দুনিয়ার ঘনাদা: গান

দুনিয়ার ঘনাদা: গান

গান

সাংঘাতিক অবস্থা বাহাত্তর নম্বরের।

কেন, কী হল?

কী আবার হবে! খেয়ে বসে সুখ নেই। রাত্রে ঘুম নেই।

কী হয়েছে কী আসলে?

যা হয়েছে তাই জানাতেই তো টঙের ঘরে সাত সকালে গিয়ে হাজির হয়েছি।

আমাদের চেহারাগুলোই আমাদের বক্তব্যের বিজ্ঞাপন।

শিশিরের চুলে অন্তত হপ্তাখানেক তেল পড়েনি। মাথাটা যেন কাকের বাসা!

গৌর দাড়ি কামায়নি ক-দিন তা কে জানে! জামাটা যে ময়লা আর বোতামগুলো যে ছেঁড়া তা-ও তার খেয়াল নেই।

শিবু গালে ক্ষুর লাগায়নি, মাথায়ও তেল ছোঁয়ায়নি তো বটেই, তার ওপর ক-দিন ক-রাত্রি ঘুম না হওয়ার প্রমাণ স্বরূপ দুচোখের কোণে কালি লাগিয়েছে।

আর আমি? ভয়ে ভাবনায় দিশেহারা হয়ে দুপাটির দুটো আলাদা জুতো দুপায়ে গলিয়ে ভুল করে শিবুর ঢাউস শার্টটাই গায়ে চড়িয়ে এসেছি।

টঙের ঘরে প্রায় ফাঁসির আসামির মতো কালিমাখা মুখে ঢুকে তক্তপোশের ধারে কোনও রকমে বসেও আমরা প্রথমটা যেন একেবারে বোবা হয়ে গেছি।

যা বলতে এসেছি আমাদের ভয়ে শুকনো গলা ঠেলে তা যেন বেরুতেই চায়নি।

কী করছেন তখন ঘনাদা?

না, একেবারে নির্বিকারভাবে তাঁর তক্তপোশটির ওপর বসে গড়গড়ায় টান দেননি। এমন কী তাঁর কেরাসিন কাঠের শেলফ হাতড়ে আশ্চর্য কিছু খুঁজে বার করবার চেষ্টাও তাঁর দেখা যায়নি।

একটু ভাল করে শার্লকি দৃষ্টিতে মেঝেটা লক্ষ করলে একটু যেন সন্দেহজনক ব্যাপারেরই আভাস পাওয়া যায়।

মেঝের ওপর গড়গড়ার কলকেটা টিকে ছাই ইত্যাদি ছড়িয়ে যেভাবে পড়ে আছে। তাতে মনে হয় কেউ যেন অসাবধানে তাড়াতাড়ি সেটা পা দিয়ে লাথিয়ে ফেলেছে।

কিন্তু তাঁর অত আদরের গড়গড়া আর সাজা কলকেতে তাড়াতাড়ি অসাবধানে পা লাগানো কি ঘনাদার পক্ষে সম্ভব?

অমন অসাবধান তিনি হবেনই বা কেন হঠাৎ বিচলিত না হলে?

ছাদের ওপরে দেখার আগেই সিঁড়িতে আমাদের পদশব্দ আর হাহাকার শুনেই ঘনাদা হঠাৎ বেশ একটু বিচলিত হয়ে তাঁর ঘরের দরজাটাই বন্ধ করতে যাচ্ছিলেন, আর তাতেই পা লেগে তাঁর গড়গড়া কলকে উলটে পড়েছে এমন একটি সিদ্ধান্ত কি করা যায় না!

আর সে সিদ্ধান্ত সঠিক হলে আমাদের সঙ্গে ঘনাদার একটা সমব্যথীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে নাকি?

সম্পর্কের সুতোটা অবশ্য এখনও অতি সূক্ষ্ম। খুব সাবধানে পাকাতে হবে, কারণ একটু চালের ভুল হলেই ছিঁড়ে যেতে পারে।

খুব সাবধানেই পাকটা দেওয়া হয়।

হাহাকারটা সিঁড়িতেই শেষ করে এসেছি। টঙের ঘরে ঢুকে তক্তপোশের ওপর বসবার পর ঘনাদাকে দেখেই যেন মুখে আর কথা ফুটতে চাইছে না।

শিবুই যেন প্রথম কোনও রকমে কথাটা তোলে। হতাশ ভাঙা গলায় বলে, কালও ঘুম হয়নি, ঘনাদা!

ঘুম হয়নি! ঘুম হয়নি! তিরিক্ষি মেজাজে খিঁচিয়ে ওঠে গৌর, ভাল লাগে না রোজ এই প্যানপ্যানানি। খালি নিজের সুখটুকুর ভাবনাই সারাক্ষণ। ঘুম আমাদের কার হচ্ছে শুনি!।

আহা, শিবুকে মিছিমিছি গাল দিয়ে লাভ কী! শিশির ক্লান্ত গলায় শিবুকে একটু সমর্থন করে, শুধু ওর নিজের কথা নয়, ও আমাদের সকলের অবস্থাটাই বোঝাতে চেয়েছে। মাথা গুলিয়ে আছে বলে কথাটা গুছিয়ে বলতে পারেনি।

থাক! শিবুর হয়ে অত ওকালতি তোমায় করতে হবে না। আমি গৌরের পক্ষ নিয়ে গরম হয়ে উঠি, আমাদের অবস্থা কি শুধু ওই ঘুম-না-হওয়া দিয়ে বোঝাবার। কেন ঘুম হচ্ছে না তার কিছু ঘনাদাকে দেখিয়েছে?

আমি পকেট থেকে একটা চৌকো কার্ড বার করে ঘনাদার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলি, দেখুন, ঘনাদা।

গড়গড়াতে টান বা শেলফ হাঁটকাবার মতো কোনও কিছুতে তন্ময় হবার ভান না করলেও আমরা ঢোকবার পর ঘনাদা বেশ একটু ছাড়ো-ছাড়ো ভাবই দেখাবার চেষ্টা করছিলেন।

কিন্তু আমি চৌকো কার্ডটা বার করবার পর সে নির্লিপ্ত দূরত্ব আর রাখতে পারেন না।

হাতের যে ছোট আয়নাটা অকারণেই সামনে তুলে রেখে মুখের কিছু যেন দেখবার ছল করছিলেন সেটা তাড়াতাড়ি ফতুয়ার পকেটে রেখে বেশ ব্যস্ত হয়ে কার্ডটা আমার হাত থেকে প্রায় ছিনিয়ে নেন।

তিনি যখন কার্ডটা দেখতে তন্ময় আমরা তখন মনসায় ধুনোর গন্ধ দিতে ত্রুটি করি না।

শিশির যেন সভয়ে বলে, ও কার্ড তুইও তাহলে পেয়েছিস?

বলার সঙ্গে সঙ্গে তার পকেট থেকে একটা ভিন্ন রঙের অনুরূপ কার্ড শিশির বার করে দেখায়।

শিবু ও গৌর কেউ পেছপাও থাকে না।

আমরাই কি পাইনি! বলে দুজনেই দুটো কার্ড বার করে তক্তপোশের ওপর মেলে ধরে।

ঘনাদাকে এবার তক্তপোশেরই অন্য প্রান্তে বসে পড়ে কার্ড চারটে মিলিয়ে দেখতে হয়।

চার রঙের হলেও কার্ডগুলো মাপে এক। আর প্রত্যেকটির ওপর এক পিঠে যা আঁকা তা একই ছবির নকশা।

আর কী সে নকশা! দেখলেই গায়ে আপনা থেকে কাঁটা দেবার কথা।

কার্ডের তলা থেকে ফণা-তোলা একটা সাপের মাথা উঠে চেরা জিভের সঙ্গে যেন মুখের ভেতর থেকে বিষের হল্কা বার করছে।

কার্ডের মাথায় শুধু তিনটি শব্দ লাল হরফে লেখা, এখনও সময় আছে।

এসবের মানে কী বলতে পারেন? কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করে শিবু, ক্রমশ তো অসহ্য হয়ে উঠল।

কারও বিদঘুটে ঠাট্টা-টাট্টা হতে পারে? আমি যেন হতাশার আশা হিসেবে একটা ব্যাখ্যা খাড়া করবার চেষ্টা করি।

ধমকও খাই তৎক্ষণাৎ।

ঠাট্টা! খিঁচিয়ে ওঠে গৌর, এই সব ভয়ংকর হুমকিকে ঠাট্টা ভাবছ! ঠাট্টা হলে স্বয়ং যমরাজই করছেন জেনে রাখো।

হ্যাঁ, বেনেপুকুরে ওই ভুল করে একজনদের সর্বনাশও হয়েছে। শিবু গৌরের সমর্থনে এবার একটা জবর গোছের নজিরই হাজির করে, একহপ্তা দুহপ্তা তিনহপ্তা বাড়ির কেউ গ্রাহ্য করেনি, পাড়ার বকা ছেলেদের বাঁদরামি ভেবেই উড়িয়ে দিয়েছে। তারপর–

তারপর কী? শিবুর নাটকীয়ভাবে থেমে যাওয়ার পর আড়চোখে একবার ঘনাদার দিকে চেয়ে নিয়ে প্রায় বুজে আসা গলায় জিজ্ঞাসা করি, কী হয়েছে তারপর?

ওই উড়িয়েই দিয়েছে! শিবুর সংক্ষিপ্ত জবাব।

উড়িয়েই দিয়েছে মানে? আমরা অস্থির হয়ে উঠি, বকা ছেলের বাঁদরামি বলে উড়িয়েই দিয়েছিল সেই বেনেপকরওয়ালারা। তাহলে আর হলটা কী?

উড়িয়ে-দেওয়া জবাবই পেল তাদের আহাম্মকির! শিবু এবার একটু ব্যাখ্যা করে বোঝায়, প্রথমে চিলেকোঠার ঘরটাই দিলে উড়িয়ে।

চিলেকোঠার ঘর! আমরা এ ওর মুখের দিকে তাকাই, তার মানে এই ছাদের ঘরটাই।

শিশির এই শুনেই গরম হয়ে ওঠে অদেখা অজানা আততায়ীদের ওপর—তা ওড়াতে হলে ছাদের ঘরটাই কেন? আর ঘর ছিল না সে বাড়িতে?

ঘর তো ছিলই! শিবু বুঝিয়ে দেয়, সে সবের কী হবে তার ইশারাও ছিল ওই উড়ে যাওয়া ঘরের বাইরের পাওয়া একটা চিরকুটে। তাতে লেখা ছিল—যা হবে তার প্রথম নমুনা।

কিন্তু আমাদেরও সেরকম নমুনা দেখাবে নাকি? আমার মুকখানা ঠিক ফ্যাকাশে না মারলেও গলাটা প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে ওঠে, তাহলে তো—

বাকি কথাটা উহ্য রেখে আমি সভয়ে ঘনাদার কাছেই যেন পাদপূরণটা চাই।

ঘনাদা পাদপূরণ করেন না, তবে কার্ডগুলো তুলে ধরে জিজ্ঞাসা করেন, এ কার্ডগুলো কবে এসেছে?

আজ্ঞে, একদিনে তো আসেনি। শিশির ঘনাদাকে সঠিক খবর দেয় ব্যস্ত হয়ে, প্রথম শিবুর নামে একটা কার্ড আসে ডাকে, আমাদের সেটা দেখাতে আমরা তা নিয়ে হাসিঠাট্টাই করেছি। তার পরে পায় গৌর—

ডাকে-টাকে নয়! গৌর রিলে রেসের ব্যাটনের মতো শিশিরের কথার খেইটা ধরে নেয়, খেলার মাঠ থেকে বাড়িতে এসে জামা খুলতে গিয়ে এক পকেটে শক্ত মতো কী একটা টের পেলাম। পকেট থেকে বার করে দেখি—এই কার্ড।

আমারটা আরও বিশ্রীভাবে পেয়েছি। গৌর থামতেই শিশির শুরু করে দিতে দেরি করে না, এই তো আর মঙ্গলবার ন-টার শো দেখে ফিরছি, হঠাৎ এই গলির মুখেই দাঁড়ান শুনে চমকে গেলাম। গলির আলোটার অবস্থা তো দেখেছেন। সেই যে কবে বালব চুরি গেছে, তারপর থেকে আর করপোরেশনের করা হয়নি। জায়গাটা ঘুটঘুটি অন্ধকার। তারই মধ্যে ইলেকট্রিক পোস্টটার পাশেই দুটি ছায়ামূর্তি যেন এগিয়ে এল। দুজনের গায়ে রেনকোট বা ওভারকোট গোছের কিছু, মাথার টুপিও মুখের ওপর টানা। আমার বেশ কাছে এসে দাঁড়াবার পরও তাদের মুখগুলো দেখতে পেলাম না। শুধু গলার স্বর যা শুনতে পেলাম তাতেই যেন ভেতরটা কেঁপে উঠল। সে কী দারুণ খাদের গলা। যেন পাতাল গুহা থেকে ভুতুড়ে চাপা আওয়াজ উঠে আসছে। সেই গলাতেই শুনতে পেলাম—আর পনেরো দিন মাত্র সময় পাবে, এই নাও তার পরোয়ানা।এই বলেই আমার হাতে কী একটা দিয়ে ওদিকের অন্ধকারেই যেন মিলিয়ে গেল। কোনও রকমে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে এসে পৌছে আলো জ্বেলে দেখি—এই কার্ড?।

আর আমার বেলা! শিশিরের বিবরণটায় উৎসাহিত হয়ে আমি তক্ষুনি শুরু করি, সে যা হয়েছিল তা ভাবলেই গায়ে এখনও কাঁটা দেয়।

তাহলে এখন আর ভেবে দরকার নেই। শিবু হিংসুকের মতো আমায় থামিয়ে দিয়ে বলে, তুইও কার্ড পেয়েছিস এইটুকুই আসল খবর। এখন কথা হচ্ছে, এগুলো পাঠাচ্ছে কারা?

কারা আবার? দাঁত খিঁচিয়ে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়ে বলতে ইচ্ছে করে কি না, এ কীর্তি আমাদের এই চার জাম্বুবানের?

নিজেরা সব ফলাও করে যে যার গল্প সাজালেন, আর আমার বেলাতেই শুধু খবরটাই যথেষ্ট। আমাকে বলতে দিলে যে নিজেদের গল্পগুলো কানা হয়ে যাবে!

এমন হিংসুটেদের সঙ্গে এক দণ্ড আর থাকতে ইচ্ছে করে না, তবু যে থাকি সে নেহাত আমার মহানুভবতায়। ওদের হিংসের বিরুদ্ধে আমার মহত্ত্বেরই জয় হয়। এবারও তাই উদার হয়ে ওদের ক্ষমা করে ফেলি শেষ পর্যন্ত!

তবু ফাঁস যখন হয়েই গেছে ব্যাপারটা তখন এখানেই খুলে বলি।

এবারের ষড়যন্ত্র ঘনাদাকেই বাগ মানাবার জন্য। তবে প্যাঁচটা একটু নতুন আর চালটাও আলাদা।

আগে থাকতে উদ্দেশ্যটা জানাবার দরুন আমাদের অনেক প্ল্যান ঘনাদা এ পর্যন্ত ভেস্তে দিয়েছেন। এবার তাই একেবারে চোরা লড়াইয়ের ব্যবস্থা। আমাদের আসল মতলব না জানিয়ে আচমকা হামলায় কাবু করে ফেলব। ঘনাদা ভেবে চিন্তে পিছলে পালাবার সময়ই পাবেন না।

প্ল্যানটা খুব ভাল করেই ছকা হয়েছে। তার প্রথম বুদ্ধিটা এক হিসেবে ঘনাদা নিজেই দিয়েছেন নিজের অজান্তে। সেদিন ছুটির সকালে তাঁর কাছে দুপুরের ভোজের মেনু ঠিক করতে গিয়ে তাঁকে একটু বিচলিতই মনে হয়েছিল। কারণটাও জানতে দেরি হয়নি। হাতের খবরের কাগজটা থেকে অত্যন্ত চিন্তিত মুখ তুলে বলেছিলেন, জঙ্গল! জঙ্গল! জঙ্গল হয়ে গেল কলকাতা শহর!

রসালো কিছুর আশায় তক্তপোশে চেপে বসে মুখচোখে যতদূর সাধ্য আতঙ্ক ফুটিয়ে জিজ্ঞাসা করেছি, কোথায়? কোন পাড়ায়, ঘনাদা? বাঘ-টাঘ বেরিয়েছে নাকি? সেই ঝাড়খালির সুন্দরী, থুড়ি সুন্দর বাঘ এই কলকাতায়?

বাঘ নয়, তার চেয়ে ভয়ংকর জানোয়ার! গম্ভীর মুখে বলেছেন ঘনাদা, বুঝলে কিছু!

আমরা হাঁ-করা হাঁদা সেজেছি।

মানুষ! মানুষ! ঘনাদা আমাদের জ্ঞান দিয়েছেন, এই কলকাতা শহরে তারই উপদ্রব বেড়েছে। এই দেখোনা, বুড়ো মানুষ পেনসন নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। বাড়ি দোরগোড়ায় পিস্তল ছোরা দেখিয়ে তাঁর সব সম্বল কেড়ে নিয়েছে, আর হুমকি দিয়ে আরেক পাড়ায় একটা গলির মুখই দিয়েছে বন্ধ করে। লোকজনকে আধঘণ্টার হাঁটুনি হেঁটে অন্য দিক দিয়ে ঘুরে যেতে হয়।

ঘনাদার বিক্ষোভ শুনতে শুনতে কথাটা একেবারে জিভের ডগায় এসে গিয়েছিল। অনেক কষ্টে সামলেছি নিজেদেরঘনাদার কাছে দুপুরের মেনুর ফর্দের সঙ্গে কলকাতার জঙ্গল সম্বন্ধে দামি দামি সব টিপ্পনি শুনে এসেই বসে গিয়েছিলাম আমাদের লক্ষ্যভেদের প্ল্যান ছকতে।

হ্যাঁ, এবারেও ঘনাদাকে বাহাত্তর নম্বর থেকে সরানোই আসল লক্ষ্য।

তবে সেই ঘনাদাকে ভোট দিন আন্দোলনের মতো চিরকালের জন্য বাহাত্তর নম্বর ছাড়াবার মতলবে নয়, দিঘা কি দার্জিলিঙের দ্বিধার মতো শখের বেড়াতে যাওয়া নিয়ে রেষারেষিও এর মধ্যে নেই। মাত্র মাসখানেকের জন্য ঘনাদাকে এখান থেকে কোথাও নিয়ে যেতে পারলেই হয়। অনুরোধটা আমাদের বাড়িওয়ালার আর গরজটা আমাদের নিজেদেরও।

বাড়িটার অনেকদিন ধরে পুরোপুরি সংস্কার হয়নি। খাপছাড়া তালিমারা এখানে সেখানে একটু আধটু মেরামত হয়েছে মাত্র।

আমাদের পেড়াপিড়িতে এই চড়া বাজারেও বাড়িওয়ালা চুন বালি সিমেন্ট দিয়ে পুরোপুরি বাহাত্তর নম্বরের ছাল চামড়া বদলাতে রাজি হয়েছেন। কিন্তু আধার্থেচড়া ভাবে সে কাজ তো আর হয় না। তাই পাছে হঠাৎ বেঁকে বসে বাধা দেন এই ভয়ে বাড়িওয়ালা ঘনাদাকে কোনও রকমে মাসখানেকের জন্য সরাবার অনুরোধ জানিয়েছেন।

এ অনুরোধ না রাখলেই নয়, কিন্তু ঘনাদা কি সেই শান্ত সুবোধ ছেলেটি যে একবার সাধলেই সুড়সুড় করে বাহাত্তর নম্বর থেকে বেরিয়ে আসবেন।

ঘাড় তিনি যাতে না বাঁকাতে পারেন তার চাল ভেবে যখন সারা হচ্ছি তখন তাঁর নিজের কাছ থেকেই হদিসটা পেয়ে গেলাম।

হ্যাঁ, কলকাতা মানে জঙ্গল এই সুরটাই খেলিয়ে ঘনাদাকে কাবু করতে হবে। আর ঘুণাক্ষরে আগে থাকতে ঘনাদাকে কিছু না জানিয়ে! বাহাত্তর নম্বর তেমন বিভীষিকা করে তুলতে পারলে উনি মানুষ নামে জানোয়ারের কলকাতা ছেড়ে খোকা বাঘ-সুন্দরের ঝাড়খালিতে যেতেও বোধহয় আপত্তি করবেন না। শুধু ভয়টাকে ঠিক মতো পাকিয়ে তুলে একেবারে স্ফুটনাঙ্কে মানে ফুট ধরতেই কথাটা পাড়া দরকার!

তাই জন্যেই এইসব পাঁয়তাড়া। শুধু শিউরে তোলবার ছবি আঁকা কার্ডই নয়, আরও অনেক রকম আয়োজনই হয়েছে। সাপের ছোবল আঁকা কার্ড ঘনাদাও পেয়েছেন, স্বীকার করুন আর না করুন। মাঝরাত্রে বাইরের দরজায় বিদঘুটে কড়া নাড়াও শুনেছেন সন্দেহ নেই।

হ্যাঁ, ওই এক মোক্ষম প্যাঁচ কষা হচ্ছে দু-একদিন বাদে বাদে প্রায় হপ্তা খানেক ধরে।

হঠাৎ মাঝরাত্রে বাইরের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। প্রথমে আস্তে, তারপর বাড়তে বাড়তে একেবারে পাড়া কাঁপানো আওয়াজ।

কে? কে? যেন ঘুম থেকে উঠে আমরা বারান্দা থেকেই চিৎকার করি। নেমে যাবার সাহস যেন কারওই হয় না।

ঘনাদা যে তাঁর টঙের ঘর থেকে বেরিয়ে ন্যাড়া সিঁড়ির ধারে আলসের কাছে। দাঁড়িয়েছেন তা টের পেয়ে আমরা আরও একটু হইচই বাড়াই।

বনোয়ারি—! বনোয়ারি—! রামভুজ! রামভুজ—! কোথায় গেল সব ওরা! সাড়া দেয় না কেন?

সাড়া দেবে কোথা থেকে?—আমাদেরই একজনের হঠাৎ যেন স্মরণ হয়— ওরা যে ক-দিন রাত্রে দেশোয়ালিদের গানের মজলিশে যাবার জন্য বাসায় থাকছে

সে কথা ভুলে গেছ?

তাহলে? তাহলে, শিবু যেন একটু ভেবে আমার দিকে চেয়েই সমস্যাটার সমাধান করে ফেলে, হ্যাঁ, তুই-ই একবার দেখে আয় না নীচে গিয়ে দরজাটা খুলে!

আমি? আমি যাব!—আমায় আর ভয়-তরাসেরঅভিনয় করতে হয় না—তার চেয়ে, কী বলে, সবাই মিলেই তো গেলে হয়।

প্রথম রাত্রে সবাই মিলেই নেমে গিয়েছিলাম। গিয়ে বড় রাস্তার চায়ের দোকানের ছোকরাটাকে কথা-মতো একটা আধুলি দিয়ে, এর পর থেকে এখানে নয়, দোকানেই পাওনা মিলবে জানিয়ে ফিরে এসেছিলাম যেন ভয়ে বেসামাল হয়ে।

ওপরে এসে কাঁপা গলায় এলোমেলো এমন আলাপ চালিয়েছিলাম যাতে ব্যাপারটার রহস্য যেমন দুর্বোধ্য তেমনই ভয়ংকর হয়ে ওঠে।

কই, কেউ মানে কাকেও তো দেখতে পেলাম না!

এত রাত্রে অমন কড়া নাড়ার মানেটা কী!

এখনও মানে জিজ্ঞাসা করছ? এখনও বুঝতে কিছু বাকি আছে?

তার মানে, মানে আমাদের এখানে থাকতে দেবে না!

না। আপাতত তো নয়।

চুপ চুপ, আস্তে!

এর মধ্যে ছায়াটা সরে যাবার আভাস পেয়ে মনে হয়েছে প্যাঁচটা নেহাত বিফল হয়নি।

ওষুধ যে ধরতে শুরু করেছে তা টের পেয়েছি পরের দিন থেকেই। ঘনাদা তাঁর সন্ধের আসরে যাচ্ছেন না এমন নয়, কিন্তু ফিরছেন একটু বেশি তাড়াতাড়ি। সেই সঙ্গে সারাদিন সদর দরজা বন্ধ রাখা সম্বন্ধে যেন একটু অতিরিক্ত সজাগ হয়ে উঠেছেন।

এ কয়দিনের প্রস্তুতি পর্বের পর আজ হাওয়াটা সব দিকেই অনুকূল মনে হচ্ছে। বক্তার বদলে এমন মনোযোগী শ্রোতার ভূমিকায় ঘনাদাকে বড় একটা দেখা যায় না।

আপাতত এ কাজ কাদের হতে পারে সেই গবেষণাই চলছে।

শিশির বুঝি ওয়াগন ব্রেকারদের কথা বলছিল। কোনও একটা গ্যাং, তাদের মালগাড়ি লুটের মাল রাখবার জন্য এ বাড়িটা হাত করতে চাচ্ছে, এই তার অনুমান!

ছো! বলে এ অনুমান নস্যাৎ করে দিয়ে গৌর তখন বলেছে, ওয়াগন ব্রেকার! ওয়াগন ব্রেকার এখানে আসবে কোথা থেকে? কাছে পিঠে রেললাইন আছে কোনও! উঁহুঁ, ওসব নয়।

গৌর তারপর রীতিমতো লোমহর্ষক একটা থিওরি খাড়া করে। তার মতে এ কাজ নিশ্চয়ই কোনও আন্তর্জাতিক গুপ্তচর দলের। তারা এক ঘাঁটিতে বেশিদিন থাকে না। একবার এখানে, একবার ওখানে আস্তানা বদলায়। আর সে আস্তানা জোগাড় করে এমনই হুমকি দিয়ে। তাদের অসাধ্য কিছু নেই, আর মায়াদয়ারও তারা ধার ধারে না! একটা ঘাঁটি জোগাড় করতে দু-দশটা জান খরচ তাদের কাছে ধর্তব্যই নয়।

কিন্তু এদের কাজটা কী? কী করে এরা! বিস্ফারিত চোখে জিজ্ঞাসা করি আমি!

কী না করে! গৌর যেন সামনে মাইক ধরে বলে যায়, এই যে দেশে এত গণ্ডগোল, এত সমস্যা, চুরি ছিনতাই রাহাজানি, নিশানে নিশানে হানাহানি, লাল নীল কালোবাজার ঘাটতি বাড়তি উঠতি পড়তি রকবাজ সাবোটাজ, পুরো দামে কম কাজ, ধর্মঘট লক আউট তুফান খরা বন্যা চাল তেল কয়লার জন্য ধরনা এ সব কিছুর মূল হল তারা। দেশটার আখের যাতে মাটি হয় তাই সারাক্ষণ তুর্কি নাচন নাচিয়ে সব কিছু ভণ্ডুল করে দেওয়াই তাদের মতলব।

তা এমন একটা গুপ্তচর দলের কথা ঘনাদা কি আর জানেন না!

কথাটা বলে ফেলেই নিজের আহাম্মুকিটা বুঝতে পেরে মনে মনে জিভ কাটি।

এই এক ছুতো পেয়ে ঘনাদা একটি গল্প ফেঁদে বসলেই তো সর্বনাশ! আমাদের আসল উদ্দেশ্যই তাহলে মাটি। আজ ঘনাদার কাছে গল্প তো চাই না, চাই তাঁকে বেশ একটু ভড়কে দিয়ে বাহাত্তর নম্বরটা ক-দিনের জন্য ছাড়াতে।

আমার ভুলে এত কষ্টের আয়োজনের পর ঘাটের কাছে বুঝি ভরাড়ুবি হয়।

গৌরই সে বিপদ থেকে বাঁচায় অবশ্য।

ঘনাদা এই ছুতোটাই ধরতেন কি না জানি না। কিন্তু তিনি মুখ খোলবার আগেই গৌর যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার ওপর ঝাঁঝিয়ে ওঠে, ঘনাদা জানবেন মানে? এ কি ওপারের সেই সব বনেদি কোনও দল! নেহাত চ্যাংড়া গুপ্তচরদের মহলের সেদিনকার উঠতি মস্তান বলা যায়! ঘনাদারই এখনও নাম শোনেনি! তা না হলে বাহাত্তর নম্বরে মামদোবাজি করতে আসে।

সেই জন্যেই ভাবছি, একটু থেমে গৌর যেন গভীরভাবে কী ভেবে নিয়ে বলে, এই সব চ্যাংড়াদের যখন বিশ্বাস নেই তখন দু-চারদিন মানে মানে একটু সরে গেলে বোধহয় মন্দ হয় না। ওদের দৌরাত্মি তো মাসখানেকের বেশি নয়। তার মধ্যে নিজেরাই খতম হয়েও যেতে পারে। সেই মাসখানেক একটু চেঞ্জে ঘুরে এলে ক্ষতি কী? তাও দিঘা কি দার্জিলিঙ নয়, এই ডায়মন্ড হারবারে। গাঙের ধারে বাড়িটা মিনিমাগনা পাচ্ছি।

আমরা সবাই সোৎসাহে সরবে এ প্রস্তাব অনুমোদন করি।

বলিস কী! ডায়মন্ড হারবারে এমন বাড়ি!

গাঙের ধার মানে তো মিনি সমুন্দুর!

আর এক পা বাড়ালেই তো ডায়মন্ড হারবার। যাওয়া আসার কোনও হাঙ্গামাই নেই।

তা ছাড়া ওখানকার টাটকা মাছ! তপসে পারশে ভেটকি ভাঙর আর ইলিশ গুড়জাওলি একবার মুখে দিলে আর ডায়মন্ড হারবার ছাড়তে ইচ্ছে হবে না।

গদগদ উচ্ছাসের মধ্যে ঘনাদার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিতেও ভুলি না।

না, বেয়াড়া কোনও লক্ষণ সেখানে দেখা যায় না। একটু গম্ভীর—যেন একটু ভাবিত। তা সেটা তো স্বাভাবিক।

জো বুঝে আসল কথাটা পেড়ে ফেলে শিশির, কাল সকালেই তা হলে রওনা হচ্ছি, ঘনাদা! যত তাড়াতাড়ি পারি বেরিয়ে পড়ব। আপনি তো খুব ভোরেই ওঠেন।

ঘনাদা উত্তরে শুধু বলেন, হ্যাঁ, তা উঠি।

ব্যস! এর বেশি আর কীভাবে মত দেবেন ঘনাদা! আমাদের মতো দু বাহু তুলে ধেই ধেই করে নৃত্য করবেন নাকি? স্পষ্ট হ্যাঁ তিনি বলেননি, কিন্তু না-ও তো তাঁর মুখ দিয়ে বেরোয়নি।

আমরা আহ্লাদে আটখানা হয়ে নীচে নেমে যাই। সারাদিন তোড়জোড় চলে। বাহাত্তর নম্বর ছাড়বার। ঘনাদার সঙ্গে আর কোনও আলাপ আলোচনায় ঘেঁসি না, পাছে কোনও ভুল বোলচালে পাকা খুঁটি কেঁচে যায়।

ঘনাদাকে একবার বিকেলের দিকে বেরুতে দেখি। ফেরবার সময় মুখটা যেন হাসি-হাসি মনে হয়। আর আমাদের পায় কে?

মাঝরাত্রে সেদিন বাইরের কড়া নাড়াটা শুধু একটু বাড়িয়ে দেওয়া হয়, অদ্য শেষ রজনী বলে।

পরের দিন সকালে জিনিসপত্র গুছোনো বাঁধাছাঁদার মধ্যেই একবার ঘনাদাকে দেখে আসা উচিত মনে হয়। যাবার আগে কোনও সাহায্য-টাহায্য তো দরকার হতে পারে।

কিন্তু ন্যাড়া সিঁড়ি দিয়ে চিলের ছাদ পর্যন্ত উঠেই যে পা দুটো সেখানে জমে যায়। টঙের ঘরের খোলা দরজা দিয়ে যে-দৃশ্য দেখা যাচ্ছে তা কি সত্যি, না দুঃস্বপ্ন!

ঘনাদা নিশ্চিন্ত নির্বিকার হয়ে তাঁর খাটো ধুতির ওপর ফতুয়াটি গায়ে দিয়ে এক হাতে গড়গড়ার নল ধরে টান দিতে দিতে তক্তপোশের ওপর উবু হয়ে বসে কাগজ পড়ছেন!

এ কী, ঘনাদা! ভেতরে গিয়ে এবার বলতেই হয় হতভম্ব হয়ে, ভুলে গেছেন। নাকি?

ঘনাদা কাগজ থেকে মুখ না তুলেই বেশ মধুর কন্ঠে আমাদের আশ্বাস দেন, না, ভুলব কেন?

তবে এখনও তৈরি হননি যে? আমাদের বিমূঢ় জিজ্ঞাসা।

হইনি, দরকার নেই বলে। ঘনাদার দৃষ্টি এখনও খবরের কাগজের ওপর, গানটা দিয়ে দিলাম কিনা।।

গানটা দিয়ে দিলেন!তক্তপোশের ধারে আমাদের বসতে হয় এবারে, কিন্তু খুব সানন্দে সাগ্রহে নয়।

বিস্মিত প্রশ্নটা কিন্তু আপনা থেকেই গলা দিয়ে বেরিয়ে গেল, গান দিয়ে দিলেন কাকে? কেন?

কেন দিলাম! এতক্ষণে খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে ঘনাদা আমাদের ওপর কৃপাদৃষ্টি বর্ষণ করলেন, না দিলে এ সব উৎপাত বন্ধ হয় না যে। আর দিলাম মাৎসুয়ো-কে।

কে এক মাৎসুয়োকে কী গান দিলেন আর তাইতে সব উৎপাত বন্ধ হয়ে যাবে বলে আমাদের আর কোথাও যাবার দরকার নেই বলছেন!

আমরা ঘুরপাক খাওয়া মাথাটাকে একটু থামাবার চেষ্টা করে প্রথম রহস্যটাই জানতে চাইলাম—মাৎসুয়ো আবার কে?

ঘনাদা যেন অপ্রস্তুত হয়ে একটু হাসলেন।

ও, মাৎসুয়ো কে তা তো তোমরা জান না। কিন্তু মাৎসুয়ো পরিচয় দিতে হলে ইয়ামাদোর কথাও বলতে হয়, আর যেতে হয় প্রশান্ত মহাসাগরের প্রায় মাঝামাঝি টোঙ্গা দ্বীপপুঞ্জের উত্তরে এমন দুটি ফুটকিতে সাধারণ ম্যাপে অনুবীক্ষণ দিয়েও যাদের পাত্তা পাবার নয়। নাম লিমু আর নিফা, ঠিক কুড়ি অক্ষাংশের দুধারে একশো চুয়াত্তর থেকে পঁচাত্তর দ্রাঘিমার মধ্যে দুটি ছেলেখেলার দ্বীপ। একটি দু মাইল আর অন্যটি বড় জোর দেড় মাইল লম্বা, কিন্তু এই মহাসমুদ্রে এই দুটি মাটির ছিটে নিয়েই মাৎসুয়ো আর ইয়ামাদোর মধ্যে কাটাকাটি ব্যাপার। লিমু দ্বীপটা মাৎসুয়োর আর নিফার মালিক ইয়ামাদো। গত মহাযুদ্ধের সময় দুজনেই জাপানের নৌবাহিনীতে ছিল। ওই অঞ্চলেই যুদ্ধের কাজে থাকতে হয়েছিল বলে দুজনেই ওই দ্বীপমালার রাজ্যকে ভালবেসে ফেলে। যুদ্ধ থামবার পর দেশে ফিরেও তারা ভোলে না। কিছুকাল ব্যবসা বাণিজ্য করে বেশ কিছু রোজগার করে দুই বন্ধুই ওই অঞ্চলে গিয়ে পাশাপাশি দুটি দ্বীপ কেনে।

দুজনের বন্ধুত্বে সেইখানেই দাঁড়ি। নিজের নিজের দ্বীপকে একেবারে অতুলনীয় স্বর্গ বানিয়ে ফেলার রেষারেষিতে দুজনেই যেন দুজনের মাথা নিতেও পেছপাও নয়।

ঠিক সেই সময় আমার সঙ্গে মাৎসুয়োর দেখা। দেখা না বলে ঠোকাঠুকিই বলা উচিত। জাপানের হোক্কাইদো দ্বীপের পাহাড়ে তুষার-ঢাল দিয়ে সে রাত্রে মশাল হাতে নিয়ে আমি কি করে নামছি।

কী করে নামছেন? শিবুর প্রশ্নটার ধরনে ভক্তিভাবের একটু যেন অভাব মনে হল।

স্কি করে, ঘনাদা প্রশান্তভাবেই বলে চললেন, রাত্তিরে মশাল নিয়ে স্কি করায় একটা আলাদা উত্তেজনা আছে। জাপানে মশাল নিয়ে স্কি করায় তাই খুব উৎসাহ। তবে দক্ষিণের সব স্কি-ঘাঁটিতে এ খেলা চললেও ঢাল একটু বেশি আর বিপজ্জনক বলে হোক্কাইদোতে মশাল নিয়ে স্কি কেউ বড় করে না।

মশাল নিয়ে মনের আনন্দে নামতে নামতে সেই জন্যই বেশ একটু অবাক হচ্ছিলাম কিছুক্ষণ থেকে। আমার পেছনে মশাল নিয়ে আর-একজন কে যেন নেমে আসছে। আর নামছে রীতিমতো বেগে। হোক্কাইদোর তুষার পাহাড়ের ঢাল রাত্তিরবেলা একেবারে নির্জন। অন্য কোথাও হলে এক আধজন স্কিয়ার তবু দেখা যায়। এখানে ওপরের লজ কেবিন পর্যন্ত বন্ধ। স্কিলিফট নেই বলে আমি সিঁড়ি-পা ফেলে ফেলে পাহাড়ের মাথায় উঠেছি। আমার মতো এই রাত্রে স্কি করবার বেয়াড়া শখ আবার কার!

কিন্তু শখই শুধু বেয়াড়া নয়, লোকটা যে একেবারে রাম আনাড়ি মনে হচ্ছে। নামছে একেবারে পাগলা ঘোড়ার মতো, কিন্তু কোথায় নামছে তার যেন ঠিক নেই। এত চওড়া তুষার ঢাল পড়ে থাকতে আমারই ঘাড়ের ওপর পড়তে যাচ্ছে যে!

গোঁয়ার্তুমি করে এই রাত্রে স্কি করতে নেমে এখন তাল সামলাতে পারছে না নাকি? সত্যিই পেছন থেকে ঘাড়ের ওপর এসে পড়লে তো সর্বনাশ। দুজনের শরীর স্কি আর চাকা লাঠিতে জড়াজড়ি হয়ে গড়াতে গড়াতে একেবারে গুঁড়ো হয়ে যাব যে!

এ বিপদ এড়াবার জন্যে যা যা সম্ভব সবই করলাম। প্রথম স্টেম বোগেন নিলাম।

কী নিলেন! স্টেনগান? আমাদের হাঁ করা মুখের প্রশ্ন—গুলি করবার জন্য?

না, স্টেন গান নয়, স্টেম বোগেন! ঘনাদা অনুকম্পার হাসি হাসলেন একটু ওটা হল স্কি করার সময় এক রকম বাঁক নেওয়া। মোঙ্গল আর ল্যাপদের কাছে। বিদ্যেটা শিখলেও নরওয়ে-সুইডেনই প্রথম স্কি-টা ইউরোপে চালু করে বলে শব্দটা স্ক্যান্ডিনেভিয়ান।

আমাদের জ্ঞান দিয়ে ঘনাদা আবার তাঁর বিবরণ শুরু করলেন—স্টেম বোগেন-এ খুব সুবিধা হল না। লোকটার আমার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়াই যেন নিয়তি।

কিন্তু সত্যি কি তাই?

স্টেম বোগেন-এর পর স্টেম ক্রিস্টিয়ানা বাঁক নিলাম, কিন্তু লোকটা তখনও যেন আঠার মতো পেছনে লেগে আছে। যে রকম আনাড়ি তাকে ভেবেছিলাম তা-ও তো সে নয়। শক্ত শক্ত উত্রাই-এর ঢাল আর বাঁক বেশ ভালই সামলাচ্ছে। মরিয়া হয়ে নামছে বলে প্রায় ধরেও ফেলেছে আমায়।

তাহলে আমায় জেনেশুনে জখম কি খতম করা কি তার মতলব? কেন? লোকটাই বা কে?

এ সব প্রশ্নের জবাব ভাববার তখন সময় নেই, যেমন করে হোক লোকটার মতলব ভেস্তে দিতে হবে।

তা-ই দিলাম। পর পর দুটো স্টেম বোগেন আর স্টেম ক্রিস্টিয়ানা বাঁক নিয়ে তাকে ঝেড়ে ফেলতে না পেরে ওই শক্ত তুষারেই নরম তুষারের সুইস টেলেমার্ক বাঁক নিয়ে ঘুরেই লাঙ্গল-পা করে থেমে গেলাম।

লোকটা আমার একেবারে গা ঘেঁসে ছিটকে গিয়ে খানিক দূরে ঘাড়মুড়ো গুঁজে পড়ল।

ভাবলাম ঘাড় ভেঙে শেষই হয়ে গেল বুঝি। কিন্তু তা হয়নি। খুব কড়া জান। হাড়গোড় ভাঙা নয়, একটা পা মচকানোর ওপর দিয়েই ফাঁড়াটা গেছে।

ধরেটরে কোনও রকমে তুললাম। এখন তাকে নীচে নিয়ে যাওয়াই সমস্যা।

কিন্তু নিয়ে যাব কাকে? খোঁড়া হয়েও লোকটার কী রোখ! আর আমারই ওপরে।

জাপানিতে সে যা বললে বাংলার চেয়ে হিন্দিতে বললেই তার ঝাঁঝটা বুঝি একটু ভাল বোঝানো যায়।

তাকে ধরে তোলবার আগে থেকেই সে আমার ওপর তম্বি শুরু করেছে। তুমকো হাম খুন করেঙ্গে, মারকে কুত্তাকো খিলায়েঙ্গে—এই হল তার বুলি।

ব্যাপারটা কী? লোকটা পাগল-টাগল নাকি!

না, তা তো নয়। মশালটা ভাল করে মুখের কাছে ধরতে মুখটা চেনাচেনাই লাগল। সঠিক মনে পড়ল তার পরেই।

হ্যাঁ, টোকিওর উয়েনো স্টেশন থেকে রওনা হবার সময় ছুটির দিন পড়ায় স্কিয়ারদের দারুণ ভিড় হয়েছিল। কলেজের ছেলেমেয়ে আর কমবয়সি চাকরেদের ভিড়ই বেশি। স্কি নিয়ে তারা সবাই জাপানের কোনও-না-কোনও স্কি রিসর্ট-এ যাচ্ছে। ট্রেন আসবার পর ঠেলাঠেলি করে ওঠবার সময় কে যেন পেছন থেকে আমায় টেনে চলন্ত গাড়ি থেকে ফেলে দেবার চেষ্টা করেছিল। তখুনি ফিরে চেয়ে হাতেনাতে কাউকে ধরতে পারিনি, কিন্তু এই মুখটাই যেন তার ভেতর দেখেছিলাম মনে হচ্ছে।

শুধু উয়েনো স্টেশনে কেন, তার আগে আরও দু-তিন জায়গায় এই মুখটা দেখেছি বলে মনে পড়ল। লোকটা যেন বেশ কিছুকাল ধরে আমার পিছু নিয়েছে। কেন?

দুটো স্কিকে জুড়ে একটা স্ট্রেচার গোছের বানিয়ে তার ওপর লোকটাকে শোওয়াবার ব্যবস্থা ইতিমধ্যে করে ফেলেছি। সেই অবস্থায় তাকে তুষারের ওপর দিয়ে টেনে টেনে নিয়ে যেতে যেতে সেই কথাই জিজ্ঞাসা করলাম—কে তুমি? আমার পিছু নিয়েছ কেন?

ওই অবস্থাতেই লোকটা গজরে উঠল, তোমায় খুন করবার জন্য!

বেশ সাধু উদ্দেশ্য! হেসে বললাম, কিন্তু খুন করাই যদি তোমার নেশা হয় এই মহৎ কাজটার জন্য আমার চেহারাটাই পছন্দ হল কেন! এ পৃথিবীতে তো শুনি তিনশো কোটি মানুষ গিজ গিজ করছে। তাদের কাউকে মনে ধরল না!

না, তুমিই আমার একমাত্র শত্রু। সে দাঁতে দাঁত চেপে সাপের মতো হিসহিসিয়ে উঠল, ইয়ামাদোর সঙ্গে মিলে তুমি আমার কী সর্বনাশ করেছ জানো না।

ও, তুমি তাহলে মাৎসুয়ো! লিমু দ্বীপের মালিক! এতক্ষণে অন্ধকারে আলো দেখতে পেলাম, কিন্তু তোমায় তো আমি কখনও চোখেও দেখিনি, তোমার লিমুতেও কখনও পা দিইনি।

তা দিলে তো তোমায় কুচি কুচি করে কেটে হাঙরদের খাওয়াতাম! মাৎসুয়ো যেন মুখ দিয়ে আগুনের হলকা ছাড়ল, তুমি লিমুতে আসোনি, কিন্তু ইয়ামাদোর হয়ে তার নিফা থেকে কী বিষ মন্তর ঝেড়ে আমার সোনার লিমু ছারখার করে দিয়েছ, জানো! আমি বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম আর ইয়ামাদো তো নেহাত চাষার ছেলে। আমি বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে আমার লিমুকে মর্তের স্বর্গ বানিয়ে তুলেছিলাম। সেই স্বর্গ তুমি শ্মশান করে দিয়েছ।

তুমি বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলে! একটু হেসেই বললাম, হ্যাঁ, ইয়ামাদোর অনুরোধে একবার তার দ্বীপে বেড়াতে গিয়ে তোমার সঙ্গে তার রেষারেষির কথা শুনেছিলাম বটে। তোমার নামটাও সেই সময়ে শুনি আর তুমি যে তোমার লিমুকে নন্দন কানন বানাবার জন্য যা কিছু সম্ভব বিজ্ঞানের সাহায্য নিচ্ছ সে খবরও পাই। তখনই তোমার সম্বন্ধে তোমাদেরই একটা জাপানি প্রবাদ আমার মনে এসেছিল রঙ্গো ইয়োমি নো রঙ্গো শিরজু! এখন আমার বিরুদ্ধে তোমার আক্রোশের কারণ শুনেও সেই প্রবাদই আবার শোনাচ্ছি–রঙ্গো ইয়োমি নো রঙ্গো শিরজু।

তখন তুষার পাহাড়ের ঢাল থেকে নীচের বসতিতে পৌঁছে গেছি। সেখানে অ্যাম্বুলেন্স গাড়িতে তুলে মাৎসুয়োকে হাসপাতালে ভর্তি করবার ব্যবস্থা করলাম। তার জন্য যাই করি, মাৎসুয়ো কিন্তু তখনও আমার ওপর সমান খাপ্পা। তার ক্যাবিন থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসবার সময় গলায় যেন বিষ ঢেলে বললে, পা খোঁড়া হয়েছে বলে তুমি আমার হাত থেকে পরিত্রাণ পাবে ভেবেছ! আমি অর্ধেক পৃথিবী ঘুরে হোক্কাইদোর স্কি ঘাঁটিতে যেমন তোমায় খুঁজে বার করেছি তেমনই যেখানেই যাও তোমার নিশ্চিত শমন হয়ে দেখা দেবই এই কথাটি মনে রেখো।

আমি তাহলে তোমাদের প্রবাদটাই এবার আমার বাংলা ভাষায় বলি, মাৎসুয়ো। বেশ একটু গম্ভীর হয়েই বললাম, তোমার বেদ মুখস্থ, কিন্তু বুদ্ধি ড়ু টু। তোমার নিজের সর্বনাশ তুমি নিজেই করেছ এইটুকু শুধু বলে যাচ্ছি। আর কথাটা যদি ধাঁধা মনে হয় তাহলে তার উত্তর বার করবার জন্যে ক-টা ইশারাও দিয়ে যাচ্ছি—তোমার আখের খেত, বুফো ম্যারিনাস আর বছরে চল্লিশ হাজার।

এই বলেই চলে এসেছিলাম হোক্কাইদো থেকে। তারপর এতকাল বাদে গড়িয়াহাট মোড়ে কাল বিকেলে আবার দেখা। না, সে মাৎসুয়ো আর নেই। ভাবনায় চিন্তায় দুনিয়াভর টহলদারির ধকলে পাকা আম থেকে শুকিয়ে আমসি হয়ে গেছে। সে খ্যাপা নেকড়েও এখন একেবারে পোষা খরগোশ। আমায় দেখে রাস্তার ওপরই পায়ের ধুলো নেয় আর কী!

পায়ের ধুলো! মুখ দিয়ে কথাটা বেরিয়ে গেল, জাপানিরা আজকাল আবার পায়ের ধুলো নিতে শিখেছে নাকি।

আহা, মাৎসুয়ো আর কি জাপানি আছে নাকি! ঘনাদা ঝটপট সামলে নিলেন, এবাংলায় ও বাংলায় আমায় খুঁজতে খুঁজতে আধা নয়, চৌদ্দ আনাই বাঙালি হয়ে গেছে। এই তোমাদের মতোই প্রায় চেহারা।

ঘনাদা আমাদের চেহারাগুলো একবার যেন চেক করে নিয়ে আবার শুরু করলেন, আফশোসেরও তার সীমা নেই, আমাকে মিছিমিছি শত্রু না মনে করলে কত আগেই তার সব মুশকিল আসান হয়ে যেত সেই কথা ভেবেই তার বেশি দুঃখ। আমি যে তিনটে ইশারা দিয়েছিলাম তাই থেকেই সে তার লিমু দ্বীপের অভিশাপের রহস্য বার করে ফেলে। কিন্তু তার নিজের অতি বুদ্ধির প্যাঁচই এখন তার নাগপাশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বলতে বলতে মাৎসুয়ো রাস্তায় দাঁড়িয়েই হাঁফাচ্ছিল। চিনে হলে হবে না, জাপানি রেস্তোরাঁই বা কোথায় পাব। সামনে যে ময়রার দোকান পেলাম তাতেই নিয়ে গিয়ে বেশ একটু ভাল করে মাৎসুয়ো-কে কচুরি শিঙাড়া খাইয়ে চাঙ্গা করে তুললাম।

ঘনাদা থামলেন। ইঙ্গিতটাও মাঠে মারা গেল না। আমরাও বুঝলাম। বাহাত্তর নম্বর থেকে ঠাঁই বদল যখন হবেই না তখন মিছে আর মেজাজ বিগড়ে থেকে লাভ কী! আমাদের দিক দিয়ে অনুষ্ঠানের ত্রুটি যাতে না থাকে শিশির তাই চট করে একবার নীচে থেকে ঘুরে এল। তারপর চ্যাঙাড়ি ভর্তি কচুরি শিঙাড়া তো এলই, টিন ভর্তি সিগারেটও।

ঘনাদা কেমন অন্যমনস্কভাবে গোটা কৌটোটাই হাতাবার সঙ্গে সঙ্গেই অর্ধেক চ্যাঙাড়ি ফাঁক করে যেন মাৎসুয়োর খিদের বহরটাই আমাদের বুঝিয়ে দিলেন। তারপর শিস-দেওয়া কৌটো খুলে শিশিরকে উদার হয়ে একটা বিলিয়ে আর নিজে একটা ধরিয়ে রামটান দিয়ে নতুন করে শুরু করলেন, হ্যাঁ, মাৎসুয়োর দুঃখের কাহিনী শুনে এবার বলতেই হল, আসলে ওই বুফো ম্যারিনাসই যে তোমার লিমু দ্বীপের কাল তা এখন বুঝেছ তো? ইয়ামাদোর নিফা দ্বীপে অতিথি হবার সময়েই আখের খেতের নারকুলে পোকা মারতে তোমার এই বুফো ম্যারিনাস আমদানির কথা শুনে আমি রঙ্গো ইয়োমি নো রঙ্গো শিরজু বলে তোমাদের প্রবাদটা আওড়েছিলাম। সত্যিই এটা পুকুরের বোয়াল মারতে খাল কেটে কুমির আনার শামিল আর বেদ মুখস্থ বুদ্ধি ড়ু টু-র দৃষ্টান্ত। বিজ্ঞানের সাহায্য নিতে গিয়ে তুমি মূর্থের মতো বেয়াকুবি-ই করেছ। তোমার আমদানি করা বুফো ম্যারিনাস এসে প্রথমে আখের খেতের সব পোকা ঠিকই সাবাড় করেছে, তারপর হয়ে উঠেছে রূপকথার সেই অজর অমর রাক্ষুসির পাল। রক্তবীজের মতো দিন দিন বেড়ে এরা তোমার গোটা লিমু দ্বীপটাকেই পেটে পুরতে চলেছে। লম্বায় এরা আধ হাতেরও ওপরে, ওজনে কম-সে কম সওয়া কিলো। ভাল মন্দ সব পোকামাকড় শেষ করেও এদের খিদে মেটে না, খাবার মতো সাপ ব্যাঙ যা পায় এরা অম্লান বদনে গিলে ফেলে। এদের গায়ের গ্রন্থির এক রকম রসে কুকুর বেড়াল মারা যায় আর বছরে প্রায় চল্লিশ হাজার গুণ বেড়ে এরা যেখানে থাকে সেই জায়গাই শ্মশান করে তোলে।

আজ্ঞে ঠিকই বলেছেন, আমার কথার পর ককিয়ে উঠল মাৎসুয়ো। ওই বুফো ম্যারিনাস-ই সব সর্বনাশের মূল জানবার পর আমি আমার সমস্ত লোকজন নিয়ে দ্বীপ থেকে তাদের নির্মূল করবার আয়োজন করেছি। কিন্তু অমন করে মেরে কটাকে শেষ করা যায়। বছরে চল্লিশ হাজার যারা ডিম পাড়ে, তাদের একশোটা যখন মারি তখন হাজারটা নতুন করে জন্মায়। নিরুপায় হয়ে আমি টোঙ্গা সামোয়া থেকে ভাড়া করা ধাঙড় আনালাম। একটা বুফো মারলে দশ টাকা। কিন্তু তাতেও রক্তবীজের ঝাড় বেড়েই যাচ্ছে। একেবারে হতাশ হয়ে শেষ পর্যন্ত আপনার খোঁজেই এসেছি, এ অভিশাপ কাটাবার উপায় কিছু আছে কি না জানতে। তা যদি না থাকে তো লিমুতে আর ফিরব না। একেবারে নিরুদ্দেশ হয়ে যাব।

নিরুদ্দেশ তোমায় হতে হবে না, মাৎসুয়ো! একটু সান্ত্বনা দিয়ে এবার বললাম, এ সমস্যা তোমার শুধু ওই লিমু দ্বীপের নয়! অস্ট্রেলিয়ার মতো বিরাট দেশও আজ এই সমস্যা নিয়ে দিশাহারা। তবে হতাশ হয়ো না। উপায় আছে। একমাত্র গান দিয়েই তোমার লিমুকে এখন বাঁচানো যায়।

গান! আমাদের চোখই ছানাবড়া—গান দিয়ে লিমুকে বাঁচাবেন!

হ্যাঁ, মাৎসুয়ো-ও ওই প্রশ্ন করেছিল, অবোধকে বোঝাবার হাসি হাসলেন ঘনাদা, তাকে তাই বলতে হল যে ওষুধপত্র গুলিবারুদ কোনও কিছুতে কিছু হবে। বুফো ম্যারিনাস-এর সমস্যার ফয়সালা যদি কিছুতে হয় তো গানে-ই হবে। চৌরঙ্গির একটা বড় রেডিও গ্রামোফোন ইত্যাদির দোকানে তাকে নিয়ে গিয়ে টেপ রেকর্ডে খানিকটা গান তুলে দিয়ে বললাম, যেটুকু মনে আছে তাতে এই টেপটুকু যেমনভাবে বলে দিচ্ছি সেইভাবে বাজালেই কাজ হাসিল হবে বলে বিশ্বাস। নির্দেশগুলো তারপর একটু ভাল করে বুঝিয়ে দিয়ে চলে এসেছি। মাৎসুয়ো কৃতজ্ঞতায় গদগদ হয়ে আজ-কালের মধ্যেই লিমুর জন্য রওনা হবে। সুতরাং আর কোনও উপদ্রবের ভয় নেই।

তা তো নেই, কিন্তু বুফো ম্যারিনাস কী বস্তু আর আপনি সব সংকট-মোচন যে টেপটা তাকে দিলেন সেটি কীরকম গানের?

বুফো ম্যারিনাস হল এক জাতের কোলা ব্যাঙ। ঘনাদা সদয় হয়েই আমাদের বোঝালেন, আদি জন্ম দক্ষিণ আমেরিকায়। সেখান থেকে হাওয়াই ঘুরে অস্ট্রেলিয়ায় আমদানি হয়েই সর্বনাশ করতে শুরু করেছে। টেপে তুলে যে গানটা মাৎসুয়োকে দিলাম সেটা এই ব্যাঙ বাবাজি বুফো ম্যারিনাস-এরই বিয়ের গান বলতে পারো। মদ্দা ব্যাঙ গলা ফুলিয়ে এই গান গাইলে তার টানে দলে দলে কনে ব্যাঙেরা সব হাজির হয়। সুবিধে-মতো জায়গায় এ গান বাজিয়ে তাই চল্লিশ হাজারি ডিমের ব্যাঙবউদের ধরে কোতল করা যায়। কিছু দিন একাজ করতে পারলেই বুফো ম্যারিনাস-এর বংশ সব নির্বংশ।

কিন্তু ওই কোলা ব্যাঙের বিয়ের গান আপনি গাইলেন কী করে?

ঠিক কি আর গাইতে পেরেছি! ঘনাদা বিনয় দেখালেন, তবে দক্ষিণ আমেরিকায় ঘোরবার সময় বনে বাদাড়ে শুনে যেটুকু মনে ছিল তাই একটু গেয়ে দিয়েছি। ওতেই অবশ্য কাজ যা হবার হবে। ব্যাঙবরেরাও সবাই নিশ্চয় কালোয়াত নয়।

কিন্তু, আমাদের প্রশ্ন তখনও শেষ হয়নি, আপনার ওই মাৎসুয়ো আপনার ওপর অত ভক্তিমান হয়ে উঠবার পরও অমন ভয় দেখানো কার্ড পাঠাচ্ছিল কেন?

ওটা ভয়ে! ভয়ে! ঘনাদা যেন স্নেহের প্রশ্রয়ের হাসি হাসলেন, প্রথমেই সোজাসুজি আমার কাছে আসতে সাহস করেনি। তাই আগেকার ধরনটাই রেখে তারই ভেতর আমায় পরীক্ষা করে দেখবার কায়দা করেছিল। আমি অবশ্য গোড়াতেই কার্ডগুলো দেখেই বুঝেছিলাম। ওতে ছবিগুলো ভয়ের, কিন্তু সেই সঙ্গে মাৎসুয়োর নামটাও, জাপানি গুপ্ত হরফে লেখা।

তাই লেখা নাকি!

আমরা পরস্পরের মুখের দিকে চেয়ে বেশ একটু ঘুরপাক খাওয়া মাথা নিয়েই নীচে নেমে গিয়েছি এরপর। এ অবস্থায় শিশিরের সিগারেটের গোটা টিন-টাই ফেলে আসা খুব স্বাভাবিক নয় কি?

শেষ চমকটা অবশ্য তখনও বাকি ছিল।

বড় রাস্তায় চায়ের দোকানে গিয়েই সেটা পেলাম। সেখানকার চা-পরিবেশনের ছোকরাকে সেদিন থেকে আর রাত্রে কড়া না নাড়বার কথা জানাতে গেছলাম। তার দরকার হল না।

আমাদের দেখেই একটু বিষণ্ণ মুখে বেরিয়ে এসে সে বললে, আজ থেকে আর মাঝরাত্রে কড়া নাড়তে হবে না তো বাবু!

না, হবে না। কিন্তু তোমায় বললে কে?

আজ্ঞে, ওই আপনাদের বড়বাবু! কাল বিকেলে আর ক-দিন একাজ করতে হবে জানতে যাচ্ছিলাম। উনি তখন বেড়াতে বার হচ্ছেন। ওঁকেই জিজ্ঞাসা করতে জানিয়ে দিলেন যে আজ থেকে কড়া নাড়া বন্ধ।

সকালে একবারের বেশি চা আমরা কেউ খাই না। কিন্তু এরপর ওইখানেই বসে পড়ে পর পর কড়া করে দুকাপ না গলায় ঢেলে আর উঠতে পারলাম না।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত