সেদিন প্রতিদিনের মতই কোচিং শেষে বান্ধবীদের সাথে বাড়ি ফিরছিলাম। আমার একটু শপিং করার দরকার ছিল বলে ওদের থেকে বিদায় নিয়ে শপিং মলে ঢুকে পড়লাম। গুনগুন করে গান গাইছিলাম আর ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। একটু পরে খেয়াল করলাম যে কেউ একজন আমার গা ঘেঁষে চলতেছে। ব্যাপারটা তেমন কিছু মনে করিনি। তবে আমি যেখানেই যাচ্ছি সেও ঠিক আমার পিছু পিছু যাচ্ছে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিলাম চশমা পরিহিত একটা ছেলে। দেখে তো অনেক ভদ্র মনে হয়।
ছেলেটি ফোনে কি যেন লিখছিল। এই ফাঁকে দেখে নিলাম ছেলেটির পাশেই আরো কয়েকজন ছেলে লোভাতুর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মেজাজটা এতোটাই খারাপ হলো যে বলার মত না। মনে মনে ভাবলাম সবগুলো জানোয়ারগুলো হয়তো একই গ্রুপের। একজনকে লেলিয়ে দিয়ে বাকিরা সব মজা নিচ্ছে। আমি যেখানেই যাচ্ছি না কেন, ছেলেটি প্রায় আমার গা ঘেঁষে সেখানেই যাচ্ছে। আর তার সাথে বাকি ছেলেগুলোও। এদের কি কোন বিবেকবোধ নেই।নাকি এরা শুধু নারীকে ভোগপন্য আর উপভোগের কিছু মনে করে আমার বুঝে আসে না। গা ঘেঁষা ছেলেটি এবার কাকে যেন ফোন করলো
-কিরে কখন থেকে মেসেজ করছি। কোন উত্তর দেস না কেন? বললাম না তাড়াতাড়ি আসতে। কতক্ষন লাগবে আর? তাড়াতাড়ি আয়। আমি আর কন্ট্রোল করতে পারছি না।
ছেলেটির কথাগুলো শুনে মাথাই রক্ত উঠে গেল।এখানে এতগুলো ছেলে মিলে যেটা করছে সেটাই সহ্য হচ্ছে না তার উপর আরো একজনকে আসতে বলছে। এদের কিছু না বললে সবার সাথেই এমন করবে। আমি কিছু একটা বলার জন্য পিছন ঘুরলাম। আশ্চর্য! ছেলেটি দ্বিগুন বেগে ঘুরে আমার পিছনে চলে গেল। ব্যাপরটা কি বুঝতে পারলাম না।দেখলাম ছেলেগুলোও পাশের সাইড দিয়ে পিছনের দিকে চলে গেল।আমি শপিং মলে ঢুকার মাত্র মিনিট পাঁচেক হয়েছে। এর মাঝেই এতকিছু ঘটে গেল বুঝতেই পারলাম না। এবার বুদ্ধি করে শপিং মলের বোর্ডের পাশে গিয়ে ঘুরলাম। এবার ছেলেটি চাইলেও আমার পিছনে যেতে পারবে না। এবার ছেলেটি চলে যেতে চাইলো। আমি ছেলেটাকে ডাক দিলাম,
-এই যে মিষ্টার ছেলেটি আমার দিকে ঘুরলো কিন্তু কোন কথা বললো না
-আপনার সমস্যা কি আমার পিছু নিয়েছেন কেন? তাও আবার গ্যাংকে সাথে নিয়ে। মেয়ে দেখলে কি মাথা ঠিক থাকে না, নাকি লুচ্চিমী করার জায়গা পান না! এদেরকে দিয়ে হচ্ছে না আবার আর একজনকে ডাকছেন? আচমকা ঘটনায় ছেলেটি কি বলবে বুঝতে পারছে না। তার চোখমুখ লাল হয়ে গেল।
-না মানে সমস্যা ঠিক আমার না। সমস্যা আপনার
-কিহ! আপনি কি বলতে চাইছেন?
-আপনার শরীরের কাপড়ের সমস্যা
-মানে!
-আপনার পিছনে পিঠের কাছে বগলের নিচের অংশে ব্রা…
আর কথা শেষ করতে পারলো না ছেলেটি। তার আগেই সজোরে একটা চড় বসিয়ে দিলাম। ছেলেটির চোখ থেকে চশমাটা নিয়ে পড়ে গেল। কিছু একটা বলতে যাব ঠিক তখনি কে যেন আমাকে আচমকা টান দিল। তাকিয়ে দেখি একটা বোরখা পরিহিত মেয়ে আমাকে টানতেছে।
-আপু প্লিজ! দয়া করে এদিকে আসেন। আমি যেতে যেতে পিছন ফিরে দেখি ছেলেটি হাতড়াতে হাতড়াতে রেলিংটা ধরলো। মেয়েটি আমাকে টানতে টানতে টায়াল রুমের দিকে নিয়ে গেল।
-আমাকে এখানে আনলে কেন?
মেয়েটি আমাকে ঘুরতে বলে ফোন দিয়ে একটা পিক উঠিয়ে আমাকে দেখালো। ছবিটা দেখার পরেই মনের অজান্তেই আমার হাতটা পিঠের দিকে চলে গেল। আমার পিঠের নিচে বগলের কাছের অংশ ছিঁড়ে গিয়ে ভিতরের অর্ন্তবাস দেখা যাচ্ছিল।
-ভাইয়া আমাকে টেক্সট করছিলো তখন আমি ওয়াশরুমে ছিলাম। পরে যখন বের হলাম তখন ফোন দিল। ফোন পেয়ে আর মেসেজ দেখে তাড়াতাড়ি নিচে নামলাম। আমি তিন তলায় ছিলাম তখন। নিজেকে তখন অপরাধী মনে হচ্ছিল।
-সরি! আমি না বুঝে ওনাকে চড় মেরেছি। ওনার চশমা পড়ে হয়তো নষ্ট হয়ে গেছে।
-সেকি! ভাইয়া তো চশমা ছাড়া কাছের কিছুই ঠিকমত দেখতে পায় না
তড়িঘড়ি করে মেয়েটির দেওয়া ড্রেসটা পড়ে বের হলাম। বের হয়ে ওনাকে কোথাও দেখতে পেলাম না। একটু সামনে যেতেই শপিংমলের সামনে হালকা ভিড় দেখতে পেলাম। পাশ থেকে শুনতে পেলাম একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে। আমার ভিতরটা কেন জানি মোচড় দিয়ে উঠলো। নড়াচড়ার শক্তিটুকু যেন হারিয়ে ফেলেছি। ধীর পায়ে গেটের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলাম। সময়টা যেন থমকে গেছে। অনন্তকাল পর যেন গেটের কাছে এসে দাঁড়ালাম। তারপর যেটা দেখলাম তাতে গেটের দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে পড়লাম।
একটা পিকআপ একপাশে হেলে আছে। আর পিকআপে থাকা প্লাস্টিকের ফার্নিচারগুলো সামনের দিকে পড়ে গেছে। তারপাশেই একটা মেয়েকে কয়েকজন জড়াজড়ি করে ধরে রাখার চেষ্টা করছে। মেয়েটি কাদতেছে সামনের দিক দেখে। আর নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ওখানে যেতে চাচ্ছে। তারমানে ফার্নিচারে নিচে ওনার কেউ পরেছে। কিন্তু ছেলেটিকে আশে পাশে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। কয়েকজন মানুষ মিলে ফার্নিচারগুলো সরিয়ে ফেলছে। যদিওবা আমি জানিনা ভিতরে কে আছে তারপরেও কেন জানি মনে হচ্ছিল ভিতরে ওনি নেই।এক্সিডেন্ট হলেও সেখানে না ছিল রক্তের স্রোত, না ছিল কোন রক্তের দাগ! তারপরেও ভিতরটা কেমন জানি করছিলো।
একে একে যখন ফার্নিচারগুলো সরানো হচ্ছিল তখন নীল টিশার্ট টা দেখতে পাচ্ছিলাম। আমি কিছু বুঝে ওটার আগেই পাশের মেয়েটি ভাইয়া বলে চিৎকার দিয়ে উঠলো। মেয়েটি সামনে যেতে চাইলে আমি আর একজন ওকে যাওয়ার পথ আগলে ধরলাম। ধীরে ধীরে যখন সব সরানো শেষ হলো তখন দেখতে পেলাম ছেলেটি একটা ট্রলিকে ঢেকে রেখেছে। ভিতরে কিছু একটা আছে। প্লাস্টিকের ফার্নিচার হওয়ায় সেরকম কোন কিছু হয়নি। যখন কাছে গেলাম দেখলাম ভিতরে একটি বাচ্চা এক হাত দিয়ে গাল ছুয়ে দিচ্ছে আর ছেলেটি চোখ বন্ধ করে সেটাকে অনুভব করছে। মেয়েটি দৌড়ে এসে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে চোখে মুখে চুমু দিতে থাকলো আর ছেলেটির দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকালো। ছেলেটি ওঠে দাঁড়ালে মেয়েটি(ছেলেটির বোন) এসে জড়িয়ে ধরলো।
-তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি বাসায় গিয়ে মাকে কি বলতাম?
-আরে পাগলি আমার কিছু হয়নি তো। তবে ঠিকমত চোখে দেখতে পারছি না যে তুই কাঁদছিস না কি করছিস?
তখন আমার কি যেন মনে হয়েছিল। পিছন ফিরে শপিং মলের দিকে দৌড় দিলাম। অনেক্ষন খোঁজাখুঁজির পর পেয়ে গেলাম কাঙ্খিত বস্তুটাকে।সেটা নিয়ে যেতেই দেখি দুই ভাই বোন জড়াজড়ি করে শপিং মলের ভিতরেই আসতেছে। আমি গিয়ে ছেলেটির দিকে চশমাটা এগিয়ে দিলাম। ছেলেটি চশমাটা নিয়ে মুছে চোখে দিয়ে বললো,
-ধন্যবাদ আপনাকে। আমি বলার মত কোনকিছু খুজে পাচ্ছি না। তখন ছেলেটিই বলতে শুরু করলো-
-জানিস মাহি বাচ্চাটির চেহারা আমি ঠিকমত দেখতে পাইনি ঠিকই কিন্তু তার পরম নির্লিপ্ততায় আমাকে স্পর্শ করাটাকে আমি কোনদিন ভুলতে পারবো না। একটু আগের ঘটনা তারপরে এই দুর্ঘটনা এতে আমাদের কোন হাত নেই। সবকিছুই নিয়তির খেলা। আমি সেদিন কিছু বলতে পারিনি। পরে বাচ্চাটির মা এসে ছেলেটিকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিয়ে গেল আর সেই সাথে ছেলেটির নামটাও শুনে গেল। সিফাত! একটি ভালবাসার নাম! একটি নির্ভরযোগ্য মানুষের নাম! একজন আদর্শ ব্যাক্তিত্বের নাম! পরিবর্তনশীলতার নাম।
এতকিছু কেন বলছি জানেন? কিছুদিন আগে সেই মেয়েটির সাথে দেখা হয়েছিল। দুই বছরের মত হলেও মেয়েটির চেহারা আমার ঠিক মনে আছে।কথা বার্তা বলার পরে জানতে পারলাম মেয়েটি তার বাচ্চার নামটাই পরিবর্তন করে সিফাত রেখেছে।শুনে মনটা খুশিতে ভরে গেল আমার। বাসায় ফিরতে ফিরতে সেদিন সন্ধ্যা হয়ে গেছিল। কারন সেদিন বাচ্চাটির সাথে কিছু সময় ছিলাম। কারন বাচ্চাটি দেখতে অনেক সুন্দর ছিল। যদিও বাচ্চাটির বয়স তখন প্রায় সাড়ে তিন বছর। বাসায় ফিরে এসে ফ্রেশ হতেই একটা মেসেজ আসলো। মেসেজটা দেখে মুচকি হেসে রান্নাঘরে গিয়ে কফি বানালাম।তারপর সেটা নিয়ে বেলকনিতে গেলাম। একটা কফির মগ ওর দিকে এগিয়ে দিলাম।
-আজ এতো দেরি করলে যে!
-তোমার আমাদের প্রথম দিনের পরিচয়ের কথা মনে আছে?
-থাকবে না কেন? সেই স্মৃতি আর স্পর্শটাকে কি কখনো ভোলা যায়! আমি মাঝে মাঝেই এখনো সেই স্পর্শটাকে অনুভব করি। আমি ফোন থেকে একটা পিক বের করে ওকে দেখালাম।
-এটা কার পিক?
-যার স্পর্শ তুমি এখনো অনুভব করো আমার কথা শুনে ভাল করে ছবিটা দেখতে লাগলো।
-উহুমমম, শুধু কি তোমার স্পর্শমানবের কথা ভাবলেই হবে নাকি আমারও এমন স্পর্শের কারো ব্যবস্থা হবে? ও কিছু বললো না শুধু আমার হাতের উপর হাত রাখলো। আর আমি ওর কাধে মাথা রাখলাম। সেই সাথে যুক্ত হলো আমাদের একসাথে কাটানো আর একটি চাঁদনী রাত।