ইভটিজিং

ইভটিজিং

আমার প্রথম বাচ্চা সবে হয়েছে। ঢাকার সেন্ট্রাল হাসপাতালে গিয়েছি বাচ্চার চিকিৎসার জন্য। সেখানকার এক ডাক্তার নিয়মিত আমার বাচ্চাকে দেখতেন। ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল। সেন্ট্রাল হাসপাতাল থেকে হাঁটতে হাঁটতে সাইন্স ল্যাবের সামনে চলে এসেছি, সি এন জি পাচ্ছি না। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছি, সি এন জির দেখা নাই।তখন তো আর পাঠাও, উবার ছিল না, সি এন জি ভরসা। উপায় না দেখে স্ত্রী বললো, চল পাবলিক বাসেই উঠা যাক।সাইন্স ল্যাব থেকে বাসে উঠলাম, জুরাইন আসবো। বাসে উঠে দেখি শুধুমাত্র একটা সিট ফাঁকা। স্ত্রী বললো, তুমি বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বস।

এই গরমে বোরকা পরা অবস্থায় বাচ্চা কোলে নিয়ে বসা বেশ কষ্টকর। আমি তাই করলাম। স্ত্রী দাঁড়িয়ে রইলো। এখন কিছু কিছু বাসে ফ্যান আছে, তখন ছিল না। বাস শাহবাগ আসলে একলোক বাসে উঠলো। লোকটা আমার মুখ চেনা। একটা অফিসে দুই একবার দেখা হয়েছে, কথা হয়নি। সে এসে আমার স্ত্রীর পাশে এসে দাঁড়াল।ইচ্ছে করলে একটু ফাঁকা হয়ে দাঁড়াতে পারতো।বাসে ততটা ভীড় নয়,দুই চারজন যাত্রী দাঁড়িয়ে আছে। অনেকটা গা ঘেষে দাঁড়াল। গাড়ি একবার ব্রেক কষলো, এই সুযোগে সে আমার স্ত্রীর গায়ে এসে পড়লো।স্ত্রী কিছুটা সরে আসলো।

মৎস্য ভবনের সামনে এসে হঠাৎ কিছু বুঝে উঠার আগেই লক্ষ করলাম স্ত্রী সেই লোকটাকে কিল ঘুসি মারছে। আমি হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম। লোকটাকে এক নাগাড়ে চড় মেরেই যাচ্ছে, লোকটা কোন কথা বলছে না। অবশেষে বাধ্য হয়ে লোকটা বাস থেকে নেমে গেলো। বাস ঝাঁকুনির সুযোগে সে দুইবার স্ত্রীর গায়ে হাত দিয়েছে। স্ত্রী যখন চড় মারছিল, লোকটার সাথে আমার চোখাচোখি হয়ে গেল। লজ্জায় আমি কিছু বলতে পারছিলাম না। তাকে আমি ভালো লোক বলেই জানি।

বাসের লোকজন সবাই হতভম্ব হয়ে বসে ছিল। লোকটা নামার পর শুরু হলো নানা গুঞ্জন। আমিও স্ত্রী বাচ্চাসহ নেমে গেলাম। আমি ইচ্ছে করলে তার অফিসে জানাতে পারতাম। রুচি হয়নি। তার অফিসে আর যাইনি।তার মুখোমুখি হতে ঘৃণা লেগেছে। লোকটা ছিল বয়সে আমার চেয়ে অনেক বড়।কোন এক বিচিত্র কারণে লোকটার জন্য আমার মায়া লাগছিল। এই অপমানের কথা কি সারাজীবন সে ভুলতে পারবে? সে হয়তো কারও না কারও সম্মানিত বাবা,মামা,চাচা!

বিয়ের আগে একবার আমার ছোট বোন বললো সে ঢাকা ইউনিভার্সিটি এলাকা ভালো করে ঘুরে দেখতে চায়।সে কখনো দেখেনি।আমি তাকে নিয়ে গেলাম। কাজী নজরুল ইসলামের কবর দেখালাম।শহীদ মিনারে নিয়ে গেলাম। চারু কলায় দুই ভাইবোনে ফুসকা খেলাম।টিএসসিতে বসে চা খেলাম। তাকে নিয়ে গেলাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যান দেখাতে।দূপুর সময় লোকজন কম।কিছুটা ফাঁকা বলা যায়। অনেকক্ষণ হাটাহাটি করার পর এক জায়গায় বসলাম। সে ক্লান্ত হয়ে গেছে। অদূরে এক লোক হেঁটে হেঁটে পানির বোতল বিক্রি করছে। তখন পানির বোতল বালতিতে চুবিয়ে রেখে বিক্রি করতো যাতে পানি ঠান্ডা থাকে। আমি পানির বোতল আনতে গেলাম।

চারটা ছেলে বোনের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল।সম্ভবত ভার্সিটির পোলাপান।একটা ছেলে ঝালমুড়ি খাওয়া উচ্ছিষ্ট ঠোংগা বোনের গায়ে ছুঁড়ে মারলো। বোন প্রতিবাদ করাতে একটা ছেলে কুৎসিত গালি দিয়ে বসলো। আমি দূর থেকে দৃশ্যটা দেখে দৌড়ে এলাম। কাছে গিয়ে কারন জানতে চাওয়া বাকি আমার দিকে তাদের তেড়েমেরে আসতে বাকী নাই। বুঝলাম অবস্থা সুবিধাজনক নয়।আমি নিশ্চুপ হয়ে গেলাম। বোন পরিস্থিতি বুঝে আমাকে হাত ধরে টেনে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেলো। আমি পিছন ফিরে চাইলাম।একটা ছেলে চিৎকার করে বললো, মালটা তো ভালোই পাইছস, চালিয়ে যা!!

গায়ে আগুন ধরে গেলো। বোন দুই হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখলো। আমি নিশ্চিত,যদি আমার হাতে একটা পিস্তল থাকতো, চার জনকেই মেরে ফেলতাম! ফিরে আসার সময় দুই ভাইবোন একটা কথাও বলতে পারিনি।লজ্জায় ঘৃনায় মরে যেতে ইচ্ছে করেছিল। আমি জানি ছোট বোন লজ্জায় ভিতরে ভিতরে অনেক কেঁদেছিল! ছোট বোনের বিয়ে হওয়ার আগ পর্যন্ত সে আর আমার সাথে বাইরে বের হতে চায়নি।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত