নারী

নারী

– মেডাম কি একা থাকেন?
– আপনার টাকাটা
– ওইটা তো নেয়াই যাবে। তবে যাই বলেন, আপনার স্বামী খুবই অন্ধ বুঝলেন তো। নয়তো আপনার মতো বউরে এরকম একা ফেলায়ে চইলে যাইতে পারে বলেন।

– বলেন তো রাতে সঙ্গী হিসেবে আমি এসে যাই, একাকীত্ব আর থাকবে না। এবার আর নিজেকে আঁটকে রাখতে পারলো না নীলু। চেঁচিয়ে উঠে বললো,
– আপনি আপনার টাকা নিয়ে এই মূহুর্তে বেরিয়ে যাবেন, নয়তো জুতোপিটে করে বের করবো।
– বেশি তেজ কিন্তু ভালো না মেডাম।
– বের হবেন আপনি??
– মাসের শেষে কিন্তু আবার আসবো।

বলেই শরীফ বেপারি টাকাটা নিয়ে বের হয়ে গেলো। নীলু সেখানে বসেই চোখের পানি ছেড়ে দিয়েছে। কিছুই যে করার নেই তার। শুধু পানি ফেলা বাদে। যে লোকটা একটু আগে বাড়ি থেকে বের হলো সে হলো শরীফ বেপারি, ব্যবসায়ী কিন্তু উচ্চ সুদের বিনিময়ে টাকা ধার দেয় মানুষকে। তারপর টাকা ফেরত না দিলে নানা ভাবে হয়রানি করে৷ নীলুর স্বামী, রাকিব আজ তিন মাস হয়েছে নিখোঁজ। রাকিব ছোট একটা ব্যবসা করতো, কিন্তু ব্যবসায়ে লস খেয়ে দিশেহারা হয়ে গেছে। এতো ধারকর্জ করেছে যে, সবকিছু ছেড়ে পালিয়ে যাওয়াটাই সে বেটার মনে করেছে। কাপুরুষের মতো নিজে পালিয়ে, বউ, বাচ্চা আর বুড়ো বাবাকে পাওনাদারদের কাছে অপমানিত হওয়ার জন্য রেখে গিয়েছে। নীলু আর রাকিবের মেয়ে চমকের বয়স তিন বছর। ছোট্ট মেয়েটা বাবা ভক্ত, তিন মাস বাবাকে না দেখে কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে। নীলু শ্বশুর মশাই আরিফ সাহেবও বেশ অসুস্থ। ছোট মেয়ে, অসুস্থ শ্বশুর আর এই ধারদেনা পেরে উঠছে না মেয়েটা।

শিক্ষাগত যোগ্যতা ততটাও নেই, যা আছে তাতে খুব কষ্টে একটা ছোট চাকরি যোগাড় করেছে। খুব কষ্টে সংসার চলছে। আর এই সমাজ ও যেনো হায়েনার রুপ নিয়েছে। মুদির দোকানে কেনাকাটা করতে গেলেও মুদি দোকানী ছলেবলে হাত ধরার চেষ্টা করে। পাড়ার ছেলেরা তো আছেই যেন চোখ দিয়ে ধর্ষণ করছে। তাদের নোংরা দৃষ্টিকে এড়িয়ে চলাটা যে খুবই দুষ্কর। তার উপরে এই শরীফ বেপারি, মাসের শেষে চলে আছে সুদের টাকা নিতে। সম্পত্তি বলতে এই ভিটেবাড়িটাই আছে। প্রতিদিন রাত নির্ঘুম কাটছে নীলুর। কি করে মেয়েকে মানুষ করবে, পিতা সমান শ্বশুরকে চিকিৎসা করবে, প্রায় ৪০ লাখ টাকার মতো ধার, এই পনেরো হাজার টাকার চাকরিতে কিভাবে সব সামলাবে।

সেদিন বসের কাছে ফাইল দিতে যেয়ে বসের কুমতলব যেনো স্পষ্ট হয়ে গেলো নীলুর কাছে। তার যোগ্যতা এতোটা না যে সে প্রমোশন পাবে, কিন্তু বস তাকে অন্য ইঙ্গিত করছে। তাতে প্রমোশন তার নিশ্চিত। স্বামী নিখোঁজ তার উপরে এতো সুন্দরী মেয়ে, অভাবের সংসার বস ও ঝোপ বুঝে কোপ মেরেছেন। নীলু সেদিন কোনো উত্তর দেয় নি। পরদিন রিজাইন লেটার জমা দিয়ে চাকরি টা ছেড়ে দিলো। যত কষ্টেই থাকুক না কেনো, নিজের চরিত্রের উপর কোনো দাগ পরতে দিবে না নীলু। তাকে যে শক্ত হতে হবে। ঝড়ের কবলে যেমন পাহাড় অটল থাকে ঠিক তেমনি তাকেও দূর্বল হলে চলবে না। এই সমাজে তাকে যে টিকে থাকতে হবে। সে যে নারী, নারীরা যে সব পারে। অবশেষে ভেবে চিন্তে শ্বশুর মশাইকে অনেক সাহস করে নীলু বললো,

– বাবা এই বাড়িটা যদি আমরা বেচে দেই, তবে আপনার ছেলের ধারগুলো শোধ হবে হয়তো।
– মারে তুই, যা ভালো মনে করিস তাই কর। ওই কাপুরুষটার জন্য তোর জীবনটা নষ্ট হয়ে গেলো রে মা।
– আপনি কাঁদবেন না বাবা, সে যা ভালো মনে করেছে সে করেছে। এখন আমার চাকরিটাও আর নেই। এই ভিটেবাড়িটা বিক্রি করে ধার গুলো দিয়ে আমরা অন্য কোনো শহরে চলে গেলে কেমন হয় বাবা।
– আমার কোনো আপত্তি নেই রে মা, যা তুই ভালো বুঝিস।

বাড়িটা খুব ভালো জায়গায়, তাই খরিদ্দার খুঁজতে কষ্ট হলো না নীলুর৷ খুব বড় একজন ব্যবসায়ী ভালো দামেই বাড়িটা কিনে নিলো। তাতে ধারদেনা দিয়ে যা ছিলো তাই নিয়ে নীলু ঢাকা ছেড়ে খুলনা চলে আসে। শুরু হয় নীলুর জীবনের নতুন অধ্যায়। শ্বশুরের চিকিৎসার জন্য কিছু টাকা রেখে, বাকি টাকা দিয়ে একটা দর্জি দোকান খুলে। সেলাই, কাপড় কাটা বেশ ভালোই জানতো নীলু। আরো কিছু মেয়েদের নিয়ে দর্জি দোকানটা শুরু করে। ছোট বাসা ভাড়া নেয়। মাস শেষে যা টাকা হয় তাতে বাড়ি ভাড়া দিয়ে অল্প কিছু টাকা থাকে,তাতেই নীলুকে সংসার চালাতে হয়। একহাতে সংসার, মেয়ে, শ্বশুর আর দোকান চালিয়ে যাচ্ছে নীলু।

নিরলস পরিশ্রম করে দোকানটা সবার কাছে পরিচিত করে তুলেছে। এখানে সবাই জানে নীলু বিধবা, আর শ্বশুরমশাই তার বাবা। নীলুর মেয়ে চমক ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। স্কুলে ভর্তি হবে, তাই খরচাটাও বাড়বে৷ নীলু কাজ আরো বাড়িয়ে দিলো। সিজনের সময় রাত তিনটা অবধিও কাজ করতে দেখা যায় তাকে৷ সারাদিন পরিশ্রমের পর ও বাড়িতে বাবা আর মেয়ের যত্নের কোনো ত্রুটি সে রাখে নি। হাসি মুখে সব কষ্টকে বরণ করে নিয়েছে। কিন্তু কিছু কষ্ট যে মনে দাগ কেটে দিয়ে যায়। যখন চমক তার বাবার কথা জানতে চায় তখন আর নিজেকে শক্ত রাখতে পারে না নীলু। কি করে বলবে তোর বাবা একজন কাপুরুষ। ভয়ে পালিয়ে গিয়েছে। মেয়ে,বউ,বুড়ো বাপটার কথা ও একবার ভাবে নি।

সময় যে বহমান, কারোর জন্য থেমে থাকে না। সময়ের স্রোত নিজের তালেই চলতে থাকে। কেউ কেউ সময়ের স্রোতে ভেসে যায় কেউ কেউ টিকে থাকে। নীলু টিকে আছে। আজ অবধি নীলু টিকে আছে। চমক আজ ডাক্তার। বরাবর ই ভালো ছাত্রী সে। নিজে টিউশনি করিয়ে নিজের পড়াশুনোর খরচ চালিয়ে আজ মেডিকেল কলেজের ডাক্তার সে।তার মার নিরলস পরিশ্রমের মান রেখেছে। সে জানে তার বাবা মারা গেছে। নীলুর শ্বশুর মশাই মারা গেছেন। বাবা মারা যাওয়ায় নীলু খুব ভেঙ্গে পড়েছিলো।

বট বৃক্ষের মতো ছিলেন তিনি। রাকিব অবশ্য খোঁজ খবর নিয়ে এসেছিলো নীলুর কাছে। ফিরে এসেছিলো, কিন্তু নীলু বাঁধা দেয়। সে আর এই মিথ্যে সংসারের মায়ায় জড়াবে না। যখন নীলুর তাকে দরকার ছিলো তখন সে পালিয়ে বেরিয়েছে। নীলুর নির্ঘুম রাত গুলোতো আর সে চাইলেও ফিরিয়ে দিতে পারবে না। এমন ও দিন গেছে,শুধু পানি খেয়ে রাত কাটিয়েছে নীলু। আজ যখন সব কিছু আছে নীলুর আজ তার ভালোবাসা উপচে উঠছে। নীলুর চাই না এই ভালোবাসা। নীলুর দর্জি দোকানটা এখনো আছে তবে নীলু আর বসে না। বার্ধক্যের ছাপ যে পড়েছে তার চোখে মুখে। এখন আর সে তেমন খাটতে পারে না। দোকানটার থেকে যা কামাই হয় তা নীলু নিজে নেয় না। তার সাথে কর্মচারীরা সারাদিন খাটে তাদেরই দিয়ে দেয়। তার মেয়ে যে আজ ডাক্তার তার তো আর অভাব নেই।

নীলুর দোকানের কর্মচারীগুলো ও অসহায়। কারো বাড়ি মা-বাবা অসুস্থ, তো কারোর স্বামী ছেড়ে গেছে, কারোর স্বামী প্যারালাইজড তো কারোর ধারকার্যের জন্য কাজ করতে হয়। নীলু এদের জন্যই দোকানটা বন্ধ করতে পারে না। এদের যাতে আয়ের উৎস বন্ধ না হয়। তার শত শত নারীর জন্য একটা উদাহরণ হয়ে দাড়িয়েছে নীলু। নারী চাইলে কি না করতে পারে। তার কোনো পুরুষের প্রয়োজন হয় না। নীলু আজ এক জন মা হিসেবে স্বার্থক, একজন মেয়ে হিসেবে স্বার্থক, স্বার্থক একজন নারী হিসেবে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত