একবার আব্বার সাথে জিয়া কাকার বাড়িতে গিয়েছিলাম। জিয়া কাকার দুটো মেয়ে। একজন কলেজে পড়ে, আরেকজন তখন প্রাইমারিতে। রিয়া, টিয়া নাম। আমরা যাওয়ার পর রিয়া বৌ সেজে এসে আব্বারে সালাম দিলো। আব্বা খুশি হয়ে পিচ্চি মেয়েটাকে একশো টাকা দিলেন! একটু পর বড় মেয়ে টিয়াও বৌ সেজে এসে আব্বারে সালাম করলো! আব্বা তাঁকেও একশো টাকা দিলেন!
আব্বা আমাকে আস্তে আস্তে বলছিলেন, “ দেখ, টাকা আদায় করার কী সুন্দর কৌশল! তোর মাথায় তো বুদ্ধি নাই৷ ” আব্বার কথা মেনে নিলাম৷ আমার মাথায় আসলেই বুদ্ধি নাই৷ বারান্দায় বসে মুরুব্বীদের কথাবার্তা শুনছি। এর মাঝে আবার রিয়া বৌ সেজে এসে আমাকে সালাম করলো! সবাই হেসে দিলো। সালাম যখন করেই ফেলেছে। টাকা তো দিতেই হয়! নাহলে মান সম্মান কিছু থাকে?
কিন্তু আমার পকেটে তখন মাত্র দুই টাকা ছিলো চকলেট খাওয়ার জন্য! আব্বার কাছে তো সবার সামনে টাকা চাইতে পারি না। তাই নিজের পকেট থেকেই দুই টাকা বের করে দিলাম! ওমা, দুই টাকা দেওয়ার পর মেয়েটার কী যে রাগি মুখ! ঝারি দিয়ে বললো, “ আপনার কাছে আমি আরো আটানব্বই টাকা পাই। তাড়াতাড়ি শোধ করে দিবেন! ” জিয়া কাকা বললো, “ দিয়ে দিবে, দিয়ে দিবে মা। ও বড় হলে দিয়ে দিবে। এতো রাগ করলে হয় না। ” কিছুক্ষণ পর লাগলো ক্ষুধা, ভাতের নয়, চকলেটের!
কার কাছে টাকা চাই বুঝে পাচ্ছিলাম না। অবশেষে রিয়ার কাছেই চাইলাম। “ রিয়া, তোমারে যে দুইটা টাকা দিছিলাম। আমারে দিয়া দাও। চকলেট খামু। ” রিয়ার মুখ তখন নড়াচড়া করছে। বুঝে গেলাম আমার দুই টাকা দিয়ে নিজেই চকলেট খেয়ে ফেলেছে! সে আমার কথার জবাব না দিয়ে উল্টো চোখ রাঙিয়ে বললো, “ আটানব্বই টাকা কই আমার? পাওনা টাকা দেয়ার খবর নাই, আইছে কর্যা নিতে! ”
আচ্ছা, সেদিন আর আমার চকলেট খাওয়া হলো না। তেরো বছর পর, বাসর রাতে ঢুকে বৌয়ের ঘোমটা তুলতে গেলাম। সে ঘোমটা শক্ত করে ধরে রেখে বললো, “ আটানব্বই টাকা আমার পাওনা আছে। পাওনা টাকা পরিশোধ না করে বৌয়ের গায়ে ছুঁয়া যায় না! ” মহা মুশকিল! এখন আটানব্বই টাকা পাই কই? খোঁজাখুঁজি করে একশো টাকার একটা নোট পেলাম রুমেই।
“ একশো টাকা পাইছি। নিয়ে নাও। আরো দুই টাকা বকশিস! ”
সে ঘোমটা আরো শক্ত করে ধরে বললো, “ আমি কোনো হোটেলের ওয়েটার নই। বকশিস আমি চাই না। আমার পাওনাটা দিলেই হয়! ”
“ এই মুহূর্তে আটানব্বই টাকা তো নাই! আচ্ছা দেখছি। ”
বের হয়ে দেখলাম কোথাও ভাংতি পাওয়া যায় কিনা। কিন্তু সে রাতে ভাংতি আর মিললো না! অসহায় হয়ে তাঁর কাছে গিয়ে বললাম, “ আটানব্বই টাকা হলো না। হয় নব্বই নিতে হবে। নাহলে একশো! ”
“ ঠিক আছে। ”
“ কী ঠিক আছে? ”
“ আমার কাছে দুই টাকা আছে। ”
“ আমি দুই টাকা দিয়ে কী করবো?
“ চকলেট খাবেন। ”
সে শাড়ির কুঁচি থেকে দুই টাকার একটা কয়েন বের করে বিছানায় রাখলো। বিনিময়ে আমি একশো টাকার নোট তাঁর হাতে দিলাম। তারপরে সে ঘোমটা সরাতে দিলো! দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ভাবছিলাম। কী হয়রানিটা সে আমাকে করিয়েছে মাঝ রাতে৷ মেয়েদের পাওনা যে তাঁরা কোনোদিনও ভুলে না। তা ভালোবাসা হোক বা টাকা। কয়েক যুগ পরেও ভুলে না। তা সেদিন টের পেয়েছিলাম!