গোপনে

গোপনে

ভোরবেলা ঘুম ভেঙেই কান্নাটা শুনতে পেয়েছিলো অয়ন্তিকা। ঘুমের ঘোরেই এদিক ওদিক তাকিয়ে আধো অন্ধকারে খুঁজছিলো কান্নার উৎসটা। পাশেই শুয়ে আছে,ঐক্য। অঘোরে ঘুমাচ্ছে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে গেছে। মুখটা ভীষন নিষ্পাপ। সাংসারিক জটিলতা যেন ওকে একটুও স্পর্শ করে না। ওর চোখে বিশ্ব সংসারের সব ভালো। অয়ন্তিকা ওর চোখ দিয়ে বিশ্ব দেখার চেষ্টা করে দেখেছে, পদে পদে ঠকতে হয় ঠিকই, কিন্তু ভালো থাকা যায়। যদিও চেষ্টা করেও অয়ন্তিকা কখনো ঐক্য হতে পারবে না। কাল রাত পর্যন্ত ল্যাপটপের স্ক্রিনে তাকিয়ে থেকে প্রায় মধ্যরাতে বিছানায় এসেছিল ঐক্য। তখন অয়ন্তিকা ঘুমিয়ে পড়েছিলো। কিন্তু কপালে একটা নরম ঠোঁটের ভিজে ভিজে স্পর্শ আর নাকে মৃদু নিকোটিনের গন্ধ অনুভব করেছিল, তার ভীষন কাছের মানুষটা ঘুমের আগে তাকে কপালে চুমু খেয়ে শুভরাত্রি জানালো। এই সময় নাকি ঐক্যের অফিসে ভীষন কাজের প্রেসার থাকে। প্রেসারটা চলবে মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত।

তাই বাড়ি ফিরতেও বেশ দেরি হচ্ছে ঐক্যর। অয়ন্তিকা যেহেতু হাউজওয়াইফ,তাই আলাদা বন্ধু সার্কেল ওর তৈরি হয়নি। সেইজন্যই হয়তো ঐক্যর ফেরার অপেক্ষাটা ওর প্রতিদিনই থাকে। শ্বশুর, শাশুড়ি, বড় জা, ভাসুর আর ভাসুরের আট বছরের মেয়ে ঋদ্ধি, ওর ডাক নাম বনি…এই নিয়ে অয়ন্তিকার সংসার। প্রত্যেকেই নিজের জগতে ভীষন ব্যস্ত। ভাসুর স্কুল শিক্ষক, জা তো মেয়ে নিয়েই ব্যতিব্যস্ত। ওইটুকু মেয়ের পড়াশোনা, স্কুল নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত, ইদানিং আবার অ্যাবাকাস আর ডান্স ক্লাসে ভর্তি করে, দিনরাত মেয়েকে নিয়ে এদিক ওদিক ছুটছে দিদিভাই। শ্বশুরমশাইয়ের ওষুধের দোকান। তাই এই বয়েস পর্যন্ত তিনিও ভীষন ব্যস্ত। শাশুড়িমা, সংসারের কাজ আর সিরিয়াল নিয়েই থাকেন। সমস্যা কেবল অয়ন্তিকার। বছর চারেক হলো ওর ঐক্যর সাথে বিয়ে হয়েছে। গ্র্যাজুয়েশনের পর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল ওর। ভালো পাত্র হাতের নাগালে পেয়ে আর হাতছাড়া করেনি অয়ন্তিকার বাবা।

অবশ্য ঐক্যর মত নির্বিবাদী ছেলে এ যুগে সত্যিই বিরল। অয়ন্তিকার সব দিকে ঐক্যর যে ভীষন খেয়াল তা নয়। তবে ও মুখ গোমড়া করে থাকলে, ঐক্য ঠিক বুঝতে পারে অয়ন্তিকার মনখারাপ। সেদিন ওর পছন্দের কিছু ঠিক বাড়িতে নিয়ে এসে ঢোকে। জয়েন্ট ফ্যামিলিতে বউয়ের জন্য আলাদা করে জিনিস আনাটা বড্ড দৃষ্টিকটু। তাই ঐক্য লুকিয়ে লুকিয়েই নিয়ে আসে ওর জন্য। এনেই বলে,দরজাটা বন্ধ করে দাও। তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে! অয়ন্তিকার হাতে একমুঠো জুঁই বা একটা চকলেট ধরিয়ে দিয়ে বলে , এটা শুধু তোমার জন্য। অয়ন্তিকা চকলেট খেতে ভীষন ভালোবাসে। ডার্ক চকলেট ওর ফেভারিট। বনির জন্য আলাদা আছে, এটা তুমি খাও.. বলেই ঐক্য ওর ঠোঁটটা ছুঁয়ে বলে, গোপনীয়তা ভালো অয়ন্তিকা। ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখতে একটু আড়াল প্রয়োজন। বনির জন্যও মাঝে মাঝেই ঐক্য এটা ওটা নিয়ে আসে।

