“যুবতী মেয়ে দেখলে সবাই প্রেম করতে চায়,যেমনটা বরই গাছ দেখলে সবাই একবার ঢিল ছুঁড়ে।” বুঝলা নাতি যৌবনকালে কালো কাকটাও সুন্দর লাগে।” দাদীর মুখে এমন কথা শুনে রাগে আমার শরীরটা জ্বলে যাচ্ছে।আজকাল অনেক ছেলেরাই আমাকে বিভিন্নভাবে প্রেমের প্রস্তাব পাঠায় ইশারা ইঙ্গিতে, এটা কি আমার দোষ!”
এই বলে সেঁজুতি স্কুলের ড্রেস আর বই নিয়ে বের হলো।বাহিরে তুলি,মিথি আর শাহিদা দাঁড়িয়ে আছে।তারপর তারা স্কুলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো।স্কুলে যাওয়ার পুরো পথটা ওরা হেঁসে আর কথা বলেই উড়িয়ে দেয়।ইসসসস কত কথা জমে থাকে তাদের মনে। উৎসব নামের একটা ছেলে আজকাল ওদের স্কুলে আসা যাওয়ার পথে দাঁড়িয়ে থাকে।ছেলেটা ভালোই স্মার্ট। চোখে কালো সানগ্লাস আর সুন্দর ড্রেস আপে ছেলেটাকে ভালোই লাগে।যদিও ছেলেটা একটা বেকার তবে চেয়ারম্যান বাড়ির ছেলে। ওরা প্রতিদিন ছেলেটাকে দেখে তবে বুঝতে পারেনা ছেলেটা কার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে রোজ। এভাবে কয়েকদিন ভালোই কাটছিলো তবে একদিন হঠাৎ ছেলেটা সেঁজুতিকে যাওয়ার পথে প্রশ্ন করে বসলো, ওর বাড়ি কোথায় আর বাবার নাম কি?
সেঁজুতি ছেলেটার কথায় কোনো উত্তর না দিয়েই সেদিন বাসায় চলে আসলো। উপরে রাগী রাগী চেহারা দেখালেও সেঁজুতির মনে কেমন যেনো এক আনন্দ বয়ে গেলো যা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না এভাবে আরো কয়েকদিন কেটে গেলো। মাঝেমধ্যে ছেলেটা ওদের পিছন পিছন স্লো করে বাইক চালাতো না হয় হর্ণ বাজাতো। আবার সেঁজুতি পিছনে ফিরলে লাইট জ্বালিয়ে রাখতো। এইসব খুন শুঁটি সেঁজুতির খুব ভালো লাগতো। একদিন তো ছেলেটা ওর ফোন নম্বর চেয়ে বসলো! সেদিনও সেঁজুতি কিছু বলেনি তবে সারাদিন কথাটা মনে করে মুচকি মুচকি হাসতো।
এরপর প্রায় অনেকদিন পর একদিন হঠাৎ মায়ের ফোনে একটা নম্বরে কল আসলো।মা রান্না ঘরে থাকায় সেঁজুতি নিজেই ফোনটা রিসিভ করে জানতে পারলো এটা ঐ ছেলে যার নাম উৎসব। বেশি কথা হলো না মায়ের ভয়ে। তারপর না চাইতেই একদিন সেঁজুতি ছেলেটার প্রেমে পড়ে গেলো। যে সেঁজুতি আগে একেবারে সাধারণ থাকতো এখন সে সবসময় সাজুগুজু করে থাকে।তার প্রতিটা আচরণ একেবারে অন্যরকম হয়ে গেলো।তখন সেঁজুতি মনে মনে ভাবতো পৃথিবীটা আসলেই অনেক সুন্দর!
এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে রাত জেগে অনেকদিন কথা চললো।স্কুল ফাঁকি দিয়ে লুঁকিয়ে লুঁকিয়ে দেখা করা,সবার মাঝখানে চোখের ইশারায় কথা বলা আরো কত কি! উৎসব নামের ছেলেটা একদিন সেঁজুতিকে বললো, “আচ্ছা সেঁজুতি! তুমি কি জানো তোমার চোখ অনেক সুন্দর! বিশ্বাস না হলে তুমি একদিন ঘুম থেকে উঠে, চোখে কাজল দিয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ো আমি নিশ্চিত তুমি নিজেই তোমার চোখের প্রমে পড়ে যাবে।” সেদিন থেকে সেঁজুতি কখনো চোখে কাজল দেয়া মিস করেনি। প্রথম প্রেম বলে কথা। এরমধ্যে একদিন ছোট কাকীর ভাইয়ের ছেলে এসেও সেঁজুতির ফোন নম্বর চাইলো।
এভাবে টুকটাক সেঁজুতিকে অনেক ছেলেরাই ইশারা করে। তখন সেঁজুতি ক্লাস নাইনের ছাত্রী। একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে স্কুলের এক বড় আপু উৎসব সম্পর্কে অনেককিছু বললো সেঁজুতিকে। “উৎসব নাকি ভালো ছেলে না, ও নাকি সবার সাথে স্বার্থের জন্য সম্পর্কে জড়ায় আর পরে ধোঁকা দেয়।” এগুলো শুনে সেঁজুতি সাথে সাথে উৎসবকে ফোন করলো। সবকিছু শুনে প্রতিত্তোরে উৎসব বললো, “এগুলো সব মিথ্যা কথা। ওরা নাকি উৎসবের সাথে প্রেম করতে চাইতো আর ও পাত্তা না দেয়ায় এগুলো বলতো।” এভাবে দিনগুলো বয়ে যাচ্ছিলো।তারপর হঠাৎ একদিন রাতে উৎসব বললো,
“অনেকদিন তোমার সাথে কথা হলো কিন্তু কখনো সামনাসামনি তোমাকে দেখা হয়নি,আমার খুব ইচ্ছে করে খুব কাছ থেকে তোমাকে দেখার।তোমাদের স্কুলের পাশে আমার একটা ভাবির বাসা আছে তুমি একটু এখানে এসো কাল।শুধু কথা বলবো তার পরেই চলে যেও।” উৎসবের কথা শুনে সেঁজুতি কিছু না বলে ফোন কেটে দিলো।পরেরদিন বান্ধবীদের সাথে এগুলো শেয়ার করার পর ওরা নিষেধ করলো সাথে উৎসবের নামে আরো অনেক খারাপ খারাপ কথা বের হলো যেগুলো একসময় সত্যি বলেই প্রমাণ হলো।
এই নিয়ে চিন্তা করতে করতে সেঁজুতির বার্ষিক পরীক্ষা খুবই খারাপ হলো। স্কুলের হেডস্যার কিভাবে যেনো ওর ব্যাপারে কোনকিছু আইডিয়া করলো।পরে একদিন স্যার ওকে ডেকে নিয়ে বললো, “শোন সেঁজুতি, তোমরা এখন ছোটো। জীবনে এখনো অনেকসময় পড়ে আছে।আবেগ দিয়ে জীবন নষ্ট করো না বিবেকের চোখ দিয়ে একবার পৃথিবীটা দেখো কিন্তু ভুল ট্রেনে চড়ে বসো না,জীবনটা একেবারে লন্ডভন্ড হয়ে যাবে। প্রায়শ্চিত্তের ও সুযোগ পাবে না।”
সেদিন সেঁজুতি কিছু বলেনি পুরো রাস্তা কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরলো।সেঁজুতির মনে হতে লাগলো উৎসবের মতো একটা ছেলে সে কোনদিন পাবে না।ওদিকে উৎসব ক্রমাগত সেঁজুতিকে অবহেলা করতে লাগলো যেগুলো ছিলো সেঁজুতির কাছে বিষের কাঁটার চেয়েও যন্ত্রণাকর। সেঁজুতি না পারছে উৎসবের কথা রাখতে না পারছে সহ্য করতে।কত বুঝিয়েছে উৎসবকে সে কিন্তু কোন কাজ হয়নি। আজকাল আবার উৎসবকে রাতে অনেকসময় ধরে ওয়েটিং দেখা যায়। এতে সেঁজুতির হৃৎস্পন্দনের গতি বেড়ে যায়।কত রাত যে সেঁজুতি না ঘুমিয়ে পার করেছে তার হিসেব আজো অজানা।
একদিন সেজুতি বাধ্য হয়ে রাজি হয়ে গেলো উৎসবের কথায়।তারপর উৎসব আবারো আগের মতো কেয়ারিং হয়ে গেলো সেঁজুতির প্রতি।যেদিন সেঁজুতি উৎসবের সাথে যাবে সেদিন মা যেনো কিভাবে বিষয়টা টের পেলো। মা ওকে বকা ও দেয়নি আর মার ও দেয়নি শুধু বলেছিলো, “তোমার ভবিষ্যৎ জীবনসঙ্গীকে তুমি ঠকিয়ো না।” সেদিন আর সেঁজুতি বাড়ির বাইরে পা রাখেনি।এরমধ্যে এসএসসি পরীক্ষায় ও শেষ হয়ে গেলো। সেঁজুতি সেদিন একপ্রকার বাধ্য হয়েই গ্রাম ছেড়েছিলো কারণ সে জানতো এখানে থাকলে সে উৎসবকে ভুলতে পারবে না।
তারপর এক নতুন জীবন শুরু হলো সেঁজুতির।কিন্তু খুব খারাপ লাগতো সেঁজুতির এই ভেবে, উৎসব সেদিনের পর থেকে আর কখনো সেঁজুতির সাথে যোগাযোগ করেনি।তাহলে কি সত্যিই উৎসব ছিলো আর ভাবতে পারেনা সেঁজুতি, শুধু মনকে প্রশ্ন করে, ভালবাসা কি এতোটাই সস্তা! তারপরও সেঁজুতি জীবনে চলার পথে অনেক বন্ধু এবং শুভাকাঙ্ক্ষী পেয়েছে কিন্তু উৎসবকে মন থেকে ওভাবে ভুলতে পারেনি। আজ সেঁজুতি লেখাপড়া শেষ করেছে, ভালো একটা চাকরিও করে। আগামীকাল তার বিয়ে উৎপলের সাথে। ছেলেটা খুব শান্তপ্রকৃতির তবে সেঁজুতিকে খুব ভালবাসে। তারপর কেটে গেলো আরো বছর দশেক!
আজ সেঁজুতি ২ সন্তানের মা।জীবন থেকে অনেকগুলো বছর সে পিছনে ফেলে এসেছে।কত স্মৃতি, আনন্দ আর কষ্টে মোড়ানো দিনগুলো। কিন্তু আর কখনো খবর নেয়নি সেঁজুতি উৎসবের তবে একদিন তুলি বলেছিলো, ছেলেটা নাকি ৩ টা বিয়ে করেছে তাও নাকি সাংসারিক জীবনে অনেক সমস্যা হচ্ছে কারণ সে একজনকে সারাজীবনের জন্য মেনে নিতে পারেনা। যাক সেসব কথা।আজকাল পিছনের এই কথাগুলো মনে পড়লে সেঁজুতির বড্ড হাসি পায়, সে অচিরেই বলে ফেলে, “আমি সেঁজুতি কতই না বোকা ছিলাম একসময়ে!”
আসলে আমরা জীবনের খারাপ সময়গুলোতে ভরসা হারিয়ে ফেলি।বিষন্নতায় আমাদের ঘিরে ফেলে।আসলে সময়ের কাছে সবকিছু ম্রিয়মাণ! আজ যা নিয়ে আপনি কষ্ট পাচ্ছেন একসময় দেখবেন সেই কষ্টই আপনি ভুলে গেছেন সময়ের স্রোতে।আসলে জীবন কখনো কারো জন্য থেমে থাকে না সে চলতে থাকে তার আপন গতিতে।