“কিছু না করতে পারলে মরে যাচ্ছিস না কেন?” বাবা যেদিন একথাটা বলেছিলো না, সেদিনই ঘর ছেড়েছিলো রাফি। আর বাবারই বা কি দোষ! ইংরেজিতে মাস্টার্স করা একটা ছেলে বেকার হয়ে ঘরে বসে আছে, অন্নধ্বংস করছে, বাবা আর বলবেনই বা কি! সারাদেশের যে একই অবস্থা, অসংখ্য উচ্চশিক্ষিত যুবক-যুবতী চাকরি না পেয়ে বেকার বসে আছে, একথায় মন স্বান্তনা পায়, তবে অভাব মেটে না। তাই বাবার দোষ, রাফি কখনোই দেয় না। পকেটে কিছু জমানো টাকা নিয়ে ঢাকার গাড়ি ধরেছিলো রাফি। একমাসেই সব টাকা শেষ হয়ে গেলো। রাগ করে এরমধ্যে বাড়িতে যোগাযোগও হয় নি আর। কিছু করতে না পারলে জীবনে, আর হবেও না যোগাযোগ। রাফি খুব জিদ্দি।
এমনই এক রাতে না খেয়ে রাস্তায় শুয়ে ছিলো রাফি। সে রাস্তায় যাচ্ছিলেন তফাদ্দার সাহেব। তার রিকশার গ্যারেজের একটু সামনেই শুয়ে ছিলো রাফি। তফাদ্দার ভাবলেন কষিয়ে লাথি দেবেন একটা। তবে ছেলেটার চেহারা দেখে তার ভদ্র এবং শিক্ষিত মনে হলো। মারলেন না, বরং ডাকলেন। ডেকে নিয়ে গেলেন তার গ্যারেজের ভিতরে। সেই থেকে রাফি তফাদ্দার সাহেবের হয়ে রিকশার ভাড়া ওঠায়। তফাদ্দার সাহেবের মোট ১৮টা রিকশা, এগুলোর হিসাব রেখেই রাফির দিন কাটে। কোন টাকা সে নেয় না। তার খরচ তফাদ্দার সাহেব দেন। তবে রাফি যে সুখী নয়, এটা রাফি যেমন বুঝতে পারছিলো, বুঝতে পারছিলেন তফাদ্দার সাহেব।
তফাদ্দার বুঝেছিলেন, রাফি বড় জানোয়ার। ছোট খাঁচায় একে আটকে রাখা যাবে না। বিশ্বাসী লোক আজকাল পাওয়া যায় না। তবু তিনি তাকে চাইলেন ছেড়ে দিতে। একদিন তাকে ডেকে সব বুঝিয়ে বললেন। রাফির মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। এই অস্থায়ী নিশ্চিত ঠিকানাতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল সে। কি করবে এখন? তফাদ্দার সাহেব তখন একটা খুব কঠিন কথা বললেন। বললেন, ” তুই আমার গ্যারেজ থেকেই একটা রিকশা ভাড়া নে, তুই রিকশা চালা।” রাফি হতবাক হয়ে গেলো। ইংরেজি সাহিত্যে পড়ালেখা করে সে রিকশা চালাবে? বাবা জানতে পারলে কি ভাববেন! তফাদ্দার সাহেব রাফির মনোভাব বুঝতে পেরে একটা কথাই বলেছিলেন, ” কোন কাজই ছোট না বাবা। ছোট মানুষের মন।”
সেদিন থেকেই রিকশা চালানো শুরু করেছিলো রাফি। গুলশানে রাফি রিকশা চালাচ্ছে আজ প্রায় একবছর হয়ে গেলো। তার কর্ম ব্যাসার্ধ সীমিত, শুধু গুলশানের ভিতরেই রিকশা চালায় সে, এ্যাম্বাসী এরিয়ায়। এই একবছরে সে যে টাকা ইনকাম করেছে তা দিয়ে তিনটা রিকশা কিনেছে। দুটো ভাড়া দিয়েছে আর একটা সে নিজেই এখনো চালায়। কোন কাজই ছোট না। বাড়িতে যোগাযোগ আজও হয় নি। তবে আরেকটু গোছাতে পারলেই বাবাকে ঢাকায় আসতে বলবে রাফি।
একদিন এক বিদেশী ভদ্রমহিলা রাফির রিকশায় উঠলেন। রাফি তাকে দেখেওনি ঠিকমতো, তিনি রিকশায় বসে কার সাথে যেন মোবাইলে কথা বলছিলেন, না চাইতেও কানে আসছিলো। কথা শুনে রাফি বুঝলো ভদ্রমহিলা বাংলাদেশে ঠিক এডজাস্ট করতে পারছেন না, মাত্রই আসলেন। তার রিসার্চের জন্য কিছু জায়গায় যাওয়া দরকার সেটা হচ্ছে না, গাইডের সাহায্য যথেষ্ট হচ্ছে না। তিনি চিন্তায় আছেন কিভাবে পুরো ঢাকা কভার করবেন। বিশেষ করে লালাবাগের কেল্লা শব্দটা বারবার আসছিলো।
একটা ইউরোপীয় এ্যাম্বাসীর সামনে এসে তিনি নামলেন রিকশা থেকে। ভাড়া দিলেন বাংলাদেশী একশ টাকা।
রাফি বললো, “It’s more than enough mam. My fair should be no more than 30 tk.” একটা কথা আছে বজ্রাহত। ভদ্রমহিলা এই লুংগি আর ফুলহাতা শার্ট পরা যুবকের মুখে আমেরিকান এ্যাক্সেন্টের ইংরেজি শুনে বজ্রাহত হয়ে গেলেন। হাত বাড়িয়ে ১০০ টাকাটা নিয়ে গুণে গুণে ৩০ টাকা দিলেন। রাফি, “Have a nice day mam” বলে রিকশা টান দিচ্ছিলো। ভদ্রমহিলা পেছন থেকে ডাকলেন। তারপরে কথা যা হলো ইংরেজিতে, বাংলায় অনেকটা এরকম, “ইয়াং ম্যান, তুমি কি আমাকে তোমার শহরে কিছু জায়গায় নিয়ে যেতে পারবে? আমি তোমাকে টাকা দিবো।”
রাফি এই প্রথম ভদ্রমহিলার দিকে দেখলো। তার বয়স রাফির চেয়ে বেশি হবে না, হয়তো পি.এইচ.ডি স্টুডেন্ট।
চোখে অনেক মোটা চশমা, সোনালী চুল। রাফির এই বিদেশীনিকে না করতে পারলো না। রাজি হয়ে গেলো তার শহর ঘুরে দেখানোর প্রস্তাবে। তবে শর্ত একটাই, প্রতিদিন ভাড়া দেয়া যাবে না। স্মিতহাস্যে বিদেশীনী রাজি হলেন। ভদ্রমহিলা পরবর্তী আট মাস বাংলাদেশে ছিলেন। প্রতিদিন সকালে রাফির রিকশায় উঠতেন, রাফি তাকে নিয়ে সারাদিন ঢাকা শহরে ঘুরতো। সে গুলশানের গন্ডি ছেড়ে বেরিয়ে এলো। ভদ্রমহিলার নাম ছিলে এথেনা। এথেনা আর রাফির অনেক আলাপ হতো। সবই ইংরেজিতে। হয়তো খোলা মনে কথা বলার জন্যই রাফির রিকশাটায় উঠেছিলো এথেনা। আরো বেশি কিছু পেয়ে গেলো।
আট মাসে একটা পহেলা বৈশাখ গেলো। সেদিন রাফি পাঞ্জাবী পড়ে রিকশা নিয়ে এসেছিলো। সেটা দেখে এথেনা এ্যাম্বাসী থেকে নামলো শাড়ি পড়ে, এ্যাম্বাসীতে চাকরি করা এক বাংলাদেশী মহিলা পড়িয়ে দিয়েছিলো সেটা। সেদিন কারণ ছাড়াই অনেক ঘোরা হলো, রাফির সাথে কথা বলে রাফির জীবনের সব কথা জেনে নিলো এথেনা। রাফিও এই অসম বান্ধবীকে সব বলে নিজেও একটু হালকা হলো। আটমাস পরে চলে যাওয়ার সময় শেষ বার রিকশা থেকে নামলো এথেনা। দু’জনেই জানে এটাই শেষ দেখা। কেউ কোন কথা বলতে পারছে না। ভালোবাসা কি? শুধু শরীরে কি ভালোবাসা হয়? অনেকসময় রিকশার চাকাতেও জড়িয়ে যায় ভালোবাসা। এথেনা আট মাসের রিকশা ভাড়া দিলো তার দেশের কারেন্সীতে। বাংলাদেশী টাকায় প্রায় আট কোটি টাকা। রাফি নিলো, নিষেধ করলো না।
এথেনা রাফিকে তার ঠিকানা দিলো, তার দেশের ফোন নাম্বার দিলো। রাফি দিলো তার রিকশার গ্যারেজের মালিক তফাদ্দার সাহেবের ঠিকানা। যাওয়ার সময় বিদেশীনীর চোখ জলে ভরে উঠছিলো, আর কথা হলো না। এ্যাথেনা যাওয়ার আগে বললো, “you should be prepared to visit more countries. Nobody knows what future holds for us.” জল রাফির চোখেও ছিলো। তাই দৃষ্টি ছিলো নিচে। চলে গেলো এ্যাথেনা। রাফি এখনো রিকশা চালায়। তবে এ্যাথেনা গেছে দু মাস হলো, এর মধ্যে পাসপোর্ট করিয়েছে সে। তার বাবাকে নিয়ে হজ্বে যাওয়ার ইচ্ছা। এদিকে DHL এর খামে ভরা ইউরোপের কোন এক দেশের ওয়ান ওয়ে টিকেট টা তখনো তফাদ্দার সাহেবের রিকশার গ্যারেজের ঠিকানায় এসে পৌঁছায় নি।
দুই বছর পরের কথা। রাফির বাবা ইউরোপের এক দেশের এয়ারপোর্টে মাত্র নেমেছেন। তিনি এত মানুষ দেখে কিছুই বুঝছেন না। প্রচন্ড ঠান্ডা। তার সারা শরীরে শীতের কাপড়। তবুও শীত মানছে না। হঠাৎ একদিন রাফি ফোন করলো। সে এখন এদেশে থাকে। এদেশেই বিয়ে করেছে। একটা বাবুও আছে। তার পাসপোর্ট রাফিই করে দিয়েছে, টিকেটও সে পাঠিয়েছে। ছেলেটা বাড়ি থেকে চলে আসার পর এতদিন আর দেখা হয় নি। না জানি কেমন আছে ছেলেটা। তাকে রিসিভ করতে একটা লোক এসেছে। হাতে প্ল্যাকার্ডে তার নাম লেখা। লোকটা তাকে নিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে একটা খালি জায়গায় নিয়ে এলো।
সামনের দিকে তাকিয়ে বাবা জোরে হেসে উঠলেন। প্রাণখোলা নির্মল হাসি। সামনে একটা রিকশা। তাতে স্যুট পরে চালকের আসনে রাফি বসে আছে। পিছনে মোটা চশমা পড়া সোনালী চুলের একটা মেয়ে, ছোট্ট একটা বাবু কোলে। বাবুটা দেখতে রাফির মায়ের মতো। রাফি আর বিদেশীনী দুজনের মুখেই হাসি। হাসতে হাসতে সামনে এগিয়ে বাবা ডাকলেন, “এই রিকশা, যাবে?” সাথে সাথে বরফ পড়া শুরু হলো।