রুপুকে বিয়ে করে যেদিন আমি বাসায় আসি, আমার মায়ের চেহেরায় আমি হতাশাকে সর্বোচ্চ মাত্রায় দেখেছিলাম সেদিন। দরজা খোলে দিয়েই মা আমার পাশে রুপুকে দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুধু এটাই বলেছিলেন, দেখিস তোর সাথে একদিন তোর ছেলেমেয়েও এমনটা করবে। আমি এটাকে অভিশাপ হিসেবে নিইনি। আমি সব শুনে হজম করে চুপ ছিলাম সেদিন। বাবা সোফায় বসে পত্রিকা পড়ছিলেন, দূর থেকে উনি সহানুভূতির চোখেই তাকিয়ে ছিলেন, আর ওতেই আমি সাহস পেয়ে রুপুকে নিয়ে সোজা রুমে চলে যাই।
এখানে আমি আমার মাকে ইগ্নোর করেছি তা কিন্তু নয়। একজন মা হিসেবে উনার একটা ডিমান্ড থাকতেই পারে ছেলের বিয়ের ব্যাপারে। রুপু সেদিন অনেক বেশি কেঁদেছিল রুমে ঢু্কার পর। বিয়ের প্রথম রাত আমাদের, রুপু হালকা সেজেছিল। অবশ্য আমার অনেক কাজ বাকি ছিল তখনো। ফ্রেশ হয়ে নেয়ার ব্যাপারে ওকে সাহায্য করা, কারণ হুইল চেয়ারটা নিয়ে ওর পক্ষে ওয়াশরুমে যাওয়া পসিবল ছিলোনা। একেতো বিয়ের ব্যাপারে সারাদিন মাথার উপর বয়ে যাওয়া সবকিছু, বাবা-মা কে ছেড়ে নতুন ঠিকানা, তার উপর বাকি জীবন যে আরেক জনকে মা বলে ডাকার অনুপ্রেরণা নিয়ে এসেছিলো শুরুতেই তার নারাজি।রুমে ঢুকার পর থেকেই রুপুর দিকে তাকিয়ে ছিলাম শুধু, ওর ফুঁপিয়ে কান্না দেখে আমার কোন কথা বলার সাহস হচ্ছিল না। ওকে সাহায্য করার জন্য হাত বাড়াতেও খুব ভয় হচ্ছিল আমার, যদি বলে উঠতো করুণা করছো? আমি ওর এই প্রশ্নটাকে খুব বেশি ভয় পেতাম।
মা হয়তো নিজের সন্তান হিসেবে কষ্ট থেকেই কথাটা বলে ফেলেছিলেন। একবার ভাবলাম রুমে ঢুকেই সব মানাভিমানকে হারিয়ে দিয়ে ওকে জিতিয়ে দিবো। আমার একটা ব্যাপার ওর খুব বেশি পছন্দের ছিল সেটা হলো আমি মানুষকে প্রচুর হাসাতে পারি। ওর কোন অভিমানকে আমি বেশিক্ষণ টিকতে দিয়েছি বলে আমার ঠিক মনে পড়েনা। কিন্তু একটু পরে ভাবলাম এটা তো আমাদের নিয়মিত খুনসুটি নয় যে হাসিয়ে দিবো, পাছে এই হাসানোর প্রচেষ্টাটাও ওর কাছে করুণা হিসেবে ঠেকবে।
যখন ওর হুইল চেয়ারের পাশে ওর সাথে হেলান দিয়ে মনমরা হয়ে বসেছিলাম তখন রুপু নিজেকে সামলে নিয়ে বলেছিল, আমার একটাই ব্যর্থতা কি জানো আশু? এই যে তোমাকে রাজি করাতে না পারা, অনেকবার বলেছিলাম আমাকে বিয়ে করে নিজের জীবনটাকে ধীরগতি দেয়ার কোন মানে হয়না। তুমি কানেই নিলানা।
আমি আমার মায়ের হয়ে ক্ষমা চাইতে গিয়েও থেমে গিয়েছিলাম, কারন আমার মনে হয় রুপু আমার মা কে আমার চাইতেও বেশি ভালোবাসতো। আজ থেকে একবছর আগেও মা রুপুকে দেখে মা বলেই ডাকতেন। রুপুর সাথে আমার সম্পর্কটাকে মা তেমন একটা প্রাধান্য দিতেন না। যেদিন আমার চাকরীটা হয় সেদিন থেকেই মা আমার সম্পর্কের ব্যাপারে অনেকটাই পজেটিভ হয়ে যান।
রুপুর পরিবারে অবশ্য ব্যাপারটা তেমন একটা প্রশ্রয় পেতোনা। যদিও রুপুর মা আমাকে কিছুটা হলেও পছন্দ করতেন কিন্তু ওর বাবা আমার সাথে একটা মার্জিনের বাইরে যেতেন না কখনো। অবশ্য যদিও ব্যক্তি হিসেবে আমি উনার প্রিয় ছিলাম অনেক আগে থেকেই। হয়তো ঠিক আমার মায়ের মতোন উনারও একটা এক্সপেক্টেশান ছিল মেয়েকে নিয়ে।খুব অবাক হয়েছিলাম যখন দেখি আমার মায়ের এক্সপেক্টেশান আর রুপুর বাবার এক্সপেক্টাশান দুটো একই দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে ব্যস্তানুপাতেই সামনে এগিয়ে গেলো।
সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল, কিন্তু যখন ও এম.বি.এ ফাইনাল দিলো তখন রোড একসিডেন্টে ওর একটা পা অচল হয়ে যায়। রুপু যতদিন হাসপাতালে ছিল ততোদিন আমি রাতভোর এক করেই ছেড়েছিলাম। ও যখন ঘুমোতো তখন আমি পাশে বসে ওর দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলতাম, স্রষ্টার কাছ থেকে আমার পাওয়া উপহার তুমি নও, তোমাকে ফিরে পাওয়া। একসময় রুপু বলতো, “করুণা করছো?” ও আমাকে অনেক রকম বাজেভাবে ট্রিট করে দেখতো আমি আসলেই সরে যাচ্ছি কিনা। কিন্তু শেষমেশ রুপু ঠিকই বোঝে নিয়েছিল যতই সে আমাকে বাজেভাবে ট্রিট করছে ততই আমি ওর প্রতি আরো দুর্বল হচ্ছি। একসময় হাল ছেড়ে দিয়েছিল।
মা অবশ্য আমাকে কিছুই বলেনি। কিন্তু আমার চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল আর উসকুখুশকো চুল দেখে উনি কিছু তো একটা বলতে চাইতেন কিন্তু কোন একটা কিছুর অভাবে বলতে পারতেন না। কে জানে! রুপুকে মাও খুব স্নেহ করতেন বলে হয়তো! রুপুর বাবাও ইদানিং আমার প্রতি অনেক দায়িত্ববান হয়ে উঠেছেন, প্রতিটা ব্যাপারে একদম নিজের ছেলের মতোনই ট্রিট করছেন। আমার এই ব্যাপারটা অনেকদিনের চাওয়া ছিল কিন্তু সেটাকে হাতের কাছে পেয়েও চাওয়া এবং পাওয়ার হিসেব মিলাতে পারছিলাম না আমি। কারন এটাকে এখন আমার করুণা বলেই মনে হয়।
রুপুর সাথে আজ দুইবছর ধরে সংসার করতে করতে আমাকেও “করুণা করছ?” এই রোগে ধরে গেছে। রুপুদের বাসায় যখন আমি কোন কারনে যাই তখন আমাকে আলাদাভাবে একটা সম্মান দেয়া হয়। সেখানে আমাকে হিরেরটুকরোর মতোন আদর-যত্ন করা হয়। রুপুর ভাই-বোন আর ভাইয়ের বউয়েরা আমাকে আলাদা একটা খাতির করে, বলা যায় ওদের বাসায় গেলে আমার সাথে সবাই লেগেই থাকে খাতিরের কমতি হলো কিনা। অথচ শাশুড়ের বাসায় এত যত্ন পেয়েও আমি এড়িয়ে যাই সবকিছুকে এটা ভেবে যে আমাকে করুণা করা হচ্ছে।
ইদানিং রুপুর সাথে “করুণা করছো?” এই দুর্বলতার জায়গাটাকেও আমি বেশ তামাশা বানিয়ে ফেলেছি।
ওই যে বললাম আমি পারি!! এখন রুপু আমার কোন একটা কাজ করে দিতে আসে তখন আমি বলে উঠি, “কি গো! করুণা করছো আমাকে? আমার একটা রুপু আছে বলে?” ও তখন খিলখিল করে হেসে উঠে, আর আমি ওর হাসিমাখা মুখের দুর্লভ মায়াটাকে লুফে নিয়ে জিতে যাই।
ভাবছেন আমার পরিবার? মা কয়েকদিন পর স্বাভাবিক হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে এটাই বলেছিলেন, থাক বাবা রুপুটা না হয় আমার কাছে স্রষ্টার কাছ থেকে পাওয়া ভিন্ন মোড়কের একটা উপহার!! কে জানে! এই যে আমি লিখতে বসলাম ছাদে এসে, হয়তো আমার ছেলেটা ওর দাদার ঘাড়ে চড়ে বসে আছে আর আমার মা রুপুর মাথায় বিনি পাকিয়ে দিচ্ছেন।