অচেনা মানুষ

অচেনা মানুষ

পড়ালেখার চাপে আপার শশুড়বাড়িতে আমার তেমন একটা যাওয়া হতো না! এই নিয়ে আপার অভিযোগের কমতি ছিলো না!

– আমি গ্রামে থাকি তাই যে তুই আসতে চাস না সেটা আমি বুঝিরে পুটলি! ঘুরে বেড়ানোর জন্য গ্রামের মত সুন্দর জায়গা আর কোথাও নেই! এখন তো পরীক্ষা শেষ – এইবার অন্তত আয়! আর আসলে কিন্তু সকালে এসে বিকালে চলে যেতে পারবি না! বেশ কিছুদিন আমার কাছে থাকবি!

– আচ্ছা আপা আসবো কিন্তু তোমার শশুড়বাড়ির মানুষের সামনে আমাকে পুটলি ডাকবে না!

– আপা হাসেন আর বলেন আচ্ছা ডাকবো না – তুই আগে আয় তো!

দুইদিন পর আম্মা আব্বা আমি আর ভাইয়া মিলে আপার শশুড়বাড়িতে যাই – আপার শশুড়বাড়ি যৌথ পরিবার – শশুড় শাশুড়ী ভাসুর জা তাদের বাচ্চা আর ননদ দেবর মিলে একটা ফুটবল টিম! এত মানুষের ভীড়ে আমাদের খুব সংকোচ হয়! তবুও আপার জন্য যেতে রাজী হই আমরা! আপাকে এখন যতোটা আমাদের মনে হয় তার চেয়ে ঢের বেশী সেই বাড়ির মানুষ মনে হয়!

আপার চাল চলন দেখলে মনেই হয় না – শহরে বড় হয়েছে – নাটক থিয়েটার করা পাড়া কাঁপানো সুন্দরী ছিলো আপা কিন্তু এখন সেই আপাকে দেখলে মনে হয় – এই মেয়ে বুঝি জন্ম থেকেই এই বাড়িতে বড় হয়েছে! সুতি একটা শাড়ি পড়ে এ ঘর ও ঘর করে সারাদিন কাজ করে ; জবজবা করে মাথায় তেল দিয়ে রাখে ; খাবারের পরে শাশুড়ী জা’দের সাথে পান মুখে পুড়ে দেয়! আমরা খুব বেশি শহুরে হয়ে গেছি কিনা জানি না তবে এই আপাকে এখন আর আমাদের কেন জানি আপন মনে হয় না! দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে আব্বা আম্মা আর ভাইয়া আমাকে রেখে চলে যান – আমার তখন যে কী অসহায় লাগে অথচ মাত্র তিন বছর আগেও আপাকে ছাড়া রাতে ঘুমানোর কথা ভাবতেই পারতাম না! আমরা আসলেই অভ্যাসের কাছে দায়বদ্ধ – অভ্যাস বদলে ফেললে মায়ার সুতোতেও টান পড়ে যায়!

– কিরে তোর কি মন খারাপ হয়ে গেল? আরেহ বোকা আমি তো আছি! মন খারাপ করিস না! আপা আমার কাঁধে হাত রেখে বলে।

– না আপা ; মন খারাপ করছি না!

– আয় চল আজকে তোকে নিয়ে নদীতে গিয়ে নৌকা চড়বো!

আপা রেডি হতেই আমি বললাম – দুলাভাই যাবে না আপা? আপা বললো – নদীকে ঘিরেই তার ব্যবসা বানিজ্য তাই নতুন করে নদীর কাছে তার আর কোনো আবেদন নাই! আপা যতো সহজভাবে সবাইকে আপন করে নিয়েছে সে হিসেবে দুলাভাই একেবারে উল্টো – নিজেকে আড়াল করে রাখতেই পছন্দ করেন ; একেবারেই খুব কম কথা বলেন – তবে বেশ গুছানো মানুষ ; গ্রামে থাকলেও আপার কোনো কিছুই কমতি রাখেন নি! হয়তো সে জন্য দুলাভাই এর প্রতি আমাদের সবার প্রবল শ্রদ্ধাবোধ কাজ করে!

নদীর পাড়ে যেতে যেতে আপা হড়বড় করে সব আত্নীয় স্বজনদের কথা জানতে চান – আমি যতখানি জানি ততোখানি বলে যাই। একসময় আমরা দুই বোন নৌকায় উঠে বসি – আপা গুনগুন করে গান গায় আমি আপার দিকে তাকিয়ে বলি – আপা তুমি ভালো আছো?

– আপা হাসে আর বলে – ভালো থাকা খুব সহজ নয়রে পুটলি তবে ভালো থাকার অভিনয়টুকু করা খুব সহজ!

আমি আর কিছু বলি না – শুধু মনে পড়ে – আমাদের এলাকার মিরাজ ভাইয়ের সাথে আপার প্রেমের ঘটনা এলাকায় মুখরিত ছিলো – আপা আর মিরাজ ভাই একই থিয়েটারে নাটকের রিহার্সাল করতো! আকর্ষণীয় রূপ আর অভিনয় দক্ষতা দিয়ে আপা হয়তো আজ মিডিয়া জগতে দাপিয়ে বেড়াতে পারতো কিন্তু পরিস্থিতি তাকে আজ কোথায় নিয়ে এসেছে! মিরাজ ভাই এর পুরো পরিবার আমেরিকায় থাকতেন – উনাদের পাঠানো ভিসাতে আমেরিকায় ঘুরতে গেলেন মিরাজ ভাই আর যাবার আগে আপাকে কথা দিয়ে গেলেন – ঘুরে এসেই উনি আম্মা আব্বার কাছে আপার জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবেন!

এরপর প্রায় দুই বছর কেটে গেলো – মিরাজ ভাই কোনো যোগাযোগ করলেন না! ফেসবুক ডিএক্টিভেট করে ফেললেন – মিরাজ ভাই এর বন্ধুবান্ধদের সাথে যোগাযোগ করেও মিরাজ ভাই এর কোনো খবর আপা বের করতে পারলেন না!

আম্মা আব্বা আর অপেক্ষা করতে রাজী হলেন না তাই বিয়ের জন্য বিভিন্ন পাত্রের বায়োডাটা আপাকে দেখাতে লাগলেন! সবাইকে চমকে দিয়ে আপা এ বিয়েতে মত দেন কিন্তু আম্মা আব্বা খুব খুশি হলেন না কারণ এ বিয়েটা হলে আপাকে গ্রামে থাকতে হবে কারণ পাত্রের ট্রলারের ব্যবসা তাছাড়া বড় সংসার! তবুও আপা এই প্রথম কোনো বিয়েতে মত দিলেন তাই আম্মা আব্বাও মত দিলেন!

বিয়ের পর থেকে আপা একেবারেই বদলে যান – স্বল্পভাষী আপা খুব কথা বলতে থাকেন; কথায় কথায় হাসেন – পুরোপুরি অচেনা মানুষ হয়ে যায় আপা! আমার কেন জানি এই আপাকে দেখলে খুব অস্বস্তি হয়! কাছের মানুষের অচেনা হাসিখুশি রূপে কোথাও যেন হু হু করে হাহাকারের বাতাস বয়ে যায়! সেই বাতাসের সাথে আমার দীর্ঘশ্বাস মিশে যায়!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত