আমাদের ক্লাসের কোন ছেলেটাকে তোর সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে?” নবম শ্রেণীতে পড়ুয়া টিনএজ সোমা, যথেষ্ট সুন্দরী ছিমছাম গঠন আর হালকা একটু শর্ট। তবে এই মুহূর্তে ওর বান্ধবীর মুখে এমন প্রশ্ন শুনে একদম অপ্রস্তুত হয়ে গেলো! যদিওবা সে এই প্রশ্নের সঠিক মানেটা বুঝতে পারেনি। হয়তোবা ওই মনে করেছে ভালোলাগে বলতে, সুন্দর- স্মার্ট- ডিসেন্ট ও ভালো ছাত্রই হবে! এসব দিক থেকে বিবেচনা করলে, ক্লাসের ফিফ্থ বয় মাহিন ছিলো।সেজন্য সাত পাঁচ না ভেবেই, সোমা তড়িৎ উত্তর দিয়ে দেয়ঃ
—– কে আবার হবে, অবশ্যই মাহিন!
তবে সোমার বলা কথাটা যেন কাল হয়ে দাঁড়ালো! কেননা ওর কাছে যে দুজন বান্ধবী জিজ্ঞেস করেছিল, তাদের মধ্যে একজন ছিল মাহিনের লাভার মীম। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার ছিল যে, ওদের দুজনের রিলেশনের বেপারটা তৃতীয় কোন ব্যক্তি জানতো না। তাছাড়া ওদের এই রিলেশনকে গোপন রাখার জন্য, ওরা খুবই গোপনীয়তা অবলম্বন করতো। কেননা মীমের পরিবার ছিল প্রভাবশালী, হিতে বিপরীত কিছু হয়ে যাবে বিদায় এই গোপনীয়তা!
অপরদিকে মীমও ছিল খুবই চালাক চতুর ও সূক্ষ্ম ব্রেনের মেয়ে, তাইতো সোমার বলা কথাকে কেন্দ্র করে গুগলি গেইম আরম্ভ করে দেয়। সে চিন্তা করলো– “আমি যদি এখন সোমার এই কথাকে সিরিয়াস বানিয়ে পুরো ক্লাসে ছড়িয়ে দিতে পারি যে, সোমার সাথে মাহিনের প্রেমের সম্পর্ক আছে; তাহলে আমরা দুজন অবাধে মেলামেশা করতে পারবো এবং কেউ আমাদের সন্দেহ করবে না!”
যেই ভাবা সেই কাজ, মীম তাঁর সাথে থাকা বান্ধবী আনিকাকে বললোঃ “দেখছিস, তলে তলে এত দূর আর আমরা কিচ্ছু জানিনা!” ব্যাস একেতো বান্ধবী আনিকা ছিলো নাচনেওয়ালি, সেখানে মীম দেয় ঢোলের বাড়ি। তারপর আর মীমকে কষ্ট করতে হয়নি, বাকিটা আনিকা একাই কাভার করে দিয়েছে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে পুরো ক্লাসের সবাই জেনে গেলো “মাহিন-সোমার” নয়া প্রেমের কেমিস্ট্রি, ফিজিক্স ও ক্লাইমেক্স, যদিও ইহা ছিলো ফেইক!
তারপর সব বান্ধবীরা মিলে মাহিনের নাম নিয়ে সোমাকে খ্যাপাতে লাগলো। প্রথম কয়েকদিন এই টর্চারিং সোমাকে পাগল করে দিলো, তাই কমনরুম- ওয়াশরুম এমনকী ক্লাসে বসেও মাঝেমধ্যে কান্না করতো। এতে সবাই আরো বেশি সুযোগ পেলো, তাই খ্যাপানোর মাত্রা বাড়িয়ে দিলো। সোমা এটা নিতে না পেরে কিছুদিনের জন্য স্কুল আসা বন্ধ করে দিল আর তখনই সে উপলব্ধি করলো, এই মিথ্যে নাটকের মধ্যে ভালোবাসার অস্তিত্ব বিদ্যমান আছে! হয়তো এজন্যই ওই মাহিনকে মিস করা শুরু করলো! মানে ওর ভিতরেও মাহিনের জন্য আলাদা একটি জমি বরাদ্দ হয়ে গেছে।
এসবের পিছনে দুইটা কারণ হতে পারেঃ এক– মাহিন ও সোমাকে নিয়ে সবাই এত এত খ্যাপাতো যে, হয়তো ছর জন্যেই ওর মনের ভিতর একটা জায়গা তৈরি হয়ে গেছিল। নয়তোবা নাম্বার 2– মীম গেমটা শুরু করার পর মাহিনকেও এটা শেয়ার করেছিল এবং বলেছিল সোমার সাথে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে ও টিফিন আওয়ারে সোমাকে চকলেট- আইসক্রিম খাওয়াতে। যাতে সবাই এই রিলেশনের ব্যাপারটা বিশ্বাস করে আর সেই ফাঁকে ওরা দুজন সেইফ থাকে!
এদিকে সোমার মনের ভেতর তিল তিল করে ভালোবাসার পাহাড় জমছিল, মাহিন কে নিয়ে। অপরদিকে মাহিন ও মীমের ভালোবাসার দৌরাত্ম্য দিন দিন বাড়তে ছিল। কেননা ওরা তখন নিশ্চিন্তে প্রেমের বৃন্দাবন সাজাচ্ছিলো।
তবে কথায় বলে, “ভাগ্যের লিখন না যায় খন্ডন!” তাইতো হুট করে এক কালবৈশাখী ঝড়ে ওরা তিনজন ছিটকে পড়ল তিন প্রান্তে। মাহিন ও মীমের সম্পর্কের খবর পৌঁছে যায় মীমের গার্জিয়ানের কানে। একদিনের ভিতর মীমকে স্কুল বদলি করিয়া, ভর্তি করে দেয় অন্য বিভাগীয় স্কুলে!
মাহিন বা মীম কতটা কষ্ট পেয়েছিল সেটা কেউ দেখেনি, তবে এই খবরটা ক্লাসের সবার কানে পৌঁছালে সবথেকে বেশি বিধ্বস্ত হয়েছিল সোমা। ওর স্বপ্নের নায়ক ওর সাথে এরকম করে মিথ্যে অভিনয় করতে পারলো, সেটা ভাবতেই ওর কলিজা ছিঁড়ে আসতেছিল। প্রচুর কান্না করেছিল, স্কুল আবসেন্স করেছিল। এমনকী কিছু দিন অসুস্থ হয়েও শয্যাশায়ী ছিল!
তারপর কেটে যায় কয়েকটি মাস, সবকিছুই আবার আগের মত স্বাভাবিক হয়ে যায়। শুধু মাহিন নিসঙ্গতা ফিল করে আর সোমা ভিতরে ভিতরে দুমড়েমুচড়ে মরে। বিশেষ করে মাহিনের এই নিঃসঙ্গতা ও মায়াবী চাহনি, সোমাকে যেন আরো বেশি পাগল করে দিচ্ছিল। মাহিনের প্রতি আরো গভীর ভালোবাসা জন্ম নিচ্ছিল সোমার মনে। ইচ্ছে করছিল মাহিনকে জড়িয়ে ধরে বলতে- “তোমার কোন দুঃখ নেই- কষ্ট নেই, সব আমাকে দিয়ে দাও আর পৃথিবীর সব সুখ তুমি নিয়ে নাও!”
এভাবেই ওরা ক্লাস নাইন থেকে টেনে উঠলো। নতুন বছর স্কুলের তেমন ক্লাস হচ্ছে না, সবাই স্পোর্টস ও কালচারাল প্রোগ্রাম নিয়ে ব্যস্ত। তবে সোমা লক্ষ্য করলো, মাহিন ওকে কিছুদিন ধরে ফলো করছে। সুমা যেখানেই যাক না কেন, মাহিন যেন ছায়ার মতো পিছু লেগে থাকে। সোমা ভাবলো হয়তো মাহিন তার ভুল বুঝতে পারছে এবং ওর কাছে ফিরে আসার জন্য পাঁয়তারা করছে। এটা ভেবে সোমা ভেতরে ভেতরে পুলকিত হয়ে উঠতে লাগলো আর চোখে মুখে ভালোবাসার রক্তিম আভা ফুটলো!
কিছুদিন পর ওদের স্কুল থেকে একদিনের জন্য শিক্ষা সফরে নেয়া হলো। মাহিনে শিক্ষাসফরে সোমাকে চোখে চোখে রাখল, অন্য ছেলেদের সাথে মিশতে দিলো না আর বিশেষ কেয়ারিং দেখালো। ইহাতে সোমা আরো বেশি মুগ্ধ হয়ে গেল। তবে শিক্ষা সফর থেকে ফেরার মুহূর্তে সোমার বান্ধবী আফ্রিন, মাহিনের বলা কথাগুলো সোমাকে বললোঃ–
“সোমা একা নিজের জন্যই সবকিছু কিনলি কিন্তু আমার জন্য কিচ্ছু কিনলো না, ইহাতে আমি খুব কষ্ট পেয়েছি!”
সোমা যেন সপ্তম আসমান থেকে ছিটকে নীচে পড়ল। একেতো এটা ওর খুশির খবর, অপরদিকে ওরই প্রিয় মানুষটিকে কিছু কিনে দিতে পারেনি সে কষ্টে। ওইতো কখনো এরকম করে ভাবেই নি, সত্যিই তো ওই স্বার্থপরের মতো শুধু নিজের জন্যই কিনেছে। সোমারা 5 বান্ধবী মিলে একী ব্র্যান্ড ও কালারের স্পেশাল শুপিস কিনেছিল, শেষে ঐটা মাহিনকে গিফট করে। তবে সোমার এই সুখ বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না, কেননা ওই পরে জানতে পারল– “এটা নাকি মাহিনের বাজি ছিল, ওর নিকট থেকে গিফট নিয়ে ছাড়বে!”
এই ব্যাপারটা দ্বিতীয়বার আবার সোমাকে কাঁদা লো, তাই ওই প্রমিস করল আর কখনো মাহিনকে ভালবাসতে যাবে না। তো দেখতে দেখতে বৈশাখী মেলা চলে আসলো আর সোমাকে উইশ করার জন্য, মাহিন একদিন ওর কোচিংয়ে উপস্থিত হলো। তারপর যখন মাহিন ওকে উইশ করলো, তখন সোমা খুশিতে কেঁদে দিলো! আর ওর কান্না দেখে সেদিন মাহিনও অনেক কান্না করলো! অতঃপর মাহিন বললো, “আমরা সবসময় ভালো বন্ধু হয়ে থাকবো, কেউ কাউকে কখনো কষ্ট দেবো না!”
তারপর অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে, ভাল-মন্দের ভিতর দিয়ে এসএসসি পরীক্ষার সময় হয়ে আসলো। যেদিন বিদায় অনুষ্ঠান হলো, সেদিন আবারো মাহিনের চোখে ভালোবাসা দেখতে পেল সোমা। বিশেষ করে, সোমার পিছুই যেন ছাড়ছিল না মাহিন আর ওর চোখ ছিল অশ্রুসিক্ত। অনুষ্ঠান শেষে সোমাকে আবেগী কন্ঠে বলেছিলো, “ওদের মধ্যে আর নিয়মিত দেখা হবে না, কথা হবে না, খুব কষ্ট হবে ওর!”
অতঃপর সোমাকে রিকোয়েস্ট করলো, ওর সাথে মোবাইলে সেলফি তোলার জন্য। সোমা সম্মতি জানালে, এই প্রথম সোমার কাঁধে হাত রেখে কয়েকটা সেলফি তোলে মাহিন। যখন মাহিন সেলফি তুলছিল তখন সোমা স্বপ্নে আচ্ছন্ন হয়ে আছিল– যেন নতুন কোন সুখের আবেশ, রঙিন দিগন্ত ওকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। অবশ্য এই ছবি তোলা নিয়ে, সোমার বড় ভাই সোমাকে অনেক বকা দিয়ে ছিলো। ওই এখনো জানে না, কিভাবে ওর ভাইয়া এটা জানতে পেরেছিল!
যাহোক এসএসসি পরীক্ষা চলছে, হুট করে একদিন মাহিন ওকে বললো– “আজকে রাত্রে তুমি তোমার আম্মুর ফোন দিয়ে আমাকে মিস কল দিবা, আমি তোমাকে কল ব্যাক করবো! কেননা তোমার সাথে আমার ইমারজেন্সি কথা আছে!” সোমার মনে আবার স্বপ্নের জাল বুনতে লাগলো। নতুন স্বপ্নে আবার বিভোর হয়ে যেতে লাগলো। ওর নিজেকে দেয়া সেই প্রমিস, যেন বারবার ভুলে গেলো। রাতের বেলাতে সত্যি ফোন করেছিল মাহিন, তবে যেটা সোমাকে শুনিয়েছিল তার জন্য ওই মোটেই প্রস্তুত ছিল না!
সোমা ও মাহিনের পরীক্ষার হল ছিল ভিন্ন। সোমা যে হলে পরীক্ষা দিচ্ছে, সেখানে ওর সাথে একটা মেয়ের খুব ভালো বন্ধুত্বের সম্পর্ক হয়। মেয়েটির নাম চৈতি এবং যথেষ্ট সুন্দরী। আর এই মেয়েটির সাথে প্রেম করিয়ে দেওয়ার জন্যই, সোমাকে রিকোয়েস্ট করেছে মাহিন। এই কথা শোনার পর সোমা এত কান্না করছিল যে, ফোনে আর কথা বলতে পারলো না! সেজন্য মাহিনকে বললো, “তুমি টেক্সট করো আমি উত্তর দিচ্ছি!” তবে সোমা যতক্ষণ ফোন হাতে রাখছিল, ততক্ষণই চোখের পানি টলমল করে নিচে ঝরে পড়ছিল।
তারপর চৈতির সাথে মাহিনের সম্পর্ক হয়, ওদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্কও গড়ে ওঠে। তবে মাহিন এসএসসি পাশের পর, কলেজে ভর্তি হয়ে চৈতির সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। অবশ্য তার কিছুদিন পর চৈতির বিয়ে হয়ে যায় আর মাহিন হাঁফ ছেড়ে বেঁচে যায়। আবারো মাহিনকে নিঃসঙ্গতায় গ্রাস করে, তাই পুরান চাল ভাতে বাড়ার মতো– “পুনরায় সোমার পিছনে লাগে!” মিষ্টি ব্যবহার ও মধুর সুরে কথা বলতে আরম্ভ করলো!
সোমাকে বিভিন্নভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে। সে তাঁর ভুল বুঝতে পারছে, তাই সোমা যদি ওকে আগের মতোই ভালবেসে থাকে তাহলে যেন ফিরে আসে। সোমার জন্য, মাহিন দুহাত বাড়িয়ে অপেক্ষা করবে। তবে এতদিনে সোমাও মাহিনকে ভালোভাবে জেনে যায়, “সে কোন জলের মাছ?” তাইতো সরাসরি না করে দেয়! কেননা ওই আর নতুন করে কোন কষ্ট পেতে চায় না। মাহিন ওকে ভালোবাসুক আর নাই বাসুক তবে সোমা চায়, ওর কাছে মাহিন ঘৃণার নয় বরং ভালোবাসার মানুষ হয়ে বেঁচে থাকুক।
তাছাড়াও হয়তোবা সোমার মন বলছিল, এটাও মাহিনের একটা মিথ্যা প্রস্তাব বা ভালোবাসা! তাইতো দুদিন পরেই সোমা প্রমাণ পেয়ে যায়, যখন এই বিষয়ে ওর আরেক ক্লাসমেট মাহিনকে জিজ্ঞেস করে তখন মাহিন এই কথা অস্বীকার করে আর সোমাকে কোন ধরনের ভালবাসার কথায় বলেনি এটা বললো! তারপর কেটে গেছে কয়েকটি বছর, ওদের মধ্যে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। হয়তোবা কেউ কারো খোঁজ খবর রাখেনি। তারপর সেদিন হুট করেই ওদের মধ্যে দেখা, তবে মাহিনকে দেখে সোমা নির্বাক হয়ে যায়। কেননা এই মাহিন আর সেই মাহিন আকাশ-পাতাল তফাৎ।
অনেক শুকিয়ে গেছে, মাথার চুলগুলো উস্কো খুস্কো। চেহারার মধ্যে কোন লাবন্যতা নেই, যেন ঝড়ের কবলে পড়া কোন লেজকাট শেয়াল। পরে জানতে পারলো, অনেকগুলো মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিলো ওর, এমনকী পতিতা পল্লীতেও নিয়মিত যাতায়াত করতো। অবশেষে শরীরের মধ্যে বাসা বাঁধছে মরণব্যাধি-এইডস। সোমা জানে মাহিন ভালো না, এমনকী কখনোই ভালো ছিল না। এত কিছুর পরেও সোমা পারেনি এই লোকটাকে ঘৃণা করতে। আজও যখন ওই একা থাকে, তখন মাহিনকে প্রচুর মিস করে। হয়তোবা সবার অন্তরালে দুচোখ বেয়ে অশ্রুও ঝরে। তবে একটা কথা ভেবে, প্রায়ই সোমা আপন মনে হাসে। একদিন মাহিন স্কুল লাইফে সবার সামনে বলেছিল– “আমাদের ক্লাসের সব থেকে ভালো ও লক্ষী মেয়ে সোমা!”
সেজন্যই হয়তোবা বলে, সুখ স্মৃতি মানুষকে বেঁচে থাকার শক্তি দিয়ে থাকে আর দুঃখের স্মৃতি কুঁড়ে কুঁড়ে মারে! তো যাহোক এতকিছুর পরেও সোমা যে, মাহিনের কাছে ভালো মেয়ের আখ্যা পেয়েছিলো, এটা ভেবেই ওর ভালো লাগে! সোমা এখনো মাঝে মাঝে মাহিনকে স্বপ্নে দেখে, রঙ্গিন স্বপ্ন! তবে প্রায়ই সোমা ভাবে, এটা কি ওর ব্যর্থ প্রেম; নাকি একতরফা ভালোবাসা? অবশ্য আমি এটাকে বলবো- “বিষাক্ত গোলাপ!”