বিকেলবেলা পার্কে বসে থাকাটা আমার ছোটবেলার অভ্যাস।খুব বেশি জরুরি কোন কাজ না থাকলে বিকেলবেলাটা পার্কেই বসে থেকে কাটিয়ে দেই।একা একা যখন একমনে পার্কের বেঞ্চে বসে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি তখন আমি নিজেই আশেপাশের মানুষগুলোর কাছে দর্শনীয় বস্তুতে পরিণত হই।
পার্কে ইদানীং একলা আসা হয়।দাদুর শরীর প্যারালাইসিস হবার পর একলাই আসি এখন।আগে দাদুর সাথেই আসতাম। পৃথিবীতে দাদুভাইকে ছাড়া কোনদিনই কাউকে আপন বলে মনে হয় নি। সকল কিছু আমি তার কাছেই শেয়ার করতাম। অবশ্য খুব বেশি কিছু শেয়ার করার মতো ছিলোও না। পড়াশোনা করতাম শুধু।বন্ধুমহলও তেমন ছিলো না। বাবা-মা কেমন হয় সে সম্পর্কে ধারণা খুব কম ছিলো। কারণ তারা দুজনেই একই সাথে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। তখন আমার বয়স ২ বছরের মতো হবে।আমার স্মৃতিতে তাই বাবা-মার চেহারা ভেসে উঠে না কখনো। দাদু বলতে গেলে আমাকে একা হাতে লালনপালন করেছেন।
আজকে পার্কে এসে প্রচন্ড ভীঁড় লক্ষ্য করলাম।তারপর মনে পড়লো আজ ‘ভালোবাসা দিবস’।সবাই নিজেদের প্রিয় মানুষের সাথে সময় কাটাচ্ছে। দাদু সুস্থ থাকলে অবশ্য দিনটার কথা মনে থাকতো। কারণ ভালোবাসা দিবসে সকাল সকাল দাদু আমাকে কিছু না কিছু উপহার দিতো। দাদুর হয়তো ঠিকই মনে আছে আজও।কিন্তু বলতে পারেননি।আমার এখন আফসোস হচ্ছে।আমার মনে রাখা উচিত ছিলো। আজকে পার্কে বসার মতো একটা বেঞ্চও খালি নেই।তাই একটা বড় গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ালাম। দূর থেকে একটা ঘটনা খেয়াল করছি।একটা ছোট্ট ছেলে বয়স ৭-৮ বছরের মতো হবে সে তার চেয়েও একটা ছোট মেয়েকে থাপ্পড় দিলো।ছেলেটার হাতে অনেকগুলো গোলাপ ফুল।ছোট মেয়েটার বয়স হয়তো ৩-৪ বছর হবে। মেয়েটা কান্না করছে। আমি ওদের সামনে গেলাম।আমাকে দেখেই ছেলেটা বলে উঠলো…
>>গোলাপ ফুল নিবেন স্যার।একটা ৬০ টাকা।আম্মায় কইয়া দিছে আইজ ৬০টাকার কমে যানি একটাও না বেঁচি।
>>না রে আমি গোলাপ ফুল নিবো না।কিন্তু এই পিচ্চিটা কে??তুই ওরে মারলি কেনো??
>>এইডা আমার ছোডো বইন।আর কইয়েন না স্যার এইডারে আমি আনবার চাই নাই।বাড়িত থাকলে আম্মারে জ্বালায় সারাক্ষণ।আম্মার অবস্থা আইজ ভীষণ খারাপ তাই আম্মায় অরে আমার সাথে পাঠায় দিছে।
>>কিন্তু তুই মারতাছিস কেনো ওকে??
>>অয় একটা গোলাপ ফুল চাইতাছে।
আমি অরে রাস্তার পাশের জঙ্গল থেকে কয়ডা ফুল আইন্না দিছি।
কিন্তু অয় নিবো না।অয় গোলাপ ফুলই চাইতাছে। কানডা জ্বালায় ফেলতাছে স্যার। আপনেই কন অরে দিয়া দিলে অয় শুধু শুধু নষ্ট করবো।আম্মার ওষুধের টাকা হইবো না তাইলে। এইজন্য দিছি অরে থাপড়া একটা।এখন চুপ থাকবো।
>>তোর আম্মুর কী হইছে।ওষুধ লাগবে কেনো??
>>১ মাস ধইরা জ্বরে পইড়া আছে।জ্বর নিয়াই বেচতো ফুল।কিন্তু ২ দিন ধইরা উঠবারই পারে না।তাই আমি ফুল বেচি এখন।
>>তোর আব্বু কি করে??
>>বাপরে জীবনে কোনদিন দেখি নাই স্যার। ছেলেটার এই কথাটা খুব কলিজায় লাগলো।আমারও তো বাবা নাই।কিন্তু ওর মা আছে।আমারতো মা ও নাই।
>>স্যার নেন না একটা ফুল।আইজকা অনেকেই নিতাছে।কাইল এই ফুল ২০ টাকা দিয়াও কেউ নেই নাই।আইজ আম্মা ঠিকই কইছিলো ৬০ টাকা দিয়াই সবাই নিতাছে।আইজ অনেক টাকা পামু স্যার।আম্মার জন্য ওষুধ নিবার পারুম।
>>তুই বরং একটা ফুল পিচ্চিটারে দে।আমি টাকা দিয়ে দিবো।
>>কি কন স্যার অর জন্য আপনি টাকা দিবেন ক্যান।অয় আর ফুল চাইবো না।দেখছেন না ঠান্ডা হয়ে গেছে এক থাপ্পড় খেয়ে।
>>আচ্ছা যা তোর সবগুলো ফুলই আমি কিনবো।
>>সত্যি কইতাছেন স্যার?তাইলে খুব ভালা হইবো।আম্মার জন্য তাড়াতাড়ি ওষুধ নিবার পারুম।
>>তোর আম্মারে ডাক্তার দেখাইছিস??
>> কিযে কন স্যার।জ্বরের ওষুধ কিনার টাকাই পায় না আম্মায়।ডাক্তার কেমনে দেখাইবো।
>>আচ্ছা চল তোর বাসায় যাবো আজ।তোর আম্মারে দেখে আসি।ওষুধ কিনে নিয়ে যাই চল।তোরা কই থাকিস
>>রেললাইনের পাশের বস্তিতে থাকি। আপনে কী সত্যই যাইবেন আমগো বাড়িতে??
>>হ্যাঁ যাবো চল।
আমি পিচ্চি মেয়েটার হাতে ফুলগুলো দিয়ে দিলাম।যাওয়ার সময় দুজনকে নিয়ে বিকালে নাস্তা করলাম। ওদের মায়ের জন্যও নাস্তা নিয়ে নিলাম।আর সাথে জ্বরের কিছু ওষুধ নিলাম। বস্তিতে বিভিন্ন গলি ঘুরিয়ে আমাকে একটা ছোট্ট খুপড়িতে নিয়ে এলো ছেলেটা।অনেক লোকের ভীড় সেখানে।কয়েকজন বলাবলি করছে এখানে কেউ মারা গেছে। গিয়ে দেখি একটা মেয়ে বিছানায় পড়ে আছে। এই মেয়েটাই এদের মা।আমি হাত ধরে দেখলাম হাতটা ঠান্ডা হয়ে আছে।নিঃশ্বাস পড়ছে না।বুঝলাম সত্যি সত্যি ওদের আম্মা মারা গেছে। ছেলেটার মনে একটা আতঙ্ক।পিচ্চি মেয়েটার সেদিকে কোন খেয়াল নেই।সে বাড়িতে এসে ছোট ভাঙা একটা পুতুল দিয়ে আপন মনে খেলা শুরু করে দিয়েছে।
>>স্যার আম্মায় কী মইরা গেছে??ওষুধ খাইলে ঠিক হইবো না??
এই কথাটার কী জবাব দেবো জানা ছিলো না আমার। ছেলেটা যখন বুঝতে পারলো তার মা সত্যি সত্যি মারা গেছে।তখন হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো। পিচ্চি মেয়েটা খেলছিলো।কিন্তু তার ভাইকে কাঁদতে দেখে সেও কান্না শুরু করলো। লাশটা দাফন করতে করতে রাত ১০ টার মতো বেজে গেলো।ছেলেটারে কবরের পাশ থেকে কেউই সরাতে পারছেনা।বস্তির অনেকে এদের এতিমখানায় দিয়ে আসার পরামর্শ দিচ্ছে। আমি দুজনকে নিয়ে আমার বাসার দিকে রওনা দিলাম।ছেলেটা কেঁদেই যাচ্ছে।পিচ্চি মেয়েটা কিছুক্ষণ থমকে থাকছে আবার মা মা বলে কাঁদছে। ও জানে না ওর মা কখনো সে ডাক শুনবে না।
বাসায় ফিরে দাদুকে বললাম,’দাদু তোমার জন্য ভালোবাসা দিবসের উপহার এনেছি।’ তারপর সব ঘটনা খুলে বললাম দাদুকে। সুস্থ থাকলে হয়তো আমার পিঠটা চাপড়ে দিতেন দাদু। বাচ্চাগুলোকে সান্ত্বনা দিতেন।কিন্তু দাদুর সেই ক্ষমতা এখন আর নেই।ঠোটটা হালকা বাঁকিয়ে মুচকি একটা হাসি দিলেন দাদু। ছেলেটা তখনও কেঁদেই চলছিলো। আমিও কী কাঁদবো কি না ভাবছি।কারণ ছেলেটির মতো আমার মা-বাবাও যে নেই।