মৌ-কা-সা-বি-স ও ঘনাদা
না, অনুমানে আমাদের ভুল হয়নি।
একটু ধৈর্য ধরে ক-দিন অপেক্ষা করার পরই আমাদের আশা পূর্ণ হল। চিঠির বাকসটা আমিই খুলতে গিয়েছিলাম। বাকস খুলে চিঠি একটাই পেলাম। কিন্তু সেই একটা চিঠির জন্যই আমাদের এ ক-দিনের এমন হা-পিত্যেশ করে বসে থাকা—
চিঠিটা হাতে পেয়ে খুলে পড়বার আর দরকার হয়নি। ওপরে নামটা যা লেখা আছে সেইটুকুই তখন যথেষ্ট।
সেই নামটুকু দেখে নিয়েই সোজা ওপরে ছুটে গেছি। না, আমাদের আড্ডাঘরে নয়। এই ভরদুপুরবেলা সে জায়গাটা এক রকম নিরাপদ হলেও, সাবধানের-মার-নেই বলে, সটান গৌর আর শিবুর কামরাতেই বেশ একটু হাঁফাতে হাঁফাতে গিয়ে ঢুকেছি। হাঁফানোটা অবশ্য সবটাই সিঁড়ি দিয়ে এক-এক লাফে দুটো করে ধাপ পেরিয়ে আসার জন্য নয়। ব্যাপারটার গুরুত্ব বোঝানোর জন্য ওটা একটু বাড়তি অভিনয়।
সে অভিনয়টুকুর অবশ্য দরকার ছিল না।
শিবু বাদে গৌর আর শিশির দুজনেই তখন সে ঘরে গৌরের খাটের ওপর বসে দেখা-বিন্তি খেলছে।
আমায় ঢুকতে দেখেই তারা বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, এসেছে! এসেছে তাহলে?
আমার চোখমুখের উত্তেজনা আর বাড়তি হাঁফানিটুকুর জন্য নয়, আমার হাতের লেফাফাটিই তাদের লাফ দিয়ে ওঠানোর পক্ষে যথেষ্ট।
আরে চুপ! চুপ! টঙের ঘর পর্যন্ত কাঁপিয়ে তুলবে যে! বলে ওদের থামিয়ে লেফাফাটা এবার সামনের টেবিলে রাখলাম। হ্যাঁ, এ যে আমাদেরই বড় আশার ধন সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
ব্রাউন রঙের লম্বাটে অফিসের কাজে যেমন ব্যবহার হয় সেই জাতের খাম। খামটার ওপরে নামঠিকানা টাইপ করার বদলে হাতেই লেখা।
যাঁর উদ্দেশে চিঠিটা পাঠানো হাতে-লেখা তাঁর নামটাই অবশ্য আমাদের পক্ষে যথেষ্ট। নামটা যে শ্রীঘনশ্যাম দাস তা বোধহয় কারওর বুঝতে এতক্ষণে বাকি নেই।
নামের পরে ঠিকানাটা ছিল এক নামকরা বইয়ের প্রকাশকের দোকানের। ঘনশ্যাম দাস নামটা দেখে সেই দোকান থেকেই সে ঠিকানাটা কেটে এই বাহাত্তর নম্বর বনমালি নস্কর লেনে চিঠিটা রিডাইরেক্ট করে দেওয়া হয়েছে।
চিঠিটা কোথা থেকে আসছে তাও বুঝতে অসুবিধা হয়নি, খামের ওপর লেখা প্রেরক মৌ-কা-সা-বি-স দেখে।
মৌ-কা-সা-বি-স-এর আগের চিঠিটি ঠিক এইভাবেই এক প্রকাশকের ঠিকানায় এসেছিল। সে প্রকাশক অবশ্য আলাদা। মৌ-কা-সা-বি-স-এর সেই একটি চিঠিই এর আগে আমরা পেয়েছি। কিন্তু সে চিঠি এমন যে, প্রথম আমাদের হাতে পড়বার পর থেকেই এই ক-হপ্তা ধরে আমাদের আর সব চিন্তাভাবনা একরকম ভুলিয়ে দিয়েছে।
মৌ-কাসা-বি-স-এর প্রথম চিঠিটার সামান্য বিবরণ যা বেরিয়েছিল যাদের চোখে পড়েনি তাদের জন্য, সংক্ষেপে ব্যাপারটা একটু বলে নেওয়া উচিত মনে হচ্ছে।
মৌ-কা-সা-বি-স যে শব্দগুলির আদ্যক্ষর দিয়ে গাঁথা তা হল মৌলিক কাহিনী-সার বিপণন সংস্থা। প্রায় মাসখানেক আগে এই সংস্থার যে চিঠিটি এক প্রকাশকের ঠিকানা থেকে আমাদের বাহাত্তর নম্বরের পোস্ট বাকসে এসে পৌঁছয় সেটি ঘনশ্যাম দাসের নামেই পাঠানো হয়েছিল।