কিন্তু বউয়ের জন্য আলাদা কিছু এনেছে জানতে পারলেই, ডাইনিং টেবিলে শাশুড়ি মা বলেন, যৌথ পরিবারের কিছু নিয়ম আছে ছোটবৌমা। সেগুলো মানতে শেখ। লুকিয়ে চুরিয়ে কিছু করার দরকার নেই। আমাদের দেখিয়েই করো, আমি ঐক্যকে কিছু বলবো না। সে তার মা,বাবাকে বাদ দিয়ে বউয়ের জন্য গোপনে জিনিস আনছে, এ তো ভালো কথা। ছেলে আমার বড় হয়ে গেছে। শাশুড়ি মায়ের কথা শুনে লজ্জায় অধো:বদন হয়ে যায় অয়ন্তিকা। ঐক্যর অনুপস্থিতিতে এসব কথা শুনলে চোখে জল চলে আসে ওর। কিন্তু এই ঘুমের ঘোরে যে কান্নার শব্দটা শুনতে পেল, সেটা ওর নিজের নয়। পাশের ঘরে বনি কি কাঁদছে! অয়ন্তিকার পাশেই বনিদের ঘর। বেশ কিছুক্ষণ কান খাড়া করে রইলো ও। না, বনি কাঁদেনি। ও বোধহয় এখনোও ওঠেইনি। পাশে রাখা মোবাইলটা হাতে নিতেই দেখতে পেলো, সবে ভোর চারটে দশ।

এইসময়টা মানে এত ভোরে তো একমাত্র শ্বশুর মশাইয়ের জাগার কথা। উনি ছাড়া এই ভোরে কেউ ওঠে না। একমাত্র ওনার দীর্ঘদিনের অভ্যেস, এই সময় উঠে রেডি হয়ে, মর্নিং ওয়াকে যাওয়া। বাদ বাকি সকলেরই সকাল হয় ছটা বাজলে। একমাত্র ঐক্যই আটটার আগে ওঠে না। তাই কান্নার আওয়াজটা কোথা থেকে এলো বুঝতে পারলো না অয়ন্তিকা। পাশাপাশি বাড়ি থেকে তো নয়ই। দোতলার ওপরে এসি ঘরে শুয়ে আছে ও। দরজা জানালা সব বন্ধ। তাই পাশের একতলা বাড়ি থেকে শব্দ আসা সম্ভব নয়। তাছাড়া সৌজন্য কাকুদের বাড়িতে কোনো বাচ্চা নেই। কাকু আর কাকিমা ছাড়া ওনাদের একমেয়ে। সে কলেজে পড়ে। আর অয়ন্তিকা স্পষ্ট শুনেছে একটা কচি বাচ্চার গলার কান্নার আওয়াজ। কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে ওর। কে কাঁদছে কে জানে! বেড়াল,কুকুর নয়, পরিষ্কার শুনলো মানুষের কান্নার আওয়াজ।

ঐক্য অকাতরে ঘুমোচ্ছে। আর ঘুম আসবে না অয়ন্তিকার। একবার ভেঙে গেলে আর ঘুম হয়না ওর। এপাশ ওপাশ করতে করতেই মোবাইলটা খুলে ফেসবুক স্ক্রল করতে লাগলো। মনটা যদিও চঞ্চল হয়ে আছে অকারণে। তবুও নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। ডক্টর বলেছেন, এসময় মন একটু চঞ্চল হবেই। কিন্তু দুশ্চিন্তা করা খুব ক্ষতিকর। কারণ অয়ন্তিকা দুশ্চিন্তা করলেই নাকি তার গর্ভের জনও বিচলিত হয়ে পড়বে। স্ট্রেস ভীষন খারাপ এসময়। মাত্র চারমাস হয়েছে অয়ন্তিকা ক্যারি করছে।

এখনও তার বড় হয়ে ওঠা কিছুই ফিল করেনি শরীরে। তবুও ডক্টর বারবার বলেছেন, সব সময় হাসিখুশি থাকতে। ঐক্য রোজই পেনড্রাইভে করে কমেডি ফিল্ম নিয়ে আসছে, আর সঙ্গে মজার মজার গল্পের বই। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের ‘দাম্পত্য কলহ’ পড়ে সেদিন ওর হাসি থামছিলো না। অয়ন্তিকাকে ঐক্য বলেছে, মনখারাপ না করে এগুলো দেখে সময় কাটাও। ও নিজেও অবশ্য পেটের মধ্যে বড় হয়ে ওঠা ভ্রূণটাকে নিয়ে ভীষন সচেতন। আগে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় তড়বড় করতো, এখন খুব সাবধানে পা ফেলে। ফেসবুকের নোটিফিকেশনে গতবছরের মেমোরি শেয়ার করলো। দেখেই চমকে উঠলো অয়ন্তিকা। ও পোস্ট করেছিল, হারিয়ে ফেললাম তাকে। নিচে অনেকে কমেন্ট করেছে, কি হয়েছে? কাকে হারালি? পরিচিত বা সোশ্যাল মিডিয়ার বন্ধুরা অনেকেই জানতে চেয়েছিল, ঠিক কি হয়েছে অয়ন্তিকার! কিন্তু ও কারোর কোনো রিপ্লাই দেয়নি।

কালো অক্ষরে শুধু ওইটুকু লিখেছিল, হারিয়ে ফেললাম তাকে। একমাত্র অয়ন্তিকা জানতো, কাকে হারালো।
এতক্ষনে অয়ন্তিকা ভোরবেলায় কারোর কান্নার আওয়াজ পাওয়ার ব্যাখ্যা খুঁজে পেল। অবচেতন মনে ও যার কান্না শুনতে পেয়েছিলো, সে আর কেউ নয়, ওর গর্ভের দুমাসের ভ্রূণটা। যার খবর ঐক্য আর অয়ন্তিকা ছাড়া আর কেউ জানতো না। ও না, আরেকজনও জানতো। যাকে অয়ন্তিকা নিজের মা মনে করেছিল। শাশুড়িমাকে বলেছিল ও, বাড়িতে প্রেগনেন্সি টেস্ট কিটের মাধ্যমে ইউরিন টেস্ট করেছি,আমি প্রেগন্যান্ট মা।

ঐক্যর মা বলেছিল, ডক্টরের কাছে গিয়ে কনফার্ম হতে। তারপর সবাইকে খবর দিতে। অয়ন্তিকার তখন দারুন উত্তেজনা। ভয় মেশানো আনন্দ। প্রথম মা হওয়ার অদ্ভুত অনুভূতি। ঐক্যর চোখে কৌতূহল। শুধু জিজ্ঞেস করছিল, কিছু ফিল করছো? অয়ন্তিকা বলেছিল, একটু বমি বমি ভাব, আর কিছু তো নয়। ঠিক সেই অবস্থাতেই এসেছিল অশোক ষষ্ঠী, নীল ষষ্ঠীর মত কিছু অনুষ্ঠান। ঐক্যর মা বলেছিলেন, ছোটবৌমা, এবারে তুমিও উপোষ করো। তার মঙ্গল হবে। এখন তো তুমিও মা। বড়বৌমার মত তুমিও রাতে শিবের মাথায় জল ঢেলে উপোষ ভাঙবে। মায়েদের ষষ্ঠী করতে হয়।

তবেই তো পুত্র লাভ হয়। অয়ন্তিকা একমুখ হেসে, লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলেছিল বেশ মা। অশোক ষষ্ঠীর দিনে তেমন কষ্ট হয়নি। কিন্তু নীল ষষ্ঠীর দিনে রাতে বাতি জ্বেলে, ফল খাওয়ার পর থেকেই শুরু হয়েছিল অসহ্য পেটের যন্ত্রনা। সারারাত যন্ত্রনায় ছটফট করেছিল অয়ন্তিকা। ঐক্য পেনকিলার দিয়ে বলেছিল, এটা খাও, কমে যাবে। অয়ন্তিকা ওষুধটা খেয়ে ঘুমিয়েছিল। হঠাৎই ভোর রাতে বিছানায় একটা ভিজে অনুভূতিতে ঘুমটা ভেঙে গিয়েছিল। ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসেছিলো অয়ন্তিকা। দেখেছিলো ওর পরনের নাইটিটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ভয়ে কেঁদে উঠেছিলো ও। ঐক্য ঘুম চোখে উঠে বসেছিলো। বলেছিল, এসব কি হলো! ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল অয়ন্তিকাকে। কিন্তু ডক্টর গম্ভীর মুখে বলেছিলেন, সম্ভবত ফার্স্ট স্টেজেই মিস ক্যারেজ। উনি কি প্রেগনেন্ট ছিলেন?

ঐক্য অসহায় গলায় বলেছিল, হ্যাঁ। মাত্র তিনদিন হলো জানতে পেরেছিলাম। অয়ন্তিকা তখনো ভয়ে কাঁপছিল। কেমন যেন উদ্ভ্রান্ত লাগছিলো ওর। মুহূর্তের মধ্যে কি যে ঘটে গেল! তারমানে পেটের মধ্যে ভ্রূণটা আর নেই! ওর মা হবার সম্ভাবনা ভ্রূণেই নষ্ট হয়ে গেল। অয়ন্তিকা ডাক্তারবাবুর সামনেই পাগলের মত বলে ফেলেছিলো, কাল নীল ষষ্ঠীর উপোষ ছিল। সারাদিন পেটের মধ্যে সে কঁকিয়ে কাঁদছিলো। খুব ক্ষিদে পেয়েছিলো তো তাই। ডক্টর অবাক চোখে তাকিয়ে বলেছিলেন, উপোষ করেছিলেন? আর ইউ ম্যাড? আর পেনকিলার তো পুরো প্রেগনেন্সি টাইমেও খাওয়া উচিত নয়।

আপনারা যে কি করে এত কেয়ারলেসের মত কাজ করেন! আপনারা শিক্ষিত মানুষ হয়েও কি করে যে এই ধরণের মিসটেকগুলো করেন, কে জানে! ডক্টরের গলায় বিরক্তি দেখেছিলো অয়ন্তিকা। ফেসবুকের স্মৃতিতে ফিরে এলো আবার আজকের দিনটা। আজকেও অয়ন্তিকা প্রেগনেন্ট। মাত্র চারমাসের প্রেগনেন্ট ও। তখন ছিল দুমাসের। আজকেও মা বলেছেন, নীলের উপোষ রাখতে। গতবছর নাকি অয়ন্তিকা মন দিয়ে করেনি বলেই, মা ষষ্ঠী ওকে কৃপা করেনি। স্বয়ং মহাদেব যদি কাউকে রক্ষা করেন তাহলে অমন অঘটন ঘটেনা। যেহেতু মন থেকে করেনি ,তাই ওর পেটের বাচ্চাটাও বাঁচেনি। অয়ন্তিকার ভোর ভোর ঘুম ভেঙেছে একটা কান্নার শব্দে। তবে কি কান্নাটা তার! নাকি ওর অন্তরাত্মার। যে চলে গেছে তাকে ভেবে আর লাভ নেই। যে আসতে চলছে তাকে যত্নে রাখতে হবে ওকে।

খুব যত্নে। ডক্টর বলেছেন, যেহেতু একটা মিসক্যারেজ হয়ে গেছে, তাই এটার ক্ষেত্রে সব রকম সাবধানতা নিতেই হবে। ঐক্য অফিস থেকে ফিরে রোজ জিজ্ঞেস করে, এই কিছু বুঝতে পারছো? পেটের মধ্যে কোনো কিক!
অয়ন্তিকা ঘাড় নেড়ে বলে, পারছি তো, আমার পেটটা একটু বড় হয়েছে। কিন্তু কিক,সুপারকিক ওগুলো তো বুঝতে পারছি না। তবে তুমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে যা হাত,পা ছোঁড়ো, তাতে বেবিও যে ফুটবলার হবে সে ব্যাপারে আমি নিশ্চত।
অয়ন্তিকার কথা শুনে ঐক্য লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলেছে, একটু শান্ত হলেও ক্ষতি নেই। আরেকটা শান্ত শান্ত অয়ন্তিকা চাই আমার। যে সবাইকে আপন করে নেবে।

সবাইকে আন্তরিকভাবে ভালোবাসবে, ঠিক এমন। ঐক্যর বুকে মাথা রেখে অয়ন্তিকা বলেছিল, সে বেঁচে থাকলে এখন হয়তো হামা দিতো। ঐক্য মাথা নিচু করে বলেছিল, সব আমার দোষে হয়েছে অয়ন্তিকা। পারলে আমায় ক্ষমা করো। আমিই তাকে রক্ষা করতে পারিনি। বাবা হবার মিনিমাম যোগ্যতা নেই আমার। অয়ন্তিকা ঐক্যর চুলগুলো ঘেঁটে দিয়ে বলেছে , এই তো আবার সে আসছে । তোমায় বাবা বলে ডাকবে বলেই। ঐক্য বলেছে, জানো অয়ন্তিকা, আমি কিছুতেই সেই রাতটার কথা ভুলতে পারিনা। শুধু মনেহয়, ওই রক্তের ডেলাটা আমার দিকে আঙুল তুলে বলছে, তুমি অপদার্থ।

জানো অয়ন্তিকা, কষ্টগুলো যখন জমাট বাঁধতে শুরু করেছিল তখনই তুমি আবার বললে, তুমি মা হতে চলেছ। তাই আর আগের কষ্টটাকে তরল হওয়ার সুযোগ না দিয়েই নতুনকে নিয়ে মেতে উঠেছিলাম। তবুও ভোলা কি এতোই সহজ। প্রথম শব্দেই আলাদা অনুভূতি আছেই। ঐক্যকে জড়িয়ে ধরে অয়ন্তিকা বলেছিল, পুরোনো দিনকে ফেলে আমরা অনেকটা পথ এগিয়ে এসেছি। এখন আমার রাতে নিশ্চিন্তে ঘুম হয়। সারারাত নির্ঘুম বসে থাকিনা সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে। আর তার পুরো ক্রেডিট এই পেটের মধ্যে পুচকুটার। তাই ও জন্মানোর আগেই আমাকে ঋণী করে দিলো।

বহুদিন পরে আবার ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেল অয়ন্তিকার। তাও আবার এমন তারিখে, যে তারিখটা ঘিরে ওর ভীষনরকম খারাপ স্মৃতির আনাগোনা। আজকের দিনেই কষ্টে পেটের মধ্যে কেঁদেছিল সে। বারবার যেন বলছিলো, মা খেতে দাও। লোকে বলছিলো, মাত্র দু আড়াই মাসে নাকি কোনো অবয়বই তৈরি হয়না, রক্তপিন্ড থাকে মাত্র। কিন্তু কেউ শুনতে না পেলেও অয়ন্তিকা শুনেছিল তার কঁকিয়ে কান্নার আওয়াজ। আজ একবছর পরেও সেই কান্নার আওয়াজ শুনে ঘুম ভেঙে গেল ওর। লোকে শুনলে বলবে, মানসিক সমস্যা। কিন্তু অয়ন্তিকা জানে, এটা শুধুই পাপবোধ। তাকে বাঁচিয়ে না রাখতে পাড়ার কষ্ট।

মোবাইলটা রেখে ঐক্যর বুকের কাছে ঘেঁষে শুলো ও। ভয় করছে ওর। আবার সেই বিভীষিকাময় দিন। একটা ঠান্ডা স্রোত শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে যাচ্ছে অয়ন্তিকার। ও নিজের নাইটিটা হাত দিয়ে ভালো করে ধরে দেখলো, ভিজে নেই তো! নিশ্চিন্ত হয়েই মনে মনে ঈশ্বরকে স্মরণ করলো। আজ সকাল সকাল স্নান করে রান্নাঘরে যেতে হবে, কাল রাতেই শাশুড়ি মায়ের নির্দেশ পেয়ে গেছে অয়ন্তিকা। বিছানা ছেড়ে ওঠার আগেই ঐক্য বললো, ব্রেকফাস্ট করবে ঠিক সময়ে। কিসব পুজো আছে বলে যেন,উপোষ করো না প্লিজ।

অয়ন্তিকা জানে, আজ নীল ষষ্ঠী। তার যেহেতু গর্ভে একজন বেড়ে উঠছে, তাই তাকেও আজ ষষ্ঠী পালন করতে হবে দিদিভাইয়ের মত। এতে নাকি সন্তানের কল্যাণ হয়। মা বলেছেন, গতবার নিষ্ঠার সাথে পালন করেনি বলেই সে চলে গিয়েছিল অয়ন্তিকাকে ছেড়ে। এবারে আর কোনোরকম গন্ডগোল হতে দেবে না অয়ন্তিকা। একমনে এই পালনটা করবে ও। ঐক্য বা ডাক্তার যাই বলুক, ঈশ্বরের ওপরে কারোর ক্ষমতা নেই।

ভয়ঙ্কর ঈশ্বর বিশ্বাস অয়ন্তিকার। সেই কোন ছোটবেলা থেকে মায়ের পুজোর ফুল তুলে দিতে দিতেই অয়ন্তিকার মধ্যে ঈশ্বর ভক্তি প্রবল হয়েছিল। আজও সেই ভক্তি অটুট। স্কুলের বন্ধুরা পরীক্ষার সময় ওর কপালের বড় দইয়ের ফোঁটা নিয়ে হাসাহাসি করতো। কিন্তু তবুও ওর বিশ্বাসে এতটুকু ভাঙন ধরেনি। কালরাতেও যখন শাশুড়ি মা বললেন, তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিল অয়ন্তিকা, যে নীল ষষ্ঠী সে পালন করবেই।গরমের মধ্যেই নতুন তাঁতের শাড়ি পরে লুচি বেলছে অয়ন্তিকা। পাশেই বড় জা আর শাশুড়ি আছে। শাশুড়িমা বললেন, এবারে নীলের ঘরে বাতি দিয়ে তবে উপোষ ভাঙবে বুঝলে। কথাতেই আছে “নীলের ঘরে দিয়ে বাতি, জল খাবে গো পুত্রবতী। ”

গরমে হাঁসফাঁস করছিল অয়ন্তিকা। নতুন শাড়ি, শেষ চৈত্রের গরম, শরীরের অস্বস্তি…সব মিলিয়ে কষ্ট হচ্ছিল অয়ন্তিকার। কিন্তু তবুও সন্তানের স্বার্থে ও মুখে ম্লান হাসি নিয়েই বললো, হ্যাঁ মা, আপনি যা বলবেন তাই করবো।
বড় জা বললো, কিন্তু অনু, আগেরবার এই উপোষ করার জন্যই তো ডক্টর তোকে বকেছিলো। এবারে বরং এসব করিস না। বাচ্চাটা হোক, তারপর সারাজীবন এসব করিস। বড়জায়ের দিকে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে অয়ন্তিকা বলেছিল, প্লিজ দিদিভাই এভাবে বলো না। সে ভুমিষ্ট হয়নি ঠিকই, কিন্তু তার অস্তিত্ব তো রয়েছে আমার শরীরে। তাছাড়া মা বলেছেন, তার ভালোর জন্যই নীল করা উচিত।

দিদিভাইকে উদ্দেশ্য করে মা গজগজ করে বললেন, মনে এসব ছিল বলেই তো ছেলে না হয়ে মেয়ে হলো। বংশের প্রথম সন্তান ছেলে হবে আশা করেছিলাম। দিলে তো আশায় জল ঢেলে। এখন আবার ছোটবৌমার মাধ্যমে আমার ইচ্ছেপূরন হোক সেটা বোধহয় চাইছো না। তাই এমন ভুলভাল কথা ওকে শেখাচ্ছ। ছোটবৌমা, এসব কথায় কান না দিয়ে লুচিগুলো ভেজে ঐক্য আর তোমার দাদাভাইকে খেতে দিয়ে দাও। আমি পুজোর জোগাড় করতে গেলাম। এমনিতেই ভোরের স্বপ্নটা নিয়ে আতঙ্কে ছিল অয়ন্তিকা। তাই ধীরে ধীরে ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বললো।এমনিতেই বিতর্ক ওর বড্ড অপছন্দের সাবজেক্ট। বরাবরই ধীর-স্থির বলে ওর প্রশংসা করে সবাই। বিয়ের পরেও শ্বশুরবাড়ির মানুষজনের প্রশংসা কুড়িয়েছে ও শান্ত বউ হিসেবে। তাই নিজের দুঃখ-কষ্ট চেপে ভালো বউ হবার তাগিদেই সকলের কথা মেনে চলে অয়ন্তিকা। আজও তার ব্যতিক্রম হবে না।

লুচি ভাজা শেষ হতে হতেই ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল অয়ন্তিকা। ক্ষিদে পাচ্ছিলো অসম্ভব। এসময় কি বেশি ক্ষিদে পায়! পেটের ভিতরে যেন একশো ইঁদুর দৌড়াচ্ছে, গলাটা শুকিয়ে যাচ্ছিল ওর। ঐক্য অফিস বেরোনোর সময়েও কানে কানে বলেছিল, ঘরে বিস্কিট রেখে এসেছি লুকিয়ে খেয়ে নিও প্লিজ। অয়ন্তিকা ক্লান্ত হেসে বলেছিল, একদিনই তো, একটু কষ্ট করি। ঐক্য বলেছিল , সে জন্মানোর পরে এগুলো পালন করলে হতো। আমি তোমার বিশ্বাসে আঘাত করতে চাইছি না অয়ন্তিকা, কিন্তু একটু তো বোঝো। এ সময় সারাদিনের উপোষ ঠিক কতটা ক্ষতিকর। আগেরবারের ঘটনাটা বোধহয় ভুলে গেছো তুমি। অয়ন্তিকা ঐক্যর ঠোঁটে আঙুল চাপা দিয়ে বলেছে,প্লিজ ওসব কথা আর বলো না। এবারে সব ভালো হবে। ঐক্য একটু বিরক্ত মুখেই বেরিয়ে গেছে।

নিজের ঘরে এসময় আর যায়না অয়ন্তিকা। দোতলাটা বড্ড গরম হয়ে যায়। দুপুরে গিয়ে আবার এসি চালায়।রান্নাঘরের পাশের ঘরটাতেই এসময় থাকে ও। ঘরটা বেশ ঠান্ডা। জানালার ধারে বসে ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাচ্ছিলো অয়ন্তিকা। আর পেটের মধ্যে ক্ষিদের প্রকোপ অনুভব করছিল। রান্নাঘর থেকে খাবারের গন্ধ ভেসে আসছিল, ক্ষিদেতে গাটা গুলিয়ে উঠছিলো। মাথাটাও কেমন ঝিম ঝিম করছিল ওর। হঠাৎই জানলার সামনে একজনকে দেখে চমকে উঠল অয়ন্তিকা। একটা বাচ্চা ছেলে। মুখে নীল রং, কপালে ত্রিনয়ন,মাথায় জটা, পরনে একটা বাঘছাল, হাতে ডুগডুগি।

অয়ন্তিকা আগেও রাস্তায় এদের দেখেছে। বহুরূপী সেজে ভিক্ষে করে। আজ নীলের দিনে শিব সেজে রাস্তায় বেরিয়েছে ভিক্ষে করতে। ছেলেটাকে দেখেই ও ভাবলো ওর হাতে দশ টাকা দেবে। কিন্তু তার আগেই ছেলেটা জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে অয়ন্তিকার হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বললো, খেয়ে নাও, এক্ষুনি। নাহলে আমি ভয়ানক রাগ করবো। কিছু বোঝার আগেই ছেলেটা ভোকাট্টা।প্যাকেটটা খুলে আরো চমকে গেল ও। ওর প্রিয় ব্র্যান্ডের ডার্ক চকলেট, প্রিয় বিস্কিট, জল ভরা সন্দেশ অদ্ভুত ব্যাপার তো, ওই ছোট্ট শিব কি করে জানলো, এগুলো ওর প্রিয়। কি করেই বা জানলো, ওর ভীষন ক্ষিদে পেয়েছে, ক্ষিদের চোটে বমি বমি পাচ্ছে। এত কিছু তো ওই অপরিচিত মহাদেবরূপী ছেলেটার জানার কথা নয়। তাহলে!

অনেকগুলো প্রশ্ন মাথায় একসাথে উঁকি দিচ্ছিলো। তবে অয়ন্তিকা শুনেছিল, যারা খুব বেশী আস্তিক,তাদের নাকি ভগবান স্বয়ং দেখা দেন। ছোটবেলায় ঠাম্মার মুখে শুনেছিল, একবার নাকি ওর ঠাকুরদার ভীষন বিপদের দিনে এক বয়স্ক মহিলা সাহায্য করেছিলেন। পরে হাজার খুঁজেও সেই মহিলার আর দেখা পাননি ঠাকুরদা। সেই থেকেই সকলের বিশ্বাস হয়েছিল, মা দুর্গা স্বয়ং এসেছিলেন ভক্তের কাছে অমন ছদ্মবেশে। তাহলে কি এই মুহূর্তে না খেলে অয়ন্তিকার সন্তানের কোনো ক্ষতি হবে! তাই কি বহুরূপীর সাজে স্বয়ং মহাদেব এলেন ওর কাছে! আর চিন্তা ভাবনা না করেই বিস্কিট আর চকলেটে কামড় দিলো অয়ন্তিকা। খাবারগুলো খেয়ে অনেকটা জল খেতেই গর্ভের সন্তানটা যেন তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেললো।

ঘুম পাচ্ছিলো অয়ন্তিকার। বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে পড়লো। ঐক্যকে একটা ফোন করতে হবে ছেলেটা ছুটতে ছুটতে এসে বললো, কাজ হাসিল। আমার পাওনা দাও। ঐক্য পকেটে হাত ঢুকিয়ে পার্সটা বের করলো। অফিস বেরিয়েই রাস্তার ধারে এদের রোজ দেখে ঐক্য। বাচ্চা বাচ্চা ছেলে-মেয়েগুলো মুখে সস্তার রং মেখে বহুরূপী সেজে ভিক্ষে করতে বেরোয়। রোজই কিছু না কিছু হাতে দেয় ওদের। অনেকেই বলে, ভিক্ষেটা ওদের বাহানা। কিন্তু ঐক্য ভাবে, অভাব আছে বলেই বাহানা খোঁজে। আত্মসম্মান নেই বলেই, লোকের কাছে হাত পাতে। অতশত যুক্তি তর্কে না গিয়েই খুচরো পয়সা দেয় ওদের। আজও দেখলো লাল্টু নামের ছেলেটা হাতে ডুগডুগি নিয়ে শিব সেজেছে। দেখেই মাথার মধ্যে খেলে গিয়েছিল ভাবনাটা। এই স্টেজে অয়ন্তিকাকে কিছুতেই সারাদিন না খেয়ে থাকতে দিতে পারে না ও।

ঐক্যর মায়ের পুরাতনী ভাবনার পরিবর্তন কোনোদিনই হবে না। বহু চেষ্টা করে দেখেছে ও, তাতে মান অভিমান,কান্না ছাড়া আর কিছুই হয়নি। মাঝে মাঝে ঐক্যর প্রতিবাদের উত্তরে মা বলেছে, তাহলে তুই বউয়ের হয়ে ঝগড়া করতে এসেছিস! এ সংসারে তাহলে আমার গুরুত্ব একেবারেই শেষ হলো। ঐক্য বুঝেছে, জেনারেশন গ্যাপ মেটানো ওর কম্ম নয়। অবুঝ মানুষকে কোনো যুক্তি দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয়। এখন মুশকিল হচ্ছে, অয়ন্তিকাও সেই মায়ের কথা মত কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হয়ে, নিজের ক্ষতি করে চলেছে। আগের বার এতবড় ক্ষতি হয়ে যাবার পরেও ওর শিক্ষা হলো না। এমনকি এই ব্যাপারে ও ঐক্যর কথাও শুনবে না। তাই বাধ্য হয়েই খাবারগুলো কিনে লাল্টুর হাতে দিয়ে বলেছিল, ওই গোলাপি রঙের বাড়ির দক্ষিণের জানালা দিয়ে এগুলো রেখে আসতে হবে।

ঐক্য জানে, এখন অয়ন্তিকা দোতলার ঘরে যাবে না। রান্নাঘরের পাশের ঘরটাতেই রেস্ট নেবে বা ম্যাগাজিন পড়বে। দুপুরে সবার খাওয়া না মিটলে ওপরে আর ওঠে না ও। তাই একতলার জানালাটা দূর থেকেই দেখিয়ে দিয়েছিল লাল্টুকে।লাল্টু ফিরেই বললো , একেবারে ওই বাড়ির ছোটবউটার হাতে দিয়েই পালিয়ে এসেছি। বলেছি, খেয়ে নাও। ঐক্য ওর হাতে একটা একশো টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বললো, তুইও আজ পেট ভরে খাস। দশ মিনিটের মধ্যেই ঐক্যর পকেটে ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠলো। অয়ন্তিকা বেশ উত্তেজিত হয়ে বলল, আজ একজন বাচ্চা শিবের রূপ ধরে এসেছিল। আমার হাতে খাবার দিয়ে গেছে! ঐক্য হেসে বললো, অয়ন্তিকা তোমার মাথাটা গেছে । এমন আবার হয় নাকি?

অয়ন্তিকা আরো উৎসাহে ফিসফিস করে বললো, আমি তোমার মাকে লুকিয়ে সেসব খেয়েও নিয়েছি, তুমি ফিরলে আরো চকলেট আছে, তোমায় দেব। তখন দেখবো তোমার অবিশ্বাস কি করে চিরস্থায়ী হয়। ঐক্য স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো, বেশি করে জল খেয়ে একটু রেস্ট নাও প্লিজ। অয়ন্তিকা হাসতে হাসতেই বললো,মাঝে মাঝে বোধহয় কিছু জিনিস গোপন করা উচিত, তাই না ঐক্য! এই যেমন তোমার মাকে লুকিয়ে ঐক্য বললো, কিছু গোপনীয়তায় জীবন বাঁচে অয়ন্তিকা। তাই একটু আড়াল ভালো। ফোনের ওপ্রান্ত থেকেই অয়ন্তিকার হাসির আওয়াজ শুনতে পেলো ঐক্য। ও মনে মনে বললো, দেখ, তোর বাপ আজ তোকে বাঁচিয়ে দিলো রে পুচকু। পেট থেকে বেরিয়েই আগে বাবা বলে ডাকবি বুঝলি!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত