ঘনাদার ফুঁ

ঘনাদার ফুঁ

ঘনাদার ফুঁ

জুদশি, বলেছেন ঘনাদা।

মাথার ঘিলু ঘোলানো চক্ষু ছানাবড়া করা উচ্চারণটা শুনতে কিছু ভুল হয়েছে কি বুঝতে না পেরে আমাদের হতভম্ব মুখ দিয়ে অজান্তে এই শব্দটাই আপনা থেকে আবার বেরিয়েছে—জুদশি!!!

হ্যাঁ, জুদশি! আমাদের মাথাগুলো আরও চরকি পাকে ঘুরিয়ে ঘনাদা বলেছেন, সব কিছু একেবারে অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে।

এরপর ঘনাদা আরও একটু বিশদভাবে আমাদের যা বুঝিয়েছেন, তাতে ঘনাদার সঙ্গে আমরা দুই-এ দুই-এ চার-এর জগতে আছি, কোন ভেলকিতে হঠাৎ আয়নার ওপিঠের আবোলতাবোলের মুলুকে চালান হয়ে গেছি, এই ধোঁকায় পড়ে খানিক প্রায়। বোবা আর বে-এক্তিয়ার হয়েই থেকেছি। ঘনাদার আড্ডাঘর ছেড়ে চলে যাওয়াটা আটকাবার চেষ্টা করতেই পারিনি।

আচমকা জুদশি-র এই মাথার ঘিলু ঘোলানো বিভ্রান্তিতে পৌঁছবার জন্য তার আগের ইতিহাস একটু জানা দরকার।

সে ইতিহাস এক হিসেবে দারুণ সেই বিস্ফোরণ থেকেই শুরু বলা যায়।

কোথাকার কী বিস্ফোরণ না বলতেই কেউ কেউ কিছুটা বুঝেছেন নিশ্চয়। ঠিকই তাঁরা বুঝেছেন।

বাহাত্তর নম্বরে বিস্ফোরণ! হ্যাঁ, প্রায় পারমাণবিক বিস্ফোরণই বলা যায়।

সেই বাপি দত্ত বিগড়ি হাঁস খাইয়ে খাইয়ে আমাদের পেটে চড়া পড়িয়ে এ মেস ছেড়ে যাবার পর থেকে এমন হুলুস্থুল কাণ্ড আর হয়নি।

গৌরের সেই ইন্দ্রলুপ্ত নিবারণী তেলের শিশির সেই নিদারুণ পরিণামের পরও বাহাত্তর নম্বরে এমন সাংঘাতিক সংকট দেখা দেয়নি।

কারণ এবার গৌর, শিবু কি আর কেউ তো নয়, খেপেছে স্বয়ং শিশির। সেই শিশির যার শরীরে সত্যিকার রাগ আছে বলে আমরা কখনও জানতে পারিনি।

কিন্তু সেই শিশির এখন একেবারে যেন বাহাত্তর নম্বরে দাবানল।

দাবানলটা যে হঠাৎ তুমুল হয়ে উঠবে, তার আভাস কিন্তু বেশ কিছুদিন আগে থাকতেই আমাদের পাওয়া উচিত ছিল। আভাস যে পাইনি তাও ঠিক নয়। কেমন একটু কোথায় যেন ধোঁয়ার গন্ধ পাচ্ছিলাম। তবে সেটা নেহাত ধোঁয়া বলেই উড়িয়ে দিয়েছিলাম।

ধোঁয়ার আভাসটা ছিল শিশিরের নতুন এক বাতিক।

যখনই সময় সুবিধে পায় শিশির আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজেকে কী যে দেখে প্রথমটা বোঝা যায়নি।

আমরা ঠাট্টায় সরব হয়ে তখনও উঠিনি। মুখ টিপে শুধু হাসাহাসি করি। সরব ঠাট্টার খোঁচাটা গৌরই প্রথম দিলে।

আমাদের দোতলার আড্ডাঘরে আর যাই থাক আয়না-টায়নার কোনও বালাই নেই।

শিশিরকে কিছুদিন থেকে আড্ডাঘরে সময়মত দেখা যায় না এলে একটু দেরি করেই আসে। কোনও কোনও দিন তার দেখাই পাওয়া যায় না।

দেখা যখন পাওয়া যায় তখনও কেমন গম্ভীর অন্যমনস্ক। কী যেন একটা ভাবনা ওর ওপর চেপে আছে।

সুস্থ সবল নির্ঞ্ঝাট ছেলে। তার হঠাৎ এমন গুরুতর ভাবনার ব্যাপার কী হতে পারে? আর সে ভাবনার সঙ্গে ফাঁক পেলেই আয়নায় ঘন ঘন চেহারা দেখার সম্বন্ধটা কী?

শিশির কি হঠাৎ সিনেমার হিরো হবার কথা ভাবছে নাকি! চেহারা নিয়ে তাই এত মাথাব্যথা!

সেদিন আমাদের সবাইকার পরে শিশির অমনই অন্যমনস্ক চেহারা নিয়ে আড্ডাঘরে এসে ঢাকবার পর গৌর খুব গম্ভীর হয়ে প্রস্তাব করলে, আচ্ছা, আমাদের এ বৈঠকের ঘরে একটা বড় আয়না রাখলে হয় না? কী বলিস, শিশির?

অ্যাঁ? শিশির কথাটা যেন বুঝতেই না পেরে প্রথমটা কেমন একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলে, আয়না? –

হ্যাঁ, গৌর গম্ভীর মুখেই ব্যাখ্যা করে বোঝালে, এই আড্ডাঘরে একটা বড় আয়না রাখার কথা বলছি। কত সুবিধে হয় বল তো? যখন খুশি চেহারা-টেহারা দেখে ঠিক করে নিতে পারি।

আমরা তখন কোনও রকমে মুখ ঘুরিয়ে মাথা নিচু করে হাসি চাপবার চেষ্টা করছি।

কিন্তু এত বড় একটা মোটা ঠাট্টার খোঁচা শিশির যেন টেরই পেল না। ক্ষুগ্ন হওয়া কি রেগে ওঠার বদলে, ও ধার দিয়েই না গিয়ে, গম্ভীরের সঙ্গে একটু যেন করুণ হয়ে একেবারে অন্য লাইনে চলে গেল।

এখানে আয়না? একটু বিব্রত হয়েই আপত্তি জানিয়ে সে বললে, না না, এখানে আয়না রেখে কোনও লাভ নেই। আর নিজে নিজে দেখে কিছু বোঝাই যায় না।

ঠাট্টার খোঁচা দিতে গিয়ে আমরাই তখন হতভম্ব। আবোলতাবোল কী বলছে শিশির? আয়নায় মুখ দেখতে দেখতে মাথাটাতেই গোলমাল হয়ে গেল নাকি? কথার সঙ্গে কথার কোনও জোড়-ই নেই যে!

জোড়টা কোথায় শিশিরের পরের কথায় কিছুটা বোঝা গেল।

আমাদের একেবারে অবাক করে দিয়ে শিশির বেশ একটু ব্যাকুল ভাবে জিজ্ঞাসা করলে, আচ্ছা, তোরা কিছু বুঝতে পারছিস?

কী বুঝব আমরা! আমাদের হতভম্ব জিজ্ঞাসা।

এই, মানে, এই, শিশির একটু আমতা আমতা করে বললে, আমার চেহারা কি ক্রমশ খারাপ হয়ে যাচ্ছে?

খানিকক্ষণ আমাদের কারও মুখে আর কথা নেই।

গৌরই প্রথম সামলে উঠে জিজ্ঞাসা করলে, তোর চেহারা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে কি

তাই আমাদের কাছে জানতে চাইছিস? চেহারা খারাপ হচ্ছে কি না বোঝবার জন্যই তুই আজকাল আয়না নিয়ে এত মত্ত?

হ্যাঁ, শিশির বেশ হতাশ সুরে বললে, কিন্তু নিজে দেখে কিছু বোঝা যায় না। এই একদিন মনে হয় একটু বোধ হয় চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়েছে, তার পরের দিন বেশ ফ্যাকাশে দেখায়। গালের হাড় দুটোর ওপর তো রোজ দুবেলা নজর রাখি, কিন্তু এবেলা একটু পুরন্ত মনে হলেও ওবেলা ঠিক একটু করে ঠেলে উঠেছে বোঝা যায়। তাই বলছি—ও আয়নায় নিজে দেখে কিছু বোঝা যায় না। কিন্তু চেহারা নিয়ে অত বোঝাবুঝির দায়টা কীসের? আমি জানতে চাইলাম, তোর হয়েছেটা কী?

কী হয়েছে? শিশির এবার একটা মডেল দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ল, কী হয়েছে তা যদি জানতেই পারতাম!

হ্যাঁ, এই ভাবেই শুরু। তারপর দিন দিন মাত্রা চড়েছে।

প্রথমে শুধু চেহারা দেখা, আর মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছিল।

সেই সঙ্গে একটু একটু আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ।

যেমন, আজ সকালের কাশিটার আওয়াজ শুনলি?

কাশির আওয়াজ!—আমরা সত্যিই বেশ অবাক—কাশির আওয়াজ আবার কোথায়? কার কাশি?

কার কাশি আবার? আমার কাশি। শিশির বেশ ক্ষুব্ধ আমাদের উদাসীনতায় আজ সকালে কীরকম কাশলাম, শুনলি না? খেয়ালই করিসনি বোধহয়।

খেয়াল করব না কেন? করেছি বলেই জোর দিয়ে বলতে পারি—ওই সকালের কাশির কথা বলছিস। সে আবার কাশি কোথায়! ও তো তুই ডিমের পোচ খেতে গিয়ে বিষম খেলি!

বিষম খেলুম—শিশির যেন অপমানিত—তোরা তো তাই বলবি। বলে রেগে উঠেই চলে যায় ঘর থেকে।

তখন রাগে সঙ্গ ছেড়ে গেলেও ছাড়াছাড়িটা স্থায়ী নয়। শারীরিক দুঃসংবাদ দেবার জন্য আবার আমাদের কাছেই আসতে হয়।

কাল রাত্রে কীরকম ঘাম হয়েছে জানিস? শিশির গভীর হতাশা ফুটিয়ে তোলে

তার গলায়।

ঘাম! কাল রাত্রে ঘাম! আমরা হেসে না উঠে পারি না।

হাসতে হাসতেই গৌর বলে, কাল রাত্রে গুমোট গরমের ওপর লোডশেডিং-এ পাখা বন্ধ। কার না ঘাম হয়েছে কাল। আমাদেরও তো হয়েছে।

তা তোদের হতে পারে। কিন্তু আমার ঘাম আলাদা! বলে নিজের সাংঘাতিক। ঘামের গর্বে আর দুঃখে শিশির আমাদের সঙ্গে কথাই বন্ধ করে দেয় কিছুক্ষণ।

শুরুতে এই গুমোট আগুনের আঁচ আর ধোঁয়াটুকুই ছিল।

এ শুরুর অবশ্য আরও আগের সূচনা আছে। সে সূচনা হল শিবুর একটি মারাত্মক আহাম্মকি থেকে।

কোথাও কিছু নেই হঠাৎ তার খেয়াল হয়েছে ডাক্তারি শিখে দাতব্য চিকিৎসা করে দেশের সেবা করবে।

এ সংকল্পের তাগিদে, না, কোথাও মেডিক্যাল কলেজে কি স্কুলে ভর্তি হয়নি বাজার থেকে একটি মহাভারতপ্রমাণ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার বই কিনে এনেছে।

কিনে আনার পর কী তার আস্ফালন। বইটা বেশ একটু কোঁত পেড়ে তুলে ধরে আমাদের দেখিয়ে বলেছে, জানিস কীরকম বই এটা! দুনিয়ায় হেন রোগ নেই—যার চিকিৎসার কথা এখানে পাবি না।

শিবুর কিন্তু বইটা পড়ে দাতব্য চিকিৎসা করা আর হয়ে ওঠেনি। তার বদলে বইটা পড়তে শুরু করেছে শিশির।

আর সেই থেকেই একটু একটু করে অ আ ক খ-র ধাপে ধাপে উঠতে উঠতে সে বুঝেছে যে, যে অক্ষরের পাতায় সে এখন পৌছেছে, তা পর্যন্ত দেওয়া সব কটি রোগের সে একটি ডিপো।

অ থেকে এসে ক-এ ষ-এ ক্ষএ পৌছে তাই সে প্রতিদিন সাংঘাতিক সব লক্ষণ নিজের মধ্যে আবিষ্কার করতে শুরু করেছে।

লক্ষণ তো একটা নয়, অনেক। আর সব যে একেবারে বৃহৎ চিকিৎসা-বারিধির বর্ণনার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে শিশির তা বিশদভাবে আমাদের বুঝিয়েছে—এই যেমন সকাল বিকেল তার দারুণ খিদে পাওয়া। এটা তো আর তার নিজের নয়, এ হল তার রোগের রাক্ষুসে হ্যাংলামি।

আর ওই যে ঘুম। এত সব দুর্ভাবনা থাকলেও বিছানায় শুয়ে বালিশে মাথা ঠেকাতেই যে ঘুমে বেহুশ হয়ে যায় এ তো একেবারে সাংঘাতিক খারাপ লক্ষণ।

শিশির নিত্য নতুন এমনই সব লক্ষণ আবিষ্কার করে আমাদের শোনায় আর আমরা ঠাট্টা-ইয়ার্কিতে আর উৎসাহ না পেয়ে তার জন্য রীতিমতো চিন্তিত হয়ে উঠি।

বাহাত্তর নম্বরের এত বড় যখন সমস্যা, তখন সেই টঙের ঘরের সেই তিনি করছেন কী? তিনি কি আমাদের পরিত্যাগ করেছেন, না তাঁর শরণ আমরা নিতে চাইনি।

না, তিনি আমাদের পরিত্যাগ করেননি, বহাল তবিয়তেই তাঁর টঙের ঘরে বিরাজ করছেন, আর আমরাও তাঁর শরণ নিতে ভুল করিনি।

কিন্তু ভাগ্যের দোষে চালটা যেন কেমন কেঁচে গিয়েছে। শিশিরের রোগের সেই গোড়ার দিকেই খেইটা ঘনাদাকে ধরিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিলাম। ঘনাদা সেদিন সবে এসে তাঁর মৌরসি কেদারাটিতে গা এলিয়ে দিয়েছেন। তাঁর প্রাত্যহিক অধিষ্ঠান অনুষ্ঠানের একটু ত্রুটি হয়েছে বলেই মুখটা খুব প্রসন্ন দেখায়নি।

তিনি এসে আরামকেদারাটি দখল করার পরেই শিশির তার ডান হাতের তুলে ধরা তর্জনী আর মধ্যমার মধ্যে একটি সিগারেট গুঁজে দিয়ে ভক্তিভরে লাইটার দিয়ে জ্বালিয়ে দেবে এই হল বাহাত্তর নম্বরের দস্তুর।

কিন্তু শিশিরই তখনও ঘরে আসেনি, এ অনুষ্ঠান আর পালন করবে কে?

খানিক বাদে শিশির অবশ্য এসেছে কিন্তু এ তো অন্য শিশির। কেমন অন্যমনস্ক ভাবে মনটা যেন আর কোথাও ফেলে রেখে এসে একটা চেয়ারে বসেছে শুধু।

শিশিরকে দেখে ঘনাদা উৎফুল্ল হয়ে স্বাগত জানিয়েছেন, এই যে শিশির।

শিশির তাঁর দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছে। সিগারেট সে যে হঠাৎ ছেড়ে দিয়েছে, তা না জানাক, একটু হেসেও ঘনাদার সম্ভাষণের মান রাখেনি। বাঁ হাতের আঙুল দিয়ে ডান হাতের কবজি ধরে সে তখন তার নাড়ি দেখতে তন্ময়।

ঘনাদা ভুরু কুঁচকে সেদিকে তাকিয়েছেন। আমরাও অস্বস্তি চাপা দিয়ে আসল কথাটা তোলবার সুযোগ নিয়েছি ওই নাড়ি টেপা থেকেই।

নাড়িটা আজ কীরকম দেখছিস? জিজ্ঞাসা করেছে গৌর।

খুব খারাপ, খুব খারাপ! শিশির যেন তার ফাঁসির হুকুম শুনিয়েছে, আঙুলে একেবারে স্পষ্ট টের পাওয়া যাচ্ছে।

বলতে পারতাম—তা যাবে না তো কি, নাড়ি ছেড়ে গেছে মনে হবে! কিন্তু তা না বলে খেইটা ওইখান থেকে ধরাবার চেষ্টা করেছে শিবু। বলেছে, খুব গম্ভীর হয়ে, নাড়িটা আপনি একবার দেখুন তো, ঘনাদা?

বরাদ্দ মাফিক সিগারেটের নজরানা না পেয়ে ঘনাদার মেজাজ এমনিতেই তখন খিচড়ে আছে! নাড়ি দেখার অনুরোধে হঠাৎ তেতো চিবিয়ে ফেলার মতো মুখ করে বলেছেন, কী দেখব? নাড়ি? কার নাড়ি?

তাঁর মুখের চেহারা লক্ষ করতে গেলে আমাদের তখন চলে চলে না। সেদিকে যেন চোখই না দিয়ে মিনতি করেছি, ওই শিশিরের নাড়িটা একটু দেখতে বলছি। ও ক-দিনে কীরকম শুকিয়ে গেছে তাও একটু যদি দেখেন।

মুশকিল আসান হয়ে সব গোল মিটে যেতে পারত ঘনাদাকে একটু কেরামতি দেখাবার সুযোগ তখন দিলেই।

কিন্তু তা হবার নয়।

বৃহৎ চিকিৎসা বারিধিতে নতুন কী পড়ে জানি না, তার মেজাজ সেদিন একেবারে যেন বুনো কাঁটা নটে। ঘনাদার নাড়ি দেখবার কথায় জিভে যেন ক্ষুর এঁটে বলেছে, ঘনাদা দেখবেন! কী দেখবেন উনি শুনি? ওঁর চোখে কী এক্স-রে আছে, না ওর আঙুলগুলো ই সি জির যন্ত্র, ডাক্তারি মানে আজকাল কী, তা উনি জানেন? মান্টু টেস্ট, ই এস আর, স্টারন্যাল পাংচারের নাম শুনেছেন কখনও? কী জানেন উনি এ সব ব্যাপারে?

সর্বনাশা ব্যাপার। সভয়ে আমরা এবার ঘনাদার দিকে তাকিয়েছি। বাহাত্তর নম্বরের টঙের ঘর বুঝি চিরকালের মতো খালিই হয়।

কিন্তু না, সে রকম কোনও লক্ষণ নেই। তার বদলে ঘনাদার মুখে রহস্যময় প্রশান্ত এক হাসি আর সেই সঙ্গে আমাদের মাথার ঘিলু ঘোলানো চক্ষু-ছানাবড়া করা উচ্চারণটুকু—জুদশি!

অ্যাঁ! নিজেদের অজান্তেই আমাদের গলায় বিহ্বল বিস্ময়ের প্রশ্নটা বেরিয়েছে— জুদশি!!!

হ্যাঁ, আমাদের মাথাগুলো একেবারে চরকি পাকে ঘুরিয়ে ঘনাদা বলেছেন, সব কিছু একেবারে অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে। সেনাপতি ঘোর জঙ্গলে ঢুকিয়ে দিলেন পথ হারিয়ে, মন্ত্রী খুঁজে খুঁজে গাছ কাটলেন ভোঁতা কুড়ুলে। বোটকা বুনো গন্ধই ছড়াল। রাস্তা বেরুল না। শেষে রাজা এসে জঙ্গলই জ্বালিয়ে উনুন পেতে বসালেন। ব্যস, তাতেই কাম ফতে! কিন্তু রাজার নাগাল পাচ্ছে কে?।

কথাগুলো বলেই ঘনাদা কেদারা ছেড়ে উঠে গট গট করে ন্যাড়া সিঁড়ি বেয়ে তাঁর টঙের ঘরে উঠে গিয়েছেন। শিশিরের বেয়াড়া ব্যাধির ছোঁয়াচে ঘনাদারই হঠাৎ মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে, না আমাদের বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পেয়েছে বুঝতে না পেরে দিশাহারা অবস্থায় ঘনাদাকে ডেকে থামাবার চেষ্টা পর্যন্ত আমরা কেউ করতে পারিনি।

চেষ্টা করলেও লাভ কিছু হত বলে মনে হয় না, কারণ ঘনাদা এক রকম যেন অটল জেদ নিয়েই আমাদের ছেড়ে গেছেন। আর সেই যে গেছেন তারপর থেকে আমাদের সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখছেন না বললেই হয়।

তা না রাখুন। বাহাত্তর নম্বর ছেড়ে যাবার হুমকি যে দেননি বা এখানকার হেঁশেলের অন্ন স্পর্শ না করবার গোঁ যে ধরেননি এই আমাদের ভাগ্যি।

তাঁকে নিজেদের খুশিমত থাকতে দিয়ে শিশিরকে নিয়েই আমাদের ব্যস্ত হতে হয়।

ঘন ঘন একটু আয়না দেখা আর নাড়ি টেপা থেকে বাতিকটা শিশিরের তখন ক্রমশ গুরুতর হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ ডাক্তার থেকে সে ডাক্তার, অ্যালোপ্যাথি থেকে হোমিওপ্যাথি, তা থেকে ইউনানি তো বটেই, সেই সঙ্গে ওষুধ কেনা আর তা বাতিল করার সে কী সৃষ্টি ছাড়া খ্যাপামি!

ওষুধ মানে অবশ্য শরীরের তাকত বাড়াবার সালসা অর্থাৎ টনিক যে বাজারে এত আছে তাই বা কে জানত। কোনও টনিকই শিশির কিনতে বাকি রাখে না, দুদিন বাদে ব্যাজার হয়ে বাতিল করতেও তার দেরি হয় না।

এক ভিটামিন টনিকের বোতল সিকি না খরচ হতে হতে আসে কডলিভার অয়েলের শিশি, সেটার দু চামচ পেটে যেতে না যেতেই বাতিল হয়ে গ্লিসেরো ফসফেট না কী সব নার্ভ টনিককে জায়গা করে দেয়। নার্ভ টনিকের রাজত্বও দু-চারদিনের বেশি টেকে না। তারপর ঝাড়েবংশে সব অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ নিয়েই তাকে বিদেয় হতে হয়। তার জায়গায় যারা আসে সেই হেকিমি ইউনানি। সালসাও বেশি দিন কেউ পাত্তা পায় না। শিশিরের ঘরের শিশি-বোতলের কাঁড়ি সাফ করতে বনোয়ারিকে ঘন ঘন শিশি-বোতল বিক্রিওয়ালা ডাকতে হয় রাস্তা থেকে।

বাজারের জানা-অজানা সব টনিক পরীক্ষা শেষ হলে পর শিশিরের এ রোগ যদি সারে এই আশায় যখন দিন গুনছি, তখন হঠাৎ একদিন এই সালসার পাত্র থেকেই বাহাত্তর নম্বরের অমন একটা বিস্ফোরণ হবে ভাবতেও পারিনি।

আজকাল শিশিরের রোগের ওষুধ যেমন পথ্যিও তেমনই একটু আলাদা। শিশির আমাদের আর সকলের আগেই দিনে রাত্রে তার খাওয়াটা তাই সেরে আসে।

সেদিন সে তাই নিয়েছিল।

হঠাৎ নীচে থেকে তার একেবারে বাড়ি ফাটানো চিৎকার শুনে আমরা সবাই তাজ্জব! কী হল কী শিশিরের? তার রোগের বাতিক এতদিন যা দেখে আসছি তা

তো এমন বিকারের প্রলাপে দাঁড়াবার মতো কিছু নয়।

হুতুমড় করে সবাইকে নীচে নেমে যেতে হল তৎক্ষণাৎ। শিশির তখন আমাদের খাবার টেবিলে ঘুষি মেরে চিৎকার করছে, এ বাড়ির মেস করা আমি ঘুচিয়ে দেব। বাড়িওয়ালাকে দিয়ে নোটিশ দেব সকলকে ঘাড় ধরে বার করবার। আর কিছু না হোক ঘুণ ধরা কনডেমন্ড পোড়ড়া বাড়ি বলে করপোরেশনকে দিয়ে ভাঙিয়ে ছাড়ব। আর ওই টঙের ঘর সবার আগে গুঁড়ো করতে পারি কি না তাই দেখাচ্ছি!

শিশিরের খাবার টেবিলের ওপর একটা অর্ধেক খালি কাঁচের ছোট জার, আর তার এলোমলো আর্তনাদ মেশানো আস্ফালন থেকে ব্যাপারটা বুঝতে একটু সময়ই লাগল।

ব্যাপারটা যা বুঝলাম তা অবশ্য রীতিমত গুরুতরই বলতে হয়। অ্যালোপ্যাথি হোমিওপ্যাথি ইউনানি হেকিমি ছেড়ে শিশির সম্প্রতি কবিরাজির শরণ নিয়েছে। আর দু পকেট প্রায় খালি করে সাক্ষাৎ ধন্বন্তরী এক কবিরাজকে দিয়ে দুনিয়ার সেরা বৃহৎ ছাগলাদ্য ঘৃত তৈরি করিয়ে এনেছে ওই কাঁচের জারে। জারটা সুবিধের জন্য নীচে রামভুজের কাছেই থাকে, সকাল বিকেল চা জলখাবারের সময় শিশিরের যাতে খেতে ভুল না হয়।

টঙের ঘরের তাঁর ওপর কেন শিশির এতখানি খাপ্পা তা বুঝতে এরপর আর দেরি হল না।

শিশির বিবরণটা দিতে দিতেও একেবারে যেন চিড়বিড়িয়ে উঠে ওপর দিকে আঙুল দেখিয়ে বললে, আর উনি, তোমাদের ওই উনি সেই সাত রাজার ধন ওষুধ খাবলা খাবলা নিয়ে ভাতে মেখে খেয়েছেন।

দম নিতেই একটু থেমে শিশির গলাটা আরও চড়িয়ে দিল তারপর, এটা কি পাতে খাবার ঘি?

না, পাতে, ভাতে, কি শুধু, কোনওভাবেই ও ঘৃত খাবার জিনিস নয়।

এ কার গলা? চমকে আমরা পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখেছি, আমাদের অনুমানে ভুল হয়নি। স্বয়ং ঘনাদাই—যেন ঘড়ি ধরে যথাসময়ে যথাস্থানে অপ্রত্যাশিতভাবে এসে হাজির হয়েছেন।

আমরা যত খুশিই হই, শিশির তাঁকে দেখে একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। শিশির রাগে প্রায় তোতলা হয়ে উঠল—আপনি—আপনি আবার মুখ দেখাতে এসেছেন এখানে! লজ্জা নেই আপনার! জানেন কী জিনিস আপনি নষ্ট করেছেন? জানেন আমার এই জীবন-মরণ সমস্যায় প্রতিটি ফোঁটা যার অমৃত, সেই অমূল্য জিনিস আপনি ভাতে মেখে খেয়ে

জুদশি!

কথার মাঝখানে ঘনাদার ওই বিদঘুটে উচ্চারণে আপনা থেকেই একবার থেমে যাবার পর, শিশির আরও গনগনে আগুনে হয়ে উঠল, রাখুন রাখুন আপনার সব বুজরুকি। ও সব আমাদের ঢের দেখা আছে! আপনি—

হ্যাঁ, জুদশি! ঘনাদা আবার গম্ভীর ভাবে বাধা দিলেন, সব একেবারে অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে!

কী জুদশি? কী অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে? এবার হলকা ছোটানো গলায়।

আমাদের জিজ্ঞাসাটাও প্রকাশ করলে।

কী মিলে যাচ্ছে? ঘনাদা স্থির ধীর ভাবেই জানালেন, মিলে যাচ্ছে তোমার যা

হয়েছে তাই। নিদান বিধান সবই যাচ্ছে মিলে।

কী আবোলতাবোল বকছেন, কী?—এবার শিশিরের সুর একটু পালটানো, নিদান বিধান কোথায় কী মিলেছে?

ওই যে তোমাদের তখন শোনালাম, ঘনাদা আমাদের স্মরণশক্তি একটু উসকে দিলেন, ওই যে সেনাপতি দিলেন জঙ্গলে দিশাহারা করে, মন্ত্রী গাছ কাটলেন আর শেষে স্বয়ং রাজা এসে জঙ্গল সুদ্ধ জ্বালিয়ে উনুন পাতিয়ে বসালেন। ব্যস,রাস্তা খুলে গেল তাতেই।

এটা কী পাগলা গারদ পেয়েছেন! শিশির আবার খাপ্পা হয়ে উঠল, না, বৃহৎ ছাগলাদ্য ঘৃত ভাতে মেখে আপনার ঘিলুটাই গেছে ঘণ্ট হয়ে?

আমার হয়ে যায়নি, কিন্তু তোমার তা-ই হত।

ঘনাদার এ নিষ্ঠুর টিপ্পনি শুনে শিশিরের শোক আবার উথলে উঠল, আমার তা-ই হত! আমার প্রাণ বাঁচাতে স্বয়ং ধন্বন্তরীর মতো কবিরাজ অত কষ্ট করে যা তৈরি করেছেন, আমার অনিষ্ট হত সেই ছাগলাদ্য ঘৃত খেয়ে?

হ্যাঁ, হত—ঘনাদা এতক্ষণে খাবারঘরের একটা চেয়ার টেনে জুত করে বসলেন, কারণ ছাগ-টাগ তো নয়, তোমার ওই অমূল্য ঘৃতটি ছাগি দিয়ে তৈরি।

ছাগি দিয়ে তৈরি! ঘনাদার এ ধানিলঙ্কা ফোড়নের টিপ্পনিতে শিশির মারমুখোর সঙ্গে একটু যেন কাঁদো কাঁদো—আপনি পাতে একবার খেয়েই বুঝতে পারলেন। ঘি-টা ছাগলের নয়, ছাগলির?

হ্যাঁ, পারলাম। ঘনাদা করুণা করে বললেন, যেমন বুঝতে পারছি তোমার নিদান-বিধান সব দিয়ে গেছে জুদশি!

ফের! ফের সেই জুদশি! শিশির বুঝি শেষবার মেজাজ দেখাল, কে? কে আপনার জুদশি?

কে নয়, বলো, কী! ঘনাদা কৃপা করে তারপর বিশদ হলেন, জুদশি হল দুনিয়ার সবচেয়ে দামি সবচেয়ে বিরল, রোগচিকিৎসার গুপ্ত পুঁথি। জুদশির মানে হল অষ্টাঙ্গ গুপ্ত বিদ্যার মৌল চতুসূত্র, চোদ্দো হাজার ছন্দে বাঁধা শ্লোকে তা লেখা।

সেই পুঁথি আপনার কাছে আছে? এবার জিজ্ঞাসার ছলে উসকানিটা অবশ্য আমাদের। খাবার টেবিলের দুধারে ঘনাদা আর শিশিরকে ঘিরে আমরা তখন বসে পড়েছি।

আমার কাছে ও পুঁথি? ঘনাদা সত্যের মান রাখতে মহৎ হলেন, জুদশির একটিমাত্র গোটা পুঁথি আছে বুরিয়াতিয়ার উলান উদে শহরের লোক-সংস্কৃতি সংগ্রহশালায়।

সেই চোদ্দো হাজার শ্লোকের গোটা পুঁথিটি আপনি বুঝি পড়ে মুখস্থ করে রেখেছেন? আমাদের বিস্ময় মেশানো সরল জিজ্ঞাসা।

পড়ে মুখস্থ করে রেখেছি? সত্যের খাতিরে ঘনাদা আবার অকপট হলেন। একটু দুঃখের হাসি হেসে বললেন, সে পুঁথি পাব কোথায় যে পড়ে মুখস্থ করব। সে পুঁথি আমি চোখে দেখিনি এখনও।

তা হলে? আমরা এবার একটু বিমূঢ়, ও পুঁথির তো আর দ্বিতীয় কপি কোথাও নেই বলছেন?

তা তো নেই-ই। ঘনাদা হেঁয়ালিটা আরও গভীর করলেন, আর একটি গোটা পুঁথি জোগাড় করবার জন্য সোভিয়েত বিজ্ঞান-অ্যাকাডেমির সাইবেরীয় শাখার একটি স্বতন্ত্র কমিটিই তৈরি হয়ে তিব্বত মঙ্গোলিয়া আর বুরিয়াতিয়ায় আপ্রাণ সন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে।

তাতেও কিছু পাওয়া যায়নি?—আমরা সত্যিই খুব উগ্রীব।

গেছে। আগের মতোই এখানে ওখানে ছেঁড়াখোঁড়া এক-আধটা পাতা। ঘনাদা দুঃখের সঙ্গে জানালেন—অমন আরও কত পাতা মর্ম না বোঝার দরুন যে লোকে হেলায় নষ্ট করেছে তার ঠিক নেই।

মর্ম না বুঝে নষ্ট করেছে ওই অমূল্য জিনিস! আমরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ—কারা সেই আহাম্মক!

আহাম্মক তাদের বলা একটু অন্যায় হয়। ঘনাদা তাঁর মহানুভবতায় আসামিদের পক্ষ নিলেন—হাতে পেলেও ও পুঁথির মর্ম বোঝা তো যার-তার কাজ নয়। প্রথমত, পুঁথির পাতাগুলোই একেবারে অদ্ভুত। অনেকটা পুরনো ফিলম নেগেটিভ-এর মতো দেখতে কালো বার্নিশ করা কাগজে সোনালি রঙে লেখা। সে লেখাও বোঝার ক্ষমতা আছে ক-জনের। হয় প্রাচীন আলংকারিক ব্রাহ্মী লিপিতে, নয় ওপর থেকে নীচে লাইন ধরে লেখা নিখুঁত আদি মঙ্গোলীয় হরফে ঠাসাঠাসি করে যা ওখানে লেখা তা একেবারে কঠিন ধাঁধা। সে ধাঁধা ভেদ করার বুদ্ধি না থাকলে কাগজগুলোর কোনও দাম নেই।

তা হলে? শিশির তার আসল প্রশ্নটা এবার তুললে, ওই একটি ছাড়া জুদশির গোটা পুঁথি আর যখন নেই তখন আপনি জুদশি জুশি করে অত আদিখ্যেতা করছেন কেন? আর নিদান বিধানই অত পাচ্ছেন কোথা থেকে?

কোথা থেকে পাচ্ছি?ঘনাদা সব ধৃষ্টতা ক্ষমা করার হাসি হেসে বললেন, পাচ্ছি। খাঁটি জুদশি থেকেই। গোটা না থাক, আর একটা কাটা-ছেঁড়া পুঁথি ছিল।

আরেকটা পুঁথি ছিল! আমরা উৎসাহিত হতে গিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলাম, কোথায় সে পুঁথি? আপনার কাছে তো নেই বললেন!

না, আমার কাছে নেই। ঘনাদা অকপটভাবে স্বীকার করলেন। তার কিছুটা আছে মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলানবাটার খোটোর জাদুঘরে আর বাকিটা স্পেনের সেভিলের এক ষাঁড়ের পেটে।

ষাঁড়ের পেটে!–আমরা একটু সন্দেহ নিয়েই ঘনাদার দিকে চাইলাম। সন্দেহ ঘনাদার সত্যবাদিতায় নয়। তিনি তুচ্ছ সব সত্যের নাগালের বাইরে বলেই আমরা মেনে নিয়েছি। এবারের সন্দেহটা তাঁর সামলাবার ক্ষমতা সম্বন্ধে। এবার তিনি একটা কড়া ফরমাশ নিজেকে দিয়ে ফেলেননি কি? মঙ্গোলিয়া-তিব্বত-বুরিয়াতিয়ার বিরলতম গুপ্ত পুঁথির খানিকটা সেভিলের ষাঁড়ের পেটে ঢুকিয়ে শেষরক্ষা কি করতে পারবেন?

ঘনাদা কিন্তু অকুতোভয়। অর্ধনিমীলিত চোখে যেন সেই পুরনো স্মৃতির পাতায় তন্ময় হয়ে বললেন, হ্যাঁ, সেভিলের ষাঁড়, যেমন তেমন ষাঁড় নয়, আন্দালুসিয়ার অদ্বিতীয় ষণ্ড-বিশারদ ডিউক অফ ভেরাগুয়ার সেরা ভাকাদ্দা-র সবচেয়ে বড় ঘরানার ষাঁড়। ও বাহাদুর বংশের ষাঁড়ের কীর্তি আর নাম-ডাক সেভিল স্পেন ছাড়িয়ে সেই দক্ষিণ আমেরিকায় পর্যন্ত ছড়ানো। ওই ভাকাদ্দার ছাপ দাগা জাত-ষাঁড়ের শিঙে তখনও পর্যন্ত হাজার হাজার পিকাডোর-এর ঘোড়া পেট-টোফলা হয়ে খতম হয়েছে, চুলো জান দিয়েছে অমন গণ্ডা দশ, আর ব্যান্ডেরিলেরোস আর পিকাডোরেস দশ-বিশটার ওপর খোদ এসপাদা বা মাটাডোর-ই ভবলীলা সাঙ্গ করেছে অন্তত পাঁচ-ছটি। প্লাজা দে টোরোস-এর এই কংস-মার্কা বংশের এক বিভীষিকা—

এই পর্যন্ত বলেই ঘনাদা চোখ খুলে তাকিয়ে আমাদের অবস্থাটা অনুমান করেই বোধহয় থামলেন। তারপর জীবে দয়ার নীতি স্মরণ করে ব্যাখ্যা করে বললেন, ও, ঠিক কূল পাচ্ছ না বুঝি? তা হলে জেনে রাখো, প্লাজা দে টোরোস হল বুনো খ্যাপা ষাঁড়ের সঙ্গে লড়াই-এর খেলা যেখানে হয় সেই চারদিক ঘেরা গোল রণাঙ্গন। এসপাদা বলে সবার ওপরের ষণ্ডবীরকে, ছোট একটি তলোয়ার আর রঙিন একটা নিশান নিয়ে মাটির ওপর দাঁড়িয়ে যে শেষ পর্যন্ত ষাঁড়েদের খেলিয়ে তার পর খতম করে। পিকাড়োরেস হল সওয়ারি বীর যারা লড়াই শুরু হবার পর ষাঁড়কে তাদের খাটো বল্লম দিয়ে খুঁচিয়ে খেপিয়ে তোলে আর ব্যান্ডেরিলেরোস হল এসপাদাদের পরের ধাপের বীর—যারা লাল দোলাই নেড়ে ষাঁড়কে খেলানো আর খেপানো থেকে তাদের গায়ে কাঁটা দেওয়া তীর বসিয়ে শেষ লড়াই-এর জন্য তৈরি করবার সব কাজ করে।

ঘনাদা স্পেনের ষাঁড়ের লড়াই-এর কুশীলব আমাদের চেনাবার মধ্যে একটু থামতেই শিবু যেন মুগ্ধ বিস্ময়ে বললে, আপনি ষাঁড়ের লড়াই-এও তা হলে নেমেছেন?

কিন্তু ওই একটু ভোয়াজের চেষ্টায় প্রায় হিতে বিপরীত হবার উপক্রম হবে ক জানত? যেন তাঁকে গালাগাল দেওয়া হয়েছে এমনই গরম হয়ে উঠে ঘনাদা বললেন,

যাঁড়ের লড়াই করব আমি! ওই একটা নিষ্ঠুর পৈশাচিক খেলার আমি হব একটা অংশীদার?

এ প্রশ্নের জবাব শিবুর ওপর খাপ্পা হয়েই দিতে হল।

শিবুটা একটা হাঁদারাম! বললাম আমি।

শুধু হাঁদারাম! গৌর তার ওপর আর এক পরদা চড়ালে—ওটা আহাম্মক। নইলে অমন আজগুবি কথা ভাবে!

শিবুর চোখমুখের চেহারা দেখে আমায় আবার দুদিকই সামলাতে হল। বললাম, ওই যে আপনার জুশির খানিকটা ষাঁড়ের পেটে থেকে গেছে বললেন, তাইতেই ও ভেবেছে বোধহয় যে আপনি ষাঁড়ের লড়াই করতেই ওখানে গিয়েছিলেন। এর পর শিবুকে একটু জ্ঞান বন্টন, আরে খেলা দেখতে গেলেই কি খেলায় নামতে হয়। তা হলে তো ইস্ট-মোহন খেলার মাঠে তৃতীয় মহাযুদ্ধ হয়ে যেত। সেভিলের ষাঁড়ের লড়াই-এর অত নাম-ডাক। ঘনাদা তাই দেখতে গিয়েছিলেন।

না, সে লড়াই দেখতে যাইনি।—ঘনাদা এতেও আপত্তি জানালেন বটে, কিন্তু তার সঙ্গের হাসিটা ক্ষমার——আমি গেছলাম চেয়াক গাম্বোকে বাগে পেতে।

চেয়াক গাম্বো! একটু আড়ষ্ট উচ্চারণের সঙ্গে প্রশ্নটা আপনা থেকেই বেরিয়ে গেল মুখ থেকে—সে আবার কে?

সে-ই হল সব নষ্টের মূল, শয়তান চূড়ামণি —তার কথা মনে করতেই ঘনাদার গলাটা যেন ঝাঁঝালো হয়ে উঠল—নামটা শুনে তাকে মঙ্গোলিয়ান মনে হয়, কিন্তু ওটা তার ছদ্মনাম। আসলে তার নিজের কোনও দেশই নেই। গুপ্তচরগিরি থেকে যে কাজে শয়তানি বুদ্ধি মোটা লাভে খাটানো যায়, এ সব কিছুর ধান্দায় দুনিয়াময় টহল দিয়ে বেড়ায়।

জুদশির পুরনো পুঁথি খুঁজতে খুঁজতে টাকলা মাকানের উত্তরে ঘোরাঘুরির সময়েই ওকে সঙ্গী হিসেবে নিয়েছিলাম। ও খুব করুণভাবে নিজের দুঃখের কাহিনী বলেছিল। মরুর ঝড়ে ও নাকি নিজের কাফিলা থেকে ছিটকে পড়ে তখন একেবারে অসহায় অবস্থায় পড়েছে। আমি সঙ্গে না নিলে সে এই মরুতে শুধু পিপাসাতেই শুকিয়ে মারা যাবে।

তার মুখ আর বিশেষ করে চোখের চাউনি দেখে তার আসল চরিত্র কিছুটা আন্দাজ করলেও, তার বিশাল দশাসই চেহারা আর এ অঞ্চল সম্বন্ধে বেশ কিছু জানা আছে দেখে সঙ্গে নিতে রাজি হয়েছিলাম।

গোড়ার দিকেই একদিন অবশ্য একটু শিক্ষা দিতেও হয়েছিল।

তখন আমার জুদশি পুঁথি সংগ্রহ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। কয়েকটা পাতা শুধু বাকি। সে পাতাগুলো পাবার নয় জেনে আর কটা দিন মাত্র একটু চেষ্টা করেই পুঁথিটা উলানবাটারে নিয়ে যাব বলে তখন ঠিক করে ফেলেছি।

ঠিক সেই সময়ে একদিন রাত্রে হঠাৎ কী একটা খসখস শব্দ শুনে বিছানায় উঠে বসতে হল। উঠে বসে টর্চটা জ্বেলে অবাক হয়ে দেখি চেয়াক গাম্বো আমার তাঁবুতে ঢুকে আমার পিঠে বেঁধে চলার নিজস্ব ঝোলাটা হাঁটকাচ্ছে।

আমায় টর্চ জ্বেলে তাকে লক্ষ করতে দেখে বিন্দুমাত্র সে ঘাবড়াল না। যেমন। ঝোলা হাঁটকাচ্ছিল তেমনই হাঁটকাতে হাঁটকাতে অম্লান বদনে বললে—আপনার তাঁবুতে একটা ইঁদুর ঢুকে কী কাটছে মনে হল। তাই একটু দেখতে ঢুকলাম।

খুব ভাল করেছ। টর্চটা জ্বেলে রেখেই বললাম, তবে ভুল করেছ একটু। যেটা ইঁদুর ভেবেছ সেটা ইঁদুর নয়, ছুঁচো।

ততক্ষণে জুদশির পুঁথির লাল শালু মোড়া তাড়াটা সে বার করে ফেলেছে। সেটা বগলদাবা করে ঝোলাটা ফেলে দিয়ে সে বললে, ইঁদুর নয়, ছুঁচো ঢুকেছে বলছেন। তা হতে পারে। তবে সাবধানের বিনাশ নেই। পুঁথিটা এখন থেকে আমার কাছেই রাখা ঠিক করলাম।

তাই নাকি! খুব ভাল! আমি খুশি হয়ে বললাম, একটা বড় দায় থেকে আমায় বাঁচালে।

আপনাকে আরও একটা দায় থেকে বাঁচিয়েছি। আমায় বাধিত করার সুরে বললে চেয়াক গাম্বো, আপনাকে পিস্তল-টিস্তল আর ছুঁতে হবে না। বড় বেয়াড়া জিনিস কিনা! কখন হাত ফসকে কী হয়ে যায় তার ঠিক নেই। আপনার পিস্তলটা বালিশের তলা থেকে তাই আগেই সরিয়ে নিয়েছি।

শুধু পিস্তলটাই নিয়েছ তো আর—বলে হঠাৎ থেমে গেলাম থতমত খেয়ে।

আর–বলে থামলেন কেন? গাম্বো ভুরু কুঁচকে একটু সন্দিগ্ধ ভাবে জিজ্ঞাসা করলে, কী, বলছিলেন কী!

না, ও কিছু নয়। আমি যেন তাড়াতাড়ি কথাটা চাপা দিতে চাইলাম।

গাম্বো কিন্তু নাছোড়বান্দা। গলা চড়ালেও বেশ অস্বস্তির সঙ্গে ধমক দিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, কথা চাপবার চেষ্টা করবেন না। আর কী বলতে যাচ্ছিলেন বলে ফেলুন।

অত্যন্ত অনিচ্ছার সঙ্গে যেন বাধ্য হয়েই একটু থেমে থেমে বললাম, বলছিলাম যে, বালিশের তলার পিস্তলটাই শুধু নিয়েছ আর বালিশের ওয়াড়ের মধ্যে ঢোকানো বেরেটাটা–

ব্যস, ওইটুকুতেই কাম ফতে! বালিশের ওয়াড়ের ভেতর লুকোন বেরেটার নামে সেদিকে চাইতে গিয়ে দু সেকেন্ডের একটু অন্যমনস্কতার মধ্যেই গাম্বো ডিগবাজি খেয়ে ছিটকে তাঁবুর ধারে গিয়ে ঘাড়মুড় গুঁজে পড়ল। দু সেকেন্ডের ফাঁকে কংফুর একটি মোক্ষম লাথিতেই সে তখন কোঁকাচ্ছে।

সেখান থেকে চুলের মুঠি ধরে তুলে একটা ঝাঁকানি দিয়ে বললাম, বলো, এবার কী বলার আছে এখন।

চেয়াক গাম্বোর সে কী কান্না তখন না, না, আমার আর কিছু বলবার নেই। আপনি আমায় কড়া শাস্তি দিন, কিছুতেই ক্ষমা করবেন না এই শুধু আমার মিনতি।

তবু ক্ষমাই তাকে করলাম, আর বললাম, এরপর আর বেইমানি করার চেষ্টা করলে তাকে আরও নতুন বেরেটা দেখিয়ে দেব।

বেইমানি সে তবও করল। কখন কোন ফাঁকে আমার মুখ বাঁধা জলের থলেতে বাইরে থেকে মিহি ইনজেকশনের ছুঁচে বিষ ঢুকিয়ে আমায় অজ্ঞান করে ফেলে আমার জুদশির পুঁথি নিয়ে হাওয়া হয়ে গেল একদিন।

আমাকে অজ্ঞান করার পর একেবারে খতম করেই সে যেত, কিন্তু তখন দূরবিনে আর-এক কাফিলাকে আমাদের তাঁবুর দিকেই আসতে দেখে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যা পেয়েছে তাই নিয়েই আমার উটটি নিয়ে সে চম্পট দেয়।

অজানা কাফিলার লোকজন আসাতেই অবশ্য সে যাত্রা আমার প্রাণ বাঁচে, কিন্তু গাম্বো তখন একেবারে পগার পার।

তারপর ছটি মাস ধরে গাম্বোকে ধরবার জন্য সারা দুনিয়া প্রায় চষে ফেলেছি বলা যায়। নিউইয়র্ক থেকে সানফ্রানসিসকো, টোকিও থেকে লন্ডন, প্যারিস থেকে রিও দ্য ঝানেরো—কোথাও খুঁজতে আর বাকি রাখিনি। হদিস কিন্তু কিছু মেলেনি।

ছ মাসের মধ্যে জুদশির চুরি করা পুঁথির কোনও ব্যবস্থা সে করতে পারেনি বলেই আমার তখন বিশ্বাস। তা সে করতে পেরে থাকলে জুদশির মতো দামি ও বিরল জিনিসের চোরা বাজারে একটু কানাঘুষা শোনা যেতই। সুতরাং গাম্বো যে কোথাও ঘাপটি মেরে থেকে সুযোগের অপেক্ষা করছে এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু আমাকে ফাঁকি দিয়ে সে এমন হাওয়া হয়ে গেল কী করে?

আমার মাথাতেও যা আসবে না এমন কোনও মহলে সে নিশ্চয় গা-ঢাকা দিয়ে আছে। সে জায়গা কীরকম হতে পারে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করিডা মানে এই ষাঁড়ের লড়াই-এর জগতের কথা মনে পড়েছে। এ খেলা আমি ঘৃণা করি, তাই সে মহলে খোঁজ করার কথা আমি ভাবতেই পারিনি এতদিন।

ওই জগৎটাই তা হলে এখুনি খুঁজে দেখা দরকার বুঝেছি। খোঁজা সফলও হয়েছে প্রথম চেষ্টাতেই। চেয়াক গাম্বো সেভিলের প্লাজা দে টোরোস মানে ষাঁড়ের লড়াই-এর ঘাঁটির মহলেই নিজেকে নিপাত্তা করে রেখেছে।

সন্ধান পেলেও তাকে বাগে পাবার মতো সুযোগ সহজে মেলবার নয়। আমি একটু দূরে দূরে থেকে তার ওপর সব সময়ে নজর রাখি।

একটি বড় সুবিধের ব্যাপার এই যে, গাম্বো কোথায় তার চোরাই পুঁথি লুকিয়ে রেখেছে তা খুঁজে বার করতে আমায় হয়রান হতে হবে না। কখন কী অবস্থায় সরে পড়তে হবে ঠিক নেই বলে গাম্বো সে পুঁথি কখনও হাতছাড়া করে না। আমার সেই লাল শালু মোড়া বান্ডিলেই সারাক্ষণ সেটি সঙ্গে নিয়ে ফেরে।

ষাঁড়ের লড়াই দেখা গাম্বোর এক প্রচণ্ড নেশা। প্লাজা দে টোরোস-এ যে-কোনও একটা লড়াই থাকলেই হল। সে একেবারে সামনের দামি সিটের টিকিট কিনে খেলা দেখবেই।

দূর থেকে তার সব চাল-চলন লক্ষ করে যে সুযোগ খুঁজছিলাম তাই একদিন আশাতীতভাবে এসে গেল।

বড় জবর ষাঁড়ের লড়াই-এর দিন সেটি। সারা স্পেনের সব চেয়ে খুনে ঘরানার সেরা একটি ষণ্ড টোরিল মানে লড়াকু ষাঁড়েদের খাঁচা থেকে খেলার মাঠে বেরিয়ে এসেই একেবারে লন্ডভণ্ড কাণ্ড বাধিয়ে দিয়েছে।

প্রথম চার-চারটি পিকাডোরের ঘোড়ার পেট ফাঁসিয়ে খতম করার পর দুজন পিকাডোরকেই হাসপাতালে পাঠিয়ে সে তিন-তিনজন ব্যান্ডেরিলেরোস আর জনা-পাঁচেক চুলো-কে আতঙ্কে মাঠছাড়া করেছে। তারপর স্বয়ং এসপাদা অর্থাৎ সবার ওপরে ষণ্ড বীরের যা অবস্থা করেছে, তা আর বলার নয়।

এ সাংঘাতিক ষাঁড় আবার শুধু শিং দিয়ে গুঁতোয় না, দাঁত দিয়ে কামড়েও দেয়।

সেরা এসপাদার সব জারিজুরি ভেঙে সে তো দিয়েছেই, যে লাল রেশমি নিশান নাড়ার কেরামতিতে এসপাদারা ষাঁড়েদের নাচিয়ে খেলিয়ে খেপিয়ে হয়রান করে, সেই মুলেট্টাই কামড়ে কেড়ে নিয়ে টুকরো টুকরো করেছে। মাটিতে ফেলে পায়ের খুরে দিয়েছে তেলে।

মানের দায়ে এসপাদাকে এবার মুলেট্টা ছাড়া শুধু এসতোক মানে খাটো তলোয়ার নিয়েই এসতোকাদা মানে মরণঘা দেবার জন্য এ সর্বনাশা ষাঁড়ের মহড়া নিতে হয়েছে।

কিন্তু এ ষাঁড় যেন স্বয়ং যমরাজের বাথান থেকে আমদানি মহাকালের বাহন।

সেভিলের সেরা মাটাডোর, অমন পাঁচ-দশ গণ্ডা খুনে ষাঁড়কে একেবারে নিখুঁত এসতোকাদা মানে ঘাড়ের ঠিক পেছনে এক মোক্ষম মারে হৃৎপিণ্ড পর্যন্ত খাটো তলোয়ার গেঁথে দেওয়ার বাহাদুরিতে যে কাবার করেছে, তারই টিপ দিয়েছে ভণ্ডুল করে ওই সৃষ্টিছাড়া ষাঁড়। তারপর শিং-এর এক ঝাঁকানিতে এসপাদার হাতের এসকে খসিয়ে তাকে প্রাণের দায়ে ছুটিয়েছে এধরনের বিপদ ঠেকাবার লড়াইয়ে ময়দানের ধারের বেড়ার ওপারে।

সমস্ত প্লাজা দে টোরোস-এ তখন একেবারে হুলুস্থুল হই রই কাণ্ড। এসপাদা-তাড়ানো সাক্ষাৎ মহাকালের বাহন দুই ধারালো শিং উঁচিয়ে এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে আর চারদিকের দর্শকরাও উত্তেজনায় অস্থির হয়ে যেন খ্যাপার মতো চেঁচামেচি করছে।

এমন একটি মওকা আমারও আশাতীত ছিল। দর্শকদের এই উন্মত্ত উত্তেজনার মধ্যে ওপরে আমার সস্তা টিকিটের গ্যালারি থেকে আমি অবাধে নেমে এসেছি নীচে একেবারে লড়াইয়ের মাঠের ওপরেই ঝোলানো গাম্বোর দামি গ্যালারিতে।

সে তখন উত্তেজনায় দিশাহারা, আর সকলের মতো হাত-পা ছুড়ে এসপাদাকে গাল দিয়ে ষাঁড়টাকে বাহবা দিচ্ছে।

বেশি কষ্ট করতে হয়নি। তার বগলের শালু মোড়া বান্ডিলটা একটু আলগাভাবেই ধরা ছিল। এই অবস্থায় ব্যবহার করবার জন্য যে ম্যাজিক বড়িটা পকেটে এনেছিলাম সেটা মুখে দিতে হয়নি। এক হেঁচকা টানে বান্ডিলটা কেড়ে নিয়ে ছুটে পালাবার চেষ্টা করেছি তার পর।

কিন্তু পালাব কোথায়? উত্তেজনায় উন্মত্ত দর্শকের ভেতর দিয়ে পথ পাওয়াই শক্ত। এক মুহুর্তের জন্য হকচকিয়ে গিয়ে গাম্বো তখন চিৎকার করতে করতে আমার পেছনে তাড়া করেছে। একা তার হাত থেকে পালানো হয়তো শক্ত হত না। কিন্তু পেছনে সে আর সামনে ওপরে চেয়ে দেখি তারই ভাড়াটে পাহারাদার ক-জন যমদূতের মতো আমার দিকে এগিয়ে আসছে।

এ সংকটে একমাত্র যা করবার তাই করতে হল।

কী করলেন আপনি? ধরা দিলেন? ঘনাদা দম নিতে একটু থামবার পর শিশিরেরই প্রথম উদ্বিগ্ন প্রশ্নে হাওয়া একটু ঘুরছে বলেই আশা হল।

না, না, ধরা দেবেন কী? চাকাটা চালু রাখলাম আমি, ঘনাদা ওই যে কী বড়ির কথা বলছিলেন—সেইটি বোমার মতো ছাড়লেন।

যেমন তুমি আহাম্মক? শিবু খিঁচিয়ে উঠল, সে তো মুখে দেবার বড়ি! মুখে দেবার বড়ি কখনও বোমা হয়?

ওসব কিছু নয়, গৌর পরম বিজ্ঞের মতো বললে, ঘনাদা একমাত্র যা ওই অবস্থায় করা যায় তা-ই করলেন। অর্থাৎ লাল শালুর পুঁটলিটি ফেরত দিলেন গাম্বোকে। গাম্বোর হদিস যখন মিলেছে তখন একদিন তার হাত থেকে ওবান্ডিল উদ্ধার করবার সুযোগ হবেই। তার জন্যে বেফায়দা বেঘোরে প্রাণটা তো আর দেওয়া যায় না। তাই না, ঘনাদা?

না। ঘনাদা সত্যের খাতিরে যেন বলতে বাধ্য হলেন, যা বললে তার কোনওটাই নয়। ওই বান্ডিল নিয়ে নীচের অ্যারিনাতেই লাফিয়ে পড়লাম।

লাফ দিলেন নীচে! আমরা স্তম্ভিত।

ওই সাক্ষাৎ শমন যেখানে শিং বাগিয়ে ওত পেতে আছে সেইখানে? আমাদের গলা যেন বুজে আসছে আতঙ্কে।

হ্যাঁ। নিরুপায় ভঙ্গিতে বললেন ঘনাদা, সেই শিং বাগানো শমনের কোটের মধ্যেই ঝাঁপ দিয়ে পড়লাম। সমস্ত প্লাজা দে টোরোস তখন উত্তাল হয়ে উঠেছে উত্তেজনায় উল্লাসে। চিৎকার করে রুমাল স্কার্ফ নেড়ে চারদিক থেকে সবাই আমায় উৎসাহ দিচ্ছে। কেউ ফ্রানসিসকো রোমেরোর নাম করছে, কেউ এল সিড বলে চেঁচিয়ে ডন রোডরিগো দিয়াজ দে ভাইভার-এর পুরো নামটাই উচ্চারণ করছে।

আমার হাতে শুধু ওই লাল শালুর বান্ডিল ছাড়া বল্লম কি এসতোক কিছুই নেই। কিন্তু সে ভাবনা আমায় ভাবতে দিলে না গোটা প্লাজা দে টোরোসের দর্শকেরা। মুহূর্তের মধ্যে ঝপ ঝপ করে চারদিক থেকে অমন গোটা দশেক বল্লম আর খাটো তলোয়ার আমার সামনে এসে পড়ল।

ষাঁড়টা তখন কিছু দূরে দাঁড়িয়ে ফোঁস ফোঁস করে আগুনের হলকার মতো নিশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে ফেনা-মাখানো মুখে আমার দিকে চেয়ে পায়ের খুর মাটিতে ঠুকছে।

ক-বার অমনি পা ঠুকেই শিং বাগিয়ে মেল ট্রেনের মতোই সে ছুটে এল আমার দিকে।

ঘনাদা আবার একটু থামলেন।

কী করলেন তখন? আমাদের মধ্যে শিশিরই সব চেয়ে উগ্রীব, ওই এসতোক যাহোক একটা তুলে নিলেন তো?

না। সত্যাশ্রয়ী ঘনাদা যেন বাধ্য হয়েই স্বীকার করলেন, এসতোক কি বল্লম কিছুই তুললাম না। ও গোহত্যা আমার কাজ নয়।

তা হলে? আমরা উৎকণ্ঠিত।

গাম্বার জন্য আনা সেই গুলিটা পকেট থেকে বার করে মুখে দিলাম। ষাঁড়টা তখন একেবারে সামনে এসে বাগানো শিং জোড়া তুলতে যাচ্ছে। তার মুখের ওপর বুকের সমস্ত নিশ্বাস জমা করে সজোরে দিলাম এক ফুঁ!

ফুঁ দিলেন! আমাদের চোখ ছানাবড়া।

হ্যাঁ, শুধু ফুঁ সবিনয়ে বললেন ঘনাদা, তাইতেই ধেই নৃত্য করতে করতে মাটিতে মুখ ঘসবার চেষ্টায় তার কী আছাড়িপিছাড়ি। আমার ভয়ের আর তখন কিছু নেই, কিন্তু শিং বাগিয়ে চড়াও হবার পর আমার ফুঁ দেবার আগেই আমার লাল শালুর বান্ডিলের এক খাবলা সে যে কামড়ে তুলে নিয়েছে।

সমস্ত অ্যারিনার লোক যেন তখন পাগল হয়ে গিয়েছে উত্তেজনায়। ষাঁড়ের খাবলানো পুঁথির ভাগ আর উদ্ধার করবার নয় বুঝে যেটুকু পেরেছি তাই নিয়েই আমি সেই হট্টগোলের মধ্যে সরে পড়বার পথ খুঁজছি।

প্লাজার আর কেউ তা গ্রাহ্য না করুক, চেয়াক গাম্বো তাতে চুপ করে থাকতে পারে! মরিয়া হয়ে আমায় ধরবার জন্য সে-ও লাফিয়ে পড়েছে লড়াইয়ের মাঠে।

আর তাতেই হয়েছে সর্বনাশ। মাটিতে নাক-মুখ ঘসবার চেষ্টা করেই ষাঁড়টা আমার ফু-এর ধাক্কা খানিকটা তখন সামলে উঠেছে। গাম্বোকে ওভাবে লাফিয়ে পড়তে দেখে সে একেবারে প্রলয়ের বাহন।

একটা ছুট, একটা চিৎকার আর সেই সঙ্গে একেবারে এফোঁড় ওফোঁড় শিংয়ের গুঁতো।

প্লাজা ভরতি সমস্ত দর্শকই তখন দিশাহারা হলেও কর্তব্যে ত্রুটি কর্তাদের হয়নি। ওই হট্টগোলের মাঝে অ্যাম্বুলেন্সকে গাম্বোর দিকে ছুটে যেতে দেখে তুমুল গোলমালের সুযোগে মাঠ থেকে বেরিয়ে এসেছি। জুদশির পুঁথির অনেকখানিই সেই খুনে ষাঁড়ের পেটে গেছে, কিন্তু যা বেঁচেছে তাও বড় কম নয়। সেই অমূল্য জিনিস নিজের কাছে আর রাখিনি। যে মুলুকের জিনিস, সেই মঙ্গোলিয়ার উলানবাটারে নিয়ে সবটাই জমা করে দিয়ে এসেছি। ও তা হলে? শিশিরকে একটু বেশি ভাবিত মনে হল, সে জুশি তো এখন নাগালের বাইরে। আপনি তো ভাল করে পড়েও দেখেননি।

তা কি আর দেখিনি? ঘনাদা শিশিরের ভুল ভাঙলেন। – পড়েছেন? শিশির অত্যন্ত উৎফুল্ল। কিন্তু যা পড়েছেন তা কি আর মনে আছে?

মনে থাকবে না কেন? ঘনাদা যেন এরকম সন্দেহে অপমানিত। গোটা পুঁথিতে চোদ্দো হাজার আর আমার ওই ভেঁড়াটায় ন-হাজার শ্লোক মাত্র।

মাত্ৰ ন-হাজার? ঘনাদার স্মৃতিশক্তির এই যৎকিঞ্চিৎ নিদর্শনে আমাদের মুহ্যমান গলা দিয়ে ওই বিহ্বল উচ্চারণটুকু বার হল।

হ্যাঁ, ন-হাজারের বেশি নয়। ঘনাদা একটু বিশদ হলেন, তবে মানে না বুঝে শুধু মুখস্থ করে লাভ কী? সেই মানে বোঝাই দায়—

কেন? কেন? আমাদের ব্যাকুল প্রশ্ন, ভাষা খুব শক্ত বুঝি!

ভাষা তো বটেই, তার চেয়ে বেশি কঠিন ভাব। ঘনাদা ব্যাখা করলেন, সব জটিল ধাঁধায় লেখা কিনা।

সব ধাঁধায় লেখা? আমাদের বিস্মিত কৌতূহল!

কীরকম ধাঁধা শুনবে? ঘনাদা সদয় হয়ে উদাহরণ দিলেন, এই একটা শোলোক গদ্যে বলছি শোনোখারাপ আওয়াজের রোগ। তার জন্য সেনাপতির কাছে যেতে তিনি দিলেন লুক-মিক। রোগ কিন্তু সারল না। তখন চাবুক হাতে রাজা যেই এসে দাঁড়ালেন অমনই রোগ গেল পালিয়ে।

এই আপনার জুদশির ধাঁধার নমুনা?—হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞাসা করতে হল—এ ধাঁধার আবার মানে আছে?

তা আছে বইকী! ঘনাদা আমাদের অজ্ঞানতিমির ঘোচালেন—রোগটা হল বাচ্চাদের চোখ দিয়ে জল পড়া। বুরিয়াতিয়ায় কি মঙ্গোলিয়ায় ও রোগ বোঝাবার শব্দটা বেশ বিদঘুটে। তাই তাকে বলা হয়েছে খারাপ আওয়াজের রোগ। আর লুক-মিক হল ভেড়ার লোমের মতো কোঁকড়ানো পাপড়ির তিব্বতি এক জাতের চন্দ্রমল্লিকা। বাচ্চাদের চোখের জল পড়া ওই চন্দ্রমল্লিকার পাপড়ির রস দিলে সারে। তবে সঙ্গে কড়া অনুপান চাই। সেনাপতি শুধু লুক-মিকই বিধান দিয়েছেন। তাতে সারেনি, কিন্তু চাবুক হাতে রাজা মানে আরও কড়া অনুপান মেশাতেই ওষুধ অব্যর্থ হয়ে গেল।

তা হলে? আমরা বিহ্বলভাবে জানতে চাইলাম, শিশিরের অসুখের কথায় সেদিন ধাঁধা মতো যা শুনিয়েছিলেন তা আপনার ওই জুদশি থেকেই নেওয়া? শিশিরের রোগের নিদান-বিধান ওরই মধ্যে লুকোনো আছে?

তা আছে বই কী! বলে ঘনাদার উঠবার উপক্রম দেখে শিশিরই তাঁকে সবচেয়ে ব্যস্ত হয়ে থামিয়ে প্রথম মিনতি জানালে, ও ধাঁধাটার যদি একটু ব্যাখ্যা করেন।

ব্যাখ্যা করতে বলছ? ঘনাদা কেমন একটু উসখুস করে এদিক ওদিক চেয়ে বললেন, কিন্তু কী জানো।

ঘনাদাকে তাঁর বাক্যটি আর শেষ করতে হল না। শিশিরই তার আগে প্রায় লাফ দিয়ে উঠে পড়ে বললে, একটু বসুন! আমি এখুনি আপনার সিগারেট আনছি। এই যাব আর আসব।

শিশির তখুনি এক লাফে ঘরের বাইরে।

শোনো! শোনো! ঘনাদা পিছু ডাকলেন, সিগারেট তো আনছ সেই সঙ্গে তোমার ওই কী চিকিচ্ছের বই, কী বারিধি না কী, সেটাও নিয়ে এসো একবার।

সেটাও আনব?—শিশির একটু অবাক হয়েই ওপরে চলে গেল। আমরাও তাই।

শিশিরের সিগারেট আনতে দেরি হল না। প্যাকেট-ট্যাকেট নয়, একেবারে আনকোরা সিগারেটের টিন। অসুখের বাতিকে খাওয়া ছেড়ে দিলেও ঘর থেকে বিদেয় করতে পারেনি। টিনের সঙ্গে বৃহৎ চিকিৎসা বারিধি বইটাও শিশির এনেছে।

শিশির যথারীতি সিগারেটটা ধরিয়ে দেবার পর মৌজ করে দুটো রাম টান দিয়ে শিশিরের বইটা একটু নাড়তে নাড়তে ঘনাদা তাঁর ধাঁধার ব্যাখ্যা শোনালেন নাটকীয়ভাবে।

ধাঁধাটা কী? সেনাপতি ঘোর জঙ্গলে ঢুকিয়ে দিয়ে দিলেন পথ হারিয়ে, মন্ত্রী খুঁজে খুঁজে গাছ কাটলেন ভোঁতা কুড়ুলে। তাতে শুধু বদগন্ধই ছড়াল, কাজ হল না কিছু। তখন রাজা এসে জঙ্গল জ্বালিয়ে উনুন পেতে বসাতেই সব সমস্যা মিটে গেল। এ ধাঁধার মোদ্দা মানে শুধু এই যে তোমার যা রোগ এখন তাতে সেঁক নেওয়া দরকার।

সেঁক? কীসের সেঁক? আমাদের সকলেরই হতভম্ব প্রশ্ন।

রাজা যা জ্বালিয়ে উনুন পেতে বসালেন সেই জঙ্গলের মতো গোলমেলে মস্ত প্রকাণ্ড কিছুর। ঘনাদা বোঝালেন, যে জঙ্গলে ঢুকে ব্যাধি শুরু, ছাড়া ছাড়া ভাবে সামলাতে গিয়ে যা রোগ বাড়িয়ে দিয়েছে, সেই গোটা জঙ্গলই চেলাকাঠ করে উনুনে দিয়ে তার সেঁক নিতে হবে। পারবে তা নিতে?

প্রশ্নটা শিশিরকে করলেও আমরা সবাই নিজেদর সম্মতি আর উৎসাহ জানালাম— পারবে না মানে! নিশ্চয়ই পারতে হবে। এত বড় রোগ বলে কথা!

কিন্তু সেঁকটা নেব কী জ্বালিয়ে? শিশিরের বিমূঢ় জিজ্ঞাসা।

কী জ্বালিয়ে নেবে? দাঁড়াও, দাঁড়াও, ঘনাদা যেন তৎক্ষণাৎ আকাশ-পাতাল সব খুঁজে নিয়ে বললেন, একটা খুব মোটা ঢাউস বই হলে হয়। বই মানেই তো জঙ্গল। তা তোমার এই বৃহৎ চিকিৎসা বারিধিটাই সবচেয়ে ভাল।

ওই বই! শিশির আপনা থেকেই একটু শিউরে উঠে বললে, কিন্তু ও বই যে—

কিন্তু টিন্তু কিছু নয়, ঘনাদা তাকে প্রায় ধমকে থামিয়ে দিলেন, ওই বই-ই তোমার জঙ্গল। ভাল চাও তো পুড়িয়ে সেঁক নাও আজই।

ঘনাদা আর এ ঘরে থাকলেন না। গট গট করে ওপরে নিজের টঙের ঘরে চলে গেলেন, শিশিরের সিগারেটের টিনটা অবশ্য সঙ্গে নিয়ে।

শিশির সেদিকে চেয়ে একটু দ্বিধাভাবে বললে, আচ্ছা, এটা কি সত্যি ওই জুদশির বিধান?

আলবত জুদশির বিধান? আমরা সমস্বরে তাকে আশ্বস্ত করলাম, ধাঁধার নমুনা দেখেই বুঝতে পারলি না, একেবারে খাঁটি নির্ভেজাল জুদশি!

জুদশির বিধান অব্যর্থ। শিশিরের সব রোগ সেরে গিয়েছে।

পু:—ঘনাদার মারাত্মক ঝুঁ-এর ম্যাজিক বড়িটা কীসের, সে রহস্যভেদ কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়নি। ঘনাদাকে আড্ডাঘরে পেয়ে সেদিন আমি বলেছি, ওটা বড়ি নয়, ক্যাপসুল। অ্যামোনিয়া কারবোনেট, মানে স্মেলিং সল্ট-এ ভরা। ঘনাদা মুখে নিয়ে দাঁতে কেটে বলীবদের মুখে ফুঁ দিয়ে ওটা ছিটিয়েছেন।

না, শিবু আমার থিওরি নস্যাৎ করে দিয়ে বলেছে, ওটা ক্যাপসুল, তবে স্মেলিং সল্ট-টল্ট নয়। শুকনো ধানি লঙ্কার গুঁড়োয় ভরা। না ঘনাদা?

ঘনাদা জবাব না দিয়ে ঈষৎ হেসে তাঁর টঙের ঘরের দিকে চলে গেছেন।

ন্যাড়া ছাদের সিঁড়িতে তাঁর পায়ের শব্দ পাবার পর গৌর বলেছে, ও কিছু নয়, স্রেফ হ্যালিটোসিস।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত