-স্যার আপনার ফোনে গেমস আছে? টিউশনি করাতে এসেছি।আমার ছাত্রী অনিকার রিডিং রুমে বসে আছি।ও এখনো পড়তে আসে নাই।এমন সময় ওর পিচ্ছি বোন অরিন এসে আমাকে উপরের প্রশ্নটা জিজ্ঞাস করলো।পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি,বাচ্চাদের হাতে ফোন দেওয়া আর ৫ তলা বিল্ডিং এর উপর থেকে ফোন ফেলে দেওয়া একই কথা।কারণ দুইটাতেই ফোন একদম ওলটপালট হয়ে যায়।তাই আমি অরিন কে এড়ানোর জন্য বললাম,
-নারে বুড়ি।আমার ফোনে তো কোন গেমস নাই।
-আচ্ছা স্যার সমস্যা নাই।ফোনটা আমাকে দেন।আমি প্লে স্টোর থেকে নামিয়ে নেবোনে।
একটা ক্লাস ফোরে পড়ুয়া বাচ্চা মেয়ের কাছে থেকে আমি এরকম উত্তর মোটেও আশা করি নাই।আমাকে কেমন মগা বানিয়ে ফোনটা নিয়ে গেলো। আমি এই টিউশনি টা পেয়েছিলাম আমার এক বন্ধুর সাহায্যে।তো প্রথমদিন টিউশনিতে এসে আমার ছাত্রী অনিকাদের ড্রয়িং রুমে বসেছিলাম।ছাত্রী ক্লাস নাইনে পড়ে।আর ছাত্রীরা যে বেশ বড়লোক তা তাদের ঘরের আসবাবপত্র দেখেই বোঝা যাচ্ছে।ছাত্রীর বাবা নাকি পুলিশের বড়ো কর্মকতা।তারমানে গুরুদক্ষিণাটা বেশ ভালোই পাওয়া যাবে।বসে বসে এসবই ভাবছি এরকম সময় দেখি একটা ছোট্ট মেয়ে তার থেকে বড়ো একটা ট্যাব হাতে নিয়ে টিপতে টিপতে আমার দিকে এগিয়ে আসছে।আমার কাছে এসেই আমাকে জিজ্ঞাস করলো,
-আপনি আপুর টিচার?
-হ্যাঁ।তোমার নাম কি বাবু?
-আমার নাম অরিন।
আমি ক্লাস ফোরে পড়ি।আর আমি অনেক বড়ো হয়ে গেছি।তাই আমাকে বাবু বলে ডাকবেন না।বুঝছেন? আমি ওর কথা শুনে একদম তব্দা খেয়ে গেলাম।এইটুকু বাচ্চা মেয়ের একি পাকাপাকা কথা।আমি নিজেকে কোনমতে সামলিয়ে বললাম,
-আচ্ছা ঠিক আছে আর বলবো না। অরিন বললো,
-আপনাকে কি বলে ডাকবো?
এমনিতেই এই অবস্থা।যদি একে আবার ভাইয়া বলে ডাকতে বলি তাহলে এই পিচ্চিটা তো আমাকে জ্বালিয়ে শেষ করে দিবে।আর স্যার নাম শুনলেই একটু ভয় ভয় ভাব জাগে।তাই স্যার বলে ডাকতে বললে হয়তো অরিন আমাকেও একটু ভয় পাবে।তাই ওকে বললাম,
-আমি যেহেতু তোমার বড়ো আপুর স্যার।তাই তুমিও আমাকে স্যার বলে ডেকো।
কিন্তু আমি ওকে যে জন্য স্যার ডাকতে বলেছিলাম আমার সেই আশায় অরিন একেবারে জল ঢেলে দিলো। টিউশনিটা ভালোই যাচ্ছিলো।অনিকা বেশ ভাল ছাত্রী।তাই ওকে পড়াতে বেশি বেগ পেতে হয়না।একবার বুঝিয়ে দিলেই ও সব বুঝে যায়।এই কয়দিনে অরিনের সাথেও বেশ খানিকটা ভাব হয়ে গেছে।কিন্তু ও মাঝে মাঝে এমন সব কান্ড করে না!যা আর বলার মতো না।এইতো সেদিন টিউশনিতে গিয়েছি।এমন সময় অরিন এসে বললো,
-ভাইয়া!ভাইয়া!আমি চাঁদে যেতে চাই।
অরিন তার এরকম উদ্ভট ইচ্ছার কথা মাঝে মাঝেই আমাকে জানায়।তাই আমি খুব একটা অবাক হলাম না।বেশ স্বাভাবিকভাবেই বললাম,
-চাঁদে যেতে হলে তো অনেক পড়াশোনা করতে হয়!অনেক বড়ো হতে হয়।
-কতো বড়ো হতে হয়?আপনার থেকেও বড়ো। আমি বললাম,
-হ্যাঁ।আমার থেকেও বড়ো হতে হয়।
-মিথ্যা কথা।আমি আপুর ফেসবুকে দেখলাম আপুর থেকেও ছোট একটা ছেলে চাঁদে গিয়ে চাঁদের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে।
-আরে পাগলী!ওগুলা এডিট করা যায়।ওই ছেলে নিজের ফটো এডিট করে চাঁদের ওপরে বসিয়ে দিয়েছে।অরিন এবার আমার হাত ধরে একটু আদুরে গলায় বললো,
-স্যার আপনি এডিট করতে পারেন?
-এই একটু আধটু পারি।কেন? অরিন বললো,
-স্যার তাহলে আমাকেও এডিট করে চাঁদে পাঠিয়ে দেন না।আমার না চাঁদে যাওয়ার অনেক শখ।
আমি ওর কথা শুনে আবারও তব্দা খেয়ে গেলাম।কিন্তু অরিন আমার হাত ধরে ঘ্যানঘ্যান করতেই লাগলো।সেদিন অরিনের আম্মু এসে ওকে না থামালে হয়তো ও আমাকে দিয়ে এডিট করিয়ে চাঁদে গিয়েই ছাড়তো! আজকে টিউশনি করানোর জন্য অরিনদের বাড়িতে ঢুকতেই সুন্দর রান্নার ঘ্রাণে আমার পেটের ভেতরে একদম মোচর মেরে উঠলো।প্রতিদিনই অবশ্য ওদের বাড়িতে সুন্দর রান্নার ঘ্রাণ পাই। কিন্তু আজকে একটু বাড়াবাড়ি রকমের সুন্দর ঘ্রাণ পেলাম।বাড়িতে দেখলাম অনেক আত্মীয়-স্বজনও এসেছে।আজকে এদের বাড়িতে হয়তো কোন প্রোগ্রাম আছে!আমি আর অতোসতো না ভেবে অনিকার রিডিং রুমে চলে গেলাম।অনিকাকে পড়ানো শুরু করেছি এমন সময় আন্টি এসে বললো,
-হৃদয় আজকে আমাদের বাড়িতে তোমাকে ডিনারের জন্য নিমন্ত্রণ করলাম।অনিকাকে পড়ানো শেষ হলে ডাইনিং রুমে চলে এসো।তো অনিকাকে পড়ানো শেষ হলে আমি ডাইনিং রুমে চলে এলাম।এসে দেখি ডাইনিং টেবিলে অনিকার বাবাও বসে আছে।ভদ্রলোককে আজ বেশ হাসিখুশি মনে হচ্ছে।পরে খাওয়ার সময় শুনলাম ওনার নাকি প্রমোশন হয়েছে।আর সেই উপলক্ষেই এই খাওয়াদাওয়া।অনিকার সব মামা-চাচারাও ডায়নিং টেবিলে বসে আছে।অনিকা-অরিন আর ওদের সব কাজিনরা টিভির রুমে বসে একটা কার্টুন সিরিজ দেখছে।তাই আন্টি ওদের সবার খাওয়ার টিভির রুমেই দিয়ে আসলো।আমাদের সবাইকেও খেতে দেওয়া হলো।খাবারের আইটেম বেশ কয়েকপদের।আর খাবার গুলাও স্বাদের হয়েছে।তাই বেশ তৃপ্তি করে খেতে লাগলাম।খাওয়া যখন মাঝপথে তখন দেখি অরিন ওর রুম থেকে দৌড় দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমার কাছে এসেই অরিন আমাকে বললো,
-স্যার আই লাভ ইউ। আমি একটু হেসে বললাম,
-আই লাভ ইউ টু।কিন্তু তোমাকে এটা বলা কে শেখালো?
-আপু শিখিয়েছে।
-তা আমাকে এটা বললে কেন? অরিন বললো,
-আপু বলেছে স্যারদের নাকি আই লাভ ইউ বলতে হয়। আমি বললাম,
-কেন?স্যারদের আই লাভ ইউ বলতে হয় কেন?
-আপুকে দেখলাম একটা কাগজে লিখেছে “আই লাভ ইউ হৃদয় স্যার।
আমি এই লেখা দেখার পরে আপুকে জিজ্ঞাসা করতেই তো আপু আমাকে বললো,স্যারদের আই লাভ ইউ লিখলে নাকি পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়া যায়। অনিকার বাবা পানি খাওয়ার জন্য সবে পানি মুখে নিয়েছিলো।অরিনের এই কথা শুনে তার মুখ থেকে পানি বের হয়ে গেলো।আমি ডায়নিং টেবিলের সবার দিকে তাকিয়ে দেখি সবাই আমার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।এরা নিশ্চয়ই ভাবছে আমিই অনিকাকে এটা করতে বলেছি।অনিকার ভাবসাব আমার কিছুদিন ধরেই ভালো লাগছিলো না।আমার আগেই এই জিনিসটা বোঝা উচিৎ ছিলো।কিন্তু আমি এই জিনিসটা যতোক্ষণে বুঝতে পারলাম ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
অনিকার বাবার তো নিজস্ব রিভলবার আছে।যদি ওটা দিয়ে গুলি করে এখন আমাকে মেরে ফেলে?হায় খোদা!আমাকে এই শেষ বারের মতো বাঁচাও।এই বিচ্ছু পিচ্চিটার জন্য মনে হয় আমার প্রাণটা বেঘোরেই দিতে হলো।অরিনের দিকে তাকিয়ে দেখি ও ওর ফোকলা দাঁত বের করে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।যেন আমাকে এই পরিস্থিতিতে ফেলতে পেরে ও ভিষন মজা পাচ্ছে।প্রচণ্ড ঝড় হওয়ার আগে যেরকম আশেপাশের সব কিছু নিরব হয়ে যায়!এই ডায়নিং টেবিলে এখন তেমনই পিন পতন নীরবতা বিরাজ করছে।জানিনা আজ আমার ভাগ্যে কি দূর্ভোগটাই না আছে!বাচ্চারা আসলেই বোমার মতো ভয়ংকর।কখন কোথায় ফেটে যে প্রাণ সংশয় করবে তা বোঝাই মুশকিল!