সপ্তাহ দুয়েক আগে বিয়ে করেছি। করেছি বলতে জোর করে বিয়ে দেয়া হয়েছে আমাকে। লেখাপড়া শেষ করে সবেমাত্র একটা চাকরি পেয়েছি, ঠিক তখনি। নিজের পছন্দমতো কেউই ছিলো না। তাই বাবা-মায়ের পছন্দ করা মেয়েকেই করতে হলো। শুনেছি মেয়েটা নাকি বেশ ভালো। গায়ের রং ততটা ফর্সা নয়। শুধু এতটুকু কথার উপর ভিত্তি করে ব্যাচেলর জীবনের ইতি টেনেছি।
সকলেরই বিয়ের দিন বাসর হয়। আমার ঠিক উল্টো। কত স্বপ্ন ছিলো এই বিয়েকে ঘিরে। কিন্তু নাহ, কিছুই হলো না। যতটা ভেবেছিলাম তার থেকে কালো এই মেয়ে। রাগে-দুঃখে আর তাকে স্পর্শ করি নি। জোৎস্না রাত ছিলো, চাঁদের আলো ঘরে ঢুকে মিটমিট করে জ্বলছিলো। কিন্তু ভালোবাসার অভাব ছিলো বলে কোন কিছুই হয় নি। হয় নি বাসরবিলাস।
রাইসা বুঝতে পেরেছে ওকে ঠিক আমার পছন্দ হয় নি। সেজন্য আমার সাথে কথা কম বলতো। বেশিরভাগ সময় আমি ওকে এড়িয়ে যেতাম। মনে মনে একটা আক্ষেপ ঠিকই ছিলো, আমার বউ কালো! মনটা সবসময় খারাপ থাকতো। রাত হলে বিছানায় নয়, সোফাতে ঘুমাতাম। তবুও বাবা-মা কে বুঝতে দেই নি আমি কষ্টে আছি। রাইসা কথা কম বললেও সবসময় যখন যেটা প্রয়োজন সেটা রেডি করে রাখতো। মেয়েটা একাকি কাঁদতো। বেশ কয়েকবার দেখেছি,কিছু বলি নি। মনে মনে ভাবতাম, রাইসা ওর মতো থাকুক।
রাইসা ছিলো আল্লাহ ভীরু। অপরদিকে আমি নামাযও পড়তাম না, রোযাও রাখতাম না। সবসময় এসব থেকে দূরে থাকতাম। মেয়েটা আল্লাহ ভীরু বলে বাবা-মা আমার জন্য ওকে পছন্দ করে দিয়েছে। আর যাইহোক, বাধ্য মেয়ে রাইসা। জীবনটাকে ধিক্কার দিচ্ছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম, “বিয়ের আগে কেন ওকে দেখলাম না! কেন বাবা-মায়ের কথার উপর একটা কালো মেয়েকে বিয়ে করলাম! ”
ঘরে ঢুকলাম, রাইসা তখন রান্নাঘরে। বিছানার উপর একটা বই দেখতে পেলেম। বইটা হাতে নিয়ে বুঝলাম,ইসলামীক বই। তারমানে রাইসা ইসলামীক নিয়ম পদ্ধতি সমূহ জানতে আগ্রহী। বইটি নিয়ে সোফায় বসে পড়লাম। একটা একটা করে পাতা উল্টালাম। বইটার নাম “আদর্শ নারী “। একটা হাদীস দেখে চোখটা আটকে গেল, “তোমরা মেয়ে মানুষদেরকে চারটা গুন দেখে বিবাহ করো। সৌন্দর্যতা, আল্লাহ ভীরুতা, ধনসম্পদ ও বংশ। ” পরে দেখলাম ব্যাখায় বলা আছে, উক্ত চারটির মধ্যে আল্লাহ ভীরুতার উপর বেশি প্রাধান্য দিতে হবে। রাইসা কাজ শেষ করে বইটা খুঁজছিলো। আমি তখনন বেলকনিতে বসে পেপার পড়ছিলাম। লক্ষ করলাম কিছু একটা পাগলের মতো খুঁজছে। আমি পেপারের ফাঁক দিয়ে দেখে বুঝলাম। কিছুক্ষণ পর সব সংকোচ ভুলে আমাকে নিচু স্বরে বললো, “আপনি কি আমার বইটা দেখেছেন?” পেপারটা ভাজ করতে করতে বললাম, “কোন বইটা?”
“আদর্শ নারী”
“জ্বী, আমার বুক সেলফে দেখেন।”
বলাবাহুল্য পুরো বইটা খুব দ্রুত শেষ করে ফেলেছি। বইটা পড়ে কিছুটা হলেও অনুশোচনা এসেছে আমার। মনে মনে ভাবতে লাগলাম, ” রাইসাকে তো আমি বিয়ে করেছি। তাহলে কেন ওর অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলবো? ও মানুষ মাত্র। ওর কালো হবার পিছনে ওর তো কোন হাত নেই। যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, তিনিই তাকে কালো করে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। হয়তো এটাও একটা পরীক্ষা। ” মনটা ছটফট করতে করতে সোফায় ঘুমিয়ে পড়লাম।
গভীর রাত্রে ঘুম ভেঙে গেল। কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম। তড়িঘড়ি করে উঠে দেখলাম, বাইরের আবছা আলোর পাশে কে যেন নামায পড়ছে। বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাইসা নেই। নিশ্চিন্ত হলাম, ওটা রাইসা ছিলো। আমি সোফায় চুপ করে বসে থাকলাম। ঘর অন্ধকার ছিলো বলে আমাকে ঠিক দেখা যাচ্ছিলো না। রাইসা নামায শেষ করে মুনাজাত শুরু করেছে। মুনাজাতের সময় ওর চোখ দিয়ে পানি ঝরছিলো। ওর চোখে কেন জানি পানি দেখো আমার মনটা গলে গেল। খুব খারাপ লাগছিলো।
রাইসার অস্পষ্ট কথা আমার কানে ভেসে আসছিলো। বলছিলো, “হে আমার মাবুদ, আমার স্বামী আমাকে উনার স্ত্রীর মর্যাদা থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছেন। আমার কি দোষ বলুন, আমি তো নিজের ইচ্ছায় কালো হইনি। তুমি তো আমাকে কালো করেই সৃষ্টি করেছো। তুমি তো বলেছো, রাত্রের শেষভাগে দুনিয়ায় আগমন করে বান্দাদের আহ্বান করো বলতে থাকো, তোমাদের কার কি সমস্যা আমার কাছে চাও আমি তোমাদেরকে দান করবো।” হে মাবুদ আমার স্বামী হয়তো আমাকে বুঝে উঠতে পারে নি। উনাকে ক্ষমা করো আর বোঝার মতো ক্ষমতা দান করো। তোমার কাছে আর কি বা চাওয়া থাকতে পারে! আমার সংসারে সুখ দান করো। আমার স্বামী ইসলামের পথ থেকে বিমুখ। তাকে হেদায়াতের পথ দেখাও। তুমি না দেখালে করে করবে মাবুদ! ” মুনাজাত শেষ করে পিছনে ঘুরতেই চমকে ওঠে রাইসা। আমি ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছি। মনে মনে ভাবলাম, যাকে বিয়ের পর থেকে এড়িয়ে চলছি সে কিনা আমার জন্য এতো ভাবে! আমাকে দেখে বেশ খানিকটা অবাক হয় রাইসা,
– আপনি ঘুমান নি?
– ঘুমিয়েছিলাম, ঘুম ভেঙে গেছে।
– ওহ।
– রাইসা তুমি আমাকে মাফ করে দাও।
– কিসের জন্য?
– তোমাকে কালো ভেবে অনেক অবহেলা করেছি। তোমাকে তোমার যোগ্য স্থান না দিয়ে কষ্ট দিয়েছি।
দুজনের চোখেই পানি। রাইসার চোখে সুখের পানি আর আমার চোখে হতাশার পানি। মেয়েটা আমার বুকে মাথা রেখে ডুকরে উঠলো। আমার চোখ থেকেও ঝরঝর করে পানি ঝরছে। মলিন মুখটা উপরে উচিয়ে কপালে চুমু এঁকে দিলাম আর বললাম,
– জনম জনম এভাবে আমার হেদায়াতায়ের জন্য দোয়া করবে। বিশ্বাস করো ফজর থেকে পাঁচ ওয়াক্ত নামায শুরু করবো। মহান আল্লাহর কাছে পাপের জন্য ক্ষমা চাইবো। কত গুনাহ করেছি এই জীবনে তার ইয়ত্তা নেই।
– আল্লাহ আপনাকে সারাজীবন যেন আমার পাশে পাশে রাখেন। সুখে-দুঃখে যেন দুজন দুজনার পাশে দাঁড়াতে পারি। (আমিন) রাইসার কথা শুনে অশ্রুসিক্ত চোখে আমিও আমিন বলে উঠলাম।