— ব্যাগপত্র গুঁছিয়ে নিও ।এক ছাদের নিচে থাকাটা আর সম্ভব হচ্ছেনা ।আরেকটা কথা আমি সেপারেশনের সকল প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছি। এই বার ফাইনালি সেপারেশন নিয়ে নিতেই হবে। বিবাহিত জীবনের বছর চারেক না পেরুতেই এমনটা মনে হলো আলিফের । আজকাল আমাকে নাকি ওর কাছে বিদঘুটে মনে হয় ! আমাকে দেখতে এখন আর ভালো লাগেনা ওর ! আলমারির দ্বিতীয় তাক এ এখন আর ওর দেওয়া শাড়ি জমা হয় না আমার জন্য ! পুরোনো শাড়িগুলোর ভাঁজ, ফ্যাকাসে রঙ ধারন করেছে ঠিক আমার ই মত।
–সেপারেশন ? কেবল একটাই প্রশ্ন করলাম ওকে।আর কিছুই বললাম না। সেপারেশনের কারণটা জানতে চাইতে বললো,
— মা হওয়ার যোগ্যতা রাখো না আবার কোন মুখে কারণ জানতে চাও ? কম তো ডাক্তার দেখাও নি ! কাজের কাজ কিছুই তো হলো না।ইদানিং মনে হয়, তোমার সাথে সংসার করলে আমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তার জন্য আমার সেপারেশন চাই ।
— মা ? হতে পারলাম না তো ! আসলেই বোধহয় তোমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার ! ইজি চেয়ার থেকে উঠে আলমারির ভেতর থেকে সাইড ব্যাগটা বের করতে করতেই বললাম।
–এত কি খুঁজো সাইড ব্যাগে ? ব্যাগটা গুঁছিয়ে নিতে এত সময় লাগে ? বেশ বিরক্ত হয়ে আলিফ আমায় বললো।
–নাগো । আজ আর ব্যাগটা গুঁছিয়ে নিতে হবেনা । জিনিসপত্র গুলো বরং রেখেই দাও । এই শাড়িগুলোর প্রয়োজন না হলেও যদি কোনো একসময় তোমার এই ব্যাগটার প্রয়োজন পড়ে ! অতঃপর চলে এলাম বড় ভাইয়ার কাছে।মা বাবা কেউই বেঁচে নেই । তাই ভাইয়ের কাছে আশ্রয় নিতে হলো আমাকে।তখন পর্যন্ত আমাদের ডিভোর্স হয় নি। কাঁঠালি রঙের শাড়িটার ভাঁজ খুলে আজ রোদে দিলাম।আলিফের কাঁঠালি রঙটা খুবই প্রিয় !
আজ প্রায় মাসখানেক পর হুট করে বিকালে আলিফের ফ্ল্যাটে গিয়ে পৌঁছালাম। কারণ ওর অফিস ছুটি হয় বিকাল ৫টায়।ওকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিলো।চার বছরের সংসার ছিলো।সংসার জীবনের মায়া বলতেও একটা কথা আছে।আর ওকে একটা প্রয়োজনীয় নিউজ দেওয়ার জন্যই ছুটে আসা। যথারীতি কলিংবেল চাপতেই ওপাশ থেকে দরজা খুলে দিলো।হাসিমুখে মাথা উপরে উঠিয়ে তাকাতে অবাক হলাম ! কারণ সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো এক অপরিচিত মেয়ে ।
–কাকে চাই ? অপরিচিত মেয়েটা আমায় প্রশ্ন করলো ।
–আলিফ আছে ? ঝাপসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে মেয়েটাকে প্রশ্ন করলাম।
–কে আসলো তিথী ? ভেতর থেকে পুরুষকণ্ঠে প্রশ্নটা আমার কানে ভেসে আসলো।
–দেখো আলিফ, তোমার কাছে কেউ একজন এসেছে। মেয়েটা আলিফকে ডেকে বললো।
–তুমি ? আলিফ ভেতর থেকে এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আমায় প্রশ্ন করলো।
–হ্যাঁ আমি । মেয়েটা কে গো ? জানার কৌতুহল নিয়ে ওকে প্রশ্ন করলাম।
–ভাবছি তোমাকে ডিভোর্স দেওয়ার পর বিয়ে করবো আমরা দু’জন । দেখেছো তো মেয়েটার চোখের নিচে তোমার মত কালি পড়ে নি । বেশ স্বচ্ছ ওর চাহনি ! হাসিটাও খুব মিষ্টি ! আর খুব সুন্দর করেই কথা বলে । দেখতে উনিশ/কুড়ি বয়সের লাগে।আর তোমাকে তো .. আচ্ছা যাই হোক,আমার জন্য ঠিক তো মেয়েটা ? উপহাস এর হাসি হেসে আমায় বললো আলিফ।
–সাইড ব্যাগটাতে তোমার একটা জিনিস ছিলো । সেটাই দিতে আসলাম ।
–লাগবেনা । বাইরে রাখা ময়লার ঝুড়িটাতে ফেলে দিও। আমার জিনিস তো ? ওটা তোমার কাছে থেকে আবর্জনা হয়ে গেছে । ওটার জন্য ময়লার ঝুড়িটাই সঠিক জায়গা ।এই কথা বলে আলিফ দরজা বন্ধ করে দিলো।
চলে আসলাম ওর ফ্ল্যাট থেকে । মনের ক্ষত, জিনিসটা বুঝি এমন ই হয় ? না কাউকে দেখানো যায় না হজম করা যায় ! বাড়িতে এসে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলাম।অমানুষের জন্য কষ্ট পেয়ে লাভ নেই।তার থেকে ভালো সেপারেশন হয়ে যাওয়া।যাকে বলে মিউচুয়াল সেপারেশন ! সেদিন থেকে আমরা আলাদা থাকতে শুরু করি।এই কয়েক মাসে আলিফ আমার কোনো খোঁজ খবর নেয়নি।অপেক্ষায় ছিলাম, যদি একটিবার ও দেখতে আসে । কিন্তু আসেনি ।
কাচের টুকরোর মত খন্ড খন্ড হয়ে যাচ্ছে আমাদের চারবছরের সংসার। লিখিতভাবে সেপারেশন না হলেও মনের দিক থেকে অনেক আহেই আলাদা হয়ে গেছি আমরা দু’জন। অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়ে গেলো। সেদিন হুট করেই রাস্তায় তার সাথে দেখা।সেই অপরিচিত মেয়েটি , যাকে আলিফ বিয়ে করার কথা বলেছিলো।কাছে গিয়ে থমকে যাই ! সেই উনিশ/কুড়ির মেয়েটাকে আজ কেমন বয়স্ক মনে হচ্ছে ! চোখের নিচে কালিও পড়ে গেছে !
–কেমন আছো ? এক অজানা কষ্ট বুকে চেপে রেখে মৃদু হাসিতে প্রশ্ন করলাম মেয়েটাকে ।
–ভালো । তুমি ? মেয়েটা আমায় প্রশ্ন করলো।
–আলিফ কেমন আছে ? আমি কেমন আছি সেটা না বলে অমানুষটার কথা জিজ্ঞেস করলাম।জানিনা কেন জানি খুব জানতে ইচ্ছে করছে, আলিফ কেমন আছে কথাটা !
–জানিনা ।আলিফের সাথে আমার যোগাযোগ নেই ।
–তোমরা তো বিয়ে করার কথা ছিলো,তাইনা? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম !
–সাইকো টাইপের লোক’কে বিয়ে করা যায় ?বিয়ের আগে থেকে ওর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা আমার উপর !
–আলিফ এখন কোথায় ?
–দেখো গিয়ে আবার কয়জনকে বিয়ে করার কথা বলে বেড়াচ্ছে ! ইডিয়ট একটা লোক ।আলিফকে আরও কয়েকটা গালাগাল দিয়ে মেয়েটা চলে গেলো আমার সামনে থেকে। অন্য কারো মুখ থেকে প্রিয় মানুষের সম্পর্কে কটু কথা শুনতে কারো ভালো লাগেনা।আমারও লাগে নি।প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারিনি । যোগ্যতার প্রশ্ন চলে আসবে সেই ভয়ে ! হঠাৎ সেদিন আলিফ খালার বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়।আমি আলিফকে দেখে থমকে যাই ! সেই চেনা মুখ, চেনা চাহনি ! আলিফ আমাকে দেখে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় ।
–তুমি এখানে কেন ? কিছুক্ষণ পর আমি ওকে প্রশ্ন করি ।
–মা , তখন থেকে তোমাকে খুঁজছি । কোথায় গিয়েছো তুমি ? এই আঙ্কেলটা তোমার কাছে এসেছে । তৃণা আমার পাশে দাঁড়িয়ে একদমে কথাগুলো বলে শেষ করে আবার ভিতরে চলে গেলো।
–তোমার মেয়ে ?আলিফ আমায় জিজ্ঞেস করলো।
–হু , আমার মেয়ে ।
–ভাইয়ার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে এখানে আসা। আসলে তোমায় খুব দেখতে ইচ্ছে করছিলো । মেয়েটা তোমাকে মা বললো কেন ?
–আমি যে ওর মা, তাইতো আমাকে মা বলেছে।
–মা মানে ? কি নাম ওর ?
–তৃণা ।
শোন আলিফ, তখন যদি একবার খোঁজ নিতে তাহলে জানতে পারতে যে তোমার একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তান হয়েছিলো । কিন্তু তুমি তো মোহ এর ঘোরে ছিলে ।
হ্যাঁ তোমার ফ্ল্যাট ছেড়ে যখন চলে আসি তখন আমি দেড়মাসের অন্ত:সত্বা ছিলাম।কিন্তু তখন পর্যন্ত আমি সেটা জানতাম না।পরে ডাক্তারের সাথে বিস্তারিত আলাপ করে বিভিন্ন চেকআপের মধ্যে দিয়ে জানতে পারি, আমি অন্ত:সত্বা।
ওর জন্মের আগে ছুটে গিয়েছিলাম তোমার কাছে কিন্তু কিছুই বলতে পারিনি।বলার জন্য ছুটে গিয়েছিলাম তোমার ফ্ল্যাটে।আর সাইড ব্যাগে ছিলো প্রেগন্যান্সি রিপোর্ট ! সেদিন তুমি আমাক বলার সুযোগ দাও নি।আবর্জনা বলে ডাস্টবিনে ফেলে দিতে বলেছিলে সেই রিপোর্ট !
মনে পড়ে ?
–হ্যাঁ , মাথা নিচু করে আলিফ আমার প্রশ্নের উত্তর দিলো ।
— আলিফ, আর কিছু বলার আছে তোমার ?
–আমি জানিনা , আমি কিভাবে ক্ষমা চাইবো ! আদৌ আমি ক্ষমা পাওয়ার উপযোগী কিনা ! তারপরেও একটা কথা বলতে চাই, ফিরে চলো মৃদুলা ।
–তুমি বরং তোমার মত ই থাকো,আলিফ । যেটা তুমি নিজেই চেয়েছিলে। এখন তোমাকে খুব অপরিচিত মনে হয় ! মনে হয়, তুমিই বা আমার কে ? এককালের পরিচিত ছাড়া কিছুই মনে হয়না তোমাকে । তখন এতটা মানসিক আঘাত পেয়েছিলাম তোমার থেকে যেন নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না।কিন্তু তোমাকে বলতে পারিনি।বললে হয়তো অলিখিতভাবে আমাদের মিউচুয়াল সেপারেশন টা হতো না ! আর আমিও জানতে পারতাম না মুখোশের আড়ালে তোমার কোন রুপ বিদ্যমান ? তুমি তো আমাকে ভালবাসনি আলিফ ! আমি একজন মুখোশধারী লোকের সাথে চারবছর সংসার করেছি ! ভাবতেই অবাক লাগে !
–এই সমাজে তুমি একা পারবে তো তৃণাকে মানুষ করতে ?আমার পরিচয় দেওয়া ছাড়া তুমি তৃণাকে বড় করতে পারবে তো ?
–বাবার পরিচয় নিয়ে বড়াই করছো ? আমার পরিচয়ে আমার মেয়ে বড় হবে । যেই সংসারে পিতা নামক ব্যক্তি বেঁচে নেই সেই সংসারের সন্তানরা কি অমানুষ হচ্ছে ? বরং তারা মর্মান্তিক পরিস্থিতি এবং বাস্তবতার সম্মুখীন হয়ে সঠিক মানুষ হিসেবে ঠিকই গড়ে উঠছে ।
–তুমি যদি আমার সাথে ফিরে না যাও বা এই রকম আচরণ করতেই থাকো তাহলে কিন্তু আমি আমার মেয়েকে নিয়ে যাবো ।
–ভয় দেখাচ্ছো ? আমার কাছ থেকে তুমি তৃণাকে জোর করে নিয়ে যেতে পারবে না।একজন নারী শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তার সন্তানকে আগলে রাখার অসীম ক্ষমতা নিয়ে মা হন। আর তুমি তো এখানে ক্ষমার জন্য আসোনি।এসেছো নিজের ক্ষমতা দেখানোর জন্য ! আর শোনো , তোমাকে সেপারেশন নিয়ে আর ভাবতে হবেনা । এবার সত্যি তোমার মত অমানুষকে ডিভোর্স দেওয়ার সময় হয়েছে। অনেকটা সময় পেয়েছিলে, কিন্তু আফসোস নিজেকে ঠিক করতে পারলে না।