শান্তিপর্বে ঘনাদা
চিলের ছাদে যাবার ন্যাড়া সিঁড়িতে উঠতে উঠতেই আমরা সবাই থ।
এ কী শুনছি, কী!
না, শোনার ভুল নয়, সত্যিই টঙের ঘর থেকে পয়ার ছন্দে গাঁথা কাব্য-লহরী ভেসে আসছে। কণ্ঠটা অবশ্য কিঞ্চিৎ রাসভ-বিনিন্দিত, কিন্তু তাতেও তার লালিত্য ঝংকার একেবারে মেরে দিতে পারেনি।
দাঁড়িয়ে পড়ে একটু শুনতেই হয়।
..মুনি বলে, অবধান করহ রাজন।
হস্তিনা নগর মাঝে ধর্মের নন্দন॥
মহাধর্মশীল রাজা প্রতাপে তপন।
শীলতায় চন্দ্র যেন, তেজে বৈশ্রবণ॥
সর্বত্র সমানভাবে গুণে গুণধাম।
প্রজার পালনে যেন পূর্বে ছিল রাম॥
নানা বাদ্য বাজে সদা শুনিতে কৌতুক।
হস্তিনা নগরবাসী সবাকার সুখ॥…
মহাভারত বলে মনে হচ্ছে না?
হ্যাঁ, নির্ঘাত মহাভারত! কাশীরাম দাসেরই সই যেন পাচ্ছি।
হঠাৎ আমাদের এই বাহাত্তর নম্বরের বাতাস পবিত্র করতে এ সব আমদানি কেন!
ব্যাপারটা বুঝতে ছাদ পর্যন্ত গিয়ে আরও শুনতে হয়।
জাতিবন্ধু কন সবে সতত আনন্দ।
মহারাজ বিদ্যাশীল সকলি স্বচ্ছন্দ॥
রাজার প্রসাদে রাজ্যে সকলের সুখ।
মৌন হয়ে মহারাজ একা অধোমুখ।
নাহি রুচে অন্নজল কান্দিয়া ব্যাকুল।
পাত্র মিত্র ভ্রাতা আদি ভাবিয়া আকুল॥
নৃপতির শোকে শোকাতুর সর্বজন।
একসঙ্গে ভীম পার্থ মাদ্রীর নন্দন॥
পাত্র-মিত্রবন্ধু আর ধৌম্য তপোধন।
নানামতে নৃপে করে প্রবোধ অর্পণ॥
অনেক প্রকারে সবে বুঝায় রাজারে।
যোগমার্গ কথা কহি অনেক প্রকারে॥
এতক্ষণে গুটি গুটি পা ফেলে টঙের ঘরে সবাই পৌঁছে গেছি।
সেখানে যা দেখি সকলেই তাতে ভ্যাবাচাকা।
ঘনাদার এ আবার কী রূপ!
তক্তপোশের ওপর এদিকে ওদিকে ভারী ভারী ডবল থান ইটের মতো সব বই সাজানো। তার মাঝখানে কাঠের বইদানির ওপর প্রায় এক বিঘত চওড়া একটি বই খুলে ঘনাদা সুর করে মহাভারত পড়ছেন!
আমাদের দেখে ঘনাদা একটু কুটিভরে মুখ তুলে চাইলেন।
ভ্রূকুটিটা আমাদের উদ্দেশে ভেবে একটু ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু তাঁর পরের মন্তব্যে বোঝা গেল ভ্রুকুটির লক্ষ্য ভিন্ন।
না, নেই! নেই!—ঘনাদার গলায় রীতিমত তিক্ত বিক্ষোভ-স্রেফ বাদ দিয়ে দিয়েছে। আর বর্ধমান কাটোয়ার ইন্দ্রাণী পরগণার সিদ্ধি গ্রামের কমলাকান্তের পো কাশীরামের তো তা জানার ভাগ্যই হয়নি।
মুখে আমাদের কথা নেই, কিন্তু আমাদের চেহারাগুলোই চারটি হাঁ করা জিজ্ঞাসার চিহ্ন।
ঘনাদা তাই দেখেই একটু সদয় হন বোধ হয়। বলেন, কী বলছি, বুঝতে পারছ না নিশ্চয়! বলছি মহাভারতের কথা—আদি ও অকৃত্রিম মহাভারত।
আজ্ঞে, কী যেন নেই বলছিলেন! আমাদের মুখে এই বিস্ময়টুকুই ফোটে।
হ্যাঁ, দেখছি, নেই! ঘনাদা একটু বিশদ হন—কোথাও নেই! কাশীরাম দাস, সঞ্জয়, শঙ্কর, শ্রীকর নন্দী, কবীন্দ্র পরমেশ্বর, নিত্যানন্দ ঘোষ, কৃষ্ণানন্দ বোস, পরাগল খাঁর মহাভারতে তো নয়ই, এমনকি ব্যাসদেবের নামে যা চলছে সেই মূল মহাভারতেও না।
একটু থেমে আমাদের বোধহয় একটু দম নিতে দিয়ে ঘনাদা আবার একটা অ্যাটমিক টিপ্পনি ছাড়েন—নেই বটে, তবে ছিল।
কোথায়? ধরা-গলায় প্রশ্ন করি।
তা বলে দিলেই তো অর্ধেক রহস্য ফাঁস। তবু সেটুকুও বলে দিচ্ছি।—প্রথমে একটু বাঁকা হাসি হাসলেও ঘনাদা কৃপা করে আমাদের আর অজ্ঞান-তিমিরে রাখেন না—ছিল শান্তি পর্বে রাজধর্মানুশাসন পর্বাধ্যায়ের তৃতীয় খণ্ডে।
যেমন ছিল তেমনই থেকেই যেত। যুদ্ধটুদ্ধ শেষ করে পাণ্ডবরা সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে রাজত্ব করতে যাচ্ছেন তখন ঘটা করে হস্তিনাপুরের রাজপ্রাসাদে ঢোকবার মুখে যা হয়েছিল তা ঠিকঠিকই বর্ণনা করা থাকত মহাভারতের পাতায়।
তোমরা বলতে পারো, ঘনাদা আমাদের মনের কথাই যেন আঁচ করে বলেন, তাই না হয় থাকত! তাতে হতটা কী? ওই জগদ্দল আঠারো পর্বের পুথির পাহাড়ের আশি হাজার শ্লোক ঘেঁটে কে ওই কেচ্ছাটা খুঁজে বার করতে যেত! আর গেলেই পেত নাকি?
দিঘার বালির তীরে দুটো ভাঙা ছুঁচ খোঁজা তো তার চেয়ে সোজা!
তার চেয়ে থাক না যেমন আছে তেমনই আশি হাজার শ্লোকের মধ্যে হারিয়ে। কী দরকার ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে লোকের নজরে পড়বার!
এই বুদ্ধিই দিয়েছিল নকুল সহদেব।
ভীমসেনেরও তা মনে ধরেছিল। তিনি অবশ্য আর-একটা যুক্তিও দিয়েছিলেন। সে যুক্তিটা আরও জোরালো।
আরে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধটুদ্ধ পর্যন্ত শেষ হয়ে আমাদের রাজত্ব পাবার পর মহাভারতে আর পড়বার কি কিছু আছে যে লোকে কষ্ট করে পাতা ওলটাবে? বলেছিলেন ভীমসেন-গণেশঠাকুরের কলম চালিয়ে শুধু আঙুল টনটন-ই সার। ব্যাসদাদুর ওসব বকবকানি শুনতে কারও দায় পড়েছে।
কিন্তু পুরুতঠাকুরের ঘ্যানঘ্যানানি তাতেও থামেনি।
পুরুতঠাকুর মানে ধৌম্য শর্মা। পঞ্চপাণ্ডবদের সঙ্গে সেই আদিপর্ব থেকেই আঠার মতো লেগে আছেন।
হাজার হোক সুদিনে দুর্দিনে সমানভাবে যিনি সঙ্গে থেকেছেন তাঁর আবদার-বাহানা একটু রাখতেই হয়। কিন্তু আবদারটা যে বড় বেয়াড়া।
শান্তিপর্বের অশান্তির ব্যাপারটুকু মহাভারত থেকে বাদ দিতে হবে।
তা না দিলে নাকি সর্বনাশ হয়ে যাবে। দেশে নীতি ধর্ম বলে আর কিছু থাকবে না। রাজার রাজত্ব লাটে উঠবে। দেবতা বামুন কেউ আর মানবে না। ক্রিয়াকর্ম পুজো-আচ্চা সব কিছু যাবে উঠে।
বলছেন কী, পুরুত মশাই! সভাঘরের দোরগোড়ায় ওই কী-একটু কথা কাটাকাটি, তা মহাভারতে থাকলে একেবারে সৃষ্টি রসাতলে যাবে!
তা তো যাবেই-ধৌম্য শর্মার সেই এক কাঁদুনি–আর স্বয়ং মহারাজ যুধিষ্ঠিরের নামটাই ইতিহাসে পুরাণে যে কালিমাখা হয়ে থাকবে।
কখনও না! জোর গলায় হুঙ্কার দিয়ে একবার প্রতিবাদও করেছিলেন মধ্যম পাণ্ডব, বড়দার নামে কেচ্ছা করে কার এত বড় বুকের পাটা দেখি। তেলে ছাতু করে দেব না!
গলার হুংকারে আর হাতের গদার আস্ফালনের ভয়ে দু-পা পেছিয়ে গেলেও ধৌম্য শর্মা নিজের কোট ছাড়েন না।
কাঁপা গলাতেই বলেন, আরে, তুমি গদা হাঁকিয়ে ক-জনকে থামাবে! হস্তিনাপুরে
হয় সবাই ভয়ে মুখ খুলবে না, কিন্তু অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গ কোশল মদ্র মৎস্যের কানাকানি থামাবে কী করে? আর তাও যদি পারো, তবু এই ত্রেতা থেকে কলি পর্যন্ত তোমার গদা কি পৌছবে?
তাহলে উপায়? যেমন করে হোক, আশি হাজার থেকে অন্তত এই গণ্ডা দুয়েক শ্লোক সরিয়ে দিতেই হবে।
তাই তো! ভীমসেনকে বেশ ভাবিত হতে হয়, কিন্তু শোলোক কটায় আসলে কী আছে বুঝিয়ে বলুন তো!
ধৌম্য বুঝিয়েই বললেন। বৃকোদর বাহাদুরের রদ্দা-খাওয়া নিরেট মাথায় সবটা ঠিক ঢোকে এমন নয় কিন্তু ঢোকে না বলেই পুরুতঠাকুর মশায়ের কথায় বিশ্বাসটা বাড়ে।
না, ওই বিষমাখা শোলোক ক-টা মহাভারত থেকে বাদ না দিলেই নয়।
কিন্তু উপায়টা তার কী?
ব্যাসদাদুকে এ নিয়ে জ্বালাতন করতে গেলে তিনি তো এবার নির্ঘাত শাপমন্যি দিতেন। কিন্তু তাঁকে পাওয়াই বা যাচ্ছে কোথায়। তিনি তো গোটা মহাভারতটি উগরে দিয়ে তাঁর জন্মস্থান সেই কৃষ্ণ দ্বীপে গিয়ে অজ্ঞাতবাস করছেন।
গণেশঠাকুরকেও কিছু বলে লাভ নেই। তিনি সেই হিড়িম্বের সঙ্গে যুদ্ধের ব্যাপারটা কাটছাঁট করা থেকেই পঞ্চপাণ্ডবের ওপর বেশ একটু ব্যাজার হয়ে আছেন। এ নতুন আবদার করতে গেলে পুরনো কেচ্ছাটাই হয়তো আবার ঢুকিয়ে দেবেন।
তাহলে শেষ ভরসা কৃষ্ণের সারথি সেই দারুক। আরবারের মতো একটা উপায় যদি বাতলে দেয়। কিন্তু কিছুদিন ধরে দারুকের যে দেখাই নেই। নোলার ঠেলায় ভালমন্দ খাওয়ার লোভে ভীমসেনের ভোজসভাতেও হাজিরা দেয়নি।
সে তাহলে আছে কোথায়? করছে কী?
শ্রীকৃষ্ণ অবশ্য ভীষ্মদেবের মহাপ্রয়াণের পর বাবা-মাকে দেখার জন্য দ্বারকায় গেছেন। কিন্তু দারুক রথ চালিয়ে তাঁকে দ্বারকায় পৌঁছে দিয়েই তো ফিরে এসেছে হস্তিনাপুরে।
এখানে এসেও তার এমন উধাও হবার মানে কী?
দারুকের খোঁজ করতে করতে হস্তিনাপুর প্রায় চষে ফেলার পর দারুককে পাওয়া গেল, মানেটাও বোঝা গেল তার অন্তর্ধানের।
দারুক কারবারে নেমেছে। দারুণ লাভের কারবার।
কারবারটা কীসের?
তা বোঝা বেশ শক্ত। হস্তিনাপুরের বিপণিকেন্দ্র মানে বড়বাজারে নয়, সেই যাকে বলে মান্ধাতার আমলের রাজা হস্তীর সময়কার এক এঁদো পুরোনো গলির মধ্যে প্যাঁচার কোটরের মতো দারুকের ছোট্ট একটা দোকানঘর।
তা তো বুঝলাম, কিন্তু মান্ধাতার আমলের রাজা হস্তীটা কে?
কে আবার? পাণ্ডবদের ঠাকুরদার ঠাকুরদা রাজা প্রতীপ, তাঁর সাতপুরুষ আগেকার অতি বৃদ্ধ প্রপিতামহ কুরু। সেই কুরুর আবার চার পুরুষ আগেকার বৃদ্ধ প্রপিতামহ হলেন রাজা হস্তী। শহরটা তিনিই পত্তন করেছিলেন বলে তার নাম হস্তিনাপুর।
সেই সাবেকি এঁদো গলির কোটরের মতো একটা কুঠুরিতে কারবার খুললে কী হয়, দারুক তাতেই দিনে দিনে ফুলে ফেঁপে ঢোল।
কারবারটা হয় কী ভাবে তাও ধরবার উপায় নেই।
সারাক্ষণ বেচাকেনার খদ্দের আসছে যাচ্ছে এমন তো নয়। দিনে কেন, হপ্তায় একবার একজন এলেই কিন্তু কাম ফতে।
যারা আসে তারাও কেমন যেন চোরের মতো আসে লুকিয়ে চুরিয়ে। দিনের চেয়ে রাতের অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়েই বেশি।
এসে দারুকের সঙ্গে কী যেন গুজগুজ ফুসফুস করে। তারপর উত্তরীয়র আড়ালে লেনদেন যা হবার হয়।
লেনদেন যা হয় তা যে মোটা কিছু সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। নইলে দারুকের অত রবরবা কীসের?
রথ চালাবার বদলে সে নাকি তার নিজেরই চড়বার রথ বানাবার বায়না দিয়েছে। হস্তিনাপুরের খানদানি রাজাগজাদের পাড়ায় বাড়িই কিনে ফেলেছে একটা।
এমন ফলাও কারবারের অমন চোরাগলির ঠিকানা কেন?
সেইটেই বুঝতে পারেননি ভীমসেন। দারুকের এ আস্তানা খুঁজে বার করতে কি কম হয়রানি হয়েছে! পাঁচ-পাঁচটা তাঁর চর পাঁচ দিন হস্তিনাপুর চষে ফেলে তবে ঠিকানা এনে দিয়েছে ভীমসেনকে।
যে সে তো আর এখন নয়। ভীমসেন দস্তুরমতো এখন যুবরাজ। যেমন-তেমন জায়গায় তাঁর যাওয়া কি আর এখন চলে।
তবু গরজ বড় বালাই। দারুককে বারবার ডেকে পাঠিয়েও কোনও লাভ হয়নি। আসব, আসব বলেও সে এখনও সময় পায়নি আসবার। মধ্যম পাণ্ডবের বাড়ির ভুরিভোজের নেমন্তন্ন সত্ত্বেও।
অগত্যা পুরুতঠাকুর ধৌম্যকে সঙ্গে নিয়ে ভীমসেনকেই যেতে হয় পুরনো হস্তিনাপুরের সেই এঁদো গলিতে। একটু ছদ্মবেশেই অবশ্য যান। কিন্তু ওই পাহাড়-প্রমাণ-চেহারা কি ছদ্মবেশে লুকোবার!
সন্ধের পর অন্ধকারে পিঠে পাঁচমণি বস্তা নিয়ে মুটে সেজে গেলেও রাস্তায় কারও কারও চোখে পড়তেই হয়। আর একবার যার চোখে পড়ে সে আবার মুখ ঘুরিয়ে একটু না দেখে পারে না। হস্তিনাপুরের মতো পালোয়ানদের শহরেও ওরকম একটা চেহারা তো খুব সুলভ নয়!
যাই হোক কোনওমতে তো খুঁজে পেতে সে এঁদো গলিতেই পৌঁছনো যায়, কিন্তু আসল কাজ হাসিল করাই যে দায় হয়ে ওঠে।
এমনিতেই ঠিকানা চিনে গলি দিয়ে আসতে আসতে পুরুতঠাকুরের একবার ভিরমি যাবার অবস্থা হয়েছে।
এ পথ ও পথ ঘুরে দারুকের গলিতে সবে ঢুকতে যাচ্ছেন এমন সময় আর্তনাদ করে ধৌম্য শর্মা ভীমসেনকেই জড়িয়ে ধরলেন। ভীমসেনকেও তখন অবশ্য ভয়ে না হোক, বিস্ময়ে থমকে দাঁড়াতে হয়েছে।
ব্যাপারটা চমকে দেবার মতো ঠিকই। একে আঁকাবাঁকা সরু গলি, তার ওপর অন্ধকার। সেই অন্ধকারে সামনে থেকে এসে পিপের মতো প্রকাণ্ড কী যেন একটা জানোয়ার বিদঘুটে আওয়াজ করতে করতে ছুটে বেরিয়ে গেল।
দেখলে! দেখলে বরাহটাকে! কাঁপতে কাঁপতে বললেন পুরুত-ঠাকুর ধৌম্য, হস্তিনাপুরের মতো শহরের মাঝখানে অত বড় বুনো বরা।
বরা! ভীমসেন বেশ একটু ভাবিত হয়ে বললেন, এখানে বরা আসবে কোথা থেকে? আর বরা তো ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে। এটার আওয়াজ কীরকম বিদঘুটে না! তাহলে এ আবার কী জানোয়ার! ধৌম্যঠাকুরের মুখোনা শুকিয়ে আমসি।
নেহাত প্রাণের দায় মানের দায় না হলে ওইখান থেকে পিটটান দিতেন নিশ্চয়।
কোনওরকমে কাঁপতে কাঁপতে ভীমসেনের বিরাট বপুর আড়ালে শেষ পর্যন্ত ধৌম্যঠাকুর ঠিক ঠিকানায় পৌঁছন।
দোকানঘর তো নয়, অন্ধকার একটা কোটর বললেই হয়। মিটমিটে একটা মোমবাতি জ্বেলে নিচু একটা কাঠের পিড়েয় বসে আর একটা চৌকির ওপর খেরো বাঁধানো একটা জাবদা খাতা রেখে দারুক কী যেন সব লিখছে।
হিসেবটিসেবই হবে নিশ্চয়। কিন্তু এই তো দোকানের ছিরি! এক রত্তি মালও কোথাও নেই। তার আবার এত হিসেব কীসের!
যুবরাজ মধ্যম পাণ্ডবকে দেখে দারুক খাতির করতে অবশ্য ভোলে না। কৃতাঞ্জলি হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে খাতা লেখার চৌকিটাই তাঁর জন্য এগিয়ে দেয়।
তারপর করজোড়েই বলে, আপনি এখানে আসবেন ভাবতেই পারিনি। এ আমার কী সৌভাগ্য, আবার কী লজ্জা! আপনি ডেকে পাঠিয়েছেন, আমি তো এই কালই যাচ্ছিলাম।
মুখে যতই ধানাইপানাই করুক, আসল কাজের ব্যাপারে দারুক কিন্তু বাগ মানতে চায় না। ভীমসেনের সঙ্গেও সে বেশ কিছুক্ষণ লেজে খেলে।
ফরমাশটা শুনে প্রথমে তো একেবারে যেন থ।
আজ্ঞে বলেন কী!—দারুকের মুখটা যেন ভয়ে সিটোনোতা কি কখনও সম্ভব?
সম্ভব নয় মানে?–ভীমসেন গরম না হয়ে পারেন না–আরবারে তুমিই তো বুদ্ধি বাতলে আমার গোলমালটা মিটিয়ে দিয়েছিলে।
আজ্ঞে, সে তখন কোনওরকমে দিতে পেরেছিলাম, দারুক সবিনয়ে বলে, কিন্তু সে দিনকাল কি আর আছে!
এই তো সেদিনকার কথা! ভীমসেন যত না গরম তার চেয়ে বেশি অবাক হয়ে বলেন, এর মধ্যে দিনকাল আবার কী বদলাল?
আজ্ঞে অনেক বদলেছে, অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানায় দারুক, রাজপুরীর মধ্যে সেসব খবর তো আর আপনারা পান না। সেদিন যারা ছিল আঙুল এখন তারা ফুলে কলাগাছ।
তা কলাগাছ বটগাছ যে যা খুশি হোক—আর ধৈর্য থাকে না ভীমসেনের আমাদের কাজটা উদ্ধার করে দেওয়ার সঙ্গে তার কী সম্পর্ক? তুমি সেই সেবার যাকে দিয়ে–
থাক! থাক! যেন আঁতকে উঠে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ভীমসেনকে থামিয়ে দেয় দারুক, নামটা আর করবেন না। কে কোথায় শুনে ফেলে?
বেশ, নাম করব না, যেমন বিরক্ত তেমনই একটু হতভম্ব হয়ে বলেন ভীমসেন, কিন্তু কাজটা তো তাকে দিয়ে করিয়ে দিতে পারো!
আজ্ঞে, তা পারলে আর আপনাকে আঙুল ফুলে কলাগাছের কথা বলি! দারুক হতাশ মুখে জানায়, সে এখন আমাদের নাগালের বাইরে। আমাকে তো পাত্তাই দেয় না।
আহা, পাত্তা যাতে দেয় সেই ব্যবস্থাও করবে! ভীমসেন এবার একটু আশার আলো দেখতে পেয়ে বলেন, আরবারে যা দিয়ে খুশি করেছিলে এবারে তা না হয় একটু বাড়িয়ে দেবে।
একটু বাড়িয়ে দেবেন! দারুক হতাশার হাসি হাসে, যা ছিল তা সে কি আর আছে যে একটুতে তার খাঁই মিটবে?
একটু কেন, বেশিই না হয় দেওয়া যাবে! ধৌম্যঠাকুর নিজেই এবার ব্যাকুল হয়ে ওকালতি শুরু করলেন, কাজটা না হলে দেশের সর্বনাশ হয়ে যাবে। দেশে নীতি-ধর্ম বলে কিছু থাকবে না। যুবরাজ মধ্যম পাণ্ডব কৃপণ নন। সুতরাং কত নিষ্ক লাগবে তা অকাতরে বলে ফেললা। হাজার, দু-হাজার?
আজ্ঞে, বেশ একটু দ্বিধাভরে দারুক বলে এবার, ওসব নিষ্ক-টিতে কিছু হবে না। নেহাতই যদি রাজি করানো যায় তাহলে যা বললেন তার পক্ষে অন্তত দুটি চিরকেলে গোধূমের ভাণ্ডার চাই!
গোধুমের ভাণ্ডার! ধৌম্যঠাকুর বৈশ তাজ্জব হলেও নিজেকে সামলে বলেন, বেশ তা-ই না হয় দেওয়া যাবে। না দিয়ে উপায় কী? মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে তিন যুগের মানুষ উপহাস করবে, পুজো-আচ্চা, ক্রিয়া-কর্ম সব লোপ পেয়ে দেবতা-বামুন-গুরু-পুরুত কেউ আর মানবে না, এমন সর্বনাশ তো আমরা চাই না।
তাহলে তো, ধৌম্য ঠাকুরকে ওইখানেই থামিয়ে দিয়ে দারুক বেশ চিন্তিত মুখে বলে, দুটো গোধূম ভাণ্ডারে কুলোবে না। তার সঙ্গে অন্তত পুথি ঠাসা দুটো বিরাট পাঠাগার, আর রেশম ও কার্পাস বস্ত্রের পাহাড়-প্রমাণ একটি আড়ত না হলে নয়।
এই সব না হলে নয়! এতক্ষণ চুপ করে থাকার পর আর ধৈর্য না ধরতে পেরে ভীমসেনের মুখের রাশ আলগা হয়ে যায়, কাজ করবে ওই তো তোমার পুঁচকে ইঁদুরটা, এত বই কাপড় ফসলের কাঁড়ির ঘুষ নিয়ে সে করবে কী?
আজ্ঞে, আপনি যা দেখেছিলেন সেই পুঁচকে তিনি কি আর আছেন! একটু হেসে বলে দারুক, এখন তাঁকে দেখলে ভক্তি ভয় দুইই হবে।
তার মানে! দু চোখ কপালে তুলে বলেন ভীমসেন, এ গলিতে ঢুকতে প্রায় যার গুঁতো খেয়ে কাত হচ্ছিলাম বনবরার মতো সেইটিই গণেশ ঠাকুরের ইঁদুর? ঘুষ খেয়ে খেয়ে
আজ্ঞে, ইঁদুর আর বলবেন না! ভক্তিভরে বলে দারুক, তিনি এখন মূষিক মহারাজ আর আমরা তাঁর সামান্য সেবায়েত।
এর পর দু-পক্ষের রফা হতে আর দেরি হয় না।
যথা সময়ে শান্তিপর্বের তৃতীয় অধ্যায় ঠিক মতোই সংশোধিত হয়ে যায়।
সংশোধন হয়ে দাঁড়াল কী?
দাঁড়াল এই যে যুধিষ্ঠির অভিষেকের জন্য রাজপুরীতে ঢুকে দেবতা বামুনদের যখন খাতির করছেন তখন শিখা দণ্ড আর জপমালা নিয়ে ভিক্ষুর ছদ্মবেশে দুর্যোধনের চার্বাক নামে এক বন্ধু যুধিষ্ঠিরকে যা নয় তাই গালাগাল করে। বামুনরা তাতে ক্রুদ্ধ হয়ে জ্ঞানচক্ষে চার্বাককে চিনতে পেরে ব্রহ্মতেজেই তাকে তখন ভস্ম করে ফেলেন।
যা সংশোধনের জন্যে এত কাণ্ড সেই আসল ব্যাপারটা তাহলে কী ছিল?
ছিল চার্বাক নামে সে যুগের বেয়াড়া এক মানুষের ক-টা শুধু প্রশ্ন।
চার্বাক দুর্যোধনের সখাও নন, ছদ্মবেশেও তিনি আসেননি। বামুন পণ্ডিতদের মধ্যেই তিনি ছিলেন, কিন্তু আর সবাই যখন যুধিষ্ঠিরের দরাজ হাতের দক্ষিণা প্রণামী আদায় করতেই ব্যস্ত, তখন তিনি যুধিষ্ঠিরকে শুধু দুটি প্রশ্ন করেছিলেন। বলেছিলেন, শোনো ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির, তুমি তো শক্ত শক্ত ধাঁধার খুব চটপট উত্তর দিতে পারো শুনি। অজগররূপী স্বয়ং ধর্মরাজের মাথা-ঘোরানো সব প্রশ্নের চটপট জবাব দিয়ে সকলকে নাকি তাক লাগিয়ে দিয়েছ। এখন সিংহাসনে ওঠার আগে আমার দুটো প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাও দেখি। জবাব না দিয়ে কিন্তু সিংহাসনে উঠতে পারবে না এই কড়ার।
যে আজ্ঞা, ভগবন? হাত জোড় করে বলেছিলেন যুধিষ্ঠির।
কিন্তু তাতেও ধমক খেয়েছিলেন।
না, না, ওসব ভগবন-টগবন আমি নই! বলেছিলেন চার্বাক, তোমার কাছে দক্ষিণা প্রণামীর নামে ভিক্ষে চাইতেও আসিনি। অনেক কাঁদুনিটাঁদুনি গেয়েও শেষ পর্যন্ত তুমিও রাজাগিরিই করতে যাচ্ছ, তাই তোমায় শুধু দুটি কথা জিজ্ঞাসা করছি। বলল, তোমার রাজত্ব কত বড়, আর কারা এখন তার পরম শত্রু?
এই প্রশ্ন! যুধিষ্ঠির মনে মনে একটু হেসেছিলেন কি না জানা নেই। বামুন পণ্ডিত যারা এসেছিল তারা তো গলা ছেড়েই হেসেছিল চার্বাককে টিটকিরি দিয়ে।
যুধিষ্ঠির অবশ্য নম্রভাবেই জবাবটা দিয়েছিলেন। এই কদিন আগেই রাজ্যের মাপজোক নিয়ে নকুল সহদেবের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হয়েছিল। কুরু পঞ্চাল নিয়ে পাণ্ডবদের রাজ্য দৈর্ঘ্যে কত লক্ষ যোজন আর প্রস্থে কত গড়গড় করে বলে দিতে তাঁর কোনও অসুবিধাই হয়নি।
আর দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাবে তিনি সবিনয়ে জানিয়েছিলেন যে শত্রু তাঁর আর কেউ নেই। যারা ছিল তারা সব নিপাত হয়ে গেছে।
যাও, সিংহাসনের দিকে আর পা না বাড়িয়ে সোজা বেরিয়ে যাও। গম্ভীর মুখে হাত বাড়িয়ে বাইরের সিংহদ্বারটা দেখিয়ে দিয়েছিলেন চার্বাক।
হই হই করে উঠেছিল ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা। যুধিষ্ঠির বিমূঢ় বিস্ময়ে হাত জোড় করে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আমার উত্তর কি ভুল হয়েছে?
হ্যাঁ, সম্পূর্ণ ভুল। বলেছিলেন চার্বাক, তোমার রাজত্ব কত বড় তা জানো?
আজ্ঞে যা জানি তাই তো বললাম। সবিনয়ে জানিয়েছিলেন যুধিষ্ঠির, দু-এক যোজন এদিকওদিক অবশ্য হতে পারে।
দু-এক যোজনের হিসেবে নয়, এবার একটু যেন হেসেই বলেছিলেন চার্বাক, ভুল একেবারে মূলে। নিজেকে কোনও দিন মেপে দেখেছ? দেখো আর না-দেখো, নিজের ওই সাড়ে তিন হাত দেহখানিই তোমার রাজত্ব। তা-ও নিরঙ্কুশ নয়। আর তোমার এখনকার পরম শত্রু কারা, জানো?
ভিড় করা সব বামুন পণ্ডিত সভাসদদের দেখিয়ে চার্বাক বলেছিলেন, এই সব জলৌকাবৃত্তি, মানে জোঁকমার্কা স্তাবকের দল। যদি বা একটু বুঝেসুঝে রাজত্ব চালাতে পারতে, এরা তোমাদের ঘাড়ে চেপে থেকে নির্জলা তোষামোদে সব সুবুদ্ধির গোড়াতেই ঘুণ ধরিয়ে ছাড়বে। কৌরবরা তোমাদের রাজত্ব নিতে চেয়েছিল, আর এরা তোমাদের মনুষ্যত্বই দেবে ঘুচিয়ে।
দুটো উত্তরই ভুল দিলেও যুধিষ্ঠিরের সিংহাসন ছেড়ে চলে আসা হয়নি। সভাসুদ্ধ লোকের রাগ দেখে আর হই চই শুনে চার্বাক নিজেই একটু হেসে রাজপুরী ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন।