জল
কীসে যে কী হয় কিছুই বলা যায় না।
বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের উপমাই লোকে দেয় কিন্তু শুকনো খটখটে আকাশ থেকেও যে বর্ষণ কখনও কখনও হয় সেকথা মনে রাখে ক-জন।
এ রকম বর্ষণ এই আমাদের ভাগ্যেই সেদিন হয়েছে, একেবারে যাকে বলে অভাবিত।
অভাবিত ছাড়া আর কী বলা যায়। প্রাণান্ত সাধ্য-সাধনা করেও যাঁকে এতটুকু গলাতে পারিনি গত তিনমাস, নিজের তিনতলার টঙে যিনি প্রায় অবানসোগোচর হয়ে আছেন, উঠতে নামতে কচিৎ কদাচিৎ দেখা হলে যাঁর দৃষ্টিতে হাওয়ার মতো আমরা হঠাৎ স্বচ্ছ হয়ে যাই, দোতলার আড্ডা ঘর থেকে কখনও পাড়া কাঁপানো শোরগোল তুলে কখনও বা অনুকুল বাতাসে সদ্যভাজা হিঙের কচুরি কি চিংড়ির কাটলেটের সুবাস ছড়াবার ব্যবস্থা করেও যাঁকে একবার একটু কৌতূহলভরেও ওপরের ছাদ থেকে উঁকি দেওয়াতে পারিনি, সেই ঘনাদার হঠাৎ নিজে থেকে বিনা নিমন্ত্রণেই আড্ডাঘরে এসে সহাস্যবদনে নিজের আরাম-কেদারা দখল কে কল্পনা করতে পেরেছিল!
শুধু ঘরে ঢুকে বসা তো নয়, প্রায় কুঁ মেরে আমাদের আলোচনায় মাথা গলিয়ে দেওয়া।
অথচ আজ দুপুরবেলাতেই আমরা হার মেনে ফিরে এসেছি মুখ চুন করে। শিশির যেন বৃষ্টিতে নীচের ঘরে জল পড়ার সমস্যা মেটাতে ঘনাদার কুঠুরির সামনের ছাদটা তদারক করতে গেছল। সঙ্গে আমাকেও থাকতে হয়েছিল ব্যাপারটা সরব করবার জন্য।
ছাদটা তো অনেক জায়গায় দাগরাজি করতে হবে দেখছি! আমার গলাটা আশা করি রাস্তার ওপারের বাড়িতেও শোনা গেছল।
দাগরাজি! শিশির তার গলাটা গলি ছাড়িয়ে বড় রাস্তায় পৌছে দিয়েছিল, শুধু দাগরাজিতে কী হবে! সমস্ত ছাদ খুঁড়ে নতুন করে পেটাই করতে হবে।
ঘনাদার তাতে বড্ড অসুবিধে হবে না? আমি তারস্বরে জিজ্ঞাসা করেছিলাম।
আকাশে অনেক উঁচুতে একটা চিল নিশ্চিন্ত মনে ভেসে চক্কর দিতে দিতে হঠাৎ ডানা নেড়ে তীরবেগে সরে পড়েছিল, কিন্তু খোলা দরজা দিয়ে তক্তপোশের ওপর আসীন ও খবরের কাগজে নিমগ্ন ঘনাদার বিন্দুমাত্র চাঞ্চল্য দেখা যায়নি।
ছাদের ফাটল দেখবার ছলে শিশির এবার ঘনাদার দরজার কাছে গিয়ে ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগের জন্য নতুন সিগারেটের টিনটা খোলবার কসরত করেছিল।
আমাকে ও সেই সঙ্গে পাড়ার পাঁচজনকে শুনিয়ে বলেছিল, একেবারে তাজা মাল। খুললেই কী রকম শিস দেয় শোনো।
সিগারেটের টিন খোলার শিস না হোক, শিশিরের সরব বিজ্ঞাপন সারা বনমালি নস্কর লেনকেই সচকিত করে তুলেছিল, কিন্তু ঘনাদার মুখের সামনের খবরের কাগজটা একটু কাঁপেওনি।
ছাদ মেরামত সম্বন্ধে আরও কিছু আবোলতাবোল বকে আমাদের নেমেই যেতে হয়েছিল অগত্যা।
ঘনাদার এবারের ধনুকভাঙা পণ আর টলবার নয় বলেই তখন ধরে নিয়েছি।
ছোট্ট এক বাটি তেল তিন মাস ধরে এতদুর গড়াবে ভাবতেও পারিনি আমরা কেউ।
হাঁ, সামান্য এক বাটি তেল থেকেই বাহাত্তর নম্বরের ঠাণ্ডা লড়াই এবার শুরু।
তেলটা যে সরষের তা আর বোধহয় বলতে হবে না। তখন তার আকাল সবে দেখা দিয়েছে। একেবারে হা তেল! জো তেল! বলে আর্তনাদ না উঠক, তেল। আনতে অনেকের বাড়িরই কড়া পড়ে যেতে শুরু করেছে, দোকানের কিউ দেওয়া লম্বা লাইনের কৃপায়।
সে মাসটায় মেসের ম্যানেজারি ছিল গৌরের ঘাড়ে। অতি কষ্টে মাসখানেকের মতো তেল কোথা থেকে সে জোগাড় করে এনেছে।
তিন হপ্তা না যেতেই ঠাকুর রামভুজের কাছে তেল বাড়ন্ত শুনে একেবারে খাদ্ধা।
ধমক খেয়ে রামভুজ আমতা আমতা করে জানিয়েছে যে তার কোনও কসুর নেই। বড়বাবুকে রোজ এক বাটি করে মাখবার তেল না দিতে হলে সে পুরো মাসটা নিশ্চয়ই চালিয়ে দিতে পারত।
আমরা একটা ফোঁটার জন্য মাথা খুঁড়ে মরছি, আর বড়বাবু রোজ বাটি বাটি তেল মাখছেন! বলে দেবে যে মাখবার তেল এখন থেকে নিজেই যেন জোগাড় করেন!
মেজাজ যত গরমই হোক তালে ভুল করবার ছেলে গৌর নয়। দোতলার সিঁড়ির ধারে দাঁড়িয়ে, কথাগুলো চাপা গলাতেই বলেছে।
তেতলার ঘরে সে আওয়াজ পৌছোবার কথা নয়। তবু সেদিন সন্ধে থেকেই ঘনাদা আমাদের ত্যাগ করেছেন। তাঁর সে আত্ম-নির্বাসন পর্বই চলে এসেছে আজ পর্যন্ত।
তারপর হঠাৎ যেন ভেলকিবাজিতে কোথা থেকে কী হয়ে গেল!
কার্যকারণ সূত্ৰ সন্ধান করতে গেলে গৌরের রেনকোটটাই মূল বলে ধরতে হয় বোধহয়। গৌরের একটা রেনকোট যদি না থাকত…
না, তা যদি বলি তা তা হলে রেনকোটটাই বা কেন, কার্যকারণ শৃঙ্খল খুঁজতে আরও বহুদুর তো যাওয়া উচিত।
বাংলাদেশে মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গল নামে দুটি অতুলনীয় টিম যদি না থাকত, বছরের পর বছর তাদের রেষারেষির পাল্লায় সারা দেশ যদি উত্তেজনার দোলায় না দুলত, লিগের হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতায় আগুপিছু হতে হতে দুই যদি একই পয়েন্টের কোঠায় এসে না দাঁড়াত, চ্যারিটি ম্যাচের সাতরাজার ধন মানিকের মতো দুর্লভ টিকিট শিশির ও গৌর দুজনেই যদি বহুজন্মের পুণ্যফলে না পেয়ে যেত, আর বৃষ্টির হুমকি দেওয়া এক বিকেলে দুজনে দুটি রেনকোট নিয়ে খেলার মাঠে গিয়ে উপস্থিত না হত, তা হলে গৌরের রেনকোটও হারাত না আর আমরাও ঘনাদার অভাবের দুঃখ ভুলতে রেনকোট উদ্ধারের উপায় ভেবেই সন্ধেটা জমাবার চেষ্টা করতাম না।
তব রেনকোট দিয়েই শুরু করা যাক।
গৌর সেদিন তার রেনকোটটা হারিয়ে এসেছিল। হারিয়েছিল মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গলের চ্যারিটি ম্যাচের খেলা দেখতে গিয়ে। মোহনবাগান এক গোল দিতেই উদ্বাহু হয়ে সে নৃত্য শুরু করেছিল, শিশিরের দিকে ক্ষণে ক্ষণে বিদ্ধপবাণ হানতে হানতে। ইস্টবেঙ্গল কয়েক মিনিট বাদেই সে-গোল শোধ করে দিতেই শিশিরের অসভ্যতায় বিরক্ত হয়ে অন্য জায়গায় সরে বসেছিল। শিশিরের সত্যিই বাড়াবাড়ি। ইস্টবেঙ্গল না হয় কেঁদে ককিয়ে একটা গোল শোধ করেই ফেলেছে, তাতে অমন হাত-পা ছোঁড়বার আর গাঁক-গাঁক করে চেঁচাবার কী আছে!
মোহনবাগান তারপর আর একটা গোল দিয়ে ফেলতেই নাচতে নাচতে গৌর শিশিরের কাছেই ফিরে এসেছিল। কিন্তু শিশিরের মনটা এমন ছোট ভাবতে পারেনি। মোহনবাগান জিতেছে বলে জায়গা ছেড়েই কি না সরে পড়েছে! খুশি না হয় নাই হলি, কিন্তু গৌরের ভাল ভাল শানানো কথাগুলো তো শুনতে পারতিস! সেটুকু খেলোয়াড়ি উদারতা—যাকে বলে স্পাের্টিং স্পিরিট—যদি না থাকে তা হলে খেলা দেখতে আসা কেন?
এরপর শিশির কোথায় গিয়ে লুকিয়ে বসেছে গৌর খুঁজে বার নিশ্চয়ই করত। তা-ই করবেই ঠিক করেছিল। হাজার হোক বন্ধুত্বের খাতিরে তাকে একটু উপদেশ দেওয়াও তো দরকার। সেই সঙ্গে ইস্টবেঙ্গল যে হারবে এ আর এমন বেশি কথা কী! বলে একটু সান্ত্বনা।
কিন্তু এর মধ্যে মেঘ নেই, জল নেই, হঠাৎ বজ্রাঘাত!
ইস্টবেঙ্গল কোথা থেকে ঝপ করে আবার একটা গোল দিয়ে বসল।
এ যে অফসাইড গোল সে-বিষয়ে অবশ্য সন্দেহ নেই। কিন্তু সে-তর্ক করতে গেলে তো শিশিরের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। ধেই-নৃত্য করতে করতে সে যে এই দিকেই এখন আসবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।
খেলা শেষ হতে তখনও মিনিট কয়েক বাকি। গৌর তবু আগেই চলে এসেছে মাঠ থেকে।
মাঠ থেকে ট্রামের লাইন পর্যন্ত আসতে আসতেই বৃষ্টি।
রেনকোটটা সম্বন্ধে খেয়াল হয়েছে সেই তখন। কিন্তু তাতে আর লাভ কী!
একেবারে সপসপে হয়ে ভিজে বাহাত্তর নম্বর বনমালি নস্কর লেনের দোতলায় আড্ডাঘরে পা দিয়েই শিশিরকে দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলেছে, কী রকম আক্কেল তোর! আমার ওয়াটারপ্রুফটা নিয়ে চলে এলি?
তোর ওয়াটারপ্রুফ! শিশির তাজ্জব, তোর ওয়াটারপ্রুফ আমি নিতে যাব কেন? আমার কি দুটো ওয়াটারপ্রুফ লাগে?
বাঃ, তোর পাশেই তো রাখা ছিল! গৌরের গলাটা আর তেমন কড়া নয়।
তার পাশে তো তুইও ছিলি! শিশিরের একটু যেন বাঁকা জবাব, মোহনবাগান গোল খেতেই গ্যালারির ফাঁকে গলে পড়েছিলি নাকি!
বাহাত্তর নম্বরও খেলার মাঠের মতো কাদা হয়ে ওঠবার ভয়ে ওয়াটারপ্রুফ রহস্যের সমাধানে আমাদেরও যোগ দিতে হয়েছে এবার।
ব্যাপারটা কী বুঝে নিয়ে নিজের নিজের মতামত ও পরামর্শ জানিয়েছি।
শিবু দার্শনিক মন্তব্য করেছে, খেলার মাঠে ওয়াটারপ্রুফ কখনও হারায় না। হারায়, আবার পাওয়া যায়।
কী রকম? গৌরের বদলে আমরাই অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছি।
কী রকম আবার? শিবু গম্ভীর ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে, ওই মাঠেই পাওয়া যায় একটু ধৈর্য ধরে থাকলে। রংটা, মাপটা হয়তো মিলবে না, কিন্তু পাওয়া যাবেই।
তার মানে আর কারুর ফেলে যাওয়া ওয়াটারপ্রুফ! তা-ই আমি নেব? গৌর জামা নিংড়াতে নিংড়াতে চোখ পাকিয়ে বলেছে।
ওই সব তুচ্ছ আত্মপর ভেদ খেলার মাঠে নেই। শিবু যেন বাণী দিয়েছে, কেউ হারাবে, কেউ পাবে, এই ওখানকার দস্তুর। হারিয়ে এসেও আফশোস করবে না, পেয়ে গেলেও নিতে কোনও সংকোচ করবে না। এক হিসেবে ওটা ওয়াটারপ্রুফ বদলাবদলিরই বাজার। নিজেরটায় অরুচি ধরলে ইচ্ছে করেই কেউ কেউ ফেলে আসে বলে আমার বিশ্বাস। নিজেরটা হারালে পরেরটা নিতে তো আর বিবেকে বাধবে না!
শিবু আরও হয়তো ব্যাখ্যান করত। কিন্তু গৌর তার ভিজে জামাটা শিবুর মাথাতেই নিংড়ে বলেছে, থাক, থাক, আর মাথা খাটিয়ে কাজ নেই। যা ফুলকি ছাড়ছে, এঞ্জিনই না জ্বলে যায়।
শিবুকে তখনকার মতো ঠাণ্ডা করে গৌর নিজের ঘরে গেছে জামাকাপড় ছেড়ে আসতে। ইতিমধ্যে বনোয়ারি ঝাল-মুড়ির গামলা রেখে গেছে মাঝখানের টেবিলে।
তাই চিবোতে চিবোতে চোখে যত জল ঝরছে, বুদ্ধি তত যেন খুলে যাচ্ছে মাথায়।
গৌর ফিরে আসবারও যেন তখন আর তর সইছে না।
সে ঘরে এসে ঢোকবামাত্র তাই আশ্বাস দিলাম, কোনও ভাবনা নেই। রেনকোট ফেরতই পেয়ে গেছ মনে করতে পারো!
যে ভাবে কেউ কপাল কুঁচকে, কেউ বা মুখ বাঁকিয়ে হেসে তাকাল, তাতে একটু ক্ষুণ্ণ হবারই কথা।
কিন্তু হৃক্ষেপই করলাম না। আমার মুশকিল-আসানে মোক্ষম দাওয়াই-টা একবার শুনলে মুখের চেহারা যে বদলে যাবে সে বিষয়ে আমার তো সন্দেহ নেই।
শোনবার পর তা-ই হল! সবাই একেবারে যাকে বলে হতবাক।
শিবু চোখ দুটো প্রায় ছানাবড়া করে জিজ্ঞাসা করলে, কী বললে?
প্রস্তাবটা আর একবার শুনিয়ে দিতে হল একটু বিশদ ব্যাখ্যা সমেত।
এমন কিছু কঠিন ব্যাপার নয়। শুধু কিছু হ্যান্ডবিল ছাপিয়ে খেলার মাঠে গিয়ে গেটে গেটে বিলি করা। হ্যান্ডবিলে লেখা থাকবে—
সাবধান! সাবধান!
ক্রীড়ামোদী জনসাধারণের অবগতির হেতু জ্ঞাপন করা যাইতেছে যে গত ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান প্রতিযোগিতার দিনে খেলার মাঠে একটি বর্ষা-ত্রাণ পরিচ্ছদ অনবধানতায় ক্রীড়াভূমির কাষ্ঠাসনে পরিত্যক্ত হইয়াছে। উক্ত পরিচ্ছদের অধিকারী কঠিন চর্মরোগে আক্রান্ত। সুতরাং ভ্রমক্রমে কেহ যেন সেটি ব্যবহার না করেন। করিলে রোগ তদ্দেহে সংক্রামিত হওয়া অবধারিত। পরিচ্ছদটি পুরাতন সংবাদপত্রে সতর্কভাবে আচ্ছাদিত করিয়া নিম্নলিখিত ঠিকানায় বাহকের দ্বারা বা ডাকযোগে প্রেরণ করিয়া জনহিতৈষণার পরিচয় দিন।
খানিকক্ষণ ঘরে আর টুঁ শব্দ নেই।
শিবুই প্রথম বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বললে, হ্যাঁ, এতেই কাজ হবে, নির্ঘাত কাজ হবে।
শিবুর সমর্থনে সন্তুষ্ট হয়ে তার দিকে চেয়ে একটু প্রসন্ন হাসি হাসলাম।
শিশির আমার দিকে বিস্ময়ভরেই বোধহয় খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বললে, হ্যাঁ, কাজ ঠিক হবে, তবে পুলিশ না করপোরেশনের লোক, কারা আগে আসবে তা-ই ভাবছি।
সুরটা কেমন ভাল লাগল না। একটু সন্দিগ্ধ হয়েই জিজ্ঞাসা করলাম, পুলিশ কি করপোরেশনের লোক আসবে, মানে?
না। শিবু আমায় আশ্বাস দিলে, শিশির ভুল করছে। এলে প্রথমে অ্যাম্বুলেন্সই আসবে।
অ্যাম্বুলেন্স! আমি বিমূঢ় আর সেই সঙ্গে একটু বিরক্তও বটে, আম্বুলেন্স এখানে আসছে কোথা থেকে!
কোথা থেকে আর! শিশির ব্যাখ্যা করলে, খোদ স্বাস্থ্যদপ্তর থেকে।
শিবু ব্যাখ্যাটা বিশদ করলে, গৌরকে ধরে নিয়ে গিয়ে ছোঁয়াচে রোগের হাসপাতালে নজরবন্দী করে রাখবার জন্যই অ্যাম্বুলেন্স আসবে। এরকম একটা সাংঘাতিক রুগিকে তো বাইরে রাখা নিরাপদ নয়।
একটা নয়, দুটো অ্যাম্বুলেন্সই তা হলে আসা উচিত। গৌরই মন্তব্য করলে, একটা যদি আমার জন্য হয় তা হলে আরেকটা এ-ইস্তাহার যাঁর মাথা থেকে বেরুচ্ছে তাঁর জন্য। সে-অ্যাম্বুলেন্স অবশ্য মেন্টাল হসপিটাল থেকেই আসবে।
এবার যে হাসির রোলটা উঠল তাতে যোগ দিতে পারলাম না। সংসারের ওপর আমি তখন বীতশ্রদ্ধ! সত্যিকার গুণের আদর যেখানে নেই, পরোপকারের নিঃস্বার্থ চেষ্টা যেখানে উপহাসের বিষয়, সে স্থান ত্যাগ করাই উচিত কিনা ভাবছি এমন সময় একটু যেন হন্তদন্ত হয়েই ঘনাদার প্রবেশ।
বিমূঢ়তার ধাক্কায় হাসির রোল থামতে না থামতেই শিশিরের ছেড়ে ওঠা আরামকেদারায় গা এলিয়ে দিয়ে নিজে থেকেই সাগ্রহে জিজ্ঞেস করলেন, কী, হাসি কীসের?
আমার তো বটেই, যারা এতক্ষণ হেসে ঘরের কড়িকাঠ কাঁপাচ্ছিল তাদেরও মুখের হাঁ আর বুজতে চায় না।
শিশিরই সবার আগে নিজেকে সামলে বললে, আজ্ঞে, হাসিটা কিছু নয়। আসলে আমরা একটা সমস্যা নিয়ে ভাবছি।
কী সমস্যা! ঘনাদা ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলেন সমস্যা ধরতে নয়, শিশিরের সিগারেটের জন্য। যথারীতি তাঁর মধ্যমা ও তর্জনীর মধ্যে সিগারেট স্থাপন করে লাইটার দিয়ে ধরিয়ে দিয়ে শিশির বললে, সমস্যা একটা বর্ষাতির।
ও, বর্ষাতির! বলে ঘনাদার অবজ্ঞাসূচক নাসিকাধ্বনিই আশা করেছিলাম— তার বদলে বেশ উৎসাহ ভরে তিনি বললেন, হ্যাঁ, বর্ষাতি একটা সমস্যা বটে। বিশেষ করে যদি ফুটন্ত জলের বৃষ্টি হয়। সেবার সেই হাওয়াই দ্বীপে কিলোইয়া ইকি মানে ছোট কিনলাইয়া আগ্নেয়গিরি হঠাৎ জেগে ওঠায় যা হয়েছিল!
ঘনাদার হল কী! এ যে মেঘ না চাইতেই জল! ফুটন্ত বৃষ্টি থেকেই গল্পের বন্যা বয়ে যেত বোধহয়, কিন্তু গৌর নেহাত বেরসিকের মতো বাগড়া দিলে।
সে বৃষ্টির কথা হচ্ছে না। আমার বর্ষাতিটা খেলার মাঠে হারিয়েছে…
গৌরকে কথাটা আর শেষ করতে হল না। ঘনাদা হারিয়ে পর্যন্ত শুনেই বলে উঠলেন, তা হারিয়ে যাবার কথা যদি বলো একটা বর্ষাতি হারানো তো কিছু নয়, সেবার নিউ গিনির কারাম্বা গাঁয়ে পুকপুক মানে কুমির শিকারে বেরিয়েছি…
রেনকোট হারিয়ে গৌরের আজ মাথার ঠিক নেই বোধহয়। ঘনাদাকে বাধা দেবারই তার যেন বেয়াড়া জেদ চেপে গেছে।
কুমিরের কথা আসছে কোথা থেকে! প্রায় যেন ধমকেই সে ঘনাদাকে থামিয়ে দিলে, শুনছেন বর্ষাতিটা ভুলে খেলার মাঠে ফেলে এসেছি। সেটা উদ্ধার করা যায় কিনা তা-ই সবাই ভাবছি। খবরের কাগজে একটা বিজ্ঞাপন..
গৌরকে আর এগুতে হল না। ঘনাদার যেন কুটো পেলেই আঁকড়ে ধরবার অবস্থা। বিজ্ঞাপনের ওপরই ঝাঁপিয়ে পড়লেন প্রায় চোখ কান বুজে—
বিজ্ঞাপন বড় গোলমেলে জিনিস হে। খবরের কাগজের একটা বিজ্ঞাপন থেকেই বেচুয়ানাল্যান্ডে অত বড় একটা চক্রান্ত সেদিন ধরা পড়েছিল।
গৌর এবারও বাদ সাধবার উপক্রম করছিল। দুদিক থেকে দুপায়ে শিবু আর শিশিরের কড়া ঠোক্কর খেয়ে তাকে থামতে হল।
গৌর থামলেও আর এক উপদ্রব আচম্বিতে দেখা দিল আড্ডা ঘরের দোরগোড়ায়। আমাদের বনোয়ারি। কাঁচুমাচু মুখে সে তার বার্তাটুকু জানাল—
বড়াবাবুকে একজনা নীচে বোলাইছে।
গৌরকে সামলাবার পর এমন ঘাটের কাছে এসে ভরাড়ুবি হতে আর আমরা দিই। পাছে ঘনাদা এই ফাঁকে ফসকে যান এই ভয়ে বনোয়ারিকে ধমক দিতে যাচ্ছিলুম, কিন্তু তার দরকার হল না।
ঘনাদা একবার বনোয়ারির দিকে কেমন একটু সন্ত্রস্তভাবে চেয়ে নিজেই গল্পের দড়ি ধরে যেন বেপরোয়া ঝুলে পড়লেন।
কী বলছিলাম? বিজ্ঞাপন? হ্যাঁ, বড় অদ্ভুত বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল জোহান্নেসবার্গের এক কাগজে। জোহান্নেসবার্গ কোথায় জানো তো? দক্ষিণ আফ্রিকায় ট্রান্সলের সব চেয়ে বড় শহর। শহর গড়ে উঠেছে সোনার খনির কল্যাণে। হিরেও আছে। শহরের দক্ষিণেই যে নিচু পাহাড়ের সার চলে গেছে তা সোনায় ঠাসা বলা যায়। শহরের নামটাও ওই সোনার সন্ধান থেকেই এসেছে। ১৮৮৬-তে জোহান্নেস রিসসিক বলে একজন ওলন্দাজ ছিলেন জরিপ বিভাগের কর্তা। তাঁর আমলেই সোনার খোঁজ ওখানে মেলে। তাঁর নামেই তাই শহর বসানো হয়।
মাটিতে যেখানে সোনা সেখানে মানুষের মনে সিসের বিষ। গায়ের চামড়া ধলা না হলে সে-দেশের মানুষ জন্তুজানোয়ারেরও অধম বলে গণ্য। ধলাদের রাজত্বে কালা আদমির মানুষদের মানুষ হয়ে বাঁচবার অধিকার নেই। তারা শুধু আছে ধলাদের খেতখামারে গোরু বলদের মতো খাটতে, খনির তলা থেকে ইদুরছুঁচোর মতো ধলাদের জন্য সোনা হিরে তুলতে। ধলাদের ছায়া মাড়ালেও কালাদের সাজা পেতে হয়। তাদের শহরের বাইরে ছাগলের খোঁয়াড়ের অধম বস্তিতে থাকার ব্যবস্থা। ধলাদের বাসে ট্রামে তারা চড়তে পারে না, ধলাদের দোকানে রেস্তোরাঁয় ঢুকতে তো নয়ই। ধলাদের জন্য আলাদা করে রাখা পার্কের বেঞ্চিতে শুধু হেলান দেওয়ার জন্য কালা মানুষকে হাজতে যেতে হয়েছে এমন দৃষ্টান্তেরও অভাব নেই।
দক্ষিণ আফ্রিকায় কালাদের ওপর ধলাদের জুলুমের সঠিক খবর আনবার জন্য এক মার্কিন কাগজের হয়ে তখন সেখানে গিয়েছি। পোর্ট এলিজাবেথ, ডারবান, কিম্বার্লি, প্রিটোরিয়া হয়ে শেষ পৌঁছেছি জোহান্নেসবার্গে। যা দেখবার শোনবার সবই দেখাশোনা হয়েছে, পাততাড়ি গুটিয়ে ফিরে এলেই হয়। এমন সময় সেখানকার কাগজে ওই বিজ্ঞাপনটি চোখে পড়ল। আফ্রিকানস ভাষার কাগজে। এ অঞ্চলের বেশির ভাগ ধলাই মূলে ওলন্দাজ। প্রায় চারশো বছর আগে যারা এসেছিল তাদেরই বংশধর। আফ্রিকানস ভাষাও সেই আদি ওলন্দাজি ভাষার অপভ্রংশ।
ছোট্ট বিজ্ঞাপন। খবরের কাগজের লাইন চারেক মাত্র। কিন্তু যেমন অদ্ভুত তার মর্ম তেমনই কালাদের ওপর অবজ্ঞা আর ঘৃণা মেশানো তার ভাষা। বিজ্ঞাপনটা কালাদের পড়বার জন্য অবশ্য লেখা নয়। পড়বে কে? ওখানকার কালাদের কাগজকালির সঙ্গে সম্পর্ক তো শুধু টিপসই দেওয়ায়।
কালা কুলিমজুরদের ঠিকাদারদের উদ্দেশেই বিজ্ঞাপনটা দেওয়া। তাতে লেখা সাতদিন জল না খেলেও মরে না এমন সুটকো চিমসে গোছের একটা কালা নফর চাই। কোনও ঠিকাদার সেরকম কাউকে ধরে আনলে পুরস্কার পাবে।
এরকম বিজ্ঞাপন দেখে আর ঠাণ্ডা থাকা যায়।
গেলাম ঠিকানা যা দেওয়া ছিল খাস শহরের সেই এলফ স্ট্রিটের অফিসে।
পোশাকটা কুলি মজুরের মতোই করেছিলাম। যেতে যেতে এ-শহরের যা এক বিশ্রী উপদ্রব সেই সাদা ধুলোর ঝড়ে পড়ে চেহারা আরও খোলতাই হয়ে গেল। জোহানেসবার্গের চারধারে সোনার খনির গুঁড়ো করা পাথর থেকেই এই ধুলোর পাহাড় জমে থাকে। ঝড়ের সময় তারই ধুলোয় সারা শহর অন্ধকার করে দেয়।
জোহান্নেসবার্গ শহরের রাস্তাগুলো যেন জ্যামিতি ধরে পাতা। পুব থেকে পশ্চিম আর উত্তর থেকে দক্ষিণের সোজা সোজা রাস্তাগুলো পরস্পর চৌকোণা করে কেটে গিয়েছে।
অফিসটা একটা ছোটখাটো তামাকের কোম্পানির। ঠিক এলফ স্ট্রিটে নয়, তার গা থেকে বার হওয়া একটি গলির মধ্যে।
আমাদের মতো কালা আদমির অবশ্য আসল অফিসে ঢোকবার হুকুম নেই। অফিসের পেছনের গোডাউনের ভেতরে গিয়ে দাঁড়াতে হল।
বিজ্ঞাপন চার লাইনের হলেও উমেদার খুব কম জোটেনি দেখলাম। ভরসার কথা এই যে বিজ্ঞাপনের ফরমাশের সঙ্গে তাদের প্রায় কারুরই মিল নেই। বেশির ভাগই শক্তসমর্থ চেহারা। রোগা পটকা যা আছে সবই বুড়োটে। সঙ্গে ধলা ঠিকাদার। পুরস্কারের লোভেই কপাল ঠুকে যা হাতের কাছে পেয়েছে, ঝেটিয়ে এনেছে।
আমার অনুমান ভুল নয়। এক এক করে ডাক পড়ে আর ভেতরে গিয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতেই বাতিল হয়ে বেরিয়ে আসে।
দেখতে দেখতে আমার পালা এসে গেল।
পাহারাদার গোছের যে জোয়ান লোকটা সবাইকে ডাক দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, আমার দিকে এবার সে ভুরু কুঁচকে ঠোঁট বেঁকিয়ে বললে, এই কালা ভূত! তোর ঠিকাদার কই? কার সঙ্গে এসেছিস?
আফ্রিকানস যেন বুঝি না এই ভাব দেখিয়ে হাঁ করে চেয়ে রইলাম। লোকটা আবার ভাঙা ভাঙা সোয়াহিলিতে প্রশ্ন করায় যেন ভয়ে ভয়ে বললাম, আজ্ঞে, একলাই এসেছি।
একলা এসেছিস! পাহারাদারের গলার আওয়াজে আর মুখের চেহারায় মনে হল আমায় নিয়ে যাবে, না বুটের ঠোক্কর দিয়ে বিদেয় করবে, ঠিক করতে পারছে না।
শেষ পর্যন্ত কী ভেবে ব্যাজার মুখে বললে, আয় তবু! আমার চেয়ে কর্তার গোদাপায়ের লাথির জোর বেশি।
গোডাউনের একধারে কাঠের পার্টিশন দেওয়া একটা মাঝারি মাপের ঘর। তারই ভেতর হাতের খাটো লাঠিটা দিয়ে পাহারাদার আমায় ঠেলে ঢুকিয়ে দিলে।
ভেতরে ঢুকে যে মূর্তিটিকে মোটা একটা চুরুট মুখে বেশ অস্থিরভাবে পায়চারি করতে দেখলাম তার জুড়ি পাওয়া ভার।
দেখলে সম্রম হওয়াই উচিত। আমাদের কিক্কড় সিং পালোয়ানের রংটা যদি ধবধবে হত আর চুলগুলো হত কোঁকড়া আর প্রায় গনগনে আগুনের মতো লাল, তা হলে খানিকটা বোধহয় মিল পাওয়া যেত।
পাহারাদার আমার পেছনে এসে ঘরে ঢুকেছিল। সসম্মানে এবার সে জানালে, কেলেটা একলাই এসেছে বলছে, হের ফিংক। চেহারাটা চিমসে দেখে নিয়ে এলাম।
মুখে চুরুট রেখেই হের ফিংক মেঘগর্জনের মতো আওয়াজে বললেন, ছুঁচোটাকে ধুলোর গাদা খুঁড়ে এনেছ নাকি? ঘরটা তো নোংরা করে দিলে!
আমার দিকে ফিরে হের ফিংক তারপর সোয়াহিলিতে ধমকের সুরে জিজ্ঞাসা করলে, সঙ্গে ঠিকাদার নেই কেন?
ঠিকাদার কোথায় পাব, বোয়ানা! মাটিতে যেন মিশিয়ে বললাম, সবে তো কাল কালাহারি পেরিয়ে কাজের খোঁজে শহরে এসেছি।
কালাহারি পেরিয়ে এসেছিস? ফিংক মুখ থেকে চুরুটটা নামিয়ে এবার একটু আগ্রহভরেই আমায় লক্ষ করে বললে, আসছিস কোথা থেকে?
তা কি জানি, বোয়ানা। সেখান থেকে আসতে অনেকগুলো সূর্যি আর অনেকগুলো চাঁদ আকাশে ঘুরে যায়। পাহাড় জঙ্গল ফুরিয়ে গিয়ে চারদিকে লাল কাঁকর আর বালি ধুধু করে…
থাম! বলে ধমকে আমার ঠিকানা জানবার চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে ফিংক এবার জিজ্ঞাসা করলে, সবে তো কাল এসেছিস, ঠিকাদারও কাউকে জানিস না। তবে
এখানকার কাজের খবর পেলি কেমন করে? তুই পড়তে জানিস?
ইচ্ছে করেই বললাম, হাঁ, বোয়ানা।
জবাব শুনে ফিংকের মুখখানাই প্রথমে হাঁ। তারপর যেন নিজের অজান্তেই তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, পড়তে জানিস তুই?
খুব জানি, বোয়ানা! যেন সবিনয়ে জানালাম, মাটিতে থাবার দাগ পড়ে বলে দিতে পারি সিম্বাটা মন্দা না মাদি, বুড়ো না জোয়ান, পেট ভরে খেয়েছে না খাবার খুঁজছে..
চুপ! চুপ! ফিংক বিরক্ত হয়ে কাছের টেবিলে রাখা খবরের কাগজটা দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, ওই রকম কাগজ পড়তে পারিস?
কাগজ! আমি যেন হতভম্ব, কাগজ পেলে তো আমরা পোড়াই, বোয়ানা!
আচ্ছা! আচ্ছা! বুঝেছি! ফিংক এবার তার আসল প্রশ্নে ফিরে এল, একাজের খবর পেলি তা হলে কোথায়?
ওই হেরেরা-দের বস্তিতে, বোয়ানা! সরল মুখ করে বললাম, এক ঠিকাদার ক-জনকে ডেকে খোঁজ নিচ্ছিল, তাই শুনেই চলে এলাম।
হুঁ! ফিংক চুরুটে টান দিয়ে কী যেন ভেবে নিলে। তারপর আমার দিকে চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, কালাহারির মরুভূমি পার হয়ে এসেছিস বলছিস?
হাঁ, বোয়ানা! কালাহারি পার না হলে এখানে আসব কী করে?
কদিন লেগেছে পার হতে?
তা তো বলতে পারব না, বোয়ানা। তবে কালাহারিতে পা দেবার আগে গোঁফদাড়ি কামিয়ে এসেছিলাম, এখানে পৌঁছে মুখে চার আঙুল জঙ্গল হয়ে গেছল। এখানকার নাপিতরা সে জঙ্গল…
আচ্ছা! আচ্ছা! বুঝেছি। বলে তাড়াতাড়ি আমায় থামিয়ে ফিংক বললে, কালাহারি যে পার হলি, তো জল পেয়েছিলি কোথায়?
জল! আমি যেন অবাক!
হ্যাঁ, জল! খাবার জল! তার কী করেছিলি?
কী আবার করব, বোয়ানা। খাইনি।
জল খাসনি! ফিংক আমায় বিশ্বাস করবে, না মিথুক বলে বুটের ঠোক্কর দেবে, যেন ঠিক করতে পারছে না।
বললাম, জল তো আমার তেমন লাগে না, বোয়ানা। চাঁদ খইতে খইতে যখন একেবারে মুছে যায় তখন একবার খাই আর বাড়তে বাড়তে পুরো থালা হয়ে ওঠে। যখন তখন একবার।
ভুরু কুঁচকে আমার দিকে খানিক তাকিয়ে থেকে ফিংক বললে, ঠিক আছে। তোর কথা সত্যি কি মিথ্যে হাতেনাতেই প্রমাণ হবে! শোন, আমার সঙ্গে ওই কালাহারিতেই তোকে যেতে হবে। প্রথমে আমার সঙ্গে যাবি মোটরে, তারপর এক জায়গায় তোকে ছেড়ে দেব। তোকে একলা গিয়ে কাজ হাসিল করতে হবে। কতদিন যে জল পাবি না, খাবার পাবি না তার কিছু ঠিক নেই। তা তুই তো জল খাস একবার পূর্ণিমায়, একবার অমাবস্যায়। তোর আর ভাবনা কী!
না, সে ভাবনা নেই, বোয়ানা। কিন্তু কাজটা কী যদি বলতেন!
এদিক ওদিক চেয়ে পাহারাদারকে পর্যন্ত চোখের ইঙ্গিতে ঘর থেকে বার করে দিয়ে ফিংক কাজটার কথা বলতে গিয়েও কী ভেবে আর বললে না। শুধু বললে, যা কাজ তা এখন শুনে কী হবে! কালাহারিতে গিয়েই বলব।
তা কী করে হয়, বোয়ানা। ভয়ে ভয়ে যেন নিবেদন করলাম, কাজটা না জেনে কী করে আপনার সঙ্গে যাই। সে পারব না।
পারবি না মানে! ফিংকের আসল মূর্তি এবারেই পুরোপুরি দেখা গেল। একটি বিরাশি সিক্কার চড় আমার গালে কষিয়ে হাতটা আবার রুমাল বার করে মুছতে মুছতে বললে, নচ্ছার কালা নেংটি। আমার মুখের ওপর বলিস কি পারব না! ঘাড় যদি আর বাঁকিয়েছিস তো দুমড়ে শুধু সিধে করব না, সোজা গারদে চালান করে দেব ট্যাক্স রসিদ নেই বলে। আছে তোর ট্যাক্স রসিদ? আছে পাস?
চড় খেয়ে একটা ডিগবাজি মেরে যেখানে পড়েছিলাম সেখান থেকে যেন কাঁদো কাঁদো মুখে গালে হাত বোলাতে বোলাতে বললাম, না, বোয়ানা!
তবে!হাত মোছা রুমালটা ঘরের কোণে ফেলে দিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে ফিংক বললে, ট্যাক্স রসিদ আর পাস ছাড়া এ-শহরের রাস্তায় তোর মতো কালো ছুঁচোর হাঁটবার পর্যন্ত হুকুম নেই তা জানিস না?
কথাটা সত্যি। দক্ষিণ আফ্রিকায় ধলাদের শয়তানি রাজত্বে আঠারো বছর বয়স হলেই কালাদের ওপর ট্যাকস ধরা হয়। সে ট্যাকস দেবার রসিদ আর পাস না নিয়ে শহরে ঘুরলে ধরা পড়লেই কয়েদ।
ফিংক এবার পাহারদারকে ডেকে বলে, আর যে কটা আছে, সব বিদেয় করে দাও। আর এ হতভাগাকে বেঁধে রেখে দাও এই ঘরে তালা দিয়ে। কিছুতে যেন পালাতে না পারে। আজ রাত্রেই ওকে নিয়ে রওনা হব।
তারপর আমার দিকে ফিরে সোয়াহিলিতে বললে, কী রে! আর ট্যাঁফু করবি?
ভয়ে যেন সিটিয়ে গিয়ে বললাম, না, বোয়ানা। এখন থেকে আমি আপনার জুতোর সুকতলা।
জুতোর সুকতলা হয়েই সে রাত্রে ফিংকের সঙ্গে রওনা হলাম তার জিপ গাড়িতে।
ফিংকের আসল মতলব যে শয়তানি গোছের কিছু তা তার রওনা হবার ব্যাপারের গোপনীয়তা থেকেই বোঝা গেল। আমায় ছাড়া আর একটা লোককে সে সঙ্গে নেয়নি। নিজে সামনে বসে জিপ চালাচ্ছে, পেছনে একরাশ খাবারদাবারের বাকস আর জলভরা ব্যাগের মাঝখানে আমি কোনওরকমে বসে আছি। খাবার আর জলের জায়গা ছাড়া একটা জাল দেওয়া সিন্দুক গোছের বাকসও আছে সেখানে। সেটা সম্পূর্ণ খালি বলেই রহস্যজনক।
জোহান্নেসবার্গ ছাড়িয়ে দুদিন দুরাত কালাহারির মরুর ভেতর দিয়ে যাবার পর সে বাকসের রহস্যটা পরিষ্কার হল। সেই সঙ্গে আমায় কী কাজের জন্য আনা তা-ও।
এতক্ষণ পর্যন্ত কালাহারির কুরুমান নদী ধরেই আমরা এসেছি। কালাহারির নদী মানে শুকনো খাত মাত্র। তাতে জলের বাম্পও নেই। কালাহারির আকাশে কখনও কখনও অবশ্য মেঘের ঘটা দেখা যায়, বৃষ্টি যে পড়ে না কখনও তা-ও নয়, কিন্তু সে ছিটেফোঁটাও পড়তে-পড়তেই যায় মিলিয়ে। তবে সত্তর বছর আগে একবার এই কুরুমান নদীতে নাকি অবিশ্বাস্য রকমের বৃষ্টিতে বান ডেকেছিল বলে গল্প আছে।
কুরুমানের এখনকার চেহারা দেখে সে গল্পে বিশ্বাস করা শক্ত। পৃথিবীর পুরোনো ঘায়ের দাগের মতো শুকনা মরা খাত যেন সৃষ্টির আদিকাল থেকে পড়ে আছে। এখানে-সেখানে একটা দুটো উটকাঁটার নিচু ঝোপ ছাড়া কোথাও প্রাণের লক্ষণ নেই।
তবু কালাহারির মতো মরুতে এই ধরনের মরা নদী দিয়ে যতদূর পারা যায় যাওয়াই সুবিধের।
এখানে তবু একটা চেনবার মতো রাস্তা পাওয়া যায়। এর বাইরে মরুভূমি তো দিকচিহ্নহীন অসীমতা। যেদিকে চাও, শুধু ছোট বড় বালিয়াড়ি। মাঝে মাঝে দু-একটা বেঁটে বাবলা জাতের শক্ত কাঁটাগাছ। কোথায় যে আছি তা জানবার উপায় নেই। সব দিকই এক রকম।
যতদূর পারা যায় কুরুমান নদীর শুকনো খাত দিয়ে এসে উইদ্রায়ই বলে একটা জায়গায় আমরা আবার আসল মরুতে উঠলাম। ফিংক অবশ্য জায়গাটার পরিচয় কিছু জানত না।
এ পর্যন্ত এটা-ওটা হুকুম করা আর যখন-তখন গালাগাল দেওয়া ছাড়া ফিংক আমার সঙ্গে কথাই বলেনি। খাবার যা সঙ্গে এনেছে তা থেকে দুবেলা গাণ্ডেপিণ্ডে খেয়েছে আর আমায় প্রায় ছোবড়া চুষতেই দিয়েছে বলা যায় হেলাফেলায়।
জুতোর সুকতলা হয়ে তবু সবই সহ্য করেছি শুধু তার গোপন শয়তানি মতলবটুকু জানবার জন্য।
কুরুমান নদীর খাত ছেড়ে ওঠবার পর তাকে বেশ একটু ভাবিত হয়ে ওদিক-ওদিক দূরবিন চোখে দিয়ে চাইতে দেখে বুঝলাম, জায়গাটা ঠিক ঠাহর করতে পারছে না।
যেন অত্যন্ত কাঁচুমাচু হয়ে বললাম, যদি ভরসা দেন তো একটা কথা বলি, বোয়ানা।
কী কথা? চোখ থেকে দূরবিনটা নামিয়ে ফিংক খিঁচিয়ে উঠল।
এ জায়গাটা আমি চিনি, বোয়ানা। এটার নাম ছিল উইতদ্ৰায়াই।
তুই কেমন করে জানলি? ফিংক বেশ সন্দিগ্ধ। আমার ঠাকুরদাদার কাছে শোনা, বোয়ানা। এখানে অনেক অনেক আগে একটা উটের কাফিলার সরাই ছিল। মরুভূমি পার হবার পথে জিরিয়ে নিতে এখানে থামত।
বটে! তোর ঠাকুরদা কি উট ছিল নাকি সে কাফিলায়? তাই জন্যই বুঝি জল না খেলে তোর চলে?
নিজের নীচ রসিকতায় ফিংকের সে কী বিশ্রী হাসি!
অম্লান বদনে সব হজম করে চুপ করে রইলাম। ফিংক দুরবিনটা আবার চোখে দিয়ে এদিক-ওদিক দেখে বললে, হ্যাঁ, উটের চোখে তুই ঠিকই চিনেছিস। এখন এখান থেকে তোকে একলা কাজ হাসিল করতে যেতে হবে। ভাল করে মন দিয়ে শুনে নে।
মনে মনে বললাম, তোমার এই কাজটা কী জানবার জন্যই জুতোর সুকতলা হয়ে এতদূর এসেছি, আর মন দিয়ে শুনব না!
মুখে বললাম, বলুন, বোয়ানা!
শোন, এখান থেকে পাঁচ দিনের হাঁটাপথে কীটমানসুফ-এ পৌছোবি। কীটমানসুফ-এ কী আছে, জানিস?
কীটমানসুফ নামটা শুনেই ফিংকের শয়তানি মতলবটা আঁচ করে মনে মনে চমকে উঠেছিলাম। বাইরে সেটা প্রকাশ না করে বললাম, কী আর থাকবে, বোয়ানা! ও অঞ্চলে সোনাদানা কি হিরে নেই বলেই শুনেছি।
ফিংক দাঁত বার করে হেসে বললে, ঠিকই শুনেছিস। সোনাদানা কি হিরের জন্য তোকে পাঠাচ্ছি না। তোকে ওখান থেকে আনতে হবে…
এক শিশি ডিউটোরিয়াম, মানে ভারী জল! ঘনাদার আগেই ফোড়ন কেটে বসল শিবু।
না, না, ইউরেনিয়ম যাতে থাকে সেই পিচব্লেন্ড খানিকটা। আমিই বা কম যাই কেন!
উঁহু! শিশির টেক্কা দিতে চাইলে, সেই যে নিরুদ্দেশ বৈজ্ঞানিক ওখানে লুকিয়ে থেকে ক্লোরোফিল তৈরি করছে, তার যুগান্তকারী ফরমুলা!
রেনকোট হারাবার বদমেজাজ গৌরের এখনও পুরো ঠাণ্ডা হয়নি। প্রায় যজ্ঞি নষ্ট করে সে বলে বসল, ঘোড়ার ডিম!
এর পর ঘনাদার মুখ আর সাঁড়াশি দিয়েও খোলা যাবে? সভয়ে তাঁর দিকে। তাকিয়ে আমরা সামলাবার হতাশ চেষ্টা করতে গিয়ে হতভম্ব হয়ে গেলাম।
কথাটা যেন কানেই যায়নি এমন ভাবে একবার শুধু বাইরের দরজার দিকে তাকিয়ে ঘনাদা নিজে থেকেই বললেন, না, ফিংক বললে, আনতে হবে দুটো ভেড়ার ছানা।
ভেড়ার ছানা! আমরা সবাই একেবারে পপাত ধরণীতলে। এত পেল্লয় পাহাড়-পর্বত গোছের ভনিতার পর নেংটি ইদুর!
হাঁ, স্রেফ দুটো ভেড়ার ছানা! ঘনাদা আমাদের মুখগুলোর ওপর চকিতে একবার চোখ বুলিয়ে বলে চললেন, ও-ই হল ফিংকের ফরমাশ। হাবাবোকা সেজে বললাম, কিন্তু ভেড়ার ছানা যদি ওরা না দেয়। শুনেছি ওখানে নাকি বড্ড কড়াকড়ি। ভেড়া তো ভেড়া, তার দুটো লোম ছিঁড়েও কারুর নিয়ে যাবার উপায় নেই। বাইরের কাউকে ভেড়ার পালের ত্রিসীমানায় যেতে দেয় না।
তা নয় তো কী তোকে আদর করে ডেকে নিয়ে গিয়ে কারাকুল ভেড়া ভেট দেবে হতভাগা! ফিংক খিঁচিয়ে উঠল, তোকে দুটো কারাকুল ভেড়ার ছানা যেমন করে হোক চুরি করে আনতে হবে এখানে! কালাহারি মরুভূমির ভেতর দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে যাবি আর তক্কে তক্কে থেকে ভেড়ার পাল যেখানে চরায় সেখান থেকে দুটো বেশ তাগড়া ছানা চুরি করে এই মরুভূমির ভেতর দিয়ে পালিয়ে আসবি।
কাঁদোকাঁদো মুখ করে যেন মিনতি করে বললাম, কিন্তু টের পেলে যে ওদের নেকড়ের মতো সব কুকুর লেলিয়ে দেবে, বোয়ানা, নয়তো গুলি করে মারবে। না, বোয়ানা, আমায় বরং অন্য কাজ দিন। আমি আপনাকে এক আজব পাহাড়ে নিয়ে যেতে পারি, বোয়ানা। নাম তার ব্রাকোরোটজ। এককালে তার মুখ থেকে আগুন ঠিকরে বেরুত। এখন নিবে গেছে।
ফিংক বেশ একটু অবাক হয়ে সন্দিগ্ধভাবে আমার দিকে চেয়ে বললে, ব্রাকোরোটজ আগ্নেয়গিরির নাম তুই জানলি কী করে?
ওই আমার সেই ঠাকুরদার কাছে, বোয়ানা। তিনিই আমায় হদিস দিয়ে গেছেন। সে পাহাড় যেখানে হাঁ করে আছে তার কাছে এমন জায়গা আপনাকে দেখাতে পারি যা খুঁড়তেনা-খুঁড়তে লাল নীল সবুজ ঝিলিক দেওয়া সব নুড়ি আপনাকে চমকে দেবে।
তার মানে চুনি, পান্না, নীলা! শিবুই চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞাসা করলে, সত্যি সত্যি ও সব পাওয়া যায় এমন জায়গা আপনি জানেন?
তা জানি বই কী! ঘনাদা মূর্তিমান বিনয় হয়ে বললেন, ইংরেজিতে যাদের নাম অ্যামেথিস্ট, ওপ্যাল, গার্নেট, টোপাজ বলে, সেসব পাথরেরও সেখানে ছড়াছড়ি। সে যাই হোক, আমার কথায় একবার একটু দোনামোনা হলেও ফিংক টলল না। ধমক দিয়ে বললে, থাম কালা ছুঁচো, তোকে আর লোভ দেখাতে হবে না! তোর ঠাকুরদার ভরসায় বুনো হাঁসের পেছনে আমি ছুটে মরি আর কী! আর তোর কথা যদি সত্যিই হয় তবু চুনি পান্না তো একবার বেচলেই ফুরিয়ে গেল। তার তো আর ছানাপোনা হয় না। আর এই কারাকুল ভেড়ার জোড়া পাওয়া মানে অফুরন্ত টাকার গাছ পোঁতা। যত দিন যাবে তত হবে তার বাড় আর ফলন।
তা বলে চুনি-পান্নার খনির কাছে ভেড়া! ঘনাদার কথার মাঝখানে শিবুর মুখ ফসকেই বুঝি বেরিয়ে গেল।
হ্যাঁ, খনিও যার কাছে লাগে না এমন ভেড়া। ঘনাদা ব্যাখ্যা করলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্লভ আর দামি ভেড়া হল পারস্যের। কারাকুল ভেড়া তার চেয়ে কম যায় না। একটা ভেড়ার দামই অন্তত পনেরো হাজার টাকা। কিন্তু সে ভেড়া বিক্রি হয় না। একজোড়া ভেড়ার একপাল হয়ে উঠতে ক-টা বছর আর লাগে! কারাকুল ভেড়ার ছানার পশমি ছাল কিনতে দুনিয়ার শৌখিন ধনকুবেররা পয়সার পরোয়া করে না। একশো বছরেরও আগে পারস্য থেকেই সবচেয়ে সরেস ক-জোড়া ভেড়া কালাহারি মরুর সীমান্তে আমদানি করা হয়। পালকদের যত্নে আর চেষ্টায় সেই ভেড়ার বংশ আজ পারস্যের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। এ ভেড়ার জাতের ওপর লোভ অনেকের। কিন্তু আইন করে কারাকুল ভেড়া চালান নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মালিকরা মূর্তিমান যম হয়ে তাদের ভেড়ার পাল পাহারা দেয়। দেবে না-ই বা কেন? দুটো ভেড়া সেখান থেকে সরাতে পারলেই কাম ফতে। ফিংক সেই শয়তানি মতলব নিয়েই এই কালাহারি মরুর বিপদ অগ্রাহ্য করে এখানে এসেছে। আসল কাজটা অবশ্য আমার মতো কাউকে দিয়েই হাসিল না করালে তার নয়। ছায়ার মতো নিঃশব্দে লুকিয়ে সে-মুল্লকের মজবুত তারের বেড়া দিয়ে গলে যাবার জন্য পাতলা ছিপছিপে হওয়া চাই। মরুভূমির দিকটাতেই তেমন ভয়ের কিছু নেই বলে পাহারা একটু আলগা। কিন্তু সেখান দিয়ে ঢোকা তো যার-তার কর্ম নয়। জল আর খাবার দুই-এর কিছুই অন্তত পাঁচদিনের পথে মিলবে না। সেসব লটবহর সঙ্গে বয়ে নিয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়। এমন কাউকে তাই চাই উটের মতো জল ছাড়াই অন্তত বেশ কিছুদিন যে টিকে থাকতে পারে। ফিংক এই সব ভেবেই ওরকম বিজ্ঞাপন দিয়েছিল।
আমায় এবার সে সোজা হুকুম দিলে, যেমন করে হোক কীটমানসুফ-এ গিয়ে ভেড়ার ছানার জোড়া চুরি করে আনতে।
যেন নিরুপায় হয়ে বললাম, কিছু খাবার জল তা হলে সঙ্গে দিন।
শুনেই ফিংক খাপপা—আরও কিছু চাই না? এই জিপ গাড়িটাও? সেই জন্যই সব নিয়ে এসেছি যে! হতভাগা কালা ছুঁচো। যেমন আছিস ঠিক তেমনিভাবে একখুনি রওনা হবি। তোর না একবার পূর্ণিমা আর একবার অমাবস্যায় জল খেলেই চলে! আমায় ধাক্কা দিয়েছিলি তা হলে?
ধাপ্পা কেন দেব, বোয়ানা! কাকুতি করে বললাম, কিন্তু একাজ হাসিল করতে পুরো চাঁদ থেকে পুরো আঁধারের বেশিও তো লাগতে পারে! আপনার তো অনেক আছে, শুধু একটা জলের বোতল যদি দিতেন।
একটি ফোঁটাও না! ফিংক গর্জে উঠল, তোর যদি বেশি দিন লাগে তো আমি এখানে আঙুল চুষব নাকি! তুই ওখানে গুলি খেয়ে মরলে আমায় ফিরে যেতে হবে না! তবে ওদিক দিয়ে পালাবার মতলব যদি করে থাকি তা হলে মরেছিস জানবি। এখানে আসার আগে আশেপাশে সব রাজ্যে তোর ওই সঁটকো চেহারার বর্ণনা দিয়ে খবর পাঠিয়ে দিয়েছি। খবর পাঠিয়েছি আমার টাকা চুরি করে পালিয়েছিস বলে। পালালে ধরা তুই পড়বিই। আর পড়লেই অন্তত সাতটি বছর জেলের ঘানি টানবি। বেঁচে থাকলে তাই তোকে ফিরতেই হবে এখানে।
ফিংক যে কতবড় শয়তান আগে বুঝিনি এমন নয়। তার আসল চেহারাটা এবার আরও একটু স্পষ্ট হল মাত্র।
ঘনাদা দম নেবার জন্য একটু থামতেই আবার আমাদের মূর্তিমান বনোয়ারি দরজায় এসে খাড়া। ভয়ে ভয়ে জানালে—
নীচে উ বাবু বড়া গোলমাল লাগাইসে!
বনোয়ারিকে কিছু বলব কী, ঘনাদা তার আগেই শুরু করে দিয়েছেন :
যেমন ছিলাম তেমনিই অগত্যা রওনা হয়ে পড়লাম। ফিরেও এলাম দিন দশেকের ভেতরই এক রাত্রে। সঙ্গে দুটো কারাকুল ভেড়ার ছানা।
ফিংক তো মহা খুশি। জাল দেওয়া যে সিন্দুকের মতো বাকসটা এনেছিল তার ভেতর ভেড়ার ছানা দুটোকে আমায় যত্ন করে ভরে রাখতে বলে কাজ হাসিল হওয়ার দরুন নিজেই ফুর্তি করতে বসে গেল।
কাজ সেরে তার কাছে যখন গেলাম তখন বাইরে বালির ওপরই শতরঞ্জি পেতে কাছেই উটকাঁটাঝোপ গাছের আগুন জ্বেলে সে নবাবি মেজাজে চব্যচোষ্য খাবার সাজিয়ে বসেছে। কতদিন এ কাজে লাগবে, না-জানায় ফুরিয়ে যাবার ভয়ে এতদিন জল আর খাবার যথাসম্ভব যা বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে আজ তার সদ্ব্যবহার করছে। নির্ভাবনায়।
কালাহারিতে অন্য মরুভূমির মতোই দিনের বেলা যেমন গরম, রাত্রে তেমনই কনকনে ঠাণ্ডা। দিনের বেলা থেকেই আকাশ মেঘে ঢাকা ছিল বলে সে রাত্রে ঠাণ্ডা একটু বেশি।
আগুনের কাছাকাছি গিয়ে বসে বললাম, আমার কাজ তো শেষ, বোয়ানা। এবার আমার বকশিশ।
হুঁ, তোর বকশিশটাই শুধু বাকি, খাবার চিবোতে চিবোতে পাশে রাখা রিভলভারটা হাতে করে নিয়ে ফিংক বললে, তোর জন্য খুব ভাল বকশিশই ভেবে রেখেছি।
যেন ধৈর্য ধরতে পারছি না এমনভাবে জিজ্ঞাসা করলাম, কী বোয়ানা?
তোর জন্য এখানে বালির তলায় যদি একটা ছোট্ট ঘর বানিয়ে দিই, কেমন হয়? অনেক ঘোরাফেরা করেছিস, খুব ধকল হয়েছে! একটু বিশ্রাম দরকার। সে ঘরে থাকলে আর তোকে নড়তে চড়তে হবে না। চিরকাল শুয়ে থাকতে পারবি। আমারও একটু সুবিধে হবে। তুই-ই এ ব্যাপারে একমাত্র সাক্ষী। তোর মুখ থেকে কথা বার হবার ভাবনা আর থাকবে না।
একেবারে গদগদ হয়ে বললাম, সে তো খুব ভাল কথা, বোয়ানা। শুনেই আমার আড়মোড়া ভাঙতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সুবিধের সঙ্গে একটু অসুবিধে যে আপনার হবে।
আমার অসুবিধে! রিভলভারটা তুলে আমার দিকে তাক করে ফিংক বিশ্রীভাবে হেসে বললে, আমার অসুবিধে তো শুধু মরুভূমিটা একলা পার হওয়া। সঙ্গে আমার কম্পাস আছে। তাই দেখে জিপের মুখও আমি ঘুরিয়ে রেখেছি। এখন শুধু নাক বরাবর চালিয়ে গেলেই দক্ষিণ রোডেশিয়ায় দিন দশেকের মধ্যে গিয়ে পৌঁছোব। সেখানে একবার পৌঁছেলে আর আমায় পায় কে!
কিন্তু সেখানে পৌঁছোনো তো দরকার! আমি যেন ফিংকের জন্যই ভাবিত, কম সময় তো নয়, দিন দশেক। দিন দশেক জল না খেয়ে কি আপনার চলবে?
জল না খাব কেন? ফিংক হায়নার মতো হেসে উঠল, এখনও কম-সে কম এক মাসের জল আমার গাড়িতে মজুদ।
না, বোয়ানা! অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানালাম, ভেড়ার ছানা ভরতে গিয়ে দেখি, সব জলের জায়গাগুলোই খালি। হয় ফুটো হয়ে পড়ে গেছে, নয় কেউ ফেলে দিয়েছে।
তুই! তুই জল যদি ফেলে থাকিস, ফিংক রিভলভার হাতে লাফিয়ে উঠল খ্যাপার মতোই, তা হলে একখুনি তোকে আমি…
গুলি করবেন। আমি ফিংসের কথাটাই পূরণ করে দিলাম, কিন্তু তা হলে বিপদ তো আরও বাড়বে, বোয়ানা। এই কালাহারিতে জলের সন্ধান যদি কেউ দিতে পারে তো আমি। জলের লুকোনো ঝরনা যদি না-ও মেলে তা হলেও এ-মরুভূমিতে যা দিয়ে তেষ্টা মেটানো যায় সেই বুনো তরমুজ সোমা কোথায় পাওয়া যায় আমিই আপনাকে দেখাতে পারি। আমায় গুলি করলে আপনার ফেরবার কোনও আশাই তো নেই।
রাগে দাঁত কিড়মিড় করলেও অবস্থাটা বুঝে নিজেকে সামলে ফিংক বললে, বেশ, গুলি তোকে করব না। তা হলে কী তুই চাস?
আর কী চাইব, বোয়ানা, একটু বকশিশ চাই!
কী বকশিশ? ফিংক উদার হয়ে উঠল, আমায় রোডেশিয়ায় ভালয় ভালয় পৌঁছে। দিতে পারলে তোকে এত টাকা দেব যে সারা জীবন আর তোকে খেটে খেতে হবে না। নিজের মুল্লুকে গিয়ে মোড়ল হয়ে বসবি।
আপনি মহানুভব! যেন কৃতার্থ হয়ে বললাম, কিন্তু আপনার বড় ভুলো মন, বোয়ানা। ওখানে পৌঁছে হয়তো হাত চুলকে উঠে গুলি করে বসবেন। আমি তাই বকশিশটা চাই নগদ।
কী বকশিশ, বল! ফিংক একেবারে কল্পতরু।
এমন কিছু নয় আমি একটু যেন লজ্জা লজ্জা ভাব করে নিবেদন করলাম, জোহাম্নেসবার্গে আমাকে যা দিয়ে ধন্য করে ছিলেন, তা-ই শুধু আপনাকে ফেরত দেবার হুকুম।
কী দিয়েছিলাম তোকে সেখানে? ফিংক বেশ একটু ভ্যাবাচাকা!
শুধু গালে একটা চড়, বোয়ানা! আমার গলা মিছরির মতো।
ফিংক যেরকম তিড়বিড়িয়ে উঠল তাতে রিভলভারটা বেকায়দাতেই ছুটে যেতে পারত। উট কাঁটা গাছের একটা জ্বলন্ত ডাল তার দিকে ছুঁড়ে আগেই তাই আমি একটু সরে গেছি। সেখান থেকে শোয়াঝাঁপ দিয়ে তার পা দুটো ধরে মাটিতে তাকে আছড়ে ফেলে রিভলভারটা কেড়ে নিলাম। তারপর বাঁ হাতে জামার কলার ধরে তাকে উঠিয়ে বসিয়ে যেন লজ্জিত হয়ে বললাম, একটা বড় ভুল হয়ে গেছে, বোয়ানা, একটা নয় দুটো চড়ই দুগালে আপনার দিতে হবে।
উট কাঁটার আগুন তখন ফিংকের চোখেই যেন জ্বলছে। শুধু আমার হাতের রিভলভারটার দিকে চেয়ে সে নাক দিয়ে এঞ্জিনের স্টিম ছাড়তে ছাড়তে চুপ করে রইল।
বললাম, একটা চড় দিতে হবে, বোয়ানা, যারা আপনার কাছে জন্তু-জানোয়ারের অধম এ-দেশের সেই কালো মানুষের হয়ে, আর একটা আমার নিজের জন্য।
তুই! তুই এ-দেশের লোক নয়! ফিংক সাপের মতো হিসহিসিয়ে উঠল।
না, বোয়ানা। আমার দেশের নাম মানুষের দুনিয়া। আপনার দক্ষিণ আফ্রিকা তার মধ্যে নেই।
চাবুকটা নিরুপায় হয়ে হজম করে ফিংক বললে, তা হলে তুই একাজে এসেছিলি কেন?
ওই আপনার অদ্ভুত বিজ্ঞাপনের টানে, বোয়ানা। একটা কিছু শয়তানি প্যাঁচ এর মধ্যে আছে সন্দেহ করে।
কিন্তু কালাহারির মরু তুই চিনলি কী করে? বিনা জলে দশ দিনের পথ গেলি-এলি কী করে? ভেড়ার ছানাও কেমন করে আনলি? ভয়-ভাবনা রাগের চেয়ে ফিংকের কৌতূহল তখন বেশি।
বকশিশ নেওয়া যখন পালিয়ে যাচ্ছে না, আর তা নেবার পর কানে শোনবার অবস্থা আপনার যখন না-ও থাকতে পারে, তখন প্রশ্নগুলোর জবাবই আগে আপনাকে দিয়ে নিই। এই কালাহারি মরু আমার কাছে নতুন নয়, বোয়ানা। এখানকার আদিবাসী হোটেনটটদের খোঁজ নেবার জন্য আগেও কবার এসেছি…
হঠাৎ গৌরের কাশিটা বড় বেয়াড়া হয়ে উঠলেও দাদা আজ আর ঐক্ষেপ না করে বলে চললেন, জল সঙ্গে না থাকলেও এ অঞ্চলের গোপন সব ঝরনা আমার জানা, আর তা-ও যেখানে নেই সেখানে যার কথা আগে বলেছি সেই সোমা অর্থাৎ বুনো তরমুজ খুঁজে বার করেই কাজ চালিয়েছি। ভেড়ার ছানা অবশ্য আমাকে চুরি করতে হয়নি। দক্ষিণ আফ্রিকার সব ধলাই আপনার মতো নয়। মানুষের রক্ত যাদের শরীরে বয় এমন দু-চারজনও আছে। কীটমানসুফ-এ এরকম একজনের সঙ্গে আমার একটু দোস্তি আছে। টাঙ্গানাইকায় একবার শিকারে গিয়ে আলাপ। তার ধারণা, এক খ্যাপা হাতির আক্রমণ থেকে তাকে আমি বাঁচিয়েছি। সেই বন্ধুর কাছেই আপনার কথা বলে কদিনের জন্য দুটো ভেড়ার ছানা ধার করে এনেছি। ইচ্ছে আছে কালই আপনার জিপ নিয়ে রওনা হব ফিরিয়ে দেবার জন্য।
ফিরিয়ে দেবে আগেই ঠিক করে রেখেছিলে! ফিংকের উন্নতি শুধু তুই থেকে তুমিতে। গলায় নইলে বিস্ময়ের সঙ্গে তেমনই পারলে ছিঁড়ে ফেলা আক্রোশের জ্বালা।
হ্যাঁ, বোয়ানা, আগেই ঠিক করেছিলাম। নইলে সত্যিই চুরি করে আনতে তো পারি না। কিন্তু আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। মেঘলা রাত। ঠাণ্ডা বাড়ছে। বকশিশটা নেওয়া এবার সেরে ফেলি।
নিজের হাতের দিকে চেয়ে একটু থেমে আবার বললাম, হাতে রিভলভারটা থাকলে আবার জুত হয় না।
রিভলভারটা ছুঁড়ে ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই ফিংক বুনো মোষের মতো আমার ওপর লাফিয়ে পড়ল।
তারপর প্রায় উটকাঁটার আগুনের ওপর পড়ল সচাপ্টে।
ডান গালের চড়টা একটু জোরেই হয়েছিল। তাড়াতাড়ি সেখান থেকে তাকে তুলে বাঁ গালে একটু আস্তেই মারলাম। শতরঞ্জির ওপর খাবার প্লেটগুলোর কয়েকটা ভাঙল।
সেইখানেই তাকে ফেলে রেখে জিপে গিয়ে একটা দড়ি নিয়ে এলাম। হাত আর পা দুটো তাই দিয়ে বাঁধতে বাঁধতে বললাম, এটা বকশিশের ফাউ। জোহানেসবার্গে যা দিয়েছিলেন কড়ায় গণ্ডায় শোধ না করলে চিরকাল ঋণী থাকব যে! রাত্তিরটা এখানেই কাটান। কম্বল ঢাকা দিয়ে যাচ্ছি। সকালে উঠেই কীটমানসুফ রওনা হওয়া যাবে। কী বলেন?
জবাবে ফিংক তার আফ্রিকানস ভাষায় কুৎসিত একটা গালাগাল দিলে শুধু। জিপ থেকে আর একটা কম্বল নিয়ে বেশ একটু দূরে একটা লুকোনো জায়গায় গিয়ে শুলাম। কিছুক্ষণ অন্তত জেগে থাকবার ইচ্ছে থাকলেও কদিনের ধকলে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না।
সকালে উঠে যা ভেবে রেখেছিলাম তাই হয়েছে দেখলাম। ফিকে রাত্রেই জিপ নিয়ে পালিয়েছে।
ফিংক পালাবে বলেই ভেবে রেখেছিলেন? শিশিরের হতভম্ব প্রশ্ন।
হ্যাঁ, সেই জন্যই বাঁধন এমন দিয়েছিলাম যাতে নিজেই ছিড়তে পারে?
ফিংককে তা হলে সেই ভেড়ার ছানা দুটো নিয়েই পালাতে দিলেন? আমার গলায় যেন আওয়াজই বার হতে হতে চায় না।
হ্যাঁ, তা-ই দিলাম, কিন্তু পালাবে আর কোথায়। তার কম্পাস আগেই বিগডে জিপটা একটু ঘুরিয়ে রেখে দিয়েছি। মেঘলা রাতে আকাশের তারাও দেখতে পাবে না দিক ঠিক করতে। জিপ নিয়ে নাক বরাবর সোজা গিয়ে উঠবে ওই কীটমানসুফ-এই। সেখানে তার জন্য অভ্যর্থনাসভা তৈরি। বমাল সমেত গ্রেফতার আর হাজত। নিজে নিয়ে গিয়ে ধরিয়ে দেবার ঝামেলাটা বাঁচালাম তাকে পালাবার সুযোগ দিয়ে।
হামি কী বলবে বড়াবাবু! নিরুপায় বনোয়ারির কাকুতি আবার শোনা গেল।
দেখো তো হে, কে আবার এসেছে জ্বালাতন করতে! ঘনাদা তাচ্ছিল্যভরে হুকুম করলেন আমাদের মুখের চেহারাগুলো পড়ে নিয়ে।
শিশির তা-ই দেখতেই গেল।
মিনিট পনেরো বাদে যখন ফিরে এল তখন ঘনাদা তার সিগারেটের টিনটা ভুলে পকেটে করে তাঁর টঙের ঘরে উঠে গেছেন।
ব্যাপার কী, শিশির? আমরা কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
বিশেষ কিছু নয়। শিশির নাকটা একটু ওপরে তুলে বাতাসটা শুকতে শুকতে বললে, ওই!
ওপর থেকে তখন পয়লা নম্বরের অম্বুরি তামাকের গন্ধ ভেসে আসছে।
ওই মানে? আমরা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ওই তামাকের গন্ধ?
হ্যাঁ! বড় রাস্তার তামাকের দোকান থেকে ঘনাদা সবচেয়ে সরেস অম্বুরি তামাক কবে বুঝি কিনে এনেছিলেন দামটা বাকি রেখে। তারপর ওধার আর মাড়াননি। আজ দূর থেকে তাঁকে দেখতে পেয়ে দোকানের মালিক পিছু পিছু এসেছে তাগাদা করতে। নীচে সে-ই গোলমাল করছিল।
তা তুমি কী করলে? আমাদের ব্যাকুল প্রশ্ন।
কী আর করব! তাকে খুশি করেই বিদেয় করতে হল। এ সব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে ঘনাদার শান্তিভঙ্গ তো আর করা যায় না। গৌরের রেনকোট যখন গেছে তখনই জানি ওর হিংসেতে একটা কিছু লোকসানের ফাঁড়া আমার আছেই।
গৌরের মুখে এতক্ষণে সত্যিই হাসি ফুটল।