ঘনাদা এলেন
হ্যাঁ, ঘনাদা একদিন এসেছিলেন!
নিশ্চয়ই একদিন এসেছিলেন আমাদের এই বাহাত্তর নম্বর বনমালি নস্কর লেনে।
কিন্তু কবে কখন কেমন করে তিনি প্রথম এলেন সে কথা মনে করতে গিয়ে বেশ মুশকিলে পড়তে হচ্ছে।
ঘনাদা নামে কোনও একজনের সঙ্গে এই বাহাত্তর নম্বরে প্রথম পরিচয়ের স্মৃতি বলতে মনে যা আসছে তা স্রেক একটি ব্যাগ।
হ্যাঁ, মাঝারি সাইজের ক্যাম্বিসের একটা ব্যাগ।
না, মানুষ জন কেউ নয় শুধু একটি ক্যাম্বিসের ব্যাগ—ঘেঁড়াখোঁড়া পুরনো না হলেও বেশ একটু জীর্ণ গোছের।
বাহাত্তর নম্বরের প্রথম পত্তনের সময়ে, সবকিছু তখন তো এলোমেলো অগোছালো। সুবিধামত একটা বাড়ি পেয়ে যে কজনে মিলে সেখানে একটা শহুরে আস্তানা বানাবার ব্যবস্থা করেছিল, এখন বাহাত্তর নম্বর বলতে যাদের নামগুলো আপনা থেকেই মনে আসে, সেই চারজনই তাদের মধ্যে তখন ছিল প্রধান।
অর্থাৎ বাহাত্তর নম্বর বলতে এখন যেমন তখনও সেই চার মূর্তিমান–শিশির, শিবু, গৌর এবং আমি।
বাড়িটা পুরনো হলেও খুব ভাঙাচোরা নয়। সামান্য একটু-আধটু মেরামতের পর চুনকাম করিয়ে আমরা তার কয়েকটা ঘরে তখনই বিছানাপত্র পেতে ঢুকে পড়েছি। এখন যেটা আমাদের আড্ডাঘর সেইটেই তখন কিছু-জমা করা আসবাবপত্র নিয়ে খালি পড়ে আছে। ঠিক করা আছে যে দুদিন বাদে একটু হাতখালি হলেই আসবাবপত্র গুছিয়ে সেটাকে বসবার ঘর বানানো হবে। সকালে বিকালে ওদিকে যেতে আসতে এরই মধ্যে সেখানে একদিন ঘরের মাঝে জমা করা আসবাবপত্রের মধ্যে একটা গোলটেবিলের ওপর ক্যাম্বিসের ব্যাগটা চোখে পড়েছে।
একদিন দুদিন বাদেও টেবিলের ওপর ক্যাম্বিসের ব্যাগটা সমানে বসানো আছে। দেখে ব্যাগটা কার তার সন্ধান নিতে হয়েছে।
ব্যাগটার বর্ণনা আগেই করেছি। ওরকম ব্যাগ আমাদের কারওর যে নয় তা বুঝেই সেটার উপস্থিতি একটু অবাক করেছে।
পরম্পরকে জিজ্ঞাসা-টিজ্ঞাসা করেও রহস্যটার খুব স্পষ্ট একটা মীমাংসা কিন্তু। পাওয়া যায়নি। শিবুই একটু ভেবে ভেবে জড়িয়ে জড়িয়ে বলেছে, হ্যাঁ, ওই একন, মানে আমাদের চেনা কেউ নন, মানে বিপদে পড়ে—
বিপদে পড়ে কী? গৌর শিবুকে তার কথাটা শেষ করতে না দিয়ে ঝাঁঝালো। গলায় জেরা করেছে, বিপদে পড়ে তিনি এখানে আমাদের সঙ্গে বাসা বাঁধবেন নাকি?
না, না, তা নয়! শিবু তাড়াতাড়ি প্রতিবাদ করে জানিয়েছে, বরাবরের জন্য না, মাত্র ক-দিনের জন্য বাধ্য হয়ে এখানে আছেন। খুব কি একটা দরকারি ব্যাপারে কার জন্যে যেন–
হয়েছে। হয়েছে। শিশির শিবকে একরকম ধমক দিয়েই থামিয়ে দিয়ে বলেছে, কে, কী, কেন কিছুই না জেনে কোনও একজনকে ঢুকিয়ে দিয়েছ আমাদের এখানে। এখন তিনি তাঁর এই ব্যাগ নিয়ে
না, না, কোনও অসুবিধে আপনাদের করব না। শিশিরের কথার মাঝখানে তাকে থামিয়ে বারান্দার দরজা দিয়ে যিনি এবার ঘরে ঢুকেছেন তাঁর চেহারার বর্ণনা দেবার বোধহয় দরকার নেই। হ্যাঁ, সেই শুকনো পাকানো ত্রিশ থেকে ষাট যে কোনও বয়সের ধারালো কুড়ুল মার্কা মাঝারি মাপের চেহারা। গলাটি শুধু চেহারার তুলনায় রীতিমত ভারিক্কি।
ঘরের ভেতর ঢুকে এসে দু-হাত তুলে সকলকে নীরব নমস্কার জানিয়ে ভদ্রলোক। বলেছেন, মাত্র দুদিনের ব্যাপার। আপনাদের তেতলায় ন্যাড়া ছাদে একটা ঘর দেখে এলাম–
তেতলায় ন্যাড়া ছাদের ঘর? আমরা ব্যস্ত হয়ে উঠে বলেছি, সেটা আবার ঘর কোথায়? যতসব ফালতু ভাঙাচোরা আসবাবপত্রে ভরা চোর কুঠুরি বললেই হয়।
তা হোক, ভদ্রলোক আমাদের আশ্বস্ত করে বলেছেন, ওখানে একটা ভাঙা তক্তপোশ রয়েছে দেখলাম। ঘরটা একটু পরিষ্কার করে আমার ব্যাগটা নিয়ে দুদিন বেশ কাটিয়ে দিতে পারব। ব্যাগটা তাই এখন নিতে এসেছি।
ঘরের টুকিটাকি দু-চারটে জিনিস রাখা বড় গোলটেবিলটার ওপর থেকে তাঁর ক্যাম্বিসের ব্যাগটা তুলে নিয়ে ভদ্রলোক চলে যাবার জন্য দরজার দিকে পা বাড়িয়ে যেন আমাদের আশ্বস্ত করবার জন্যই বলেছেন, ওই জার-বোয়া জবাবের জন্যেই তো অপেক্ষা। তা হয়তো অন্তত কালই পেয়ে যাব পাওয়া তো উচিত।
কী বললেন? কীসের জবাব? আমাদের সকলের প্রশ্নটা গৌরের মুখেই এবার শোনা গেছে।
জবাবটা জার-বোয়া ছাপের। মানে জার-বোয়া ছাপের ইশারায় ভদ্রলোক যেন অনিচ্ছাসত্ত্বেও একটু বিশদ হয়েছেন—কাগজে ও ছাপ দেখেই আমি আর কোনও ভুল করিনি। যেমন কথা ছিল তেমনই, যেখানে ও ছাপ দেখেছি সেখানেই, তখনই যেমন জুটেছে তেমনই আস্তানা জোগাড় করে যথাস্থানে ঠিকানা জানিয়ে দিয়েছি। এখন শুধু জবাবটা আসার অপেক্ষা। জার-বোয়ার ছাপ, কাগজে যে ছাপিয়েছে, গরজটা নিশ্চয়ই তার এমন যে জবাব দিতে এক লহমা সে দেরি করবে না। চাই কী, আপনাদের এই বনমালি নস্কর লেনে স্বয়ং সেই বব কেনেথই—
ওই পর্যন্ত বলেই ভদ্রলোক হঠাৎ থতমত খেয়ে থেমে গিয়ে, না, না, এসব কী বলছি। মাপ করবেন আপনারা, বলে তাঁর ব্যাগটা নিয়ে বারান্দার দরজার দিকে এগিয়েছেন।
কিন্তু দু পা-র বেশি বাড়াতে তিনি পারেননি। আমাদের সকলের হয়ে শিশিরই দাঁড়িয়ে উঠে তাঁকে বাধা দিয়ে বলেছে, আহা, যাবার জন্য অত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? আপনার সেই চার পোয়া ছাপ যে ছেপেছে—
চারপোয়া নয়, জার-বোয়া! শিশিরকে বেশ একটু করুণার সঙ্গেই সংশোধন করে ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করেছেন, জার-বোয়া কী তা তো নিশ্চয় জানেন?
না। অত্যন্ত লজ্জিত ভাবে নিজেদের মূর্খতা স্বীকার করে বলেছি, জার-বোয়া বল্লম উল্লমের মতো কোনও অস্ত্রশস্ত্র, না কোনও রকম বাদশাহি পোশাকটোশাক?
না, সে সব কিছু নয়, অনুকম্পাভরে ভদ্রলোক জানিয়েছেন, জার-বোয়া হল সাহারার মরু অঞ্চলের এক রকম ইঁদুর। ইদুরের বদলে—
ভদ্রলোক এই পর্যন্ত বলতেই শিশির, শিবু দুজনেই এক সঙ্গে উঠে পড়ে তাঁর হাত থেকে ক্যাম্বিসের ব্যাগটা টেনে নিয়ে তাঁকে ধরে একটা খালি চেয়ারে বসাতে বসাতে বলেছে, আহা, আপনি যাবার জন্য অত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? আপনার সেই জার-বোয়া ছাপের মক্কেল তো আর দোতলা বাদ দিয়ে আপনার তেতলায় পৌঁছতে পারবে না। আপনি এখানেই বসুন না। তারপর ওই মরু অঞ্চলের ইঁদুর জার-বোয়া নিয়ে কী যেন বলছিলেন?
ওই জার-বোয়া নিয়ে? ভদ্রলোক বেশ যেন একটু অনিচ্ছার সঙ্গে একটা চেয়ারে বসে বলেছেন, হ্যাঁ, বলছিলাম যে ইঁদুরের বদলে ওকে উত্তর আফ্রিকার মরুভূমির খুদে ক্যাঙ্গারু বললেই যেন ঠিক হয়। ক্যাঙ্গারুদের মতো সামনের পা দুটি খুদে খুদে আর পেছনের পাগুলো সামনের চেয়ে প্রায় ছ-গুণ লম্বা। ইঁদুরগুলো তাই তাদের আকারের তুলনায় ক্যাঙ্গারুদের চেয়ে লম্বা লাফ দিতে পারে।
তা পারে তো পারে! আমিই প্রথম একটু ঠাট্টার সুর লাগিয়ে বলেছি, উত্তর আফ্রিকার এক ক্যাঙ্গারু-মার্কা ইঁদুরের এত কী খাতির যে তার ছবি কোথাও ছাপা দেখলেই একপায়ে খাড়া হয়ে দাঁড়াতে হবে, আর ওই ক্যাঙ্গারু-দুরের ছবি ছাপাও। বা হয়েছে কোথায়? এখানকার কোনও কাগজে তো দেখিনি।
এখানকার কোনও কাগজে দেখেননি! ভদ্রলোকের গলায় এবার যেন অবোধের প্রতি অনুকম্পা—তা দেখবেন কী করে? এখানকার কোনও কাগজে তো নেই, ও ছাপ বেরিয়েছে খাস লন্ডন টইমসে।
লন্ডন টাইমসে বেরিয়েছে আর আপনি–?
আমার কথাটা আর শেষ করতে হয়নি। ভদ্রলোক নিজেই বাক্যটা সম্পূর্ণ করে বলেছেন, আর আমি এখানকার ইমপিরিয়াল লাইব্রেরিতে গিয়ে সেটা দেখে এসেছি। যেখানে যখন যাই আর থাকি ওই লন্ডন টাইমসটার ওপর আগাগোড়া চোখ বোলানো আমার সাত বছরের নিত্য কর্ম।
সাত বছর! আমাদের সকলের হয়ে গৌর দূ-চোখ প্রায় কপালে তুলে বলেছে, আপনি সাত বছর ধরে লন্ডন টাইমস-এর ওপর চোখ বুলিয়ে আসছেন?
হ্যাঁ প্রায়–সাত বছরই তো হল। ভদ্রলোক একটু যেন দুঃখের সঙ্গে জানিয়েছেন।
কিন্তু কেন? সাত বছর ধরে রোজ রোজ নিয়ম করে একটা বিশেষ বিদেশি কাগজের ওপর চোখ বুলিয়ে যাওয়া সোজা কথা নয়। তার একটা কারণ নিশ্চয়ই আছে! শিশির আমাদের সকলের মনের কথাটাই প্রকাশ করেছে।
তা কারণ আছে বইকী। নিশ্চয় একটা কারণ আছে। ভদ্রলোক এখনও যেন কথাটা খোলসা করে বলতে চান না।
কিন্তু আমরা ছাড়বার পাত্র নয়। সোজাসুজি তাঁকে চেপে ধরেছি—তা সেই কারণটা একটু খুলে বলুন না!
খুলে বলব? ভদ্রলোক এখনও যেন দ্বিধা করে তারপর বলেছেন, তাহলে যেতে হবে কিন্তু উগাণ্ডায়!
উগাণ্ডায়? আমরা বিমূঢ়। গৌরই প্রথম নিজেকে সামলে জিজ্ঞাসা করেছে, উগাণ্ডা মানে আফ্রিকার উগাণ্ডায়?
হ্যাঁ, সেখানকার রিজার্ভড ফরেস্ট মানে অভয়ারণ্যে। ভদ্রলোক যেন বাধ্য হয়ে জানিয়েছেন।
কিন্তু সেখানে এখন যাব কী করে? জিজ্ঞাসা করে আর যা বলতে যাচ্ছিলাম তা আর বলা হয়নি।
ভদ্রলোক তাড়াতাড়ি আমাদের ভুল শুধরে দিয়ে বলেছেন, না না, এখন নয়, যাবার কথা বলছিলাম সাত সাড়ে সাত বছর আগেকার উগাণ্ডার সংরক্ষিত অরণ্যে। মানে সমস্ত ব্যাপারটার সেখানেই শুরু কিনা। শুরু টাইকুন ট্যানার-এর সেই আফ্রিকা-চমকানো শাহানশাহি-সফরি-তে!
একটু থেমে আমাদের অবস্থাটা অনুমান করেই বোধহয় ভদ্রলোক তাড়াতাড়ি নিজের কথার ব্যাখ্যায় বিশদ হয়ে বললেন, সফরি মানে যে কী তা নিশ্চয় আপনারা জানেন, তবে টাইকুন ট্যানার-এর সফরির সঙ্গে এখনকার গোনাগুনতি খরচে ভাড়া করা সফরির আকাশ-পাতাল তফাত-জঙ্গলে বারশিঙা শিকার আর বাজার থেকে কাটা-পাঁঠার মাংস কেনার চেয়ে অনেক বেশি। টাইকুন ট্যানার-এর সফরি মানে একটা রাজসূয় ব্যাপার। বন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে যত খুশি যে কোনও প্রাণীশিকার আইন করে তখন বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু নামের আগে সিংহের ঘাড়ের কেশরের মতো টাইকুন শব্দটা যার জোড়া হয়ে গেছে, কোটিপতি ধনকুবেরদেরও যে শাহানশাহ, টেকসাস-এর সেই জীবন্ত ট্যাঁকশালা টাইকুন ট্যানার কি আইনের পরোয়া করে! সরি-তে গোনাগুনতি শিকার করবার সরকারি পারমিট মানে হুকুমনামা সে তো উগাণ্ডার অরণ্য-দপ্তরের বড়কর্তার কাছ থেকে নিজে নিয়ে নিয়েছে। টাইকুন ট্যানার-এর নাম জানতে কারও বাকি নেই। সেই টাইকুন ট্যানার নিজে সশরীরে অফিসে এসেছে। বন-বিভাগের বড়কা তাকে খাতির করে কোথায় বসাবেন ভেবে পাননি। টাইকুন ট্যানার-এর চেহারাটা তার ঐশ্বর্যের মাপে এমন দশাসই যে একটা প্রমাণ মাপের কোচ-এ তাঁকে আঁটানো যায় না। টাইকুন ট্যানার অবশ্য কোথাও বসার বদলে আগাগোড়া দাঁড়িয়েই বন-বিভাগের বড়কর্তার সঙ্গে তাঁর কথা সেরেছেন। শিকারের পারমিটটা সেখানে দাঁড়িয়েই তিনি পড়ে দেখেছেন যে অন্যসব সাধারণ জানোয়ারের বেলা তেমন কড়াকড়ি না থাকলেও হাতি গণ্ডার সিংহের মতো বড় বড় জানোয়ারের বেলা শিকারের অনুমতি দারুণ কড়া। এ হুকুমনামা পড়েও অন্য অনেকের মতো বিন্দুমাত্র অনুযোগ-আপত্তি না জানিয়ে টাইকুন ট্যানার যেন খুশি মনে বন-বিভাগের বড়কর্তার সঙ্গে করমর্দন করে চলে আসবার সময় শুধু জিজ্ঞাসা করেছে, শিকার যতই গোনাগুনতি করে রাখা হোক, সফরির লোকলস্কর লটবহরের বেলা সেরকম কোনও বিধিনিষেধ নেই তো?
না, তা নেই। বন-বিভাগের বড়কর্তা একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন, কিন্তু অত বড় বিরাট বাহিনী আপনি সঙ্গে নিচ্ছেনই বা কেন? ওর অনেক ঝামেলা।
ওই ঝামেলা পোহানোতেই আমার সুখ, বলেছে টাইকুন ট্যানার, তাছাড়া বিরাট আর কোথায় দেখলেন! শিকারি আমার একজন, ওই বব কেনেথ!
হ্যাঁ, ও তো একাই একশো। হেসে বলেছেন অফিসার, ওর চেয়ে বড় শিকারি এখন সারা আফ্রিকায় আর কেউ আছে বলে জানি না।
হ্যাঁ, তাই শুনেছি বলেই ওকে নেওয়া। দেখা যাক, যত হাঁক ডাক তত এলেম সত্যি আছে কি না! হেসে বলেছে টাইকুন ট্যানার।
এর ওপর আপনি শিকারের বন্দুকও গণ্ডা গণ্ডা নিয়েছেন—দেখলাম আমাদের অফিসে পাঠানো আপনার লটবহরের তালিকা থেকে। অত বন্দুক আপনার মিছিমিছি বওয়াই সার। কী কাজে লাগবে আপনার অত বন্দুক? হাসিমুখেই জিজ্ঞাসা করেছেন। বন-বিভাগের ওপরওয়ালা অফিসার।
মনে করুন, ও শুধু নিজের অহংকারকে একটু তোয়াজ, বলেছে টাইকুন ট্যানার, ওগুলো যে সঙ্গে আছে তাই দেখার সুখ। আর শুধু, এখন দুনিয়ার সেরা যা শিকারের বন্দুক আছে তা সব তো ওর মধ্যে আছেই, সেই সঙ্গে সেরা একজন বন্দুকের ডাক্তারকেও সঙ্গে নিয়েছি।
বন্দুকের ডাক্তার? রীতিমতো অবাকই হয়েছেন বন-বিভাগের বড়কর্তা—সে আবার কী?
কী তা বুঝলেন না! টাইকুন ট্যানার বলেছে, ডাক্তার মানে হালের বন্দুকের কারিগরির সেরা মিস্ত্রি। ম্যাচলককে যে রাইফেলের সঙ্গে পাল্লা দেওয়াতে পারে।
তা ভালো! তা ভালো! মনে মনে এই দাম্ভিক টাকার কুমিরটার ওপর যতই খাপ্পা হয়ে উঠুন, মুখে হাসি টেনে বন-বিভাগের বড়কর্তা বলেছেন, আইনকানুন সব মেনে আপনার এত সাধের সফরি সার্থক হয়ে ফিরে আসুক এই শুভকামনাই জানাই।
ও, আপনাদের আইনের কথা বলছেন? কিচ্ছু ভাববেন না, ফিরে আসার পর তার গায়ে আঁচড়ও দেখতে পাবেন না। এ শুভকামনার জন্য ধন্যবাদ, বলে টাইকুন ট্যানার বন-বিভাগের বড়কর্তার এমন করমর্দন করে দপ্তর থেকে বেরিয়ে এসেছে যে জখম হাত নিয়ে বনের বড়কর্তাকে ককিয়ে ওঠা চাপতে হয়েছে অনেক কষ্টে।
টাইকুন ট্যানার-এর যাদের নিয়ে অত হম্বিতম্বি তার সফরিতে গোল বাধল কিন্তু তাদের নিয়েই—সেই কে না কে বন্দুকের ডাক্তার আর আফ্রিকার সেরা শিকারি বব। কেনেথ।
ঢাইকুন ট্যানার-এর সফরি তখন জানা-অজানা অনেক বন জঙ্গল পার হয়ে এক নতুন জায়গায় আস্তানা গেড়েছে। এ পর্যন্ত যা শিকার হয়েছে তা সাধারণ তিনটে দলের সফরির পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু ট্যানারের তাতে মন ভরেনি। এ সফরি থেকে সে এমন কিছু মেরে নিয়ে যেতে চায়, দুনিয়ার শিকারিমহলের চোখ যাতে ছানাবড়া হয়ে যাবে।
এই নতন আস্তানায় সেই ভাগ্যই যেন তার জন্য অপেক্ষা করছিল। আস্তানা পাতবার পরের দিনই সকালে নিজের বাদশাহি তাঁবু থেকে বেরিয়ে কাছাকাছি জঙ্গলটা একটু ঘুরে আসতে গিয়ে সে এক জায়গায় এসে দাঁড়াবার পরই আতঙ্কে যেমন কেঁপে উঠল তেমনই হয়ে গেল মোহিত।
ভদ্রলোক এই মোক্ষম জায়গায় এসে, হঠাৎ থেমে গিয়ে, নিজের গায়ের কোটটার দুদিকের পকেট দুটো দুবার চাপড়ে, মুখটায় কেমন যেন বিরক্তি ফুটিয়ে চুপ করে গেলেন।
কী হল কী তাঁর হঠাৎ ভেবে যখন আমরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছি শিশির তখন ব্যাপারটা ঠিক বুঝে ফেলে তার হাতের টিন থেকে একটা সিগারেট বাড়িয়ে দিয়ে বললে, সিগারেট খুঁজছেন? এই নিন না।
নেব? ভদ্রলোক যেভাবে শিশিরের দিকে চেয়ে যে-গলায় নেব বললেন, তাতে প্রথমে মনে হল বুঝি শিশিরের তাঁকে সিগারেট দিতে চাওয়াটা অপমান জ্ঞান করে তিনি আসর ছেড়ে চলেই যাবেন উঠে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মনে হল ভদ্রতার খাতিরেই শিশিরের স্পর্ধা সহ্য করে তিনি নরম হয়ে শিশিরের বাড়িয়ে দেওয়া টিনের উঁচিয়ে থাকা সিগারেটটা তুলে নিয়ে নিজের ওপরই বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন, হ্যাঁ, প্যাকেটটা কোথায় যে ফেলে এসেছি কে জানে! হ্যাঁ, একটা কথা কিন্তু বলে রাখছি, কিছু মনে করবেন না। সিগারেট আমি কারও কাছে দান নিই না। সুতরাং এ সিগারেট আপনার কাছে ধার হিসেবেই নিলাম। মনে রাখবেন, আপনার কাছে একটি সিগারেট ধার রইল।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই মনে রাখব, বলে শিশির তখন তাঁর সিগারেটটার জন্য তার লাইটারটা জ্বালিয়ে ধরেছে।
সে লাইটারের আগুনে সিগারেটটা ধরিয়ে তাতে দুটো রাম-টান দেবার পর প্রায় এক জালা ধোঁয়া ছেড়ে ভদ্রলোক বলেছেন, কী যেন বলছিলাম? হ্যাঁ, ওই টাইকুন ট্যানার-এর আতঙ্ক আর উল্লাসের কথা।
ঠিক! ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে টাইকুন ট্যানার তখন খুশিতে ডগমগ।
এই তো! টাইকুন ট্যানার-এর প্রাসাদের সিংহদরজার মান বাড়াবার জন্য এইটিরই দরকার ছিল। কম-বেশি প্রায় আশি কিলো ওজনের গজদন্ত নিয়ে কিছুদূরে স্বয়ং হাতিদের সম্রাট ঐরাবতই যেন তার সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে বনভ্রমণে বেরিয়েছে।
ট্যানার-এর হাতে বন্দুক ছিল না। আর থাকলেই বা সে করত কী? একবার তার দিকে ফিরে তাকে দেখতে পেলে গজরাজ কী করতে পারেন তাই ভেবে কাঁপতে কাঁপতে ট্যানার-এর গায়ে তখন যেমন ঘাম ছুটছে তেমনই আবার আশায় বুকও দুলছে যদি কোনওমতে হাতির পাল তার দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে চলে যায় আর যদি তারপর কোনওমতে তাঁবুতে ফিরে সে দরকার মতো সকলকে ডাক দিয়ে এই হাতির পালের পিছু নিয়ে কেনেথকে দিয়ে আসল গজরাজকেই শিকার করতে পারে।
ট্যানার-এর ভাগ্য তখন ভাল। হাতির পাল নিয়ে গজরাজ নিজের খেয়ালে অন্য দিকে চলে যেতেই সে নিজের তাঁবুতে এসে সবার আগে বব কেনেথ আর সমস্ত বন্দুক পিস্তলের খোদ খবরদারির ভার যার ওপর সেই বড় মিস্ত্রিকে ডেকে পাঠিয়ে সমস্ত ব্যাপারটা জানালে। ভাগ্যের জোরে আপনা থেকে যা তার হাতের মুঠোয় এসে গেছে তার দেখা গজরাজের সেই দাঁতাল মুণ্ডটা যে তার চাই-ই, সক্কলকে সেটা সে জোর দিয়ে জানিয়েছে।
কিন্তু কই! এত বড় একটা খবরে কারওর কোনও সাড়াশব্দ নেই কেন? তার সামনে দুই মূর্তি যেন জড়ভরত হয়ে দাঁড়িয়ে।
কী? কী হল কী তোমাদের? টাইকুন ট্যানার এবার গর্জে উঠল, সব কালা বাবা হয়ে গেছ নাকি?
মানে?—আমতা আমতা করে এবার মুখ খুলল বব কেনেথ-বড় শিকার আর আমরা কি করতে পারি? আমাদের
আমাদের? ধমক দিয়ে কেনেথকে থামিয়ে দিয়ে টাইকুন ট্যানার আবার গর্জন করে উঠল, কী হয়েছে আমাদের? হাত ঠুটো হয়ে গেছে, না বন্দুকের সব বারুদ ভিজে গেছে? শিকার করতে পারব না কেন?
পারব না। বন্দুকের বড় মিস্ত্রি বেশ ঠাণ্ডা গলায় বললে, আমাদের পারমিটে আর বড় শিকারের অনুমতি নেই বলে। হুকুমনামায় যে কটা বড় শিকার আমাদের মারবার অনুমতি দেওয়া ছিল সব ক-টাই আমরা মেরেছি। দু-একটা ছোট শিকারের বন্দুক ছাড়া সব বন্দুক আমি তাই বাক্সবন্দি করে দিয়েছি।
কী করেছ, চিমসে চামচিকে? বলে ঘাড় ধরে বন্দুকের মিস্ত্রিকে শূন্যে তুলে টাইকুন ট্যানার বললে, বড় বন্দুক সব বাক্সবন্দী করে দিয়েছ?
হ্যাঁ, ট্যানারের হাতে ঘাড়-টিপে-ধরা অবস্থাতেই বন্দুকের মিস্ত্রি যেন সুখবর দেবার মতো গলায় বললে, শুধু বাক্সবন্দীই করিনি, তার আগে বন্দুকগুলোর কলকজা খুলেও দিয়েছি।
কলকজা খুলে দিয়েছিস! চিড়বিড়িয়ে উঠে টাইকুন ট্যানার বন্দুকের মিস্ত্রিকে আছড়ে মারবার মতো করে দূরে ছুঁড়ে দিয়ে বললে, তোকে আমি জ্যান্ত মাটিতে পুঁতে মারব।
একটা ডিগবাজি খেয়ে বন্দুকের চিমসে মিস্ত্রি তখন কিছুদূরে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবুঝকে বোঝাবার মতো গলায় সে বললে, আমায় পুঁতে ফেলতে চান? তা অবশ্য আপনি পারেন। কিন্তু তাহলে আপনার ওই অত সাধের বন্দুকগুলোর মায়া যে ছাড়তে হবে। ওগুলোর কলকজা এখন খোলা। সেসব আবার জোড়া লাগাবার বিদ্যে অমন দু-পাঁচ হাজার মাইলের মধ্যে সারা উগাণ্ডায় আর কারওর নেই। আমি মাটির নীচে পোঁতা থাকলে ওসব বন্দুকের প্যাঁচ জানা মিস্ত্রির খোঁজে কাকে কোথায় পাঠাবেন? যাকে পাঠাবেন সে ঠিক ঠিকানায় পৌঁছবে কি! পৌঁছলেও কতদিনে সে ওস্তাদ মিস্ত্রি নিয়ে এখানে ফিরবে? আর যতদিনে ফিরবে ততদিন আপনি এখানে টিকে থাকতে পারবেন কি?
বন্দুকের মিস্ত্রি যতক্ষণ তার কথা শোনাচ্ছিল ততক্ষণ টাইকুন ট্যানার-এর মুখটা ছিল যেন বজ্রবিদ্যুৎ ঝড়বৃষ্টির ছবি ফোটানো ছায়াছবির পর্দার মতো। এই মনে হচ্ছিল রাগে দাঁত কিড়মিড়িয়ে হিংস্র হায়নার মতো সে ঝাঁপিয়ে পড়বে বন্দুকের মিস্ত্রির ওপর আবার মিস্ত্রির কথা শুনতে শুনতে নিজের অবস্থাটা বুঝে সে দমকা ঝড় হঠাৎ থেমে যাওয়ার মতো সামলাবার চেষ্টা করছিল নিজেকে। শেষ পর্যন্ত তার প্যাঁচালো বুদ্ধিরই জয় হয়েছে।
বেয়াড়া গরম মেজাজের জন্য নিজেই যেন নিজের কান মলে ট্যানার এবার যা বলেছে তার মর্ম হল এই যে বন্দুকের মিস্ত্রির ওপর রাগারাগি করা তার অন্যায় হয়েছে। মিস্ত্রির সঙ্গে সে মিটমাটই চায়। মিস্ত্রি যদি তার সব বন্দুকের কলকজা ঠিক করে সেগুলো চালু করে দেয় তাহলে সে, যা তার পাওনা, তার ওপর মোটা বকশিশ দিয়ে তাকে ছুটি দিয়ে যাবে।
বন্দুকের মিস্ত্রি একটু ভেবে নিয়ে প্রস্তাবটায় রাজি হয়েছে। আর ঘণ্টাকানেক বাদে বাক্সবন্দী সব বন্দুক খুলে চালু করে দিয়ে তার পাওনা আর বকশিশ চেয়েছে।
বন্দুকগুলো সব হাতে পাওয়ার পর নিজমূর্তি ধরেছে ট্যানার। পাওনা আর বকশিশ চাও? সে যেন কৃতজ্ঞতায় গদগদ হয়ে বলেছে, দুই-ই পাবে এখনই।
পাওনাটা সে তখনই মিটিয়ে দিয়েছে, তার নিজের ক-জন দৈত্যাকার কাফ্রি সেপাই দিয়ে বন্দুকের মিস্ত্রিকে ধরে বেঁধে শিকার করা জানোয়ারদের ছাড়ানো চামড়া জমা করা একটা তাঁবুতে বন্দি করে ফেলে রেখে। আর ফেলে চলে যাবার সময় আশা দিয়ে গেছে যে বকশিশটা দিয়ে যাবে দাঁতাল গজরাজকে মেরে তার গজদন্ত নিয়ে এখানকার আস্তানা তুলে চলে যাবার সময়ে হাত-পা বাঁধা অবস্থাতেই এই জঙ্গলে ফেলে রেখে দিয়ে।
বন্দুকের মিস্ত্রিকে হাত পা বেঁধে বন্দি করে চলে যাবার পর টাইকুন ট্যানার নিজেই কিন্তু পড়েছে মহা মুশকিলে। হাতি মারবার চালু বন্দুক তো সে হাতে পেয়েছে, কিন্তু সে বন্দুক ছুঁড়বে কে? বন্দুক উদ্ধারের পর খোঁজ নিয়ে জানা গেছে যে শিকারি বব কেনেথকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। খোঁজাখুঁজির মধ্যে তার তাঁবুতে তার লেখা একটা চিরকুট পাওয়া গেছে। বব কেনেথ তাতে লিখে গেছে যে হুকুমনামায় যা লেখা আছে তা অগ্রাহ্য করে বাড়তি দাঁতালো হাতি তো নয়ই, অন্য কোনও কিছু শিকার করে সে সারা আফ্রিকায় অচ্ছুৎ শিকারি হিসেবে দাগী হয়ে নিজের সব রুজি-রোজগার আর ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে পারবে না। সেই জন্যই টাইকুন ট্যানার-এর জবরদস্তি এড়াতে নিজের ন্যায্য পাওনাগণ্ডা না নিয়েই তাকে পালাতে হচ্ছে।
পালাতে হচ্ছে, কিন্তু পালিয়ে যাবি কোথায়? কেনেথের লেখা চিরকুট পড়তে পড়তে রাগে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলেছে টাইকুন ট্যানার, আমার সমস্ত লোকলস্কর লাগিয়ে সারা উগাণ্ডা চষে তোকে খুঁজে বার করব-ই।
যে কথা সেই কাজ। ট্যানার গজরাজের সন্ধান ছেড়ে কেনেথকে খুঁজতেই তার সফরির সকলকে লাগিয়েছে তখুনি। এমন বেড়াজালে জঙ্গল ঘিরে তল্লাশি চালিয়েছে যাতে একটা খরগোশও না গলে পালাতে পারে।
কিন্তু এই বেড়াজালে ঘেরা তল্লাশির ভেতর দিয়ে শিকারি কেনেথ গলে এসেছে। এসেছে রাতের অন্ধকারে টাইকুন ট্যানার-এর সফরির তাঁবু মহল্লায়। সেখানে নিঃশব্দে বন্দুকের মিস্ত্রিকে বন্দি করা শিকারে মারা জানোয়ারদের চামড়া রাখা তাঁবুতে ঢুকে সে কিন্তু অবাক। হাতে একটা ছোরা নিয়ে সে যতটা নিঃশব্দে সম্ভব হামাগুড়ি দিয়ে তাঁবুতে ঢুকেছিল বড় মিস্ত্রির বাঁধন কেটে তাকে মুক্তি দেবার জন্য। কিন্তু হাত-পা-র বাঁধন কেটে সে মুক্তি দেবে কী, বড় মিস্ত্রি নিজেই আগে থাকতে বাঁধনটাধন খুলে সেখানে বসে আছে। কেনেথ খানিকটা হামাগুড়ি দিয়ে যাবার পর হঠাৎ চমকে উঠে শুনেছিল—কে তাকে ফিসফিস করে বলেছে, আর না, ছোরাটা খাপে খুঁজে এবার উঠে বোসো।
গলাটা যে বড় মিস্ত্রিরই তা বুঝে একেবারে হতভম্ব হয়ে উঠে বসে কেনেথ দেখেছিল, বন্দুকের মিস্ত্রি হাত-পা খোলা অবস্থায় তার সামনে বসে একটা চামড়ার টুকরোয় কী যেন করছে।
কেনেথকে উঠে বসতে দেখে সেকাজ থামিয়ে মিস্ত্রি বলেছে, পালিয়ে গিয়েও তুমি যে ফিরে এলে?
এলাম আপনারই বাঁধন কেটে আপনাকে মুক্ত করা যায় কি না চেষ্টা করে দেখতে। কিন্তু আপনি নিজেই যে বাঁধন খুলে বসে আছেন। কী করে খুললেন ওই জংলি কাফ্রি দৈত্যগুলোর অমন শক্ত বাঁধন?
কী করে খুললাম? বন্দুকের মিস্ত্রি একটু যেন হেসে বলেছে, সময় পেলে তোমায় শিখিয়ে দেব, কিন্তু এখন তুমি আর সময় নষ্ট কোরো না। এখুনি পালাও আর যাও উত্তর দিকে!
উত্তর দক্ষিণ কোনও দিকেই আর আমি যেতে চাই না, বেশ হতাশভাবে এবার বলেছে শিকারি কেনেথ, আমার হাতের এই ছোরাটা আর কোমরবন্ধের এই পিস্তলটা ছাড়া আমার কাছে আর কিছু নেই। এই নিয়ে গণ্ডা গণ্ডা যাদের কাছে রাইফেল আর বন্দুক আর কমপক্ষে ষাট-সত্তর জন জঙ্গল ঠেঙিয়ে খোঁজবার লোক-লস্কর তাদের বিরুদ্ধে আমি কী করব আর কোথায় পালাব? পালাতে হলে আপনি নিজে পালাননি কেন?
আমি? বন্দুকের মিস্ত্রি একটু যেন অবাক হয়ে বলেছেন, হ্যাঁ, আমি পালাইনি বটে, তবে এই কাজটা করতে এমন তন্ময় হয়ে গেছলাম যে সময়টা কত কেটেছে ঠিক খেয়াল করিনি।
এমন অবস্থাতেও সময়ের খেয়াল যার জন্যে করেননি সেটা কী এমন কাজ? শিকারি কেনেথ রীতিমতো অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন।
কাজটা কিছু নয়, এই চামড়ার টুকরোর ওপর একটা পেরেক দিয়ে আঁচড়কাটা একটা ছবি! বলে বড়মিস্ত্রি চামড়ার টুকরোটা কেনেথের হাতেই তুলে দিয়ে বলেছে, এটা তুমিই রাখখা। তোমার কাজে লাগবে।
আমি কাছে রাখব এই চামড়ার আঁচড়কাটা টুকরো? এটা আমার কাজে লাগবে? কী বলছেন কী আপনি! বন্দুকের মিস্ত্রির মাথাটা ঠিক আছে কি না সে বিষয়েই সন্দেহ ফুটে উঠেছে এবার কেনেথের কথায়।
যা বলছি আজগুবি শোনাচ্ছে, না? হেসে জিজ্ঞাসা করেছে বড় মিস্ত্রি, কিন্তু হাতে-হাতে ফল পেলেই বুঝবে আবোলতাবোল কিছু বলিনি। তোমার হার্তে যে চামড়ার টুকরোটা দিয়েছি তাতে আঁচড় কাটা কীসের ছবি তা জানো? জানবার কথাও নয়। ওটা আঁচড় কেটে যা দেখাবার চেষ্টা হয়েছে সেটা একটা জার-বোয়া। আফ্রিকার ঝানু শিকারি হলেও জার-বোয়া কাকে বলে হয়তো জানো না। জার-বোয়া হল একরকম মরু অঞ্চলের অদ্ভুত ইঁদুর। ইঁদুর না বলে খুদে ক্যাঙ্গারুও বলা চলে। সামনের পা দুটি ছোট ছোট আর পেছনেরগুলি ক্যাঙ্গারুর মতো লম্বা বলে শরীরের তুলনায় অনেকদূর পর্যন্ত লাফ দিতে পারে। তোমায় এখান থেকে পালিয়ে উত্তরদিকে যেতে বলেছি, এই উত্তরে চাড় থেকে শুরু করে সাহারার মরুভূমিতে এই খুদে ক্যাঙ্গারু জার-বোয়াদের পাওয়া যায়। এই জার-বোয়ার ছাপমারা তাবিজ-পরা আফ্রিকায় এক গুপ্তসমিতি আছে। তারা আফ্রিকাকে ইউরোপের সাদা চামড়ার লোকেদের দাসত্ব থেকে মুক্ত করবার জন্য গোপনে বিরাট আয়োজন করে যাচ্ছে। তারা তোমার হাতের ওই জার-বোয়ার আঁচড় কাটা চামড়ার টুকরোটা দেখলেই তোমায় নিরাপদে সাহারা পেরিয়ে মিশরের কায়রো পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিয়ে আসবে। এখন তুমি শুধু উত্তরমুখো গিয়ে উগাণ্ডাটা পার হয়ে যাও।
কিন্তু পার হবে কী করে? কেনেথ হতাশভাবে বলেছে, বললাম না, আমার কাছে শুধু একটা পিস্তল আর একটা ছোরা। পার হবার আগেই ওদের গণ্ডা গণ্ডা বন্দুকে আমি তো ঝাঁজরা হয়ে যাব।
কিছু হবে না! বন্দুকের মিস্ত্রি জোর দিয়ে বলেছে, প্রথমত তুমি আফ্রিকার শিকারি, জঙ্গলে কি করে নিঃসাড়ে গাছপালার সঙ্গে মিশে গিয়ে চলাফেরা করতে হয় তা তুমি ওদের সাতজন্ম শেখাতে পারো। সুতরাং ওরা এমনিতে তোমার হদিসই পাবে না। আর যদি বা পায়, ওদের কোনও বন্দুকের গুলি তোমার ডাইনে বাঁয়ে দু-গজের মধ্যে পৌঁছবে না।
দু-গজের মধ্যে পৌঁছবে না? ঘোর অবিশ্বাসের সঙ্গে বলেছে কেনেথ, এ কী ঝাড়ফুঁক মন্ত্র নাকি?
না, মন্ত্র নয়, যন্ত্রযন্ত্রের কেরামতি, বলেছে বড় মিস্ত্রি, তুমি তাতে বিশ্বাস করে নির্ভয়ে চলে যাও। আর দেরি না করাই ভাল!
কিন্তু আপনি! যেতে গিয়ে ফিরে দাঁড়িয়ে সত্যিকার উদ্বেগের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করেছে কেনেথ, আপনি যাবেন না আমার সঙ্গে?
না,বলে একটু থেমে বন্দুকের মিস্ত্রি কিছুটা কৌতুকের স্বরেই বলেছে, সত্যিকথা বলতে গেলে আমার এখন পোয়াবারো যাকে বলে তাই। যাকে সে হাত-পা বেঁধে কাঁচা চামড়ার গুদামের তাঁবুতে বন্দি করে ফেলে দিয়েছিল সকাল না হতেই টাইকুন ট্যানার তার কাছে ছুটে এল বলে! তারপর আমার আঙুল নাড়ায় টাইকুন ট্যানারকে ওঠবোস করাতে পারব। সোজা কথা নয়, দুনিয়ার সেরা সফরির সর্দার, তার গণ্ডা গণ্ডা সব বন্দুকে নিশানার চারধারে দু-গজের মধ্যে গুলি পৌঁছোচ্ছে না কেন, এ ধাঁধার উত্তরের জন্য তাকে বাঁদরনাচ করাতে করাতে আমি একদিন তাকে রাজধানী কাম্পালাতে বনবিভাগের বড়কর্তাদের হাতেই তুলে দেব। সুতরাং আমার জন্য তোমার ভাবনা করবার কিছু নেই। আর হ্যাঁ, তুমি নিজের প্রাণের মায়া ছেড়ে দিয়ে আমাকে বাঁচাবার জন্য যে এখানে এমন করে এসেছ, এ ঋণ আমি কোনওদিন ভুলব না। কখনও কোথাও যদি দারুণ বিপদে পড় তাহলে, তোমার হাতে যা দিয়েছি, ওই জার-বোয়ার ছাপ দেওয়া একটা বিজ্ঞাপন বিলেতের লন্ডন টাইমসে ছাপাবার ব্যবস্থা কোরো। আমি যেখানেই থাকি সে বিজ্ঞাপনে সাড়া দিয়ে তোমায় আমার তখনকার ঠিকানা জানাবই। তারপর তুমি আমার ঠিকানায় চিঠি লিখে তোমার বিপদ আর ঠিকানা জানালেই—আমি বেঁচে থাকলে—তোমার পাশে গিয়ে দাঁড়াবই, এটা নিশ্চিত জেনো।
ক্যাম্বিস ব্যাগের ভদ্রলোক দম নেবার জন্যই একটু থেমে বললেন, ক-দিনের জন্য আপনাদের এই শহরটা ছুঁয়ে যাবার সময়ই লন্ডন টাইমসের বিজ্ঞাপনটা দেখে হাতের কাছে পেয়ে আপনাদের এই বাহাত্তর নম্বরের ঠিকানাটাই জানিয়ে লিখে পাঠিয়ে দিয়েছি বলে একটা উত্তর না আসা পর্যন্ত আর নড়তে পারছি না। আপনাদের তাই বাধ্য হয়ে একটু কষ্ট দিচ্ছি।
না, না, কষ্ট কীসের? আমরা প্রায় সমস্বরে বলেছি, যতদিন লন্ডন টাইমসের বিজ্ঞাপনের ব্যাপারে কোনও চিঠি না পান ততদিন আপনি থাকুননা এখানে—ওই ওপরের টঙের ঘরটা পছন্দ হলে সেখানেই থাকুন। কিন্তু একটা কথা শুধু জিজ্ঞাসা করছি, টাইকুন ট্যানার আপনাকে বন্দুকের পাকা মিস্ত্রি বলে তার সফরিতে নিয়েছে আবার শিকারি কেনেথকে আপনি যেভাবে জার-বোয়া ছাপের তাবিজ-পরা আফ্রিকার গুপ্ত বিপ্লবীদলের খবর দিয়ে ভরসা দিয়েছেন তাতে মনে হয় ওই জার-বোয়া ছাপের গুপ্ত দলের সঙ্গেও আপনার ভালরকম যোগাযোগ ছিল। এখন আবার আপনাকে দেখছি এই আমাদের কলকাতা শহরে। আসল পরিচয়টা তাহলে আপনার কী?
হ্যাঁ, কেনেথও ওই কথা জিজ্ঞাসা করেছিল আমাকে চামড়ার জার-বোয়া ছাপ নিয়ে তাঁবু থেকে জঙ্গলের পথে চলে যাবার সময়। তাকে যা বলেছিলাম, তাই আপনাদের বলি—নিজের পরিচয় কি কেউ আমরা জানি! সেই পরিচয়ই তো সবাই খুঁজছি সারা জীবন।
আমাদের হতভম্ব করে ওইটুকু বলেই টেবিল থেকে ক্যাম্বিসের ব্যাগটা নিয়ে তিনি তেতলার ন্যাড়া ছাদের সিঁড়ির দিকে চলে গিয়েছিলেন।
ক্যাম্বিসের ব্যাগটা না থাক, ভদ্রলোক এখনও আমাদের টঙের ঘরেই আছেন। না থেকে উপায় কী? লন্ডন টাইমসের জার-বোয়া ছাপ-মারা বিজ্ঞাপনদাতার উদ্দেশে লেখা তাঁর চিঠির জবাব যে এখনও আসেনি।