ঘনশ্যাম দাসের নাম থাকা সত্ত্বেও সে চিঠি যে আমরা খুলে পড়েছিলাম তার সোজা কারণটা এই বলা যেতে পারে যে চিঠিটায় ঘনশ্যাম দাসের নাম থাকলেও সেটা সোজাসুজি তাঁর বাহাত্তর নম্বরের ঠিকানায় না পাঠিয়ে কোনও এক প্রকাশকের মারফত পাঠানো।
এরকমভাবে যে বা যারা চিঠি পাঠিয়েছে তারা ঘনাদার জানাশোনা কেউ যে নয় তা অনায়াসেই ধরে নেওয়া যেতে পারে।
ঘনাদার চিঠি অমন বেপরোয়া খোলার সাহস করার আসল কারণ কিন্তু আলাদা। সে কারণ হল এই যে, ঘনাদার ভাবগতিক যা দেখছি তাতে তিনি তাঁর নামের চিঠি আসাটা যেন পছন্দ করেন না মনে হয়। অপছন্দ করার চেয়ে ভয় করেন বললে যেন তাঁর ধরন-ধারণটা ভাল করে বোঝানো যায়।
শিবুর একটা চিঠির ব্যাপার থেকেই কথাটা আমাদের প্রথম মনে হয়। শিবু সেবার কিছুদিনের জন্য তার এক মামার সঙ্গে পশ্চিমে বেড়াতে গিয়েছিল। চিঠিপত্তর লেখা শিবুর বড় একটা ধাতে আসে না। কিন্তু সেবার ঘনাদাকে একটু উপরি খাতির দেখাবার জন্য সে তাঁর নামেই একটা চিঠি পাঠিয়েছিল আমাদের এই বাহাত্তর নম্বরে। ঠিকানায় হাতের লেখাটা শিবুর বলে বুঝে আগ্রার পোস্ট অফিসের ছাপ দেখে সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত হলেও চিঠিটা আমরা খুলিনি। উৎসাহভরে সেটা ঘনাদার কাছেই পৌঁছে দিতে তাঁর টঙের ঘরে হাজির হয়েছি।
কিন্তু তাঁর নামে চিঠি আছে শুনে খুশি হবার বদলে তিনি কেমন অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। সে অস্থিরতাটা বিরক্তির মেজাজ দেখিয়েই ঢাকা দেবার চেষ্টায় তিনি রুক্ষ গলায় বলেছিলেন, চিঠি! আমার নামে চিঠি কোথা থেকে আসবে? কথাগুলো এমনভাবে তিনি বলেছিলেন যেন তাঁর নামে চিঠি আসাটা সরকারি গোয়েন্দা দপ্তরের হুঁশিয়ারির গাফিলতি। চিঠিটা তারপর তিনি আর নিতেই চাননি। চিঠিটা ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে আমরাও বুঝেছি যে কচিৎ কদাচিৎ নেহাত নিজের বিশেষ দরকারে নিজে থেকে দুনিয়ার দু-একজন হেনতেন-র ধরা ছোঁয়ার মধ্যে আসা স্বীকার করলেও তিনি তাঁর ছদ্মনামের অজ্ঞাতবাসে সাধারণ চিঠিপত্রে যোগাযোগের মানুষ নন।
তাঁর নামের চিঠি এলে বিনা দ্বিধাতেই তাই আমরা খুলি। মৌ-কা-সা-বি-স-এর প্রথম চিঠি সেইভাবেই খুলে কিন্তু বেশ একটু মজা পেয়েছিলাম। সে প্রথম চিঠিতে লেখকদের নতুন গল্পের খেই জোগানোই যে মৌ-কা-সা-বি-স-এর ব্যবসা তা জানিয়ে ঘনাদাকে তাঁর গল্পের পুঁজি বাড়িয়ে সাহায্য করবার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। যোগাযোগ করবার একটা উপায় সে চিঠিতে দেওয়া থাকলেও আমরা মজার ব্যাপারটা আরও গড়াতে দেবার জন্য সে চিঠির উত্তর কিছুদিন দিইনি। এরপরে আবার মৌ-কা-সা-বি-স-এর চিঠি পাবই ভেবে নিয়ে অপেক্ষা করেছিলাম ধৈর্য ধরে। আমাদের অপেক্ষা করা বিফল হয়নি।
মৌ-কা-সা-বিস-এর দ্বিতীয় চিঠিটা খুলে নতুন করে উৎসাহিত হবার খোরাকও পেলাম।
প্রথম চিঠিতে কী রকম গল্পের তারা জোগান দিতে পারে তার একটু নমুনা দেওয়া ছিল। এবারের চিঠিতে নমুনা-টমুনা দেওয়ার বদলে প্রথম থেকেই যেন আক্রমণ শুরু।
ঘনশ্যাম দাস আর নয়, সোজাসুজি ঘনাদা বলে সম্বোধন করে লেখা—
কী ঘনাদা, আমাদের চিঠি পেয়ে ভড়কে গেলেন নাকি! একবার একটা চিঠি দিয়ে একটু পরখ করে দেখবারও সাহস হল না? শুনুন, শুনুন, আগে থেকেই ভরসা দিয়ে রাখছি, আমাদের আগে থাকতে কিছু দিতে হবে না। আগে দুচারবার কারবার করে দেখুন। তাতে সন্তুষ্ট হলে তখন যা মর্জি হয় দেবেন। আমাদেরও অবশ্য একটা শর্ত আছে।
কাউকে খদ্দের করবার আগে আমরা তাঁকে একটু যাচাই করে নিই। অনেককাল ধরে অনেক সরেস নিরেস গল্পের ছক প্যাঁচালেন। ঘিলুটা তাতে ঘোলাটে হয়ে গেছে। কিনা একটু পরখ করে নিতে চাই। বেশি কিছু নয়, সামান্য দু-চারটে প্রশ্ন। জবাবগুলো চটপট দিতে পারেন কি না দেখুন। না পারলে জবাবগুলো অবশ্য চিঠিটার ভেতরের পাতাতেই উলটো করে লেখা পাবেন। এমনিতে কথাগুলো যেন আবোলতাবোল, কিন্তু আয়নার সামনে ধরলেই সেখানে সোজা অক্ষরগুলোর সঠিক কথাটা পেয়ে যাবেন। এই যেমন আপনি লেখায় পেলেন,
ইনে নেখাসে উকে কিছু মাথামুণ্ডু নেই মনে হচ্ছে তো? এখন আয়নার সামনে ধরলেই কথাগুলো আর আবোলতাবোল থাকবে না। উত্তরটা অমন করে দেখবার আপনার দরকার হবে না বলেই আশা করছি। এখন ভাবুন:
১। খাঁ খাঁ রোদের রাজ্যে যে পাহাড়ের চুড়ার তুষার গলে না।
২। একশো বছরেরও আগে মিশরের কায়রো শহরে, নানা গরিবানি কাফিখানায় ঘুরে ঘুরে হাজার এক আরব্য রজনীর অপরূপ সব কিসসা তিনি নতুন করে উদ্ধার করেছিলেন। আর সে কীর্তির আগে ভারতের ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে তিনি ছিলেন এক সেনাপতি। সিপাহি বিদ্রোহের বছর ১৮৫৭-তে তিনি ছিলেন কোথায়? আর তার পরের বছর কোথায় কী এমন আবিষ্কার করেছিলেন, যা তুলনাহীন? তাঁর আবিষ্কারের সঙ্গে উজিজি শব্দটা উচ্চারণ করলে পুরনো কোনও ইতিহাসের স্মৃতি ঝলকে ওঠে কি?
৩। উনিশশো চোদ্দ ছাড়িয়ে প্রায় আঠারো পর্যন্ত জার্মান রপ্ত করে আবার তা ভুলে ইংরেজি শিখতে হয়েছিল কোথায়, কাদের?
৪। একসঙ্গে জিরাফ, উটপাখি আর শিম্পাজি খুঁজতে যাব কোথায়?
এ সব প্রশ্নের জবাব মনে মনে দিয়ে ঠিক হয়েছে না বেঠিক হয়েছে, পেছনের পাতা উলটে দেখে নিন। চারটের মধ্যে তিনটেও যদি ঠিক হয়ে থাকে যে কোনও বড় কাগজের ব্যক্তিগত কলমে এক লাইনে প্রস্তুত বলে একটা বিজ্ঞাপন দিন। তাহলেই আপনার যা এরপর করবার মৌ-কা-সা-বি-স-এর নির্দেশের সেই পরের কিস্তি পেয়ে যাবেন। জিরাফ আর উটপাখি ছোটা তেপান্তরে সোনালি সুমুদুরের মতো বোথা আর স্মাটসদের সোনালি গমের খামার কীভাবে ছড়াচ্ছে তার রহস্য জানাব।
এ চিঠি আদ্যোপান্ত বার কয়েক পড়বার পর রীতিমত ভাবনাতেই পড়লাম আমরা তিনজন। শিবু তখনও আসেনি। কিন্তু সে এলেও বিশেষ বুদ্ধি বাতলাতে পারত বলে মনে হয় না।
এ চিঠি নিয়ে এখন কী করা যাবে সেইটাই হল সমস্যা। ঘনাদাকে এ চিঠি এখন দিতে যাওয়া যায় না!
যে-কোনও চিঠি সম্বন্ধে তাঁর পাকা এলার্জি তো আছেই, তার ওপর প্রথম চিঠিটা বেমালুম চেপে গিয়ে দ্বিতীয় চিঠিটা দিতে যাওয়ার কৈফিয়তটা হবে কী?
তা হলে এ চিঠিটাও কি বেমালুম হজম করে ফেলব?
কিছুতেই না। জোরালো প্রতিবাদটা কিছুক্ষণ আগে ঢোকা শিবুর। নিজের মতটাকে জোরালো যুক্তির গাঁথুনি দিয়ে সে বললে, ঘনাদাকে মাপবার এমন একটা মওকা হেলায় হারালে আফশোসের সীমা থাকবে না যে!
কিন্তু ঘনাদার হাতে এ চিঠি তুলে দেব কী বলে? আমাদের ভাবনা।
তাঁর হাতে তুলে দেব কেন? শিবুর ব্যাখ্যা—ও চিঠি নিজেদের কাছেই রেখে এসব প্রশ্নের ধাঁধা তাঁর নাকের সামনে যেন অজান্তে ঘোরাব।
কীভাবে? আমাদের বিমূঢ় জিজ্ঞাসা।
কীভাবে তা আমিই কি জানি! শিবু অকপটে স্বীকার করে জানালে, কিন্তু সময় মতো কি ঠিকঠাক বুদ্ধিগুলো জোগাবে না! দেখাই যাক না।
তা মোটমাট আমরা খেলাটা খুব মন্দ খেলিনি। কাঁচা চাল দু একটা দিয়ে ফেলিনি এমন নয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুরোপুরি বানচাল হওয়া থেকে নৌকোটা বাঁচিয়েছি।
টঙের ঘরে অভিযানে যাবার আগে অবশ্য রসদের কথা ভুলিনি। আমরা প্রথম তিনজন একটু আগে পরে করে যেন নেহাত আড্ডা দেবার জন্যই উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘরে এসে বসবার পর শিবু একটু ব্যস্তভাবেই ঘরে ঢুকেছে। ঢুকেছে সে একলা নয়, সঙ্গে তার বনোয়ারি আর বনোয়ারির এক হাতে ঢাউস টিফিন কেরিয়ার আর অন্য হাতে বড় ঝোলার মধ্যে ডিশ, প্লেট, বাটি, ইত্যাদি তৈজসপত্র।
দিগ্বিজয়ীর হাসি হেসে ঘনাদার দিকে চেয়ে বলেছে, না, লোভ সামলাতে আর পারলাম না, ঘনাদা। নিয়েই এলাম এই নতুন অপূর্ব জিনিস।
নতুন অপূর্ব জিনিস! আমরা সন্দিগ্ধভাবে শিবুর দিকে তাকিয়ে বলেছি, নতুন জিনিস মানে খাবার! এই শহরে পাওয়া যায় অথচ বাহাত্তর নম্বরের অজানা এমন কোনও নতুন খাবার আছে নাকি?
আমরা থামতেই গৌর খেই ধরে বলেছে, দেশি বিদেশি চীনে জাপানি ইরানি তুরানি কাশ্মরী না তামিল—
থাম থাম! কথার মাঝখানে গৌরকে থামিয়ে দিয়ে শিবু বলেছে, আজগুবি বিদেশ বিভূঁইয়ের নয়, এই আমাদের দেশেরই জিনিস, কিন্তু খাসনি কখনও, নামও শুনেছিস কিনা সন্দেহ। শুনেছিস কখনও উত্তাপাম নামটা?
শিবু যতক্ষণ বক্তৃতা দিচ্ছে তার মধ্যে টিফিন ক্যারিয়ার খুলে সর্বপ্রথম ঘনাদার সামনে বনোয়ারি প্লেট, ডিশ সাজিয়ে তার মধ্যে একটা গোলাকার মোটা পরোটার মতো খাদ্য বার করে দিয়ে সঙ্গের ছোট বড় পাত্রগুলোও নাতিতরল বস্তুতে পূর্ণ করে দিয়েছে।
সেইদিকে তাকিয়ে আমাদের দৃষ্টি পরিচালিত করে শিবু এবার বলেছে, এ আহার্য দেখবার ও চাখবার সৌভাগ্য কি কখনও হয়েছে? অথচ এ আমাদের দক্ষিণ ভারতের জিনিস, নাম উত্তাপাম। সঙ্গে ছোট ছোট পাত্রে যা পরিবেশিত হয়েছে সেই নারিকেল মণ্ড চাটনি আর অন্য পাত্রের সম্বর ডালের সঙ্গে সেব্য।
শিবুর বক্তৃতা শেষ হবার আগেই বনোয়ারি সুনিপুণ হাতে আমাদের সকলের সামনেই প্লেটে বাটি বসিয়ে তাতে অভিনব উত্তাপাম সাজিয়ে দিয়েছে।
ঘনাদার মুখে কোনও মন্তব্য এখনও না শোনা গেলেও শিবুর অভিনব আমদানির দু-চার টুকরো যথাযোগ্য অনুপান সহকারে মুখে তুলতে তিনি ত্রুটি করেননি। তাঁর মুখে অতিরিক্ত আহ্লাদ কিছু ফুটে না উঠলেও বিকৃতিও দেখা যায়নি কিছু।
এর মধ্যে শিশির খেলার প্রথম চাল চেলে বলেছে, তা নেহাত অখাদ্য কিছু অবশ্যই নয়, কিন্তু
কিন্তুটা কী? শিবু গরম হয়ে উঠেছে—এই উত্তাপাম, এর মধ্যে কিন্তুটা কোথায় পাচ্ছ শুনি?
খেই পেয়ে গিয়ে আমি এবার একটু মেজাজি গলায় বলেছি, কিন্তু একটু আছে বইকী! নামটা যেমন হোক, জিনিসটি ওই দোসার রকমফের নয় কি!
দোসার রকমফের এই উত্তাপাম? শিবু যেন চরম অপমানে তোতলা হয়ে গিয়ে বলেছে, তোতোমাদের কী করতে হয়, জানো? ইকোয়েটর-এর লাগাও খাঁ খাঁ রোদের রাজ্যে ভিসুভিয়াস-এর মরা জাতভাইয়ের মাথায় বরফের চূড়ায় তুলে দিতে হয়। তখনও হয়তো তোমরা বলবে, এর আর নতুন কী?
দাঁড়াও! দাঁড়াও! আমরা যেন দিশাহারা হয়ে বললাম, আমাদের না তোমার কার মাথার ঘিলুটা নড়ে গেছে, আগে বুঝি! কী বললে তুমি? ইকোয়েটর-এর লাগাও মানে বিষুবরেখার কাছাকাছি খাঁ খাঁ রোদের রাজ্যে ভিসুভিয়াস-এর মানে সেই বিখ্যাত ভলক্যানো-র মরা জাতভাইয়ের বরফ ঢাকা চূড়ায়—
এই পর্যন্ত বলেই আমরা হাসতে শুরু করলাম, শিবুকে যেন তেলেবেগুনে জ্বালিয়ে।
হাসছ! তোমরা হাসছ? শিবু আমাদের দিকে তখন এমন হিংস্রভাবে চাইলে যেন আমাদের বিকশিত দন্তপাটিগুলো গুঁড়ো না করে তার তৃপ্তি নেই।
হ্যাঁ, হাসছি! আমরা নির্বিকারভাবে ঘনাদাকেই সালিশি মেনে বললাম, ঘনাদাই বলুন না, এরকম প্রলাপ শুনে না হেসে পারা যায়।
ঘনাদা তখন তাঁর তৃতীয় উত্তাপামটি শেষ করার পর বনোয়ারির টিফিন ক্যারিয়ারের অন্য একটি পাত্র থেকে বড় চামচে বার করে দেওয়া সুগন্ধে ভুরভুর ছানার পোলাও সবে একটু চাখতে শুরু করেছেন।
আমাদের জিজ্ঞাসায় তাঁর মুখে সামান্য যে একটু হাসির আভাস দেখা গেল, সেটা করুণার, না ধরি-মাছ না ছুঁই পানি গোছের দায় এড়ানোে চতুরতার, তা বোঝা শক্ত বলে তাঁকে আবার একটু উসকে দেবার চেষ্টায় বলতে হল, কী বলল শুনলেন তো! বিষুবরেখার কোথাও খাঁ খাঁ রোদের রাজ্যে ভিসুভিয়াস-এর মরা জাতভাইয়ের
হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমিই বলছি, শিবুই কথাটা যেন আমাদের মুখ থেকে কেড়ে নিয়ে গড়গড় করে বলে গেল, তুষার ঢাকা চূড়োয়—এই তোমাদের আজগুবি মনে হচ্ছে? তা হলে যদি জিজ্ঞাসা করি, সিপাই যুদ্ধের পরের বছরে যিনি আরকী আশ্চর্য অজানা কিছু আবিষ্কার করেছিলেন, তার আগের বছরে তিনি কোথায় ছিলেন? এর পর সেই আশ্চর্য মানুষটি মিশরের কায়রো শহরের কফিখানায় ঘুরে ঘুরে আরব্য উপন্যাসের হাজার রজনীর উপাখ্যান নতুন করে উদ্ধার করেন।
থামো, থামো! আমরা নিজেদের মাথাগুলো দুধারে চেপে ধরে বললাম, মাথায় একেবারে চরকিপাক লেগে গেছে।
তাহলে আরও একটু লাগাই! বলে শিবু যেন মজা পেয়ে বলে গেল, এই সঙ্গে যদি উজিজি শব্দটা উচ্চারণ করি তাতে হঠাৎ কিছু মনে পড়ে যায় কি?
আমি যেন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠার ভান করে রীতিমত বিরক্তির সঙ্গে বললাম, শোনো শোনো, অত যদি আবোলতাবোল বকবার শখ থাকে তো নিজের ঘরে গিয়ে খিল দিয়ে দরজা বন্ধ করে মনের সুখে যা খুশি বললাগে যাও। আমাদের এমন জ্বালাতন করবার অধিকার।
অধিকার আমার নেই বলছ? কিন্তু এত জ্বালাতন না হয়ে তোমাদের নিরেট মাথাগুলো একটু নাড়া দিয়ে সচল করার চেষ্টাও তো হতে পারে। তাই বলছি উনিশশো চৌদ্দ থেকে প্রায় আঠারো পর্যন্ত জার্মান শিখতে শিখতে কাদের আবার ইংরেজি শিখতে হয়েছিল। আর জিরাফ, উটপাখি আর শিম্পাঞ্জি যেখানে পাওয়া যায় সেখানে উটপাখি ছোটা তেপান্তরে অঢেল মিঠে জলের মদত পেয়ে বোথা আর স্মাটসদের সোনালি পাকা গমের সব খামার ছাড়াতে ছাড়াতে কালামাটি ধলা করবে আর কতদূর?
ভুল! ভুল!!
সত্যিই আমরা চমকে উঠেছি সবাই। মায় শিবু পর্যন্ত। কথাগুলো জোরালো গলায় প্রতিবাদ নয়। একটু কৌতুক মেশানো টিপ্পনির মতো। কিন্তু গলাটা স্বয়ং ঘনাদার। , তাঁর দিকে ফিরে দেখি প্লেট সাফ করে বনোয়ারির পরিবেশনের মর্যাদা রেখে তিনি রামভুজের আনা স্পেশ্যাল চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে একটু হাসছেন।
প্রথমটা একটু ধাঁধার মধ্যে পড়লেও গৌরই প্রথম গলায় উপরি উৎসাহ ফুটিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, ভুল তো? শিবু যা বলেছে সবই গুল, মানে ভুল—
না, সব নয়। ওই ঘনাদা তাঁর বাড়িয়ে ধরা ডান তর্জনী আর মধ্যমার মধ্যে খুঁজে দেওয়া শিশিরের সিগারেটটা মুখের কাছে এনে শিশিরের লাইটারের অপেক্ষাতে কথাটা অসমাপ্ত রাখলেন। তারপর শিশির সিগারেটটা ধরিয়ে দেবার পর দুটি সুখটান দিয়ে ধীরে ধীরে বললেন, প্রথমে যা সব বলেছে তার কোনওটাই ফালতু বুকনি নয়।
ফালতু বুকনি নয়! আমাদের এবার আর অবাক হবার ভান করতে হল না। ওই যে, কী বলছিল, ভিসুভিয়াসের মরা খাঁ খাঁ রোদের রাজ্যে তুষার চূড়ায় পাহাড়–
হ্যাঁ, ও সবই সঠিক বর্ণনা, ঘনাদা সস্নেহে আমাদের অজ্ঞতা যেন ক্ষমা করে বললেন, শিবু যা যা বললে, সবই পৃথিবীর একটি বিশেষ জায়গার নানা রকমারি বিবরণ। বিষুবরেখার লাগাও খাঁ খাঁ রোদের রাজ্যে ভিসুভিয়াস-এর মরা জাতভাই এক তুষার চূড়ার পাহাড় সত্যিই আছে। আফ্রিকার সবচেয়ে উচু সে পাহাড়ের নাম কিলিমানজারো। বহু বছরকাল, আগে ও-পাহাড়টা সত্যিই ছিল এক আগ্নেয়গিরি। তারপর সে আগ্নেয়গিরি কবে থেকে ঠাণ্ডা হয়ে আছে। ওই কিলিমানজারোর কাছেই আছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মিষ্টি জলের হ্রদ। সাইবিরিয়ার এক বৈকাল হ্রদ ছাড়া যার চেয়ে গভীর হ্রদও দুনিয়ায় নেই।
ভারতবর্ষের সিপাই বিদ্রোহ হয় ১৮৫৭তে। ঠিক তার কিছু আগে এই ভারতের ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একজন সেনাপতি এখানকার কাজ ছেড়ে দিয়ে নীল নদের উৎস আবিষ্কারের আশায় দুঃসাহসিক অভিযানে বেরিয়ে পড়েন। নীল নদের উৎস তিনি আবিষ্কার করতে পারেননি। কিন্তু সিপাই বিদ্রোহের পরের বছর ১৮৫৮ সালে সে আবিষ্কারের পথে নীল নদের উৎস রহস্যের কয়েকটি অমূল্য সমাধান সূত্রের সন্ধান পান। এগুলির প্রধান হল ওই কিলিমানজারো পাহাড়ের রাজ্যে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মিষ্টি জলের হ্রদ টাঙ্গানাইকা আবিষ্কার।
উৎসাহভরে শিবু এবার একটু মাতব্বরি মন্তব্যের লোভ ছাড়তে পারেনি। যা থেকে ও দেশটার নামও টাঙ্গানাইকা।
না, ঘনাদা তাকে দমিয়ে দিয়ে বলেছেন, এখন ওই অঞ্চলের নাম হয়েছে টানজানিয়া। সে যাই হোক টাঙ্গানাইকা হ্রদ যিনি স্পিক নামে আরেক বন্ধুর সঙ্গে আবিষ্কার করেন তাঁর কথাই বলি। নাম তাঁর রিচার্ড বার্টন। নানা গুণে গুণী। একাধারে পণ্ডিত বিদ্বান তার ওপর অস্থির ছটফটে দুঃসাহসী ভবঘুরে মানুষ। সিপাই বিদ্রোহের আগেই ভারত থেকে এক বন্ধু জন স্পিককে নিয়ে নীলনদের উৎস সন্ধানে আফ্রিকায় চলে আসেন। তাঁর সেই অভিযানে টাঙ্গানাইকা হ্রদ আবিষ্কার করলেও এ সন্ধান ছেড়ে তিনি আরেক নেশায় মাতেন। তা হল সহস্রাধিক আরব্য রজনীর যে সব আশ্চর্য অপরূপ মুখে-মুখে বলা কাহিনী তখন আরবি ভাষার জগতে নেহাত সাধারণ সরাই আর কফিখানার আড্ডাবাজ খদ্দেরের মধ্যে ছড়িয়ে ছিল সেগুলি সম্পূর্ণ সংগ্রহ করা।
এ কাজের জন্যই তিনি সমস্ত সাহিত্যরসিক দুনিয়ার কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন। স্যার উপাধিও তিনি এজন্য পেয়েছিলেন।
একটু থেমে আমাদের কিঞ্চিৎ হতভম্ব মুখগুলোর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে ঘনাদা তারপরে বলেছেন, উজিজি আসলে একটা গ্রামের নাম। ওই টাঙ্গানাইকা হ্রদেরই ধারে। আগে গ্রাম ছিল, এখন শহর হয়েছে। রিচার্ড বার্টন আরবদের ক্রীতদাস জোগাড় আর চালানের এ ঘাঁটিতে গিয়েছিলেন। এবং এর পরে বিখ্যাত আফ্রিকা-পর্যটক লিভিংস্টোনকে আরেক আফ্রিকা-পর্যটক স্ট্যানলি ওখানে অসুস্থ অবস্থায় খুঁজে পান।
আগেকার চালু জার্মান ভাষা ছেড়ে ইংরেজি ধরার দায় এই অঞ্চলের বান্টু জাতেদের ওপরই পড়েছিল। প্রথম মহাযুদ্ধের আগে ও অঞ্চলটা ছিল জার্মানদের অধীনে। জার্মানরা প্রথম যুদ্ধে হেরে যাবার পর অঞ্চলটার আসল অধিকার ইংরেজদের হাতে আসে। শিবু এ পর্যন্ত যা বলেছে তা মোটামুটি ঠিক হলেও ওই শেষের কথাটাই একেবারে ভুল। ও যাদের সোনালি গমের খামার দেখতে দেখতে উটপাখি আর জিরাফ ছোটা তেপান্তরে টাঙ্গানাইকার মিষ্টি জলের অঢেল সেচে ক্রমশ ছড়িয়ে যাবার কথা বলেছে সেই বোথা আর স্মাটসরা আসলে কালা-ধলার আসমান-জমিন ফারাক বর্ণবিদ্বেষী দক্ষিণ আফ্রিকার বুয়র বংশের লোক। জার্মানদের প্রতাপের সময় তাদের একই মেজাজ মতলবের সুযোগ নিয়ে সেই বর্ণবিদ্বেষী বুয়রদের কিছু কিছু দল ওই সোনালি মাটির দেশে খামার পত্তন করতে শুরু করে। তাদের মতলব ছিল ধীরে ধীরে এ রাজ্যটাও হাতের মুঠোয় নিয়ে এখানে তাদের নিজেদের দক্ষিণ আফ্রিকার মতো কালা-ধলার ভেদের রাজ্য সৃষ্টি করে।
তারা এখানে এসে নিজেদের মতলব হাসিল করতে প্রথমে সরল কাফ্রিদের অবজ্ঞা আর কুসংস্কারের সুযোগ নেবার জন্য মোটারকম নানা ঘুষ দিয়ে ধড়িবাজ সব ওঝাদের হাত করে। এই ভূতের ওঝা বা উইচ ডক্টরদের সাহায্যে এ অঞ্চলের সরল বান্টুদের তারা ক্রমশ গোলাম বানিয়েই ছাড়ত। কিন্তু তা আর হল কই! একের পর এক তাদের খামারের সব গমের খেত শুকিয়ে ঝলসে যেতে লাগল কী যেন এক অভিশাপে। শেষে এমন হল যে, নিজেদের চাষবাস সব কিছু ছেড়ে আবার সেই দক্ষিণ আফ্রিকায় ফেরা ছাড়া তাদের আর কোনও উপায় রইল না।
কিন্তু হঠাৎ তাদের খামারগুলোর অমন অবস্থা হল কেন? না জিজ্ঞাসা করে পারলাম না আমরা— চাষবাসের বিদ্যে তাদের তো ভালই জানা ছিল। অভিশাপ-টভিশাপ গোছের কুসংস্কার কাটাবার মতো ভূতের ওঝারাও ছিল তাদের হাতে।
তা ছিল! ঘনাদা স্বীকার করলেন, কিন্তু ওঝাদেরও ভিরমি খাওয়ানো বুনো হাতির পিঠে-চড়া কাঁধে ঝোলা-জড়ানো এক নতুন ওঝার জাদুতে খ্যাপা অসুরের মতো ওঝাদেরও আতঙ্ক এসে সব ফসলের খেতে দেখা দেবে, আর তারপর কিছুদিন বাদে কী এক ফসলদানার মতো পোকার ঝাঁকে আকাশ অন্ধকার হয়ে যাবার পর সমস্ত খেত ঝলসে যাবে, এ তো আর কেউ ভাবেনি।
তার মানে? আমরা একটু বিমূঢ় হয়ে বলেছি, ওই সেরা নতুন ওঝাই এ কাজ করেছে, কিন্তু বুনো হাতির পালের একটার পিঠে চড়ে যাওয়াও তো চারটিখানি কথা নয়। বুনো হাতি বশ মানাল কী করে?
খুব অবাক হবার কিছু আছে কি? ঘনাদা একটু হাসলেন, প্রথম হাতি ধরে বশ মানানোর বিদ্যা যিনি শিখিয়েছিলেন, সেই ঋষি পালক্যপ্যের দেশের মানুষের পক্ষে ও কাজ কি অসম্ভব!
তার মানে এই আমাদের বাংলা অঞ্চলের কেউ গেছলেন ওখানে, ওঝার সেরা ওঝা হয়ে? আমাদের চোখগুলো সব বিস্ফারিত—কিন্তু অভিশাপটা ছিল কী?
কী আর, ঘনাদা বলেছেন হেসে, থলের মধ্যে মাজরা পোকার ডিম। তখন পর্যন্ত ঝলসা রোগের বাহন এ পোকার খবর তো দুনিয়ার কাছে পৌঁছয়নি।
ঘনাদা চুপ করলেন। আমাদেরও কারও মুখে কিছুক্ষণ আর কথা বার হল না।
এরপর কী করব এই আমাদের ভাবনা। ব্যক্তিগত কলমে প্রস্তুত বলে বিজ্ঞাপন দেব একটা, না এবার চুপ করে বসে থাকব কিছুদিন, এখনও ঠিক ধরতে পারিনি।