“আমি প্রেমে পড়েছি! আই এম ইন লাভ!!!” ছোটভাইয়ের এরকম চিৎকার শুনে চমকে গিয়ে ধড়মড় করে বিছানা থেকে উলটে পড়ে গেলাম ! পা ভাঙল কি না কে জানে ! হুমায়ূন আহমেদের একটা উপন্যাস পড়ছিলাম, কিছুক্ষণের জন্য অন্য একটা জগতে হারিয়ে গিয়েছিলাম। শায়ানের (ছোট ভাই) চিল্লানি শুনে আমি কিছুক্ষণ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছি। আম্মু আব্বু বাসায় নেই তো তাই বান্দরটা এত সাহস করে চিৎকার করে এসব কথা বলছে ! দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বললাম,
– কি বলছিস তুই এসব ! গাধা কোথাকার ! আমার মেজাজকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে পা নাচাতে নাচাতে বলল,
-পাশের বাসায় রাইসা নামের মেয়েটা ! কি কিউট ! কি ডিসেন্ট !
-হতেই পারে, ক্রাশ খাওয়া অন্য ব্যাপার।
-না আপু তুমি বুঝছ না ব্যাপার টা ! আমার প্রথম ভালবাসা ছিল ইমু। ওর মত মেয়ে আর হয় না ! ক্লাস সিক্সে ওকে ঐ যে আজিজ স্যারের প্রাইভেটেই প্রথম দেখি। তারপর আস্তে আস্তে ওকে কখন যে ভালবেসে ফেলি…অনেক কিছু হয়ে গেছে আপু। ও আমাকে ছ্যাকা দিয়ে ঐ যে কলেজের ভাইয়াটার সাথে লেগে গেছে। সেই সময়টায় লিজা আমার পাশে ছিল। আমাকে এত্ত সাপোর্ট করেছে ! পুরো ক্লাস সেভেন আমার সাথে ছিল। কিন্তু আমি পরে জানলাম ওর তো বিএফ আগে থেকেই ছিল ! কি যে কষ্ট পেয়েছি আপু ! অবশেষে এই রাইসা মেয়েটা আমার জীবন বদলে দিয়েছে ! আপু আমি একেই বিয়ে করব, কেমন?
-তোর বয়সে থাকতে আমরা ভাজা মাছ উলটে খেতে জানতাম না ! মা কাঁটা বেছে দিত…আর তুই কি না !
-তুমি তো এখনো কাঁটা ঠিকভাবে বাছতে পারো না ! এইজন্যই তো এত বড় হয়ে গেছ তাও বিএফ জোটে নাই ! ভালবেসে ব্যর্থ হওয়ার কষ্ট তুমি কি বুঝবে হুহ !
আমাকে পুরোপুরি হতভম্ব করে সে চলে গেল…ইচ্ছে ছিল কষিয়ে দুটো চড় বসিয়ে দেওয়ার। কিন্তু আম্মুর আদরের ধন কি না ! একটা মারলেই দশটা মারের বিচার আম্মুর কাছে দেবে আর তারপর তার দুইগুণ…না না তিনগুণ মার আম্মু আমাকে দেবে ! ভাবতে ভাবতে গায়ে কাটা দিচ্ছিলো ! কিন্তু এই একটা সুযোগ পেয়েছি বটে ! শায়ানকে আমি ছোট থেকেই হিংসে করতাম, আম্মু সব ভালবাসা ওর ওপর ঢেলে দিয়েছে !
যদিও আব্বুর ভালবাসার সিংহভাগ আমি পেয়েছি কিন্তু তাতে কি? আম্মুরটারও সিংহভাগ আমার চাই ! তাই এই সুযোগে শায়ানের বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র রটে ফেললাম ! আমারও তো ১০ বছরের সিরিয়াল দেখার অভিজ্ঞতা আছে কি না ! প্ল্যানটার কাজ শুরু করে দিলাম ঠিক পরের দিনই। পাশের বাসার আন্টির বাসায় গেলাম গল্প করতে। আন্টির সামনে শায়ানের ব্যাপারে বললাম, সে রাইসাকে পছন্দ করে এসব। আম্মুকে বলতে মানা করলাম কারণ আমি জানি আমি মানা করলে আন্টি অবশ্যই বলবে ! অপেক্ষা করতে লাগলাম আন্টি কখন আম্মুকে বলে আর শায়ান ইচ্ছামত পিটানি খাবে !
আজ সারাদিন ভার্সিটিতে ছিলাম তবে যতদূর জানি আন্টি তার কাজ করে দিয়েছে। রাতে খাওয়ার সময় আম্মু গম্ভীর গলায় আমাকে বলল “খাওয়া শেষে আমার ঘরে আসবি।” আমার মনে তো আনন্দের জোয়ার ! আম্মু কি তবে শায়ানের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য ডাকছে ! আমিও খেয়ে যথাসময়ে উপস্থিত। ঘরে ঢোকার পর আম্মু কেন জানি দরজা বন্ধ করে দিল। অত্যন্ত গম্ভীর সুরে বললো “রাইয়ানের সাথে তোর কি সম্পর্ক?” রাইয়ান হলো রাইসার বড় ভাই, আমার অনেক সিনিয়র।
-কই? কি সম্পর্ক আম্মু?
-(রেগে গর্জন করে) তোর সাথে নয়ত আর কার সাথে? আজ ভাবি আমাকে অনেক কথা শুনিয়ে গেছে। বলেছে আমি যেন আমার বাচ্চাদের সামলে রাখি। ওনার বাচ্চাদের আশেপাশে যেন ঘেষতে না দেই !
-(আকাশ ভেঙে আমার মাথার ওপর পড়ল) আম্মু কি বলছ তুমি এসব? স্পেসিফিকালি কারো নাম কি বলে নি?
-না…তবে যতদূর বুঝলাম যে তোর কথাই বলছে। আমি তোর বাবার সাথে কথা বলছি। তোর এবার একটা বিয়ে দেওয়া দরকার। ভাবিকেও দেখিও দেব আমার মেয়েকে বড় ঘরে বিয়ে দিয়ে ! খুব বাজেভাবে ফেঁসে গেছি। নিজের পাতা ফাঁদে নিজেই ! খুব টেনশন হচ্ছে। ক’দিন ধরে অনেক আত্নীয় স্বজন আসছে যাচ্ছে। আব্বুর সাথে কথা বলার সাহস সুযোগ কোনটাই এখনো হয়নি। হঠাৎ মটাৎ কোন ছেলে দেখতে আসে কি না কে জানে ! ব্যাপারটা একমাত্র আব্বুই সামাল দিতে পারবে।
বিকেলবেলা আব্বুকে নিজেই গিয়ে বললাম শোবার আগে যেন আমার রুমে আসে। কিছু জরুরি কথা আছে। আমার কথায় আব্বু ঘরে এসেছেন। আব্বুকে সামনে বসিয়ে রেখে আমি অনবরত সব বলে যাচ্ছি। প্রথমে একটু জ্ঞান দিলাম, ফেয়ার এন্ড লাভলীর এড থেকে কিছু ডায়ালগ ধার নিলাম -“মেয়েদের আগে জব করা উচিৎ তারপর বিয়ে, তাহলেই তো ইকুয়াল ইকুয়াল !” আব্বু গম্ভীর ভঙ্গিতে চোখ বন্ধ করে মনোযোগ দিয়ে সব শুনে যাচ্ছেন। এরপর আমি শায়ানের ব্যাপারটা, আমার চক্রান্ত- সব খুলে বললাম। আমার কথা শেষে বাবা গা দুলিয়ে হাসতে হাসতে বলছেন “ওরে পাগল মেয়ে আমার ! তুই একদম টেনশন নিস না ! তোর আম্মুর সাথে আমি কথা বলব। তুই পড়াশুনা কর ভালমতো।” আব্বুর কথায় বড় একটা বোঝা মাথা থেকে নেমে গেল। আম্মুকে যে কি বোঝালো, পরে আর আম্মু বিয়ের কথা তোলে নি। বাসায় শান্তি ফিরে এলো (দশদিন পর) আমি বিছানায় শুয়ে ফোন গুতাচ্ছি। শায়ান এসে আমাকে বলল,
-আপু কাল ঐ মেয়েটা কে এসেছিলো রে? (কণ্ঠে যেন মধু ঝড়ছে) ফোন থেকে মুখ না তুলেই জবাব দিলাম,
-কোন মেয়েটা?
-ঐ যে মৌসুমি আপুর সাথে যে আসলো…
-ওহ ঐটা? ও তো মৌসুমির ছোটবোন মিম। জুনিয়র আমাদের, কেবল ফার্স্ট ইয়ারে। কেন রে?
-আসলে আপু মেয়েটা খুব কিউট।
আর আজকাল তো আবার সিনিয়র আপুদের সাথে রিলেশনের ট্রেন্ড চলছে তুমি একটু কথা বলে দেখোই না ! আজ চড়টা দিতে পারলে বেশ হত ! কিন্তু তা তো সম্ভব না কারণ আম্মু বাসাতেই আছে। শায়ানের কথা শুনে ওর দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আমার এখন কিচ্ছু করার নেই ! কিচ্ছু না !