ক্লিপটোমেনিয়া

ক্লিপটোমেনিয়া

প্রিয়ন্তির শাশুড়ি কাল রাতে বালিশের নিচে পাঁচশো টাকা রেখেছিলেন। কিন্তু আজ সকালে সেই টাকা খুঁজে পাচ্ছেন না। টাকা তো হেঁটে হেঁটে চলে যাওয়ার মতো বস্তু না। টাকাটা কেউ সরিয়েছে এবং কে সরিয়েছে সেটা তিনি জানেন।
তিনি রান্নাঘরে গিয়ে কাজের মেয়ে সালমার চুল চেপে ধরে বললেন, “বালিশের নিচে পাঁচশো টাকা রেখেছিলাম। তুই টাকাটা চুরি করেছিস?” সালমা কাঁদতে কাঁদতে বলল, “ছিহ! আম্মা গরীব হইতে পারি কিন্তু চোর না!” প্রিয়ন্তির শাশুড়ি সালমার দুইগালে চড় দিয়ে হনহন করব নিজের ঘরে চলে গেলেন। সালমা হু হু করে কাঁদতে লাগলো।

দরজার পাশে দাঁড়িয়ে পুরো ব্যাপারটাই দেখলো প্রিয়ন্তি। তার প্রচণ্ড খারাপ লাগছে সালমার জন্য, কিন্তু শাশুড়িকে কিছু বলবে সেই সাহস তার নেই। সালমার সামনে দাঁড়াতেই সালমা বলল, “দেহেন তো ভাবী আমি তো আইজকা আম্মার ঘরেই যাই নাই। ট্যাকা চুরি করমু ক্যামনে!” প্রিয়ন্তি ভেবে দেখলো আসলেই সালমা আজ মায়ের ঘরে যায়নি৷ আসার পর থেকে তার সাথে রান্নাঘরেই কাজ করছে। তাহলে টাকাটা গেল কোথায়? এমন তো না যে তিনি টাকা অন্য কোথাও রেখে ভুলে গেছেন! ঘরে বসে ভাবতে লাগলো সে। আনমনে ড্রয়ার খুলতেই সে দেখতে পেলো পাঁচশো টাকা। তার ড্রয়ারে এতো টাকা আসলো কীভাবে! ঠিক তখনই তার মনে পড়ল সকালের কথা।

আজ সকালে শাশুড়ির বিছানা গুছাতে গিয়ে প্রিয়ন্তি দেখেছিল পাঁচশো টাকা। কি মনে করে সে পাঁচশো টাকা শাড়ির আঁচলে বেঁধে নিয়েছে। রেখে দিয়েছে নিজের ড্রয়ারে। অথচ ব্যাপারটা সে সম্পূর্ণ ভুলে গেছে। সবকিছু মনে পড়তেই ঘৃণায় মাথা নিচু হয়ে গেল প্রিয়ন্তির৷ এই কাজটা সে কেন করলো! কি কারণে করলো! এই কথা এখন মাকে বললে তিনি আর তাকে আস্ত রাখবেন না। বিকেলবেলা শাশুড়ি ঘুমিয়ে গেলে চুপিচুপি তার ড্রয়ারে টাকা রেখে এলো প্রিয়ন্তি। চিন্তা করেছে তিনি টাকা খুঁজে পেলে বলবে, তিনি ড্রয়ারে টাকা রেখে হয়তো বা ভুলে গেছেন।

প্রিয়ন্তির এই স্বভাবটা এর আগে ছিল না। প্রায় বছর হয়ে এলো প্রিয়ন্তি নিজের অজান্তেই এসব কাজ করতে শুরু করেছে। কোন জিনিস যদি তার ভালো লেগে যায় তাহলে সে সেটা গোপনে নিজের কাছে এনে লুকিয়ে রাখে। সোজা কথায় চুরি করে। যখন কাজটা করে তখন খারাপ লাগে না। কিন্তু পরে যখনই ব্যাপারটা মনে পড়ে সে অনুতাপে জর্জরিত হয়ে যায়। তখন করার কিছুই থাকে না। প্রথম ব্যাপারটা ঘটেছিল একটা বিয়ের দাওয়াতে। তার আপন মামাতো বোনের বিয়ে।

কনের জন্য বাছকন্যার শাড়ি এসেছিল। বেগুণী রঙের একটা শাড়ি প্রিয়ন্তির খুবই পছন্দ হয়েছিল। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রিয়ন্তি সেই শাড়িটা নিয়ে নিজের লাগেজে রেখে দিয়েছিল। পরে তার খুবই লজ্জা লেগেছে। এই কাজটা সে কেন করলো! শাড়িটা চাইলে নিশ্চয়ই তার বোন অমত করতো না! তারপরও সে এমন লজ্জাজনক একটা কাজ কেন করলো। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে একবার সে তাদের বাসার কাজের মেয়ে সালমার ব্যাগ থেকে একটা অচল কয়েনও চুরি করেছিল। এতো সামান্য একটা জিনিষ কি চুরি করার মতো হলো! পাঁচ আনার বাতিল একটা কয়েন! এটা চুরি করার কোন মানে হয়! প্রিয়ন্তি নিজেকে প্রশ্ন করে কিন্তু উত্তর ভেবে পায় না। রাতের বেলা প্রিয়ন্তির স্বামী পবন আসে অফিস থেকে। শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বলে, “একটা সুসংবাদ আছে।” প্রিয়ন্তি আনন্দিত গলাতে বলল, “কি হয়েছে? তাড়াতাড়ি বলো।”

– আজ অফিসের বেতন প্লাস ওভারটাইমের বোনাস পেয়েছি। তুমি না স্বর্ণের কানের দুল বানাতে চেয়েছিলে? কাল কিনলে কেমন হয়?
– সত্যিই? আমার তো তর সইছে না। আচ্ছা চলো, কাল বিকেলেই আমরা যাবো স্বর্ণালংকারের দোকানে।

পরদিন বিকেলে পবন আর প্রিয়ন্তি স্বর্ণালংকারের দোকানে গেল। দোকানি ওদের সামনে হরেক রকম স্বর্ণের কানের দুল বের করে দেখাতে লাগলো। প্রতিটাই প্রিয়ন্তির ভীষণ পছন্দ হচ্ছে। অবশেষে খুব সুন্দর নকশার একটা স্বর্ণের কানের দুল কিনে নিয়ে বেরিয়ে এলো ওরা।

বাসায় এসে ব্যাগ খুলতেই চমকে যায় প্রিয়ন্তি। ব্যাগে একজোড়া না, দুইজোড়া কানের দুল! একজোড়া তো ওরা কিনেছে আরেকজোড়া আসলো কীভাবে! তখন প্রিয়ন্তির মনে পড়লো, দোকানি যখন কানের দুল দেখাচ্ছিল তখন সে লুকিয়ে একটা স্বর্ণের কানের দুল নিজের ব্যাগে ভরে নিয়েছিল। এমনটা যদি হয়ে থাকে তবে সে সত্যিই অনেক বড় অন্যায় করেছে। কী করবে ও? পবনকে বলবে? প্রিয়ন্তি পবনকে ডেকে কানের দুলজোড়া দেখালো। পবনের চোখ কপালে উঠার জোগাড়! অবাক কণ্ঠে বলল, “প্রিয়ন্তি! এই কানের দুল তোমার কাছে আসলো কীভাবে! তুমি কি এটা?” প্রিয়ন্তি অপরাধীর ভঙ্গিতে বলল, “না না, তুমি যা ভাবছো, তা না! আমি এটা চুরি করিনি। আসলে আমার এটা খুবই পছন্দ হয়েছিল। এতোই ভালো লেগেছিল যে সাতপাঁচ না ভেবে ব্যাগে করে নিয়ে এসেছি।”

-তাই বলে তুমি চুরি করবে?

প্রিয়ন্তি কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে এই পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সব ঘটনা গড়গড় করে বলে ফেলল। কিছুদিন আগে শাশুড়ির বালিশের নিচে রাখা পাঁচশো টাকা সে চুরি করেছিল পরে আবার ফেরত দিয়েছে এসব কথাও বাদ দিল না। পবন সবকিছু শুনে যেন আকাশ থেকে পড়ল। বলল, “তাহলে অবস্থা খুবই গুরুতর প্রিয়ন্তি। এই গহনা আমরা কী করবো? যদি দোকানের সি.সি. ক্যামেরায় ধরা পড়ে যে তুমি সবার অলক্ষ্যে এই দুলজোড়া ব্যাগে ঢুকিয়েছ তাহলে তো তোমাকে সবাই চোর বলে জানবে। এই কারণে তোমার নামে মামলা হতে পারে, অনেক জরিমানাও দেওয়া লাগতে পারে। এখন কী করবো বলো?”

-দোকানে গিয়ে দুলজোড়া ফেরত দিলে কেমন হয়?
-দুল দিতে গিয়ে যদি আরও বিপদে পড়ি?
-সেটাও চিন্তার বিষয়। কী করি বলো তো?
-থাক, তোমার চিন্তা করা লাগবে না। এখনই দুলজোড়া দাও আমি দোকানে ফেরত দিয়ে আসি।

পবন দুলজোড়া নিয়ে গেল স্বর্ণালংকারের দোকানে। সবকিছু গুছিয়ে বলল, তার স্ত্রী ভুল করে এক গহনা নিতে গিয়ে অন্য গহনা নিয়েছে। দোকানি তার কথা বিশ্বাস করতে চাইলো না। কষ্টিপাথর দিয়ে ঘষে ভালো করে পরখ করে দেখলো এটা আসলেই খাঁটি স্বর্ণের গহনা কি না! স্বর্ণের দুল নিশ্চিত হতেই সে আর কথা না বাড়িয়ে গহনা নিয়ে নিল। পবনের পরিচিত এক বোন অর্পনা একজন মানসিক রোগের বিশেষজ্ঞ। প্রিয়ন্তিকে নিয়ে পবন ডা. অর্পনার চেম্বারে গেলেন। প্রিয়ন্তি তার সমস্যা খুলে বলল। সব শুনে ডা. অর্পনা নিশ্বাস ছেড়ে বললেন, “তোমরা আমার কাছে এসে খুবই ভালো কাজ করেছো। প্রিয়ন্তি যেগুলো করছে সেগুলো নিজের ইচ্ছায় নয়, একটি মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে করছে। এই রোগটির নাম ক্লিপটোমেনিয়া। এধরনের রোগীরা সাধারণত যে জিনিস প্রবলভাবে পছন্দ করে তা নিজের কাছে সংগ্রহ করার জন্য চুরি পর্যন্ত করতে পারে। পরে তাদের অনুতুপ্তবোধ হয়৷ কেউ বা আবার এটাকে স্বাভাবিক বলে মনে নেয়।”

-এ রোগের কি কোন ওষুধ নেই?
-এ রোগের নির্দিষ্ট কোন ওষুধ নেই।

তবে কিছু মেডিটেশন, ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ করতে পারো। চিন্তামুক্ত থাকার চেষ্টা করবে। সবচেয়ে ভালো হয় যদি তোমরা দুজন একসাথে কোন দূরের জায়গা থেকে বেরিয়ে এসো। এতে তোমাদের ভালো লাগবে। প্রিয়ন্তি নিজেকে চাপ দেওয়া থেকে দূরে রাখো। প্রিয়ন্তি আর পবন একে অপরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। সত্যিই তো! সমস্ত চাপ সরিয়ে এবার তাদের উচিৎ কিছুদিনের জন্য দুজন মিলে দূরে কোথাও ঘুরতে যাওয়া। যেখানে থাকবে না কোন দুশ্চিন্তা, শুধুই নিবিড় শান্তি!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত