মোহমুক্তি

মোহমুক্তি

দুইমাস পূর্বে গভীর রাতে ঘুমের ভিতর বিছানায় হাত দিয়ে অনুভব করলাম পাশের জায়গাটা খালি,চমকে জেগে উঠে দেখি রতন এখনো ঘুমাতে আসেনি! এখনও নিশ্চয়ই ল্যাপটপে মুখ গুঁজে আছে।আস্তে করে বিছানা থেকে নেমে পাশের ঘরে উঁকি দিলাম যা ভেবেছি, গভীর মনোযোগ দিয়ে ল্যাপটপের ভিতর ডুবে আছে, এয়ার ফোন দিয়ে কার সাথে যেন কথা বলছে, হাসছে।

ভিষণ কৌতুহল হলো, কি করে প্রতিরাত জেগে ল্যাপটপে? একটু কি দেখবো? যে গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছে পেছন থেকে চুপিচুপি দেখলে নিশ্চয়ই টের পাবে না।আস্তে করে পা টিপে টিপে পেছনে যেয়ে ল্যাপটপের পর্দায় চোখ পড়তে থমকে গেলাম।স্বল্প বসনা সুন্দরী নারী, তার সাথে ভিডিও কলে কথা বলছে।

মাথা ঘুরে উঠলো। নিজেকে সামলাতে পারলাম না, চিৎকার করে উঠলাম ছি ছি প্রতি রাত জেগে এসব করো তুমি? তোমার রুচি এত জঘন্য। ঘরে তোমার বউ বাচ্চা আছে আর তুমি রাত জেগে সুন্দরী মেয়েদের সাথে ভিডিও কল করো দ্রুত ল্যাপটপ বন্ধ করে রতন রাগে দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিসে গলায় বললো, আমার যা খুশি আমি তাই করবো।তোমাকে কি কোন কিছু থেকে বঞ্চিত করেছি? ঠিক মতো খাওয়া পরা দিচ্ছি। মাসিক হাত খরচ দিচ্ছি সব রকম চাহিদা মেটাচ্ছি আর কি চাও তুমি? আমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবে না সোমা, তাহলে ফল ভাল হবে না , যাও শুয়ে পড়ো।বেয়াদব মেয়েছেলে আমার উপর গোয়েন্দাগীরি করে। কতো বড়ো সাহস, দেখতে এসেছে আমি কি করি!

লজ্জায় দুঃখে ঘর ছেড়ে চলে আসলাম।মনে হচ্ছে এক্ষণি আত্নহত্যা করি কিন্তু ছোট ছোট দুইটা ছেলে মেয়ে ওদের কি হবে? আমি ছাড়া ওদের আগলে রাখবে কে? বাড়ি থেকে চলে যাবো? কিন্তু কোথায় যাবো? বাপের বাড়ির অবস্থা ভাল না। বাবা নেই ভাই এর সংসারে দুই বাচ্চা নিয়ে বোঝা হওয়া যাবে না। নিজের লেখাপড়া তেমন হয়নি এই যোগ্যতা নিয়ে ঢাকা শহরে একদিন ও টিকতে পারবো না। চোখ মুখ বুজে আমাকে এখানেই পড়ে থাকতে হবে,শুধুমাত্র সন্তানদের ভবিষ্যত চিন্তা করে।

পরেরদিন রতন গোসল করছে,হঠাৎ ওর মোবাইল টা বেজে উঠলো।ধরবো কি? ধরি না হয়, এখনও তো বাথরুমে। ফোন টা রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপর প্রান্ত থেকে ভেসে এলো মেয়েলি কন্ঠ হ্যালো রতন কাল তোমার সাথে হোটেলে খুবই সুন্দর মূহুর্ত কাটালাম আবার কবে আমরা দেখা করবো? আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। ফোন কেটে দিয়ে ধপ করে বিছানায় বসে পড়লাম।কি নোংরা মানসিকতার মানুষ, এর সাথে চিৎকার চেচাঁমেচি করলে সন্তান কেড়ে নিয়ে আমাকে হয়তো বাড়ি থেকে বের করে দেবে না হয় আরেকটা বিয়ে করবে সেই ঘরে বাচ্চা হবে আমার বাচ্চাদের ভবিষ্যত একদম শেষ হয়ে যাবে। বাচ্চাদের ভবিষ্যত রক্ষা করতে হলে আমাকে ধৈর্য্য ধরতেই হবে।

রতন বাথরুম থেকে বেরোনোর সাথে সাথে বাচ্চা দুটো কে ডাক দিলাম।মাহিন মিলা এদিকে এসো তো।রতনের হাত টেনে নিয়ে বাচ্চাদের মাথায় রেখে বললাম, তুমি যদি বাচ্চাদের এতটুকু ভালবাসো তাহলে ওদের মাথায় হাত রেখে বলো, তুমি কোনদিনও দ্বিতীয় বিয়ে করবে না।আমার সংসারে কাউকে প্রবেশ করাবে না। একটু ভেবে রতন বললো, বেশ আমি কথা দিলাম আমি কোনদিনও দ্বিতীয় বিয়ে করবো না,এই সংসারে নতুন কাউকে ঢোকাবো না কিন্তু তোমাকেও কথা দিতে হবে তুমিও আমার ব্যাপারে নাক গলাবে না।

বেশ কথা দিলাম।শুধুমাত্র সন্তানদের কথা ভেবে রতনের অন্যায় মেনে নিলাম। এইভাবে রতনের সাথে ভয়াবহ কষ্টে আমার দিন কাটে।গভীর রাতে রতন যখন আমার শরীরে হাত রাখে মনে হয় হজারটা শুয়োপোকা আমার শরীরে কিলবিল করে বেড়াচ্ছে। নারীত্বের এতো অপমান সহ্য করে বেঁচে থাকা অসম্ভব কষ্টের। রতন ঘুমিয়ে যায় আমি সাররাত একফোঁটা ঘুমাতে পারি না। অসহ্য ঘৃণায় ছটফট করি চোখের পানিতে বালিশ ভিজে যাই। শুধুমাত্র বাচ্চাদের কথা চিন্তা করে এই নরকে পড়ে আছি। এর কিছুদিন পর রতন ব্যবসার কাজে ঢাকার বাইরে গেছে।দুপুরে ভাত খাওয়ার পর একটু তন্দ্রার মতো এসেছে হঠাৎ মোবাইলের শব্দে তন্দ্রা ছুটে গেল।অপর প্রান্ত থেকে পুরষ কন্ঠ বলে উঠলো হ্যালো আমি কি রতন সাহেবের স্ত্রীর সাথে কথা বলছি?

জি আমি উনার স্ত্রী। বলুন কি বলবেন। ম্যাডাম রতন সাহেব একসিডেন্ট করেছে, আমাদের হসপিটালে আছে। খবরটা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম, শয়তান হোক চরিত্রহীন হোক তবুও তো আমার স্বামী, আমার বাচ্চাদের বাবা।তাড়াতাড়ি হসপিটালের নাম ঠিকানা নিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।সারা রাস্তা ফুঁফাতে ফুৃৃঁফাতে কেঁদে দোয়া করলাম আমার সন্তানরা যেন এতিম না হয়। হসপিটালে পৌঁছে ডাক্তারের সাথে কথা বললাম, জানে বেঁচে গেলেও মাজার থেকে নিচের অংশ প্যারালাইসিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

পনেরো দিন রতন কে নিয়ে আমি হসপিটালে ছিলাম। ওর নিচের অংশ পুরোপুরি অবশ হুইল চেয়ার একমাত্র ভরসা।এর মধ্যে ওর কয়েকজন বন্ধু ছাড়া কোন বান্ধবী দেখা করতে আসিনি। রতন নিজের প্রফাইল থেকে বারবার তার একসিডেন্টের খবর জানিয়ে স্টাটাস দিচ্ছে কিন্তু কোন বান্ধবীর খোঁজ নেই। রতন অস্থির হয়ে বান্ধবীদের কাছে ফোন দিচ্ছে কিন্তু কোন বান্ধবীর কাছে ফোন যাচ্ছে না। রাগ করে মোবাইল ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলল,বদমাইশ মেয়েছেলের দল যখন সুস্থ ছিলাম তখন দিনের ভিতর সাত আটবার ফোন দিয়েছে আর এখন অসুস্থ জেনে দেখতে আসা তো দূরে থাক ফোনটাও রিসিভ করছে না।

হাসপাতাল থেকে রতনকে নিয়ে বাড়ি ফিরেছি। দিনে দিনে রতন ভেঙে পড়ছে, ওর মুখের দিকে তাকালে আমারই খারাপ লাগছে। আজ দুপুরে খাবার খাওয়ানোর জন্য যেমন মুখের কাছে হাত নিয়েছি হঠাৎ রতন আমার দু’হাত চেপে ধরে কান্নাভেজা কন্ঠে বললো সোমা আমাকে ক্ষমা করে দেও।আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আমি হিরে ফেলে মিথ্যে কাচেঁর পিছনে ছুটে বেড়িয়েছি।তোমার এখন অনেক পরিশ্রম হবে। সংসার চালাতে হবে পঙ্গু স্বামীকে সেবা করতে হবে, আমার ব্যাবসা তোমাকেই দেখতে হবে। এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যু আমার জন্য ভাল ছিল।

আমি হাত দিয়ে রতনের ঠোঁট আলতো করে চেপে ধরে আদ্র কন্ঠে বললাম, এই ভাবে বোলো না। আমি সবসময় চেয়েছি মোহমুক্ত হয়ে তুমি আমার কাছে ফিরে আসো,যে ভাবেই হোক তুমি ফিরে এসেছো এতেই আমি খুশি। আমার কোন কষ্ট হবে না আমি সবকিছু হাসি মুখে করবো।তোমাকে নিয়ে অনেক সুখে শান্তিতে থাকবো। মনে মনে বললাম, কত রাত আমি ঘুমাতে পারিনি, আজ তোমার পাশে পরম শান্তিতে নিশ্চিন্তে ঘুমাবো।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত