সাংঘাতিক ক্লেপট্যামোনিয়া

সাংঘাতিক ক্লেপট্যামোনিয়া

আমি আর আমার স্ত্রী রুপা দুজনই পুলিশ স্টেশনে বসে আছি।এসপি সাহেব আমার স্ত্রীর রিপোর্ট দেখছেন আর দাড়ি চুলকাচ্ছেন।জীবনে মনে হয় উনিই প্রথম ব্যক্তি,যে এমন রোগী মহিলার সন্ধান পেয়েছেন।যাকে উনি সকালে নিউমার্কেটের মেয়েদের এক জুয়েলারি দোকান থেকে চুরির অপরাধে গ্রেফতার করেছেন।

আসলে আমার স্ত্রীর একটা রোগ আছে।সাইকোলজিতে যার নাম ক্ল্যাপট্যামোনিয়া। চুরিকে সে কখনো না করতে পারেনা।সে পাচ-দশজন প্রফেশনাল চুরের মতো পরিকল্পিতভাবে অপরাধজনিত চুরি করেনা,সে চুরিটা করে নিজের মনের প্রশান্তির জন্য।ওর যখন চুরি করতে ইচ্ছে হয় নিজের ঘরের জিনিসও চুরি করে।রেস্টুরেন্টের খাবার থেকে জুয়েলারি দোকানের গহনা সব চুরিতে সে খুব এক্সপার্ট। ধরা পড়েনা।জীবনে দুইবার ধরা পড়েছে।একবার বিয়ের পর আরেকবার আজ।

রিপোর্ট দেখা শেষে এসপি সাহেব আমাদের কাছে ডাকলেন।চুরীর অপরাধে আমাদের জিজ্ঞেসাবাদ করা হবে।আমার স্ত্রীকে দুজন মেয়ে পুলিশ এসে অন্য এক রুমে নিয়ে গেলেন আর আমাকে এসপি সাহেবের সামনে চেয়ারে বসতে বলে উনি আবার রিপোর্ট দেখতে দেখতে বললেন, তুমি তারেকের শালা সাফিম না? আমি মাথা নেড়ে বললাম, হ্যা স্যার। তোমার দুলাভাইতো তোমার অনেক নাম করতো।পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়।কোনো বদ অভ্যাস নাই।সবিতো সত্য তাইনা? আমি মাথা নেড়ে বললাম, হ্যা স্যার। দেখেই বুঝা যায়।তো কপালে এতো অসৎ বউ জোটল কি করে? আমি আমতা আমতা করে বললাম,স্যার বিধির লিখন। কোনো পুলিশের এসপি এতো ভালো হয় আগে জানা ছিলোনা।এসপি সাহেব ভদ্রভাবে বললেন, তুমি কোন ইউনিভার্সিটিতে পড়তা জানি? জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি।ইংরেজিতে অনার্স-মাষ্টার করেছি স্যার। বড় শিক্ষিত হয়েছ।তাও কপাল খারাপ।

রূপার কারণে আত্মীয় স্বজন সবাই আমাকে ভুল বুঝে। এসপি সাহেব খুব মজা নিয়ে বললেন,ইন্টারেস্টিং রোগ।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর তোমার বউ আসুক। প্রথম কেমনে বুঝতে পারলে তোমার স্ত্রীর এই ক্ল্যাপট্যামোনিয়া রোগ আছে। নিজের স্ত্রীর চুরির কাহিনি অপরিচিত একজনকে বলতে নিজের লজ্জা লাগছিল তার ওপর দুলাভায়ের বন্ধু। তাও এখান থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য বলতে আমি বাধ্য হলাম। আমাদের বিয়ের দিনের ঘটনা স্যার।শশুর আব্বা তাকে দেওয়া ওপরওয়ালার শ্রেষ্ঠ উপহারটা আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন,বাবা তোমার আমানত সারাজীবনের জন্য তোমার হাতে তুলে দিলাম।ওর বিপদে আপদে তুমি তার খেয়াল রেখো। শশুর আব্বার চালাকি তখন আমার পরিবারের কেউ ধরতে পারিনি স্যার।শশুর আব্বা তখন নিজের বিপদ আমার ঘাড়ে চাপিয়েছেন।সুন্দরী বউ পেয়ে সবাই খুশি হয়েছিল।

ঘরভর্তি আত্মীয়-স্বজন।আদর করে কেউ কেউ আমার বউকে বুকে জড়িয়ে নিচ্ছে।বউটা আমার অনেক সুন্দরী বলে কিছুক্ষণ পর পাচ-ছয়জনে পুরো বাড়িতে হুলুস্থুল কান্ড শুরু করে দিলো।।কারো গলার হার কারো পকেটের টাকা কারো হাতের আন্টি কোথায় হারিয়ে গেছে।বাবা-মা খুব উদ্ধিগ্ন হয়ে পড়লেন।নতুন বউয়ের কানে এই ঘটনা পৌছালে বাড়ির মানসম্মান যাবে।সেদিন অনেক নির্দোষ মানুষকেও চুরির সন্দেহে চ্যাক করা হলো স্যার। আমাদের বাড়িতে সবাই আপসেট হয়ে পড়ল।এরেঞ্জড ম্যারিজ বলে রূপাকে আগে সহজ করে তুলতে দু’চারটা কথা বলে দুজন ঘুমিয়ে পড়লাম।পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে আবিষ্কার করলাম আমার হাতের ঘড়িটা নেই।ঘড়িটা শাশুড়ী আম্মা দিয়েছেন।রোলেক্সের ঘড়ি।দাম কম হলেও লাখের উপরে। এসপি সাহেব বললেন, তোমার হাতের এই ঘড়িটা? না স্যার এটা আরেকটা।

–অহ আচ্ছা,তারপর কি হলো?

তাড়াতাড়ি টেবিল ছেড়ে রুমে চলে আসলাম। বউকে বললাম,ঘড়ি নাই,কোথায় যেন পড়ে গেছে।  বউ ওয়াশরুমে ছিল।ওখান থেকে জবাব দিল ঘড়ি হারায়নি।ওয়ারড্রবে রাখা আছে। ওয়ারড্রবের কাছে যেতে দেখি কিছু টাকা আর কিছু গহনা।এগুলোর একটাও আমি রূপাকে দেয়নি। রূপার জন্য অপেক্ষা করছি। রূপা ওয়াশরুম হতে বের হতে জিজ্ঞেস করলাম,গহনা আর টাকাগুলো কি তোমার? রূপা প্রায় কেঁদে দিলেন।যদিও আমি বলিনি তুমি চুরি করেছ।রূপা কাদতে কাদতে বলল, এসব আমি ইচ্ছেকৃতভাবে নিইনি।আপনি আমাকে চুর ভাববেন না।চুরের চুরি আর আমার চুরি এক নয়।চুরি করাটা আমার রোগ। আমারটা অভেসিভ কম্পালসিভ ধরনের ডিসঅর্ডার।মানে আমার কোনো জিনিসের প্রতি আকাঙ্খা জাগলে তা পেতে চুরি হলেও করতেই হবে।চুরিটা আমার কাছে নেশার মতো।যে মূহুর্তে মন চাই করতে না পারলে আমি পাগল হয়ে যাব।

আমার এখানে থামতে হলো এসপি সাহেবের কথায়।উনি বললেন, ডেঞ্জারাস রোগ।ভাই তখনোতো সময় ছিলো সেপারেট হয়ে যাওয়ার।কেন হওনি? তোমার পরিবারের লোকজন বিষয়টা জেনেছেতো? জেনেছে স্যার।জানলেও কিছু করার ছিলোনা স্যার।বিয়ের প্রায় এক মাস পর বড় খালার হ্যান্ড ব্যাগ চুরি করতে গিয়ে মায়ের চোখে পড়েছিল।সেদিন মা-বাবা,খালারা বলেছিল ডিভোর্স দিতে।আমি দিইনি।অনেক ভালোবেসে ফেলেছি স্যার বউটাকে।তাই বউয়ের পক্ষ নিয়ছেলাম।বাবা ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিলেন।

–চুরি করা জিনিসগুলা ফেরত দাও নাকি হজম করে বিক্রি করে টাকা কামাও? না স্যার এসব বিক্রি করিনি।আমাদের যথেষ্ট সম্পদ রয়েছে।এসবের দরকার হয়না। পরিচিত কারো কিছু হলে আমি বাহানা সাজিয়ে দিয়ে দিই।

–তোমার হাতের ঘড়িটা কোথা থেকে কিনলে? স্যার এটা বউ ভার্সিটির সমাবর্তনের সময় উপহার দিয়েছে।
–অহ আচ্ছা, কোথায় থেকে কিনল জানো?

না স্যার,সমাবর্তন থেকে ফেরার পর ও আমাকে সেটা হাতে পড়িয়ে দেয়? এসপি সাহেব একটু ইতস্ততভাবে বললেন, না মানে আমার ঘড়িটা আমি সমাবর্তনে হারিয়ে ফেলেছিলাম।হুবহু তোমারটার মতো।আমিও জগন্নাথ ইউনিভার্সিটির সাবেক ছাত্র।তবে বলছিনা তোমার বউ আমার ঘড়ি চুরি করেছে।হতে পারে ও তোমাট জন্য শপিংমল থেকে কিনেছে।

এবার আমি অপমানবোধ করলাম। রূপা চুরি করে কোন জিনিস আমাকে উপহার দিবেনা।ও পরিচিত কারো হলে তা আবার তার ইচ্ছে পূরণের পর ফিরিয়ে দেয় অপরিচিত হলে তা কোন গরিবকে দিয়ে দেয়। ও আসুক তারপর নাহয় বাড়িতে গিয়ে জেনে নিব।যদি ও চুরি করে তাহলে কি আর করা এসপি সাহেবের ঘড়ি এসপি সাহেবকে দিয়ে দিবো।
উনাকে আর কিছু বললামনা চুপচাপ বসে আছি। প্রায় দেড়ঘন্টা পর রূপা আসলেন।এসপি সাহেব দুলাভায়ের বন্ধু মানুষ বলে এই যাত্রায় বেঁচে গেছি । আমরা থানা থেকে বের হয়ে গাড়িতে ওঠেছি মাত্র। এমন সময় এসপি সাহেবের ফোন,হ্যালো,সাফিম যে দুজন মহিলা তোমার বউয়ের সাথে ছিলো ওখান থেকে একজনের গলায় থাকা প্রাইম মিনিস্টারের কাছ থেকে পাওয়া গোল্ড মেডেল টা পাচ্ছেনা।দেখতো তোমার বউ নিয়ে গিয়েছে কিনা?নিলে আমাকে একটা ফোন দিও।আর তাড়াতাড়ি তোমার স্ত্রীর চিকিৎসা দাও।

–এই রোগের কোনো চিকিৎসা নাই স্যার।এটা স্ব-চিকিৎসার উপায় নির্ভরশীল।

ফোন কেটে দিলো এসপি সাহেব। আমি ভ্যাবাছ্যাকা খেয়ে গেলাম।এই মেয়েটা সাধারণ মানুষের জিনিস চুরি করতে করতে প্রশাসনের লোককেও ছাড়ছেনা।প্রশাসন ও বুঝতে পারেনি।ও চুরিটা করে কেমনে।আর মানুষও তা বুঝতে পারেনা।অবশ্যই সাইকিয়াট্রিস্ট বলেছেন, চুরি করতে করতে ওরা এমন ট্যাকনিক আবিষ্কার করে ফেলে যা শুধু রোগী বাদে কেউ বুঝতে পারেনা। যদিও ধরা খাই তাহলে ডাক্তারের দেওয়া প্রেসক্রিপশনটা দেখাতে।তাই সবসময় রূপার প্রেসক্রিপশন ওকে নিয়ে বের হলে সাথে রাখি।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত