গুল-ই ঘনাদা
হ্যাঁ, সত্যিই অবিশ্বাস্য অঘটন।
ঘনাদা রাজি। কষ্টেসৃষ্টে অনেক সাধাসাধির পর নয়, রাজি এক কথায়। মুখ থেকে কথাটা পড়বামাত্র ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিয়েছেন ঘনাদা। আর সেইটেই অবিশ্বাস্য অঘটন।
সত্যি কথা বলতে গেলে এরকম অঘটনের জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না।
আমাদের সব প্যাঁচ তাই কেটে গেছে, সব চাল বানচাল, সব বুদ্ধি গুলিয়ে গিয়ে আমরা একেবারে হতবুদ্ধি।
তা হতবুদ্ধি হওয়া আর আশ্চর্য কী! আমরা আটঘাট বেঁধে কিস্তিমাতের জন্য যেভাবে সব খুঁটি সাজিয়েছিলাম, ঘনাদা একটি চালে তা ভেস্তে দিয়েছেন।
ঘনাদা রাজি হবেন না কিছুতেই এই নিশ্চিত বিশ্বাসের ওপরই আমাদের সব চাল ছকে রাখা ছিল।
তিনি অস্থির হয়ে উঠবেন আমাদের বায়না এড়াবার জন্য, আর আমরা তাঁর নিজের হামবড়াইয়ের প্যাঁচেই তাঁকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে জব্দ করব, এই ছিল মতলব।
সেই মতলবেই সবাই মিলে সেদিন একেবারে চোখেমুখে যেন আগুনের হলকা নিয়েই ন্যাড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠে টঙের ঘরে ঢুকেছিলাম।
না, এ অপমান আর সহ্য করা যায় না।
এর একটা বিহিত না করলেই নয়।
আমাদের একেবারে জাত তুলে যা-তা বলা!
ঘনাদা কি একেবারে নির্বিকার নির্লিপ্ত?
না। তা ঠিক নয়। চোয়ালের-হাড়-ঠেলা কুড়ুল-মার্কা মুখে ভাবান্তর কিছু অবশ্য দেখা যায়নি। কিন্তু গড়গড়ায় টান দেওয়ার মাত্রাটা বেশ একটু বেড়ে যাওয়াতেই আশ্বস্ত হয়েছি। ওষুধটা প্রথম দাগ পড়তেই কাজ হচ্ছে বোঝা গিয়েছে।
হুঁকোয় ঘন-ঘন টান দেওয়াটা তাঁর হুঁশিয়ারিরই লক্ষণ। আমরা কোন দিক দিয়ে কীরকম হানা দিতে যাচ্ছি তা আঁচ করে তার মওড়া নেবার ফিকিরই তিনি ভাবছেন নিশ্চয়।
খুশি হয়ে আমরা আমাদের পরের চাল এবার চেলেছি।
কোন হাটে যে ছুঁচ বেচতে এসেছে, বাছাধন এখনও জানে না! নাক বেঁকিয়ে বলেছে এবার শিশির।
থোঁতা মুখ কেমন করে ভোঁতা করতে হয়, এবার দেখাচ্ছি! গৌর দাঁতে দাঁত ঘষে বলেছে।
এরপর শিবু আমাদের সাজানো ছক মাফিক একটু উলটো সুর ধরেছে, কিন্তু এই তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে ঘনাদাকে জ্বালাতন করা কি ঠিক হচ্ছে?
তুচ্ছ ব্যাপার! আমি খেপে উঠেছি শিবুর ওপর, আমরা বন্দুক ধরতেই জানি
বলে টিটকিরি দেওয়াটা তুচ্ছ ব্যাপার হল?
বেশ, তুচ্ছ ব্যাপারই সই, গৌর শিবুর কথাটাই পেঁচিয়ে ধরে বলেছে, কত যে তুচ্ছ, ঘনাদা তা-ই শুধু দেখিয়ে দেবেন। ডান হাতটাও লাগাতে হবে না ওঁকে। বাঁ হাতেই বুলস আই শতকরা-নিরানব্বইবার।
ঘনাদার নীরব সম্মতিটা যেন পেয়েই গেছি, এমনই উৎসাহে সবাই এবার ব্যাপারটা নিয়ে মেতে উঠেছি।
ঘনাদাকে তো আর চেনে না! শিশির শুরু করেছে, ওকে নিয়ে আজ বিকেলে হাজির হলে সেই রকম টিটকিরিই নিশ্চয় দেবে। বলবে, কী! বন্দুক ছোড়ার শখ এখনও মেটেনি বুঝি? বুকে হাতে এমব্রোকেশন মালিশ করে আবার তাই এসেছ? সঙ্গে এ মূর্তিমানটি আবার কে?
উনি, মানে উনি, আমরা যেন আমতা আমতা করে বলব,আমি এবার কল্পনার সুতো ছেড়েছি, উনি একটু চেষ্টা করে দেখতে চাইছেন। চেষ্টা শুনেই ভুরু দুটো কোঁচকাবে নিশ্চয়ই, আর সেই সঙ্গে টিপ্পনি শোনা যাবে। চেষ্টা করবেন উনি? বন্দুকটা তুলতে পারবেন তো?
ঘনাদা তারপর অতি কষ্টেই যেন বন্দুকটা তুলবেন। এবার খেই ধরেছে গৌর, তারপর ডান কাঁধ না বাঁ কাঁধে লাগাবেন ঠিক করতে না পেরে শুধু হাতে ধরেই ঘোড়াটা টিপে বসবেন।
তারপরই হই হই কাণ্ড রই রই ব্যাপার! শিবুও যেন আর মেতে না উঠে পারেনি, নিশানার মাঝখানের লাল আলোর ড়ুমটাই ফটাস!
বন্দুকওয়ালার চোখ কি ছানাবড়া? আমি নিজেই জিজ্ঞেস করে তার জবাব দিয়েছি, উঁহুঃ, এখনও নয়। হঠাৎ বেটপকা গুলিটা লেগে গিয়েছে ভেবে সে বদমেজাজে একটু ঠোঁট বাঁকিয়েই বলবে, কী! আরও ছোড়ার শখ আছে নাকি!
কী বলবেন তাতে ঘনাদা?
ঘনাদা কেন, আমরাই যা বলবার বলব। শিশির এবার দোহার দিয়েছে, মুখোনা কাঁচুমাচু করে বলব, তা একটু আছে।
বেশ, ছুড়েই দেখ তাহলে! বন্দুকওয়ালা এবার দাঁত খিঁচিয়েই বলবে নিশ্চয়।
তাতে আমরা যেন আরও ভড়কে গিয়ে ভয়ে ভয়ে বলব, কিন্তু নিশানার মাঝখানে আর একটা লাল আলোর ড়ুম দিলে হয় না?
আবার লাল বা? লোকটার মুখটা যা তখন হবে! রীতিমত চিড়বিড়িয়ে উঠে বলবে, লাল বাবের বুলস্ আই আবার দাগবার আশা আছে নাকি! থাক! থাক! খুব কেরামতি হয়েছে। আর দুটো গুলি পাওনা আছে। এমনি ছুড়ে দিয়ে বিদেয় হও।
কিন্তু এখানকার চাঁদমারির যা নিয়ম, আমরা সবিনয়ে বলব, সেটা মানা উচিত নয় কি?
ও, নিয়ম দেখাতে এসেছে? আমাদের চিবিয়ে খাবার মতো গলায় বলবে বন্দুকওয়ালা, বেশ, বুলস আইয়ের লাল বাব্বই লাগিয়ে দিচ্ছি। দেখি নিশানদারির দৌড়। দেখি ক-টা বালব ফাটে!
বু আইয়ের লাল আলোর ড়ুম কিন্তু ফাটবে। একটা দুটো নয়, পর পর পাঁচটা দশটা পনেরোটা!
শেষকালে লাল আলোর বান্ধই হবে বাড়ন্ত।
বন্দুকওয়ালার মুখোনা তখন কী হবে? কেলে হাঁড়ি, না জালা? আর চোখ দুটো নেহাত কোটরে কুলোবে না বলেই ছানাবড়ার বদলে মালপো হতে পারবে না।
ওঃ, কী শিক্ষাটাই হবে!
কল্পনার শেষ দিকের তুলিটা চারজনে মিলেই চালিয়ে এসে এবার ঘনাদার দিকে যেন আকুলভাবে ফিরেছি।
আপনাকে কিন্তু আজ যেতেই হবে, ঘনাদা।
বন্দুকওয়ালার নাকটা একেবারে ওর ওই নকল চাঁদমারির মাটিতেই ঘষে দিয়ে আসব।
একজিবিশনে বিকেল চারটে থেকে লোক জমতে শুরু হয়। সন্ধে ছটা নাগাদ পুরস্কারের লোভে চাঁদমারি মানে শুটিং গ্যালারি জমজমাট হয়ে ওঠে।
ঠিক সেই মোক্ষম সময়টিতে আপনাকে নিয়ে গিয়ে হাজির হব। আজ সাতটায় একজিবিশনের চাঁদমারিতে বাহাদুরকা খেল হবে বলে লাউডস্পিকারে ঘোষণার ব্যবস্থাও আমরা করে এসেছি।
আঃ! ছবিটা যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। চাঁদমারির সামনে লোকে লোকারণ্য। বন্দুকওয়ালা হতভাগা চিপটেন কেটে কেটে সকলকে অপমান করে তাল ঠুকছে, কই! সব ঠুটো হয়ে দাঁড়িয়ে কেন? কার কত মুরোদ বন্দুকটা ছুড়ে দেখিয়ে যাক।– ঠিক সেই সময়ে আপনাকে নিয়ে ঢুকব। বন্দুকওয়ালা তো টিটকিরি দেবেই। অন্য সবাইরাও নিশ্চয় ভাববে, এ তালেবরটি আবার কে?
তালেবরটি যে কে তা ভাল করে বুঝিয়ে ওই মেলাভর্তি লোকের মাঝখানে নাক খত খাইয়ে সব টিটকিরির শোধ আজ নিতেই হবে। আপনি তৈরি থাকবেন ঘনাদা, ঠিক কাঁটায় কাঁটায় ছটায়।
আমরা সব কথা যেন পাকা করে ওঠবার উপক্রম করেছি।
আসল খেলা এইবারই শুরু হবার কথা। ঘনাদা কেমন করে এ দায় থেকে পিছলে বার হবার চেষ্টা করেন সেই মজা দেখাই আমাদের মতলব।
গড়গড়ার নলটা মুখ থেকে নামিয়ে ঘনাদার আচ্ছা বলে একটু টান দেওয়ায় সেই আশাতেই ফিরে তাকিয়েছি।
কিন্তু এ কী বলছেন ঘনাদা! প্রশ্নটা একটু বেয়াড়া নয় কি?
ঘনাদা অত্যন্ত সরলভাবে জিজ্ঞাসা করেছেন, বন্দুকটা কী বলো তো। গান, না রাইফেল?
বন্দুকটা বন্দুকটা? আমরা একটু বুঝি থতমত খেয়েছি। তারপর গৌরই প্রথম সামলে উঠে বলেছে, বন্দুকটা রাইফেল।
ভাল। ভাল। ঘনাদা যেন খুশি হয়েছেন। আর আমরা বেশ ভাবিত হয়ে উঠেছি। লক্ষণটাও ভাল নয়। ঘনাদার কি এখন বন্দুকের খবর নিয়ে মাথা ঘামাবার সময়! দায় এড়াবার জন্য এখনই তো তাঁর আঁকুপাঁকু শুরু হয়ে যাওয়া উচিত।
রাইফেলের খোঁজ নেওয়াটা ঘনাদার সেই ভড়কানিরই হয়তো একটা লক্ষণ ভেবে মনকে অবশ্য প্রবোধ দিয়েছি। তাঁর পরের প্রশ্নে সেই আশায় একটু হাওয়াও লেগেছে।
আচ্ছা, ঘনাদা গড়গড়ায় দুটো টান দিয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন, তোমাদের ওই খেলার চাঁদমারির মালিকের নামটা কী তা জানো নাকি?
তা আর জানি না? এবার আমাদের জবাব দিতে দেরি হয়নি। সকালে সবাই মিলে ঠিক করা নামটা চটপট বলে দিয়েছি। নাম হল অটো কালেদ।
অটো কালেদ! নামটা বার তিনেক যেন জিভে তারিয়ে তারিয়ে উচ্চারণ করেছেন ঘনাদা।
আর তারপর আমাদের একেবারে আক্কেলগুড়ুম করে দেওয়া সেই বাণীটি শুনিয়েছেন। ঘাড় নেড়ে বলেছেন, বেশ। যাব তাহলে।
যাবেন?
আমাদের ধরা গলায় উল্লাসটা একটু বোধহয় আর্তনাদের মতো শুনিয়েছে।
তবু সেই রকমই একটা ভাব বজায় রেখে উলটো প্যাঁচ কষা শুরু করতে হয়েছে। তখনই।
ভাবছি, আগে থাকতে একটা পোস্টার ছাড়লাম না কেন? শিশির আফশোস করেছে, সারা শহরে একটা শোরগোল তুলে দিতে পারতাম।
শোরগোল এমনিতে কিছু কম হবে ভাবছিস? গৌর শিশিরকে সংশোধন করেছে, মুখেই যা রটাবার ব্যবস্থা করেছি তাতে কাতারে কাতারে লোক ওখানে গিয়ে জড়ো হবে দেখিস।
তা ছাড়া ওখানে গিয়েই তো একজিবিশনের লাউড স্পিকারে সব ঘোষণা করে দেব। শিবু তার পরিকল্পনাটা জানিয়েছে।
ঘোষণাটা কী হবে কিছু ভেবেছিস? জিজ্ঞাসা করেছি আমি।
তা আর ভাবিনি? শিবু গড়গড় করে তার ঘোষণা শুনিয়েছে, আসুন, আসুন, দলে দলে চাঁদমারিতে এসে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নিশানাদারি দেখে জীবন সার্থক করুন।
শুধু ওই নয়, বলতে হবে, শিশির ঘোষণাটা আরও চটকদার করতে চেয়েছে, পৃথিবীর অকৃত্রিম ও অদ্বিতীয় বন্দুকবাজ শ্রীঘনশ্যাম দাসকে স্বচক্ষে দেখার এমন সুযোগ আর পাবেন না।
ঘোষণাটা বাতলাতে বাতলাতে ঘনাদার দিকে চেয়ে শিশির জিজ্ঞাসা করেছে, আপনার সেই ইউরোপের কীর্তিটাও বলব নাকি, ঘনাদা?
ঘনাদাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমি জানতে চেয়েছি, কোন কীর্তিটার কথা ভাবছিস? লেনিনগ্রাডে রিভলভারে সেই মাছি মারা, না ড্যানিউব দিয়ে হাইড্রোফয়েলে যেতে যেতে সেই—
কীর্তিটা চটপট ভেবে নিতে না পেরে যে অপ্রস্তুত অবস্থাটা হতে পারত, শিবু ধমক দিয়ে তা থেকে আমায় বাঁচিয়েছে।
কী আজেবাজে বকছিস? শিবুর গলাটা কড়া—ওসব বললে কে কতটুকু বুঝবে! তার চেয়ে বার্লিনের সেই রেকর্ডের কথা বলব, সেই দাঁড়িয়ে, বসে, কাত কি চিত হয়ে শুয়ে যেভাবে হোক বন্দুক ধরে দুশোর মধ্যে একশো সাতানব্বইর নীচে নিশানাদারি নামেনি।
ওই রেকর্ডের কথাই বলব তো? প্রশ্নটা এবার সরাসরি ঘনাদাকে।
বলবে? ঘনাদার কোনও ভাবান্তর দেখা যায়নি। একটু যেন সবিনয়ে বলেছেন, কিন্তু ওসব কথা না বলাই তো ভাল।
ঘনাদা বলছেন, না বলাই ভাল। তার মানে বলাতেও ঘনাদার বিশেষ আপত্তি নেই। অর্থাৎ ঘনাদা তাঁর সায় দেওয়া নাকচ করছেন না। সত্যিই আমাদের আবদার রেখে বিকেলে বন্দুকের কেরামতি দেখাতে একজিবিশনের মেলায় যেতে রাজি।
এরপর তদা নাশংসে বিজয়ায় মার্কা মুখে রীতিমতো দিশেহারা হয়ে নেমে আসা ছাড়া আর করবার কী আছে। নামতে নামতে ভেবেছি, আমাদের চালাকি কি বুমেরাং
হয়ে আমাদের ওপরই এসে হানা দিতে যাচ্ছে?
সকাল থেকে দুপুর আর দুপুর থেকে বিকেল গড়িয়ে যাওয়ার পর সে বিষয়ে আর কোনও সন্দেহ রইল না।
এর আগে দু-দুবার ঘনাদা মুখে এমনই আমাদের আবদারে সায় দিতে বাধ্য হলেও জিরো আওয়ারের আগে একটা-না-একটা ফিকিরে আমাদের ফাঁস ফসকে বেরিয়ে
গেছেন।
একবার গেছলেন তক্তপোশের তলায় লুকিয়ে সেখান থেকে একটা কাঁচের টুকরো বার করে, আর একবার কেঁচোর ওপর ভক্তি গদগদ হয়ে।
ঘনাদা শেষ মুহুর্তে সেই রকম একটা ছুতো বার করবেন এ আশা কিন্তু বিফলই হল। ছ-টার পর সাড়ে ছ-টা বাজতে ঘনাদাকে নিয়ে একজিবিশনের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়া ছাড়া উপায় রইল না।
তবু যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। রাস্তায় বেরিয়ে পড়েও শেষ চেষ্টা করতেও বাকি রাখলাম না। ঘনাদাকে বেমালুম সরে পড়বার যত রকম সম্ভব—সব সুযোগই দিলাম। ট্যাক্সির নামও না করে ইচ্ছে করেই ঘনাদাকে সসম্মানে পেছনের দিকে বসিয়ে নিজেরা ট্রামের সামনে গিয়ে বসলাম আর সারা রাস্তায় ভুলেও একবার পেছন ফিরে তাকালাম না।
এমন একটা মৌ-কা ঘনাদা কি অবহেলা করবেন? চুপিসারে যে-কোনও স্টপে নেমে গেলে তাঁকে রুখছে কে?
নামবার জায়গার কাছাকাছি এসে দুরুদুরু বুকে বেশ একটু ব্যাকুলভাবেই পিছন ফিরে তাকালাম। তাকিয়ে বুকগুলো দমে গেল।
ঘনাদা জাজ্বল্যমান চেহারায় সেখানে বসে আছেন। মুখ ঘোরাতে দেখে বেশ একটু উৎসুকভাবেই যেন বললেন, কী হে, এইখানেই নামতে হবে না?
সেইখানেই নামলাম, আর তারপর থেকে ভূমিকা বদলাতে হল।
ঘনাদার নয়, আমাদেরই এখন পালাবার ফিকির খোঁজার গরজ। ট্রাম স্টপ থেকে নেমে একজিবিশনের গেটে যেতে যেতেই ফন্দিটা ঠিক করে নিয়ে কাজে লাগালাম।
বুদ্ধির বাহাদুরি-টুরি কিছু নয়, নেহাত ছেলেমানুষি ফন্দি। কোনওরকমে কায়দা করে ঘনাদাকে টিকিট কিনে ভেতরে ঢুকিয়ে দেবার পর নিজেরা গেট থেকেই হাওয়া।
এ-রকম একটা কাঁচা চালে শেষরক্ষা হবে না জানি, তবু আপাতত মান বাঁচিয়ে চলনসই একটা কৈফিয়ত বানাবার ফুরসত তো পাওয়া যাবে।
কিন্তু যত ফুরসতই পাই, চলনসই একটা কৈফিয়ত খাড়া করাও কি সম্ভব?
একজিবিশনের গেট থেকে পালিয়ে এলোপাথাড়ি এ রাস্তায় সে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে পরামর্শ করে কোনও কূলই পেলাম না। যে-গল্পই সাজাই সবই যে শতচ্ছিদ্র, তা বুঝতে পারি। কিন্তু সারারাত তো বাইরে কাটানো যায় না, পালিয়েও যাওয়া যায় না। বাহাত্তর নম্বর ছেড়ে।
শেষ পর্যন্ত মরিয়া হয়েই বনমালি নস্কর লেনে গিয়ে ঢুকলাম।
ঘনাদাকে কী মূর্তিতে যে দেখব তা তো বুঝতেই পারছি। কপালে যা আছে তার কাছে ফাঁসি-দ্বীপান্তরও তুচ্ছ। তবু যা হয় তোক, সাফ-সাচ্চা কথাই বলে দেব।
বলব যে–
বলার ভাবনাগুলো নীচে থেকে দোতলায় ওঠার সিঁড়ির মুখেই জমে পাথর হয়ে গেল। বনোয়ারি তখন আমাদের সামনে দিয়েই বেরিয়ে ওপরে যাচ্ছে।
কিন্তু ওর হাতের ট্রেতে ওসব ঢাকা দেওয়া প্লেট কীসের?
এসব কী, বনোয়ারি? কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? জিজ্ঞাসা করতেই হল হতভম্ব হয়ে।
বনোয়ারি যা জবাব দিলে তাতে একেবারে তাজ্জব। প্লেটগুলো নাকি কবিরাজি কাটলেটের আর বনোয়ারি এসব নাকি বড়বাবু মানে ঘনাদার ফরমাশেই তাঁর কাছে নিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু ট্রেতে অমন পাঁচ-পাঁচটা প্লেট কেন? তোমার বড়বাবু কি পাঁচ প্লেটই সাঁটবেন?
না, তা নয়, বনোয়ারি হাসিমুখে জানাল যে, পাঁচটার মধ্যে চারটে প্লেট আমাদেরই জন্য।
আমাদের জন্য? আমাদের জন্য ঘনাদা নিজে থেকে কবিরাজি কাটলেটের অর্ডার দিয়ে রেখেছেন? তা তিনি কোথায়? তাঁর টঙের ঘরে?
না, টঙের ঘরে নয়, দোতলায় আমাদের আড্ডাঘরেই তিনি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।
ঘনাদার অপেক্ষা করাটা কী ধরনের? আমাদের জন্য এ-ভোজের ব্যবস্থা করারই বা মানে কী?
খাঁড়ার কোপ দেবার আগে বলির ছাগেদের জন্য যেমন নধর ঘাসের ব্যবস্থা থাকে। তেমনই কিছু?
দুরুদুরু বুকে ওপরে উঠে দোতলার বারান্দা দিয়ে আড্ডাঘরে গিয়ে ঢুকলাম।
ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই একেবারে হতভম্ব। ঘনাদা বেশ মৌজ করে তাঁর মৌরসি আরামকেদারায় গা এলিয়ে শুয়ে গড়গড়া টানছেন। তাঁর সামনের টেবিলেই পাঁচ-পাঁচটি প্লেট সমেত বনোয়ারির ট্রেটি রাখা।
হতভম্ব শুধু ঘনাদাকে অমনভাবে শায়িত দেখে নয়, আমাদের প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর অবিশ্বাস্য সম্ভাষণ শুনেও।
এসো, এসো, ঘনাদা যেন সাদরে বললেন, মিছিমিছি হয়রান হয়ে এলে তো! কথাগুলো বাঁকা না সোজা আর ঠিক কোন দিকে যাচ্ছে ধরতে না পেরে খুনের আসামিদের মতোই ভয়েভয়ে যে যেখানে পারি টান হয়ে গিয়ে বসলাম।
বনোয়ারি তার ট্রেটা সামনের টেবিলে রেখে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। আমরা বসবামাত্র হাতে হাতে এক-একটা প্লেট ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল।
কিন্তু প্লেট থেকে যত মনমাতানো গন্ধই পাই, সেদিকে দৃষ্টি দেবার মতো মেজাজ কি তখন আছে?
অবস্থাটা বুঝে ঘনাদাই এবার দৃষ্টান্ত ও উপদেশ দিয়ে আমাদের উৎসাহিত করলেন। নিজের ম্যাগনম প্লেটটির প্রতি মনোনিবেশ করে বললেন, নাও, নাও খেয়ে নাও। মোড়ের প্যারিস গ্রিল থেকে অর্ডার দিয়ে আনা স্পেশ্যাল কবিরাজি। ঠাণ্ডা হলে আর তার পাবে না।
ঘনাদার কথায় কবিরাজি কাটলেটের সদগতিতে মন দিতে হল, কিন্তু রহস্যটা কী তখনও ভেবে থই পাচ্ছি না। ঘনাদার মহানুভবতা একটু মাত্রাছাড়া মনে হচ্ছে না এ ব্যাপারে? আমাদের নির্বোধ চালাকি হাতেনাতে ধরে ফেলেও তিনি প্রসন্ন মনে আমাদের জন্য নিজে থেকে আমাদেরই হয়রানির জন্য সমবেদনা প্রকাশ করছেন।
যা দেখছি শুনছি, তা কি স্বপ্ন না সত্যি!
তা স্বপ্ন বলে মনে হওয়া আশ্চর্য কিছু নয়।
নিজের ঢাউস প্লেটের জোড়া কাটলেট চেটেপুটে শেষ করে আমাদের এই ঘোরলাগা অবস্থাতেই ঘনাদা তাঁর প্রথম সম্ভাষণের খেই ধরলেন, তোমাদের ওই অটো কালেদ না কী নাম, তাকে আর খুঁজে পাওনি তো? আর পাবেও না। আমিও পাইনি।
আপনিও পাননি? আমাদের ধরা গলা থেকে তাঁর কথায় একটু অস্ফুট প্রতিধ্বনি ছাড়া আর কিছু বার হল না।
হ্যাঁ, ঘনাদা গলায় একটু যেন করুণা মিশিয়ে বললেন, বেচারা আজ সকালেই মেলা থেকে সব পাততাড়ি গুটিয়ে পালিয়েছে। তবে আমার কাছ থেকে পালাবে কোথায়? মেলায় না গেলেও যেখানে ধরবার, ঠিক তাকে গিয়ে ধরেছি।
আপনি ওই অটো কালেদকে শেষ পর্যন্ত ধরেছেন? কী করে? কোথায় ধরলেন? তাঁর খোঁজ পেলেন কী করে?
খোঁজ পেলাম ওই নামটা থেকেই।ঘনাদা স্নেহের দৃষ্টিতে আমাদের যেন একটু তিরস্কার করে বললেন, অমন একটা আজগুবি নাম দেখেই তো লোকটা যে নকল জাল তা বোঝা উচিত ছিল। অটো হল খাস জার্মান নাম, আর কালেদ খাঁটি যুগোশ্লাভ পদবি। নেহাত আহাম্মক ছাড়া ওই দুটো বেজাত শব্দ জুড়ে কেউ নকল নাম বানায়?
ঘনাদা একটু থেমে জবাবের আশাতেই আমাদের দিকে চাইলেন কি না জানি না, কিন্তু আমাদের চোখগুলো তখন ঘরের মেঝেতেই নেমে গেছে।
ঘনাদা একটু হেসে তারপর আবার শুরু করলেন, নামটা শুনেই সন্দেহ হয়েছিল। বন্দুকের নিশানাদারি নিয়ে দেমাক আর মেলায় চাঁদমারি খুলে কারবার করার কথা জেনে ছদ্মনামের ধড় বাজটি যে কে তা আর বুঝতে বাকি রইল না। মেলায় গিয়ে ধরবার আগেই সে হয়তো হাওয়া হবে এ ভয় অবশ্য আমার ছিল, তাই তার পালাবার ফিকির আর রাস্তাটাও আগেই আন্দাজ করে নিয়েছিলাম।
আগেই আন্দাজ করে নিয়েছিলেন? কী করে? আমাদের ঘোর লাগা অবস্থাটা ক্রমশ তখন আরও সঙ্গিন।
ও কথা তোমাদের ওই অটো কালেদও জিজ্ঞাসা করেছিল, তাকে তার লুকোনো আস্তানায় গিয়ে ধরবার পরে। ঘনাদা বলে চললেন, প্রথমে তো দেখাই করতে চায় না। ডকের পাহারাদার ভেতর থেকে খবর নিয়ে এসে জানালে যে কালেদ সাহেব কারও সঙ্গে দেখা করতে চান না।
দেখা করতে চান না? বটে? মোক্ষম মন্ত্রটি এবার লাগাতে হল। একটা চিরকুটের ওপর শুধু মন্তরটি লিখে পাহারাদার সেপাইকে বললাম, এইটি শুধু সাহেবের কাছে দিয়ে এসো। দেখা যাক, তিনি কী বলেন।
ব্যস, চিরকুটে লেখা ওই দুটি শব্দতেই একেবারে যেন ভোজবাজি হয়ে গেল। পাহারাদার খবর আনবে কী, তোমাদের কালেদ সাহেব নিজেই ছুটে এলেন হন্তদন্ত হয়ে।
এমনই মন্ত্রের গুণ? মন্ত্রটা কী?
মন্ত্রটা শুনতে চাও? মন্ত্রটা এমন কিছু নয়, শুধু দুটি শব্দ। পার্দাচিরস মার্মেরেটস।
কী বললেন? পর্দা চিরে মারমার ঠাস? ওই হিং-টিং-ছট শব্দের এত গুণ?
হ্যাঁ, ঘনাদা মৃদু একটু হাসলেন, ও দুটো তোমাদের ওই কালেদ সাহেবের কাছে যেন সাপের মন্তর। একবার আওড়ালেই ফণা নামিয়ে সুড়সুড় করে যেদিকে চাও সেদিকে চলে যাবে। ওই মস্তরটি জানলে তোমরাই ওকে বাঁদর-নাচ নাচাতে পারতে। বন্দুক ছোড়া নিয়ে টিটকিরি দেবার সাহস আর ওর হত না।
কাঁপতে কাঁপতে এসে আমার সঙ্গে দেখা করার পর ওকে অবশ্য ভাল রকম ধাতানিই দিয়েছি। বলেছি, তোমার চাঁদমারির নামডাক শুনে হাতের তাক একটু ঝালাতে এসেছিলাম যে হে। দেখতে এসেছিলাম স্কিট, না সোজাসুজি টার্গেট শুটিং-এর ব্যবস্থা করেছ।
মুখোনা কাঁচুমাচু করে তোমাদের কালেদ বলেছিল, না, না, স্কিট কি ট্রাপের ব্যবস্থা কী করে করব? শুধু ওই একটু টার্গেট শুটিং।
ওই পর্যন্ত শুনেই ধমকে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিলাম, টার্গেট শুটিং? ভড়কিবাজির আর জায়গা পাওনি? বুলস্ আই-এ লাল বালব দিয়ে টার্গেট শুটিং কোথায় দেখেছ শুনি? আর যত মুখখু গোলা লোক পেয়ে রাইফেলের ভাঁওতা দিয়েছ? কী রাইফেল তোমার? কত গেজের? বারো, কুড়ি, না আটাশের? উনিশশো তিনের স্প্রিংফিল্ড আরমারি, না দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সেমি-অটোমেটিক?..
আজ্ঞে, কেন আর লজ্জা দিচ্ছেন? করুণ মুখ করে বলেছে তোমাদের কালো, সবাই সমান মুখখু জেনে এয়ারগাকেই আসল রাইফেল বলে চালিয়েছি। বন্দুকের বিদ্যে তো আমাদের সকলের টু ঢু। বন্দুকের কথা ছেড়ে আমার খোঁজ পেলেন কী করে সেইটে যদি বলেন!
আমাদেরও এই এক কথা। বন্দুকের কুলুজির চেয়ে ঘনাদার খালেদ, থুড়ি কালেদ সন্ধানের রহস্যটাই আগে জানতে চাই। কিন্তু সে কথা তাঁকে বলি কোন মুখে!
ঘনাদা নিজে থেকেই অবশ্য দয়া করে আমাদের অটো কালেদেরই যেন মিনতি রাখলেন। বললাম, কেমন করে খোঁজ পেলাম? খোঁজ পাওয়া তো শক্ত কিছু নয়। সকালের খবরের কাগজটা পড়েই তো যা জানবার জেনে গেছি?
খবরের কাগজ পড়ে!
এবার সবিস্ময় উক্তিটা অটো কালেদের নয়, আমাদেরই।
হ্যাঁ, ঘনাদা করুণাভরে জানালেন, খবরটা কাগজেই ছিল। কাগজটা কি ভাল করে পড়েছ আজ সকালে?
আজ্ঞে, তা তো তন্নতন্ন করেই পড়েছি মনে হচ্ছে, আমরা বিমূঢ় গলায় নিবেদন। করলাম, কোনও খবর তো কোথাও পাইনি।
পাওনি? ঘনাদা অনুকম্পার হাসি হাসলেন, দেখোনি বালবোয়া :~ এডেন, অ্যাকোয়াবা, সাফানা, লোডিং—১৭ কে পি ডি—রেডি-ক্রোজিং ১২।৩?
এগুলো কাগজে ছাপা খবর? তার ওপর কালেদের সন্ধানের খেই?
আমাদের হাঁ করা মুখগুলো এর পর আর কি বোজানো যায়! অবস্থাটা বুঝে ঘনাদা তাই ব্যাখ্যাটা করে দিলেন। বুঝতে পারছ না বুঝি কিছু? খুব তত খবরের কাগজ পড়ো তন্ন তন্ন করে, ও খবর কোনওদিন দেখোনি? আরে, ওগুলো জাহাজি খবর। শিপিং নিউজ-এ সব চেয়ে খুদে হরফে রোজ পাবে। যা এইমাত্র বললাম তার মানে হল বালবোয়া নামে জাহাজ এডেন অ্যাকোয়াবা ইত্যাদি বন্দরে পাড়ি দেবার জন্য বারো তারিখ মানে আজই রওনা হচ্ছে।
এই খবর দেখেই বুঝলেন যে ওই আমাদের খালেদ না কালেদ এইতেই পালাচ্ছে? আমাদের বিস্ময়যুক্ত সংশয় এবার সরবই হল।
তা আর বুঝব না? ঘনাদা আমাদের বুদ্ধির স্থূলতায় বেশ যেন হতাশ হলেন, তোমাদের অটো কালেদ যা চরিত্র তাতে হট করে প্লেনে পালানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাতে ভিসা পাসপোর্টের অনেক ঝামেলা আছে। তা ছাড়া তার নকল চাঁদমারির লটবহর তো সে ফেলে যেতে পারে না। তাই বালবোয়া গোছের কোনও। মাল-জাহাজে যাওয়াই তার পক্ষে সুবিধে। প্লেনে নয়, সে এসেওছিল নিশ্চয় ওই.কম কোনও জাহাজে। কাল হঠাৎ পালাবার তাড়ায় বালবোয়া জাহাজটাই যে সে বেছে নেবে, তা ওই বিজ্ঞাপন দেখেই বুঝলাম। কাল পর্যন্ত বালবোয়া জাহাজের লোডিং চালু ছিল। আজই সে জাহাজ ছাড়ছে। নিজের লটবহর বোঝাই করে চটপট সরে পড়বার এমন সুযোেগ তোমাদের কালেদ ছাড়তে পারবে না বুঝেই ঠিক সময়ে গিয়ে ওই খিদিরপুরের সতেরো নম্বর ডকে তাকে ধরেছিলাম।
ধরে তাকে করলেন কী? আমরা এবার উদগ্রীব, পুলিশে দিলেন?
পুলিশে! পুলিশে দেব অমন একটা বেচারা মানুষকে? ঘনাদা আমাদের যেন ধিক্কার দিয়ে বললেন, এখানে ওখানে তোমাদের মতো মক্কেলদের একটু আধটু ভাঁওতা দিয়ে করে খায়, তাকে পুলিশে দেবার কী আছে? বন্দুকের ব না জেনে বোকার মতো বাহাদুরি করাটা তো আর তার দোষ নয়।
লজ্জায় আমাদের অধোবদন হওয়াই বোধহয় উচিত, তবু কৌতূহলটা চাপা গেল। একটু বাধো বাধো গলাতেই তাই জিজ্ঞাসা করলে শিবু, কিন্তু ওই যে, আপনার পর্দা চিরে মারমার ঠাস, না কী মন্ত্র–
পর্দা চিরে মারমার ঠাস নয়, ঘনাদা প্রায় ধমক দিয়ে শিবুকে থামিয়ে বললেন, কথাটা হল পার্দাচিরস মার্মেরেটস।
তা সে যাই হোক, ওই মন্তর ঝাড়তেই ওই আমাদের খালেদ, থুড়ি কালেদ অমন সুড়সুড়িয়ে এল কেন? শিবু এবার নাছোড়বান্দা, একটা কিছু গলদ নিশ্চয় তার মধ্যে আছে। নইলে ও সাপের মন্তরে অত ভয় কেন? – ভয় নয়, ঘনাদাকে এবার প্রাঞ্জল হতে হল, ও মন্তরের প্রতি কৃতজ্ঞতা। ওই মন্তরের কল্যাণেই একদিন যে প্রাণে বেঁচেছিল সেটুকু তোমাদের ওই কালেদ ভোলেনি।
ওই মন্তরের কল্যাণে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল? আমাদের জিজ্ঞাসা করতে হল। কী থেকে? সাপের কামড়?
না, তার চেয়ে অনেক ভয়ংকর কিছু।ঘনাদা গম্ভীর হলেন, দুনিয়ায় যার চেয়ে হিংস্র আর সাংঘাতিক আর কোনও প্রাণী নেই।
প্রাণীটা কী জিজ্ঞাসা করবার অবসর না দিয়েই ঘনাদা আবার শুরু করলেন, ধু ধু এক মরুভূমির মাঝখানে সমুদ্রের বাড়িয়ে ধরা নুলোর মতো এক উপসাগরের ধারে সেদিন ছিপ ফেলে বসে ছিলাম। উপসাগরটা হল গালফ অফ আকাবা আর মরুভূমিটা সাইনাই। তখনও উনিশশো সাতষট্টির যুদ্ধের অনেক দেরি। ইসরায়েল তখনও সাইনাই মরুভূমি দখল করেনি, সেটা লোহিত সমুদ্রের ধারে প্রায় বেওয়ারিশ হয়ে পড়ে আছে।
কিছুদিন আগেই এক আরব দৌ মানে বারদরিয়ার দেশি নৌকোয় সাইনাইয়ের দক্ষিণের রামমহম্মদে নেমে এই মরুর মাঝে একটা আস্তানা করেছি।
আকাবা উপসাগরের জল একেবারে কাঁচের মতো স্বচ্ছ। পাড়ের এক জায়গায় বসে নীচের চেতল মার্কা মাছটা যে আমার ছিপের টোপটার কাছে ঘোরাফেরা করছে তা তখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। মাছটা টোপ গেলার সঙ্গে সঙ্গে টান দেওয়া কিন্তু আর হল না। হঠাৎ বন্দুকের শব্দে মরুভূমির নিস্তব্ধতা চুরমার হয়ে গেল, সেই সঙ্গে একটা গুলি আমার ছিপের ডগাটা প্রায় ছুঁয়ে ডান দিকের বালিতে গিয়ে বিধেছে টের পেলাম।
গুলি কে ছুড়েছে তা জানতে দেরি হল না। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই কাছের একটা বালিয়াড়ির পাশ থেকে দুই মূর্তিকে বেরিয়ে আমারই দিকে আসতে দেখলাম। তাদের মধ্যে একজন তোমাদের এই অটো কালেদ, আর অন্যজন লম্বায় চওড়ায় প্রায় দৈত্যের মতো তামাটে রঙের একটি মানুষ।
সেই মানুষটাই যে সর্দার আর তোমাদের কালেদ যে তার শাগরেদ, তা বুঝতে দেরি হয় না। লোকটার চেহারা দুশমনের মতো হলেও ব্যবহারটা খুব হাসিখুশি প্রাণখোলা।
আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে হাসির দমকে মরুভুমি কাঁপিয়ে বললে, কী দরবেশ বাবাজি, পেটের পিলে চমকে গেছে নাকি?
তা গেছে! হেসেই বললাম, তবে মাছটা যে ফসকাল সেইটেই দুঃখ।
ফসকেছে আমারও। আর একটু হলে নাকের ডগাটাই উড়িয়ে দিচ্ছিলাম, বলে লোকটার আবার সে কী হাসির ধূম।
হাসি থামিয়ে সে কিন্তু খুব উৎসাহের সঙ্গেই আলাপ পরিচয় করলে। বেসিল এসকল বলে নিজের পরিচয় দিয়ে আমার নামটা জানবার পর আমার হাত ধরে সে কী আদরের ঝাঁকানি!
তার ঝাঁকানিতে আমায় বারতিনেক বালির ওপর আছড়ে ফেলে তারপর তার যেন হুঁশ হল।
আরে! তুমি যে বালিতেই শুয়ে আছ, বলে আমায় হেঁচকা টানে তুলে মিঠে গলাতেই জিজ্ঞাসা করলে, তা কী মাছ ধরছিলে?
যা ধরছিলাম তা তো তোমার বন্দুকের গুলিতেই ফসকে গেল! আমি অসাড় ডান হাতটা বাঁ হাত দিয়ে যথাসম্ভব মাসাজ করতে করতে বললাম, তবে একটা-দুটো মাছ আগেই ধরেছি।
তাই নাকি! কী ধরেছ দেখি। এস্কল উদগ্রীব হয়ে উঠতে মাছের থলিটা খুলে তাকে দেখিয়ে বললাম, ধরেছি এই দুটো মোজেসের সোল!
মোজেসের সোল! এস্কল ভুরু কুঁচকে মুখ বেঁকিয়ে বললে, ও আবার কী নাম!
না, অন্য নামও আছে! তাকে আশ্বস্ত করলাম, তবে নামে কী দরকার? মাছ। খাবার মতো হলেই হল।
খাবার মতো মাছ ধরবার আর কি জায়গা ছিল না! এস্কলের গলায় এবার একটু বাঁকা সুর, মরতে এই মরুভূমিতে এসেছ কেন?
মরতে তুমিও তো এখানে এসেছ! একটু হেসে বললাম, মরু হলে কী হয়, এখানে মধু আছে নিশ্চয়।
আছে নাকি? এস্কলের চেহারা আর গলাটা একসঙ্গে রুক্ষ হয়ে উঠল হঠাৎ, তা, তোর মধু তো এই আকাবা খাঁড়ির মাছে। এই পুঁচকের বদলে বড় মাছ ধরলেই পারিস।
বড় মাছ আবার এখানে কী?আমি একটু বোকা সাজলাম।
বড় মাছ কী, জানিস না? এবার হিংস্র গলায় বললে এস্কল, জলের দিকে চেয়েই দেখ না একবার।
যা দেখবার তা আগেই আমি দেখেছি। যেখানে আমি ছিপ নিয়ে বসেছিলাম, ঠিক তার নীচেই খাঁড়ির কাকচক্ষু জলে এক সঙ্গে তিন-তিনটে সমুদ্রের যমদূত ঘুরছে।
যেন ঠাট্টা ভেবে সরল ভাবে বললাম, বাঃ! ওগুলো তো হাঙর, আবার যেমন তেমন নয়, আসল মানুষ-খেকো ট্রাইনোডন ওবেস!
হুঁ, এস্কল চিবিয়ে বললে, হাঙরদের ঠিকুজি কুষ্টি জেনে ফেলেছিস দেখছি!
তা জানতে হবে না! আমি যেন তার প্রশংসায় একটু ফুলে উঠে বললাম, শুধু কি এখানকার হাঙর, এ বালির রাজ্যের আরও অনেক সুলুকসন্ধানই যে এ ক-দিনে নিয়ে ফেলেছি।
নিয়ে ফেলেছিস, এস্কলের চোখ দুটো এবার যেন জ্বলছে মনে হল, তাহলে হাঙর ধরাই তো তোর এখন দরকার!
কী করে ধরব? আমি যেন এস্কলের কাছেই আর্জি জানালাম, এ ছিপে কি হাঙর ধরা যায়?
তাহলে জাপটে গিয়ে ধর! বলে সেই তামাটে দৈত্য আমায় খাঁড়ির পাড় থেকে প্রচণ্ড ধাক্কা দিলে।
ইচ্ছে করলে চক্ষের নিমেষে সরে গিয়ে ওই পাঁচমণি লাশকে নিজের ঠেলাতেই খাঁড়ির তলাতে পাঠাতে পারতুম। কিন্তু তার বদলে এক হাতে আমার মাছের থলে নিয়ে আর এক হাতে এতক্ষণ যে তার ওস্তাদের পাশে ঠুটো জগন্নাথ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তোমাদের সেই অটো কালেদকে জড়িয়ে টান দিয়ে খাড়ির জলে গিয়ে পড়লাম।
হাঙর ক-টা তখনকার মতো সেখান থেকে চলে গেছে। তারা ফেরার আগেই এস্কল তার নিজের শাগরেদ তোমাদের ওই কালেদকে তোলবার ব্যবস্থা করবে ভেবেছিলাম। কিন্তু সেরকম কোনও মতলব তার দেখা গেল না। তোমাদের কালেদের দরকার তার কাছে বোধহয় ফুরিয়েছিল। তাই আমার সঙ্গে আরেকটা আপদ যেন বিদেয় হল এমনই তখন তার মুখের চেহারা। সেই চেহারায় আমায় একটি টিটকিরির সেলাম দিয়ে তাকে চলে যেতে দেখে একবার শুধু তাকে ডেকে ফেরালাম। একটা কথা রাখবে, দোস্ত?
কী, কী কথা? সে বিদ্রুপভরে জিজ্ঞাসা করলে।
এই শেষ একটা উইল করে যাবার ইচ্ছে ছিল। একটু শুনে নেবে?
হাঙর ক-টা তখন আবার আমাদের দিকেই আসছে। সে দিকে চেয়ে সে হায়নার হাসি হেসে উঠে বললে, উইলের অত তাড়া কীসের? কাল আসিস। শুনব।
তার হুকুম মেনে পরের দিনই এলাম। এস্কল তখন একা-একা খাঁড়ির পাড়ে আমারই মতো ছিপ ফেলে বসে আছে।
হঠাৎ বন্দুকের গুলিতে তার ছিপের সুতোটা গেল ছিঁড়ে। এস্কল তো একেবারে ভ্যাবাচাকা। তার একশো গজের মধ্যে কাউকে না দেখতে পেয়ে আরও তাজ্জব। এত দূর থেকে ছিপের সুতো ছেড়বার মতো গুলির তাগ কার?
না, আমাদের কাশি পর্যন্ত এবার শোনা গেল না। ঘনাদা আমাদের ওপর একবার চকিত চোখ বুলিয়ে নিয়ে আবার শুরু করলেন, যার তাগ, বালিয়াড়ির ধার থেকে তাকে বেরিয়ে আসতে দেখে যেমন অবাক তেমনই রেগে আগুন হয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে এস্কল বললে, তুই-তুই এখনও বেঁচে আছিস?
হ্যাঁ, আছি। কাছে এসে সবিনয়ে বললাম, ভূত হয়ে যে নেই তা বোঝাবার জন্য গুলিটা করতে হল। কিন্তু বাতাসে কেমন একটা পোড়া-পোড়া গন্ধ যেন পাচ্ছি, তাই না?
গন্ধ শুধু নয়, দূরের আগুনের শিখা আর ধোঁয়াটাও এবার দেখা গেল। তোমার আস্তানার তাঁবুগুলোই যেন জ্বলছে মনে হচ্ছে এস্কল! আমি সমবেদনার সুরেই বললাম।
এস্কল কিন্তু খেপে গেল একেবারে।
তুই! তুই এ আগুন জ্বালিয়েছিস! বলে বুনো মোষের মতোই ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপর।
বালির ওপর তার থোবড়ানো মুখটা একটু ঘুরিয়ে সোজা করে দিয়ে বললাম, কিছু মনে করো না, দোস্ত, বাধ্য হয়েই আগুনটা দিতে হল। এখানে হাইজ্যাকিঙের প্লেন নামাবার যে ঘাঁটিটি তুমি তোমার দলের হয়ে পাতছিলে যন্ত্রপাতি সমেত সেটা বরবাদই হয়ে গেল এখন। তোমাদের এই শয়তানি চক্রান্ত ভাঙবার জন্যই এ ক-দিন এই সাইনাই মরুর হাওয়া আমায় খেতে হয়েছে।
আমাদের চক্রান্ত ভাঙবি তুই? বালিতে চিত হয়ে থাকা অবস্থাতেই এস্কল আমায় বেকায়দায় পেড়ে ফেলার জন্য হড়কে যাওয়া কাঁচির জুডোর প্যাঁচ চালাল।
না, খাঁড়ির জল থেকে ঝুঁকে পড়ে বললাম, উইল যদি করতে চাও, আমি শুনতে কিন্তু রাজি। তবে তোমার নিজের নামেই করতে হবে। নাম তো তোমার বেসিল এসকল নয়। বেসিল হল গ্রিক আর এস্কল ইহুদি, তুমি যে তা নও, সেটা কাল আমার ধরা মাছের নাম বলার সময়েই বুঝেছি। ইহুদি হলে মোজেসের সোল বললে অমন হাঁ করে থাকতে না। তুমি না-ইহুদি না-আরব, এদের দুপক্ষের ঝগড়ার সুবিধে নিয়ে সাইনাই মরুভূমিতে শুধু নিজের শয়তানি মতলব হাসিল করতে এসেছ। তা এ যাত্রা যদি রক্ষা পাও তাহলে সে চেষ্টা করে দেখো।
এবার আমার হাতের পুঁটলিটা তার দিকে ছুড়ে দিয়ে বললাম, রক্ষা পাবার একটা উপায় তবু করে দিয়ে যাচ্ছি। কাল যে মাছ দেখে নাক সিটকেছিলে সেই মাছই ও থলিতে আছে। ওরা গা টিপে দুধের মতো যে রস বেরোয়, তাই একটু করে চারধারের জলে দিয়ো, হাঙরের চোদ্দ পুরুষের কেউ তোমায় ছোঁবে না। হাঙর খেদানো এ মাছের নামটাও মন্ত্রের মতো মনে রেখো। কাল প্রাণে বাঁচবার পর তোমার শাগরেদও এই মন্ত্র আমার কাছে শিখে তোমার মতো শয়তান সর্দারের সংশ্রব চিরকালের মতো ছেড়ে গেছে। মন্তরটা ধীরে ধীরে বলছি, ও মাছের গা টিপতে টিপতে মুখস্থ করে ফেললা—পাদাচিরস্ মার্মেরেটস।
ঘনাদা তাঁর বিবরণ শেষ করে আমাদের দিকে চেয়ে একটু হাসলেন, তারপর নিজের টঙের ঘরের দিকে পা বাড়াতে গিয়ে ফিরে দাঁড়িয়ে শুধু বললেন, ও একটা কথা ভুলে যাচ্ছিলাম। এ আরামকেদারাটা একটু পুরনো হয়ে গেছে। একজিবিশনের মেলায় আজ নতুন একটা অর্ডার দিয়ে এসেছি। ওরা কালই হয়তো পাঠিয়ে দেবে।
ঘনাদা আর দাঁড়ালেন না।
কালেদের মতো কাঁচা চালাকি চালাতে যাবার খেসারত তখন আমরা মেনে নিয়েছি।