৪. হারেস মাঝে মাঝে ঢাকা গিয়ে
হারেস মাঝে মাঝে ঢাকা গিয়ে মেয়ে স্বপ্নাকে দেখে আসতেন, কিন্তু বাড়িতে নিয়ে আসতেন না। মেয়ের প্রতি ফায়জুন্নেসার তেমন টান না থাকলেও মাঝে মধ্যে স্বামীর সঙ্গে তাকে দেখার জন্য যেতে চাইতেন। হারেস রাজি না হয়ে বলতেন, মেয়েকে আমি নিজের মতো করে মানুষ করব, তাই আমি চাই না তুমি তার সঙ্গে দেখা কর। এই নিয়ে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে প্রায় রাগারাগি হত।
লুৎফা বেগম মেয়ে ফায়জুন্নেসার উপর খুব অসন্তুষ্ট ছিলেন। তাই তিনি জামাই-এর হয়ে মেয়েকে বলতেন, “জামাইয়ের সঙ্গে আমিও একমত। স্বপ্নার উপর তোর ছায়াও যেন না পড়ে। তোর মা হওয়ার যোগত্যা নেই। যে দিন যোগ্যতা অর্জন করতে পারবি, সেদিন স্বপ্নার কাছে মা বলে পরিচয় দিবি।” তারপর থেকে ফায়জুন্নেসা মেয়েকে দেখতে যাওয়ার অথবা তাকে নিয়ে আসার ব্যাপারে স্বামী খুন হওয়ার আগে পর্যন্ত তাকে ঠিকানা অথবা মেয়ে কেমন আছে জিজ্ঞেস করেন নি। এমন কি আজিজকে নিয়ে যতদিন প্রেম সাগরে সাঁতার কেটেছেন, ততদিন মেয়ের কথা একরকম ভুলেই গিয়েছিলেন। হঠাৎ একদিন রাতে ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখলেন, “মেয়ে স্বপ্না যেন বাড়িতে এসে আজিজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে জিজ্ঞেস করল, কে ইনি? বাবা মারা যাওয়ার পর ইনাকে কি তুমি বিয়ে করেছ?”
মেয়েকে দেখে ফায়জুন্নেসা এত লজ্জা পেলেন যে, সরে বসে মাথা নিচু করে ছিলেন। কোনো কথা বলতে পারলেন না।
তুমি কথা বলছ না কেন মা? তা হলে আমার ভাবা কি অনুচিত হবে, ইনি তোমার উপপতি? ছিঃ মা ছিঃ তুমি নারী জাতির কলঙ্ক। তোমার মতো চরিত্রহীন মেয়ের পেটে জন্মেছি ভেবে নিজেকে খুব ঘৃণা হচ্ছে। আমি এক্ষুনি চলে যাচ্ছি, তোমাকে কখনও মা বলে স্বীকৃতি দেব না। কথা শেষ করে স্বপ্না সেখান থেকে চলে গেল।
আর তখনই ফায়জুন্নেসার ঘুম ভেঙ্গে গেল। এই স্বপ্না দেখার পর থেকে বার বার যেমন মেয়ের কথা মনে পড়তে লাগল, তেমনি মনে পাপবোধ জেগে উঠল। তারপর থেকে আজিজকে এড়িয়ে চলতে শুরু করেন এবং শেষমেষ আজিজকে চাকরি থেকে বরখাস্থ করে তাড়িয়ে দেন। তারপর মেয়ের খোঁজ খবর নেয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়েন। কিন্তু মেয়ে কোথায় থাকে, এতদিন তার খবরচপত্র কে দিচ্ছে, কিছুই জানেন না। ভাবলেন, মা নিশ্চয় নাতনির সবকিছু জানেন।
একদিন মাকে জিজ্ঞেস করলেন, স্বপ্না কোথায় থাকে জান?
লুৎফা বেগম হাশেমের কাছ থেকে মেয়ের সব কিছুর খবর রাখেন আর মেয়েকে হেদায়েত করার জন্য সব সময় দোয়া করেন। আজিজকে বরখাস্থ করার খবর যেদিন শোনেন, সেদিন আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন।
আজ তাকে স্বপ্নার কথা জিজ্ঞেস করতে গম্ভীরস্বরে বললেন, এত বছর পর মেয়ের খবর জানতে চাচ্ছিস কেন? যদি বলি সে নেই, আল্লাহ তাকে দুনিয়া থেকে তুলে নিয়েছেন?
ফায়জুন্নেসা চমকে উঠে কান্নাজড়িতরে বললেন, এমন কথা বলো না মা। তুমি একদিন বলেছিলে, “যেদিন মা হওয়ার যোগ্য হবি, সেদিন মেয়ের কাছে মা বলে পরিচয় দিবি।” এত বছর পর কেন তার খবর জানতে চাচ্ছি, নিশ্চয় বুঝতে পারছ। মন বলছে, তোমার সঙ্গে স্বপ্নার যোগাযোগ আছে।
হ্যাঁ, আছে। তুই কি তার সঙ্গে দেখা করতে চাস?
হ্যাঁ, মা। তাকে দেখার জন্য মন খুব অস্থির হয়ে পড়েছে।
কিন্তু সে তো পড়াশোনা শেষ না করা পর্যন্ত আসবে না।
আমি যাব তার সঙ্গে দেখা করতে, তুমি ঠিকানা দাও।
ঠিকানা দিলেও কাজ হবে না।
কেন?
স্বপ্না তোর সঙ্গে দেখা করবে না।
সে আমি বুঝব, তুমি ঠিকানা দাও।
লুৎফা বেগম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তোর কারণে আজ পনের বছর তাকে দেখতে না পেয়ে কি ভাবে দিন কাটাচ্ছি, তা আল্লাহ ভালো জানেন, কথা শেষ করে চোখ মুছলেন।
ফায়জুন্নেসা মায়ের দু’পা জড়িয়ে ধরে ভিজে গলায় বললেন, আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। আমাকে মাফ করে দাও মা। তারপর আবার বললেন, হয় ঠিকানা দাও, না হয় তাকে আবার ব্যবস্থা কর।
লুৎফা বেগম পা ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন, উঠে বস। বসার পর বললেন, তোর কাছ থেকে এই কথা শোনার জন্য এত বছর বুকে পাথর চাপা দিয়ে সবর করে ছিলাম। আজ তোর কথা শুনে সেই পাথর আপনা থেকে সরে গেছে। তাই স্বপ্নাকে দেখার জন্য আমিও অস্থির হয়ে পড়েছি। ওর ঢাকার পড়াশোনা শেষ। আরও পড়াশোনা করার জন্য আমেরিকা যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে জানার পর ভেবেছিলাম, মৃণালবাবু ও হাসেমকে নিয়ে এয়ারপোর্টে তার সঙ্গে দেখা করতে যাব। আল্লাহ যখন তোর সুমতি দিয়েছেন তখন তুইও আমাদের সঙ্গে যাবি।
খুশিতে ফায়জুন্নেসার চোখে পানি এসে গেল। মাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, স্বপ্নাকে কিছুদিনের জন্য এখানে আনা যায় না?
না।
কেন মা?
সে কথা এখন বলতে পারব না।
ফায়জুন্নেসা মাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, তা হলে এক কাজ করলে হয় না, আমরা ঢাকায় গিয়ে হোটলে থেকে আমেরিকা যাওয়ার আগ পর্যন্ত ওকে আমাদের সঙ্গে রাখব?
না, তাও সম্ভব নয়। ও যেখানে থাকে সেখানকার সুপার অনুমতি দেবেন না।
আমি মা, আমি বললেও অনমতি দেবেন না?
না, দেবেন না। তা ছাড়া এত বছর মেয়ের খোঁজ খবর রাখিস নি, এখন মা বলে পরিচয় দিলেও স্বপ্না তোর সঙ্গে দেখা করবে বলে মনে হয় না। এয়ারপোর্ট ছাড়া তার সঙ্গে কিছুতেই তোর দেখা হওয়া সম্ভব নয়। তাই যা বলছি শোন, আমেরিকায় পড়াশোনা শেষ করে ওর এখানে ফিরে আসার কথা। এর মধ্যে তুই চিঠি দিয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করবি। তুই তো শিক্ষিত ও বুদ্ধিমতী, চিঠিতে এমন কিছু লিখবি, যাতে সে ফিরে আসে।
যদি ফিরে না এসে ওখানে থেকে যায়?
আমাকে কথা দিয়েছে ফিরে আসবে। তবে আমি যদি মরে যাই, তা হলে কি করবে বলতে পারছি না। চৌধুরী বংশের শেষ প্রদীপ প্লা। সে যাতে চৌধুরী স্টেটের হাল ধরতে পারে, সেজন্য হারেস তাকে সেইভাবে মানুষ করার ব্যবস্থা করেছিল। হারেস নেই, এখন তাকে ফিরিয়ে এনে সবকিছু বুঝিয়ে দেয়া তোর কর্তব্য।
আমেরিকা যাওয়ার দিন এয়ারপোর্টে স্বপ্নার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর অল্প সময় আলাপ করার সুযোগ পেয়েছিলেন ফায়জুন্নেসা। সে সময় চোখের পানি ফেলতে ফেলতে মেয়েকে বলেছিলেন, মানুষ মাত্রই ভুল করে, তবে আমি হয়তো গুরুতর ভুল করেছি। সেজন্যে মা হয়ে তোর কাছে ক্ষমা চাইছি। বল মা, আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছিস? পড়াশোনা শেষ করে ঘরে ফিরে আসবি বল?
পরিচিত হওয়ার পর থেকে স্বপ্না একটা কথাও বলল না, শুধু মায়ের দিকে তাকিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল। মার ক্ষমা চাওয়া ও ঘরে ফেরার কথা শুনেও কিছু বলল না, একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে রইল।
লুৎফা বেগম নাতনিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, কিছু বলছিস না কেন? তুই বোধ হয় জানিস না, আল্লাহ ও রসুল (দঃ) এর পরেই মা বাবার স্থান। মায়ের স্থান পিতার উর্বে স্থাপন করা হয়েছে। হাদিসে আছে, “এক ব্যক্তি রসুলুল্লাহ (দঃ) কে জিজ্ঞাসা করিল, সন্তানের উপর তাহার পিতা-মাতার কি হক (দাবি) আছে? তিনি বলিলেন, তাহারা উভয়েই তোমার বেহেশত ও তোমার দোয়োখ।”[১]
সন্তানের কর্তব্য বিদেশ যাওয়ার সময় মা-বাবার অনুমতি নেয়া। তোর বাবা নেই, এখন মা-ই তোর মা-বাবা। মনে রাখিস, মা-বাবার মনে কষ্ট দিয়ে কেউ জীবনে সুখী হতে পারে না। মা-বাবার ভুল ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখাও সন্তানের কর্তব্য। এখন তোর উচিত মাকে ক্ষমা করে দিয়ে তার অনুমতি নেয়া ও তার কথার উত্তর দেয়া।
দীর্ঘ পনের ষোল বছর মা তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে নি বলে স্বপ্নার মনে রাগ ও অভিমানের পাহাড় জমে ছিল। তাই এতক্ষণ একটা কথাও বলে নি। নানির কথা শুনে সেই রাগ ও অভিমান কপূরের মতো উড়ে গেল। মা বলে ফায়জুন্নেসাকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলতে লাগল।
এতবছর পর মা ডাক শুনে ফায়জুন্নেসাও চোখের পানি রোধ করতে পারলেন না। ভিজে গলায় বললেন, বল মা, লেখাপড়া শেষ করে তুই আমার কোলে ফিরে আসবি?
স্বপ্না সামলে নিয়ে চোখ মুখ মুছে প্রথমে নানিকে ও পরে মাকে কদমবুসি করে বলল, হ্যাঁ মা ফিরে আসব। এবার তুমি আমাকে যাওয়ার অনুমতি দাও।
এরপর থেকে ফায়জুন্নেসা প্রতি মাসে মেয়েকে চিঠি দেন। স্বপ্নাও চিঠির। উত্তর দেয়। মাস তিনেক আগে দেশে ফেরার কথা জানালেও নানি ও মাকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য কবে ফিরবে জানায় নি।
.
বাসের চেয়ে ট্রেনের জার্নি আরামদায়ক। তাই ফায়সাল ট্রেনে যাতায়াত করে। নীলফামারী থেকে ট্রেনে রংপুর এসে ঢাকার ট্রেনে উঠতে হয়। ঐ ট্রেন ছাড়ে সন্ধ্যে সাতটায়। তাই ফায়সাল ঐদিন সকালে রওয়ানা না হয়ে বিকেল পাঁচটায় চৌধুরী বাড়ি থেকে বেরোল।
এদিকে রিকশা খুব কম চলাচল করে। তবে মাইল দুয়েক দূরে একটা বাজার আছে, ওখানে সব সময় রিকশা পাওয়া যায়। আজ ভাগ্যগুণে কিছুদূর আসার পর পিছন থেকে আসা একটা খালি রিকশা পেয়ে গেল।
বাজারের কাছাকাছি এসেছে এমন সময় সামনে থেকে একটা ট্যাক্সি আসতে দেখে রিকশাওয়ালাকে ফায়সাল সাইড দিতে বলল।
রিকশাওয়ালা বলল, দেখছেন না, সাইড দেয়ার মতো রাস্তাটা চওড়া নয়?
ফায়সাল চিন্তিত হয়ে বলল, তা হলে এখন কি হবে?।
রিকশাওয়ালা বলল, কি আবার হবে? গাড়ির ড্রাইভারকে ব্যাক গিয়ারে বাজারে যেতে হবে।
কিছুটা দূর থেকে ট্যাক্সি ড্রাইভার হর্ণ বাজাচ্ছিল। সাইড না পেয়ে রিকশার সামনে এসে ব্রেক করে বলল, সাইড দেয়ার জন্য আগের থেকে হর্ণ বাজালাম, তুমি সুবিধে মতো জায়গায় দাঁড়াতে পারতে।
রিকশাওয়ালা বলল, সাইড দেয়ার মতো জায়গা থাকলে তো দাঁড়াব। বাজার কাছেই, ওখানে সাইড দেয়ার জায়গা আছে, আপনি ব্যাক গিয়ারে বাজারে চলুন।
রিকশাওয়ালার কথা শুনে ড্রাইভার রেগে গেল। সামনের রাস্তার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে কি করবে জানার জন্য পিছনে বসা প্যাসেঞ্জারের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল।
ততক্ষণে ফায়সাল রিকশা থেকে নেমে পিছনের সিটে স্বপ্নে দেখা সেই মেয়েটিকে দেখে অবাক হয়ে একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে রইল।
স্বপ্না আজ ভোরে ঢাকায় পৌঁছে এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি ক্যাব নিয়ে বাড়ি আসছে। ড্রাইভারের তাকানর উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে রিকশাওয়ালার কথা যাচাই করার জন্য গাড়ি থেকে নামতেই ফায়সালের চোখে চোখ পড়ে গেল। তাকে ঐভাবে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে খুব রেগে গেল। বলল, আপনার কি ভদ্ৰতা জ্ঞানও নেই? দেখে তো মনে হচ্ছে ভদ্রঘরের ছেলে।
স্বপ্নার কথা ফায়সালের কানে গেল না। কয়েক বছর ধরে যে মেয়েকে স্বপ্নে দেখে আসছে, সেই মেয়ে আজ তার সামনে। তাই বাস্তব জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।
স্বপ্না চৌধুরী বংশের মেয়ে না হলেও নাতনি। তার রক্তে চৌধুরী বংশের রক্ত। তাই ছেলেটাকে একইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ও তার কথার উত্তর না পেয়ে আরো রেগে গেল। এগিয়ে এসে ফায়সালের গালে কষে একটা চড় মেরে বলল, অভদ্রদেরকে এইভাবে ভদ্রতা শেখাতে হয়।
স্বপ্নার চড় খেয়ে ফায়সাল বাস্তবে ফিরে এল। যন্ত্রণা অনুভব করে গালে হাত বুলোত বুলোতে রিকশাওয়ালাকে বলল, রিকশা রাস্তা থেকে জমিতে নামাও।
রিকশাওয়ালা ঘটনাটা দেখেছে। তাই কিছু না বলে রিকশা রাস্তা থেকে জমিতে নামাল।
ততক্ষণে স্বপ্না গাড়িতে উঠে বসেছে। ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দিল।
গাড়ি চলে যাওয়ার পর রিকশাওয়ালা ফায়সালকে বলল, আমি একা রিকশা রাস্তায় তুলতে পারব না, আপনিও ধরুন।
রাস্তায় রিকশা তোলার পর ফায়সাল উঠে বসল।
রিকশাওয়ালা রিকশা চালাতে চালাতে বলল, একটা মেয়ে আপনার গালে চড় মারল আর আপনি তাকে কিছু না বলে তার গাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন? ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না, আমি হলে বলে থেমে গেল।
ফায়সাল মৃদু হেসে বলল, কি করতেন? তার গালে আপনিও চড় মারতেন?
হ্যাঁ, মারতামই তো। মেয়ে হয়ে যদি ছেলের গালে চড় মারতে পারে; তা হলে ছেলে হয়ে পারতাম না কেন?
মেয়েরা যা করতে পারে সবক্ষেত্রে ছেলেরা তা পারে না।
এটা আপনি ঠিক বলেন নি, বরং মেয়েদের চেয়ে ছেলেরা বেশি পারে।
তাই যদি হয়, তা হলে মেয়েরা সন্তান পেটে ধরতে পারে, ছেলেরা পারে না
এই কথা শুনে রিকশাওয়ালা থতমত খেয়ে গেল। কোনো উত্তর দিতে পারল না।
ফায়সাল বলল, এখন বুঝলেন তো, ছেলে হোক আর মেয়ে হোক সবাই সব কাজ করতে পারে না।
রিকশাওয়ালা আর কিছু না বলে চুপ করে রইল।
স্বপ্না ছেলেবেলায় মায়ের তেমন আদর যত্ন পাই নি। চাকরানি তাসলিমা তাকে দেখাশোনা করত। এমন কি তার কাছেই ঘুমাত। তাই মায়ের প্রতি তার তেমন টান ছিল না। বরং মাকে ভয় করত। তাই বাবা যখন তাকে ঢাকায় এনে হোমে রেখে যায় তখন মায়ের জন্য মন খারাপ হয় নি। তারপর বড় হয়ে যখন জ্ঞান হল তখন মা তাকে একবারও দেখতে আসে নি বলে মায়ের উপর প্রচণ্ড অভিমান হয়। সেজন্যে বাবা এলে তাকে মায়ের কথা জিজ্ঞেস করত না। এমন কি বাবা মারা যাওয়ার পর নানি লুৎফা বেগম যখন চিঠি দিয়ে সে কথা জানাল। তখন বাবার জন্য অনেক কান্নাকাটি করলেও বাড়িতে আসে নি এবং মায়ের কথাও নানিকে জানাতে বলে নি। তারপর নানির সঙ্গে চিঠিতে যোগাযোগ থাকলেও মাকে কোনো চিঠি দেয় নি। অবশ্য মাঝে মধ্যে মাকে চিঠি দিয়ে ও বাড়িতে গিয়ে তার খবর নেয়ার খুব ইচ্ছা হত। তাই একবার বাড়িতে যাওয়ার জন্য লোক পাঠাতে নানিকে জানিয়েছিল। উত্তরে লুৎফা বেগম জানিয়েছিলেন, লেখাপড়া শেষ করে আসবি। তোর বাবাও আমাকে সে কথা বলেছিল। তাই নানির চিঠি পাওয়ার পর মাকে চিঠি দেয়ার ও বাড়িতে আসার চিন্তা মন থেকে মুছে ফেলেছিল। আমেরিকা যাওয়ার সময় এয়ারপোর্টে প্রায় পনের ষোল বছর পর নানিকে ও মাকে দেখে সে সময় মায়ের আচরণে বেশ অবাক হয়ে ভেবেছিল, যে মা আজ এত বছর মেয়ের খোঁজ খবর রাখে নি, এক বারের জন্যে দেখতেও আসে নি, এমন কি একটা চিঠি পর্যন্ত দেয় নি, সেই মা তাকে আমেরিকায় পড়াশোনা শেষ করে বাড়িতে ফিরে আসার জন্য চোখের পানি ফেলে আকুতি মিনতি করছে কেন? তখন অভিমানে মায়ের সঙ্গে কথা বলতে চায় নি। নানির কথায় অভিমান ধরে রাখতে পারে নি এবং আমেরিকায় গিয়ে মায়ের সঙ্গে চিঠি দেয়া-নেয়া করে তার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা জন্মেছে। তারপর বাড়িতে এসে মা ও নানির স্নেহ ও ভালবাসায় আপ্লুত হয়েছে।
একদিন লুৎফা বেগম চৌধুরী বংশের পূর্ব পুরুষদের ইতিহাস ও ওনাদের করুন মৃত্যুর কথা নাতনিকে বললেন।
স্বপ্না পূর্ব পুরুষদের মৃত্যুর ঘটনা শুনে দুঃখ পেলেও জিনেদের ব্যাপারটা বিশ্বাস করল না। বলল, ওসব কল্প কাহিনী।
লুৎফা বেগম বললেন, আমি এ বাড়ির বৌ হয়ে এসে আমার শাশুড়ি যখন আমাকে এসব কথা বলেছিলেন তখন আমিও বিশ্বাস করি নি। তারপর ওনার শাশুড়ি যা কিছু বলেছিলেন, সেসব বলে বললেন, তুই চৌধুরী বংশের একমাত্র প্রদীপ। তোকে নিয়ে আমি ও তোর মা খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম। তবে এখন আল্লাহ আমাদেরকে সেই চিন্তা থেকে নিকৃতি দিয়েছেন।
স্বপ্না কপাল কুচকে জিজ্ঞেস করল, কি ভাবে?
আমাদের স্টেটের ম্যানেজার নিজের থেকে একদিন আমাদেরকে বললেন, আপনারা স্বপ্নার জন্য কোনো দুশ্চিন্তা করবেন না। পূর্ব পুরুষদের মতো ওনার জীবনে কিছু ঘটবে না।
স্বপ্না হেসে উঠে বলল, ম্যানেজার বললেন আর আপনারা ওনার কথা বিশ্বাস করে ফেললেন? আসলে কি জানেন নানি, ওসব কথা উনিও বিশ্বাস করেন নি। তাই নিশ্চয়তা দিয়েছেন।
তোর কথা ঠিক নয়। ম্যানেজার খুব ধার্মিক। এখানে জয়েন করার কিছু দিনের মধ্যে এ বাড়ির পরিবেশ পাল্টে দিয়েছে। ছোট বড় সবাইকে আপনি করে বলে। এমন কি চাকর-চাকরানিদেরকেও। সবাইকে তালিম দিয়ে নামায ধরিয়েছে। তোর মাও নামায পড়ত না। গতকাল থেকে পড়ছে। আর সেটা ম্যানেজারের কারণেই। আজিজের সঙ্গে আমাদের শত্রুতার কথা তোকে তো বলেছি। সেই আজিজকেও মিত্র বানিয়েছে। এখনও এক বছর হয় নি ম্যানেজার হয়ে এসেছে, এর মধ্যে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে। উপযাজক হয়ে সেই ছেলে আমাদেরকে মিথ্যে প্রবোধ দেবে, তা হতে পারে না।
স্বপ্না চিন্তা করল, ম্যানেজার ধর্মের মুখোশ পরে আজিজের মতো আখের গোছাবার তালে নেই তো? যদি তাই হয়, তা হলে বাছাধনকে জেলের ঘানি টানাব।
লুৎফা বেগম বললেন, কি রে, কি ভাবছিস?
না, তেমন কিছু না, শুনেছি, ম্যানেজার ছুটি নিয়ে বাড়ি গেছেন, কবে ফিরবেন?
তুই যেদিন এলি, ঐদিন পনের দিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি গেছে।
ওনার বাড়ি কোথায়?
ঢাকায়।
আচ্ছা, ওনাকে কি আমাদের পূর্ব পুরষদের কথা আপনারা বলেছেন?
না।
আমার মনে হয়, উনি কারো কাছ থেকে সবকিছু জেনেছেন। ঠিক আছে, আসার পর আমি আলাপ করে দেখব, কতটা ভালো।
স্বপ্না প্রায় প্রতিদিন হাশেমের সঙ্গে স্টেটের সবকিছু ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল।
একদিন তাকে জিজ্ঞেস করল, ম্যানেজার কেমন লোক বলতে পার?
হাশেম বলল, ওনার মতো ভালো ছেলে আমি জীবনে দেখি নি।
স্বপ্না মনে করেছিল ম্যানেজার বয়স্ক লোক। হাশেম হেলে বলতে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ম্যানেজারকে ছেলে বলছ কেন? উনি বয়স্ক লোক না?
না মা, ওনার বয়স বড় জোর আঠাশ কি ত্রিশ।
তাই না কি?
শুধু তাই নয়, দেখতেও খুব সুন্দর। যেমন রঙ তেমনি স্বাস্থ্য। তা ছাড়া উনি সবদিকে এক্সপার্ট।
সবদিকে এক্সপার্ট মানে?
মানে, উনি সব ধরনের মারামারীতে খুব পটু। ধর্মের আইন নিজে যেমন মেনে চলেন, অন্যদেরকেও মেনে চালাবার চেষ্টা করেন। আর কি অমায়িক ব্যবহার। গ্রামের গরিব-বড়লোক, ছোট-বড় সবাইকে সম্মান দিয়ে কথা বলেন।
সবার মুখে ম্যানেজারের প্রশংসা শুনে স্বপ্নার সু ধারণা হল, ম্যানেজার কারো কাছ থেকে চৌধুরী বংশের খোঁজ খবর নিয়ে রাজকন্যাসহ রাজত্ব পাওয়ার আশায় এখানে এসেছে এবং ধর্মের মুখোশ পরে সকলের মন জয় করেছে।
একদিন অফিসের বড়বাবু মৃণালবাবুর সাহায্যে ম্যানেজারের খাতাপত্র চেক করতে লাগল। পাঁচ দু’দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে কারচুপির কোনো প্রমাণ না পেয়ে ভাবল, এটাও ম্যানেজারের একটা চাল।
.
চৌদ্দ দিন ছুটি কাটিয়ে আজ রাত আটটার সময় ফায়সাল কর্মস্থলে ফিরে এল।
নটার সময় আকলিমা রাতের খাবার নিয়ে এসে বলল, আপনি যে দিন বাড়ি গেলেন, ঐদিন মালেকিনের মেয়ে বিদেশ থেকে এসেছেন।
ফায়সাল কিছু না বলে খেতে বসল।
আকলিমা মনে করেছিল, তার কথা শুনে ম্যানেজার খুশি হয়ে ওনার সম্পর্কে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করবেন। চুপচাপ খেতে দেখে আবার বলল, লেখাপড়া করার জন্য ওনার বাবা সাত বছর বয়সে ঢাকায় নিয়ে………
তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে ফায়সাল বলল, ওনার কথা বলার দরকার নেই, আমি সব জানি।
আকলিমা আর কিছু না বলে চুপ করে রইল। ফায়সালের খাওয়া হয়ে যেতে বাসন পেয়ালা নিয়ে চলে গেল।
পরের দিন ফায়সাল অফিসে কাজ করছিল। হঠাৎ দরজার দিকে তাকাতে স্বপ্নাকে দেখে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে বলল, আসুন।
স্বপ্না ম্যানেজারের সঙ্গে পরিচয় করার জন্য কিছুক্ষণ আগে এসে ফায়সালকে চিনতে পেরে থমকে দাঁড়িয়ে ভাবছিল, আসার দিন তা হলে ইনারই গালে চড় মেরেছে। ফায়সাল তার দিকে তাকাতে চোখে চোখ পড়ে গেল। বেশ কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে একে অপরকে বোঝার চেষ্টা করল। তারপর প্রথমে ফায়সাল মৃদু হেসে বলল, সেদিনের ঘটনায় আমি কিছু মনে করি নি। প্লীজ, ভিতরে এসে বসুন।
স্বপ্না ভিতরে এসে ফায়সালের সামনের চেয়ারে বসল।
ফায়সাল বসে বলল, আমি কিন্তু আপনাকে সালাম দিয়েছি।
আমি যেখানে মানুষ হয়েছি, তারা সালাম কি ও কেন শেখায় নি।
তা হলে আমি শেখাই?
না, প্রয়োজন হলে নিজেই শিখে নেব।
ঠিক আছে, কিছু বলার থাকলে বলুন।
বলতে আসি নি, পরিচয় করতে এসেছি।
মাফ করবেন, কথাটা ঠিক বলেন নি।
স্বপ্না রাগের সঙ্গে বলল, মানে?
মানে, এখানে আসার পর আপনার পরিচয় আমি যেমন জানি, আপনিও তেমনি জানেন। শুধু আমাকে দেখার বাকি ছিল। তাই দেখতে এসেছেন।
এবার স্বপ্না রাগের পরিবর্তে অবাক হল, জিজ্ঞেস করল, আপনার বাকি ছিল?
আপনাকে আমি অনেক দিন আগে থেকে দেখে আসছি। শেষবারে দেখেছি পনের দিন আগে বাড়ি যাওয়ার সময় রাস্তায়।
স্বপ্না আরো অবাক হলেও তা প্রকাশ না করে রাগের সঙ্গে বলল, মিথ্যের বেড়াজাল বিছিয়ে এখানকার সবাইকে ধোকা দিতে পারলেও আমাকে পারবেন না। জানেন না, মিথ্যে দিয়ে সত্যকে বেশি দিন ঢেকে রাখা যায় না?
কেন জানব না? আর জানি বলেই কখনও মিথ্যা বলি না, মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে কোনো কাজও করি না।
তা হলে কেন বললেন, আমাকে অনেক দিন থেকে দেখে আসছেন?
কথাটা সত্য, তাই বলেছি।
কোথায় দেখেছেন?
মাফ করবেন এখন বলা সম্ভব নয়।
কখন সম্ভব হবে?
সময় মতো আপনি নিজেই জানতে পারবেন।
তার কথা শুনে স্বপ্না খুব রেগে গেল। রাগ সামলাবার জন্য কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, আমাকে যদি অনেক দিন থেকে দেখে থাকেন, তা হলে সে দিন রাস্তায় অভদ্রের মতো আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন কেন?
মাফ করবেন, সে কথাও বলা এখন সব নয়।
এবার আর স্বপ্না রাগ সামলাতে পারল না। কর্কশ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, আমাকে চেনেন?
ফায়সাল মৃদু হেসে বলল, “সাত খণ্ড রামায়ণ পড়ে সীতা রামের মাসি।” আপনার প্রশ্নটা সে রকম হয়ে গেল না?
সাট আপ, যা জিজ্ঞেস করেছি উত্তর দিন।
চিনব না কেন? আপনি মরহুম ইনসান চৌধুরীর নাতনি জেবুন্নেসা ওরফে স্বপ্না। যিনি চৌধুরী বংশের একমাত্র প্রদীপ ও চৌধুরী স্টেটের একমাত্র উত্তরাধিকারী।
তাই যদি জানেন, তা হলে তার সঙ্গে কি রকম ব্যবহার করা উচিত নিশ্চয় জানেন?
জি, জানি।
তা হলে আমার সঙ্গে হেঁয়ালী করছেন কেন? আমার প্রশ্নের উত্তরও দিচ্ছেন কেন?
আমি হেঁয়ালী করি নি, তবে যে সব প্রশ্নের উত্তর দিই নি, সেগুলো আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আর ব্যক্তিগত ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা কারো উচিত নয়।
ব্যক্তিগত ব্যাপার যদি মালিকের সঙ্গে সম্পর্কিত হয় তখন মালিকের জানার অধিকার নিশ্চয় আছে?
তা আছে, তবে কেউ অপারগ হলে মালিকের জোর খাটিয়ে জানা ঠিক নয়। স্বপ্না গর্জে উঠল, একজন কর্মচারী হয়ে মালিককে জ্ঞান দান করছেন?
আপনি ক্রমশ রেগে উঠছেন। রাগ খুব খারাপ জিনিস। রাগের বশে মানুষ এমন কাজ করে ফেলে, সারাজীবনেও যার ক্ষতি পূরণ করা যায় না। তাই রাগকে আল্লাহ হজম করতে বলেছেন। নুন, আপনাকে জ্ঞান দেয়ার জন্য কিছু বলি নি। যা সত্য তাই বলেছি।
স্বপ্না আর ধৈর্য ধরতে পারল না, উঁচু গলায় বলল, মিত্যুক, ভণ্ড কোথাকার, এক্ষুনি আপনাকে বিদায় করে দিতে পারি জানেন?
জি, জানি। আরো জানি, আপনি তা করতে পারবেন না।
পারি কি না দেখবেন?
ফায়সাল হাসি মুখে বলল, আপনার মাও অনেকবার আমাকে বিদায় করতে চেয়েছেন; কিন্তু পারেন নি। কথাটা সত্য কিনা ওনাকে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারবেন।
এই পনের দিনেই মায়ের মন মেজাজ স্বপ্না জেনে গেছে। তাই ফায়সালের মুখে মায়ের কথা শুনে চুপ করে গেল।
ফায়সাল তা বুঝতে পেরে অল্পক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, আপনি কি ভাববেন জানি না, এতকিছুর পরও আপনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা এতটুকু কমে নি। একটা কথা বলছি, রাগ করবেন না। জ্ঞানীরা বলেছেন, “ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না।” স্বপ্নাকে তার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকাতে দেখেও আবার বলল, এবার আপনি আসুন। পনের দিন ছিলাম না, অনেক কাজ জমা হয়ে আছে। প্রয়োজনে অন্য সময় বা অন্যদিন আলাপ করবেন।
স্বপ্না রাগের সঙ্গে বলল, আপনি ভীষণ চালাক ও পাকা অভিনেতা। শুনে রাখুন, আপনি যা কিছু হন না কেন, আমাকে ফাঁকি দিতে পারবেন না। কিছুদিনের মধ্যে আপনার মুখোশ সবার কাছে খুলে দেব।
ফায়সাল হেসে উঠে বলল, তা যদি পারেন, তা হলে আমার জীবন ধন্য হয়ে যাবে।
জেলের ঘানি টেনে যদি ধন্য হতে চান, তবে সেই ব্যবস্থাই করব বলে প্লা সেখান থেকে গটগট করে চলে গেল।
ফায়সাল মৃদু মৃদু হাসতে হাসতে তার চলে যাওয়া দেখল। তারপর কাজে মন দিল।
ফায়জুন্নেসা মেয়েকে ঘণ্টাখানেক আগে অফিসরুমের দিকে যেতে দেখে ভেবেছিলেন, ম্যানেজারের সঙ্গে আলাপ করতে যাচ্ছে। এখন তাকে রাগান্বিত মুখে ফিরতে দেখে চিন্তা করলেন, নিশ্চয় ম্যানেজারের সঙ্গে কিছু একটা হয়েছে। কাছে এলে জিজ্ঞেস করলেন, ম্যানেজারের সঙ্গে আলাপ করতে গিয়েছিলি বুঝি?
স্বপ্না বলল, হ্যাঁ, গিয়েছিলাম।
কি রকম বুঝলি?
আমারটা পরে বলছি, আগে তুমি ওনার সম্পর্কে কমেন্ট কর।
ওনার মতো ভালো ছেলে দ্বিতীয় আছে কি না জানি না। এবার তোরটা বল।
আমারটা ঠিক বিপরীত, ওনার মতো হীন চরিত্রের ছেলে আমিও দ্বিতীয় দেখি নি। ভালোর, মুখোশ পরে তোমাদের সবাইয়ের মন জয় করেছে। আমি ওনার মুখোশ খুলে দিয়ে জেলের ঘানি টানাব।
ফায়জুন্নেসা মেয়ের কথা শুনে খুব অবাক হয়ে বললেন, কি বলছিস তুই?
হ্যাঁ, মা, যা সত্য তাই বলছি। উনি খুব ধূর্ত ও শঠ। ধর্মের মুখোশ পরে ধার্মিক সেজে আমাদের সবকিছুর মালিক হতে চান। আমি ওনার শঠতা ধরে ফেলেছি।
ফায়জুন্নেসা বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, তুই ম্যানেজারকে বুঝতে ভুল করেছিস। তোকে আর দোষ দেব কি, প্রথম দিকে আমিও ওনাকে ভুল বুঝেছিলাম। পরে উনিই ভুল ভাঙ্গিয়ে দিয়েছেন। আমার কথা বিশ্বাস না হলে তোর নানিকে জিজ্ঞেস করতে পারিস।
তোমার মতো নানিও ওনাকে খুব ভালো ছেলে মনে করেন। আমিও বলে রাখছি, যেমন করে হোক একদিন না একদিন ওনার মুখোশ খুলে দেবই দেব।
তুই ওনাকে কেন সন্দেহ করছিস বলতো?
পরে বলব। তবে এখন এতটুকু বলতে পারি, সবার মুখে ওনার সুখ্যাতি শুনেও মাত্র ঘণ্টা খানেক আলাপ করে তোমাদের মতো আমারও মনে হয়েছে ওনার মতো ভালো ছেলে এযুগে বিরল। আর সেটাই হল সন্দেহের কারণ।
সন্দেহটা কি বলবি তো।
বললাম না, পরে বলব? আশা করি, কিছুদিনের মধ্যে সন্দেহটা প্রমাণ করতে পারব। সবাই তখন এমনই জানতে পারবে।
তুই কি আমাদের পূর্ব পুরুষদের ইতিহাস জানিস?
হ্যাঁ, নানি বলেছেন। তবে আমি বিশ্বাস করি নি। তারপর নানিকে স্বপ্না যা কিছু বলেছিল সব পুনরায় বলে বলল, তোমাদের বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে শঠতার জাল বিস্তার করেছেন স্বার্থ হাসিল করার জন্য।
ফায়জুন্নেসা চিন্তা করলেন, মেয়ের মনে যে সন্দেহ ঢুকেছে তা কোনো যুক্তিতেই দূর করা যাবে না। তাই ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, মা হয়ে একটা কথা বলব, রাখবি?
বল। রাখার মতো হলে নিশ্চয় রাখব।
ম্যানেজারের শঠতা প্রমাণ করার জন্য এমন কোনো দুর্ব্যবহার ওনার সঙ্গে করবি না, যার ফলে চলে না যান।
চলে যাবেন কি করে? তোমাদের গুণ্ডাবাহিনী রয়েছে না? তুমিই তো একদিন বললে, বাইরের কেউ চৌধুরী স্টেটে চাকরি করতে এসে স্ব-ইচ্ছায় কখনও ফিরে যেতে পারে না?
তা বলেছি, তবে এটা বলি নি আমাদের গুণ্ডাবাহিনীতে যে কয়জন আছে, তারা ম্যানেজারের সঙ্গে পারবে না। তা ছাড়া তারা এখন ওনাকে পীরের মতো ভক্তি শ্রদ্ধা করে।
পীরের মতো ভক্তি শ্রদ্ধা করে আমি বুঝতে পেরেছি; কিন্তু আট দশজন গুপ্তা ওনাকে আটকাতে পারবে না বুঝতে পারছি না।
উনি যে শুধু মারামারীতে পারদর্শী তা নয়, শত্রুকে আক্রমণ করার ও নিজেকে রক্ষা করার এত বেশি কলা কৌশল জানেন, যা নাকি আমাদের গুণ্ডাবাহিনীও জানে না।
তুমি এসব জানলে কি করে?
হাশেমের কাছে শুনেছি।
স্বপ্না হেসে উঠে বলল, হাশেম চাচা বলল আর তুমি বিশ্বাস করলে?
তুই তো আমাকে কথাটা শেষ করতে দিলি না। বলছি শোন, হাশেমের মুখে যখন শুনলাম, ম্যানেজার শত্রুদের গ্রামে গিয়েছিলেন এবং দশ বারজন গুণ্ডার সঙ্গে লড়াই করে অক্ষত অবস্থায় ফিরে এসেছেন তখন তাকে জিজ্ঞেস করলাম তা কি করে সম্ভব?
হাশেম বলল, আমিও বিশ্বাস করি নি। তাই ঘটনাটা সত্য কিনা জানার জন্য আমাদের গুপ্তাবাহিনীর সঙ্গে পরামর্শ করে সুযোগ মতো একদিন হঠাৎ ম্যানেজারকে আক্রমণ করলাম। কিন্তু আমরা কেউ ওনাকে একটাও মোক্ষম আঘাত করতে পারলাম না। বরং উনিই আমাদের সবাইকে আহত করে বললেন, আপনারা আমাকে পরীক্ষা করছেন বুঝতে পেরেছি বলে বেঁচে গেলেন, নচেৎ কি করতাম আয়াই ভালো জানেন। আমরা ওনার কাছে মাফ চাইলাম। উনি বললেন, আল্লাহ সবাইকে মাফ করুন।
এবার নিশ্চয় বুঝতে পারছিস কেন কথাটা বললাম।
স্বপ্না বলল, ঠিক আছে তোমার কথা রাখার চেষ্টা করব। তারপর নিজের রুমে এসে ভাবল, এতবড় দক্ষ ফাইটার হয়েও আসার দিন যখন তার গালে চড় মারলাম তখন তো অনায়াসে হাতটা ধরে ফেলতে পারতেন অথবা প্রতিশোধ নিতে পারতেন? তা হলে এটাও কি শঠতার মধ্যে মহত্ত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু উনি তো তখন আমার পরিচয় জানতেন না? হঠাৎ তার মন বলে উঠল, তোমার মা ও নানির কাছে হয়তো তোমার কথা শুনেছে, তুমি দেখতে মায়ের মতো, তাদের কাছে তোমার আসার কথা শুনেছে, তাই অপরিচিত হলেও তোমাকে দেখেই চিনেছে। তা ছাড়া উনি তো নিজেই বলেছেন, তোমাকে অনেক দিন আগে থেকে চেনেন। কয়েকদিন চিন্তা করে স্বপ্না একটা প্ল্যান ঠিক করল। তারপর একদিন মা ও নানিকে বলল, আমি স্টেটের সবকিছুর দায়িত্ব নিতে চাই।
লুৎফা বেগম কিছু না বলে মেয়ের দিকে তাকালেন।
ফায়জুন্নেসা মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বললেন, স্টেটের দায়িত্ব যেমন ম্যানেজারের উপর আছে তেমনি থাকবে, তুমি শুধু অবজার্ভ করবে।
কেন? আমার উপর তুমি কি ভরসা করতে পারছ না, না আমাকে দায়িত্ব পালনে অনুপযুক্ত মনে করছ?
স্টেটের দায়িত্ব খুব কঠিন, যা পালন করা কোনো মেয়ের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই ভেবেছি, স্টেটের সর্বময় কর্তৃত্ব তোকে দেব। তোর কথামতো স্টেটের সবকিছু চলবে। তুই যা বলবি বা যা সিদ্ধান্ত নিবি, সবাইকে সেসব মেনে নিতে হবে। এমন কি ম্যানেজারকেও। অবশ্য স্টেটের ভালো মন্দের ব্যাপারে তোর সঙ্গে আলাপ আলোচনা করার অধিকার ম্যানেজারের থাকবে।
স্বপ্না নানিকে উদ্দেশ্য করে বলল, আপনি কিছু বলবেন না?
লুৎফা বেগম বললেন, আমি তোর মায়ের সঙ্গে একমত। তারপর মেয়েকে বললেন, মসজিদ মাদরাসার ব্যাপারটা স্বপ্নাকে জানাও।
ফায়জুন্নেসা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, কিছুদিন আগে ম্যানেজার আমাদের গ্রামে মসজিদ ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করার জন্য বলেছিলেন। ইদানিং বার বার তাগিদ দিচ্ছেন। আমি মসজিদ ও মাদরাসা কিভাবে পরিচালিত হবে জিজ্ঞেস করতে বললেন, মসজিদের খরচ কম, তাই মসজিদের নামে একটা জল মহল ওয়াকফ করে দিলে সেটার আয়ে চলবে। মাদরাসার খরচ বেশি, সেজন্য বাকি চারটে জলমহল মাদরাসার নামে ওয়াকফ করে দিলে সেগুলোর আয়ে মাদরাসা চলবে। আর মসজিদ ও মাদরাসা পরিচালনা করার জন্য একটা কমিটি থাকবে। কমিটির সদস্যরা মসজিদ, মাদরাসা ও জলমহলের আয় ব্যয়ের হিসাব রাখবে।
স্বপ্না শুনে খুব রেগে গেল। রাগ সামলে নিয়ে বলল, তোমরা কি ম্যানেজারের কথা মেনে নিয়েছ?
হ্যাঁ, মেনে নিয়েছি।
খুব আশ্চর্য হচ্ছি, ম্যানেজার যা বলেন মেনে নাও, এর কারণ কি বলবে?
এবার লুৎফা বেগম বললেন, বর্তমান ও ভবিষ্যতের চৌধুরী বংশধরদেরকে জিনেদের আক্রোশ হতে রক্ষা করার জন্য।
স্বপ্না রাগের সঙ্গেই বলল, আপনাকে আগেও বলেছি আর এখনও বলছি, ওসব আগের যুগের অশিক্ষিত মানুষের মনগড়া কথা। শুধু আমি কেন, এখন কোনো শিক্ষিত মানুষ এসব বিশ্বাস করে না। মৃণালবাবুর কাছে জেনেছি, ঐ পাঁচটা জলমহল থেকে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ টাকা আয় হয়। ওয়াকফ করে দিলে আমরা ঐ টাকা থেকে বঞ্চিত হব। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ম্যানেজার নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য জিনেদের কথা বলে মসজিদ মাদরাসা করতে চাচ্ছেন।
ফায়জুন্নেসা কিছু বলার আগে লুৎফা বেগম বললেন, আমরা ম্যানেজারকে অনেক ভাবে পরীক্ষা করে বিশ্বাস করেছি। তাই ওনার কথামতো ঐসব করতে রাজি হয়েছি। তবে ফাইন্যাল কিছু হয় নি। ফাইন্যাল হওয়ার আগে ওনাকে কেন তুই বিশ্বাস করতে পারছিস না এবং কেন ওনাকে ধূর্ত ও শঠ মনে করছি, তার প্রমাণ দেখাবি। তারপর তোকে স্টেটের সর্বময় কর্তৃত্ব দেয়া হবে।
স্বপ্না বলল, কিন্তু তার আগেই তো লক্ষ লক্ষ টাকা আয়ের জলমহলগুলো আপনারা ওয়াকফ করে দিচ্ছেন?
তাতে কি হয়েছে? জল মহলগুলো ছাড়াও চৌধুরী স্টেটের আয় কম না। তোর পূর্ব পুরুষরা অত্যাচার করে ভাগ চাষিদের কাছ থেকে যত না ফসল পেত, ম্যানেজার অত্যাচার না করে তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহারের মাধ্যমে তার থেকে অনেকগুন বেশি ফসল আদায় করছেন। তুইও যদি ম্যানেজারের মতো সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করিস, তা হলে আরও বেশি ফসল পাবি। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরের লোকেরা চৌধুরী স্টেটের মালিকদের ভয়ে তটস্থ থাকত, আর এখন এই ম্যানেজারকে তারা পীরের মতো ভক্তি শ্রদ্ধা করে। তুই যদি ম্যানেজারের পথ অনুসরণ করতে পারিস, তা হলে তোকেও সবাই ওনার মতো ভক্তি শ্রদ্ধা করবে। আমার আর কিছু বলার নেই। কথা শেষ করে লুৎফা বেগম নিজের রুমে চলে গেলেন।
স্বপ্না মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কিছু বলবে?
ফায়জুন্নেসা বললেন, না, তোর নানির সঙ্গে আমি একমত। তবে তোর নানি ম্যানেজারকে যতটা বিশ্বাস করে আমি ততটা করি না। কারণ আজিজকে বিশ্বাস করেছিলাম। ফলে আমাদের অনেক অর্থসম্পদ হারাতে হয়েছে। তাই আমি আর কাউকেই তেমন বিশ্বাস করি না। তবে ম্যানেজারকে কিছুটা করি। কারণ তিনি এমন কিছু কথা বলেছেন যা শুনে বিশ্বাস করতে হয়েছে। তাই মসজিদ ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠা ও সেগুলো পরিচালনা করার জন্য জলমহলগুলো ওয়াকফ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
সেই কথাগুলো আমাকে বলা যাবে না?
না। যা বলছি শোন, যে কারণে তুই ম্যানেজারকে সন্দেহ করিস, সেই কারণে আমার মনেও সন্দেহ জাগায়। মসজিদ মাদরাসা চালু হওয়ার পর জলমহল ওয়াকফ করা হবে। তার আগে যদি তুই সন্দেহের কারণ প্রমাণ করতে পারিস, তা হলে ওয়াকফ করব না।
মা তার দলে জেনে স্বপ্না যেমন খুশি হল তেমনি সাহসও পেল। বলল, তুমি দেখে নিও, আমি ম্যানেজারের শঠতা প্রমাণ করবই করব।
আগের পর্ব :
১. ট্রেন যখন নীলফামারী স্টেশনে পৌঁছাল
২. পৈত্রিক সূত্রে বিশাল সম্পত্তি
৩. কাগজে বিজ্ঞপ্তি দেখে
পরের পর্ব :
৫. ফায়জুন্নেসা ফায়সালকে ডেকে পাঠিয়ে
৬. মাস তিনেকের মধ্যে মসজিদ তৈরি