স্বপ্নে দেখা সেই মেয়েটি: ৫. ফায়জুন্নেসা ফায়সালকে ডেকে পাঠিয়ে

স্বপ্নে দেখা সেই মেয়েটি: ৫. ফায়জুন্নেসা ফায়সালকে ডেকে পাঠিয়ে

৫. ফায়জুন্নেসা ফায়সালকে ডেকে পাঠিয়ে

একদিন ফায়জুন্নেসা ফায়সালকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, আপনি তো জানেন স্বপ্লাই চৌধুরী স্টেটের একমাত্র উত্তরাধিকারী। ও যাতে চৌধুরী বংশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারে সেভাবেই ওকে সবকিছু বুঝিয়ে দেবেন। উচ্চশিক্ষা নিলেও স্টেট চালাবার মতো জ্ঞান ওর নেই। আর বয়সই বা কত হয়েছে। তা ছাড়া চৌধুরী বংশের রক্ত ওর শরীরে। ন্যায় অন্যায় কিছু করে ফেলাই স্বাভাবিক। সেজন্যে মনে কিছু না করে ওর ভুল-ত্রুটি দেখিয়ে দেবেন। আপনি খুব বুদ্ধিমান আশা করি……..

ওনাকে হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে ফায়সাল বলল, আর কিছু বলার প্রয়োজন নেই। কথাগুলো আমিই আপনাকে বলব ভেবেছিলাম, কাজের চাপে সময় করতে পারি নি। আজই বলতাম, তার আগে আপনি বলে ফেললেন। যাই হোক, আপনি নিশ্চিত থাকুন, এ ব্যাপারে যা কিছু করার ইনশাআল্লাহ আমি করব। তারপর মসজিদ মাদরাসা কোথায় প্রতিষ্ঠা হবে সে ব্যাপারে আলাপ আলোচনা করে বিদায় নিয়ে ফায়সাল চলে এল।

ম্যানেজারের পাশের রুমে ইনসান চৌধুরী স্টেটের হিসাব পত্র চেক করতেন। উনি মারা যাওয়ার পর ওনার জামাই হারেস সেই কাজ করতেন। হারেস মারা যাওয়ার পর ফায়জুন্নেসা এতদিন করে এসেছেন। আজ থেকে স্বপ্না মায়ের কাজ করবে।

স্বপ্না এই রুমে আগে আসে নি। আজ এসে রুমের পরিবেশ দেখে খুশি হল। দরজা জানালায় ভারি পর্দা, মেঝেয় কার্পেট বিছান, গদীওয়ালা মুভিং চেয়ার, সেক্রেটারিয়েট টেবিলটা খুব সুন্দর। দুটো সেগুন কাঠের আলমারী। টেবিলের উপর একগ্লাস পানি ঢাকা রয়েছে দেখে পিপাসা অনুত্ব করে পানি খেয়ে গ্লাস রেখেছে, এমন সময় দরজার বাইরে থেকে ম্যানেজারের গলা শুনতে পেল, আসতে পারি?

স্বপ্না বলল, আসুন।

ফায়সাল অনেকগুলো ফাইল নিয়ে ঢুকে স্বপ্নার দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ফেরাতে পারল না। তার মনে হল, স্বপ্নে তাকে যে পোশাকে দেখে, আজ সেই পোশাক পরেছে। তখন তার একরাতের স্বপ্নের কথা মনে পড়ল, স্বপ্না তাকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, আমি এলেই তুমি আমার দিকে হা করে তাকিয়ে থাক কেন?

ফায়সাল বলেছিল, আল্লাহ তোমাকে নিখুঁত সুন্দরী করে সৃষ্টি করেছেন, তার উপর এই পোশাকে তোমাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী বলে মনে হয়। তাই তোমাকে দেখলেই আমি বাস্তব জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।

এখন সেই পোশাকে স্বপ্নাকে দেখে ফায়সাল বাস্তব জ্ঞান হারিয়ে অপলক নয়নে তার দিকে তাকিয়ে রইল।

আগে হলে স্বপ্না খুব রেগে যেত; এখন রাগল না বরং মৃদু হেসে মোলায়েম স্বরে বলল, দাঁড়িয়ে আছেন কেন, বসুন।

ফায়সাল সম্বিত ফিরে পেয়ে ফাইলগুলো টেবিলের একপাশে রেখে বলল, আপনাকে সবকিছু বুঝিয়ে দিতে আপনার মা বলেছেন।

স্বপ্না বলল, সে কথা আমি জানি।

ফায়সাল বসে একটা ফাইল খুলে খোকসাবাড়ির ম্যাপ বের করে চৌধুরী স্টেটের কোথায় কি আছে দেখাতে লাগল। জমি-জায়গা, আগান-বাগান, পুকুর ডোবা ও জলমহল দেখাতে প্রায় দু’ঘণ্টা সময় লাগল। ম্যাপটা ফাইলে রেখে ফায়সাল বলল, ঐ সমস্ত জায়গায় আপনাকে সরজমিনে যেতে হবে। লোকজনদের সঙ্গে পরিচিত হতে হবে, তাদের সুবিধে অসুবিধের কথা জানতে হবে এবং অসুবিধা দূর করার ব্যবস্থা করতে হবে। তারপর অন্য একটা ফাইলের দিকে হাত বাড়াল।

স্বপ্না বলল, টায়ার্ড ফিল করছি, আজ আর নয়।

তা হলে থাক, কাল শুরু করা যাবে বলে ফায়সাল উঠে দাঁড়াল।

স্বপ্না বলল, বসুন একটা কথা জানতে খুব ইচ্ছা করছে।

ফায়সাল বসে বলল, বলুন।

সেদিন রাস্তায় যেভাবে আমার দিকে তাকিয়েছিলেন, আজও রুমে ঢুকে সেভাবে তাকিয়েছিলেন। সেদিন অভদ্র ভেবে রেগে গিয়ে আপনার গালে চড় মেরেছিলাম, কিন্তু আজ আপনার চোখের দৃষ্টি আমাকে রাগাতে পারে নি। বরং অন্য কিছু মনে হয়েছে। দুদিন দুরকম প্রতিক্রিয়া হল কেন বলতে পারেন?

পারি, তবে শোনার পর সেদিনের মতো আমার গালে চড় মারতে আপনার ইচ্ছা করবে।

সেদিনের ঘটনায় খুব অনুতপ্ত, প্লীজ ক্ষমা করে দিন।

না-না, ক্ষমা চাইছেন কেন? সে দিন উচিত কাজই করেছিলেন। আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে সেদিনের মতো অন্যায় কিছু হয়ে যাবে। তাই উত্তরটা বলতে চাচ্ছি না।

স্বপ্না মৃদু হেসে বলল, কথা দিচ্ছি, ওরকম ঘটনা আর কখনও ঘটবে না।

ফায়সাল বলল, অনেক দিন থেকে একটা মেয়ে স্বপ্নে আমার সঙ্গে অভিসার করে। সেদিন তাকে বাস্তবে দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। মনে হয়েছিল, রাস্তায় দাঁড়িয়ে স্বপ্না দেখছি না তো? কথা শেষ করে স্বপ্নার মুখের দিকে তাকাল কোনো রিএ্যাকসন হয় কিনা দেখার জন্য।

স্বপ্না স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে হাসি মুখে জিজ্ঞেস করল, আর আমার আজ সেদিনের ব্যতিক্রম হল কেন বলবেন না?

ফায়সালও স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে হাসিমুখে বলল, কথাটা সত্য বলেন নি। সেদিনের মতো আজও রেগে গিয়ে চড় মারতে ইচ্ছা হয়েছিল আপনার। কিন্তু তা কাজে পরিণত না করে রাগ চেপে রেখে মেকি প্রেমিকার ভূমিকায় অভিনয় করছেন আমার মুখোশ খোলার প্রমাণ জোগাড় করার জন্য।

ফায়সালের কথা শুনে স্বপ্না এত অবাক হল যে, অনেকক্ষণ কথা বলতে পারল না।

ফায়সাল বলল, আর কিছু বলবেন?

আপনার ধারণা ভুল। কারণ কারো মনের কথা অন্যে জানতে পারে না।

তা ঠিক, তবে আমি সত্য কথাই বলেছি। প্রমাণ করুন।

আপনার চোখ মুখ আমাকে জানিয়েছে। কারণ মানুষের মনের কথা চোখ মুখে ফুটে উঠে। আল্লাহ যাকে চোখ মুখের ভাষা বোঝার ক্ষমতা দিয়েছেন, তারা বুঝতে পারেন।

স্বপ্না বলল আচ্ছা, যে মেয়েটি স্বপ্নে অনেক দিন থেকে আপনার সঙ্গে অভিসার করছে, সেই মেয়ে যে আমি তার প্রমাণ কি? আমার মতো দেখতে অন্য কোনো মেয়েও তো হতে পারে?

হ্যাঁ, তা পারে। তবে আমি হাফ্রেড পার্সেন্ট সিওর সে মেয়ে আপনি।

প্রমাণ করতে পারবেন?

ইনশাআল্লাহ পারব।

করুণ তো দেখি?

ফায়সাল চোখ বন্ধ করে বলল, হোমে থাকার সময় আপনার বাম হাতের বাজুতে ফোড়া হয়েছিল। ডাক্তার অপারেশন করেছিলেন। অপারেশনের দাগ এখনও আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সন্ত্রাসীদের রিভলবারের গুলি আপনার ডান পায়ের গোছে বিদ্ধ হয়েছিল। ডাক্তার অপারেশন করে গুলি বার করেছিলেন। সেই দাগও এখনও আছে।

তার কথা শুনে স্বপ্না হতবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কারণ দু’টো ঘটনাই সত্য এবং আজও হাতে পায়ে অপারেশনের দাগ আছে।

ফায়সাল ঘটনা দু’টো বলার পরও চোখ খুলে নি। অনেকক্ষণ স্বপ্নাকে চুপ করে থাকতে দেখে চোখ খুলে দেখল, সে তার দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মৃদু হেসে বলল, কি এতেই হবে, না আরো প্রমাণ দিতে হবে?

তার কথা স্বপ্নার কানে গেল না। সে তখন ভাবছে, এসব কথা ম্যানেজার কি করে জানলেন?

ফায়সাল তার অবস্থা বুঝতে পেরে পেপার ওয়েট টেবিলে ঠুকে শব্দ করে সরিয়ে রাখল।

স্বপ্না চমকে উঠে বাস্তবে ফিরে এসে বলল, এসব কথা আপনি কেমন করে জানলেন?

স্বপ্নে যে মেয়েটি অভিসার করতে আসত, সেই বলেছে।

আপনি বারবার অভিসারের কথা বলছেন, তা হলে কি স্বপ্নের সেই মেয়েটিকে ভালবাসেন?

ভালবাসি মানে? এত ভালবাসি যা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না।

এখন সে আর স্বপ্নে অভিসার করতে আসে না?

এখানে চাকরি করতে আসার পর মাত্র একবার এসেছিল। সে সময় বলেছিল, এবার আর স্বপ্নে নয়, বাস্তবে অভিসার করবে।

আপনি কি মনে করনে স্বপ্না আর বাস্তব এক?

শুধু আমি কেন, কেউ তা মনে করে না।

তা হলে বললেন কেন, স্বপ্নের সেই মেয়েটি এবার বাস্তবে আপনার সঙ্গে অভিসার করবে?

কথাটা আমি বলি নি, বলেছিল স্বপ্নের মেয়েটি।

আপনার স্বপ্নের মেয়েটি যদি আমি হয়েও থাকি, তা হলে আপনার সঙ্গে অভিসার করছি না কেন?

এখন না করলেও কিছুদিনের মধ্যে করবেন।

আপনি ভীষণ চালাক ও বুদ্ধিমান হয়েও রাম ছাগলের মতো কথা বলতে পারলেন?

ফায়সাল হেসে ফেলে বলল, আমি তো জানি শুধু ছাগল নয়, কোনো পশু পাখি ও জীব-জন্তু মানুষের মতো কথা বলতে পারে না। রাম ছাগল কথা বলতে পারে জানা ছিল না।

স্বপ্নাও হেসে ফেলে বলল, বড় জাতের ছাগলকে রাম ছাগল বলে। লোকে বলে, ছাগলে কি না খায় আর পাগলে কি না বলে। তাই আপনার কথা শুনে কথাটা বলেছি।

রাম ছাগল না বলে পাগল বলা উচিত ছিল আপনার। তবে আমি যে পাগল নই, তা খুব ভালোভাবেই জানেন। তাই পাগল বললেও ভুল করতেন। তারপর ঘড়ি দেখে বলল, জোহরের নামাযের সময় হয়ে গেছে, এবার আসি বলে স্বপ্না কিছু বলার আগে ফায়সাল সেখান থেকে চলে গেল।

স্বপ্না প্রেমের অভিনয় করে ফায়সালের আসল স্বরূপ উদঘাটন করার পরিকল্পনা করেছিল; কিন্তু আজ তার সঙ্গে আলাপ করার পর বুঝতে পারল, এ পথে সফলতা লাভ করতে পারবে না।

প্রতিদিন তার কাছে ফাইলপত্র ও কাজ-কর্ম বুঝে নেয়া ছাড়া অন্য কোনো আলাপ যেমন স্বপ্না করে না, তেমনি ফায়সালও করে না। দিনে স্টেটের কাজ করে। অবসর সময় মা ও নানির সঙ্গে কাটালেও রাতে ফায়সালের কথা মনে পড়ে। অনেক রাত পর্যন্ত ঘুমাতে পারে না। তার স্বপ্নে দেখা মেয়েটির অভিসারের ব্যাপারটা তাকে খুব চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। অনেক সময় তার মনে হয়, ফায়সাল তাকে ক্যাপচার করার জন্য ঘটনাটা বানিয়ে বলেছে। পরক্ষণে মনে পড়ে তা হলে তার দু’দুটো অপারেশানের কথা জানল কি করে?

স্টেটের সবকিছু স্বপ্নাকে বুঝিয়ে দেয়ার পর ফায়সাল অফিসে থাকে না বললেই চলে। মসজিদ-মাদরাসা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ব্যস্ত থাকে। অবশ্য স্বপ্নাকে নিয়ে মাঝে মাঝে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে সরজমিনে যায়। সে সময় স্বপ্নার পরিচয় গ্রামবাসীদের জানায়।

স্বপ্না তাদের ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে, সুবিধে অসুবিধে জেনে তা দূর করার আশ্বাস দেয়।

একদিন সারজমিন থেকে ফেরার সময় চৌধুরী বাড়ির গেটে তিন চারজন অচেনা লোককে দারোয়ানের সঙ্গে কথা কাটাকাটি করতে দেখে ফায়সাল দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে?

দারোয়ান বলল, ওরা আজিজের লোক। ভিতরে গিয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাচ্ছে। আপনি বাইরে গেছেন বলা সত্ত্বেও ভেতরে যেতে চাচ্ছে।

ফায়সাল লোকগুলোকে নিয়ে একটু দূরে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, আজিজ মিয়া। কার কাছে আপনাদেরকে পাঠিয়েছেন?

তাদের একজন বলল, চৌধুরী স্টেটের ম্যানেজারের কাছে।

আমিই ম্যানেজার। বলুন, কেন পাঠিয়েছেন।

আপনি এই গ্রামে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করবেন শুনে সে ব্যাপারে উনি আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চান। তাই আমাদেরকে পাঠিয়েছেন আপনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

ফায়সাল আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, উনি কেমন আছেন?

ভালো না। মাস খানেক আগে ওনার একমাত্র ছেলে সাপের কামড়ে মারা গেছেন। তারপর থেকে ওনার অবস্থা খারাপ। দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছেন, কারো সঙ্গে তেমন কথাবার্তা বলেন না। আপনাকে আমাদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য বিশেষ করে বলেছেন।

ফায়সাল বলল, মাগরিবের নামাযের সময় হয়ে এল। আজ আর যাব না। আপনারা ওনাকে আমার সালাম জানিয়ে বলবেন, কাল সকাল নটার সময় আসব। তারপর লোকগুলোকে বিদায় করে ফিরে এসে স্বপ্নাকে নিয়ে গেটের ভিতরে ঢুকল।

স্বপ্না জিজ্ঞেস করল, আজিজের লোকগুলো কেন এসেছিল?

ফায়সাল বলল, আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

আপনি কি বললেন?

বললাম, কাল সকালে যাব।

যাওয়াটা কি উচিত হবে?

নিশ্চয় উচিত হবে।

ওরা আমাদের শত্রু জেনেও যাবেন?

হ্যাঁ, যাব।

যদি আপনার ক্ষতি করে?

করলে করবে, তাতে আপনার কি? আপনার তো বরং খুশি হওয়ার কথা।

এমন কথা বলতে পারলেন?

কেন পারব না? আপনার কাছে আমি একজন শঠ ও ভণ্ড। ওরকম লোক খুন হলে সবাই খুশি হয়।

এই কয়েক মাস প্লা ফায়সালের সঙ্গে মেলামেশা করে তাকে যত জানছে তত যেমন মুগ্ধ হচ্ছে তেমনি তাকে ভালবাসতে শুরু করেছে। তাই শক্ত আজিজের সঙ্গে দেখা করতে যাবে শুনে শঙ্কিত হয়ে একের পর এক প্রশ্ন করেছে। ফায়সালের শেষের কথা শুনে বলল, কি আপনি তো এখানকার মানুষের কাছে মহং।

ফায়সাল বলল, মহৎ না শঠ তা আল্লাহ ভালো জানেন। এখন আর কোনো কথা নয়, নামাযের সময় হয়ে গেছে।

.

আগে লুৎফা বেগম নিজের রুমে খেতেন। স্বপ্নার জিদে মেয়ে ও নাতনির সঙ্গে খেতে হচ্ছে। আজ রাতের খাওয়ার সময় স্বপ্না বলল, আজিজ তিন চারজন লোক পাঠিয়েছিল ম্যানেজারকে নিয়ে যেতে। ম্যানেজার তাদেরকে বলেছেন, কাল সকালে যাবেন।

ফায়জুন্নেসা বললেন, তুই জানলি কি করে?

তখন আমি ওনার সঙ্গে ছিলাম।

তুই ম্যানেজারকে কিছু বলেছিস না কি?

বলেছি, আজিজ আমাদের শত্রু জেনেও যাওয়ার কথা বললেন কেন? যদি আপনার ক্ষতি করে?

শুনে ম্যানেজার কি বললেন?

বললেন, “করে করবে, তবু আমি যাব।”

আর কিছু না বলে ফায়জুন্নেসা খেতে শুরু করলেন।

স্বপ্না কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে বলল, ম্যানেজারের যাওয়াটা কি ঠিক হবে? তোমাদের নিষেধ করা উচিত।

তুই করিস নি?

না।

করলেও লাভ হত না। উনি যখন যাবেন বলেছেন তখন যাবেনই।

তোমাদের কথাও শুনবেন না?

না।

স্বপ্না রেগে উঠে বলল, একজন কর্মচারী হয়ে মালিকদের কথা শুনবে না, এ কেমন কথা?

এবার লুৎফা বেগম বললেন, না শুনবেন না। কারণ আমরা আমাদের ভালো মন্দ যা বুঝি, তারচেয়ে উনি অনেক বেশি বুঝেন। তোকে তো বলেছি, আজিজ এখন আর আমাদের সঙ্গে শত্রুতা করে না।

স্বপ্না বলল, হঠাৎ ওনার সুমতি হল কেন?

তা বলতে পারব না। তবে মনে হয় ম্যানেজারের কারণেই হয়েছে।

আপনার এরকম মনে হল কেন?

প্রতিবছর জলমহলের মাছ ধরার সময় আজিজের লোকজন হামলা করে। এ বছর মাছ ধরার আগের দিন ম্যানেজারকে সে কথা জানাতে বললেন, আজিজ আর আপনাদের সঙ্গে শত্রুতা করবে না। তার কথার প্রমাণ পেয়ে মনে হয়েছে। ম্যানেজারকে আজিজ ডেকে পাঠিয়েছে জেনে মনে হচ্ছে, কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে আলাপ করবে।

তারপর আর কেউ কোনো কথা না বলে খাওয়া শেষ হতে লুৎফা বেগম রুমে চলে গেলেন।

ফায়জুন্নেসা মেয়েকে নিয়ে নিজের রুমে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ম্যানেজারের ব্যাপারে কোনো কু পেয়েছিস?

স্বপ্না বলল না, পাই নি। খুব আশ্চর্য হই, যে কোনো বিষয়কে টার্গেট করে যখন ওনার শঠতা ধরার চেষ্টা করি তখন উনি সেটার এমন সুন্দর ব্যাখ্যা করেন, যা আমি চিন্তাই করতে পারি নি। আর একটা ব্যাপারেও খুব আশ্চর্য হই, আমি তার সঙ্গে কি আলাপ করব না করব, তা উনি আগের থেকে জানতে পারেন। এটা কি করে সম্ভব মাথায় ঢুকছে না। এ ব্যাপারে তুমি কিছু বলতে পার?

ফায়জুন্নেসা অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, বলব কি? আমার ও তোর নানির মাথায়ও এ ব্যাপারটা ঢোকে নি। তোর নানি তো একদিন ম্যানেজারকে বলেই ফেললেন, তুমি মানুষ না অন্য কিছু? তখন ম্যানেজার তোর নানির পায়ে হাত দিয়ে বললেন, এবার নিশ্চয় বুঝতে পারছেন আমি মানুষ?

স্বপ্না বলল, মাঝে মাঝে আমারও মনে হয় উনি মানুষ নয়, অন্য কিছু।

ফায়জুন্নেসা বললেন, তোকে যে লোক পাঠিয়ে ওনার ঢাকার বাড়ির খেজ খবর নিতে বলেছিলাম, নিয়েছিস?

হ্যাঁ, নিয়েছি। ওনার মা-বাবা বা অন্য কোনো আত্মীয় স্বজন নেই। দূর সম্পর্কের এক ফুপু-ওনাকে মানুষ করেছেন। ফুপুর স্বামী বা ছেলেমেয়ে কেউ নেই। একটা পুরানো তিন কামরা বাড়িতে থাকেন। আর্থিক অবস্থা মোটামুটি স্বচ্ছল। বয়স ষাটের উপর। একটা বয়স্ক কাজের মেয়ে ও একটা কাজের লোক ওনার কাছে থাকে।

তুই প্রেমের অভিনয় করে ওর সবকিছু জানার চেষ্টা করতে পারিস।

সে চেষ্টা করি নি মনে করেছ? বুঝতে পেরে এমন একটা ঘটনা শোনালেন, যা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম।

কি ঘটনা বলতে শুনি।

স্বপ্না ম্যানেজারের স্বপ্নে দেখা মেয়েটার ঘটনা বলে বলল, আমি যে সেই মেয়ে তা প্রমাণ করতে বললাম। ম্যানেজার আমার হাতের ও পায়ের দুটো অপারেশনের কথা ও অপারেশনের দাগ যে এখনও আছে তাও বললেন।

হাতে পায়ে তোর অপারেশন হয়েছিল কেন?

স্বপ্না সে কথা বলে বলল, ম্যানেজার আরও বললেন, স্বপ্নে আমি নাকি ওনাকে অপারেশনের দাগ দু’টো দেখিয়েছি। সব থেকে বেশি আশ্চর্য হলাম যখন বললেন, সেই মেয়েকে তিনি নিজের থেকে বেশি ভালবাসেন। মেয়েটিও তাকে ভীষণ ভালবাসে এবং স্বপ্নে মাঝে মাঝে ওনার সঙ্গে অভিসারে আসেন।

শুনে তুই কিছু বলিস নি?

বলি নি আবার? বললাম, আমি যদি আপনার স্বপ্নে দেখা সেই মেয়ে হই, তা হলে বাস্তবে আমি আপনাকে ভালবাসি না কেন? আর অভিসারই বা করছি না কেন? বললেন, খুব শিগ্রি আপনি আমাকে ভালবাসবেন এবং আমার সঙ্গে অভিসারও করবেন।

তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে কোনো রূপকথার গল্প শুনছি।

আমার কিন্তু তা মনে হয় নি। মনে হয়েছে, স্বপ্নের ঘটনা শুনিয়ে আমাকে সহ আমাদের সবকিছুর মালিক হতে চান।

এখন কি সে ধারণা পাল্টে গেছে?

না, পাল্টায় নি। তবে ওনার চরিত্রের দৃঢ়তা ও মাধুর্য ধারণায় ফাটল ধরাতে শুরু করেছে। যত সহজে ওনার মুখোশ খুলতে পারব ভেবেছিলাম, তা সম্ভব নয়। কোনো দিন পারব কি না তাও বলতে পারছি না। ওনার আসল স্বরূপ জানার জন্য যে পথেই অগ্রসর হই, সেই পথেই উনি প্রাচীর তুলে দেন, তাই ক্রমশ ওনার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছি। আমার সবকিছু গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। কি করব ভেবে পাচ্ছি না।

মেয়ের অসহায়ত্ব বুঝতে পেরে ফায়জুন্নেসা বললেন, এতে চিন্তা করার কি আছে? তোর মা হয়ে আমিই যখন ওনার স্বরূপ জানতে পারি নি, তখন তুইও যে পারবি না তা জানতাম। তাই অনেক ভেবে চিন্তে তোর নানির সঙ্গে আলাপ করে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সিদ্ধান্তটা তুই কি মেনে নিতে পারবি?

সিদ্ধান্তটা আগে শুনি, তারপর বলব।

আমরা ম্যানেজারকে জামাই করতে চাই।

যেদিন ম্যানেজার স্বপ্নের মেয়েটির কথা বলে সেদিন স্বপ্না খুব রেগে গিয়ে ভেবেছিল, তাকে ক্যাপচার করার জন্য মিথ্যের জাল বিছিয়ে ফাঁদে ফেলতে চান। কি মেলামেশা করে যত ওনাকে জানছে তত নিজেই সেই ফাঁদে পড়ার জন্য তার মন অস্থির হয়ে উঠেছে। মায়ের কথা শুনে সেই অস্থিরতা আরো হাজারগুণ বেড়ে গেল। তাই মনকে শান্ত করার জন্য কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। মেয়েকে চুপ করে থাকতে দেখে ফায়জুন্নেসা বললেন, এক্ষনি মতামত জানাবার দরকার নেই, ভেবে চিন্তে জানা। তবে একথাও ঠিক, তোর অমতে আমরা কিছু করব না। এবার ঘুমোতে যা।

পরের দিন সন্ধ্যের পর ফায়জুন্নেসা ফায়সালকে ডেকে পাঠালেন।

ফায়সাল দোতলা ড্রইংরুমে ঢুকে সালাম দিয়ে দেখল, ফায়জুন্নেসা, লুৎফা বেগম ও স্বপ্না রয়েছেন।

স্বপ্না সালামের উত্তর দিয়ে বসতে বলল।

ফায়সাল বসার পর লুৎফা বেগম বললেন, স্বপ্নার কাছে শুনলাম কাল আজিজের লোক তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছিল। আজ সকালে যাবে তাদেরকে বলেছিলে, গিয়েছিলে নিয়?

জি, গিয়েছিলাম।

কেন ডেকেছিল।

আপনারা মাদরাসা করবেন শুনে আলাপ করার জন্য।

কি আলাপ করলেন?

উনি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করার কাজে বেশ কিছু টাকা দিতে চান আর মাদরাসার গরিব ছাত্রদের জন্য এতিমখানা করার জন্যও টাকা দিতে চান। শুধু তাই নয়, মাদরাসা ও এতিমখানা যাতে বন্ধ হয়ে না যায়, সেজন্য বেশ কিছু, জমিও ওয়াকফ করে দেবেন বললেন।

মা কিছু বলার আগে ফায়জুন্নেসা রেগে উঠে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, পরের ধনে পোদ্দারী করে সওয়াব কামাতে চায়। আহা ম্যানেজার সাহেব, আপনি তো কুরআন হাদিসের অনেক জ্ঞান রাখেন, অবৈধ পন্থায় উপার্জিত সম্পদ এরকম কাজে দান করলে কি সওয়াব পাওয়া যায়?

লুৎফা বেগম মেয়েকে ধমকের সুরে বললেন, সব জানার পরে জিজ্ঞেস করিস, ওকে কথা শেষ করতে দে। তারপর ম্যানেজারকে বললেন, আজিজের কথা শুনে তুমি কি বললে?

বললাম, শুনেছি আপনার আর্থিক অবস্থা আগে খুব খারাপ ছিল। চৌধুরী স্টেটে ম্যানেজারী করার সময় স্টেটের তহবিল তসরুফ করে ও কৌশলে স্টেটের অনেক জমি-জায়গা নিজের নামে করে নিয়ে বড়লোক হয়েছেন। আপনি মনে হয় জানেন না, এসব কাজে অসৎ পথে উপার্জিত সম্পদ দান করতে নেই। করলেও তার কোনো সওয়াব আল্লাহ দেন না। তাই জেনেশুনে ঐ সম্পদ এরকম কাজে গ্রহণ করতে আমি পারব না।

আগে হলে আমার কথা শুনে হয়তো আমাকে খুন করে ফেলতেন, কিন্তু এখন উনি একরকম মৃত্যুশয্যায়। তারপর ওনার ছেলের মৃত্যুর কথা বলে বলল, তাই একটু গীরস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এসব কথা জানলেন কি করে? বললাম, যেমন করে জানি না কেন, কথাগুলো যে সত্য, অস্বীকার করতে পারবেন না। কারণ এই গ্রামের মুরুব্বীরা সবাই ব্যাপারটা জানেন।

অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, হ্যাঁ, আপনার সব কথা সত্য। এখন আমি আমার পাপের জন্য অনুতপ্ত। তাই যা কিছু অসৎ পথে উপার্জন করেছি সব মাদরাসায় দান করতে চেয়েছিলাম। আপনিই বলুন, কিভাবে আমি পাপের প্রায়শ্চিত্য করব? কি করলে আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করবেন? তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বললেন, বেশ কিছুদিন আগে আমাদের মসজিদে দরবেশের মতো একজন মুসাফির এসেছিলেন। তিনি এমন কিছু কথা আমাকে বলেছিলেন, যা শুনে আমার দিব্যচোখ খুলে যায়, দুষ্কর্মের জন্য মনে অনুশোচনা জাগে এবং মনে মনে সংকল্প করি, প্রায়শ্চিত্য করার। উনি আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে আরো বললেন, মানুষ জীবনে ন্যায় অন্যায় অনেক করে। সে জন্যে তওবা করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হয়। তিনি চলে যাওয়ার আগের দিন আপনার অনেক সুনাম করে আমাকে বলেছিলেন, আপনি একটা মাদরাসা করবেন, আমি যেন আপনার সঙ্গে যোগযোগ করি।

বললাম, আল্লাহ দয়ার সাগর, “যে বান্দা অন্যায় কাজের জন্য অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চায়, তাকে তিনি ক্ষমা করে দেন।” এটা কুরআন হাদিসের কথা। আপনি যখন অনুতপ্ত তখন নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমা করবেন। তবে আমি হাদিস মোতাবেক যে কথা বলব, তা আপনাকে করতে হবে।

আমার কথা শুনে আজিজ মিয়া যেন আশার আলো দেখতে পেলেন। তাড়াতাড়ি চোখ মুছে বললেন, বলুন কি করতে হবে? আপনি যা বলবেন তাই

বললাম, অসৎ পথে চৌধুরী স্টেটের যত যা কিছু নিয়েছেন, সেসব স্টেটের মালিকের কাছে ফেরৎ দিতে হবে অথবা স্টেটের মালিকের কাছে অন্যায় স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে হবে এবং উনি যদি আন্তরিকভাবে ক্ষমা করে দেন, তা হলে যা কিছু আপনি মাদরাসায় দান করতে চাচ্ছেন তা আমি গ্রহণ করব। আর সে জন্য আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করবেন ও সওয়াব দান করবেন।

উনি আবার চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললেন, আপনার কথায় আমি রাজি। আমার শারীরিক অবস্থা তো আপনি দেখতেই পাচ্ছেন, চৌধুরী স্টেটের মালিকের কাছে যাওয়ার ক্ষমতা নেই। কি করব আপনি আমাকে পরামর্শ দিন।

বললাম, ঠিক আছে, আপনার কথা আমি স্টেটের মালিকের কাছে বলব, উনি কি বলেন না বলেন আপনাকে জানাব। তারপর বিদায় নিয়ে চলে আসি।

ফায়সাল চুপ করে গেলে লুৎফা বেগম নাতনিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এখন তুমিই চৌধুরী স্টেটের একমাত্র উত্তরাধিকারী, আজিজের ব্যাপারে তোমাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

স্বপ্না কিছুক্ষণ চিন্তা করে নানিকে বলল, আপনি মালিক হলে কি করতেন?

লুৎফা বেগম বললেন, অপরাধী অন্যায় স্বীকার করে ক্ষমা চাইলে তাকে ক্ষমা করা উচিত। বিশেষ করে অপরাধী যখন মৃত্যু পথের যাত্রি হয়।

স্বপ্না মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার মতামত বল।

ফায়জুন্নেসার কানে মা ও মেয়ের কথা যায় নি। তিনি ম্যানেজারের মুখে আজিজের কথা শোনার পর থেকে চিন্তা করছিলেন, কে সেই মুসাফির? যে নাকি আজিজের মতো পাপীর দিব্যচোখ খুলে দিতে সক্ষম হয়েছেন? তিনি কি আমার ও আজিজের কীর্তিকলাপ জানেন? আমরা চিন্তা করছিলেন, আজিজ কি তার ও আমার সম্পর্কের কথা এবং আমি তাকে দিয়ে যা কিছু করিয়েছি, সে সব ম্যানেজারকে বলেছে?

মাকে এতক্ষণ মেঝের দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকতে দেখে স্বপ্না একটু বড় গলায় বলল, মা, কি এত চিন্তা করছ? আমার কথার উত্তর দিচ্ছ না কেন?

মেয়ের বড় গলায় ফায়জুন্নেসা সম্বিত ফিরে পেয়ে বললেন, কি জানতে গচ্ছিস?

নানি আজিজকে ক্ষমা করার কথা বললেন, তোমার মতামত জানতে চাচ্ছি।

তোর নানির সঙ্গে একমত বলে ফায়জুন্নেসা ফায়সালকে জিজ্ঞেস করলেন, যে মুসাফিরের কথা শুনে আজিজের দিব্যচোখ খুলে গেছে, সেই মুসাফিরকে আপনি চেনেন?

ফায়সাল বলল, জি না, চিনি না।

তা হলে তিনি আজিজের কাছে আপনার সুনাম গাইল কি করে? তা ছাড়া আপনার মাদরাসা প্রতিষ্ঠার কথাই বা জানলেন কি করে?

যে মসজিদে জুম্মার নামায পড়তে যায়, বেশ কিছুদিন আগে সেই মসজিদে দরবেশী পোশাকে অপরিচিত একজন মুরুব্বীকে দেখে কিছুক্ষণ আলাপ করেছিলাম। সে সময় উনি আমার পরিচয় ও কাজ-কর্ম সম্পর্কে জেনে অনেক দোয়া করেছিলেন। তবে উনিই যে সেই মুসাফির তা বলতে পারব না। তারপর স্বপ্নার দিকে তাকিয়ে ফায়সাল বলল, আজিজকে ক্ষমা করার ব্যাপারে এবার আপনার মতামত বলুন।

স্বপ্না বলল, আমার জায়গায় আপনি হলে কি করতেন?

ফায়সাল চিন্তাই করে নি, স্বপ্না তাকে এরকম প্রশ্ন করবে। তাই থতমত খেয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে মৃদু হেসে বলল, দেখুন, আমি আপনাদের একজন কর্মচারী, আমার মতামত একেবারে মূল্যহীন।

সপ্ন বলল, মূল্যহীন হোক অথবা মূল্যবান হোক, আপনি বলুন।

ফায়সাল বলল, হাদিসে পড়েছি, “আমাদের নবী করিম (দঃ) বলিয়াছেন, যাহার হাতে আমার জীবন তাঁহার শপথ, আমি যদি বড় শপথকারী হইতাম, তবে আমি তিনটি বিষয়ে শপথ করিতাম: দানে ধন কমে না; যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি অন্বেষণে কোনো অত্যাচারীকে ক্ষমা করিয়া দেয়, আল্লাহ তাহার বিনিময়ে বিচারের দিন তাহার সম্মান বৃদ্ধি করিবেন এবং যে ব্যক্তি ভিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত করে, আল্লাহ তাহার জন্য দারিদ্রতার দ্বার উন্মুক্ত করেন।”[২] তবে এ কথা শরীয়ত সম্মত যে, অত্যাচারী যদি বারবার অত্যাচার চালিয়ে যায়, তা হলে তার প্রতিকার করা উচিত। এবার আপনি বলুন কি করবেন। আপনার মতামত জানার পর আজিজের সঙ্গে যোগাযোগ করব।

স্বপ্না বলল, আল্লাহ ও তার রসুল (দঃ) এর সন্তুষ্টির জন্য আমিও তাকে ক্ষমা করে দিলাম।

ফায়সাল আলহামদুলিল্লাহ বলে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, এরকমই আপনার কাছে আশা করেছিলাম। তারপর বিদায় নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এল।

পরের দিন ফায়সাল আজিজের বাড়িতে গিয়ে ক্ষমা পাওয়ার কথা জানাল।

আজিজ চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললেন, মনে হচ্ছে বেশি দিন বাঁচব না। তাই দু’একদিনের মধ্যে চৌধুরীদের যা কিছু অসৎ পথে নিয়েছিলাম, সবকিছু মাদরাসায় ওয়াকফ করে দেব। আমার একটা নাতি আছে, আপনি দোয়া করবেন, আল্লাহ যেন তাকে হায়াতে তৈয়েবা দান করেন।

ফায়সাল বলল, দোয়া তো করবই, তা ছাড়া সে যাতে আলেম হয়, সে চেষ্টাও করব।

আজিজ বললেন, আল্লাহ আপনাকে খোকসাবাড়ির জন্য রহমত স্বরূপ পাঠিয়েছেন। আপনি কয়েকদিনের মধ্যে আসবেন। আরো কিছু কথা আপনাকে বলার আছে।

ফায়সাল বলল, ঠিক আছে, ইনশাআল্লাহ আসব। তারপর বিদায় নিয়ে ফায়সাল চলে এল।

কয়েকদিন পর ফায়সাল আবার যে দিন গেল তার পরের দিন আজিজ মারা গেল।

———-
(১) বর্ণনায় : হযরত আবু ওমাবাহ (রাঃ) – মেশকাত।

(২) বর্ণনায় : হযরত আবু কাবশাহ (রাঃ) – তিরমিযী।

আগের পর্ব :
১. ট্রেন যখন নীলফামারী স্টেশনে পৌঁছাল
২. পৈত্রিক সূত্রে বিশাল সম্পত্তি
৩. কাগজে বিজ্ঞপ্তি দেখে
৪. হারেস মাঝে মাঝে ঢাকা গিয়ে
পরের পর্ব :
৬. মাস তিনেকের মধ্যে মসজিদ তৈরি

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত