আমার বয়স তখন মাত্র দশ বছর। আমার বাবা আমার সৎ মায়ের কথা শুনে বয়স্ক এক লোকের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করে।লোকটার বয়স প্রায় পঞ্চাশ বছরের মতো হবে, আমার সাথে ওই লোকের বিয়ে দিলে ওই লোকটা নাকি বাবাকে অনেক টাকা দিবে, যা দিয়ে বাবা নাকি সারাজীবন বসে বসে খেতে পারবে। আমাকে সেদিন বাবা এসে বললো,
শুন্ রেখা এটা তোর জন্য একটা বড় সুযোগ, তুই তো মেয়ে, তোকে খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করে তো আমাদের কোন লাভ নেই। কারন তুই তো আর বড় হয়ে রোজগার করে আমাদের খাওয়াতে পারবি না, তো এখন যদি তুই ওই ছেলেকে বিয়ে করিস, তাহলে আমরাও হয়তো কিছু পেলাম আর তুই ও ভালো থাকলি। আমি বললাম,
– কিন্তু বাবা ওই লোকের তো বয়স অনেক বেশি।এমনকি তোমার চাইতেও উনার বয়স বেশি। আমি এ বিয়ে করতে পারবো না বাবা। আমি লেখাপড়া করতে চাই বাবা,আমি বিয়ে করতে চাই না বাবা। আমার সৎ মা তখন বললো,
– মেয়ের কথা শুনলেই গা পিত্তি জ্বলে যায়, এত ভালো একটা সম্মন্ধ যদি তুই হাতছাড়া করিস, তাহলে জেনে রাখ, এই বাড়িতে তোর আর জায়গা হবে না। এই বাড়ি ছেড়েই চলে যাবি,আর যদি না যাস, ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবো,বলে রাখলাম। মায়ের কথা শুনে খুব খারাপ লাগলো, কান্না করে দিলাম।কি করে মা বাবার সামনেই এরকম কথা বলতে পারলো, কিন্তু বাবা মাকে কোন কিছুই বললোনা। কারণ বাবা তো আমার সৎ মায়ের হাতের পুতুল হয়ে গেছে, মায়ের সাথে তাল মিলিয়ে উনিও বললেন,
– তোর মা যেটা বলছে, সেটা ভালো করে মাথায় ঢুকিয়ে নে।কান্নাকাটি করে কোন লাভ হবে না।
আমার বাবা আমাকে এরকম কথা কেমন করে বলছে?? মা না হয় আমার নিজের মা না, কিন্তু বাবা , উনি তো আমার নিজের বাবা। তাহলে এসব কথা বলতে তার একটুও কি বাধছেনা।
লোকে বলে মা মারা গেলে বাপ নাকি খালু হয়ে যায়। আসলেই তারা একদম ঠিক কথা বলতো। যেটা আমি হাড়ে-হাড়ে টের পাচ্ছি। এখন মনে হচ্ছে মা তুমি আমাকে ছেড়ে কেন চলে গেলে মা, আমি যে এদের সাথে লড়াই করতে পারছিনা মা, যদি তুমি থাকতে তাহলে হয়তো তুমি এটা হতে দিতে না। আমার যে খুব কষ্ট হচ্ছে মা, তুমি কি দেখতে পাচ্ছো না মা। ওরা আমার বিয়ের সব আয়োজন করেছে, একটু পর ই আমার বিয়ে, কি করবো ভেবে পাচ্ছি না।
আমার চাচাতো বোন এসে আমাকে বললো তুই যে করেই হোক এখান থেকে পালা, নাহলে ওরা তোকে যে করেই হোক বিয়ে দিয়েই ছাড়বে। আমি ওর কথা শুনে, জানালা দিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলাম। জানিনা কোথায় যাচ্ছি, কার কাছে যাচ্ছি, শুধু জানি পালাতে হবে। এখন থেকে অনেক দূরে। এরপর এক বাড়িতে কাজের লোক হিসাবে কাজ শুরু করলাম। কিন্তু একদিন এক ভদ্রমহিলা আমাকে দেখে বাড়ির মালিক কে জিজ্ঞেস করল এটা কে। তখন উনি বললেন, নতুন কাজের লোক। ওই মহিলা ওই বাড়ির মালিক কে খুব বকলো, ছোট মেয়েকে দিয়ে বাড়ির কাজ করানোর জন্য।
এরপর উনি আমাকে উনার বাসায় নিয়ে গেলেন। উনার বাড়িতে উনি একাই থাকতেন। তাই উনি বললেন তুমি চাইলে আজ থেকে তুমি এই বাড়িতে থাকতে পারো। আমার কোন সন্তান নেই, তাই আমার স্বামী আমাকে ডিভোর্স দিয়েছে। তুমি তো আমার মেয়ের মতো। তোমার ও কেউ নেই তাই আমি তোমাকে দত্তক নিতে চাই। জানো আমার মা ডাক শোনার খুব ইচ্ছা। তুমি কি আমাকে মা বলে ডাকতে পারবে?? মহিলার কথা শুনে আমার খুব কান্না আসলো, পৃথিবীতে আসলেই সব ভালো মানুষের কিছু না কিছু কষ্ট থাকেই।আমি কাঁদতে কাঁদতে উনাকে মা বলে ডাকলাম। উনি আমার মুখে মা ডাক শুনে , আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন।আর বললেন আজ থেকে আমি ই তোর মা।
আমি লেখাপড়া কমপ্লিট করে একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ হয়েছি। মা আমাকে ডাক্তার বানাতে পেরে এখন অনেক খুশি। এভাবেই অনেক ভালো দিন কাটছিলো আমার, হঠাৎ একদিন বাসায় যাওয়ার সময় দেখলাম আমার সৎ মা ভিক্ষা করছে, উনি বলছেন, উনার স্বামী নাকি কঠিন রোগে আক্রান্ত। চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা লাগবে।
কথা টা শুনে নিজের অজান্তেই চোখে র কোনে পানি চলে আসলো।আমি উনার সাথে হাসপাতালে গিয়ে সব টাকা দিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করলাম।
এক সপ্তাহ পর আবার তাদের দেখতে গেলাম, মাকে সাথে নিয়ে। আমার বাবা তখন ও আমাকে চিনতে পারেনি।
উনি আমার মাথায় হাত রেখে বলল, অনেক সুখী হও মা। তোমার মতো সন্তান কে যে গর্ভে ধারণ করেছে, আর যে বাবা তোমাকে মানুষ করেছে, তাদের জীবন টা আসলেই ধন্য। আজ আমার মেয়েটা বেঁচে থাকলে ঠিক তোমার মতোই হতো। বলে উনি কেঁদে উঠলেন আর বললেন মেয়ের উপর অন্যায় করেছি দেখেই হয়তো আল্লাহ আমাদের এতো শাস্তি দিচ্ছে, বাড়িঘর হারিয়ে আজ আমরা পথের ফকির।
আমি উনাদের একটা ফ্ল্যাট কিনে থাকার ব্যবস্থা করে দিলাম,এখন তাদের যাবতীয় খরচ আমিই বহন করি।.কিন্তু তারা এখনও জানে না যে আমিই তাদের সন্তান।আর আমি জানাতেও চাই না, কারন আমি তাদের সন্তান হতে চাইনা, আমি শুধু আমার মায়ের সন্তান হতে চাই। তাই আমি থাকি আমার মায়ের সাথে।মাঝে মাঝে মনে হয়, রক্তের সম্পর্কের চেয়েও ভালোবাসা, মায়ার সম্পর্ক টা অনেক দামি।