এই গল্পের নাম নেই

এই গল্পের নাম নেই

জেল হওয়ার কিছুদিন পর সূচি জানতে পারলো সে মা হতে চলেছে।মা হওয়াটা সব মেয়ের কাছে আশীর্বাদ হলেও সূচির কাছে ছিল অভিশাপ।আবারও মনে পড়ে গেল সেই ভয়াল কালো রাত।বুকের ভিতর চিনচিনিয়ে উঠলো বাবার মত ভাই হারানোর ব্যথা।আর দুঃখিনী মায়ের সন্তান হারানোর আর্তনাদ।সূচি কোনভাবেই চায়না বাচ্চাটা এই পৃথিবীর মুখ দেখুক।জেলের এক কোণায় পড়ে থাকা সূচির আহাজারি ক্ষমতার কাছে ছিল মূল্যহীন।কার বাচ্চা ক্যারি করে চলেছে সূচি নিজেও জানেনা।নির্ঘুম রাত্রি যাপন করে চলেছে সূচি।

সূচির মা তার মেয়ের জামিনের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছে কিন্তু কোন লাভ হচ্ছে না।খুনের কেইসে এতো সহজে জামিন পাওয়া যায়না।সূচির পেটটা সময়ের সাথে সাথে বড় হচ্ছে।আর কিছুদিন পরেই তার সন্তান অনাকাঙ্খিত ভবিষ্যত নিয়ে আসবে।এই অসহ্য যন্ত্রণার চেয়ে মরে যাওয়া ভাল ছিল সূচির কাছে।সূচি রোজ রাতে কেঁদে কেঁদে বলতো,”ভাইয়া তুই কোথায় হারিয়ে গেলি?আমার খুব কষ্ট হচ্ছে রে।কেন আমার আর মায়ের জীবনটা ওলট-পালট হয়ে গেল?তুই এসে সব ঠিক করে দে।তুই যে আমার শক্তি ছিলি ভাইয়া।”

সূচি মা হয়ে গেল।বাচ্চাটার দিকে অদ্ভুদ চোখে তাকিয়ে আছে সূচি।ও কার মত দেখতে হলো?!!!তোর বাবা কে রে সোনা?তোকে তো আমার কাছে জেলে রাখতে পারবো না।তোকে দেখে আমার খুশি হওয়ার কথা কিন্তু কেন খুশি হতে পারছি না বল তো বাবা?!!! পরেরদিন সূচির মা জেলখানায় এসেছিল।সূচি তার ছেলেকে মায়ের কোলে দিয়ে বললো ওকে যেন কোন অনাথ আশ্রমে রেখে আসে।সূচির মা বাচ্চাটিকে নিজের কাছে রাখতে চেয়েছিল কিন্তু ঐদিনই গাড়ি দুর্ঘটনায় বাড়ি ফেরার পথে তিনি মারা যান।আর বাচ্চাটি রাস্তার পাশে আহত অবস্থায় পড়ে থাকে।

এইদিকে সূচি ছেলের জন্য অনবরত কেঁদেই চলেছে।শত হলেও দশমাস তার গর্ভে ছিল।নারী-ছেঁড়া ধন যে কি তা ঐ মা-ই একমাত্র জানে।দশদিন পর খবর এলো সূচির মা এই পৃথিবীতে আর নেই।আর তার ছেলের খোঁজও কেউ জানেনা।সূচি এরকমটা শোনার জন্য কখনোই প্রস্তুত ছিলনা।তাকে কেউ খবর দিতে পারেনি কারণ সূচিকে অন্য জেলে ট্রান্সফার করা হয়েছিল।মৃত মায়ের মুখটা দেখারও সুযোগ হয়নি।বিধাতা এতো দুঃখ কেন তার ভাগ্যে লিখে রেখেছিল?!!!তার ছেলেকে কি রাস্তার কুকুর ছিঁড়ে খেয়ে ফেলেছে?নাকি ডাস্টবিনের ময়লার সাথে কোথায় ফেলে দেওয়া হয়েছে??এসব চিন্তায় সূচি পাগল হয়ে যাচ্ছিলো। মধ্যরাতে চিৎকার করে সূচি কেঁদে উঠে।এতে অন্য কয়েদিদের সমস্যা হয়।সখিনা নামের একজনের সাথে সূচির ভাল বন্ধুত্ব হয়।তাকে সূচি তার এই করুণ পরিণতির কথা খুলে বলে।

ওরা চারজন ছিল।তার মধ্যে একজন প্রভাবশালীর ছেলে।আমার কলেজ থেকে ফিরতে সেদিন রাত হয়ে গিয়েছিল।কারণ রাস্তায় বাস নষ্ট হয়ে যায়।আমাকে রাস্তায় একা পেয়ে ওরা চারজন একের পর এক হামলে পড়েছিল সেদিন।আমার চিৎকার সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছায়নি।কেউ বাঁচাতে আসেনি।ওরা আমার মুখ বেঁধে নির্জন জায়গায় নিয়ে যায়।সকাল বেলা যখন জ্ঞান ফিরলো আমার তখন চারপাশে অনেক লোক আমাকে দেখছিলো।কিছু সাংবাদিক আমার ছবি তুলছিলো।একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছিলো।কি বিশ্রী সেই প্রশ্নগুলো?ওদের তো হেডলাইন বানাতে হবে।সেখানে বড় করে ছাপানো হবে “কলেজছাত্রী গণধর্ষণের শিকার”।কি লজ্জা!কি লজ্জা!!সেদিন ট্রেনের নিচে মাথা দেওয়ার কথা না ভেবে দোষীদের শাস্তির জন্য তৎপর হই আমি।

আমাকে সাহস দিয়েছিল আমার ভাইয়া ইমন।ওরা যখন বুঝতে পারলো ওদের পালানোর পথ নেই তখন নানা ভাবে ভাইয়া আর আমাকে চাপ প্রয়োগ করতে থাকে।ওদের ক্ষমতার কাছে হার মানতে চায়নি আমার ভাইয়া।তাই রাস্তায় ওরা চারজন আমার ভাইয়াকে কুপিয়ে মেরে ফেললো।যাকে আমি সবচাইতে বেশি ভালোবাসতাম সেই ভাইয়ার রক্তাক্ত মুখ আমি সহ্য করতে পারিনি।সেই প্রভাবশালীর ছেলেকে আমি নিজ হাতে দা দিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলেছিলাম।আমার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল।নিজের মধ্যে ছিলাম না আমি।বাকি তিন নরপশু ভয়ে পালিয়েছিলো।ঐ ছেলের বাবার জন্য আমার জেলখানায় একজন গর্ভবতী হিসেবে যে বেসিক ফ্যাসিলিটি পাওয়ার কথা ছিল সেগুলো থেকে বঞ্চিত হয়েছি।নিজের মা আর ছেলেকে হারিয়ে ফেলেছি!!!

চৌদ্দ বছর পর সূচি জেল থেকে ছাড়া পেয়ে যায়।জীবন থেকে বহু মূল্যবান সময় হারিয়ে গেলেও হার মানেনি সূচি।জীবনটা নতুন করে গুছানোর চেষ্টা করেছে।বহু বছর পার করে সে একজন সাবলম্বী। প্রবণীনের খাতায় তার নাম চলে এসেছে।আজও সে মনে মনে তার ছেলেকে খুঁজে বেড়ায়।ছুটির দিনগুলোতে এতিমখানায় গিয়ে গিয়ে অনেক খুঁজেছে তার ছেলেকে।আজ সে ক্লান্ত!বড়ই ক্লান্ত!!

আর অপর দিকে সূচির ছেলে বেঁচে ছিল।একটা সন্তানহীন পরিবারের কাছে গিয়ে পড়ে।সূচির ছেলে আজ নামকরা ডাক্তার।দুইজন আজ দুই প্রান্তের বাসিন্দা।একদিকে ভালোই হয়েছে ছেলেটা সমাজে একটা মা-বাবার পরিচয় পেয়েছে।নইলে রাস্তার ছেলে,জারজ এসব শুনে শুনে বড় হতে হতো।মরার আগে প্রতিদিন মরতো। মা আর ছেলের মিলটা কিভাবে করানো যায় তার কোন সূত্রই লেখকের কাছে জানা নেই।আল্লাহ চাইলে একদিন না একদিন মা-ছেলের নিশ্চয় দেখা হবে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত