স্বপ্নে দেখা সেই মেয়েটি: ৬. মাস তিনেকের মধ্যে মসজিদ তৈরি

স্বপ্নে দেখা সেই মেয়েটি: ৬. মাস তিনেকের মধ্যে মসজিদ তৈরি

৬. মাস তিনেকের মধ্যে মসজিদ তৈরি

মাস তিনেকের মধ্যে মসজিদ তৈরি সম্পূর্ণ হলেও মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করে চালু করতে প্রায় এক বছর সময় লাগল। আজ মাদরাসা উদ্বোধন হবে। ধর্মমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন। এই দু’ বছরের মধ্যে খোকসাবাড়ি ইউনিয়নের সমস্ত গ্রামে ফায়সালের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে। আবাল বৃদ্ধ তাকে শ্ৰেণীমতো ভক্তি শ্রদ্ধা করে, তাকে খোকসাবাড়ির আল্লাহর রহমত মনে করে। বিশেষ করে গরিবরা তাকে পীরের মতো মান্য করে। আর করবে নাই বা কেন? যে সব অসহায় পরিবারের আয়ের কোনো উৎস নেই, তাদের আয়ের উৎস করে দিয়েছে, অসহায় পরিবারের অনেক আইবুড়ী মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্থা করেছে, বিভিন্ন গ্রামের রাস্তা ঘাটের সংস্কার করে দিয়েছে। গরিব ও অসহায় পরিবারের হেলেমেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। সব থেকে বড় যে কাজ করেছে সেটা হল, চৌধুরীদের অত্যাচার থেকে সমস্ত গ্রামের মানুষকে রক্ষা করেছে। অবশ্য ফায়সালের সঙ্গে স্বপ্নারও সুনাম ছড়িয়েছে। কারণ ফায়সাল যা কিছু করেছে স্বপ্নাকে দিয়ে করিয়েছে, সে শুধু সঙ্গে থেকেছে আর লোকজনের কাছে। স্বপ্নার পরিচয় জানিয়েছে। তার ফলে চৌধুরী বংশের আগে যে দুর্নাম ছিল এখন আর তা নেই। বরং ক্রমশ সুনাম বেড়েই চলেছে।

তাই আজ মাদরাসা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে হাজার হাজার মানুষ এসেছে। চৌধুরী স্টেটের সব লোক এসেছে। লুৎফা বেগম বোরখা পরে এলেও ফায়জুন্নেসা ও স্বপ্না গায়ে মাথায় চাদর দিয়ে এসেছেন।

নীলফামারী জেলার এম.পি, আসার পর ধর্মমন্ত্রী মাদরাসা উদ্বোধন করলেন। তারপর অনুষ্ঠানে ভাষণ দেয়ার সময় প্রথমে ফায়সালের ও চৌধুরী স্টেটের মালিকদের ভূয়সী প্রশংসা করলেন। তারপর যারা এই প্রতিষ্ঠানে জমি জায়গা ও টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করেছে তাদের, বিশেষ করে আজিজের অনেক প্রশংসা করে বললেন, আশা করি, যারা এই মহৎ প্রতিষ্ঠান করেছেন এবং যারা সাহায্য করেছেন, তারা সবাই এটা যাতে ভালোভাবে পরিচালিত হয় সে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এই প্রতিষ্ঠান যাতে সরকারের অনুদান পায়, সে ব্যবস্থা ইনশাআল্লাহ আমি করব। এখানেই আমার বক্তব্য শেষ করছি। আল্লাহ হাফেজ তারপর সালাম জানিয়ে বসে পড়লেন।

এমন সময় একটা জীপ এসে মঞ্চের কাছে থামতে সেদিকে সবাই তাকাল। জীপ থেকে ডি.আই.জি, আই.জি ও খোকসাবাড়ি থানার ওসি নেমে মঞ্চে এসে ধর্ম মন্ত্রীর সঙ্গে সালাম ও মোফাসা করার পর উনি ওনাদের বসতে বললেন। আর ওনাদের সঙ্গে যে কয়েকজন পুলিশ এসেছে, তারা মন্ত্রীকে স্যালুট দিয়ে একপাশে দাঁড়াল।

ওসি সাহেব বসেন নি, পঁড়িয়ে ছিলেন। ওনারা বসার পর ওসি সাহেব মন্ত্রী মহোদয়ের অনুমতি নিয়ে জনগণকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনারা চৌধুরী বংশের কিংবদন্তীর কথা অনেক শুনেছেন। তিন বছর আগে এখানকার থানার ওসি হয়ে আসার পর আমিও শুনেছি। কিন্তু বিশ্বাস করতে পারি নি। প্রায় দু’বছর থানার নথীপত্র দেখে ও আপনাদের অনেকের সঙ্গে আলাপ করে দৃঢ় ধারণা হয়, নিশ্চয় এর মধ্যে কোনো রহস্য আছে। রহস্য উদ্মাটনের জন্য প্রথমে ডি.আই.জি. কে সবকিছু জানিয়ে নতুন করে তদন্ত করার জন্য অনুরোধ করি। উনি ফাইল পত্র আই.জি. সাহেবের কাছে পাঠান। তিনি গোয়েন্দা বিভাগের একজনকে তদন্ত করার জন্য পাঠাবার ব্যবস্থা করেন। তারপর মঞ্চে দাঁড়ান ফায়সালের কাছে গিয়ে তার হাত ধরে তুলে বললেন, ইনিই তিনি, যিনি দু’বছর আগে চৌধুরী স্টেটের ম্যানেজার হয়ে কাজ করছেন। ইনি এই দু’বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে একদিকে যেমন চৌধুরী বংশের দুর্নাম ঘুচিয়ে সুনাম অর্জনের কাজ করছেন, তেমনি চৌধুরী বংশের ব্যাপারে যে কিংবদন্তী আছে, তার রহস্য উদঘাটন করেছেন। এখন আমরা ওনার মুখ থেকে রহস্য উদঘাটনের কাহিনী শুনব। মন্ত্রী মহোদয়, আই.জি. ও ডি.আই. জি. সাহেবের কাছে সবিনয় নিবেদন করছি, আপনারা জনাব ফায়সালকে সব কিছু বলার জন্য অনুমতি দিন।

ওনারা অনুমতি দেয়ার পর ফায়সাল বলল, ওসি সাহেবের পাঠান ফাইলপত্র পড়ে আমিও কিংবদন্তী কথাগুলো বিশ্বাস করি নি। এর মধ্যে পেপারে চৌধুরী স্টেটের ম্যানেজারের জন্য লোক চায় জেনে এখানে এসে চাকরিতে জয়েন করি। আসার পথে নীলফামারী স্টেশনে নেমে এক বৃদ্ধের সঙ্গে আলাপ করে চৌধুরী বংশের অনেক কিছু জানতে পারি। পরে সেই বৃদ্ধের অনেক খোঁজ করেও আর দেখা পাই নি। তারপর বাড়িতে যাওয়ার কথা বলে ছুটি নিয়ে প্রথমে চৌধুরী বংশের প্রথম পূর্ব পুরুষ জয়নুদ্দিনের আসল বাড়ি ডোমারে অনুসন্ধান চালিয়ে জানতে পারি, জয়নুদ্দিন দীঘিতে মাছ ধরতে গিয়ে জিনেদের একঘড়া সোনার মোহর পেয়ে লোক জানাজানির ভয়ে এখানে পালিয়ে এসে বাস করেছেন, কথাটা মিথ্যা। আসল কথা হল, উনি যখন দীঘিতে মাছ ধরতে যান। তার আগে ডাকাতরা ডাকাতি করে এসে টাকা ও সোনার গহনা ভাগাভাগি করছিল। পুলিশরা গোপন সূত্রে সেকথা জানতে পেরে তাদেরকে এ্যারেস্ট করতে আসেন। তখন তারা টাকা ও সোনার গহনা একটা পিতলের কলসে ভরে শক্ত কাদা দিয়ে মুখ বন্ধ করে দীঘির পানিতে ফেলে দেয়। পুলিশরা ততক্ষণে ঘেরাও করে সবাইকে এরেস্ট করে এবং তাদের সাত বছরের জেল হয়। জয়নুদ্দিনের জালে সেই পিতলের কলসি উঠে আসে। তবে একথা ঠিক, লোক জানাজানির ভয়ে জয়নুদ্দিন গোপনে এখানে এসে বসবাস শুরু করেন।

ঐ ডাকাত দলে সামশের নামে একজন ছিলেন। তিনি হলেন পাশের গ্রামের আজিজ মিয়ার পরদাদা অর্থাৎ দাদার বাবা। জেলে সামশেরের আচরণ ভালো হওয়ায় মেয়াদ শেষ হওয়ার দু’বছর আগে ছাড়া পান। তারপর সেই দীঘিতে যেখানে টাকা ও গহনার কলস ফেলেছিল, সেখানে কয়েকদিন গভীর রাত্রে জাল ফেলে নিরাশ হয়ে ডোমার গ্রামে খোঁজ করতে লাগলেন, হঠাৎ কেউ বড়লোক হয়েছে কিনা। একদিন একজন লোকের কাছে জানতে পারলেন, বছর চারেক আগে হত-দরিদ্র জয়নুদ্দিন স্ত্রী ও একছেলেকে নিয়ে খোকসাবাড়িতে গিয়ে খুব বড়লোক হয়ে চৌধুরী উপাধি নিয়ে বাস করছেন। কথাটা জেনে সামশেরের দৃঢ় ধারণা হল, এই জয়নুদ্দিনই নিশ্চয় টাকা ও গহনার কলস পেয়েছে। বাড়িতে ফিরে এসে একদিন জয়নুদ্দিনের সঙ্গে দেখা করে জানতে চাইলেন ওনার হঠাৎ গ্রাম ছেড়ে এখানে আসার ও হত-দরিদ্র হয়ে কি করে এত বড় লোক হলেন।

জয়নুদ্দিন তখন গ্রামের প্রভাবশালী লোক। সামশেরকে অপমান করে তাড়িয়ে দেন।

সামশের লোক পরম্পরায় জানতে পারলেন, জয়নুদ্দিন জিনেদের একঘড়া সোনার মহর পেয়ে এখানে এসে বসবাস করছেন। তখন ওনার ধারণাটা আরও দৃঢ় হল। জয়নুদ্দিন আসল কথা চেপে গিয়ে জিনেদের সোনার মহরের ঘড়ার কথা বলেছেন। তারপর শুরু করলেন শতা। সময় সুযোগ মতো জয়নুদ্দিনের গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করে জলমহলে ফেলে দেন। এর কিছুদিন পর সামশের মারা যান। মারা যাওয়ার আগে ছেলে সারওয়ারকে জয়নুদ্দিনের কাহিনী বলে যান। সারওয়ার সময় সুযোগ মতো জয়নুদ্দিনের ছেলে আবসার উদ্দিনকে গলায় ফাঁস দিয়ে মেরে একই জলমহলে ফেলে দেন। সারওয়ার মারা যাওয়ার আগে ছেলে সোরাব উদ্দিনকে সবকিছু বলে ইনসান চৌধুরীকে একইভাবে হত্যা করার কথা বলে যান। কিন্তু তা করার আগে হঠাৎ সোরাব উদ্দিন মারা যান। তখন ওনার ছেলে আজিজ ক্লাস টেনে পড়ে। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় ইনসান চৌধুরীর একমাত্র মেয়ে ফায়জুন্নেসার সঙ্গে মন দেয়া-নেয়া হয়। কলেজে পড়ার সময় আজিজ দাদিকে কথাটা জানিয়ে বলেন, বি.এ. পাশ করে আমি ফায়জুন্নেসাকে বিয়ে করব।

নাতির কথা শুনে দাদি আয়শা খাতুন চিন্তা করলেন, সোরাব উদ্দিন যে কাজ করতে পারে নি, আজিজকে দিয়ে তা করাতে হবে। বললেন, তোর কথা শুনে আমি খুব খুশি হয়েছি। তারপর চৌধুরীদের সঙ্গে তাদের পূর্বপুরুষদের শত্রুতার কারণগুলো বলে বললেন, ইনসান চৌধুরী হল বিশাল হাঙ্গর মাছের মতো আর আমরা হলাম চুনো পুঁটি মাছের মতো। উনি মেয়েকে কেটে নদীতে ভাসিয়ে দেবেন তবু তোর সঙ্গে বিয়ে দেবেন না। তাই বি.এ. পাশ করার পর তোর প্রথম কাজ হবে ইনসান চৌধুরীকে তার বাপ-দাদার মতো হত্যা করে জলমহলে ফেলে দেয়া। তারপর ঐ মেয়েকে বিয়ে করে তুই চৌধুরী স্টেটের মালিক হবি। দাদির কথা মতো আজিজ বি.এ. পাশ করার পর ইনসান চৌধুরীকে হত্যা করার সুযোগের অপেক্ষায় রইলেন। এদিকে ইনসান চৌধুরী তার সঙ্গে মেয়ের সম্পর্কের কথা জেনে স্টেটের ম্যানেজার হারেসের সঙ্গে ফায়জুন্নেসার বিয়ে দেন। আজিজ সে কথা জেনে শশুর জামাই দুজনকেই হত্যা করার চেষ্টা করতে লাগলেন। তারপর সুযোগ পেয়ে প্রথমে ইনসান চৌধুরীকে পূর্বপুরুষদের মতো একই কায়দায় হত্যা করে জলমহলে লাশ ফেলে দিলেন। এটাকেও সবাই জিনেদের দুশমনী ভাবলেন। এমন কি থানার পুলিশরাও তাই ভেবেছিলেন। তারপর কৌশলে ইনসান চৌধুরীর জামাইকেও একই পন্থায় হত্যা করে এবং কৌশলে ফায়জুন্নেসার মন জয় করে স্টেটের ম্যানেজার হন। ম্যানেজার হওয়ার পর স্টেটের আয় থেকে টাকা মেরে অনেক জমি-জায়গা করে ধনী হয়ে যান। তারপর ফায়জুন্নেসাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। ততদিনে আজিজের ধনী হওয়ার কথা ফায়জুন্নেসা শুনেছেন এবং স্টেটের আয় ব্যয়ের হিসাবে অনেক কারচুপি জানতে পারেন। তাই বিয়ের প্রস্তাব শুনে ফায়জুন্নেসা আজিজের মতলব বুঝতে পারেন এবং ওনাকে যা তা বলে অপমান করে তাড়িয়ে দেন। তারপর থেকে আজিজ তার গুণ্ডাবাহিনী দিয়ে চৌধুরী স্টেটের ক্ষতি করেই চললেন।

ওসি ফায়সালকে জিজ্ঞেস করলেন, এতকিছু জেনেও আজিজকে আগেই এ্যারেস্ট করার ব্যবস্থা করলেন না কেন?

ফায়সাল বলল, আজিজ ও ওনার পূর্ব পুরুষরা যে একের পর এক চৌধুরী স্টেটের মালিকদের হত্যা করেছেন, তা আগে জানতে পারি নি।

তারপর চৌধুরীদের টাকা আত্মসাৎ করে যে সব সম্পত্তি করেছিলেন, সেগুলো মাদরাসায় কিভাবে ওয়াকফ করলেন সে সব বলে বললেন, মৃত্যু শয্যায় উনি আমাকে এসব কথা বলেছেন।’

এবার আই.জি. সাহেব ফায়সালকে বললেন, এই জটিল রহস্য উঘাটন করার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আশা করি, অতি শিঘ্রি ঢাকা অফিসে জয়েন করবেন।

ফায়সাল বলল, জি, করব।

ধর্ম মন্ত্রী ফায়সালের ভূয়সী প্রশংসা করে বললেন, আমি জেনেছি, আপনি সরকারি কাজে এসে এই দু’বছরের মধ্যে খোকসাবাড়ি থানার সমস্ত গ্রামের মানুষকে উন্নতির পথ দেখিয়েছেন, চৌধুরীদের শত্রুকে মিত্র করেছেন এবং জিনেদের দুশমনী করার যে ধারণা করে চৌধুরীরা এতকাল আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে ছিলেন, তা দূর করে কিংবদন্তীর অবসান ঘটালেন। সে জন্য সরকার থেকে। আপনাকে পুরস্কৃত করা হবে। তারপর অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করলেন।

.

ফায়সালের আসল পরিচয় জেনে ও তার বক্তব্য শুনে ফায়জুন্নেসা প্রথম দিকে যেমন খুশি হয়েছিলেন তেমনি অবাকও হয়েছিলেন। কিন্তু ফায়সাল যখন আজিজের সঙ্গে তার মন দেয়া-নেয়ার কথা বলে তখন একথা ভেবে ভয় পেয়েছিলেন যে, স্বামী বেঁচে থাকা অবস্থায় ও মারা যাওয়ার পর আজিজের সঙ্গে তার অবৈধ সম্পর্কের কথা যদি প্রকাশ করে দেন, তা হলে আত্মহত্যা করা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। কথাটা ভেবে ভয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিলেন। তারপর ফায়সাল কৌশলে ঐ প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেলে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ভাবলেন, ফায়সাল মানুষ হলেও তার চরিত্র ফেরেশতার মতো।

লুৎফা বেগমও খুব অস্থির হয়ে পড়েছিলেন এই ভেবে যে, যদি ফায়সাল ওদের অবৈধ সম্পর্কের কথা প্রকাশ করে দেয়, তা হলে চৌধুরী বংশের ইজ্জৎ ধুলোয় মিশে যাবে। ফায়সাল তা করল না দেখে তিনিও তার প্রতি খুব সন্তুষ্ট হবেন।

আর স্বপ্না ফায়সালের পরিচয় পেয়ে যতটুকু খুশি হয়েছিল, পূর্ব পুরুষ জয়নুদ্দিনের ধনী হওয়ার ঘটনা শুনে তার থেকে অনেক বেশি নিজের কাছে নিজেকে ঘৃণিত মনে করতে লাগল। ভাবল, চৌধুরীদের এত বিশাল সম্পত্তির পিছনে রয়েছে ডাকাতদের ডাকাতির অবৈধ সম্পদ।

বাড়িতে এসে মেয়ের মন খারাপ দেখে ফায়জুন্নেসা জিজ্ঞেস করলেন, কিরে, শরীর খারাপ?

স্বপ্না বলল, না।

তা হলে তোর মন খারাপ কেন?

পূর্ব পুরুষ জয়নুদ্দিনের ধনী হওয়ার ঘটনা শুনে।

এতে মন খারাপের কি হল? আমরা তো অন্যায় কিছু করি নি?

না করলেও আমরা ওনার সেই অন্যায়ভাবে হস্তগত সবকিছু তো ভোগ করছি?

হ্যাঁ, তা করছি। তবে এজন্য তো আমরা দায়ী নই। ওসব কথা মন থেকে মুছে ফেলে এখন কি করবি চিন্তা কর।

স্বপ্না অবাক হয়ে বলল, কি চিন্তা করব?

এরই মধ্যে ভুলে গেলি? ম্যানেজারকে জামাই করার ব্যাপারে সেদিন আমাদের সিদ্ধান্তের কথা তোকে বললাম না?

উনি সরকারি লোক, সরকারি কাজে এসেছিলেন। কাজ শেষ হয়েছে, ওনার বস এবার ঢাকায় ফিরে যেতে বললেন, শুনলে না।

তা তো শুনেছি। এর সঙ্গে বিয়ের কোনো সম্পর্ক থাকবে কেন?

সম্পর্ক নেই ঠিক; কিন্তু আমাকে বিয়ে করবেন কি না তাতে তোমরা জান? প্রস্তাব দিলে যদি রাজি না হন?

কেন হবেন না? তুই তো বলেছিলি, “তিনি তোকে ভীষণ ভালবাসেন, তোকে না পেলে সারাজীবন বিয়েই করবেন না।”

আমাকে নয়, উনি ওনার স্বপ্নে দেখা মেয়েটির কথা বলেছিলেন।

ওনার স্বপ্নে দেখা মেয়েটি যে তুই, সে কথাও তো বলেছিলি। আমি তোর নানিকে দিয়ে প্রস্তাব দেওয়াব।

দু’বছর তার সঙ্গে মেলামেশা করে স্বপ্না ফায়সালকে এত ভালবেসে ফেলেছে যে, তার কেবলই মনে হয় তাকে ছাড়া বাঁচবে না। তাই সে এবার চলে যাবে, জানার পর থেকে তার মন ভীষণ ছটফট করছে। প্রস্তাব দেয়ার কথা শুনে ভাবল, পূর্বপুরুষ জয়নুদ্দিনের কারণে হয়তো ফায়সাল তাকে ভীষণ ভালবাসলেও স্ত্রীরূপে গ্রহণ করবে না। কথাটা ভেবে তার চোখে পানি এসে যেতে মুখ নিচু করে চুপ করে রইল।

কি রে, কিছু বলছিস না কেন?

ভিজে গলায় জানি না যাও বলে স্বপ্না সেখান থেকে নিজের রুমে এসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

রাতে খাওয়ার টেবিলে লুৎফা বেগম মেয়েকে বললেন, স্বপ্না কোথায়? ওকে ডাক।

ফায়জুন্নেসা কুলসুমকে বললেন, স্বপ্না আসে নি কেন দেখে এস।

কুলসুম ফিরে এসে বলল, আপা দরজা লাগিয়ে ঘুমিয়েছেন, ডাকতে বললেন, খাবেন না।

লুৎফা বেগম মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, ওর শরীর খারাপ নাকি?

ফায়জুন্নেসা মেয়ের মানসিক অবস্থা বুঝতে পেরেছেন। বললেন, না, তবে মন খুব খারাপ দেখলাম।

হঠাৎ মন খারাপ কেন হল?

মনে হয়, ম্যানেজার ঢাকা চলে যাবেন শুনে মন খারাপ, তারপর তার সঙ্গে যা আলাপ করেছেন বললেন।

লুৎফা বেগম কিছু না বলে খাওয়া শেষ করে রুমে যাওয়ার সময় বললেন, ম্যানেজারকে ডেকে পাঠাও তার সঙ্গে কথা বলব।

ফায়সাল দোতলায় ড্রইংরুমে এসে সালাম দিয়ে ঢুকে দেখল, লুৎফা বেগম ও ফায়জুন্নেসা বসে আছেন, স্বপ্না নেই।

ফায়জুন্নেসা সালামের উত্তর দিয়ে বসতে বললেন।

ফায়সাল বসার পর লুৎফা বেগম বললেন, সরকারি কাজে এসেছিলে, কাজ শেষ হয়েছে, এবার তা হলে চলে যাচ্ছ?

ফায়সাল বলল, সরকারের চাকরি করি, সরকারের হুকুম তো মানতেই হবে।

আমরাও তো তোমাকে চাকরি দিয়ে আনিয়েছি। সে ব্যাপারে কি করবে?

সরকারের আদেশ অনুসারে এখানে রিজাইন দিতে হবে।

হতে আমরা যদি এ্যাকসেপ্ট না করি।

এ্যাকসেপ্ট না করার কোনো কারণ তো দেখছি না। বরং জিনের ও মানুষের দুশমণী থেকে আপনাদের দুশ্চিন্তা আল্লাহর ইচ্ছায় দূর করে দিয়েছি, সে জন্য খুশি মনে এ্যাকসেপ্ট করাই তো উচিত। তা ছাড়া আপনারা শিক্ষিত, সরকারের আদেশ আমার মানা উচিত, তা তো ভালো করেই জানেন।

আমরা শিক্ষিত হলেও তোমার মতো জ্ঞান-বুদ্ধি আমাদের নেই। তাই তর্কে তোমার সঙ্গে পারব না। তাই এ ব্যাপারে আর কথা বলব না, তুমি যা ভালো বুঝবে করবে। এবার একটা কথা বলব, আশা করি, রাখবে।

বলুন, রাখার মতো হলে নিশ্চয় রাখব।

আমরা তোমার হাতে স্বপ্নাকে দিতে চায়।

কে দিতে চায়।

ফায়সাল অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিল, লুৎফা বেগম এ কথা বলবেন। তাই কি বলবে ভেবে রেখেছিল। বলল, বিয়ের ব্যাপারে আমার নিজস্ব কোনো মতামত নেই। মা-বাবা যদি একটা কুৎসিত অন্ধ, কানা, খোঁড়া বা বোবা মেয়েকে বৌ করতে চান, তাতেও আমার কোনো আপত্তি নেই।

লুৎফা বেগম বুঝতে পারলেন, ম্যানেজার স্বপ্নাকে বিয়ে করতে রাজি নয়, মেয়ের মুখের দিকে এক পলক তাকিয়ে নিয়ে চুপ করে রইলেন।

ফায়জুন্নেসা ফায়সালের কথা শুনে মনঃক্ষুন্ন হলেন। মাকে চুপ করে থাকতে দেখে ফায়সালের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি এত জ্ঞানী গুণী হয়ে মিথ্যে কথা বলবেন ভাবতেই পারছি না। আমরা জানি আপনার মা বাবা নেই, শুধু একজন ফুপু আছেন।

ফায়সাল মৃদু হেসে বলল, আল্লাহর কোনো মুমেন বান্দা মিথ্যা বলতে পারে না। যারা গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করে, তাদের আসল পরিচয় বাইরের লোকের কাছে গোপন রাখতে হয়। তাই চাকরির সময় যে বায়োডাটা দিয়েছি, সেটা আসল নয়।

লুৎফা বেগম মেয়েকে ধমকের স্বরে বললেন, আমি যখন কথা বলছি তখন তোমার চুপ করে থাকা উচিত। তারপর ফায়সালকে বললেন, যাওয়ার আগে ঠিকানা দিয়ে যেও, আমরা তোমার মা বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

মাফ করবেন, ঠিকানা দেয়া সম্ভব নয়। কারণটা তো একটু আগে বললাম। এবার লুৎফা বেগমও মনঃক্ষুন্ন হলেন। তা প্রকাশ না করে বললেন, কবে এখান থেকে যাবে?

এখনও সিদ্ধান্ত নিই নি, তবে দু’চার দিনের মধ্যে যেতেই হবে।

ঠিক আছে, এবার এস।

.

কুলসুম যখন খাওয়ার জন্য ডাকতে আসে তখন স্বপ্না দরজা লাগিয়ে চিন্তা করছিল, আজ মা নিশ্চয় নানিকে দিয়ে প্রস্তাব দেওয়াবে। তাই আধা ঘন্টা পর বেরিয়ে এসে ড্রইংরুমের জানালার পর্দা অল্প একটু ফাঁক করে এতক্ষণ তাদের আলাপ শুনছিল। নানি এবার এস বলতে নিজের রুমে ফিরে এসে চিন্তা করতে লাগল, ম্যানেজারের স্বপ্নে দেখা সেই মেয়েটা যদি আমি হই, তা হলে নানির প্রস্তাবে রাজি না হয়ে এড়িয়ে গেলেন কেন? মনে হয়, ওনাকে ধূর্ত, শঠ ও ঠক ধার্মিক ভাবতাম জেনে গ্নের মেয়েটির মিথ্যে কাহিনী বানিয়ে শুনিয়েছেন। কিন্তু ওনার মতো ছেলে তো মিথ্যা কাহিনী বানিয়ে বলতে পারেন না। তা ছাড়া ওনার চোখের দৃষ্টিতে যা দেখেছি, তাও মিথ্যা হতে পারে না। তখন তার মাস ছয়েক আগের একটা ঘটনা মনে পড়ল। একদিন ম্যানেজার তাকে দূরের এক জলমহল দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে স্বপ্না বলল, আপনি তো বলেছিলেন, স্বপ্নের সেই মেয়েটি কিছুদিনের মধ্যে আপনার সঙ্গে বাস্তবে অভিসার করবে, কই, আজ দেড় বছর হয়ে গেল একবারও অভিসার করল না?

ফায়সাল মৃদু হেসে বলেছিল, আপনি বুঝতে পারেন নি, সে তো প্রায় প্রতিদিন অভিসারে আসে এবং আজও আমার সঙ্গে অভিসারে বেরিয়েছে।

স্বপ্নাও মৃদু হেসে বলল, যদি তাই হয়, তা হলে তার সঙ্গে শুধু কাজের কথা আলাপ করেন কেন? অভিসারে বেরিয়ে তো প্রেমালাপ ও করে?

তা অবশ্য করে, কিন্তু মেয়েটিও করে না কেন বলতে পারেন?

স্বপ্নে লজ্জা পেত না, বাস্তবে পায় বলে। এবার একটা কথা বলব, রাখতে হবে।

বলুন, রাখার মতো হলে নিশ্চয় রাখব।

আমরা তুমিতে আসতে পারি না?

দুঃখিত তা সম্ভব নয়।

কেন?

কর্মচারী হয়ে মালিককে তুমি বলা কি উচিত?

মালিক তো বলার অনুমতি দিচ্ছে? তা ছাড়া মালিক তো এখন প্রেমিকা?

তবুও সম্ভব নয়। কারণ এটা খুব অশোভনীয়। তা ছাড়া আমি ছোট বড়, এমন কি চাকর-চাকরানিদেরও, আপনি করে বলি।

কারণটা বলবেন?

সবাইকে আমার থেকে বড় ও জ্ঞানী মনে করি।

আর যারা গরিব ও মূর্খ?

তাদেরকেও। কারণ একজন মানুষ শিক্ষিত বা ধনী হলেও গরিব বা মূর্খরা এমন অনেক জিনিস জানেন, যা অনেকেই জানেন না।

বিয়ের পরেও কি আমাকে আপনি করে বলবেন?

নিশ্চয় বলব।

কেউ নিজের স্ত্রীকে আপনি করে বলে?

কেউ না বললেও আমি বলব।

আমার লজ্জা করবে না বুঝি?

প্রথম প্রথম করবে, পরে করবে না।

তা হলে আমিও কি আপনি করে বলব।

সেটাই তো স্বাভাবিক।

কিন্তু আপনি করে বললে দূরত্ব থেকে যায়।

ওটা মনের ভুল। আমার ধারণায় আপনি করে বললে ভক্তি, শ্রদ্ধা যেমন আরো বাড়ে, তেমনি প্রেমিক প্রেমিকার মর্যাদা স্থায়ী হয়। তুমি বা তুই করে বললে, একে অপরকে অপমান করা হয়, একজন অন্য অন্যের কাছে হেয়, মানে ছোট হয়ে যায়।

এরপরও ম্যানেজার নানির প্রস্তাব এড়িয়ে গেলেন কেন চিন্তা করতে করতে এক সময় স্বপ্না ঘুমিয়ে পড়ল।

পরের দিন সকালে কয়েকশ গ্রামবাসি চৌধুরী বাড়ির গেটে এসে শ্লোগান দিতে লাগল, “আমরা ম্যানেজারকে এখান থেকে যেতে দেব না।”

হট্টগোল শুনে স্বপ্না, ফায়জুন্নেসা ও লুৎফা বেগম বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন। দারোয়ানকে আসতে দেখে ফায়জুন্নেসা জিজ্ঞেস করলেন, এত লোকজন এসেছে কেন? তারা কি চায়?

দারোয়ান বলল, ওরা ম্যানেজার সাহেবকে এখান থেকে যেতে দিতে চাচ্ছে।

ফায়জুন্নেসা বললেন, ম্যানেজারকে কথাটা জানাও।

দারোয়ানের মুখে ঘটনা শুনে ফায়সাল গেটের বাইরে এলে লোজন বার বার ঐ একই শ্লোগান দিতে লাগল।

ফায়সাল তাদের চুপ করতে বলার পর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নিরবতা নেমে এল।

ফায়সাল বলল, আমি কেন চলে যাচ্ছি, তা আপনারা গতকাল আই জি. সাহেবের কাছে শুনেছেন। তারপরও এরকম কেন করছেন বুঝতে পারছি না।

লোকজন চিৎকার করে বলল, কারও কথায় আপনাকে কিছুতেই যেতে দেব না। প্রয়োজনে এখানে আমরা আমরণ অনশন করে পড়ে থাকব।

ফায়সাল তাদেরকে অনেক করে বোঝাবার চেষ্টা করল, কিন্তু কোনো কাজ হল না। শেষে বলতে বাধ্য হল, আমি আই. জি সাহেবকে আপনাদের কথা চিঠি দিয়ে জানাব। উত্তর না আসা পর্যন্ত যাব না। এবার আপনারা দয়া করে ফিরে যান।

গ্রামবাসির মধ্যে বসির অল্প শিক্ষিত হলেও খুব বুদ্ধিমান। সে বলল, আই. জি. সাহেবের চাকরি ছেড়ে দিন। আমরা সবাই সামর্থ অনুযায়ী কিছু কিছু জমি আপনাকে দেব, থাকার জন্য ঘর করে দেব, তবু আপনাকে যেতে দেব না।

ফায়সাল বলল, ঠিক আছে, আই. জি. সাহেব চিঠির উত্তরে কি জানান আগে দেখি, তারপর কি করব না করর জানাব।এবার আপনাদেরকে চলে যাওয়ার অনুরোধ করছি।

ফায়সালের কথা শুনে আশস্ত হয়ে লোকজন চলে গেল।

ফায়সাল চলে যাবে তাই অফিসে এসে মৃণালবাবু ও স্বপ্নাকে সবকিছু বুঝিয়ে দেয়ার জন্য ডেকে পাঠাল।

মৃণালবাবু এসে বললেন, ছোট মালেকিন তো আজ উপর থেকে নামেন নি।

ফায়সাল হাশেম মিয়াকে বললেন, ছোট মালেকিনকে আসতে বলুন।

হাশেম ফিরে এসে বলল, ওনার শরীর খারাপ, আসতে পারবেন না।

ফায়সাল মৃণালবাবুকে বললেন, আপনাকেসহ ছোট মালেকিনকে সবকিছু বুঝিয়ে দিতে চাই, কিন্তু উনি আসতে পারছেন না। কাল সবকিছু বুঝিয়ে দেব।

পরপর তিন দিন একই কারণে স্বপ্না অফিসে এল না দেখে ফায়সাল চিন্তিত হল। ভাবল, কি হয়েছে জানা উচিত। তাই চাকরানি আকলিমা রাতের খাবার নিয়ে এলে জিজ্ঞেস করল, ছোট মালেকিনের কি হয়েছে?

আকলিমা বলল, কি হয়েছে জানি না, তবে আজ তিন দিন পানি ছাড়া কিছুই খান নি, রুম থেকে বারও হন নি, সব সময় মন ভার করে শুয়ে থাকেন।

ডাক্তার দেখান হয়েছে?

তা বলতে পারব না।

১৯৭

ফায়সালের ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। আর কিছু না বলে খেতে শুরু করল।

খাওয়া শেষ হতে আকলিমা বাসন পেয়ালা নিয়ে যেতে উদ্যত হতে বলল, নানি আম্মাকে বলবেন, আমি ওনার সঙ্গে দেখা করতে চাই।

একটু পরে আকলিমা ফিরে এসে বলল, আসুন। দোতলায় এসে আকলিমা তাকে ড্রইংরুমে বসতে বলে চলে গেল।

কিছুক্ষণ পর লুৎফা বেগমকে ঢুকতে দেখে ফায়সাল দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন?

লুৎফা বেগম সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, বয়স হয়েছে ভাই, শরীরে নানা রকম উদ্রব শুরু হয়েছে। তা কবে যাবে জানাতে এসেছ বুঝি? গ্রামের লোকজন সে কথা জানে?

কবে যাব এখনও ঠিক করি নি। আপনার নাতনির কি হয়েছে জানতে এসেছি। কি হয়েছে ওনার?

লুৎফা বেগম নাতনি খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে জেনে তার সঙ্গে আলাপ করে বুঝতে পেরেছেন, ম্যানেজার তাকে বিয়ে করতে রাজি হয় নি বলে তার এই অবস্থা। ফায়সালের কথা শুনে বললেন, কি হয়েছে আমরা জিজ্ঞেস করেও জানতে পারি নি। তুমি পার কি না দেখ। তারপর তাকে নিয়ে নাতনির রুমের দরজার কাছে এসে বললেন, একটু দাঁড়াও ঘুমিয়েছে না কি দেখি। তারপর পর্দা ঠেলে ঢুকে তাকে চোখের পানি ফেলে মোনাজাত করতে দেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন।

স্বপ্নার দৃঢ় ধারণা, ম্যানেজার তাকে ভীষণ ভালবাসলেও পূর্বপুরুষ জয়নুদ্দিনের কারণে বিয়ে করবেন না। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, চিরকুমারী থাকবে আর ম্যানেজার চলে যাওয়া পর্যন্ত তার সঙ্গে দেখা করবে না। এই ক’দিন শুধু কেঁদেছে আর আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেহে, “আল্লাহ তুমি সর্বজ্ঞ। আমার অন্তরের কথা তুমি জান। আমি ওকে ছাড়া বাঁচব কি না তাও জান। ওর দ্বারা তুমি আমাকে হেদায়েত দিয়েছ। তোমার উপর ভরসা করে সবর করে আছি। তুমিই এর ফায়সালা করে দাও, দোষ-ত্রুটি ক্ষমা করে আমার মনের বাসনা পূরণ করে দাও। তোমার পেয়ারা হাবিবের উপর শত কোটি দরুদ ও সালাম পেশ করছি। ওনার অসিলায় তোমার এই নগন্য গোনাহগার বান্দির দোয়া কবুল কর আমিন।”

আজ এশার নামায পড়ে দোয়া শেষ করে যায়নামায গুটিয়ে রেখেছে, এমন সময় লুৎফা বেগম ম্যানেজারের আসার কথা বলে নাতনিকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে স্থাপদে বেরিয়ে এসে ফায়সালকে বললেন, ও জেগে আছে তুমি যাও, আমি ড্রইংরুমে আছি। কথা শেষ করে দ্রুত চলে গেলেন।

নানির কথা শুনে স্বপ্না চমকে উঠল। সে ভাবতেই পারে নি ম্যানেজার তাকে দেখতে আসবেন। ভাবল, তা হলে কি আল্লাহ এই নাদান বান্দির দোয়া কবুল করেছেন? নানিকে কিছু বলতে যাচ্ছিল; ওনাকে চলে যেতে দেখে সেদিকে তাকিয়ে রইল।

ফায়সাল ঢুকে সালাম দিতে তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।

এক সময় তার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল।

ফায়সাল তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে এগিয়ে এসে বলল, সালামের উত্তর দিলেন না যে? গুনাহ হবে তো?

স্বপ্না সালামের উত্তর দিয়ে দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠে বলল, কেন এসেছেন?

ফায়সাল বলল, স্বপ্নে দেখা সেই মেয়েটি আজ তিন দিন আমার সঙ্গে অভিসারে বের হয় নি, তাই আমিই এসেছি তার সঙ্গে অভিসার করতে।

কান্নাজড়িত স্বরে স্বপ্না বলল, আপনি এত নিষ্ঠুর? এরকম কৌতুক করে আমার জ্বলন্ত হৃদয়ে ঘি ঢালতে পারলেন?

আমি নিষ্ঠুরও নই আর কৌতুকও করি নি। যা সত্য, তাই বলেছি।

তা হলে বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখান করলেন কেন?

প্রত্যাখান তো করি নি, এড়িয়ে গেছি।

এড়িয়ে যাওয়া মানেই প্রত্যাখান করা।

না, আপনি ঠিক বলেন নি, দুটোর মধ্যে পার্থক্য আছে।

পার্থক্য থাক বা না থাক, এড়িয়ে গেলেন কেন বলুন।

আমি যেমন আপনাকে মন প্রাণ উজাড় করে ভালবেসেছি এবং আল্লাহর কাছে সব সময় দোয়া করি, তিনি যেন আমাদের জোড়া কবুল করেন। তেমন আপনিও আমাকে মন প্রাণ উজাড় করে ভালবেসেছেন এবং আল্লাহর কাছে ঐ একই দোয়া করেন। তবু কেন আমার প্রতি আপনার সন্দেহ হল বুঝতে পারছি না। আপনার মা ও নানির কাছে যা বলেছি, তা যেমন সত্য, এখন যা আপনাকে বললাম, তা তেমনি সত্য। আপনার কথা মা বাবাকে অনেক আগেই জানিয়েছি। আরও জানিয়েছি, খোকসাবাড়ির কাজ শেষ হওয়ার পর ওনাদেরকে নিয়ে আসার জন্য লোক পাঠাব। ওনারা এসে যেন আপনাকে পুত্রবধূ করার ব্যবস্থা করেন। গত পরশু মা বাবাকে নিয়ে আসার জন্য লোক পাঠিয়েছি। আল্লাহ রাজি থাকলে কাল এসে যাবেন।

স্বপ্না নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না, কয়েক সেকেন্ড স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে থেকে বলল, আপনি মানুষ, না ফেরেশতা বলে তাকে জড়িয়ে ধরতে গেল।

ফায়সাল দ্রুত তার দুটো হাত ধরে ফেলে বলল, একি করতে যাচ্ছিলেন? জানেন না, বিয়ের আগে এটা হারাম? তারপর হাত ছেড়ে দিল।

ততক্ষণে আনন্দে স্বপ্নার চোখ থেকে পানি পড়তে শুরু করেছে। ভিজে গলায় বলল, আমি সেই প্রথম থেকে ভুল বুঝে আপনার সঙ্গে অনেক দুর্ব্যবহার করেছি, ধর্মীয় জ্ঞানের অভাবে আজ আবার হারাম কাজ করতে যাচ্ছিলাম। আমার সমস্ত আপরাধ ক্ষমা করে দিন বলে তার পায়ে হাত রাখল।

ফায়সাল তাকে দাঁড় করিয়ে পকেট থেকে রুমাল বার করে তার চোখ মুখ মোছার সময় বলল, মানুষ মাত্রই জেনে না জেনে অনেক ছোট বড় অন্যায় করে ফেলে। সে জন্য প্রত্যেকের তওবা করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হয়। আপনার সব রকমের অন্যায় আগে যেমন ক্ষমা করেছি, ভবিষ্যতেও তেমনি করব। এবার বলুন, এত বড়, সুখবর দেয়ার জন্য কি বখশীস দেবেন?

ফায়সাল স্বপ্নার রুমে ঢোকার পর লুৎফা বেগম মেয়ে ফায়জুন্নেসাকে ম্যানেজারের স্বপ্নাকে দেখতে আসার কথা বলে ডেকে নিয়ে এসে পর্দার আড়াল থেকে তাদের কথোপকথন শুনছিলেন। ফায়সাল বখশীস দেয়ার কথা বলতে লুৎফা বেগম রুমে ঢুকে বললেন, ওর তো নিজের কিছু নেই, যা ছিল সবটুকু অনেক আগেই তোমার মধ্যে বিলীন করে দিয়েছে? বখশীস আমরা দেব বলে মেয়েকে ভিতরে আসতে বললেন।

ফায়জুন্নেসা ভিতরে আসার পর তাকে বললেন, তোর হবু জামাই স্বপ্নার কাছে বখশীস চাচ্ছে। ওর কি আছে দেবে? তুই কি দিবি দে।

থেকে ম্যানেজারের কথা শুনে ফায়জুন্নেসা এত আনন্দিত হয়েছেন যে, তখন থেকে চোখের পানি ফেলছিলেন। মা ডাকতে চোখ মুছে রুমে এসেছেন। এখন বখশীস দেয়ার কথা শুনে আবার চোখ থেকে পানি বেরিয়ে পড়ল। সেই অবস্থায় বললেন, আমাদের যা কিছু আছে সব পূর্বপুরুষদের অবৈধ টাকায়। তোমার মতো পবিত্র ছেলেকে ঐ অবৈধ থেকে কিছু দেয়া ঠিক হবে না। তাই শুধু আল্লাহর কাছে দোয়া করছি, তিনি যেন তোমাদের দাম্পত্যজীবন সুখের ও শান্তির করেন এবং পরকালের জীবনে বেহেশত নসীব করেন। তারপর বললেন, আমি আল্লাহর এক নিকৃষ্ট বান্দি। জানি না, আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করবেন কি না। তারপর সেখান থেকে চোখ মুছতে মুছতে চলে। যেতে উদ্যত হলে ফায়সাল বলল, দাঁড়ান মা, যাবেন না।

ফায়সালের মা ডাক শুনে ফায়জুন্নেসা চমকে উঠে থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, তোমার মতো ছেলের মা হওয়ার যোগ্যতা আমার নেই।

ফায়সাল বলল, মায়ের যোগ্যতার বিচার করার অধিকার কোনো সন্তানের নেই। তারপর এগিয়ে এসে কদমবুসি করে বলল, সন্তানের কাছে মায়ের দোয়া হল, শ্রেষ্ঠ উপহার, সমস্ত পৃথিবীর রাজত্বের চেয়ে মূল্যবান এবং ইহকাল ও পরকালের সুখ শান্তি। তারপর লুৎফা বেগমকে কদমবুসি করে বলল, ঠিক বলি নি নানি মা?

লুৎফা বেগমও আনন্দে এতক্ষণ ধৈর্য ধরতে পারলেও এখন আর পারলেন, চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললেন, তোমার মতো আল্লাহর প্রিয় বান্দা কখনও বেঠিক কিছু বলতে পারে না।

ফায়সাল কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই ফায়জুন্নেসা বললেন, কিন্তু আমি আল্লাহর একজন নিকৃষ্ট বান্দি, আমার দোয়া কি আল্লাহ কবুল করবেন?

ফায়সাল বলল, যাই কিছু হন না কেন, আপনি মা। আর সন্তানের জন্য মায়ের দোয়া কবুল হবেই। আপনি জানেন কি না জানি না, বান্দা যত বড় গুনাহ করুক না কেন, অনুতপ্ত হয়ে চোখের পানি ফেলে তওবা করে ক্ষমা চাইলে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। কারণ অনুতপ্ত বান্দার চোখের পানি আল্লাহর কাছে খুব প্রিয়।

লুৎফা বেগম বললেন, হ্যাঁ ভাই, তুমি ঠিক বলেছ, এটা হাদিসের কথা। কথা শেষ করে চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলেন।

ফায়জুন্নেসাও চোখ মুছতে মুছতে মাকে অনুস্মরণ করলেন।

এবার আমার পালা বলে ফায়সাল স্বপ্নার দিকে তাকিয়ে তার চোখ থেকে পানি পড়ছে দেখে বলল, নানিমা ও মা কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলেন, আপনিও কাঁদছেন, আমি আর বাকি থাকি কেন বলে কান্নার অভিনয় করল।

স্বপ্না কান্নামুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, থাক, আর অভিনয় করতে হবে না, দু’বছর অভিনয় করে সবাইকে অনেক কাঁদিয়েছেন।

ফায়সাল বলল, তাই তো শেষ অভিনয় করে আপনাকে হাসালাম।

স্বপ্না চোখ মুখ মুছতে মুছতে বলল, সত্যি, একজন মানুষের মধ্যে যে এত গুণ থাকতে পারে, আপনাকে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না।

ফায়সাল বলল, স্বপ্নে দেখা সেই মেয়েটি, যে নাকি অপূর্ব সুন্দরী ও ফরেন থেকে উচ্চডিগ্রিধারী হয়েও আমার মতো একজন সাধারণ ছেলের প্রেমে পড়বে ভাবতেই পারি নি।

এই কথাই দু’জনেই হেসে উঠল।

আগের পর্ব :
১. ট্রেন যখন নীলফামারী স্টেশনে পৌঁছাল
২. পৈত্রিক সূত্রে বিশাল সম্পত্তি
৩. কাগজে বিজ্ঞপ্তি দেখে
৪. হারেস মাঝে মাঝে ঢাকা গিয়ে
৫. ফায়জুন্নেসা ফায়সালকে ডেকে পাঠিয়ে

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত