বিয়ের আগে সেই পুতুল খেলার বয়স থেকেই তপতী মনে মনে পছন্দ করতো রাসুকে। প্রতিদিন তপতী আর তার কয়েকজন বান্ধবী মিলে রাসুর নৌকায় করে শঙ্খচূড়া নদী পার হয়ে স্কুলে যেতো আবার দুপুর শেষে বাড়ি ফিরতো। মাঝেমাঝে নৌকায় রাসুকে না দেখলে কেন যেনো তপতীর মনে তোলপাড় শুরু হয়ে যেতো সাথে মনের মাঝে জমতো একরাশ অভিমান। যদিও এই অভিমান আর ভয়াবহ তোলপাড়ের বিন্দুমাত্র খোঁজ ও রাখতো না রাসু।সে থাকতো তাঁর মতো। রাসুও স্কুলে পড়তো, তপতীর ঠিক ৩ ক্লাস উপরে।ছেলেদের ক্লাস শুরু হতো মেয়েদের পরে। তাই রাসুকে প্রতিদিন সকালে খেয়াঘাটে দেখা যেতো তার বাবার সাথে।
তপতী নামের মেয়েটা বড্ড চঞ্চল। মায়ের বকুনি উপেক্ষা করে সে সারাদিন পুরো গ্রামময় ঘুরে বেড়াতো।কোথায় কার গাছে আম, তেঁতুল, কামরাঙা ধরেছে তার খবর তপতীর কাছেই সবার আগে থাকতো।তাঁর ছোট ছাগল ছানাটা ছিলো একমাত্র সঙ্গী তাকে নিয়েই সে ঘুরে বেড়াতো মাঠঘাট পথে। এই বয়সেই তপতী হঠাৎ রাসুর প্রেমে পড়ে যায়।রাসুকে দেখলেই তার হৃৎস্পন্দনের গতি অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যেতো। মনে মনে হাজার পছন্দ করা সত্ত্বেও কেন যেনো তপতী রাসুর দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারতো না। তার লজ্জা লাগতো ভীষণ ।
মাঝেমাঝে তপতী খেয়াল করতো রাসু তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তখন নিজেকে লুকানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়তো তপতী। এ যেনো এক অন্যরকম অনুভূতি। দেখতে দেখতে অনেকদিন কেটে গেলো। একদিন সারারাত জেগে তপতী একটা চিঠি লিখলো। মনে মনে ভাবলো আজ সবার শেষে সে নৌকা থেকে নামবে আর চিঠিটা রাসুকে দিবে। যেই ভাবা সেই কাজ।
পরেরদিন নৌকায় পা রাখতেই তপতীর শরীরে যেনো কাঁপন ধরে গেলো। সে কি করবে বুঝতে পারলো না ভাবলো আজ থাক অন্য দিন না হয় দেয়া যাবে এই বলে যেই তপতী নৌকা থেকে উপরে উঠার জন্য পা বাড়ালো অমনি চিঠিটা তার বইয়ের ফাঁক দিয়ে নৌকার কিনারে এক চিপায় পড়ে গেলো তবে সেটা রাসুর চোখ এড়ালো না।
আজ তপতীর সাথে কেউই স্কুলে আসেনি তাই তপতী একা একা পথ দিয়ে হাঁটতে লাগলো। পথে হঠাৎ রহমত চাচার ছেলে দুলালের সাথে দেখা হয়ে গেলো তপতীর। দুলাল এই গ্রামের সবচেয়ে দুশ্চরিত্র একটা ছেলে সবাই তাকে এড়িয়ে চলে। তপতী তো ভুলেও তার ছায়া মাড়ায় না। কিন্তু এই দুলাল নামের ছেলেটা তপতীকে বড্ড বিরক্ত করে তাও আজ কয়েকমাস ধরে। তপতী আজ পর্যন্ত কাউকে এ ব্যাপারে বলেনি।আর এভাবেই দুলাল তপতীর পিছু নিলো। তপতী দ্রুত হাঁটতে লাগলো। দুলাল পিছন থেকে বলতে লাগলো,
–“তপতী, সত্যি সত্যি আমি তোকে পছন্দ করি। আমার চরিত্র খারাপ তবে আমি তোকে পেলে একেবারে ভালো হয়ে যাবো আর কখনো কারো চোখের দিকেও তাকাবো না।একবার বিশ্বাস করেই দেখ না তপতী! ” তপতী রেগে গিয়ে বললো,
–“অনেকদিন ধরে জ্বালাচ্ছিস, এগুলো কি? আর কখনো আমার সামনে আসবি না। তোর লজ্জা বলতে কি কিছু নেই? আজ এ মেয়ের কাছে কাল ও মেয়ের কাছে! আগে তোর চরিত্র ঠিক কর। তারপর আসিস।”
তপতীর কথা শুনে দুলাল একপ্রকার রেগে গিয়ে ওর হাত ধরে টানতে লাগলো আর বলতে লাগলো আজই তোকে বিয়ে করবো। এই বলে দুলাল মাটির রাস্তা দিয়ে ধানক্ষেতের আল বেয়ে ওকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে লাগলো। আর আশেপাশের মানুষ এগুলো তাকিয়ে দেখতে লাগলো।
পাছে রাসু পিছন থেকে এসে সেদিনের মতো দুলালের হাত থেকে তপতীকে ছাড়িয়ে বাড়ি পৌঁছে দিলো এবং সেদিন বিকেলেই ছড়িয়ে পড়লো বদনাম আর সেটা হলো, তপতী আর দুলালকে সাতরাস্তার মোড়ে ধানক্ষেতে দেখা গিয়েছি। গ্রামের সব মানুষ এ নিয়ে কানাকানি করতে করতে পুরো গ্রাম ছড়িয়ে গেলো।এমুহূর্তে তপতীর অবস্থা যে কেমন হয়েছে তা হয়তো না লিখলেও চলবে। তারপর থেকে আর কখনো তপতী রাসুর নৌকায় সেই শঙ্খ চুড়া নদী পেরিয়ে স্কুলে যায়নি।
এমন বদনামের জন্য তপতীকে আর ভালো ছেলের সাথে বিয়ে দেয়া হয়ে ওঠেনি এমনকি তপতীর সুপ্ত ভালবাসা রাসুর সঙ্গেও না। তার মাস কয়েকপর তপতীর বিয়ে হয়ে যায় মোটামুটি এক বয়স্ক লোকের সাথে তাও আবার অনেকদূরের এক গ্রামে। ঠিক সেদিনই তপতী শেষবারের মতো শঙ্খচূড়া নদী পাড়ি দিয়েছিলো আর করুন চোখে তাকাচ্ছিলো রাসুর দিকে।আর সবাই ভুল বুঝলেও রাসু নিশ্চয়ই তাকে ভুল বুঝবে না কিন্তু রাসুর মাঝে সেদিন কোনো পরিবর্তনই দেখা যায়নি।
তারপর কেটে গেলো অনেকগুলো দিন। সবার জীবনে আসলো আমূল পরিবর্তন কারণ জীবন কখনো কারো জন্য থেমে থাকে না সে চলতে থাকে তার আপন গতিতে।সেই শঙ্খচূড়া নদীর উপর আজ ব্রীজ হয়েছে,দেশ ও অনেক উন্নত হয়ে গেছে তবে সেই দুলাল আর বেশিদিন বাঁচতে পারেনি। তপতীর বিয়ের দিন পনেরো পর তার লাশ পাওয়া গিয়েছিলো তাদের বাড়ির উত্তর পাশে ঝুলন্ত অবস্থায়। তার মৃত্যুর কারণ আজো সবার কাছে অজানা।
আজ প্রায় অনেক বছর পর তপতী তার নিজের গ্রামের উদ্দেশ্য পা বাড়ালো।একপ্রকার অভিমানেই সে এতদিন এই গ্রাম থেকে দূরে সরে ছিলো। ভেবেছিলো আর কখনো এই গ্রামে পা বাড়াবে না কিন্তু তার স্বামীর মৃত্যুর পর আর টিকে থাকা হয়নি এখানে। লোকটা যথেষ্ট ভালবাসতো তপতীকে। তাই তো মৃত্যুর আগে বলে গিয়েছিলো,
“আমি তো মনে হয় আর বেশিদিন বাঁচব না, একটা সন্তান ও দিতে পারলাম না তোমাকে। আমার প্রতি কোনো দাবি রেখোনা।মনে রেখো আমায়। কথাটা শুনে সেদিন তপতী খুব কেঁদেছিলো আর মনে মনে বলেছিলো, “খুব কি তাড়া আপনার আমাকে ছেড়ে যেতে “? কথাটার উত্তর আজো খুঁজে পায়নি তপতী। এতোদিন বাবা-মা গিয়ে গিয়ে তাঁকে দেখে আসতো তবে এখন তারা এতটাই বৃদ্ধ হয়ে গেছে যে চোখেও ঠিকমতো দেখতে পায় না।তাই তপতী চাইছে বাকি জীবনটা তাদের কাছে কাটিয়ে দিতে।
সকাল সকাল আজ তপতী রওনা দিলো তার শৈশবের গ্রামের দিকে।গ্রামে পা রাখতেই দেখা গেলো সেই শঙ্খচূড়া নদীর উপর একটা প্রকান্ড ব্রীজ দাঁড়িয়ে আছে। আর তার নিচে কে যেনো একজন একটা নৌকা নিয়ে বসে আছে কোনো যাত্রী ছাড়াই। একটু কাছে যেতেই তপতীর কলিজাটা ধক করে উঠলো। এতবছর পর কোন একজন প্রিয় পুরনো মানুষের সাথে এভাবে দেখা হয়ে যাবে তপতী বুঝতে পারেনি।
রাসু তপতীকে দেখে মুচকি হাসি দিলো আর বললো অনেকবছর পর দেখা। চল, এই বলে রাসু নৌকায় উঠে নড়েচড়ে বসলো সাথে তপতীও। রাসু আজো বিয়ে করেনি শুনে তপতীর বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। একটুপরে রাসু তার কোমরে জড়ানো লুঙ্গির ভাঁজ থেকে একটা কাগজ বের করলো যেটা আজ কুঁচকানো এক পুরনো কাগজে রুপান্তরিত হয়েছে তবে লেখাগুলো আজো স্পষ্ট, যেটা তপতী একদিন রাসুকে দিয়েছিলো।
তারপর রাসু আর কিছু বলেনি শুধু বলেছিলো,”জীবনে কিছু কিছু করা ভুলের মাঝে এমন একটা ভুল থাকে যেটা সারাজীবনের জন্য কলিজায় দাগ কেটে যায় যে দাগ ভিতরে ভিতরে অক্ষত থাকে কখনো শুকায় না।” সেদিন আমার উচিত ছিলো তোর হাজারো বদনামের মাঝেও তোর হাতটা ধরে রাখা কারণ আমি জানতাম তুই নিষ্পাপ। বিশ্বাস কর তপতী তোর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর থেকে নিজেকে আজ পর্যন্ত ক্ষমা করতে পারিনি একটা ভুল সারাজীবন আমায় কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে।তাই এই জীবনে আর কাউকে সঙ্গী করিনি।
শঙ্খচূড়া নদীর এপার এসে তপতী ছলছল চোখে রাসুর দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো, সেই নদী আজো আছে যার নাম শঙ্খচূড়া তবে আজ তপতীর বয়স হয়ে গেছে, কালো চুলগুলো সাদা রঙে রুপান্তরিত হয়েছে তবে সেই আবেগ আর ভালবাসা সেই পুরনোই রয়ে গেছে। একটুপরে রাসু হাত বাড়ালো তপতীর দিকে কিন্তু তপতীর মনে তখন বজে উঠলো একটি কথা যেটা কেউ একজন মৃত্যুর আগে বলেছিলো।কথাটা ছিলো, “মনে রেখো আমায়”