঁথে রয় হৃদয়ের মাঝে।কিছুটা প্রকাশ পায় আর কিছুটা সারাজীবনের জন্য হৃদয়ের এক কোনে অপ্রকাশিতভাবেই স্থান করে নেয়।” অতঃপর বলা শুরু করলো সুচন্দা, তার জীবনের কাহিনি। সবার জীবনের একটা অতীত আছে আজ না হয় তাদের সেই অতীতের স্মৃতি মনে করেই রাতটা শেষ হোক! সংসার করার জন্য বাকি জীবন তো পড়ে-ই আছে।