সিলেটি জামাই

সিলেটি জামাই

– আমি বাড়ি যাবো।

ল্যাপটপের স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে চশমার উপরের ফাঁক দিয়ে আমি নোজাইফার দিকে তাকালাম। এইরকম চশমার ফাঁক দিয়ে তাকালে নিজেকে কেমন মাস্টারমশাই মাস্টারমশাই মনে হয়। সে বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে আছে আমার উত্তরের জন্য। কিন্তু আমি কিছু না বলেই আবারও ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে মনযোগ দিলাম।

– আমার কথা কি কানে যায়না?
– হ্যা যাও। কিন্তু তার আগে জোহা কে আমি মায়ের কাছে দিয়ে আসি।
– কেন, আমি কি আমার মেয়েকে রেখে যাবো না’কি। আর ও সেই বাচ্চা থাকতে একবার ওর নানুবাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল, আর তুমি নিয়ে যাওনি?

– ও যাবেনা। তোমার মনে নাই তোমাকে বিয়ে করতে গিয়ে তোমার মা আমাকে কি শর্ত দিয়েছিলেন?
– হ্যা। তারজন্য আমার মেয়ে ওর নানুবাড়ি যাবেনা?
– না, যাবে না।

বিছানার পাশে রাখা মোবাইলটা হাতে নিয়েই ফ্লুরের মধ্যে আছাড় মারল। আমি দুখণ্ড হওয়া মোবাইলটার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালাম। এটাও গেল। এই নিয়ে পাঁচটা মোবাইল ভেঙ্গে চুরমার করল নোজাইফা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে প্রতিবার সে আমার মোবাইলটাই ভাঙ্গে। একবারও নিজের মোবাইলটা ভাঙ্গেনি।

মেয়েকে রেখে তার নানুবাড়ি যাবার পিছনে বেশ বড়সড় একটা কারণ আছে। নোজাইফা বিয়ে করতে গিয়ে আমাকে বেশ কষ্ট করতে হয়েছে। কারণ ওর মা কোনো ভাবেই তার মেয়ে কে কোনো সিলেটি ছেলের কাছে বিয়ে দিবেন না। এদিকে আবার আমিও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম, কুমিল্লার মেয়ে ছাড়া বিয়ে করব না। শেষমেশ ওর মা এই ভেজালযুক্ত একটা শর্ত দিয়ে দিলেন। আর আমিও ভুল করে হ্যা বলে দিয়েছি। আমার শাশুড়ি আম্মার শর্ত অনুযায়ী উনার নাতিনাতনিরা যেন সিলেটি ভাষায় কথা না বলে।

যেন শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে। আর যদি শুদ্ধ ভাষায় কথা না বলতে পারে, তাহলে না’কি আমার সন্তান কে আমার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হবে। কিন্তু জোহা মামুনি কে কখনও শুদ্ধ ভাষায় কথা বলাতে পারিনি। শুদ্ধ ভাষায় কথা বললে সে সবসময় একটি কথাই বলে “ইতা কিজাত মাত মাতো তুমি, আমি কোনতা বুঝিনা। “(এসব কি কথা বলো তুমি, আমি কিচ্ছু বুঝিনা।) আর ঠিক সেই কারণে জোহা মামুনিকে নিয়ে কখনও ওর নানুবাড়ি যাওয়া হয়নি। বেশ ভয় হয় আমার। আবার ওর নানু কি থেকে কি বলে ফেলে এই ভয়ে। মেয়েটা সবেমাত্র ক্লাস থ্রিতে উঠেছে। এখুনি শুদ্ধ ভাষা শিখতে বেশ অসুবিধে হবে।

এমনিতেই বিয়ের পর একবারই গিয়েছিলাম ওই বাড়িতে। আর প্রথমেই চোর উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলাম। সে অবশ্য এক নির্মম একটা ঘটনা বলা যেতে পারে। আমি যখন ওই বাড়িতে যাই, তখন শাশুড়ি আম্মা আচার দিতেছিলেন। আমার আবার এক সমস্যা, আচার কিংবা চা দেখলে মাথা ঠিক তাকে না। ঠিক তাই হয়েছিল। আচার দেখার পর আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল।

এদিকে আবার নতুন জামাই বলে বলতেও পারছিলাম না, যে আমি আচার খাবো। শেষমেশ চোরি করে খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু আচারের বক্স গুলো ছিল শাশুড়ির আম্মার রুমে। তবে আমি হাল ছেড়ে দেয়ার পাত্র ছিলাম না। শেষমেশ চোরি করে খেতে গিয়ে ধরা খেয়েছিলাম। অবশ্য তার আগে এক বক্স শেষ করে ফেলেছিলাম। সেই করুণ কাহিণীর কথা আর না বলি। এসব শুনলে এখন চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হয়। চোখ থেকে চশমা খোলে চোখের জল মুছতে লাগলাম। শাশুড়ি আম্মার সেই লাঠি নিয়ে দৌড়ানোর দৃশ্য মনে হলেই আমার চোখ দিয়ে অটোমেটিক জল বেয়ে পড়ে। মনে হয় যেন এই আবার দৌড়ানি দিবে।

– আব্বা? দরজার দিকে তাকিয়ে দেখি জোহা মামুনি দাঁড়িয়ে আছে।

– কি মা?
– নানুবাড়ি আমারে লইয়া কিতা যাইতায় নায় নি?
– না, মা। এসব জায়গা ভাল না।
– ইতা কিতা কও। আমি আমার ফ্রেন্ড সবটিরে কইছি আমি নানুবাড়ি যাইরাম। আর তুমি ইতা কিতা মাতো? (এসব কি বল। আমি আমার ফ্রেন্ড সবকটিরে বলছি আমি নানুবাড়ি যাবো। আর তুমি এসব কি বলো।)

জোহা মামুনি আর কিছু না বলেই চলে গেল। আমি পরলাম মহাবিপদে। এখন দেখছি মেয়ে কে নিয়ে এবার যেতেই হবে। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। মা মেয়ে কোথায় ঘাপটি মেরে বসে আছে দেখা দরকার। ড্রয়িংরুমের সোফায় নোজাইফা আর জোহা দুজনে বসে আছে। তবে বেশ আগ্রহ নিয়ে টিভির দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে দুজনে ভয় পেয়ে আছে। তাদের আগ্রহ দেখে আমি নিজে টিভির দিকে তাকালাম। এখন আমার নিজেরই ভয় করতেছে। টিভির স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে ভৌতিক একটা ফিল্ম। আমি নোজাইফার দিকে তাকিয়ে বললাম…নোজাইফা? সে চিৎকার করে উঠল, সাথে জোহা মামুনি।

– ভয় করে, আবার ভৌতিক ফিল্ম দেখছো?
– তাতে তোমার কি?

অভিমান করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। এখন আবার অভিমান ভাঙ্গাতে হবে। অভিমান ভাঙ্গানো মানে ওদের কথা মেনে নেয়া। কিন্তু তাতো সম্ভব না। সেটা হলে আমার মেয়েটাই বিপদে পড়বে। না জানি ওর মা কি করে। এদিকে আবার পেটের ভেতরটা বেশ শব্দ করছে। ক্ষুধা লাগছে। আমার আবার সময়মতো খাবার না খেলে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা দেখা দেয়। আর বেশি সময় আমি ক্ষুধা নিয়ে থাকতেও পারিনা। নোজাইফার দিকে তাকিয়ে বললাম “ক্ষুধা লাগছে? ”

– টেবিলে খাবার রাখা আছে। যার ইচ্ছে খেয়ে নাও।
– তোমরা খাবে না?
– না। (দুজনেই একসাথে)
– তাহলে আমিও খাবো না।

সোফায় তাদের পাশেই বসে পড়লাম। এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। মেয়েটার অভিমান ভাঙ্গাতে এখানে থাকতে হচ্ছে। না হলে এদের জন্য অপেক্ষা করার কোনো মানেই হয়না। কিন্তু কি করার, বউ বাচ্চা রেখে একা একা খাওয়া, বড় বেইমানি হয়ে যায়।

– হইছে, আর ডং করতে হবে না খাবে চলো? আমি জোহা মামুনির দিকে তাকিয়ে বললাম। “জোহা মামুনি তোমার নানুবাড়ি কালকেই যাচ্ছি! কিন্তু তোমাকে আমি যা শিখিয়ে দিব, তুমি কিন্তু তাই বলবে?”

– আচ্ছা।

নোজাইফা আমার কথা শুনে এবার একটু হাসল। মনে হলো চিৎকার করে বলি তার সেই হাসিটার জন্য আমি বারবার চোর উপাধি পেতে রাজী আছি। কিংবা শাশুড়ির লাঠির দৌড়ানি খেতে। সারাটা রাত আমি জোহা মামুনিকে শুদ্ধ ভাষা শিখাতে লাগলাম। যারজন্য ঘুমাতে পারিনি একটুও। কিন্তু দুঃখের কথা হলো, আমার মেয়েটা একটাও শুদ্ধ ভাষা শিখতে পারেনি। সে এসব কে অশুদ্ধ ভাষা মনে করে। তার কাছে শুদ্ধ ভাষা হচ্ছে খাটি সিলেটি ভাষা। ট্রেনের সিটে বসে থেকেও আমি বারবার তাকে শুদ্ধা ভাষা শিখাচ্ছি। কিন্তু সে এসব শুনতে নারাজ। কিন্তু আমি হাল ছেড়ে দেয়ার পাত্র নই। জোহা মামুনির দিকে তাকিয়ে বললাম..

– মা, মনে আছেতো?
– কিতা মন থাকতো?
– বললাম না শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে হবে।
– আব্বা ইতা মন আছে। তুমি অত চিন্তা কররায় কেনে?
– আইচ্ছা, চিন্তা করতাম নায়।
– নানুবাড়ি কিতা বেশি দোরই নি?
– মা, বলো নানুবাড়ি কি বেশি দূরে?
– নানুবাড়ি কি বেশি দূরে?
– হ্যা, অনেক দূর।
– কতখান দোরই ?
– কতখান দোরই নায়, বল কত দূর?
– কত দূর?
– ২০০ কিলোমিটাররের উপরে।
– ইকান কিতা বিদেশর লাকান নি?
– না গো মাই, ইকান বিদেশ নায়। হক্কলতা জানিয়া তুই বেটি কিতা করতে, মুখ বন্ধ কইরা বইতাক।

আর কোনো কথাই বললাম না। আমি নিজেও মুখটা বন্ধ করে বসে রইলাম। এখন অপেক্ষা ছাড়া কোনো উপায় নেই। কিন্তু অপেক্ষার চেয়ে টেনশনটা বেশি হচ্ছিল। সামনে যে মহাবিপদের লক্ষণ সেটা তো এমনিতেই টের পাচ্ছি। কিন্তু সেই বিপদটা কিভাবে কাটাবো সেটাই চিন্তা করে খুঁজে পাচ্ছিনা।

শ্বশুরবাড়ির গেইটে আসতেই আমার শরীরটা কেমন কাঁপুনি দিয়ে উঠল। ওপাশে দেখা যাচ্ছে সেই লাঠি দিয়ে তাড়া করা শাশুড়ি কে, সাথে নোজাইফার ভাই কেও। আমি জোহা মামুনির হাতটা বেশ শক্ত করে ধরলাম। যা কিছুই হউক না কেন, আমার মেয়েটা যেনও আমার কাছেই থাকে। কিন্তু আমাকে ভেল্কি দিয়ে জোহা দৌড়ে ওর নানুর সামনে চলে গেল। আমি বুকের বাম পাশটায় ধরে দাঁড়িয়ে গেলাম। চিনচিন ব্যথা অনুভব হচ্ছে। জোহা ওর নানুর কাছে গিয়েই শুরু করল।

– আসসালামু আলাইকুম নানু?
– ওয়ালাইকুম আসসালাম।
– কিতা গো নানু কিতা কররায়? ভালাউলা আছনি? শাশুড়ির দৃষ্টি সোজা আমার দিকে। আমি ভয়ে নোজাইফার আড়ালে চলে গেলাম। জোহা মামুনি আবারো বলে উঠল..

– হুনরায় নি গো আমার কথা। তুমি মাতো না কেনে?(শুনতে পারছো আমার কথা। তুমি কথা বলো না কেন?) শাশুড়ি এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন…

– জামাই কি শর্তের কথা ভুলে গেছো?
– জ্বি না আম্মা।
– শর্ত মোতাবেক মেয়েকে ভুলে যাও, আর একশো বার কান ধরে উঠবস করো। কথাটা শুনা মাত্রই আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। আমিই মনে হয় প্রথম কোনো জামাই যে কি না শ্বশুরবাড়ি এসে লাঞ্ছিত হয়েছি। তখনি নোজাইফা এসে কথা বলা শুরু করল।

– মা, তুমি এটা করতে পার না।
– তুই কম কথা বলবি। আরে জামাই দেড়ি করতেছো কেন? (ধমক দিয়ে)

আমি হাতে থাকা ব্যাগপত্র নীচে রাখলাম। পুরো প্রস্তুতি নিয়ে একটু সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। যখন কানে হাত দিতে যাবো, তখনি ঘটে গেল ঘটনা। জোহা মামুনি ওর নানুর কোলে উঠে উনার চুল ধরে টানাটানি করতে লাগল আর বলতে লাগল “অই বেটি বুইড়া নানি, তর কতবড় সাহস তুই আমার আব্বারে কানে ধরাস। চুল নো টাইন্না ছিরিলিমু, ছিনছ নি আমারে?”

মেয়ের কাণ্ডকারখানা দেখে আমি অবাক হয়ে গেছি। এমনকি নোজাইফা নিজেও। জোহা যে এইরকম কিছু করবে, সেটা আমার কল্পনাতেই ছিলনা। কিন্তু তারপর ঘটে গেল করুণ ঘটনা। বাপ বেটির জায়গা হল বন্দিশালায়।
একটা রুমের মধ্যে দুজন কে আটকে রাখা হল। আর দুজনকেই দুইটা বাংলা ব্যাকরণের বই দেয়া হল।
আমি জোহার দিকে তাকালাম, সে এখনো রেগে আছে। তার হাতে এখনো কিছু সাদা চুল লেগে আছে। বাবার জন্য মেয়ের এইরকম কষ্ট দেখে মনটা ভরে গেল। আমি মেয়েটা কে কোলে নিয়ে বসে আছি। শাশুড়ি মা এই নিয়ে তিনবার জানালা দিয়ে দেখে গেছেন। আমার সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। এখান থেকে কিভাবে বেরুনো যায় সেটাই চিন্তা করতেছি। কিন্তু এখানের তো কিছুই আমি চিনিনা। এখান থেকে বেড়িয়ে তো কোনো লাভ নেই। এসেছিলাম জামাই আদরের জন্য। আর এখন দেখছি কপালে অন্যকিছু আছে।

চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেছে। এই বন্দীশালায় এখনো বাবা মেয়ে পড়ে আছি। একটু আগে অবশ্য নোজাইফা এসে খাবার দিয়ে গেছে। কিন্তু আমি খাই নাই, আর না জোহা খেয়েছে। মেয়েটা না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ছে। বেশ কষ্ট লাগছে এখন। শাশুড়ির পাল্লায় পরে আমার মেয়েটা আজ না খেয়ে ঘুমালো। ইচ্ছে করতেছে শাশুড়ির মাথাটা না নেড়া করে দিয়ে আসি। কিন্তু এখন আর কি করার আছে। সারাটা রাত আমি জেগে ছিলাম, ঘুমাই নাই। ফজরের আযানের পর এই রুমের পশ্চিম জানালা ভেঙ্গে কেউ একজন ঢুকল। আমি বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। চিৎকার করতে যাচ্ছিলাম, তখনি আমি নোজাইফা কে দেখতে পাই।

– তাড়াতাড়ি চলো..

জোহা কে কোলে তোলে জানালা দিয়ে বাইরে আসলাম। তারপর দিলাম এক দৌড়। আমার দৌড়ের ঝাঁকুনিতে জোহা ঘুম থেকে উঠেই বলল “আব্বা আমরা ভাইগগা যাইরাম কেনে?” নোজাইফা বলল “এ বেটি কম মাত ছাইন। হেসে নো আম্মায় হুনিলিবা।”( এই মেয়ে কম কথা বল। পরে আম্মা শুনতে পাবেন।)

এই প্রথম নোজাইফার মুখে সিলেটি ভাষা শুনে প্রাণটা জোড়াইয়া গেল। আমি দৌড়াতে দৌড়াতে পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখি শাশুড়ি আম্মা লাঠি নিয়ে দৌড়ে আমাদের দিকে আসছেন। সেটা দেখার পর স্পিড বেড়ে গেল। আমার গন্তব্য রেলস্টেশন। যে করে হউক ভোরের ট্রেন ধরতে হবে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত