ভ্রান্ত ধারণা

ভ্রান্ত ধারণা

আমার ছেলে আহনাফ বায়না ধরেছে তাকে নিয়ে ঘুরতে যেতে হবে।যেহেতু আজকে ছুটির দিন তাই না করতে পারি নি।বিকেলে আহনাফ কে নিয়ে একটা শিশু পার্কে ঘুরতে যাই। হঠাৎ দেখতে পেলাম আমার বন্ধু নিলয়। সাথে একটা বাচ্চা ও আছে।একটু এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলাম –

–কিরে বন্ধু কেমন আছিস?
~আরে হিমু তুই..!এইতো ভালো আছি।তুই কেমন আছিস?
–আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তা তর ছেলে?
~হুম আমার ছেলে।নাম রিফাত।
–আমার ছেলে। নাম আহনাফ। আচ্ছা বন্ধু চল এই দিকটায় বসি।বসে আলাপ করা যাবে।
~হুম চল।
–সেই যে ইউনিভার্সিটি থেকে বের হওয়ার পর আর দেখা নেই।অনেকদিন পর দেখা।
~হুম বন্ধু। তারপর এখন কি করছিস,?
–একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে এসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে আছি।তুই?
~পল্লী বিদ্যুৎ অফিসে একজন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে আছি। আর বলিস না।ঘুষের ছড়াছড়ি। চাকরিটা নিতে আমার প্রায় পনেরো লক্ষ টাকা লেগেছিলো। তারপর অবশ্য দুই বছরেই টাকাটা আমিও ইনকাম করে ফেলি।

–কি বলিস! তারমানে তুই ঘুষ খাওয়া শুরু করেছিস?
~কি আর করা বন্ধু। নিজে দিয়েছি পনেরো লক্ষ টাকা।এখন আমি নিবো না সেটা কি করে হয়।
~বন্ধু একে তো ঘুষ দিয়ে চাকরি নিয়েছিস।সারাজীবন যে টাকা ইনকাম করবি সব টাকাই হারাম হবে।

তাছাড়া এখন নিজেও ঘুষ নিচ্ছিস।সবই তো হারাম খাচ্ছিস। তুই যাদেরকে ঘুষ দিয়ে চাকরি নিয়েছিস তারা সবাই প্রচুর টাকার মালিক। তাদের কাছে টাকাই সবকিছু। টাকার উপর ঘুমায় উনারা। আর এখন যাদের টাকা ঘুষ নিচ্ছিস তারা অনেকেই মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ফ্যামিলির লোক।

~কি যে বলিস। এখন এইসব চিন্তা করলে হয় না।সবাই এভাবেই চলছে।যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে।
–সবাই এইভাবে চলছে মানে।এই আমাকে দেখ।ইউনিভার্সিটি পাশ করে একটা সরকারি চাকুরীতে এপ্লাই করেছিলাম। লিখিত পরীক্ষায় সিলেক্টেড হয়েছিলাম, কিন্তু ভাইভাতে ২০ লক্ষ টাকা চেয়েছিলো উর্ধতন কর্মকর্তা।কিন্তু আমার ঘুষ দিয়ে চাকরি নেয়ার কোনো ইচ্ছেই ছিলো না আর ঘুষ খাওয়ার ইচ্ছেও নেই।তারপর একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে এসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে জয়েন করি।এখন আলহামদুলিল্লাহ ৮০ হাজার টাকার মতো পাই।আর এই টাকা দিয়ে ফ্যামিলি নিয়ে খুব ভালোভাবে চলে আমার।

~বাদ দে বন্ধু। তারপর বল ছেলে কিসে পড়ে প্লে তে নাকি নার্সারি?
–নাহ বন্ধু। আমার ছেলে আহনাফ মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে।তর ছেলে কিসে পড়ে?
~এইতো প্লে তে।তা তর ছেলেকে মাদ্রাসায় পড়াচ্ছিস কেনো?মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে তো আজকাল জঙ্গী হয়।

আর মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে তো হুজুররা ঠিকমতো ভাত খেতে পায় না।আর তুই একজন ইঞ্জিনিয়ার। ছেলেকেও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানোর চিন্তা ভাবনা রাখ।আমি আমার ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াবো।

–বন্ধু মাদ্রাসায় পড়াশোনা করলে যে জঙ্গী হয় এটা তর সম্পুর্ন ভুল ধারণা। মাদ্রাসায় পড়ুয়া ছাত্ররা ইসলামের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দেয় সর্বত্র।আর এটা ঠিক বলেছিস হুজুররা ঠিকমতো ভাত খেতে পায় না।পাবে কি করে উনারা তো সবসময় পোলাও, মাংস খায়। তাছাড়া আমার ছেলেকেও আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াবো। কিন্তু দুই বছর মাদ্রাসায় পড়াবো। যেনো ইসলামী শিক্ষাটা পায়।

~যাইহোক বন্ধু আজকে উঠি।ভালো থাকিস।
–তুই ও ভালো থাকিস।

বহুদিন পর আজ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে আছি আমার ছেলে আহনাফের জন্য।পিএইচডি কমপ্লিট করে আজকে দেশে ফিরছে। এইতো আহনাফ আসছে।এসেই জড়িয়ে ধরে কান্না করতে লাগলো। আমি বললাম গাড়িতে এসো বাবা।বাসায় চলো।তুমি খুব ক্লান্ত।

~না বাবা আমি আগে একটা জায়গায় যেতে চাই।তুমি নিয়ে যাবে?
–কোথায়?
~ বৃদ্ধাশ্রমে।

আমি দেখেছি বাবা।আমি উপভোগ করেছি। বাবা মা ছাড়া কতটা খারাপ লাগে।প্রতিদিন তোমাদের সাথে ভিডিও কল করে কথা বলেছি।তবুও মনের মাঝে একটা শূন্যতা অনুভব করেছি।আমি আমেরিকায় অনেক মোটা অংকের স্যালারির অফার পেয়েছিলাম। যেটা এই দেশে ২০ জন বুয়েট ইঞ্জিনিয়ার এর সমমান। কিন্তু তোমাদের ছাড়া আমি কি করে থাকবো বলো।আর মানুষ কি করে বাবা, মা কে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে।তাই ভেবেছি দেশের মাটিতে পা রেখে আগে সেই অভাগা বাবা,মায়ের কাছে যাবো।

–খুব ভালো চিন্তা ভাবনা। আমার ছেলে বলে কথা।চলো তাহলে।দেড়ি কেনো….

–বৃদ্ধাশ্রমে যাই।চোখ পড়লো আমারি মতো বয়সী একটা লোকের দিকে।ঠিক আমার বন্ধু নিলয় এর মতো দেখতে। শুধু দাড়ি আর চুলগুলো অল্প অল্প পেকে গিয়েছে। কৌতুহল নিয়ে এগিয়ে গেলাম। আমাকে চেনেও না চেনার ভান ধরেছে।আমি ঠিক চিনেছি। এটাই নিলয়।বললাম কিরে বন্ধু তর এই অবস্থা কেনো? আর তুই এখানে কেনো? আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে লাগলো। আমি বললাম খুলে বল বন্ধু কি হয়েছে?

~বন্ধু হিমু।জীবনে টাকা পয়সা কম ইনকাম করি নি।ঘুষ খাই বলে তর ভাবী আমাকে ডিবোর্স দেয়।তারপর কিছুদিন পর আমার একটা কিডনি ড্যামেজ হয়ে যায়।টাকা পয়সা যা ছিলো প্রায় সব শেষ হয়ে যায় চিকিৎসা করানোর জন্য।
তারপর বাকি যে ছয়তলা বাসাটা ছিলো সেটা আমার ছেলে রিফাত বিক্রি করে আমেরিকা চলে যায়।সেখানে যেয়ে ওই দেশের একটা মেয়েকে বিয়ে করে ফেলে।তারপর আর দেশে আসে নি।আর আমি এখন বৃদ্ধাশ্রমে।

–আমি শুনছিলাম আর চোখ দিয়ে পানি আসছিলো।
~বন্ধু ও কে?
–আমার ছেলে আহনাফ। আজকেই দেশে ফিরছে। বুয়েট থেকে পড়াশোনা করে আমেরিকা থেকে পিএইচডি করেছে।

~তুই ঠিক বলেছিলে বন্ধু।শুরুতেই যদি ইসলামী শিক্ষাটা দিতাম আমার ছেলেকে, তাহলে হয়তো রিফাত ও তর ছেলের মতো হতে পারতো। আর আমার এই অবস্থা হতো না। আর এই অবস্থার জন্য আমিই দায়ী।

–যা হবার হয়েছে। নামাজ পাড়বি পাঁচ ওয়াক্ত। আর আল্লাহর কাছে মাফ চাইবি। আল্লাহ নিশ্চয়ই ক্ষমাশীল। আজ নিজেকে একজন গর্বিত বাবা বলতে পারছি। ছেলেটা আলহামদুলিল্লাহ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। দেশের নামকরা বড় বড় ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্যে একজন । আলহামদুলিল্লাহ

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত