মাছ
ঘনাদা একেবারে ব্যাঘ্রঝম্প দিয়ে থালার উপর দু বাহু মেলে ধরে হাঁ-হাঁ করে উঠলেন। রামভুজ নেহাত আমাদের মেসের অনেক পুরোনো ঠাকুর, তাই, নইলে আর কেউ হলে বোধ হয় গামলা-টামলা সুদ্ধ উল্টে পড়ে খাবার ঘরে একটা কেলেঙ্কারি বাধিয়ে ফেলত।
রামভুজ ঘনাদাকে চেনে। তাই শুধু এক পা পিছিয়ে গিয়ে, বাঁ-হাতের বাটি বসানো থালাটা চিনে ভেলকিবাজের মতো অদ্ভুত কায়দায় সামলে নিয়ে বললে, কী হোইলো বাবু, মাছের ঝোল খাইবেন না! ভাল মাগুর মাছের ঝোল।
মাগুর মাছের ঝোল খাব আমি? ঘনাদার কথায় মনে হল, হিন্দু ধর্মের সবচেয়ে নিষিদ্ধ খাদ্য যেন তাঁকে জোর করে খাওয়াবার চেষ্টা করা হচ্ছে।
আসল ব্যাপারটা যে কী তা আমরা অবশ্যই সবাই জানি-ঘনাদা নিজের ফাঁদে নিজেই ধরা পড়ে, বেরুবার জন্য এখন ছটফট করছেন।
ছুটির দিন, আর তার ওপর গৌরের পাশের খবর বার হবার দরুন সকালবেলা সবাই মিলে বসে একটা খাওয়া-দাওয়ার আয়োজনের ব্যবস্থা করছিলাম। এমন সময়ে শিশিরের কাছে একটা সিগারেট ধার করতে—এ পর্যন্ত মাত্র ২৩৫৭টা তিনি ধার নিয়েছেন—ঘনাদা ঘরে ঢুকেছেন। যথারীতি সিগারেটটা ধরিয়ে চলে যাবার মুখে আমাদের ভাবগতিক দেখে বোধহয় সন্দিহান হয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন, ব্যাপার কী হে! সকালেবেলা এত জরুরি মিটিং কীসের?
এই একটু ফিস্টের ব্যবস্থা করছি আজ। আপনি
ফিস্ট! ঘনাদা শিবুকে কথাটা আর শেষ করতে দেননি। ফিস্ট শুনলেই তাঁর ভয় হয়, পাছে কেউ তাঁর কাছে চাঁদা চেয়ে বসে! তাই অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলেছেন, তোমাদের নিত্যি ওই এক হুজুগ। আমার বাপু পেটটা আজ তেমন ভাল নেই।
যেন অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে গৌর বলেছে, আচ্ছা, আপনার জন্য তা হলে আলাদা ব্যবস্থাই করব।
হ্যাঁ, তাই কোরো! বলে ঘনাদা বেরিয়ে গেছেন।
সেই আলাদা ব্যবস্থার দরুন মাংসের কালিয়ার বদলে তাঁকে সত্যিই মাগুর মাছের ঝোল পরিবেশন করা হবে, ঘনাদা তখন ভাবতেই পারেননি! আপত্তিটা তাই তাঁর এত তীব্র। সব বুঝেসুঝেও শিবু কিন্তু ন্যাকা সেজে জিজ্ঞাসা করলে, আপনিই না সকালে বললেন, পেটটা তেমন ভাল নেই, তাই তো আপনার জন্যে আলাদা করে—
শিবুকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে ঘনাদা যেন আর্তনিনাদ করে উঠলেন, তাই বলে–মাগুর মাছ?
গৌর যেন অত্যন্ত সংকুচিত ভাবে জানালে, কেন, মাগুর মাছ তো রুগির পথ্যি, হালকা বলেই জানি।
জানো যদি তো তোমরাই খাও না! আমার অত উপকার না-ই করলে। খেঁকিয়ে উঠলেন ঘনাদা।
এবার আমাকেই কথা বলতে হল। বেশ একটু কাঁচুমাচু মুখ করে বললাম, তা হলে তো বড় মুশকিল হল ঘনাদা, আমাদের জন্য যে আবার মাংসের কালিয়া রান্না হয়েছে—তা-ও আবার চর্বিওয়ালা খাসির মাংস—সে তো আপনার চলবে না!
ঘনাদা যেন অত্যন্ত অনিচ্ছাসহকারে বললেন, যেমন করে হোক তা-ই চালাতে হবে। অন্য যে-কোনও মাছ হলেও হত, কিন্তু মাগুর মাছ প্রাণ থাকতে তো মুখে তুলতে পারব না।
মাগুর মাছে এত আপত্তি কেন বলুন তো? অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলে গৌর। ঘনাদার পাতের ধারে রামভুজ তখন মাংসের কালিয়ার বাটি ধরে দিয়েছে। পর পর সে রকম দুটি বাটি শেষ না করা পর্যন্ত ঘনাদা মুখ তুলে তাকাবার পর্যন্ত ফুরসত পেলেন না।
মাংসের পর চাটনি এবং তারপর দই ও সন্দেশ পর্যন্ত ঘনাদা যেন এক নিশ্বাসে চোখ কান বুজে চালিয়ে গেলেন। সন্দেশের পর পাস্তোয়ায় এসে তাঁর গতি একটু মন্থর হতে দেখে ভরসা পেয়ে বললাম, পেটটা আপনার সত্যিই আজ খারাপ ছিল দেখছি, ঘনাদা।
আমার কথার খোঁচা যদি কিছু থাকে তা ঘনাদাকে স্পর্শই করল না। Acute angle-এ তিনি খাওয়া শুরু করেছিলেন, এখন Obtuse angle-এ পৌছে তাঁর শরীর মন মেজাজ শরতের আকাশের মতো প্রসন্ন হয়ে গেছে।
মধুর ভাবে একটু হেসে বললেন, সেইজন্যই বুঝি মাগুর মাছের ব্যবস্থা করেছিলি? ভাল-ভাল! তা, তোদের আর দোষ কী বল, মাগুর মাছ যে কেন খাই না, তোরা কী করে বুঝবি?।
একটু বুঝিয়েই দিন না! সকাতর অনুনয় করলে গৌর।
ঘনাদা উদারভাবে আশ্বাস দিলেন, আচ্ছা দেব, দেব, এই–
প্রকাণ্ড পাস্তোয়াটায় কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে যাওয়ার দরুন তাঁর শেষ কথা আর শোনা গেল না।
খাওয়া-দাওয়ার পর বসবার ঘরে তাঁর মৌরসিপাট্টাওয়ালা আরামকেদারাটি দখল করে শিশিরের একটা সিগারেট—২৩৫৮টা হল—ধার নিয়ে আরাম করে ধরিয়ে ঘনাদা শুরু করলেন, ১৯২৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর যে-চন্দ্রগ্রহণ হয়, তার কথা তোমাদের না-জানাই স্বাভাবিক, কারণ সে-চন্দ্রগ্রহণ বাংলাদেশে দূরে থাক, ভারতবর্ষ থেকেও দেখা যায়নি। তবে ড. আলফ্রেড হিল যে কারণে ১৯৩০-এ এফ, আর. জি. এস, অর্থাৎ ফেলো অব দ্য রয়্যাল জিওগ্রাফিকাল সোসাইটি রূপে মনোনীত হয়ে সম্মানলাভ করেন…কিভু এবং এডওয়ার্ড হ্রদের মধ্যে নতুন একটি নদী জন্মাবার কিছু বিবরণ তোমরাও হয়তো শুনে থাকবে।
ভূগোলের জ্ঞান আমাদের সকলেরই সমান। ওরই মধ্যে শিবু যা একটু-আধটু চর্চা করে। ঘনাদা ওই পর্যন্ত বলে চুপ করবার পর সে জিজ্ঞাসা করলে, কিভু আর এডওয়ার্ড হ্রদ কোথায় বলুন তো? আফ্রিকায় না?
হ্যাঁ। আফ্রিকায় বেলজিয়ান কঙ্গোর একেবারে পুবে—বিষুবরেখার কিছু দক্ষিণে।
আমরা কেউই সেখানে নতুন নদী জন্মাবার কথা শুনিনি জেনে, ঘনাদা দ্বিগুণ উৎসাহভরে আবার আরম্ভ করলেন, জার্মানির এক নামজাদা সার্কাস কোম্পানি আর স্পেনের এক চিড়িয়াখানার বায়না নিয়ে আফ্রিকার জঙ্গলে জঙ্গলে তখন নানা জাতের অদ্ভুত দুষ্প্রাপ্য প্রাণী ধরে বেড়াচ্ছি। চিড়িয়াখানার ফরমাশ মতো প্রায় সবকিছুই তখন ধরা হয়ে গেছে। জিরাফ আর জেব্রার মাঝামাঝি অদ্ভুত প্রাণী ওকাপি, কঙ্গোর লাল বামন মোষ, বাঘা বেড়াল, চিতা, হায়না, এ সব তো আমার সঙ্গে আছেই, তা ছাড়া নানা জাতের পাখি, মাছ, সাপও জোগাড় করেছি। সার্কাস কোম্পানির ফরমাশটাই তখন হাসিল করতে বাকি। সেটা বেশ একটু শক্ত। তাদের জন্য একটা বাচ্চা গোরিলা ধরে নিয়ে যেতে হবে। গোরিলা ধরা বড় সোজা কথা নয়। তার ওপর এমন দুর্ভেদ্য জঙ্গলে ও পাহাড়ে তারা লুকিয়ে থাকে যে, তাদের সন্ধান পাওয়াই মুশকিল। কঙ্গো ও ক্যামেরুনস-এর নিবিড় জঙ্গলে প্রথমে বনমানুষদের মধ্যে সবচেয়ে বিশাল এই প্রাণীটি আবিষ্কৃত হয়। তারপরে কঙ্গোর পুবে কিভু হ্রদের কাছাকাছি পাহাড়ের প্রায় দশ হাজার ফুট উঁচু জঙ্গলে, আর এক আরও বড় জাতের গোরিলার সন্ধান পাওয়া যায়। আপাতত সেই গোরিলার আস্তানার দিকেই যাচ্ছিলাম। আফ্রিকার—বিশেষ করে কঙ্গোর জঙ্গলে চলাফেরা যে কী ব্যাপার, ভুক্তভোগী না হলে কল্পনাই করতে পারবে না। এ সব জঙ্গল এমন দুর্ভেদ্য যে প্রতি পদে কুড়ুল কাস্তে দিয়ে পথ পরিষ্কার না করলে এক পা-ও এগুনো যায় না। দেড়শো থেকে দুশো ফুট উঁচু বড় বড় গাছ লতায়-পাতায় আকাশ এমন ঢেকে রেখেছে যে দিনের বেলাতেও সেখানে সূর্যের আলো অতিকষ্টে চুইয়ে আসে। সেই ঘন গাছের জটলার তলায় আগাছার জঙ্গলই ১৫ ফুট উঁচু। তারই ভিতর আবার অর্চিলা ও লতানে রবার গাছের দুর্ভেদ্য জট।
যে জায়গাটায় সেদিন বিশ্রাম করবার জন্যে তাঁবু ফেলেছিলাম, সেখানে এই জঙ্গল অনেকটা হালকা হয়ে সাভানা অর্থাৎ ঘাসের প্রান্তর শুরু হয়েছে। এই ঘাসও অবশ্য যেমন-তেমন নয়। ছ-ফুট উঁচু একটা জোয়ান মানুষ তার ভেতর অনায়াসে ড়ুবে যায়। একটা প্রকাণ্ড বাওবাব গাছের তলায় বেশ খানিকটা জায়গা পরিষ্কার করে আমাদের আস্তানা পাতা হয়েছিল। আফ্রিকার জঙ্গলে শিকারে বেরুনোকে বলে সফরি। আমাদের সফরিতে লোকজন তো বড় কম নয়! আসবাবপত্র, রসদ ও জন্তু-জানোয়ারের খাঁচা বাক্স ইত্যাদি বইবার জন্যেই একশো-জন কাফির জাতের মুটে আছে, তার ওপর আছে পাঁচজন মাসাই জাতের শিকারি।
এ অঞ্চলে সিংহের উপদ্রব খুব বেশি বলে আস্তানার চারদিকে চারটে আগুন জ্বালাবার ব্যবস্থা করে ও পালা করে দুজন শিকারিকে পাহারায় রেখে সবে তখন নিজের তাঁবুতে এসে শোবার বন্দোবস্ত করছি।
আমার তাঁবুতে দু-চারটে দামি পাখির খাঁচা ও মাছ-গিরগিটি ধরনের দুষ্প্রাপ্য প্রাণীর কাঁচের জারগুলো সাধারণত থাকে। একটা মাছের জার কী করে ভেঙে ফুটো হয়ে সমস্ত জলটা দেখলাম মাটিতে গড়িয়ে পড়েছে। মাছটা কাঁচের জারের তলায় খাবি খাচ্ছে দেখে সেটাকে অন্য একটা জারে তুলে রেখে জল ঢালছি, এমন সময়ে জুগন এসে ঘরে ঢুকল।
জুগন আমার সবচেয়ে বিশ্বাসী অনুচর ও সমস্ত কাফির-কুলি ও মাসাই-শিকারিদের সর্দার। যেমন দৈত্যের মতো তার চেহারা, সাহসও তেমনই অসীম। খাটো একটা বল্লম হাতে মানুষখেকো সিংহের সামনে সে নির্ভয়ে এগিয়ে যেতে পারে। চোখে দেখা যায়—এমন কোনও প্রাণীকে সে গ্রাহ্যই করে না। কিন্তু তার সব সাহস শুধু দিনের বেলায়। রাত হয়েছে কি—একটা পাতা নড়লেও ভূত প্রেত জুজুর ভয়ে সে আঁতকে ওঠে। যাদের ধরা-ছোঁয়া-দেখা যায় না সেই অশরীরী জীবেরা সেই সময়েই তার মতো শিকারিদের ঘাড় মটকাবার জন্যে ওত পেতে থাকে বলে তার ধারণা।
জুগনের মুখ-চোখের ভাব দেখেই বুঝলাম, রীতিমতো ভয় পেয়েই সে এতরাত্রে আমার তাঁবুতে ঢুকেছে।
আবার কোন জুজু কোথায় দেখেছে বলে তাকে ঠাট্টা করতে যাচ্ছি, এমন সময় নিজেই একটা অদ্ভুত শব্দ শুনতে পেয়ে চমকে গেলাম।
ভাঁটার মতো চোখগুলো বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে সভয়ে জুগন বললে, শুনতে পাচ্ছেন, বোয়ানা?
শুনতে তখন ভালরকমই পেয়েছি। না, সিংহ কি খ্যাপা হাতির ডাক নয়। অন্ধকার রাত্রির কোনও সুদূর প্রান্ত থেকে সমস্ত আকাশের বুক কাঁপিয়ে অস্ফুট একটা ভয়ের স্পন্দন যেন উঠছে—গুম গুম গুম।
একদিকে সে শব্দ শেষ না-হতে আরেক দিকে সে শব্দের অবিকল প্রতিধ্বনি শুরু হয়ে গেল। সে প্রতিধ্বনি তারপরেই অন্য আর এক দিক-প্রান্ত ধরে নিতে দেরি কবলে না। এমনই সে শব্দ যে, অন্ধকার আকাশের এককোণ থেকে আর-এককোণে কোনও অদৃশ্য বিরাট দৈত্য যেন লোফালুফি করছে মনে হল।
ভাল করে খানিকক্ষণ শুনে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কিছু বুঝলে, জুগন?
জুগন সভয়ে বললে, হ্যাঁ, বোয়ানা। বলছে, দেবতার দুশমন, শয়তানকে চাই। কোনও পাহাড়-জঙ্গল তাকে লুকিয়ে রাখতে পারবে না। তেলের কড়া তৈরি।
বললাম, ঠিকই বুঝেছ, তবে আর-একটু মন দিয়ে শোনো! বুঝবে, শুধু শয়তান নয় বলছে, সাদা শয়তানকে চাই।
আর একবার কান পেতে জুগন আমার কথায় সায় দিয়ে বললে, সাদা শয়তানই বলছে বটে, বোয়ানা। কিন্তু কার কথা বলছে বুঝতে পারছি না। আমাদের নয় তো?
এবার হেসে বললাম, তোমাদের কথা তো বাদই দিলাম। কাফ্রিদের মধ্যেও আমাকে সাদা শয়তানকানা না হলে কেউ বলবে না। সুতরাং আক্রোশটা যার ওপরই হোক, আমরা নির্ভয়ে থাকতে পারি।
ইতিমধ্যে ওই শব্দের অল্পবিস্তর মানে বুঝে আমায় কাফির কুলি ও মাসাই শিকারিদের অনেকে সভয়ে আমার তাঁবুর সামনে এসে জড়ো হয়েছিল। তাদেরও ওই কথাই বলে রাত্রের মতো বিদায় করলাম।
মুখে ওদের অভয় দিলাম বটে, কিন্তু সারারাত দুর্ভানায় ভাল করে ঘুমোতে পারলাম না। আফ্রিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় যাদের আছে, এ-শব্দের অসামান্য ক্ষমতা ও ভয়ংকর মর্ম তারা ভাল করেই জানে। এশব্দ আফ্রিকার অত্যাশ্চর্য নিজস্ব জিনিস। আসলে বিশেষ এক ধরনের বিরাট ঢাকের শব্দ ছাড়া এ-আর কিছু নয়। কিন্তু যে-দেশের দুর্ভেদ্য জঙ্গলে, দশ মাইল দূরের গাঁয়ের লোকেরা পরস্পরের ধারে কাছে ঘেঁষে না ও পরস্পরের ভাষা বোঝে না, সেই দেশে এই ঢাকের শব্দের মারফত টেলিগ্রাফের মতো তাড়াতাড়ি শতশত মাইল দূর-দূরান্তরে খবর পাঠিয়ে দেওয়া যায়। এ-ঢাকের শব্দের নিজস্ব একটা ভাষা আছে। সম্পূর্ণ ভিন্ন জাতের এবং ভিন্ন ভাষার লোকেরা এই ঢাকের ভাষা অনায়াসে বুঝতে পারে। এ-ঢাকের শব্দ বিলি করবার ব্যবস্থাও অদ্ভুত। এক গাঁ থেকে ঢাকের শব্দ শোনামাত্র অন্য গাঁ তৎক্ষণাৎ সে-খবর ঢাকের আওয়াজে প্রচার করে দেয়। এমনই করে দেখতে দেখতে বহুদূরে সে খবর ছড়িয়ে যায়। কারুর বিরুদ্ধে এ-ঢাক যদি একবার বেজে ওঠে, তা হলে যতদূরে পালাক, এ-ঢাকের নাগাল থেকে পরিত্রাণ পাবার আশা নেই।
বহুদিন আফ্রিকার বহু জায়গায় ঘোরার দরুন এ-ঢাকের ভাষা আমি ভাল করেই বুঝি! আপাতত ঢাকের খবর যা শুনলাম, তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কিছু নেই বলেই মনে হল। তবু অস্বস্তিটা একবারে গেল না।
পরের দিন সকালে তাঁবু তুলে আমরা সাভানা পেরিয়ে পাহাড়ের দিকে রওনা হলাম। এই পাহাড়ের প্রায় হাজার দশেক ফুট উঁচুতে পৌছোলে গোরিলার রাজ্যের সন্ধান পাওয়া যাবে বলে আমার বিশ্বাস। পাহাড় যেমন খাড়াই, তেমনই গভীর জঙ্গলে ঢাকা। যত ওপরেই উঠি, ঢাকের শব্দ কিন্তু আমাদের সঙ্গ ছাড়ে না। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত সে-শব্দ আমাদের পিছুতে লেগেই রইল।
চারদিনের দিন কিভু হ্রদের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছোলাম। আশপাশের ঘন কাঁটা-ঝোঁপে ভর্তি দুর্ভেদ্য জঙ্গলের চেহারা দেখে মনে হল, গোরিলাদের আস্তানা খুব দূরে নেই। সুবিধে মতো একটা জায়গা দেখে সন্ধের আগেই তাঁবু ফেলে একটু একটু এদিক-ওদিক জঙ্গলটার অবস্থা বুঝতে বেরুলাম। গোরিলা শিকার করা দস্তুরমতো কঠিন ব্যাপার, কিন্তু জ্যান্ত গোরিলা ধরা তার চেয়েও অনেক শক্ত। বড় ধাড়ি গোরিলাকে জ্যান্ত ধরা তো অসম্ভব বললেই হয়। এমনিতে তারা মানুষ দেখলে গা ঢাকা দিয়ে এড়িয়েই যায়, নিজে থেকে কখনও আক্রমণ করে না। কিন্তু একবার ঘাঁটালে আর রক্ষে নেই। তখন তাদের মতো হিংস্র ভয়ংকর প্রাণী পৃথিবীতে আর দেখা যায় না। একেবারে অব্যর্থভাবে গুলি না মারতে পারলে তাদের রোখা তখন অসম্ভব। শিকারির নাগাল একবার পেলে, ঢাকের মতো নিজের বুক চাপড়াতে চাপড়াতে এসে তাকে পাঁকাটির মতো মটকে ভেঙে দিতে পারে।
ধাড়ি গোরিলা ধরার আশা তাই কেউ করে না। ধরতে হলে বাচ্চা গোরিলাই ধরবার চেষ্টা করতে হয়। বাচ্চা গোরিলাকে একা-একা পাওয়া কিন্তু শক্ত। ছোট-ছোট পরিবারে ভাগ হয়ে গোরিলারা দলবদ্ধ হয়েই দিনের বেলা গাছের ফলমূল খেয়ে বেড়ায়। রাত্রে ধাড়ি গোরিলা কোনও গাছের তলায় পাহারায় থাকে, আর বাচ্চা আর মেয়ে গোরিলারা গাছের ওপর ডালপালা দিয়ে তৈরি মাচার মতো বাসায় ঘুমোয়। কোনও রকমে কোনও বাচ্চা কোথাও একবার ছটকে না পড়লে তাকে ধরা তাই কঠিন।
পরের দিন কীভাবে কোন দিক দিয়ে গোরিলা ধরবার ব্যবস্থা করব তাই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ভাবছি, এমন সময় জুগন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে যা বললে তাতে আমি একেবারে থ হয়ে গেলাম।
সে নাকি আমাদেরই তাঁবু থেকে কিছু দূরে পাহাড়ের এক গুহার মধ্যে একটা গোরিলাকে যেতে দেখেছে। সে গোরিলাটা নাকি দেখতে কতকটা সাদা রঙের।
সাদা রঙের গোরিলাই তো অসম্ভব আজগুবি ব্যাপার! তবু সন্ধ্যার আবছা-অন্ধকারে জুগনের দেখবার কোনওরকম ভুল হয়েছে ভাবা যেতে পারে। কিন্তু গোরিলা একা-একা গুহায় থাকে এরকম কখনও শুনিনি। না, ব্যাপারটার সন্ধান নিতেই হয়।
জুগনকে সঙ্গে নিয়ে সেই গুহার মুখে যখন পৌঁছোলাম তখন চারিদিকে বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে।
গুহাটা খুব বড় নয়। পাহাড়ের গায়ে একটা বড় ফাটলের মতো। কিন্তু ভেতরটা একেবারে জমাট অন্ধকার। সেই অন্ধকার গুহায় গোরিলার মতো সাংঘাতিক প্রাণীর খোঁজে ঢোকা প্রায় আত্মহত্যা করারই সামিল।
প্রথমে তাই গুহার মুখে বারকয়েক বন্দুকের আওয়াজ করলাম। ভয় পেয়ে যদি গুহা থেকে বেরিয়ে পড়ে। তাতে কোনও ফল না পাওয়ায় একটা শুকনো কাঠ মশালের মতো জ্বেলে নিয়ে বাধ্য হয়েই ভেতরে ঢুকলাম।
ফাটলটা খানিকটা সোজা গিয়ে, ডানদিকে বেঁকে গেছে। সামনে আমি বন্দুক হাতে সন্তর্পণে এগুচ্ছি। পেছনে জুগন মশাল হাতে আসছে। গোরিলাটা যদি হঠাৎ ঝাঁপিয়ে আসে, গুলি অন্তত একটা চালাব। তারপর যা হয় হোক। বাঁকটা ঘুরেই কিন্তু স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। এই কি জুগনের গোরিলা?
পেছনে পাথরের দেয়ালে আটার মতো লেপ্টে সভয়ে আমাদের দিকে চেয়ে যে দাঁড়িয়ে আছে, তার রং সাদা এবং চেহারা বিরাট হলেও গোরিলা সে নয়।
আমাদের থামতে দেখে হাতে পিস্তলটা উঁচিয়ে সে বিশুদ্ধ ইংরেজিতে বললে, খবরদার! এক পা এগিয়েছ কি গুলি করব।
ততক্ষণে আমি নিজেকে সামলে নিয়েছি। হেসে বললাম, তাতে কি কেউ জখম হবে মনে করেছেন, ড. হিল! আপনার তাগ যে কত তা তো আমার জানা!
অবাক হয়ে পিস্তল নামিয়ে ড. হিল এবার এগিয়ে এসে বললেন, এ কী, দাস? তুমি এখানে?
গম্ভীর হবার ভান করে বললাম, নিয়তির টানে বোধহয়। নইলে কোথায় দক্ষিণ আমেরিকার ব্রেজিলের জঙ্গল, আর কোথায় আফ্রিকার কঙ্গোর সীমান্ত। পাঁচ বৎসর বাদে আচমকা এমন আশ্চর্যভাবে দেখা হবে কেন?
ড. হিল কৃতজ্ঞভাবে বললেন, হ্যাঁ, সেবারে তুমি হঠাৎ উদয় না হলে প্রাণটা সেখানে রেখে আসতে হত বটে।
হেসে বললাম, আপনার বন্দুকের টিপ কী রকম সেইখানেই তো টের পাই। কুমির মারতে গিয়ে প্রায় আমাকেই মেরে বসেছিলেন।
তা প্রায় বসেছিলাম বটে, বলে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ড. হিল বললেন, তবে এবার তোমার সঙ্গে দেখা হয়েও কোনও লাভ হল না, দাস। এবার আমায় বাঁচানো তোমার ক্ষমতার বাইরে।
আচ্ছা, আসুন তো আমার সঙ্গে, তারপর দেখা যাবে, বলে ড. হিলের হাত ধরতেই তিনি বাধা দিয়ে বললেন, আমায় সঙ্গে নেওয়া মানে, তোমার নিজের সমূহ বিপদ ডেকে আনা, তা তো বুঝতে পারছ?
গুহার ভেতরেও জংলিদের সুদূর ঢাকের আওয়াজ তখন শোনা যাচ্ছে। একমুহূর্ত চুপ করে থেকে হেসে বললাম, গায়ে পড়ে বিপদ ডেকে আনাই যে আমার বাতিক
তা কি এতদিনে বোঝেননি, ড. হিল?
ড. হিলকে নিজের তাঁবুতে এনে তারপর তাঁর কাছে সমস্ত কাহিনীই শুনলাম।
ড. হিলকে ভূগোল-বিলাসী বললে বোধহয় ঠিকভাবে বোঝানো যায়। জীবনে তিনি বন্দুকটা পর্যন্ত ভাল করে চালাতে শেখেননি, কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক দুর্গমতম জায়গা আবিষ্কার করা তাঁর একটা নেশা। আমাজন নদীর উৎসের কাছে পাঁচ বৎসর আগে তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়। তাঁর ধারণা, সেবারে আমিই নাকি আমাজন নদীর বিদঘুটে এক অ্যালিগেটর কুমিরের কবল থেকে তাঁকে বাঁচাই।
ড. হিলের সমস্ত কথা শুনে এবারে তাঁকে বাঁচানো এবং সেই সঙ্গে নিজেদের বাঁচবার ব্যবস্থা করা কিন্তু সত্যিই কঠিন বলে মনে হল।
এই ক-দিন জংলিদের যে ঢাকের খবর শুনেছি তার লক্ষ্য যে ড. হিল স্বয়ং, এ কথা বোধহয় আর বলে দিতে হবে না।
কঙ্গোর এই অঞ্চলে ভৌগোলিক অভিযানে এসে শুধু নিজের ভালমানুষির দরুন তিনি এখানকার ভয়ংকর জংলিদের বিষ-দৃষ্টিতে পড়েছেন।
এ অঞ্চলের জংলিরা এখনও সেই আদিমতম যুগে পড়ে আছে। তাদের জঙ্গলের বাইরে কোনও দুনিয়া আছে বলে তারা জানে না। ঘুরতে ঘুরতে তাদের এক গাঁয়ে ড. হিল গিয়ে পড়েন। ড. হিলকে তারা প্রথমে অদ্ভুত এক জাতের মানুষ ভেবে একটু সমীহই করেছিল। তাঁকে ও তাঁর লোকজনকে আশ্রয় দিয়েছিল সসম্মানে। ড. হিল সেখানে পরোপকার করতে গিয়েই নিজের সর্বনাশ করলেন।
সে-গাঁয়ের সর্দার বহুদিন ধরে মাথা ধরার রোগে ভুগছিল। গাঁয়ের ওঝা-পুরুতেরা নানারকম ঝাড়ফুঁক করে ভূত প্রেত মানত করেও তাকে ভাল করতে পারেনি। ড. হিল দেখে-শুনে একটি অ্যাসপিরিন বড়ি দিয়ে একদম তাকে চাঙ্গা করে তোলেন। আর যাবে কোথায়? সর্দারের কাছে তাঁর খাতির যেমন দশগুণ বেড়ে গেল, গাঁয়ের ওঝা-পুরুতেরাও তেমনই তাঁর ওপর খাপ্পা হয়ে উঠল হাজার গুণ। জংলিদের মধ্যে তাদের মান-ইজ্জত বজায় রাখবার জন্যে ওঝা-পুরুতেরা না করতে পারে হেন শয়তানি নেই। ভাগ্যচক্রে তাদের একটা সুবিধেও হয়ে গেল। কী একটা ছোঁয়াচে রোগে গাঁয়ের কয়েকটা গোরু বাছুর তখন মারা গেছে। ওঝারা রটিয়ে দিলে যে, ড. হিলই তাঁর যাদুতে এইসব গোরু বাছুর মারছেন। প্রথমে গোরু বাছুর, তারপর মানুষ মারাই তাঁর মতলব। সর্দারকে পর্যন্ত তারা তা-ই বোঝালে।
বেগতিক দেখে দলবলসুদ্ধ লুকিয়ে পালাতে গিয়েই ড. হিল আরও বিপদ ডেকে আনলেন। তিনি কোনও রকমে তাদের চোখ এড়িয়ে এই পাহাড়ে এসে পৌঁছোলেন বটে, কিন্তু তাঁর লোকজন সব কচুকাটা হয়ে গেল। এখানে পালিয়ে এসেও অবশ্য তাঁর রক্ষা আছে বলে মনে হয় না। ঢাকের খবরে চারিদিকের জংলিদের যেভাবে তারা জাগিয়ে তুলেছে, তাতে শেষ পর্যন্ত তাদের খপ্পর থেকে মুক্তি পাওয়া প্রায় অসম্ভব।
সেদিনও সারারাত.ঢাকের যা আওয়াজ শুনলাম তাতে মনে হল—ধীরে ধীরে চারিদিক ঘেরাও করে তারা এই পাহাড়ের দিকেই ক্রমশ এগিয়ে আসছে। এখন তাদের বেড়াজাল থেকে পালাবার একমাত্র উপায় এই দুর্গম পাহাড় ডিঙিয়ে পুবদিকে টাঙ্গানাইকায় নামবার চেষ্টা করা।
মাঝরাত্রের পর ডাকের আওয়াজ কিছুক্ষণের জন্যে থামতে দেখে মনে একটু আশাও হল। হয়তো তারা ভোরের আগে আর অগ্রসর হবে না। লোকজনকে তুলে ড. হিলকে সঙ্গে নিয়ে রাতারাতি তাই রওনা হয়ে পড়লাম।
কিন্তু বেশিদূর আর যেতে হল না। সকালবেলা কিভু হ্রদের ধারে গিয়ে সবে পৌছেচি, এমন সময় সমস্ত পাহাড়-জঙ্গল যেন একসঙ্গে বজ্রের হুংকার দিয়ে উঠল। চমকে দেখি, রংবেরঙের বিদঘুটে উলকি-আঁকা হাজার-হাজার জংলি, ঢাল আর বল্লম হাতে যেন ভোজবাজিতে মাটি খুঁড়ে উঠে আমাদের ঘিরে ধরেছে।
তারপর যে দারুণ কাণ্ড শুরু হল তা আর বর্ণনা করা যায় না। ওঝা-পুরুতের লম্ফঝম্পই সবচেয়ে বেশি। আমাদের পিছমোড়া করে বেঁধে আমাদেরই মালপত্রের মধ্যে ফেলে রেখে তারা যে তাণ্ডবনৃত্য ও আস্ফালন শুরু করল তা থেকে বুঝলাম, আমাদের সোজাসুজি পুড়িয়ে মারা হবে, না, ফুটন্ত কড়াই এ সেদ্ধ করা হবে—এটুকু তারা এখনও ঠিক করতে পারছে না। জংলি কাঠের আগুনে বড় বড় কড়াই তখনই কিন্তু চাপানো হয়ে গেছে।
দুপুরের পর স্বয়ং সর্দার আসরের মাঝে দেখা দিলে। চোখের চেহারা ও ঘন ঘন নিজের কপাল টেপা দেখে বুঝলাম, আপাতত একটা অ্যাসপিরিন পেলে সে বর্তে যায়। শুধু ওঝা-পুরুতের কাছে ছোট হবার ভয়েই বোধ হয় সোজাসুজি এসে চাইতে সাহস করছে না।
জংলি হলেওসর্দার একেবারে অকৃতজ্ঞ নয়। মাথাধরা সারানোর জন্য ড. হিলের ওপর তার মনটা একটু নরমই ছিল। এগিয়ে এসে তাই ড. হিলকে সে জিজ্ঞাসা করলে, কড়াই-এ সেদ্ধ হয়ে, না, সোজা আগুনে পুড়ে তিনি মরতে চান—এইটুকু বেছে নেবার সুযোগ দিয়ে সে তাঁকে অনুগ্রহ করতে চায়।
দুনিয়ায় আর সব জায়গার মতো এই জংলিদের মধ্যেও ভড়ং আর চালের দামই সবচেয়ে বেশি।
পিছমোড়া অবস্থাতেই যতদূর সম্ভব ভারিক্কি চালে ড. হিলের হয়ে গম্ভীর ভাবে বান্টু ভাষায় বললাম, আমাদের সেদ্ধ করে, কি পুড়িয়ে মারার আগে তোমার একটু মাথা ধরার যাদু-দাওয়াই পেলে ভাল হয় নাকি?
ওঝা-পুরুতরা তৎক্ষণাৎ হাঁ হাঁ করে উঠল। ও যাদু-দাওয়াই সর্দার যেন কিছুতে না খায়। গোড়ায় ভাল হলে কী হবে, ও-দাওয়াই শেষে সর্বনাশা বিষ হয়ে উঠবে।
সর্দার কিন্তু একটু যেন দোমনা হয়েছে বুঝে হেসে বললাম, এত যাদের হম্বিতম্বি, সেই তোমার ওঝা-পুরুতরাই তাহলে মাথা ধরার একটা যাদু-দাওয়াই দিক দেখি।
সর্দার আর একটু নরম হয়েছে বুঝেই তৎক্ষণাৎ ড. হিলকে দেখিয়ে বললাম, কটা ভণ্ড ওঝা-পুরুতদের কথায় কাকে তুমি খেপিয়ে তুলছ জানো! রং আর চেহারা দেখে বুঝতে পারছ না যে, এই জঙ্গল-পাহাড় নয়, উনি সেই আকাশের চাঁদ থেকে দয়া করে এখানে নেমেছেন?
চাঁদ থেকে নেমে এসেছেন? একবার ড. হিলের দিকে, একবার আকাশের দিকে চাওয়ার ধরন দেখে বুঝলাম, সদার বেশ কাবু হয়েছে।
ওঝা-পুরুতরাও তাই বুঝেই মরিয়া হয়ে চেঁচিয়ে উঠল, সব বাজে কথা! চাঁদ থেকে নেমে এসেছেন তার প্রমাণ কী?
প্রমাণ ওঁর চেহারা! দেখতে পাচ্ছ না ওঁর গায়ের রং!
—ও-প্রমাণ চলবে না! আমরা অন্য প্রমাণ চাই। ওঝা-পুরুতদের কথায় সর্দারকেও অনিচ্ছাসত্ত্বে সায় দিতে হল।
যেন ব্যাপারটা নেহাত তুচ্ছ এমনই ভাবে বললাম, বেশ, চাঁদ থেকেই আজ রাত্রে প্রমাণ পাবে?
আমার নিশ্চিন্তভাব দেখে বেশ একটু হতভম্ব হয়ে জংলিরা নিজেদের মধ্যে গিয়ে জটলা শুরু করার পর ড. হিল হতাশভাবে বললেন, এটা কী করলে, দাস! যদিবা শুধু পুড়িয়ে মারত, এখন যে গায়ের ছাল জ্যান্ত ছাড়িয়ে নেবে! চাঁদের ধাপ্পাটা কেন মিছে দিতে গেলে।
হেসে বললাম, আপনার কোনও ভয় নেই। চাঁদের প্রমাণ আমি সত্যি দেব দেখবেন!
হতাশভাবে আমার দিকে চেয়ে তিনি বললেন, না, ভয় ভাবনায় তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে দেখছি। চাঁদের আবার কী প্রমাণ হতে পারে!
আজ কী তারিখ আপনার মনে নেই, নইলে প্রমাণটা বুঝতে পারতেন।
ড. হিল খানিক বিমূঢ় হয়ে থেকে হঠাৎ প্রায় লাফিয়ে উঠে বললেন, ওঃ, ভুলেই গেছলাম! আজ তো এখানে চন্দ্রগ্রহণ দেখা যাবে।
হেসে বললাম, হ্যাঁ, ওর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে!
কিন্তু ভাগ্য যে তখনও আমাদের ওপর অত বিরূপ তা কী করে জানব।
সন্ধে হতে না হতেই কোথা থেকে রাশি রাশি মেঘ এসে আকাশ ছেয়ে ফেলতে লাগল। ওঝা-পুরুতদের আস্ফালন তখন দেখে কে! তারাই নিজেদের ভেলকিতে মেঘ আকাশে তুলছে বলে সর্দারকে তখন বোঝাচ্ছে।
অগ্নিমূর্তি হয়ে সর্দার আমাদের কাছে এসে এবার বললে, কই, কোথায় তোমাদের চাঁদের প্রমাণ—দেখাও!
ভেতরে ভেতরে নাড়ি তখন প্রায় ছাড়বার উপক্রম, তবু বাইরে বেপরোয়া সাহস দেখিয়ে বললাম, তোমার ওঝা-পুরুতদের কিছু ক্ষমতা আছে মানছি, কিন্তু চাঁদের মানুষের তেজ যে কত বেশি, আর একটু বাদেই টের পাবে!
আমাদের সামনে একটা আধ-পোড়া মশাল মাটিতে পুঁতে দিয়ে সর্দার বললে, বেশ, এই মশাল যতক্ষণ না-নেভে ততক্ষণ তোমাদের সময় দিলাম। তারপর জ্যান্ত তোমাদের কলিজা কেটে বার করব।
তা-ই কোরো, বলে বেশ জোরে জোরেই হাসলাম। মনে মনে তখন জপছি, হে আকাশের দেবতা, দয়া করে একটা ঝড় তুলে মেঘগুলোকে তাড়াও। নইলে আর যে রক্ষা নেই।
আকাশের দেবতার দয়া করার কোনও লক্ষণ কিন্তু দেখা গেল না। মেঘগুলো যেন আরও গাঢ় হয়েই জমতে শুরু করল।
মশালটা প্রায় তখন শেষ হয়ে এসেছে। সেই দিকেই চেয়ে ইষ্টনাম স্মরণ করবার চেষ্টা করছি, এমন সময় ছলাৎ করে একটা শব্দ শুনে ফিরে দেখি, কাঁচের জারের মধ্যে রাখা একটা মাছ কী রকম যেন ছটফট করছে।
ড. হিল নিজের ভাগ্য তখন বোধ হয় মেনে নিয়েছেন। একটু দুঃখের হাসি হেসে বললেন, মাছটাও আমাদের পরিণাম বোধ হয় বুঝতে পেরেছে।
কয়েক মুহূর্ত মাছটার দিকে চেয়ে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলাম, না, ড. হিল, আর ভয় নেই। মাছটা আমাদের পরম বন্ধু, আমাদের উদ্ধারের পথই বাতলাচ্ছে।
তারপরে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ডাকলাম, কোথায় সর্দার। কোথায় সব ওঝা-পুরুত, চাঁদের মানুষের তেজটা একবার দেখে যাও।
সবাই অবাক হয়েই কাছে ছুটে এল।
উচ্চৈঃস্বরে হেসে বললাম, সামান্য একটা মেঘ দিয়ে আকাশ ঢেকে তোমার ওঝা-পুরুতেরা বাহাদুরি নিচ্ছিল সর্দার। চাঁদের মানুষ এবার এই পাহাড়-জঙ্গল দুলিয়ে দিচ্ছে দেখো।
ওঝারা চেঁচিয়ে উঠল, সব মিথ্যে কথা! সব ধাপ্পা!
জংলিরা খেপে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আর কী! এমন সময় মাটির তলা থেকে অদ্ভুত একটা প্রচণ্ড গোঙানির শব্দ যেন শোনা গেল। পরমুহূর্তে সমস্ত পাহাড়টা ঢেউ-এর মাথায় নৌকার মতো দুলে উঠল আর সেই কিভু হ্রদের জল লাফ দিয়ে তীর ছাপিয়ে উপচে পড়ল বিশাল স্রোত হয়ে।
সেই প্রচণ্ড ভূমিকম্পে ভয়ে দিশাহারা হয়ে জংলিরা কে যে কোথায় পালাল ঠিক নেই। ভূমিকম্প যখন থামল তখন দেখি, আমরাই শুধু আমাদের মালপত্রের মধ্যে প্রায় বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছি, আর কিভু হ্রদের এক পাড় ভেঙে দুরন্ত এক নদীর স্রোত নীচে বয়ে যাচ্ছে।
ঘনাদা গল্প শেষ করে থামবার পর শিবু জিজ্ঞাসা করলে, ওই মাছের ছটফটানি দেখেই ভূমিকম্পের কথা টের পেলেন নাকি? কী মাছ সেটা?
ওদেশের একরকম মাগুর মাছ, গম্ভীরভাবে বললেন ঘনাদা, ইংরেজিতে বলে cat fish. জাপানে থাকতে ও-মাছের ক্ষমতার কথা জেনেছিলাম। জাপানে তো ভূমিকম্প নিত্য লেগেই আছে। সেখানকার বৈজ্ঞানিকেরা লক্ষ করে দেখেছেন, ভমিকম্পের ঠিক আগে মাগুর-জাতের মাছ কী করে যেন তা টের পেয়ে অদ্ভুতভাবে ছটফট করে। অনেকে সেখানে তাই ভূমিকম্প আগে থাকতে ধরবার জন্যে মাগুর মাছ পোষে।