উত্তর মেলে না

উত্তর মেলে না

-এটা কি সোহমের অভিভাবকের নাম্বার ?
-হ্যা আমি সোহমের মা বলছি, কে আপনি ?
-আমি সোহমের ক্লাস টিচার কথা বলছি।
-হ্যাঁ ম্যাম, বলুন।
-আপনি যদি সোহমের ছুটির সময় একবার স্কুলে আসেন তাহলে খুব ভালো হয়।
– কি হয়েছে ম্যাম, সোহম ঠিক আছে তো?
– ডোন্ট ওয়ারি ম্যাম, ও একদম ঠিক আছে। প্রিন্সিপাল ম্যাম আপনার সাথে একটু কথা বলতে চান।
– কিন্তু সোহম তো বাসে ফেরে।
-আমি বাস ড্রাইভারকে বলে রাখছি, ও আজ বাসে ফিরবে না, আপনার সাথেই ফিরবে।
-ওকে, থ্যাংক ইউ ম্যাম।

ফোনটা রেখে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলো অদিতি। মাথার মধ্যে অনেকগুলো চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। ম্যাডাম বললেন পিকু সুস্থ আছে। তাহলে কি পড়াশুনা সংক্রান্ত কিছু? কিন্তু গত সপ্তাহেই তো পিটিএম হয়ে গেল। আর নতুন সেশনও সবেই শুরু হয়েছে। ক্লাসে যা কিছু নতুন হয় সবই প্রায় ডায়েরিতে লেখা থাকে। সর্বোপরি পিকুর পড়া নিয়ে কোনোদিনই শমীক আর অদিতিকে তেমন ভাবনা চিন্তা করতে হয়নি। নার্সারি থেকে ক্লাস সেভেন প্রতিবছরই প্রথম তিনের মধ্যে পিকুর নাম থেকেছে। শমীক তো রীতিমতো প্রাউড ফাদার। তাহলে কি মারামারি করলো? শমীককে ব্যাপারটা জানানো উচিৎ কিনা বুঝতে পারছিল না অদিতি। কিন্তু জানাবেটা কি? ব্যাপারটা যে কি সেটা তো সে নিজেই জানে না। অন্যমনস্কভাবেই অদিতি মোবাইলটা তুলে শমীককে কল করে ফেললো।

– হ্যাঁ বলো তাড়াতাড়ি। টিম মিটিং আছে।

যথারীতি ব্যস্ত গলা শমীকের। সকালে বলেছিল বটে এই মিটিং টার কথা। অদিতির একদম মনে ছিল না। পিকুর ম্যামের ফোনটা আসার পর থেকে মাথা কাজ করছে না অদিতির।

– কি হলো বলো, কেন ফোন করেছ? শমীকের গলায় বিরক্তি স্পষ্ট।
– কিছু না। পরে ফোন করবো।

অদিতি ডিসকানেক্ট করে দিলো কলটা। ছুটির সময় স্কুলে ঢুকতে গিয়ে কেমন যেন দিশেহারা লাগছিল অদিতির। পিকু বাসে যাতায়াত করায় এই সময়টা কোনোদিনই অদিতির স্কুলে আসা হয়নি। আজ দেখলো মায়েদের সাথে অনেকের দাদু, ঠাকুমাও বাচ্চাদের নিতে আসে।

এই সময় স্কুলের বড়ো গেটটা বন্ধ থাকে। ছোট গেটটা দিয়ে আই কার্ড দেখিয়ে পেরেন্টরা একে একে ছেলে মেয়েদের নিয়ে বেরিয়ে আসছেন। হৈচৈ করে সব কচি-কাঁচারা বেরোচ্ছে। ধাক্কা লাগছিল অদিতির। গেটের এক পাশে সরে গিয়ে ওদের জন্য জায়গা করে দিলো। নাম লিখিয়ে রিসেপশনে বসে আছে। একটু টেনশনই হচ্ছে অদিতির। প্রায় মিনিট কুড়ি বসার পর ডাক এসেছে প্রিন্সিপাল ম্যামের ঘর থেকে। ঘরে প্রিন্সিপাল ম্যাম, সোহমের ক্লাস টিচার মল্লিকা ম্যাম এবং আরও একজন সিনিয়ার টিচার বসা। অদিতি ঘামছিলো অল্প অল্প। গলা শুকিয়ে আসছে। ইশ্, শমীক যদি আসতে পারতো !

-বসুন মিসেস ঘোষ।
– থ্যাংক ইউ ম্যাম। অদিতি চেয়ার টেনে বসেছে। প্রিন্সিপাল ম্যাম এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছেন অদিতির দিকে।
-আপনাকে কেন হঠাৎ এভাবে ডাকা হলো, আপনি হয়তো আন্দাজ করতে পারছেন না।
– না ম্যাম। আমি সত্যিই প্রিন্সিপাল ম্যাম হাত তুলে থামালেন অদিতিকে।
– আপনার আন্দাজ করতে পারার কথাও নয়। এটা দেখুন তো। এটা সোহমেরই হ্যান্ডরাইটিং তো? একটা নোটবুক এগিয়ে দিলেন ম্যাম।
-হ্যাঁ, এটা তো ওরই…
– এই দুটোই পর্নোগ্রাফি সাইট।

অদিতির সামনে আকাশ ভেঙে পড়লেও হয়তো সে এত অবাক হতো না। কি দেখছে সে! পিকুরই ইংলিশ নোটবুকের পিছনের পাতায় গোটা গোটা অক্ষরে দুটো পর্ন সাইটের নাম লেখা। পিকু পর্ন সাইটের নাম জানে!! হাতের লেখাটা যে পিকুর তা অদিতির থেকে ভালো আর কে জানবে।

-লেখাটা যে সোহমেরই সেটা যদিও সোহম নিজেই স্বীকার করেছে। তবু আপনাকে দিয়ে কনফার্ম করালাম।
-আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। ও কোথা থেকে এসব জানলো?
-হ্যাঁ সেটাই আশ্চর্যের। ইনফ্যাক্ট আমরাও সবাই খুবই অবাক হয়েছি। সোহম এত ভালো ছেলে হয়েও….
-আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না ম্যাম। কাঁদো কাঁদো গলায় বলে ওঠে অদিতি।

– প্লিজ আপনি শান্ত হোন। দেখুন সোহম এই লেখাটা ক্লাসেরই আরেকটি ছেলেকে দেখিয়ে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছিল। ব্যাপারটা দেখে মল্লিকা ম্যামের সন্দেহ হওয়ায় ওদের দুজনকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেন। সোহম এটা তো মেনে নেয় যে লেখাটা ওরই। কিন্তু কোথা থেকে পেয়েছে এই নামগুলো, তা কিছুতেই বলানো যায়নি। মাথা নিচু করে বসে আছে অদিতি। কপালের পাশের শিরাগুলো দপদপ করছে। কোনোরকমে বলতে পারলো

-ম্যাম এবারের মতো যদি ওকে ক্ষমা করে দেন।
– এভাবে বলবেন না মিসেস ঘোষ । স্টুডেন্টরা আমাদের সন্তানের মত। আর সোহম তো খুবই ভালো ছেলে। আমরা সবাই ওকে নিয়ে প্রাউড ফিল করি। কিন্তু সেই ছেলে যদি এত অল্প বয়েসে, এভাবে নষ্ট হয়ে যায়… আমার মনে হয় আপনারা একটু খেয়াল রাখুন ও কাদের সাথে মেলামেশা করছে। অ্যাডোলোসেন্স পিরিয়ডটা বোঝেনই তো। একবার হাতের বাইরে চলে গেলে….

-আমি খেয়াল রাখবো ম্যাম। অস্ফুটে বলে অদিতি।
– আমার আর একটা রিকোয়েস্ট আছে মিসেস ঘোষ। ওকে খুব দরকার ছাড়া মোবাইল বা ল্যাপটপ ব্যবহার করতে দেবেন না। আর ওকে যতটা পারেন সময় দিন। কোয়ালিটি টাইম।

বাড়ি ফিরে অদিতি শুয়েছিল। পিকু খাওয়া দাওয়া সেরে তার পাশেই শুয়ে কমিকস পড়ছে। স্কুল থেকে ফেরার পর থেকেই কিরকম গুম হয়ে রয়েছে। অদিতির একবার মনে হচ্ছিলো ছেলেকে ধরে আচ্ছা করে মার লাগায়। কাদের সাথে মিশছে আজকাল! কি রুচি তৈরি হচ্ছে দিনদিন। আর বলছে নাই বা কেন কোত্থেকে পেয়েছে সাইটগুলো? পিকুর সাথে এ নিয়ে কথা বলতে অস্বস্তি হচ্ছিলো অদিতির। শমীক ফিরলেই নাহয় কথা বলা যাবে। মাথাটা যন্ত্রনায় ছিঁড়ে যাচ্ছে।

এক কাপ চা করে নিয়ে এসে বসেছে ব্যালকনিতে। পিকুকে নিয়ে চিন্তাগুলো যেন হাতুড়ি মারছে মাথায়। যে ছেলেকে নিয়ে গর্বে বুক ফুলে থাকতো শমীক অদিতির, আজ সে ই তাদের মান-সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। চোরের মতো করে পিকুকে নিয়ে স্কুল থেকে বেরোচ্ছিলো অদিতি। টিচারদের জোড়া জোড়া চোখ যেন অদিতিকে ঝলসে দিচ্ছিলো। পিকুর জন্য এমন দিনও তাকে দেখতে হলো! কান্না পাচ্ছিল অদিতির। নাহ্, আজ শমীক এলে পিকুকে নিয়ে বসতেই হবে। তবে শমীকের যা উগ্র মেজাজ। হয়তো না বুঝেই মারধোর শুরু করবে। তাতে আরোই হিতে বিপরীত হবে। ছেলেকে শমীক ভালোবাসে ঠিকই কিন্তু তার মন বোঝে কি? পনেরো বছরের বিবাহিত জীবনে অদিতিকেই বা কতটুকু বুঝেছে শমীক।

©শাশ্বতী রায়

– কই, আমার চ্যাম্প কই? শমীক বাড়ি ফিরেই হাঁকডাক শুরু করে দিয়েছে। অন্যদিন বাবা ফিরলেই পিকু পড়ার ঘর থেকে এসে একবার উঁকি দিয়ে যায়। আজ বাবার ডাক শুনে এলো বটে। তবে দূরে দাঁড়িয়ে আছে।
-কি হলো, দ্যাখ কি এনেছি। গরমা গরম ফিশ চপ। মা কে বল তাড়াতাড়ি প্লেটে করে দিতে। ঠাণ্ডা হয়ে গেলে আর ভালো লাগবে না।

– তুই পড়তে যা। আমি ঘরে দিয়ে আসছি। অদিতির চোখমুখ দেখে পিকু কি আন্দাজ করলো কে জানে। অপ্রস্তুত মুখে পড়ার ঘরে চলে গেল। পিকু চলে যেতে বেডরুমে এসেছে শমীক। ঘেমো জামাকাপড় ছেড়ে অ্যাটাচড বাথরুমে ঢুকে গেছে। ফ্রেশ হয়ে বেরোতে না বেরোতেই অদিতি হাজির চা জলখাবার নিয়ে।

-কি হয়েছে তোমার? ছেলেটার ওপর ওরকম খেঁকিয়ে উঠলে?
-তুমি খেয়ে নাও আগে। তারপর বলছি সব।
-জো হুকুম মেমসাব। মোবাইলে চোখ রেখে খাওয়া শেষ করে গুছিয়ে বসেছে শমীক। চোখ গোল গোল করে শুনছে স্কুল বৃত্তান্ত।

-কি বলছো তুমি? ও এসব জানবে কোত্থেকে?
– আমি কি করে জানব?
– সারাদিন করো টা কি বাড়িতে বসে? একটা মাত্র ছেলে, তার দিকেও নজর রাখতে পারো না?
– বাজে কথা বলবে না। একা আমারই দায়িত্ব না? মাসে কটা পয়সা ছুঁড়ে দেওয়া ছাড়া, বাবা হওয়ার আর কোন দায়িত্বটা করো তুমি?

– সেটা তুমি বুঝবে কি করে ? বাইরে বেরিয়ে পাঁচ পয়সা রোজগার করেছো কোনোদিন? এসি ঘরে শুয়ে বসে শুধু লম্বা লম্বা কথা।

– চাকরি করতে বেরোইনি কাদের জন্য? তোমাদের জন্যই তো। “তুমি বেরিয়ে গেলে সংসার কিভাবে চলবে, ছেলে কি ভাবে মানুষ হবে” এই কথাগুলো কে বলেছিল? সব ভুলে গেছো এখন, তাই না?

– হ্যাঁ, মানুষ হবার নমুনা তো দেখতেই পাচ্ছি। আজ ছেলে ব্লু ফিল্ম দেখছে। কাল হয়তো রেপ করবে। এই তো মানুষ করেছ। যেমন মা, তার তেমনই ছেলে হয়েছে।

– তোমরা আমাকে নিয়ে ঝগড়া করছো কেন?

শমীকের গলা সামান্য চড়ে গেছিল। পিকু যে কখন দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে কেউই খেয়াল করেনি। পিকুকে দেখেই শমীকের রাগ আরও বেড়ে গেল যেন।

– অ্যাই, তুই ওই নাম গুলো কোথা থেকে পেয়েছিস সত্যি করে বল। পিকু ঘাড় গোঁজ করে দাড়িয়ে আছে।
– চুপ করে থাকিস না পিকু। না বললে কিন্তু আজ বেধড়ক মার খাবি আমার কাছে।
– কোথায় পেয়েছিস, বলে দে না বাবা। অদিতি ছেলের পাশে এসে দাঁড়ায়।
– ও এভাবে বলবে না। দাঁড়াও শমীক বিছানা থেকে নিজের বেল্টটা তুলে নিতেই অদিতি এসে হাত চেপে ধরেছে।
– কি করছ কি তুমি। ওইটুকু ছেলেটাকে বেল্ট দিয়ে মারতে যাচ্ছো?
-ছাড়ো আমাকে। শমীক ধাক্কা দিয়ে অদিতিকে সরাতে যেতেই পিকু এসে মাঝখানে দাঁড়িয়েছে।
– মা কে একদম ছোঁবে না তুমি বাবা। তুমি জানতে চাও আমি ওগুলো কোথা থেকে পেয়েছি, তাই না?

তোমার মোবাইল থেকে। আমি ঘুমিয়ে পড়েছি ভেবে তুমি যখন ওই ভিডিওগুলো দ্যাখো, আমিও পাশ থেকে দেখি। তুমি দেখলে তোমায় তো কেউ কিছু বলে না। তাহলে আমায় কেন মারবে? রাত বাড়ছে। রাস্তায় গাড়ী চলাচলের শব্দও ক্রমে ক্রমে ক্ষীণ হয়ে আসছে। পিকু রাতের খাওয়া সেরে শুয়ে পড়েছে অনেকক্ষণ। ঝাঁ চকচকে ফ্ল্যাটে নিস্তব্ধতা এখন চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। ঘুম নেই শুধু অদিতি-শমীকের চোখে। অন্ধকারেও দু-জোড়া চোখ যেন ক্রমাগত ছেলের প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলেছে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত