নতুন জীবন

নতুন জীবন

– চলেন না স্যার। আমার রেট কম আছে। খুশি করে দিব
– এই মেয়ে কখন থেকে মানা করছি তোমাকে আমার পিছু এসো না। আর তুমি বাড়াবাড়ি করেই যাচ্ছ।
– বাড়াবাড়ির কি আছে? এত রাতে পুরুষ ছেলে এই জন্যই রাস্তায় আসে। মেয়ে মানুষের সাথে রাত কাটাবার জন্য। আপনি যেখানে নিয়ে যাবেন যাব। একদম খুশি করে দিব (বলেই আমার হাতটা চেপে ধরল মেয়েটি)
– খা***র বাচ্চা। সবাইকে তোর মা**খোর মনে হয়? কথাটা বলেই মেয়েটার গালে ঠাস করে চড় বসিয়ে দিলাম।

এমনিতেই মেজাজ গরম। রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছি। এই পতিতা মেয়েটা বিশ মিনিটের মত পিছু নিয়েছে। যেখানেই সরে যাচ্ছি পিছু পিছু আসছে। ওর জন্য কোথাও স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছি না। এখন সহ্য করতে না পেরে চড়টা বসিয়ে দিলাম। কিন্তু মেয়েটা নির্লিপ্তের মত চেয়ে আছে। গালে হাত দিয়ে চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চড়টা এত জোরে দিয়েছি যে অন্য কেউ হলে তার চোখ দিয়ে পানি পড়ত। কিন্তু মেয়েটার চোখ দেখে বোঝাই যাচ্ছে না যে এত জোরে চড়টা মেরেছি। অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আমার দিকে। তারপর বলল,

– আমার মা খা*** ছিল না স্যার। গালি দিলে আমাকে দেন। আমার মাকে নিয়ে কিছু বলবেন না

এতক্ষণে খেয়াল করলাম মেয়েটা শুদ্ধ ভাষায় কথা বলছে। প্রতিটি শব্দ স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করছে কথার মধ্যে কোন জড়তা বা আঞ্চলিকতা নেই। একটু অবাক হলাম। পতিতারা শিক্ষিতাও হয়? কৌতুহল জাগল।

– রেট কত?
– ঘন্টায় পাঁচশ টাকা
– চলো আমার সাথে মেয়েটিকে নিয়ে বাসায় আসলাম। রুমে নিয়ে গেলাম।
– ওদিকে ওয়াশরুম। তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি আসছি।

বলেই রান্নাঘরে গেলাম। দুজনের জন্য কফি বানালাম। সাথে হালকা খাবার নিলাম। ট্রে তে খাবারগুলো নিয়ে রুমে ঢুকলাম। আমার হাতে এসব দেখে মেয়েটা অবাক হল।

– স্যার এসবের সময় নেই আমার হাতে। আপনি ছাড়লে অন্য কাস্টমার দেখতে হবে
– তোমাকে আমি পুরো রাতের জন্য রেখে দিলাম। কত চাও?
– বলেন কি স্যার? পুরো রাত? আপনার অনেক টাকা যাবে যে।
– সে যাক। তুমি বলো কত নিবে
– আপনাকে ভাল মানুষ মনে হচ্ছে। এখন তো রাত দুটো বাজে। বেশি দিতে হবে না। এক হাজার দিবেন
– তবে তাই হবে। খাবার গুলো খাও।
– আমি রাতে খেয়ে বের হয়েছি। শুধু কফি নিব
– আমি বিবাহিত বুঝলে। আমার বউ আছে
– তাতে কি? আমাদের কাছে যেসব পুরুষ আসে তাদের অনেকেই বিবাহিত থাকে
– আমি তাদের মত না। আমি তোমাকে কিছু করব না
– কিছু না করলে আমাকে এখানে আনলেন কেন? আবার টাকাও দিতে চাইছেন
– হ্যাঁ টাকা দিব। আর তোমার গল্প শুনব
– গল্প শুনে কি করবেন স্যার? গল্প অনেকেই শুনতে চায়, শুনে। কিন্তু আমি পতিতাই থেকে গেলাম

– কতদিন হল এই পেশায় আছ?
– এক বছর
– এর আগে কি করতে?
– মা বাসায় কাজ করত। আমি পড়তাম। এইচ এস সি পাশ করেছিলাম
– তারপর?
– তারপর একদিন এক্সিডেন্ট এ মায়ের পা চলে যায়। কেটে ফেলতে হয়েছিল। নাহলে ওখানে পচন ধরত।
– তারপর?
– তারপর মায়ের কাজগুলো আমি করতাম। কিন্তু সব কাজ করতে পারতাম না। পড়তে হত তো। তখন আমি ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে।

– তারপর কি হল?
– আমি একটা বাসায় কাজ করতাম। আর মা ঘরে বসে অন্যের কাঁথা সেলাই করতেন। কোনভাবে কেটে যাচ্ছিল মা মেয়ের সংসার।
– হুম তারপর?

কথা বলতে বলতে ওর চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগল। ছিপছিপে গড়নের মেয়েটির দিকে তাকালে বড্ড মায়া লাগে। কি নিষ্পাপ চেহারা।

– জোয়ান মেয়ে ঘরে থাকলে বাবা মায়ের অনেক চিন্তা হয়। আর যার স্বামী নেই সেই মায়ের চিন্তা আরও বেশি হয়। আমাকে নিয়ে মায়ের চিন্তার শেষ ছিল না। যে বস্তিতে আমরা থাকতাম ওখানের লোকজনের নজর ছিল আমার উপর। অনেকেই বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু আমি ছাত্রী হিসেবে ভাল ছিলাম। আমার আর মায়ের দুজনেরই ইচ্ছা ছিল আমি অনেক পড়ালেখা করব। শত কষ্টের মাঝেও মা আমার বিয়ে দেন নি

– তারপর কি হল?
– তারপর যা ভাগ্যে ছিল।

মা জ্বরে পড়লেন। ভাল হয় না। ডাক্তার দেখালাম, ওষুধ খাওয়ালাম। ভাল হল না। সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করলাম। প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করার সামর্থ্য কোথায় আমার? সরকারি হাসপাতালে ওষুধ পাওয়া যায় কম। বাইরে থেকে কিনতে হত। কিন্তু আমি এত টাকা কোথায় পাব? তারপর একজন ডাক্তার সাহায্য করলেন। দশ দিন ওষুধ কেনার টাকা উনি দিলেন। দশ দিন পর ওনার কোন জরুরী কাজ পড়ে যাওয়ায় উনি গ্রামে গেলেন। যাবার সময় কিছু টাকা দিয়ে গেলেন আমাকে। মায়ের ওষুধ কেনার জন্য। তাতে পাঁচ দিন চলল। পরের পাঁচ দিন আবার আগের মত। ওষুধ কিনতে পারি নি। গেল বিশ দিন

– এরপর কি হল? আন্টি সুস্থ হলেন?
– সে ভাগ্য কি আমার ছিল? পঁচিশ দিন পর মা মারা গেলেন।
– ইসসস! তারপর কি হল?
– তারপর শুরু হল জীবনের আসল যুদ্ধ।

বাসায় কাজ করতাম। আবার কাঁথা সেলাই করতাম। যেটুকু সময় পেতাম পড়তাম। না কোচিং, না প্রাইভেট। মা মারা গেলেন, দু মাস পর পরীক্ষা। প্রিপারেশন ভাল ছিল না। বুঝতে পারছিলাম না কি করব। পরীক্ষা দিলাম। রেজাল্ট খারাপ হল। কিন্তু ততদিনে আমার দুর্দশা শুরু

– কেমন দুর্দশা?
– বস্তির অনেক মানুষের আমার উপরে নজর ছিল। তাদের এড়িয়ে চলতে খুব কষ্ট হত। কেউ কেউ তো আমার খোজ নেওয়ার বাহানায় ঘরেও ঢুকে পড়ত। অনেক কষ্টে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতাম। কিন্তু বেশি দিন পারলাম না। যে বাসায় কাজ করতাম একদিন খালাম্মা বাসায় ছিলেন না। কাজ করছিলাম সেই সুযোগে ওনার স্বামী আমাকে রেপ করে। আমার চিৎকার হয়ত কারো কানে পৌছায় নি। কেউ বাঁচাতে আসে নি আমাকে

– বলো কি? তারপর কি হল?
– পরদিন সেই বাসার খালাম্মার কাছে ওনার স্বামীর ব্যাপারে বললাম। উনি উল্টো আমাকেই গালাগালি করলেন। বললেন আমি টাকা হাতানোর ধান্দায় এসব বলছি। বিচার পাই নি আমি। পৃথিবীতে যার কেউ নেই তাকে ন্যায় বিচার কে দিবে?

– এরপর কি হল?
– একটা হোটেলে কাজ নিলাম।

হোটেলের ক্যাশিয়ারও সুযোগ পেলে হাত চেপে ধরত। আড়ালে যেতে ইশারা করত। বস্তির ছেলেরা যখন আমাকে ভোগ করতে পারল না তখন আমার নামে মিথ্যা অপবাদ দিল। হোটেল থেকে ফিরতে একটু রাত হত। সেই সুযোগে ওরা বলল আমি নাকি খারাপ মেয়ে। রাতের বেলা খারাপ কাজ করি। বস্তি থেকে আমাকে বের করে দেওয়া হল। আর এই ঘটনা শুনে হোটেলের মালিকও আমাকে কাজে রাখল না। যার খারাপ চরিত্রের কারণে বস্তি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে তাকে উনি কাজে রাখবেন না। মেয়েটি বলে চলেছে। কখন যেন আমার চোখ দিয়ে পানি পড়া শুরু করল বুঝলাম না। মানুষের জীবন এত কষ্টের হয়? কেন আমরা মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়াতে পারি না? আমরা এত নিষ্ঠুর কেন?

– তারপর অনেক জায়গায় কাজের চেষ্টা করেছি। কেউ একা মেয়ে শুনলে কাজ দিতে চায় না, কেউ বা একা শুনে তার সুবিধা নিতে চায়। তারপর চলে এলাম এই পথে। বাঁচতে হলে আমাকে এটাই করতে হবে। পৃথিবী আমাকে ভাল থাকতে দিবে না

– কিছু বলার ভাষা নেই। তোমার কষ্টটা হয়ত বুঝতে পারছি কিন্তু তোমার মত অনুভব করতে পারব না। এরই মধ্যে পাশের রুম থেকে আমার স্ত্রী এল।
– কে মেয়েটা? আর তুমি কখন এলে? আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এভাবে ঝগড়া করে এত রাতে কেউ বাসা থেকে বের হয়? যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটত? মেয়েটা কে বলছ না কেন?

– তুমি শান্ত হও সব বলছি। আমি নিজেই ওর নাম জানি না। কি নাম তোমার বোন?
– আমার নাম নিসা
– আবার পড়াশোনা শুরু করবে?
– হাহাহা। আমি পড়াশোনা করব? রাতের বেলায় যারা আমাকে ভোগ করে দিনের বেলায় তারাই আমার দিকে আঙ্গুল তুলবে। রাস্তায় দেখলে ধিক্কার জানাবে।

– সে ব্যবস্থা আমি করব। তোমাকে শুধু এ কাজটা ছাড়তে হবে। মেয়েটি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। হয়ত বিশ্বাস করতে পারছে না।
– আপনি মজা করছেন না তো?
– মজা করছি না। একবার এই ভাইকে বিশ্বাস করেই দেখ। তোমার জীবনটা পাল্টে যাবে।

মেয়েটি এবার সজোরে কান্না শুরু করল। হয়ত এটা সুখের কান্না। বারবার ঠকে আসা মানুষগুলো কখনও বিশ্বাসের হাত পেলে পুরোনো কষ্টগুলো হয়ত আরও মনে পড়ে যায়। আমার স্ত্রী কে সব বুঝিয়ে বললাম। ও কখনও আমার সিদ্ধান্তে বাধা দেয় নি। আজও দিল না।

সেই ঘটনার পর কেটে গেছে দুই বছর। নিসাকে আমি দূরের এক শহরে ডিগ্রি পড়ার জন্য ভর্তি করে দিলাম। ওখানেই ওকে মেসে রেখে আসলাম। কলেজে ভর্তি হওয়ার দিন ওর চোখের আনন্দটুকু আমি আজও ভুলি নি, ভুলতে পারব না। ওকে বলেছিলাম পরিপূর্ণ পর্দার মধ্যে চলতে, ইসলামের সব নিয়ম মেনে চলতে। এতে একদিকে যেমন ওকে দেখে কেউ চিনবে না, আর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে ওনার পথে থাকলে হয়ত ক্ষমা করে দিবেন। ও সেভাবেই চলে। ওর মাস খরচের টাকা আমিই দেই। সেদিন বলল টিউশন শুরু করেছে। হয়ত সব পতিতার দায়িত্ব নেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। কিন্তু একজনকে ফেরাতে পেরেছি, এই বা কম কিসে?
ভাল থাকুক সব মানুষ।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত