কপিবাজ

কপিবাজ

বিয়ের মাসখানেক পরপরই আবিষ্কার করলাম আমার বর একজন কপিবাজ। ফেসবুকে নিত্যদিন‌ই অন্যজনের লেখা কপি করে নিজের নামে চালায়।‌ অথচ আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম তার এই লেখা দেখেই। অনেকবার তাকে বলেছি, তুমি তো আমার থেকেও ভালো লেখো! সে লাজুক স্বরে জবাব দিয়েছে, ঐ আরকি! হঠাৎ হঠাৎ মাথায় লেখা আসে!

আমি তার লেখা পড়ি আর মুগ্ধ হ‌ই। যতবার তার একেকটা লেখা পড়ি মুগ্ধ হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি আর ভাবি,এই মানুষটার থেকে আমার কত কি-ই না শেখার আছে। তার লেখার কাছে আমি এখনো বাচ্চা। আমাকে তার থেকে ভাষাজ্ঞান শিখতে হবে,সহজ সাবলীলভাবে গল্প বলা শিখতে হবে।

বিয়ের পরদিন তাকে আমি বেশ কিছু ব‌ই উপহার দিলাম। হুমায়ূন আহমেদ,শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অনেকগুলো ব‌ই। কিন্তু ভয়ে ভয়ে ভাবছিলাম এইসব হয়তো তার আগেই পড়া। যে এত সুন্দর লিখতে পারে তার এইসব ব‌ই পড়তে বাকি থাকার তো কথা না। গিফট দেখে আমার বর সেরকম খুশী হলো না। একটা‌ হাই তুলে বাথরুমের দিকে চলে গেলো।‌ অথচ আমি ব‌ই গিফট পেলে সবার আগে সেগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাতা উল্টে উল্টে দেখি। নাস্তার টেবিলে আমি প্রশ্ন করলাম, ব‌ই পছন্দ হয়নি?

-হুম হ‌ইছে!

:আগে পড়া এগুলো তোমার?

-হুম কিছু কিছু পড়ছি।

: হুমায়ূন আহমেদের কবি পড়েছো?

-হ্যাঁ পড়েছি, অসাধারণ কবিতাগুলো!

এই প্রথম আমি আঁতকে উঠলাম।‌ নিজেকে সামলে নিয়ে সন্দেহের সাথে আবার প্রশ্ন করলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষের কবিতা কেমন লেগেছে?

-খুব‌ই ভালো লেগেছে, রবীন্দ্রনাথ তো বিশ্বকবি। তার কবিতা খারাপ লাগার কোনো অবকাশ নেই।

আমার গলা দিয়ে নাস্তা নামলো না। চেয়ার ছেড়ে উঠতে গিয়ে প্রায় মাথা ঘুরে পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলালাম। সে অফিসে চলে গেল। দুপুরে খাওয়ার পর আমি ফেসবুকে নিউজফিড স্ক্রল করতে করতে তার গল্প পেলাম। একটু আগে পোস্ট করেছে। অফিসের ব্যস্ততা,চেঁচামেচি, হুল্লোড়ের মাঝে মাথায় গল্প আসে? আমি তো পাশের ঘরে কেউ কথা বললেও লিখতে পারিনা! গল্পটা পড়ে শেষ করলাম। অসাধারণ লাগল। সুস্বাদু, মজাদার একটি রম্য গল্প।‌ কমেন্ট করার উদ্দেশ্যে কমেন্ট বক্সে গিয়ে দেখি একজন লিখেছে,কপিবাজ! লজ্জা করে না অন্যের লেখা নিজের বলে চালাতে?

আমি শিহরিত হয়ে কমেন্টের রিপ্লাই দিতে গিয়ে দেখি কমেন্ট ডিলিট হয়ে গেছে। আমার ব‌র‌ই সম্ভবত ডিলিট করে দিলো।‌ অথচ অন্যরা যখন কমেন্ট করছে, জোস লিখেছেন ভাই! সেখানে সে রিপ্লাই দিচ্ছে,মেনি মেনি থ্যাংকস। সেইদিন থেকেই তার প্রতি আমার সন্দেহের শুরু। এই ছেলের লেখায় মুগ্ধ হয়ে বাসার সবার বিরুদ্ধে গিয়ে তাকে বিয়ে করেছি। আমার ধারণা ছিলো আমিও লিখি,সেও লেখে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিশ্চয়ই একজন কালজয়ী লেখকের জন্ম দেবে।

দিনের পর দিন আমার বরকে পর্যবেক্ষণ করে দেখছি,সে মোটেও ‌সাহিত্যনুরাগী নয়। ব‌ই দেখলেই হাই তোলে। এপর্যন্ত তাকে একটা গল্পের ব‌ই নিয়ে কখনো‌ বসতে দেখিনি। সেই সময়টা টিভিতে খেলা দেখে,ফোনে গেম অফ থ্রোনস খেলে কাটায়।‌ একজন লেখককে লিখতে গেলে অবশ্যই চোখ কান খোলা রেখে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করতে হয়,‌ছোটখাটো ঘটনা থেকে লেখার কনসেপ্ট কালেক্ট করতে হয়। এসব কিছুই সে করে না। একদিন একটা গল্পের কনসেপ্ট নিয়ে তার কাছে গেলাম। বললাম, আমার মাথায় একটা দারুন কনসেপ্ট এসেছে! আমি কাহিনীটা বলি তুমি লিখে ফেলো! তোমার লেখা তো আমার চেয়েও সুন্দর হয়।‌

সে হাই তুলে বললো, তুমিও তো লিখতে পারো ভালো, কনসেপ্ট আছে তুমিই লেখো! দেখো, সারাদিন অফিসে কাজের চাপে থাকি। সারাদিন পর‌ বাড়ি এসে এইসব লেখাটেখা ভালো লাগেনা। তুমি তো সারাদিন বাড়িতেই বসে থাকো,বসে বসে লেখো। আমি অবাক হলাম। এটা কেমন কথা!! একজন লেখকের কাছে লেখা একটা আনন্দের বিষয়। সেটার সাথে কাজের চাপের কি সম্পর্ক? ফ্রি থাকলে লেখা যাবে কাজ থাকলে লেখা যাবে না এমন হলে তো সব বেকার‌ই লেখক হয়ে যেতো। আমি একটু জোরের সাথে বললাম, সত্যি করে বলোতো, ফেসবুকের লেখাগুলো কি তোমার?

-আরে বাবা! আমার আইডি আমার লেখা হবে না তো কার? তাই বলে কি সারাক্ষণ লিখতে হবে নাকি? এখন আর ভালো লাগে না। ‘এখন আর ভালো লাগে না’ বলার আধাঘণ্টা পরেই দেখি ফেসবুকে তার ইয়া‌বড় লম্বা একটা গল্প। কখন লিখলো এইটা তাইলে? দিনের পর দিন এভাবেই আমার সন্দেহ বাড়তে লাগলো। এরপর তার কয়েকটা লেখা ফেসবুকে সার্চ দিয়ে দেখলাম সেটা আরো অনেকেই পোস্ট দিয়েছে। হয়তো তারা কপি করেছে ভেবে আমি কিছু মনে করলাম না। এরপর আমার লিস্টের এক নামীদামী লেখিকা আমাকে নক দিলো।

-আনিসুর রহমান কি হয় তোমার?

আমি বললাম, আমার হাজবেন্ড আপু! মেয়েটা অবাক হয়ে বললো, তুমি এত ভালো লেখো, একটা কপিবাজকে কি মনে করে বিয়ে করলে!? লেখক লেখিকাদের সবচেয়ে বড় শত্রু হলো কপিবাজ। এটা ঠিক।‌ আমারো অনেকবার মনে হয়েছে আমার লেখার কপিবাজগুলোকে যদি হাতের কাছে পাইতাম ‌তাহলে হয়তো থাপ্রাইতে থাপ্রাইতে কানমুখ লাল করে দিতাম। তারপর কপিরাইট আইনে কেস করে জেলের ঘানি টানাতাম। কিন্তু এই আপু আমার বরকে কপিবাজ বলছে কেন? আমি রিপ্লাই দিলাম, কি বলেন আপু! আমি তো তার লেখা পড়েই মুগ্ধ হয়ে তাকে বিয়ে করেছি!

-হাহা! ওর কপি পড়ে মুগ্ধ হয়ে বিয়ে করেছো? হাহাহা! হোয়াট এ ফানি কনসেপ্ট! এটা নিয়ে আমি এখন গল্প লিখবো।

আমি মেয়েটার সাথে আর কথা বললাম না। একটা বুদ্ধি বের করে নিজের একটা ফেক আইডি খুললাম। সেটা দিয়ে সুন্দর একটা গল্প পোস্ট করলাম। বর যে যে গ্রুপে আছে সবগুলাতে পোস্ট করলাম। লেখাটা খুব ভাইরাল হলো। সবাই কপি করতে লাগলো। বিকালে চা নিয়ে ছাদে বসে আছি। ফেসবুকে লগ ইন করতেই সি ফার্স্টে থাকা বরের পোস্ট সামনে এলো। আমার লেখা গল্পটা সে পোস্ট করেছে। নিচে কার্টেসীতে তার নাম দেয়া।

আমি কমেন্ট করলাম, ওয়াও! দারুন গল্প তো! অফিসে বসে এতো কিছু তোমার মাথায় এলো কিভাবে? সে রিপ্লাই দিলো, এই আর কি! টুকটাক এইটুকু পারি বলেই তো তুমি আমার প্রেমে পড়েছিলে! সন্ধায় সে বাসায় আসতেই আমি ব্যাগ হাতে তার সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, তোমার জন্য‌ই অপেক্ষা করছিলাম।‌ চাবি রাখো। আমি চলে যাচ্ছি। সে অবাক হয়ে বললো, বাপের বাড়ি যাচ্ছো? বলোনাই তো আজ যাবা!

:বেড়াতে যাচ্ছি না।‌ একেবারে চলে যাচ্ছি। আমি তোমার সাথে ঘর করবো না।

-এই কি বলো! কি করলাম আমি?

: আমার ইচ্ছা! ঘর করবো না মানে করবো না। জোরাজুরি করলে মামলা করে দেবো। খবরদার আমার পেছন পেছন আসবা না।

সে হতাশ গলায় বললো,বিয়ে করলাম। নতুন ব‌উ চলে যাচ্ছে,আমি ব‌উ পাবো ক‌ই? আমি মুখ ঝামটা দিয়ে জবাব দিলাম, কপি করে নিয়ে আইসো আমার মতো আরেকটা ছাগল কোথাকার!!!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত