বড় মেয়েটাকে আজ পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে।আমার স্ত্রী যেভাবে তাড়াহুড়ো করে কাজ করছে দেখে মনে হচ্ছে আজই বিয়ে হয়ে যাবে। একবার এসে আমাকে বলল,
-শুনছ, বড় ভাই ফোন করছিল। মেয়ে পছন্দ করলে নাকি আজই আংটি পরিয়ে দিয়ে যাবে।
-বাহ! বেশ ভালো।
-তুমি একটু বাজারে যাও। দই আনা হয় নি।
– বিকালে গেলে হয় না?
-না, এখুনি যাও।
অগত্যা আমাকে উঠতে হল। যাবার সময় বড় মেয়েটার রুমে উঁকি দিলাম। প্রতিবেশী কয়েকটা মেয়ের সাথে আড্ডা মারছে।আমায় দেখে কিছুটা যেন লজ্জা পেল।মুখ নিচু করে জিজ্ঞেস করল,
-কিছু বলবে?
-না। তোর কিছু লাগবে নাকি? বাজারে যাচ্ছি।
ঘাড় নেড়ে না বলল।আমি আর কিছু বললাম না। তিন কন্যার মধ্যে বড় মেয়ে দেখতে হুবুহু আমার কার্বন কপি। ছিপছিপে লম্বা,এক মাথা কোঁকড়া চুল, লতা বরন গায়ের রঙ। ছেলে হলে হয়ত আমার মত শ্যামলা হত।মেয়ে হলে রঙ কিছুটা হালকা। অন্য দুই কন্যা মায়ের গড়ন পেয়েছে,মায়ের মত ঘিয়ে রঙা বরন। বড় মেয়ে তাই ওর প্রতি আমার মমত্ববোধ একটু যেন বেশি কাজ করে। শখ করে নাম রেখেছিলাম তিন্নি। ইচ্ছা ছিল মেয়েকে ওকালতি পড়াব। কপাল মন্দ। মেয়ের আমার মাথামোটা। টেনেটুনে এস.এস.সি পাস। ইন্টারে উঠার পর মেয়ের মা বিয়ের ঘর দেখা শুরু করল।আমার আপত্তি মেয়ের মা মাথা ঘামাল না। মেয়েকে তো আর ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বানাতে পারব না। এত পড়িয়ে কি লাভ! ছোট দুই মেয়ে আছে। শেষে ওর জন্য অন্য মেয়েদের বিয়ে আটকে থাকবে। অব্যর্থ যুক্তি।তার কাছে আমি হারতে বাধ্য হলাম। দই মিষ্টি নিয়ে বাড়ি ফিরে দেখলাম সুনসান নীরবতা। পরিবেশ কেমন থমথমে।ছোট মেয়েদুটির চোখ ফোলা ফোলা। জিজ্ঞেস করলাম,
-কি হয়েছে?
-মা মেরেছে। সবার ছোটটা উত্তর দিল।
-তোদের মা কই?
-রান্নাঘরে।
-তিন্নি?
-বড় আপু ওর ঘরে।
হাতমুখ না ধুয়ে মেয়ের ঘরে গেলাম।বালিশে মুখ চেপে ফুলে ফুলে কাঁদছে। আমি পিঠে হাত রাখতে বুকে ঝাঁপিয়ে পরল।ডুকরে ডুকরে কাঁদছে।একটু শান্ত হতে বললাম,
-কি হয়েছে, মা?
মেয়ে আমার আরো জোরে জোরো হেঁচকি টানতে লাগল। সাবধানে মাথা তুলতে মেয়ের মুখ দেখে আৎকে উঠলাম।কপালের কাছে ইঞ্চিখানেক কেটে হা হয়ে গেছে। এখন চুঁইয়ে রক্ত পরছে।
-সে কী? কপাল কাটলি কিভাবে?
– বাথরুমে পা হড়কে পরে।
-তোর মা দেখে নি? মেয়ে এবার জোরে জোরে নাক টানতে লাগল।
-মা তো দেখেই চুল ধরে মেরেছে। ওরা নাকি আমায় দেখে পছন্দ করবে না।
-চুপ করে বস এখানে। স্যাভলন আর তুলা দিয়ে কাটা জায়গাটা পরিষ্কার করতে করতে বললাম,
-মনে তো হচ্ছে সেলাই লাগবে। গভীর ক্ষত।
-হইছে। সেলাই করলে দাগ থেকে যাবে।
মেয়ের মা ধমকে উঠল। অবশেষে পাত্রপক্ষ দেখতে আসল। পাত্র আরব আমিরাতে প্রবাসী। বয়স ত্রিশের কোঠা পেরিয়ে গেছে। পাত্রের কয়েকজন মুরুব্বীর পাশাপাশি দু’জন বয়স্কা মহিলা।পাত্রের খালা, ফুপু কিছু একটা হবে। মেয়েকে অনেকক্ষন খুঁটিয়ে দেখে অপরজনকে জিজ্ঞেস করল,
-কপালের দাগটা কি যাবে মনে করেন? অপরজন পানের পিক ফেলে বলল,
-মনে হয় না।
অতএব পাত্রপক্ষ আংটি না পরিয়ে চলে গেল।তিন্নির মা প্রথমে কাঁদতে বসল। তারপর সব রাগ গিয়ে পরল মেয়ের উপর। দাঁত কিড়মিড় করে আর ঘরবাহির হয়। একটুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
– পোড়া কপাল আমার।নয়ত এমন বজ্জাত মেয়ে কেন পেটে ধরলাম।দাগওয়ালী মেয়ের কি আর বড় হবে?
আমি বাড়ি না থাকলে হয়ত মেয়ের পিঠে দু’চার ঘা পরত।আমি আমি বাড়ি আছি তাই রক্ষা। রাতে শুয়ে ছিলাম।পাশের মানুষটা ঘুমাতে পারছে না।চাপা আক্রোশে ফুসছে।আমারো ঘুম নেই।কারণটা অবশ্য ভিন্ন। একজন মেয়ে জন্মের পর যারা তাকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দেয়, মানুষ হিসেবে জন্ম নেবার পরও তার আলাদা পরিচয় সে যেন একজন মেয়ে, তারা আর কেউ নয় তার মা, বোন অথবা কাছের মহিলা আত্মীয়স্বজন।
আড়মোড়া ভেঙে তাকিয়ে দেখলাম, তিন্নির মা এখনো ঘুমিয়ে আছে। এক নজর তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। এমন ভারী দেহ নিয়ে কী করে সারাদিন এত চেঁচামেচি করে আল্লাহ মালুম। এসময়টা রোজ আমি একটু হেঁটে আসি। আজ হাঁটতে যাব চোখে পরল, শিউলি গাছের নিচে শিউলি ফুল বিছিয়ে সাদা হয়ে আছে। তিন্নি শিউলি ফুল কুড়িয়ে ওড়নায় এক কোনায় জমা করছে।আমায় দেখে মিষ্টি হেসে বলল,
-ঘুম ভাঙল বাবা?
-হ্যা। কাছে আয় তো মা, কাঁটা জায়গাটার কি অবস্থা দেখি। তিন্নি ছোট ছোট পায়ে এগিয়ে এলো। কপালের কাঁটা জায়গাটা হা হয়ে গেছে।দগদগে লালচে অংশ দেখে মনে হলো সহজে চামড়ায় টান ধরবে না। আলগোছে ছুঁয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-রাতে ব্যথা করছিল? তিন্নি আমার পিছনে কিছু একটা ছিটকে দূরে সরে গেল।মাথা নিচু করে বলল,
-ব্যথা করে নি।
পিছন ফিরে দেখলাম তিন্নির মা কড়া চোখে আমাদের দেখছে।আমার চোখে চোখ পরতে ভ্রু কুঁচকে রান্নাঘরে চলে গেল। কপালের কাঁটা জায়গাটা ধীরে ধীরে শুকিয়ে গেল কিন্তু তিন্নির কপালে একটা স্থায়ী দাগ রেখে গেল। ডান ভ্রুর কাছ থেকে কপাল পর্যন্ত ইঞ্চিখানেক দাগ আমার মেয়ের মুখে কী এমন পরিবর্তন আনল আমার জানা নেই। অথচ একটার পর একটা বিয়ের সম্বন্ধ এসে ফিরে যেতে লাগল। প্রায়ই বাড়ি ফিরে দেখি তিন্নির মা কারো না কারো সাথে ফোনে কথা বলছে,
-বুঝলেন ভাইসাব, মেয়েকে আমরা গহনায় মুড়িয়ে দিব। না…. না…ফার্নিচার তো অবশ্যই দিব। মেয়েকে কী আর খালি হাতে শ্বশুরবাড়ি পাঠানো যায়!
আমি সব শুনেও না শোনার ভান করি। এ বাড়িটা ছাড়া বাজারে আমার ছোটখাট একটা দোকান আছে। স্বাচ্ছন্দ্যে দিন চলে যায়। কিন্তু মেয়ের যৌতুক দেবার জন্য লাখ লাখ টাকা আমার সামর্থ্য নাই। তবে আমার বুদ্ধিমতি স্ত্রী কয়েকটা ইন্স্যুরেন্স করে রেখেছে।সে ভরসায় হয়ত যৌতুকের কথা বলে। ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে তিন্নি যথারীতি তিন বিষয়ে ফেইল করল। ওর মা মাথা চাপড়ে বলে, পোঁড়া কপাল আমার, ছেলে হলে ব্যবসায় ঢুকিয়ে দিতাম।ধারদেনা করে বিদেশ পাঠিয়ে দিলেও চলত। মুখপুড়ি অলক্ষী মেয়েকে নিয়ে মরণ!
ওর মায়ের বকাঝকা থেকে বাঁচার জন্য ওকে আজকাল দোকানে নিয়ে আসি। দোকানের একপাশে চুপচাপ বসে থাকে। মুখে সাড়াশব্দ নেই।কাস্টমাররা চলে গেলে হাতে হাতে কাপড় ভাজ করে তাকে তুলে রাখে। এক বৃষ্টির দিনে দোকানে কর্মচারী আসে নি সেদিন দেখলাম,মহিলা কাস্টমার আসতে নিজেই এগিয়ে গেল।হাসিমুখে কাপড় দেখাল। দরদাম করল। চলে যাবার সময় মহিলা দু’জন বলল,
-ভাই, আপনার মেয়ে বেশ লক্ষীমন্ত।
শুরুটা ছিল এইরকম।প্রতিদিন কিছু মহিলা কাস্টমার তিন্নি হ্যান্ডেল করে।যার ফলে দিন দিন মহিলা কাস্টমারের সংখ্যা বাড়তে লাগল। মফস্বলে একটা মেয়ে দোকানে বসছে এটা ছিল দূর্লভ।পাঁচজনের কুকথায় আমি কান দিলাম না।রোজ রাতে বাপ বেটি মিলে গল্প করতে করতে ঘরে ফেরি। এর মাঝে দোকানে একরাতে চুরি হলো। ঈদ উপলক্ষ্যে নতুন মাল এনেছিলাম। তার সবই হতচ্ছাড়া চোর নিয়ে গেছে। মিনমিন করে তিন্নির মাকে বললাম,
-তোমার কাছে লাখ দুয়েক টাকা হবে?মুখ ঝামটা মেরে বলল,
-আমি টাকা পাবো কই? হাত দুটি ধরে আকুল স্বরে বললাম,
-তোমার ইন্স্যুরেন্স ভাঙিয়ে দাও। নয়ত ব্যবসা তুলে দেয়া ছাড়া আমার উপায় নেই।
অগত্যা সে রাজি হলো। রাস্তার মোড়ে যে বিশাল বড় বুটিক শপ দেখছেন, এটা আমার মেয়ে তিন্নির। গজফিতা গলায় ঝুলিয়ে হাসিমুখে কাস্টমারদের সাথে কথা বলছে,পাঁচজন মহিলা কর্মচারীকে নির্দেশ দিচ্ছে, এক ফাঁকে ক্যাশিয়ারকে কী কারনে জানি ধমকে এলো। আমায় দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এলো। হাতের হটপট এগিয়ে দিয়ে বললাম,
-তোর মা পাটিসাপটা পিঠা বানিয়েছে।তোর জন্য পাঠিয়ে দিল। টুকটাক কথা বলার পর তিন্নি বলল,
-এবছর শোরুমে হাত দিব। ব্যাংক থেকে লোন নিব ভাবছি। আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম,
-লোনটোন বাদ।প্রয়োজনে দোকান থেকে আবার মাল চুরি যাবে। কী বলিস?