হ্যালি-র বেচাল
দেখা গেছে?
হ্যাঁ, দেখা গেছে! উনিশশো পঁচাশি বারোই নভেম্বর তারিখের খবর তাই।
কী দেখা গেছে যা নিয়ে এত উত্তেজনা, তা নিশ্চয় এখন আর বলতে হবে না। কোথা থেকে, কেমন দেখা গেছে সেইটেই আসল খবর।
দেখা গেছে আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলস থেকে, দূরবিন-টুরবিন নয়, একেবারে খালি চোখেই। এইটিই যা বারোই নভেম্বর তারিখের খবর।
লস অ্যাঞ্জেলস্-এর বাসিন্দাদের ঈর্ষা করবার কোনও কারণ কিন্তু নেই। আমেরিকার চিত্র-তারকাদের নিজস্ব মুলুক বলে ভাগ্য তাদের ওপর বেশি সুপ্রসন্ন এ কথা ভাবাও ভুল। যা দেখতে পাওয়া নিয়ে এত হইচই দুদিন বাদে সারা পৃথিবীর মানুষই প্রাণভরে তা দেখতে পাবে।
কিন্তু এই দেখতে পাওয়াটাই এমন কিছু কি বড় খবর?
যা দেখবার কথা হচ্ছে তা যে হ্যালির ধূমকেতু তা আর নিশ্চয় হাঁকডাক করে জানাতে হবে না। হ্যাঁ, হ্যালির ধূমকেতু আসছে, আসছে যেমন তার নিয়ম, সেই ছিয়াত্তর বছর বাদে। সে আসবে তার লম্বা আগুনের লেজটা পেছনে ছড়িয়ে আমাদের সূর্যকে একটা পাক দিয়ে, আবার ফিরে যাবে যেখান থেকে এসেছিল সেই অজানা সুদূর নিরুদ্দেশে।
ব্যাপারটা অদ্ভুত সন্দেহ নেই, কিন্তু নতুন কিছু নয়। এক জীবনে কোনও একজন একবারের বেশি দুবার ও-ঘটনা দেখবার সুযোগ পায়নি বললেই হয়। কিন্তু বিশেষ কোনও একজন পেলেও পৃথিবীর মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে এ ঘটনা যে দেখে লক্ষ করে আসছে, আরও অনেক কিছুর সঙ্গে আমাদের মহাভারতেও তার প্রমাণ আছে। যেমন তেমন প্রমাণ নয়, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধটাই যে এই ধূমকেতুর অশুভ আবির্ভাবের ফল এমন ইঙ্গিত নাকি দেওয়া আছে সেখানে।
তাই স্বীকার করতেই হচ্ছে যে হ্যালির ধূমকেতুর আসা যাওয়া একটা অসাধারণ ঘটনা হলেও একেবারে নতুন অজানা কিছু নয়।
হ্যালির ধূমকেতু আগেও যেমন এসেছে আর কিছুদিনের জন্য রাতের আকাশের পরম বিস্ময় হয়ে থেকে সূর্যদেবকে একবার পাক দিয়ে আবার নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে, এবারও তাই যাবে।
কিন্তু ব্যাপারটা এবার শুধু তাই কি?
এই ১৯৮৫-র ২রা জুলাই ফরাসি গায়নার কোস্ট থেকে গিয়োত্তো নামে যে রকেট ছোঁড়া হল সেটা কি নিছক বাহাদুরি! কী মতলবে জলের মতো পয়সা খরচ করে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি ব্রিটিশ এরোস্পেস-এর সঙ্গে থেকে সত্তর কোটি কিলোমিটার পাড়ি দেবার জন্য এই রকেট ছোঁড়ার ব্যবস্থা করেছে!
হ্যাঁ, লক্ষ্য যে হ্যালির ধূমকেতু তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু গিয়োত্তোকে ছোঁড়া হয়েছে যেদিক দিয়ে হ্যালির ধূমকেতু আসছে তার উলটো দিক থেকে তার সঙ্গে মোলাকাতের জন্য। আর সে মোলাকাত যদি সত্যিই হয় তবে হবে সেই ১৯৮৬-র ১৩ই মার্চ গ্রিনিচ মানা ঘড়ির হিসাবে সন্ধ্যা ৬-৩০ মিনিট থেকে পরের দিন ১৪ই মার্চ বেলা তিনটে ত্রিশ মিনিটের মধ্যে। সে সাক্ষাৎ যদি হয় তাহলে ৯৬০ কিলোগ্রাম ওজনের তিন মিটার লম্বা গিয়োত্তো তার খবর যা পাঠাবে সে রেডিয়োবার্তা পৃথিবীতে পৌঁছতে অন্তত আট মিনিট লাগবে।
কিন্তু খবর কি সত্যিই পাঠাতে পারবে গিয়োত্তো?
যদি পারেও তাহলে কেমন আর কী হবে সে খবর?
কী বলেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধুরন্ধরেরা? কী বলেন আপনাদের টঙের ঘরের তিনি?
এ পর্যন্ত যা লেখা হয়েছে তা পড়ে যাঁরা ওয়াকিবহাল তাঁরা নিশ্চয়ই বুঝেছেন যে রণং দেহি চ্যালেঞ্জটা সেই মৌ-কা-সা-বি-স-এর।
কিন্তু এ চ্যালেঞ্জের জবাব কেমন করে দেওয়া যাবে? টঙের ঘরের তাঁকেও আসরে নামানো যাবে কী করে?
নিজেদের মধ্যে শলা-পরামর্শ করে কোনও রাস্তাই যখন ঠিক করতে পারছি না তখন নিজেদের মধ্যে ঝগড়া দিয়েই আসরটা জমানো যায় কি না সে চেষ্টার কথা ভাবা হল।
হ্যাঁ, সোজাসুজি ঝগড়া। হ্যালির ধূমকেতু নিয়ে প্রায় হাতাহাতির অবস্থা পাকিয়ে তুলতে হবে।
ছিয়াত্তর বছর অন্তর দেখা দেওয়া ধূমকেতু এবার কী করবেন তাই নিয়ে যার যার নিজের কল্পনার লড়াই।
সুবিধে হয়ে গেল সকালের রেডিয়ো মারফত খবরটা শোনায়। তারিখ ২৭শে নভেম্বর। হ্যালির ধূমকেতু আজই নাকি আমাদের দেশের আকাশে দেখা দিচ্ছেন। তবে খালি চোখে নয়, তাঁকে দেখতে হলে দূরবিন জোগাড় করতে হবে।
খবরটা ২৭ শে সকালে পেলেও দূরবিনে দেখার মতো হ্যালির ধূমকেতুর আবির্ভাব নাকি হয়েছে ২১শে নভেম্বর সূর্যাস্তের পর।
বিশ্বাস করি না—
সমস্ত আড্ডাঘর এক মুহূর্তে চমকে একেবারে স্তব্ধ করে দেওয়া এ কার গলা? আর কারও নয়, আমাদের শিবুরই।
গুরু নানকের জন্মদিন বলে ছুটি থাকায় সকালেই সবাই এসে আড্ডাতে জমায়েত হয়েছি। বনোয়ারি সুরভিত চায়ের ট্রে নিয়ে নীচে থেকে উঠে আসবার সঙ্গে সঙ্গেই টঙের ঘরের তিনিও এসে তাঁর মৌরসি আরামকেদারা দখল করে শিশিরের মুখে সকালের বেতার সংবাদ শুনছেন—এমন সময় শিবুর এই চমকে দেওয়া ঘোষণা।
নিজের ঘোষণাটা আরও জোরালো করবার জন্য শিবু দ্বিতীয়বার সেটা গলা চড়িয়ে শোনাল, বিশ্বাস করি না আমি।
বিশ্বাস করো না? কী বিশ্বাস করো না? খানিক বিস্ময় বিমূঢ়তার পর আমাদের প্রশ্ন।
কী বিশ্বাস করি না? শিবু নিজের বক্তব্যটা জোরালো করবার জন্য প্রশ্নটা নিজেই আবার আউড়ে নিয়ে উত্তর দিলে, বিশ্বাস করি না তোমাদের ওই জ্যোতির্বিদ পণ্ডিতদের হিসেব নিকেশ।
বিশ্বাস করো না! একেবারে হতভম্ব হয়েই বললাম, কত যুগ যুগ ধরে যারা হিসেব মিলিয়ে আরও অনেক কিছুর জন্য এই ধূমকেতুর গতিবিধির নির্ভুল গণনা করে এসেছেন তাঁদের বিশ্বাস করো না? এতদিনে তাঁদের হিসেবের ভুল কোথাও ধরা পড়েছে?
ধরা পড়েনি বলেই ভুল যে হয়নি তার ঠিক কী? শিবু হার না মেনে বললে, আর আগে যদি ভুল না-ও হয়ে থাকে, এবারে হয়েছে বলেই আমার ধারণা।
তোমার ধারণা! তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললাম, তোমার ধারণা মতে কী এবার হবে শুনি? হ্যালির ধূমকেতু এবার আসবে না?
আসবে না, বলছি না, শিবু জোর দিয়ে বলে চলল, এসেই যখন পড়েছে তখন আসবে না বলবে কোন আহাম্মুক? কিন্তু যেখান দিয়ে যেমন করে এসে যতদিন থাকবে বলা হচ্ছে সেসব হিসেব মিলবে না।
তার মানে, বিদ্রুপের সুরেই বললাম, তা হলে হ্যালির ধূমকেতু আমাদের এই পৃথিবীর ওপরই আছড়ে পড়তে পারে।
তা পারে না এমন নয়, শিবু আমাদের বিদ্রুপটা গ্রাহ্য না করেই যেন ধৈর্য ধরে বোঝালো, এর পরে কোনওবার হয়তো এসে পড়বে। তবে এবারে অমন একটা দুর্ঘটনা ধরতে না পারার মতো হিসেবের ভুল হয়েছে বলে আমি মনে করি না। তবে ভুলচুক কিছু যে না হয়ে পারে না সে বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই। আর পৃথিবীর উপর আছড়ে পড়ার মতো ব্যাপারে না হোক, সে ভুল হ্যালির ধূমকেতুর এবারের গতিবিধিতেই ধরা পড়বে।
হাতে পাঁজি মঙ্গলবার, আর কেন? শিশির তর্কটা সিধে রাস্তায় চালাবার চেষ্টায় বললে, ধূমকেতু তো এসে পড়েছে, তখন তার গতিবিধির বেয়াড়াপনা দেখতে পাব আর ক-দিনের মধ্যে। কিন্তু জ্যোতির্বিদদের গণনায় ভুলচুক যে হবেই এ ধারণার ভিতটা কী জানতে পারি?
নিশ্চয় পারো, শিবু তার বক্তব্য ব্যাখ্যা করে বোঝাল, জ্যোতির্বিদেরা মূর্খ অথবা আনাড়ি গণক অবশ্যই নয়। তবু তাদের ভুল না হয়ে পারে না। আর সে ভুল হবার কারণ, যার কণামাত্র আমরা জেনেছি, সেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অতল রহস্য। জ্যোতির্বিদেরা তাঁদের দূরবিন আর রেডিয়ো-টেলিস্কোপ দিয়ে যেটুকু হদিস পান তা দিয়ে সে অসীম অতল রহস্যের কতটুকু অঙ্কের ছকে ফেলতে পারেন? এ যেন
পুকুরের জলের ঢেউ দেখে অপার সমুদ্রের রহস্যের ব্যাখ্যা করা।
না, শিবু বড় বাড়াবাড়ি করে ফেলছে। তার মানে তুমি বলতে চাও বলে শিবুর দার্শনিকতা এবার থামাবার চেষ্টা করা হল।
কিন্তু সে থামল না, সমান উৎসাহে বলে চলল, এই অসীম বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে আমাদের ছায়াপথের মতো সামান্য একটা গ্যালাক্সি অর্থাৎ নক্ষত্রমণ্ডলের এককোণে ছোট্ট একটা ধূমকেতু মাত্র ছিয়াত্তর বছর অন্তর আমাদের সূর্যের মতো একটা ছোটখাটো তারাকে পাক দিয়ে যায়। সেই পাক দিয়ে যাওয়ার রাস্তা আর সময়টা অনেককাল একরকম ছিল বলে কি চিরকাল থাকবে না, থাকতে পারে? বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ছেড়ে দিলাম, আমাদের এই ছায়াপথ গ্যালাক্সি-তেই কত কী না হচ্ছে যার ঢেউ এসে লেগে হ্যালির ধূমকেতুর গতিবিধি সব তছনছ করে দিতে পারে।
মানলাম যে তা পারে। বিতণ্ডাটা যেন জমেছে বুঝে একটু উসকানি দিলে গৌর, কিন্তু মহাশূন্যে অমন ঢেউ তোলার মতো তেমন কিছু ঘটেছে কি?
ঘটেছে নিশ্চয়, শিবু জোর দিয়ে বললে, আর যা ঘটে তার সব কি আমাদের জানা সম্ভব? আমাদের পৃথিবীর সৌরমণ্ডল যে গ্যালাক্সির ছায়াপথে আমরা আছি, আমরা তার কী দীনহীন একটা সদস্য তা জানো? জানো আমাদের এই ছায়াপথের প্রায় কিনারায় কেন্দ্র থেকে কতদূরে আমাদের সৌরমণ্ডল পড়ে আছে—তুমি জানো?
শিবুকে খোঁচা দেবার ছল করে আড়চোখে যাঁর দিকে একবার চেয়ে দেখলাম তাঁর কিন্তু কোনও সাড়াশব্দই নেই! এক পেয়ালা শেষ করে টী-পট থেকে আর-এক পেয়ালা চা ঢেলে নিয়ে হাতের খবরের কাগজটাতেই যেন তন্ময় হয়ে আছেন। এমনই করে সাজিয়ে তোলা চালগুলো কি তাহলে ভেস্তেই গেল!
ওদিকে শিবু আবার তার নিজের ফাঁদেই না পা জড়িয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে। ছায়াপথের কোন দূর কিনারায় আমাদের সৌরমণ্ডলের হেলায় ফেলায় পড়ে থাকার কী সব আঁকজোকের কথা বলছিল তা শেষ পর্যন্ত সামলাতে পারবে?
তা পারল শিবু। বেশ একটু মাতব্বরি চালেই বললে, আমাদের এই ছায়াপথের কেন্দ্র থেকে আমরা যত দূরে আছি তার সেকেন্ডে যে আলোর গতি এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল সেই আলোর সমান বেগে ছুটতে পারলেও আমাদের ত্রিশ হাজার বছর লেগে যাবে। এই দূরত্ব থেকে যে বিশালতার আন্দাজ পাওয়া যাচ্ছে তার মধ্যে যা কিছু হচ্ছে তা আমরা জানব কী করে? তোমরা বলবে যে সেই মহাভারতের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত প্রতি ছিয়াত্তর বছর পরে পরে কতবার হ্যালির ধূমকেতু ঘুরে গেছে। কম-বেশি সেই পাঁচ হাজার বছরে তার গতিবিধির কোনও এদিক ওদিক হয়েছে কি? হ্যাঁ, মানছি যে সামান্য কিছু গতিবিধির অদলবদল যদি হয়েও থাকে তা ঠিক ধর্তব্যের মধ্যে নয়। কিন্তু আমাদের কাছে অনেক মনে হলেও যে সময়টার অল্পবিস্তর সঠিক খবর আমরা পাচ্ছি তাই মাত্র পাঁচ হাজার বছর। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কাণ্ড কারখানায় পাঁচ হাজার বছর কি একটা হিসেবে ধরবার মতো সময়? আমাদের এই গোটা ছায়াপথ গ্যালাক্সি চরকির মতো অনবরত পাক খাচ্ছে তা জানো বোধ হয়। একটা পাক পুরো করতে তার কত সময় লাগে ভাবতে পারো? লাগে—লাগে–এই আন্দাজ—দশ—দশ—
শিবুর তোতলামির মাঝখানে হঠাৎ আড্ডাঘরটা কাঁপিয়ে বাজখাঁই গলায় ধমক শোনা গেল—না। কুড়ি কোটি বছর!
হ্যাঁ, বারুদের পলতেটা ঠিকই ধরেছে শেষ পর্যন্ত। ঘরের ছাদ কাঁপানো গলার ধমকটা আর কারও নয়, মৌরসি কেদারার সেই একমেবাদ্বিতীয়, তাঁরই। তিনিই আগের শেষ করা পেয়ালাটা সামনের টী-পট-এ নামিয়ে রেখে বললেন, হ্যাঁ, আমাদের ছায়াপথের একবার পুরোপুরি পাক খেতে লাগে পাক্কা কুড়ি কোটি বছর। আর আমাদের এই ছায়াপথ গ্যালাক্সির বয়স হল বারো শো থেকে দু হাজার কোটি বছর। হ্যালির ধূমকেতুর খবর যখন থেকে অল্পবিস্তর পেতে শুরু করেছি সেই পাঁচ হাজার বছর ওই অশেষ যুগযুগান্তের কাছে তো চোখের একটা পলকের বেশি নয়। সৃষ্টি থেকে আজ পর্যন্ত এ ধূমকেতুর অনেক চাল-বেচাল হয়েছে ভাবলে তাই ভুল কিছু হবে না। তারপর মাত্র পাঁচ হাজার বছর সুশীল সুবোধ থেকে এবারই তার হঠাৎ বিগড়ে গিয়ে কিছু বেচাল দেখানো তাই মোটেই অসম্ভব নয়। কিন্তু বেচালটা তার কী ধরনের হতে পারে, আর কেন, সেইটেই ভাববার!
ঘনাদা থামলেন। শিশিরও প্রস্তুত। ঘনাদার কথা শেষ হতে না হতেই তার নতুন। সিগারেটের টিন খোলার মৃদু শিসের আওয়াজ শোনা গেল। তারপর ঘনাদা তা থেকে সিগারেট তুলে মুখে ঠোঁটের ফাঁকে বসাতে না বসাতেই শিশিরের লাইটার জ্বালার মৃদু শব্দ শোনা যায় কানে।
সিগারেট ধরিয়ে ঘনাদা হালকা থেকে শুরু করে গোটা তিনেক রাম টান দিয়ে এক কুণ্ডলী ধোঁয়া না ছাড়া পর্যন্ত আমরা অধীর আগ্রহে খানিক চুপ করে থেকে ছেড়ে দেওয়া খেইটা একটু ধরিয়ে দেবার চেষ্টায় দ্বিধাভরে বললাম, হ্যালির ধূমকেতুর বেচাল তাহলে এবার সত্যি হতে পারে? তা বেচালটা কীরকম?
কথা শেষ হতে না হতেই ঘনাদার ধমক—কীরকম হতে পারে আর কেন তা নিজেরাই একটু ভেবে বলো না।
নিজেরাই ভেবে দেখব? চালের ভুলে শেষ কিস্তিটাই কাঁচিয়ে দিলাম নাকি? ঘনাদা কি চটেছেন নাকি?
না, গলাটা কড়া হলেও ঘনাদা বেশ তৃপ্তিভরেই সিগারেটে সুখটান দিলেন। দরকার এখন তাঁকে একটু তোয়াজ করা। তাই করলাম।
বোকা সেজে বললাম, বেচাল কী আর কেন হতে পারে, বলব? বেচাল হবে আমাদের গ্যালাক্সির ওই যে বলেছেন ত্রিশ হাজার আলোকবর্ষ দূরের কেন্দ্র সেখানে কোথাও কোনও সুপার-নোভা নক্ষত্রের বিস্ফোরণের দরুন আর তার ধাক্কায় হ্যালির ধূমকেতু এবার সূর্যকে পাক দেওয়ার বদলে হয় তার ভেতর মরণ ঝাঁপ দেবে কিংবা কোনওরকমে মান বাঁচিয়ে খসে যাওয়া লেজটা শুধু রেখে পালাবে।
লেজটা তোমার জন্যেই রেখে যাবে, আমার বাড়িয়ে দেওয়া চালটা শিশির উচিত মতোই চড়াতে ভুল না করে বললে, সুপারনোভা অমন অনেকে ফেটেছে আমাদের গ্যালাক্সিতে গত হাজার বছরে, তার জন্য অবশ্য হ্যালির ধূমকেতুর কোনও বেচাল আজ পর্যন্ত হয়েছে বলে জানি না। না, ঘনাদা আপনি বলুন, কী বেচাল দেখব এবার হ্যালির ধূমকেতুর কী বেচাল দেখব তা কেউই ঠিক করে বলতে পারে না, তবে— ঘনাদা যেন সুদূর মহাশূন্যেই নিজেকে চালান করে দিয়ে বললেন, তবে হয়তো-হতে-পারে এমন সব কিছু ব্যাপার অনুমান করতে পারি। তার যা এবার হতে পারে বা হতে যাচ্ছে। আমাদের নিজেদেরই কর্মফল। হ্যাঁ, ফ্রেঞ্চ গায়নার কোস্ট থেকে ছোঁড়া গিয়োত্তো হয়তো তাকে যা হুকুম তার চেয়ে আলাদা বেশি কিছু করবে। হয়তো তার গণকযন্ত্র ভুল করে বসবে, আর সেই ভুলের দরুন হ্যালির ধূমকেতু থেকে এক হাজার কিলোমিটার দূর থেকে তার খবর নেবার বদলে সে ধূমকেতুর মাথায় ঝাঁপিয়ে টু মেরে বসবে, আর তাতে যা হবে সেইটেই আশ্চর্য অবিশ্বাস্য ব্যাপার। গিয়োত্তোর গুঁতোয় ধূমকেতুর মাথা কিংবা লেজ থেকে যা বেরিয়ে আসবে সেইটেই সাত রাজার ধন মানিকের চেয়ে অবাক করা এক বস্তু। পৃথিবী থেকে লক্ষ রাখা দূরবিনে সে বস্তুর দেখা পাওয়া মাত্র পৃথিবীর দুই মহাশক্তির কেউ হয় ফেরি-রকেট চ্যালেঞ্জারে, নয় অন্য কোনও মহাকাশযানে তাকে উদ্ধার করে আনবে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু উদ্ধার করার পর সমস্ত পৃথিবীর বিস্ময়ের আর সীমা থাকবে না—জিনিসটা কী তা বুঝতে পারার পর। জিনিসটা একটা অসাধারণ টি ভি ক্যামেরা যা হ্যালির ধূমকেতুর ভেতরে গাঁথা হয়ে থেকে আগাগোড়া তার ছিয়াত্তর বছরের মহাকাশ পরিক্রমার সব বিবরণ ধরে রেখেছে। পৃথিবীর মানুষেরা এরকম একটা যন্ত্র হ্যালির ধূমকেতুর ভেতরে গেঁথে তার ছিয়াত্তর বছরের পাড়ির সব বৃত্তান্ত ধরে রেখে সংগ্রহ করার কথা ভাবছিল। সে চেষ্টা তাদের আর করতে হল না।
এটা যে কল্পনাতীত আশাতীত সৌভাগ্য সে কথা আর বলবার নয়, কিন্তু কথা যা হবে তা এই যে এমন আশ্চর্য যন্ত্র কারা তৈরি করে হ্যালির ধূমকেতুর মধ্যে গেঁথে দিয়েছে। ছিয়াত্তর বছর আগে দূরদর্শন ক্যামেরা কি রকেট-বিজ্ঞান ব্যাপারে পৃথিবীর মানুষেরও হাতেখড়ি মাত্র হয়েছে বলা যায়। এমন আশ্চর্য কীর্তি তাহলে কার?
সৌরমণ্ডলের কোনও গ্রহে উন্নত সভ্যতা দূরে থাক বুদ্ধিমান কোনও প্রাণীর অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সৌরমণ্ডল ছাড়িয়ে তার ছিয়াত্তর বছরের পরিক্রমায় হ্যালির ধূমকেতু আরও অনেকদূর পর্যন্ত টহল দিয়ে আসে বটে, কিন্তু তা-ও চার দশমিক তিন আলোকবর্ষ দূরের আমাদের সবচেয়ে কাছের তারকা প্রক্সিমা সেনটোরির চেয়ে দূরে নয়। এরকম একটা যন্ত্র বানিয়ে তা হ্যালির ধূমকেতুতে গেঁথে দেওয়ার ক্ষমতা যাদের হয়েছে এমন উন্নত সভ্যতায় পৌঁছনো প্রাণী তাহলে আছে। কোথায়? আমাদের কোনও দূরবিনে তাদের অস্তিত্ব ধরা পড়েনি কেন এতদিন, এইটেই হবে আমাদের ভাবনা। তবে এ প্রশ্নের উত্তরও আছে।
পৃথিবী থেকে সবচেয়ে কাছের তারা পর্যন্ত ফাঁকা মহাশূন্যে খানিকটা কালো নীহারিকার এলাকা যে আছে তা-ও আমরা দেখেছি। মহাকাশের মুলুকে অন্ধকার কত কী যে লুকিয়ে রাখে কে জানে, মানুষেরও আগে দূরদর্শন বা রকেট-যন্ত্র আবিষ্কারের মতো উন্নত সভ্য প্রাণীর হয়তো সেখানে কোথাও বাস। তাদের দুরদর্শন যন্ত্র থেকেও তাদের বিশদ পরিচয় পাওয়া যাবে বলে আশা করতে পারি। এখন শুধু তারই অপেক্ষায় থাকা। শিশিরের সিগারেটের টিনটা অন্যমনস্কভাবে পকেটে নিয়ে টঙের ঘরের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বললেন, ১৯৮৬-র ১৩ই মার্চ তো আর খুব বেশি দূরে নয়।