ঘনাদার ধনুর্ভঙ্গ
আবার সেই ভুল।
আর সেই ভুলেই বুঝি বাহাত্তর নম্বরের বারোটা বেজে যায়!
সবাই তখন আফশোসে হাত কামড়াচ্ছি আর গালাগাল দিচ্ছি পরস্পরকে!
সব দোষ তো এই আহাম্মকের! শিবু আমার ওপরই গায়ের ঝাল ঝাড়ছে, মেসের খরচার দিকটাও তো ভাবতে হবে বলেছিলেন। ভাবো এখন খরচার দিক। বাহাত্তর নম্বরই যে এখন খরচার খাতায়!
আর তুমি! আমিও পালটা ঘা দিতে ছাড়ছি না, সুপারিশটা কে করেছিল? তুমি? না, না খুব ভাল ছেলে! সাত চড়ে রা নেই। শুধু পড়াশুনা নিয়েই নাকি রাতদিন থাকবে। আমরা টেরই পাব না কেউ আছে! কেমন? টের কি এখনও পাওয়া যাচ্ছে!
শিবুকে দুষে কী হবে! শিশির শিবুর পক্ষ নিচ্ছে, আসল আসামি তো গৌর। শিবু তো ওর গ্রামোফোন ছাড়া কিছু নয়। গৌর যা গায় তাই ও বাজায়! গৌরই তো খবর এনেছে প্রথম। ওঁর মোহনবাগানের সি-টিমের কোন হবু প্লেয়ারের মাসির সইয়ের বকুল ফুলের ভাগনে না ভাইপো শুনেই উনি গদগদ হয়ে লাইন ক্লিয়ার লিখে দিয়েছেন।
আমি না হয় রেফারেন্স ভুল করেছি, আর উনি বুঝি একেবারে ধোয়া তুলসি পাতাটি! গৌর শিশিরকে ভেঙাচ্চে, চেহারা দেখেই উনি চরিত্র গুণে বলে দিতে পারেন! দেখিস বাহাত্তর নম্বরের একেবারে আদর্শ বোর্ডার হবে! কী বিনয়! কী আদবকায়দা দুরস্ত। ঘনাদাকে পর্যন্ত দুদিনে মোহিত করে দিয়েছে। সামলাও এবার তোমার মোহিত মোহনকে!
হ্যাঁ, ওই মোহিত করার জ্বালাতে জ্বলেই নিরুপায় হয়ে নিজেরা খাওয়া-খাওয়ি করে মরছি। সেই সঙ্গে দু-দুবার ঠেকেও কিছু না শিখে সেই পুরনো ভুলটা করার জন্য ধিক্কার দিচ্ছি নিজেদের। সত্যি তিন-তিনবার এমন ভুলটা কী বলে করলাম।
হাঁস খাইয়ে পেটে যে চড়া পড়িয়ে দিয়েছিল সেই বাপি দত্তর কথাটা না হয় ছেড়েই দিলাম। বিশেষণটা তার বুনো হলেও মানুষটা এমনিতে সাদাসিধে আর সরল ছিল একথা মানতেই হবে। জ্বালা যদি সে কিছু দিয়ে থাকে তা হলে পেয়েছে অনেক বেশি।
কিন্তু তারপর সেই ছাতার মালিক সুশীল চাকী! নতুন বোর্ডার নেবার সুখ সে তো হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেছে!
এই সব নজিরের পর আমাদের মতো ন্যাড়ার আর বেলতলায় যাওয়া উচিত?
তা ছাড়া বোর্ডার নিতে গেলাম কিনা ধনু চৌধুরিকে?
বাহাত্তর নম্বরে আমাদের ভাগীদার নেওয়াটাই আহাম্মুকি হয়েছে একথা স্বীকার করবার পরও অবশ্য আমাদের তরফের কিছু বলার থাকে। চোখে তো আমাদের সেরকম এক্সরে যন্ত্র নেই যে বুকের হাড়-চামড়া কুঁড়ে একেবারে ভেতরের চেহারাটা দেখিয়ে দেবে। ধনু চৌধুরির সার্টিফিকেটগুলো বাইরে থেকে দেখলে তো সবই মিলে যায়। সেই অতি সভ্য-ভব্য ছেলে! সাত চড়ে রা নেই। যেমন আদব কায়দা দুরস্ত তেমনই বিনয়ী। ব্যবহারে একেবারে মোহিত হতে হয়। ঘনাদাকে পর্যন্ত মোহিত করে দিয়েছে!
কিন্তু ওই মোহিত করা যে এমন সর্বনাশা তা কি আগে ভাবতে পেরেছি! গায়ে। যেন বিছুটির জ্বালা ধরিয়ে ছাড়ছে।
ওপর থেকে দোষ ধরবার কিছু নেই। প্রথম দিনই বিকেলে আমাদের আড্ডাঘরে ভক্ত হনুমানটির মতো একটি কোণে এসে বসেছে। আমাদের পাঁচজনের দয়ায় ঘনাদার একটু দর্শন পেয়ে আর বাণী শুনেই যেন ধন্য। তার স্বরূপটির একটু আঁচ পাওয়া গেছে প্লেট সাজানো ট্রে নিয়ে বনোয়ারির ঘরে ঢোকার পরেই।
ঘনাদাকে টোপে ধরবার জন্য সামান্য একটু চায়ের ব্যবস্থা হয়েছিল। প্লেটে একটি করে স্পেশ্যাল কবিরাজি কাটলেট। ঘনাদার প্লেটে অবশ্য দুটো।
প্লেটটা হাতে নিয়ে ঘনাদা যে খুশি হয়েছেন তা তাঁর রসিকতার নমুনা থেকেই বোঝা গেছে।
কবিরাজি কাটলেট বুঝি? তা এক সঙ্গে চরক-সুশ্রুতকেই আমদানি করেছ যে হে।
হ্যাঁ, যথারীতি কৃতার্থ ভঙ্গিতে বলেছি আমরা, স্পেশ্যাল অর্ডার দিয়ে এসেছিলাম সকালে।
তাই নাকি! বলে ঘনাদা সোৎসাহে স্পেশ্যাল কবিরাজির মান রাখতে যাবেন। এমন সময়ে বিনীত গলার কুণ্ঠিত প্রশ্ন আমাদের চমকে দিয়েছে—
ওই কাটলেট কি ওঁর খাওয়া ঠিক হবে?
কাটলেট-এর টুকরো তুলতে গিয়ে ঘনাদার হাতটা মুখের কাছেই থমকে থেমে গেছে। আর আমাদের কপাল, ভুরু কুঁচকে গেছে নিজেদের কানগুলোকে বিশ্বাস করতে না পেরে?
কী বললেন? শিবু বেশ সন্দিগ্ধভাবে ধনু চৌধুরির দিকে চেয়ে জানতে চেয়েছে।
বলছিলাম কী, ধনু চৌধুরি যেন অতি সংকোচের সঙ্গে ভয়ে ভয়ে নিবেদন করেছে, আপনারা নিজেরা যা খান না-খান, বাজারের আজেবাজে জিনিস ওঁর না খাওয়াই ভাল, নয় কি?
বাজারের আজেবাজে জিনিস! গৌরের স্তম্ভিত গলায় কথাগুলো যেন আটকে গেছে, আমাদের পাড়ার কমরেড কেবিনের কবিরাজি কাটলেট আজেবাজে বাজারের জিনিস! আপনি খেয়ে দেখেছেন কখনও?
আজ্ঞে না! সেই বিনয়ে গলে পড়া কিন্তু কিন্তু ভাব—দোকানের ও সব বনস্পতিতে ভাজা জিনিস তো খাই না, দাসবাবুর খাওয়া বোধহয় উচিত নয়!
একে কমরেড কেবিনের কবিরাজি কাটলেটের নামে বনস্পতিতে ভাজার কলঙ্ক। তার ওপর আবার দাসবাবু!
আমাদের মুখে খানিকক্ষণ আর কথা সরেনি! ঘনাদাই অত্যন্ত শঙ্কিত গলায় শুধু আমাদের নয়, বিশ্বসংসারকে যেন প্রশ্ন করছেন, তা হলে কী হবে? এ তো গোলমেলে ব্যাপার দেখছি!
আমরা সভয়ে এবার ঘনাদার প্লেটের দিকে তাকিয়েছি। শেষে তাঁর খাওয়াটাই মাটি হল নাকি এই উজবুকের তোলা ফ্যাকড়ায়?
না, তা হয়নি। ঘনাদা তাঁর প্লেটের দ্বিতীয় কাটলেটটার শেষ টুকরো মুখে দিয়েই তাঁর ও পৃথিবীর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে ভাবিত হয়ে উঠেছেন।
অনেক কষ্টে বাকশক্তি ফিরে পেয়ে তাঁকে আমরা এবার আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছি।
গোলমাল আবার কোথায়? শিশির তাঁকে সাহস দিয়েছে।
গোলমাল যদি থাকে তো কারও মাথায় আছে! শিবু তার সন্দেহটা জানিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু ওই যে শুনছি, বনস্পতি না কী? ঘনাদা তাঁর উদ্বেগটা প্রকাশ করেছেন।
শুনলেই হল! আমি ক্ষুব্ধ প্রতিবাদ জানিয়েছি, কাটলেট কীসে ভাজা তা কি কানে শুনে বুঝবেন?
কমরেড কেবিন কোনওদিন ঘি ছাড়া আর কিছু ব্যবহার করে! গৌর জোর গলায় ঘোষণা করেছে।
ঘি-এ ভাজলেই ভাল। আবার সেই মোলায়েম গলার সবিনয় মন্তব্য শোনা গেছে, কিন্তু বাজারের ঘি-ও ভেজাল কিনা।
ঠিকই বলেছ! ঘনাদা চিন্তিতভাবে বনোয়ারির নিয়ে আসা চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে বলছেন, খাঁটি বলে কিছু কি আর আছে! যা তা খেয়ে বেশ একটু ভাবনাই হচ্ছে তাই।
ঘনাদার ভাবনা সামলাতে হজমি-গুলি, চূরণ-জোয়ানের আরক সমেত অনেক কিছুরই ব্যবস্থা করতে হয়েছে। তাতেও আমাদের আসর কিন্তু আর জমানো যায়নি।
যা তা খাওয়ার ভাবনায়, শরীরটায় কেমন যেন জুত পাচ্ছেন না বলে ঘনাদা তাঁর টঙের চলে গেছেন তাড়াতাড়ি।
ধনু চৌধুরিকে তখনকার মতো একা পাবার সুযোগও আমাদের হয়নি। শরীর খারাপ শুনে ব্যস্ত হয়ে সে তার দাসবাবুকে উপরে তুলে দিতে সঙ্গে গিয়েছে।
ওই দিয়েই কলির শুরু। তারপর ধনু চৌধুরির আদিখ্যেতায় বাহাত্তর নম্বর আমাদের কাছে বনবাস হয়ে উঠেছে।
এত বড় ভক্ত গরুড়পক্ষী ঘনাদার ছিল কে আর জানত! ঘনাদার তোয়াজ-তদ্বির ছাড়া ধনু চৌধুরীর আর কোনও চিন্তাই নেই।
খেতে বসেছি এক সঙ্গে সবাই রাত্তিরে। বাপি দত্ত ছেড়ে যাওয়ার পর থেকে শুক্রবারের বদলে শনিবার রাত্রের খ্যাঁটটাই একটু এলাহি হয়।
রামভুজ হয়তো পারশে ঝালের সবচেয়ে ডাগর মাছটা ঘনাদার পাতে দিতে যাচ্ছে, হঠাৎ চমকে রামভুজের হাত থেকে মাছের গামলাটাই প্রায় পড়ে পড়ে।
চমকে উঠি আমরাও। ঘনাদাও বাদ যান না।
আমাদের চমকিত সকলের দৃষ্টিই গিয়ে পড়ে অবশ্য একই জায়গায়। সেখানে ধনু চৌধুরি হঠাৎ সন্ত্রস্ত হয়ে হাঁ-হাঁ করে উঠেছে, আরে করছ কী, ঠাকুর! ওই বড় মাছটা দাসবাবুকে দিচ্ছ?
হতভুদ্ধি রামভূজ, হতভম্ব আমরা, আর স্বয়ং ঘনাদাও কেমন ভ্যাবাচাকা। বলে কী ধনু চৌধুরী? সবচেয়ে বড় মাছটা ঘনাদাকে দেওয়া হচ্ছে বলে আপত্তি?
রামভুজ হাতের গামলার সঙ্গে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলে, হাঁ, এই সবসে বড়াঠোই তো বড়বাবুকে লিয়ে রাখিয়েছি। ইসমে ডিমভি আছে?
ওই ডিম আছে বলেই তো ভাবনা। ধনু চৌধুরি তার বীরপূজার সঙ্গে বিচক্ষণতার পরাকাষ্ঠা দেখায়, ডিম থাকলেই মাছ আগে নষ্ট হয় কিনা! তাই বলছি ও মাছটা দাস বাবুকে না-ই দিলে। হাজার হোক, সকালের মাছ তো।
আচ্ছা, জো হুকুম আপনাদের! রামভুজ নিতান্ত অনিচ্ছায় পুরো দেড় বিঘত মাপের পারশে কুলতিলকটিকে আবার গামলায় রাখতে যায়।
আমাদের বাকযন্ত্র তখনও বিকল। ঘনাদাই মৃদু একটু আপত্তির সঙ্গে উদার আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত দেখান, থাক থাক! মাছটা আর তুলে রেখে কী হবে! খেয়ে খারাপ যদি কিছু হবার হয় তো আমারই হোক। আমি থাকতে তোমাদের তো আর বিপদে ফেলতে পারি না?
কিন্তু আমরা সব আর আপনি এক কথা হল! ধনু চৌধুরি ভক্তির পরীক্ষায় আমাদের উপর ট্রিপল প্রমোশন নিয়ে এগিয়ে যায় তো বটেই, সেই সঙ্গে যেভাবে আমাদের দিকে তাকায় তাতে মনে হয় বানর-সেনা হয়ে আমরা যেন স্বয়ং শ্রীরামচন্দ্রকেই খামচে দিয়েছি।
এরপর এসপার-ওসপার একটা কিছু করে ফেলবার গোঁ হয় কি না?
বিশেষ করে সেইদিনকার ওই যজ্ঞনাশের পর।
ধনু চৌধুরি আসবার পর থেকে ঘনাদাকে একবারের জন্যও মুখ খোলাতে তো পারিনি! সেদিন অনেক কষ্টে সলতেটা প্রায় ধরে ধরে হয়েছে। হয়েছে, বাগড়া দিয়ে জলের ছাট দেবার ধনু চৌধুরি তখন আড্ডাঘরে নেই বলে নিশ্চয়।
কিন্তু হায় আমাদের কপাল!
সবে সলতেটা দু-একটা ফুলকি ছাড়ছে, ঠিক সেই সময়েই ধনু চৌধুরির আবির্ভাব। মুখে গভীর বেদনার ছায়া আর হাতে একটা যেন কী?
সেই বস্তুটাই ঘনাদার সামনের সেন্টার টেবিলটায় নামিয়ে রেখে প্রায় বুক-ফাটা গলায় ধনু চৌধুরী বলেছে, দেখেছেন?
আণুবীক্ষণিক কিছু নয়। একটা দেশলাইয়ের বাকস! ঘনাদার সঙ্গে দেখতে আমরাও পেয়েছি। শুধু তার ভিতর এমন শোকাবহ কী আছে বুঝতে পারিনি।
ধনু চৌধুরি আকুল আক্ষেপে সেটা তারপর বুঝিয়ে দিতে দেরি করেনি, আপনার ওপরের ছাদটা একটু দেখতে গেছলাম। ফাটা ছাদ তো মেরামত না করলে নয়, তার ওপর কেউ একটু ঝাঁট দেবার ব্যবস্থা করায় না। আপনার ছাদে এইসব জঞ্জাল জমে থাকে!
জমে আছে তো! তুমি বলে তা-ই দেখলে! ঘনাদা জমে থাকা জঞ্জালটা দু আঙুলে তুলে ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে একটি করুণ দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লেন। সেই দীর্ঘনিশ্বাসেই আমাদের ধরে-আসা আশার সলতে নিবে গেল সেদিনকার মতো।
যা হয় হোক, অপারেশন ধনুর্ভঙ্গ আর শুরু না করে পারি! যেমন বেয়াড়া ব্যামো তেমনই কড়া চিকিৎসার একেবারে নিখুঁত আয়োজন সারাদিন ধরে করে রেখেছি সেদিন।
সন্ধেবেলা তাঁর সরোবর-সভা সেরে বাহাত্তর নম্বরে ঢুকতে না ঢুকতেই গন্ধটা নিশ্চয় পেলেন ঘনাদা। সিঁড়ি দিয়ে উঠে আড্ডাঘরে ঢুকে একেবারে চাক্ষুষই পেলেন দেখতে।
চোখ কি তখন তাঁর কপালে উঠেছে? উঠলেও আমরা আর দেখব কী করে! আমরা তখন যে যার প্লেটে দিস্তেখানেক করে হিং-এর কচুরি সামলাতে ব্যস্ত।
বসুন, ঘনাদা, ওরই মধ্যে কোনও রকমে যেন ভদ্রতাটুকু করবার অবসর পেল শিশির।
ঘনাদা বসলেন। জেগে আছেন না স্বপ্ন দেখছেন ঠিক করবার জন্য নিজেকে যদি দুবার চিমটি কেটে থাকেন তাতেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই। ঘনাদা বর্তমানে বাহাত্তর নম্বরে তাঁকে বাদ দিয়ে এ-রকম ভোজসভার দৃশ্য সত্যই তো বিশ্বাসের অতীত।
একটু উসখুস করে ঘনাদা জিজ্ঞাসা করলেন, ধনু গেল কোথায়?
ধন? এতক্ষণে আমরা মুখ তুলে চাইবার ফুরসত পেলাম, এইখানেই তো ছিলেন। এ সব বাজারের মাল তাঁর আবার দুচক্ষের বিষ কিনা। তাই হয়তো আপনাকে সাবধান করতে বেরিয়ে গেছেন।
আমাকে সাবধান করতে! ঘনাদার গলার গর্জন না আর্তনাদ বোঝা শক্ত। আমাকে সাবধান কী জন্য!
যে জন্য সাবধান, বনোয়ারি ট্রেতে করে সেই মুহূর্তেই তা চাক্ষুষ এনে হাজির। ট্রে-র ওপর চার চারটি প্লেটে দুটি করে প্রমাণ সাইজের চিংড়ির কাটলেট!
বনোয়ারি অভ্যাস মতো প্রথমেই একটা প্লেট ঘনাদার অর্ধেক বাড়ানো হাতে তুলে দিতে যাচ্ছিল। আমরা হাঁ-হাঁ করে উঠলাম সমস্বরে, আরে করছিস কী? ঘনাদাকে
ওই আজেবাজে জিনিস!
শিশির অপরাধীর মতো সভয়ে প্লেটটা ঘনাদার মুখের কাছে থেকে সরিয়ে নিয়ে প্রায় গলবস্ত্র হয়ে বললে, মাপ করবেন, ঘনাদা। এ সব যে আপনার বারণ তা বনোয়ারি আর কী করে জানবে।
হুঁ! ঘনাদার নয় যেন একটা সদ্য জাগা আগ্নেয়গিরির ভেতরের গোমরানি শোনা গেল।
ঘনাদা তখন আরামকেদারা ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠেছেন। ঠিক সেই মুহূর্তে মূর্তিমান প্রভুভক্ত শ্রীমান ধনু চৌধুরির প্রবেশ।
কিন্তু কই? যা ভেবে রেখেছিলাম তা হল কোথায়? আমাদের অত তোড়জোড়ই তো মিথ্যে! আগ্নেয়গিরির গুরুগুরু ধ্বনিই শুনলাম, ফেটে আগুনের হলকা আর ছুটল না!
ধনু চৌধুরি অক্ষত শরীরে আড্ডাঘরের ভেতরে দাঁড়িয়ে আমাদের প্লেটগুলোর ওপর একবার চোখ বুলিয়ে যেন শিউরে উঠল।
এইসব আপনারা দাসবাবুকে খাওয়ালেন? ধনু চৌধুরি বুঝি কেঁদেই ফেলে।
আমাদের কিছু বলতে হল না। আমাদের হয়ে ধনু চৌধুরির দাসবাবুই জবাব দিলে, না। কেমন করে খাওয়াবে? তুমি না বারণ করে গেছ!
এ কি ঘনাদার গলা! আমাদেরই দুবার তাঁর দিকে তাকাতে হল। একসঙ্গে স্নেহ, প্রশংসা আর কৃতজ্ঞতা উথলে-ওঠা এমন গলা তো আমাদের শোনার ভাগ্য কখনও হয়নি।
ধনু চৌধুরি তখন কৃতার্থ হয়ে সলজ্জ একটু হাসি হাসছে, আজ্ঞে আপনার জন্য যেটুকু পারি না করলে এখানে আছি কেন?
হ্যাঁ, তাই তো দুঃখ হচ্ছে আরও বেশি! ঘনাদা একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার তাঁর কেদারায় গা ঢাললেন, তোমার মতো মানুষের দেখা যখন পেলাম তখনই আবার ডেরা তুলতে হবে।
ডেরা তুলতে হবে! শুনেই আমাদের হাত-পা ঠাণ্ডা। কঠিন চিকিচ্ছে করতে গিয়ে হিতে বিপরীত হল নাকি? আগাছা নিড়োতে ফসলই সাবাড় করলাম!
ডেরা তোলার কথা কী বললেন যেন? নেহাত সহজভাবে হালকা সুরে বলার ভান করলাম। কিন্তু গলার কাঁপুনি যাবে কোথায়?
কিন্তু কাকে কী বলছি! আমরা যে ঘরে আছি তা-ই যেন ভুলে গিয়ে ঘনাদা তখন তাঁর ভক্ত প্রবরকে নিয়ে ব্যস্ত।
উদাস সুরে তাকে জানালেন, এখানে থেকে তোমাদের বিপদ বাধাতে তো আর পারি না!
কেন? আমাদের বিপদ কেন? এবার ধনু চৌধুরি উদ্বিগ্ন। কেন এখনও বুঝতে পারোনি? ঘনাদা যেন একটু ক্ষুণ্ণ হয়ে বললেন, সেদিন আমার ছাদে গিয়ে কী পেয়েছিলে?
ছাদে পেয়েছিলাম? ধনু প্রথমটা একটু ভাবিত।
দেশলাইয়ের বাকস! ধনুর স্মরণশক্তি একটু উসকে দিতে হল।
হ্যাঁ হ্যাঁ, দেশলাইয়ের একটা খালি বাকস! ধনু সবিস্ময়ে জানালে, সে তো আপনাকে দেখালাম।
হ্যাঁ, দেখিয়েছ, ঘনাদা দুঃখের সঙ্গে বললেন, শুধু খালি বাকসটা। তার ভেতর কী ছিল তা তো জানো না।
ভেতরে মানেধনু একটু হতভম্ব–ছিল তো দেশলাইয়ের কাঠি।
হুঁ—ঘনাদা তাঁর পেটেন্ট নাসিকা ধ্বনি করলেন-এক হিসেবে দেশলাইয়ের কাঠিই বটে, তবে সাক্ষাৎ শমনের হাতে তৈরি। মাপে আধ ইঞ্চিও হবে না, কিন্তু একটু ছোঁয়ালে নখের ডগা থেকে ব্রহ্মর পর্যন্ত জ্বলে যাবে।
হাওয়া বুঝে আমরা বোবা হয়ে থাকাই উচিত বুঝেছি। ধনু চৌধুরিই সভয়ে জিজ্ঞাসা করলে, কী ছিল তা হলে ও বাকসে?
লক্সোসেলেস রেকলুস! ঘনাদা তাঁর খুদে বোমাটি ছাড়লেন।
আমাদের মতো ঘাগীরাই এবার কাত। ধনু চৌধুরির অবস্থা আরও কাহিল। সামলে উঠবার আগেই ঘনাদা আবার জিজ্ঞাসা করলেন বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে, এ ক-দিনের মধ্যে কোথাও কিছু কামড়ায়-টামড়ায়নি তো?
এ ক-দিনে? ধনুর মুখ প্রায় ফ্যাকাশে—না, কামড়াবে আবার কী! ওই কালো একটা বিষ পিঁপড়ে—
বিষ পিঁপড়ে! ধনুর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ঘনাদা প্রথমটা অস্থির হয়ে উঠলেন। বিষ পিঁপড়ে—ঠিক দেখেছ তো, ভুল হয়নি তো কিছু?
না, ভুল কেন হবে! ধনু এবার দিশাহারা—বিষ পিঁপড়েই তো দেখলাম।
হ্যাঁ, বিষ পিঁপড়েই হবে। ঘনাদা এতক্ষণে ভেবেচিন্তে আশ্বস্ত হলেন, তা না। হলে এতক্ষণে আর দেখতে হত না। জ্বর, বমি, পেটের অসহ্য কামড় তো শুরু হয়ে যেতই। তারপর কামড়ের জায়গায় ঘা থেকে গ্যাংগ্রিন হতেই বা কতক্ষণ। হয় একেবারে কেটে বাদ, কি চামড়া বদল ছাড়া সারাবার কোনও উপায় নেই।
এ সব হত ওই আপনার কী বললেন—লকলকে কীসের কামড়ে? ধনু চৌধুরির গলায় দু আনা অবিশ্বাসের সঙ্গে চোদ্দো আনা আতঙ্ক।
লকলকে কী নয়, লক্সোসেলেস রেকলুস। ঘনাদা এবার ব্যাখ্যা করলেন, নেহাত খুদে একরকম মাকড়সা, মাপে আধ ইঞ্চি, কিন্তু বিষ একেবারে সর্বনাশা, আলোয় দেখা দেয় না। কোণে-কানাচে, কাপড়-জামার ভাঁজে ছায়া-ছায়ায় লুকিয়ে থাকে। সহজে ধরাও যায় না।
কিন্তু আমাদের দেশে তো এমন মাকড়সা নেই। এ সর্বনাশা তা হলে আসবে কোথা থেকে? ধনু চৌধুরির শেষ আশার কুটো ধরবার চেষ্টা।
আসবে ওই দেশলাইয়ের বাকসে আর পাঠাবে টেকসাস-এর সেই লুই মার্ডেন, যাকে শয়তানির জন্য একবার আড়ংযোলাই দিয়েছিলাম। মনে পড়ছে মার্ডেনের কথা?
শেষ প্রশ্নটা আমাদের প্রতি। ঘনাদার কৃপাদৃষ্টি আমাদের দিকে পড়া মাত্র কী চটপট যে আমাদের স্মরণশক্তি সাফ হয়ে গেল! গৌরই আমাদের হয়ে তার লক্ষ্মণের ফল ধরে রাখার মতো না-ছোঁয়া পুরো প্লেটটা ঘনাদার দিকে যেন তুলে বাড়িয়ে দিয়ে উৎসাহে মুখর হয়ে উঠল, মার্ডেনের কথা আর মনে নেই। সেই যে আপনার কাছে প্রায় কীচক বধ হয়ে যে প্রতিজ্ঞা করেছিল একদিন আপনাকে দেখে নেবেই। সে-ই তা হলে এতদিন বাদে ঠিকানা পেয়ে এই শোধ নেবার ব্যবস্থা করেছে?
হ্যাঁ, ঘনাদা অন্যমনস্কভাবে চিংড়ির কাটলেটে কামড় দিয়ে ফেলে হতাশভাবে বললেন, তাই এ ডেরা আমায় ছাড়তেই হবে। একটা দেশলাইয়ের বাকস পাঠিয়ে সে তো আর থামবে না। এরপর কিলবিল করবে এ বাড়িতে লক্সোসেলেস রেকলুস! সে বিপদে তোমাদের কী বলে ফেলব! এখনও তোমরা কিন্তু সাবধানে থাকবে। খুদে শয়তানগুলো কোথায় লুকিয়ে আছে কে জানে!
না, ঘনাদাকে বাহাত্তর নম্বর ছাড়তে হয়নি। তার বদলে ধনু চৌধুরি দুদিন বাদে পাওনা-টাওনা চুকিয়ে হঠাৎ বিদেয় নিয়ে গিয়েছে।
ধনুর্ভঙ্গটা সুতরাং ঘনাদার-ই।