৩. কাগজে বিজ্ঞপ্তি দেখে
কাগজে বিজ্ঞপ্তি দেখে ঢাকা থেকে একজন এসেছে গুনে ফায়জুন্নেসা কিছুক্ষণ আগে এসেছেন। তার মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য পেপার ওয়েট ঠুকে শব্দ করেন। তারপর তাকে ঐভাবে তাকাতে দেখে বললেন, মনে হচ্ছে আপনি খুব অবাক হয়েছেন। এতে অবাক হওয়ার কি আছে? ওটা অনেক আগের ফটো। পাশের লোকটা আমার স্বামী আর ছোট মেয়েটি আমাদের একমাত্র সন্তান স্বপ্না। তারপর মৃদু হেসে বললেন, এখন অবশ্য অনেক বড় হয়েছে। ঢাকা ভার্সিটিতে জুওলজিতে মাস্টার্স করে পি.এইচ.ডি. করতে আমেরিকা গেছে।
সালাম দেয়া হয় নি মনে পড়তে ফায়সাল তাড়াতাড়ি সালাম দিল।
ফায়জুন্নেসা সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন।
ফায়সাল বসার পর হঠাৎ খেয়াল করল, দ্রমহিলার শরীরে এতটুকু বয়সের ছাপ পড়ে নি। বাঁধন শরীর, সুন্দর স্বাস্থ্য। গায়ে ওড়না থাকলেও পুরুষ্ঠ বক্ষ দুটো দেখে লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে নিল।
ফায়জুন্নেসা মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার সব কাগজপত্র এনেছেন?
জি, এনেছি। তবে সেগুলো দেখাবার আগে জানতে চাই, বর্তমানে আপনিই কি চৌধুরী স্টেটের মালিক।
তা জানা কি আপনার খুব প্রয়োজন? নিশ্চয়। যিনি আমাকে চাকরি দেবেন ওনার পরিচয় জানা উচিত নয় কি?
হুঁ, আমিই চৌধুরী স্টেটের একমাত্র মালিক ফায়জুন্নেসা। এবার নিশ্চয়। কাগজপত্র দেখাবেন?
ফায়সাল ব্রিফকেস খুলে কাগজপত্র বের করে টেবিলের উপর রাখল।
ফায়জুন্নেসা সেগুলো দেখে বললেন, ঠিক আছে। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, এত অল্প বয়সে দাড়ি রেখেছেন কেন?
দাড়ি রাখা সুন্নত হলেও ফকিহগণ ওয়াজেব বলেছেন। তাই প্রত্যেক মুসলমান পুরুষদের দাড়ি রাখা উচিত, এখানে বয়সের কথা অবান্তর।
শুনুন, এখানে চাকরি করার যে শর্তটা পেপারে দেয়া সম্ভব নয় বলে দিই নি। সেটা হল, আমি যেভাবে যা কিছু করতে বলব, দ্বিধাহীনচিত্তে করবেন। এতটু প্রতিবাদ করতে পারবেন না।
কিন্তু আপনি যদি অন্যায় কিছু করতে বলেন, তা হলে?
ফায়জুন্নেসা রেগে উঠে গম্ভীরস্বরে বললেন, তা হলেও করতে হবে।
ওনার রাগকে পাত্তা না দিয়ে ফায়সাল বলল, আর যদি কাউকে অন্যায় ভাবে হত্যা করতে বলেন?
ফায়জুন্নেসা আরও রেগে উঠে বললেন, তাও করতে হবে।
ওনার রাগকে এবারও পাত্তা না দিয়ে ফায়সাল বলল, তা হলে আপনিও শুনে রাখুন, আমি জীবনে কখনও কোনোরকম এতটুকু অন্যায় কিছু করি নি। তাই আপনার কাছে চাকরি করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এক্ষুনি বিদায় হচ্ছি বলে কাজগপত্রগুলো ব্রিফকেসে ভরে হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল।
ফায়জুন্নেসা কঠিন কণ্ঠে বললেন, নিজেকে কি ভাবেন আপনি?
মানুষের ঘরে যখন জন্মেছি তখন মানুষই ভাবি।
মানুষ মাত্রই মানুষের ঘরে জন্মায়, জন্তু জানোয়ারের ঘরে জন্মায় না।
কিন্তু মানুষের ঘরে জন্ম নিয়েও অনেকের স্বভাব-চরিত্র জন্তু-জানোয়ারের মতো হয়। হিংস্র জন্তু-জানোয়ার যেমন শুধু নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছুই বুঝে না, অনেক মানুষ তেমনি নিজের স্বার্থের জন্য ন্যায় অন্যায়ের বাদ বিচার করে না। যাকগে, এসব কথা বলে লাভ নেই। এখন রিকশা পাব বলে মনে হয় না, হেঁটেই স্টেশনে যেতে হবে। কথা শেষ করে ফায়সাল যেতে উদ্যত হলে ফায়জুন্নেসা কঠিন কণ্ঠে বললেন, চৌধুরী বাড়িতে এসে কেউ নিজের ইচ্ছায় চলে যেতে পারে
ফায়সালের তখন আসার সময় স্টেশনে বৃদ্ধের কথা মনে পড়লেও ভয় পেল। বলল, কেউ না পারলেও আমি পারব ইনশাআল্লাহ বলে দু’পা এগিয়ে দেখল, দরজায় তেলচকচকে লাঠি হাতে একজন ভয়ালদর্শন লোক তার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে। লোকটার গায়ের রং মিশমিশে কালো, ইয়া বড় মোচ, দেখতে যেমন বিশ্রি, তার হাসিটাও তেমনি বিশ্রি। তাকে দেখে একটা ভয়মিশ্রিত শিহরণ ফায়সালের শরীরে খেলে গেল। তার মন তাকে সাবধান করল, তুমি লাঠিখেলা জান না, ঐ লাঠির একটা বাড়ি খেলে মা বলার আগেই শেষ হয়ে যাবে। তড়িৎ বুদ্ধি খাটিয়ে লোকটাকে বলল, একজন নিরস্ত্র মানুষকে অত্র দিয়ে ঘায়েল করায় কোনো বাহাদুরী নেই।
ফায়সালের কথা শেষ হওয়া মাত্র লোকটা লাঠি ফেলে দিয়ে মোচে তা দিতে লাগল।
ফায়সাল ব্রিফকেসটা মারার ভঙ্গিতে তার দিকে ছুঁড়ে দিতে লোকটা যখন খেলনার মতো লুফে নিতে গেল, ঠিক তখনই ছুটে এসে তার তলপেটের নিচে প্রচণ্ড জোরে একটা পা দিয়ে আঘাত করল।
লোকটা ব্রিফকেস ধরার আগেই ফায়সালের লাথি খেয়ে ব্যথায় নীল হয়ে তলপেট ধরে বসে পড়ল। আর ব্রিফকেসটা তার মাথায় বাড়ি খেয়ে ছিটকে পড়ল।
ফায়সালকে তার দিকে এগোতে দেখে ফায়জুন্নেসা খিলখিল করে হেসে উঠে বললেন, থাক, ওকে আর আঘাত করবেন না। ব্রিফকেসটা নিয়ে এসে বসুন। চৌধুরী স্টেটের ম্যানেজার হওয়ার উপযুক্ত কিনা জানার জন্য আপনার ইন্টারভিউ নিলাম। আপনি ফুলমার্ক পেয়ে পাশ করেছেন। চাকরির জন্য যে শর্তের কথা বলেছি সেটাও ইন্টারভিউর প্রশ্ন ছিল। তারপর দু’হাতে তালি বাজালেন।
সঙ্গে সঙ্গে দু’জন ষণ্ডামার্কা লোক এসে লাঠিওয়ালা লোকটাকে ধরে নিয়ে গেল।
ফায়জুন্নেসার কথা শুনে ফায়সাল অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিল।
তাই দেখে ফায়জুন্নেসা মৃদু হেসে বসতে বলে বললেন, ইন্টারভিউটা বেশ কঠিন হয়েছে, তাই না? কি করব বলুন, মেয়ে হয়ে এতবড় স্টেট চালান কত কঠিন, আশা করি, কয়েকদিনের মধ্যে বুঝতে পারবেন। তারপর আবার তালি বাজালেন।
এবার আধা বয়সী দু’জন মেয়ে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়াল। ফায়সালকে দেখিয়ে ফায়জুন্নেসা তাদেরকে বললেন, ইনি নতুন ম্যানেজার, তোমরা ওনাকে ওনার রুমে নিয়ে গিয়ে সবকিছু দেখিয়ে দিয়ে খাওয়ার ব্যবস্থা কর। তারপর ফায়সালের দিকে তাকিয়ে বললেন, কাল সকালে আপনার কাজ বুঝিয়ে দেয়া হবে। এখন ওদের সঙ্গে যান।
রুমে এসে ফায়সাল খুশি হল। বেশ বড় রুম, ডবল খাট, খাটের বিছানাপত্র পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, তিনটে জানালা, একটা দক্ষিণ দিকে, একটা পূর্ব দিকে ও একটা উত্তর দিকে। খাটের পরে প্রায় পাঁচ হাতের মতো ফাঁকা মেঝে। একপাশে একটা টেবিল ও দুটো চেয়ার, বুকসেল্ক ও কাপড় রাখার স্টিলের আলনা। খাট বরাবর পূর্ব দিকের জানালার পাশে ড্রেসিং টেবিল আর উত্তর পাশে বাথরুমের দরজা। বাথরুমসহ পুরোরুম মোজাইক করা। এমন কি দেয়ালও মোজাইক করা। ফায়সালের মনে হল, পুরো বিল্ডিংটাই হয় তো মোজাইক করা।
কাজের মেয়ে দুটো তাকে রুমে পৌঁছে দিয়ে যখন চলে যাচ্ছিল তখন ফায়সাল তাদেরকে বলে দিয়েছিল, এক ঘণ্টা পরে খাবার নিয়ে আসতে। রুমে। ঢুকে একজন কাজের মেয়ে লাইট ও ফ্যানের সুইচ অন করে দিয়েছিল। ফায়সাল ফ্যানের স্পীড বাড়িয়ে দিয়ে জামা কাপড় পাল্টে বাথরুমে গোসল করতে ঢুকল। ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামায পড়ে ছ’টার বাসে উঠে রংপুরে পৌঁছায়। তারপর ট্রেনে করে নীলফামারী স্টেশনে নেমে রিকশায় এসেছে। এত দীর্ঘ পথ জার্নি করে সে খুব ক্লান্ত। তাই শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে আধ ঘণ্টা ধরে গোসল করল। তারপর সঙ্গে আনা নামাযের মসালা বিছিয়ে এশার নামায পড়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে যখন মাথা আঁচড়াচ্ছিল তখন দরজার বাইরে থেকে একজন কাজের মেয়ের গলা পেল, “ম্যানেজার সাহেব দরজা খুলুন, খাবার নিয়ে এসেছি।”
ফায়সাল দরজা এমনি ভিড়িয়ে বাথরুমে ঢুকেছিল। বলল, দরজা খোলা আছে, খাবার দিয়ে যান।
দু’জন খাবার নিয়ে এসে টেবিলের উপর রাখল, তারপর একজন চলে গেল আর অন্যজন মেঝের একপাশে মুখ নিচু করে বসে রইল।
ফায়সাল রুমে আসার সময় মানসিক টেনসানে ছিল বলে মেয়ে দুটোকে তেমন লক্ষ্য করে নি। এখন তাদেরকে দেখে মনে হল, এরা ঠিক কাজের মেয়ে নয়, কোনো ন্দ্র ঘরের মহিলা। বয়স প্রায় চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ, দেখতে শুনতেও ভালো। একজন চলে যাওয়ার পর ফায়সাল সঙ্গে আনা দস্তরখান মেঝেয়। বিছিয়ে টেবিল থেকে খাবারগুলো নামাতে গেলে বসা মেয়েটা তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে বলল, আপনি বসুন, আমি নামিয়ে দিচ্ছি।
খাবারের মেনু দেখে ফায়সালের মনেই হল না, অজপাড়াগাঁয়ে এসেছে। খাওয়া শেষ হতে মেয়েটি যখন থালা বাটি গুচ্ছাছিল তখন জিজ্ঞেস করল, এখানে কতদিন কাজ করছেন?
কাজের মেয়েদেরকে কেউ আপনি করে বলে না। নতুন ম্যানেজারকে বলতে শুনে মেয়েটি অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল।
কি হল? আমার কথার জবাব দিলেন না যে?
মেয়েটি মুখ নিচু করে বলল, আমার জন্ম এখানেই?
তারমানে আপনার মাও এখানে কাজ করতেন?
মেয়েটি শুধু মাথা নাড়াল।
আর আপনার সঙ্গে যিনি এসেছিলেন?
আমার মতো ওরও জন্ম এখানে?
কি নাম আপনার?
আকলিমা।
নাম শুনে ফায়সাল অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমার এক খালার নাম আকলিমা। উনি মারা গেছেন। আমি আপনাকে খালাম্মা বলে ডাকব।
আঁৎকে উঠে আকলিমা বলল, না-না, অমন কাজ করবেন না। মালেকিন জানলে আমাকে আস্ত রাখবেন না বলে ত্রস্তপদে চলে গেল।
ফায়সাল বুঝতে পারল, ফায়জুন্নেসা খুব কড়া মহিলা। চাকর চাকরানিরা ওনাকে ভীষণ ভয় পায়।
পরের দিন সকালে আকলিমা নাস্তা নিয়ে এল না, অন্য মেয়েটি নিয়ে এল।
ফায়সাল জিজ্ঞেস করল, আপনার নাম কি?
এই মেয়েটির নাম তাসলিমা। নাম না বলে বলল, দেখুন আমরা বাড়ির চাকরানি। আমাদেরকে আপনি করে বলবেন না, কোনো কিছু জিজ্ঞেসও করবেন না। আকলিমা বোকা। তাই কাল সে ভুল করলেও আমি করব না।
ফায়সাল বুঝতে পারল, এরা চাকরানী হলেও শিক্ষিতা। বলল, আমার তো মনে হয়, আকলিমা খালাম্মা কোনো ভুল করেন নি। আর আমি তো ছোট বড় সবাইকেই আপনি করে বলি।
সবাইকে বললেও আমাদেরকে বলবেন না। মালেকিন জানতে পারলে আপনার বিপদ হবে।
ফায়সাল মৃদু হেসে বলল, বিপদ হোক, তবু সবাইকেই আপনি করে বলব।
তাসলিমা আর কিছু না বলে চুপ করে রইল। ফায়সালের নাস্তা খাওয়া শেষ হতে বাসন পেয়ালা নিয়ে চলে গেল।
চৌধুরী বাড়ির সব থেকে পুরানো চাকর হাসেম। বয়স ষাটের উপর। লম্বা চওড়া পেটাই শরীর, গায়ের রঙ শ্যামলা। এত বয়স হয়েছে, দেখলে মনে হয় না। দু’চারজন যুবক তার কাছে কিছুই না। লাঠি খেলায় ও শুটিংএ পারদর্শী। তার কাছে সব সময় একটা রিভলবার থাকে। তবে সে কথা লুৎফা বেগম ও ফায়জুন্নেসা ছাড়া কেউ জানে না। সে হল চাকর-চাকরানিদের সর্দার।
নাস্তা খেয়ে ফায়সাল পাজামা পাঞ্জাবি পরে বসে বসে ভাবছিল, এখানে তাকে কি কাজ করতে হবে। কি জন্যে আগের ম্যানেজার খুন হলেন? এমন সময় হাসেম এসে বলল, চলুন, মালেকিন ডাকছেন।
ফায়সাল তার আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারল, এই লোক ঠাণ্ডা মাথায় যে কোনো লোককে খুন করতে পারে। সালাম দিয়ে বলল, আপনার পরিচয়?
হাসেম সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আমার পরিচয় মালেকিন দেবেন।
হাসেমের সঙ্গে ফায়সাল যে রুমে ঢুকল সেটা একটা হল রুম। আট-দশজন লোক টেবিল চেয়ারে বসে কাজ করছে। একপাশে দশফুট বাই বারফুটের কাচের পার্টিশান দেয়া একটা রুম হলেও ভিতরে কি আছে না আছে ফায়সাল দেখতে পেল না। দরজায় দামি পর্দা ঝুলছে।
ফায়সালকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে হাসেম কাচের রুমটা দেখিয়ে বলল, ওখানে মালেকিন আছেন, আসুন। তারপর দরজার কাছে এসে বলল, আপনি ভিতরে যান।
ফায়সাল পর্দা ফাঁক করে বলল, আসতে পারি?
ফায়জুন্নেসা তার দিকে তাকিয়ে বলল, আসুন।
ফায়সাল ঢুকে সালাম দিল।
ফায়জুন্নেসা সালামের উত্তর দিয়ে বসতে বলে কলিং বেল বাজালেন।
হাসেম ঢুকে মাথা নিচু করে দাঁড়াল।
ফায়জুন্নেসা হাসেমের পরিচয় দিয়ে ফায়সালকে বললেন, এই লোক আপনাকে চৌধুরী স্টেটের যেখানে যা আছে সব কিছু ঘুরিয়ে দেখাবে এবং কিভাবে সবার সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে জানাবে। মোট কথা ও যা বলবে, বিনা দ্বিধায় তা আপনাকে করতে হবে। বাই দা বাই, আপনার কি রিভলবার বা পিস্তল আছে?
ফায়সাল বলল, না।
ঠিক আছে, আপনাকে একটা রিভলবার দেয়া হবে, তবে এখন নয়, যখন বুঝব দেয়া দরকার তখন দেব।
আমি এসেছি চাকরি করতে, রিভলবার দিয়ে কি করব? ওসব আমার দরকার নেই।
ফায়জুন্নেসা বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, কথার মাঝখানে কথা বলবেন না। আমার কথা শেষ হওয়ার পর যা বলার বলবেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, আপনি লাঠিখেলা জানেন?
জি, না।
সাজ্জাদ লেঠেল আপনার সঙ্গে সব সময় থাকবে। তাকে বলে দেব তার কাছে শিখে নেবেন। শুটিং নিশ্চয় জানেন?
জি, জানি।
ফায়জুন্নেসা হাসেমকে বললেন, মৃণালবাবুকে ডেকে নিয়ে আয়। একটু পরে মৃণাল এসে কপালে হাত ঠেকিয়ে বললেন, সালাম মালেকিন।
ফায়জুন্নেসা ফায়সালের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে মৃণালবাবুকে বললেন, ম্যানেজার সাহেবের সঙ্গে অফিস স্টাফদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে কার কি কাজ জানিয়ে দেবেন। সেই সঙ্গে ম্যানেজার সাহেবকেও ওনার কাজ বুঝিয়ে দেবেন। তারপর ফায়সালকে বললেন, উনি অফিসের বড় বাবু। অফিসের যাবতীয় কাজ ওনার সঙ্গে পরামর্শ করে করবেন। মৃণালবাবু, এবার আপনি আসুন।
মৃণালবাবু চলে যাওয়ার পর ফায়সালের দিকে তাকিয়ে বললেন, আশ-পাশের গ্রামের কিছু লোক অনেকদিন থেকে আমাদের সঙ্গে শত্রুতা করে চলেছে। তারই জের হিসাবে আমাদের ক্ষতি করতে চেষ্টা করে। সে সময় আমরা প্রতিরোধ করি। ফলে উভয় পক্ষের অনেকে হতাহত হয়। আবার কোনো কোনো ম্যানেজারকে ক্যাপচার করে স্বার্থ সিদ্ধি করার চেষ্টাও করে। অবশ্য কোনো ম্যানেজারকেই ক্যাপচার করতে পারে নি। তাই হয় তাকে মেরে ফেলে, নচেৎ এখান থেকে চলে যেতে বাধ্য করে। এবার নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, কেন রিভলবার রাখার ও লাঠি-খেলা শেখার কথা বললাম।
ফায়সাল বলল, শত্রুতা মিটিয়ে মিত্ৰতা করা যায় না?
ফায়জুন্নেসা রেগে উঠে বললেন, সেটা আমাদের ব্যাপার আমরা দেখব, আপনি এ ব্যাপারে কোনো কথা বলবেন না।
কিন্তু মানুষের সঙ্গে শত্রুতা জিইয়ে রাখা উচিত নয়। বিশেষ করে মুসলমানদের জন্য তো নয়ই। হাদিসে আছে, আমাদের নবী করিম (দঃ) বলিয়াছেন, “হে মুসলমানগণ আমার পরে তোমরা কাফেরদের কার্যকলাপে লিপ্ত হইও না যে, তোমরা একে অপরকে হত্যা করতে আরম্ভ কর।”
আর আল্লাহ কুরআন পাকে বলিয়াছেন, “আর যদি মুসলমানদের দুই দল পরস্পর (ঝগড়া-বিবাদ) যুদ্ধে লিপ্ত হইয়া পড়ে, তবে তাহাদের মধ্যে মীমাংসা ও পুনর্মিলন করিয়া দাও, অনন্তর যদি তাহাদের এক দল অন্য দলের উপর বাড়াবাড়ি করে, তবে সেই দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর-যেই দল বাড়াবাড়ি করে যে পর্যন্ত না তাহারা আল্লাহর আদেশের দিকে ফিরিয়া আসে, অতঃপর যদি তাহারা প্রত্যাবর্তিত হয়, তবে উভয়ের মধ্যে ন্যায়ের সহিত সন্ধি করাইয়া দাও; আর সুবিচারের প্রতি লক্ষ্য রাখিও; নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়বানদিগকে পছন্দ করেন।”
এখন আপনিই বলুন, মুসলমানদের মধ্যে কি শত্রুতা থাকা উচিত?
কুরআন হাদিসের কথা শুনে ফায়জুন্নেসা আরো রেগে ওঠে বললেন, মনে রাখবেন, আমার এখানে আপনি চাকরি করতে এসেছেন, ওয়াজ করার জন্য। নয়। আর কখনও যদি এসব ব্যাপার নিয়ে বলেন, তা হলে…..বলে রাগে কথাটা শেষ করতে পারলেন না।
ফায়সাল ওনার রাগকে গ্রাহ্য করল না। মৃদু হেসে বলল, একজন মানুষ জেনে অথবা না জেনে যদি ধ্বংসের পথে অগ্রসর হয়, তা হলে অন্য মানুষের উচিত তাকে বাধা দেয়া। যদি না দেয়, তা হলে সে মানুষই না। সে ব্যাপারেও আল্লাহ কুরআনপাকে বলিয়াছেন, “আর তোমাদের মধ্যে এমন একদল এইরূপ থাকা আবশ্যক, যেন তাহারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করে এবং নেক কাজের আদেশ করিতে ও মন্দ কাজের বারণ করিতে থাকে, আর এইরূপ লোক পূর্ণ সফলকাম।”
একজন মুসলমান হয়ে যদি কুরআনের আদেশ না মানি, তা হলে কাল হাশরের মাঠে আল্লাহর কাছে মুখ দেখাব কি করে?
ফায়েজুন্নেসা ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছেন। হাসেমকে ইশারায় কিছু বলে সেখান থেকে চলে গেলেন।
হাসেম রাগের সঙ্গে ফায়সালকে বলল, এই যে ম্যানেজার সাহেব, মালেকিন নিষেধ করা সত্ত্বেও ওয়াজ করছেন কেন? আর কখনও করলে কল্লা মটকে দেব। এবার মালেকিন যে চেয়ারে বসেছিলেন ওখানে গিয়ে বসুন। একটু পরে মৃণালবাবু এসে আপনাকে সবকিছু বুঝিয়ে দেবেন। কথা শেষ করে হাসেম চলে গেল।
.
আজ চারমাস ফায়সাল এখানে কাজ করছে। এর মধ্যে চৌধুরী স্টেটের সবকিছু দেখেছে, সাজ্জাদের কাছে লাঠিখেলায় পারদর্শী হয়েছে, কয়েকদিন আগে একটা রিভলবারও পেয়েছে। অফিসের কাজ সকাল নটা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত করে। বিকেলে সাজ্জাদকে নিয়ে গ্রামে ঘুরতে বেরোয়।
সাজ্জাদের বয়স পঁয়ত্রিশের মতো। লেখাপড়া তেমন জানে না। তার বাবা লেঠেলদের সর্দার ছিল। ছেলে সাজ্জাদকে লাঠিখেলায় দক্ষ করেছে।
সাজ্জাদের বাবাও চৌধুরী বাড়িতে চাকরি করত। বাবা মারা যাওয়ার পর সাজ্জাদকে ইনসান চৌধুরী চাকরি দেন। ফায়সাল কৌশলে সাজ্জাদকে হাত করে চৌধুরী বাড়ির অনেক খবর জেনেছে। ফায়জুন্নেসার মা লুৎফা বেগম বেঁচে আছেন। তার কাছেই জানার পর ওনার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা দিনের পর দিন বেড়ে চলেছে। কিন্তু কিভাবে করবে চিন্তা করে ঠিক করতে পারছে না। আরো জেনেছে পাশের গ্রামের আজিজ কয়েক বছর এই স্টেটের ম্যানেজার ছিল। মালেকিন তাকে বরখাস্থ করার পর থেকে সে শত্রুতা করে আসছে। মাঝে মাঝে চৌধুরী স্টেটের জমির ফসল লুট করতে আসে লেঠেল বাহিনী নিয়ে। সে সময় উভয় বাহিনীর সঙ্গে মারামারি হয়। উভয় বাহিনীর অনেকে হতাহত হয়।
ফায়সাল সিদ্ধান্ত নিল যেমন করে হোক শত্রুতার অবসান ঘটাতে হবে। তার আগে এ বাড়ির সবাইকে ধর্মের পথে আনতে হবে। ছ’মাসের মধ্যে মৃণালবাবু ছাড়া অফিসের সব স্টাফকে ও বাড়ির সব চাকর-চাকরানি এমন কি হাসেমকে পর্যন্ত কুরআন-হাদিসের বাণী শুনিয়ে ধর্মের পথে আনতে সক্ষম হল। এখন সবাই তাকে পীরের মতো মানে।
ফায়জুন্নেসা মাঝে মধ্যে যখন মৃণালবাবুর কাছে ফায়সালের কাজ কর্মের খোঁজ নেন তখন মৃণালবাবু ফায়সালের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, ওনার আগে এত ভালো ছেলে কেউ ম্যানেজার হয়ে আসে নি।
কুলসুম ফায়জুন্নেসার বিশ্বস্ত চাকরানি। তাকে সব সময় মাথায় কাপড় দিতে দেখে একদিন ফায়জুন্নেসা জিজ্ঞেস করলেন, মাথায় কাপড় দিয়ে থাকিস কেন?
কুলসুম বলল, মেয়েদের মাথায় কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা ইসলামের হুকুম।
অবাক হয়ে ফায়জুন্নেসা আবার জিজ্ঞেস করলেন, ইসলামের হুকুমের কথা তোকে কে বলেছে?
ম্যানেজার সাহেব বলেছেন। শুধু আমাকে নয়, এ বাড়ির সব চাকর চাকরানিদেরকে ইসলামের কথা বলে সে সব মেনে চালাবার চেষ্টা করছেন।
ঠিক আছে, হাসেমকে আমার কাছে আসতে বল।
একটু পরে হাসেম এসে বলল, ডেকেছেন মালেকিন?
হ্যাঁ, গুনলাম ম্যানেজার নাকি তোদের সবাইকে ধার্মিক বানাবার চেষ্টা করছেন?
আপনি ঠিকই শুনেছেন। এতদিন আমরা ধর্মের কোনো কিছুই জানতামও না মানতামও না। ম্যানেজার সাহেবের কাছে সেসব জেনে আমরা মেনে চলছি। আমার কি মনে হয় জানেন মালেকিন, ম্যানেজার সাহেব আল্লাহর একজন খাস বান্দা। সাজ্জাদের কাছে শুনলাম, কয়েকদিন আগে ম্যানেজার সাহেব পাশের গ্রামে গিয়েছিলেন। সে কথা আজিজ সাহেব জানতে পেরে গুণ্ডা বাহিনী লেলিয়ে দিয়েছিলেন। উনি তাদের সঙ্গে লড়াই করে অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসেন। আপনিই বলুন, আল্লাহর খাস বান্দা না হলে কি এটা সম্ভব হত?
ফায়জুন্নেসা খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, সাজ্জাদ সঙ্গে ছিল না?
না, তবে ওর কোনো দোষ নেই। ও সঙ্গে যেতে চেয়েছিল, ম্যানেজার সাহেব নেন নি।
ম্যানেজারের সাহসতো কম না, একা একা দুশমনের গ্রামে গেছেন? ওনাকে বলে দিবি আর কখনও যেন না যান। আর শোন, আজ সন্ধ্যের পর দোতলার ড্রইংরুমে ওনাকে নিয়ে আসবি। সে কথা এখনই গিয়ে বলবি।
জ্বি বলব বলে হাসেম অনুমতি নিয়ে চলে গেল।
.
লুৎফা বেগম মেয়ের কার্যকলাপে অসন্তুষ্ট হয়ে যখন বুঝিয়ে ও বকা-বকি করে তার মতিগতি শুধরাতে পারলেন না তখন থেকে তিনি সংসার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। চৌধুরী স্টেটের ও সংসারে কি হচ্ছে না হচ্ছে কোনো] খোঁজ খবর রাখেন না। বেশিরভাগ সময় ইবাদত বন্দেগী করে কাটান। একদিন ওনার খাস চাকরানি ফরিদাকে নামায পড়তে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হঠাৎ আজ নামায পড়লি যে? তোকে তো কোনো দিন নামায পড়তে দেখি নি।
ফরিদা বলল, আমাদের নতুন ম্যানেজার শুধু আমাকে নয় এ বাড়ির সবাইকে নামায ধরিয়েছেন।
আরো অবাক হয়ে লুৎফা বেগম বললেন, সবাইকে মানে? তোদের মালেকিনকেও?
মালেকিন তো ম্যানেজার সাহেবের ওয়াজ শোনেন না। শুনলে নিশ্চয় পড়তেন।
ম্যানেজার মৌলবী না কি যে, তোদেরকে ওয়াজ করে।
মনে হয় মৌলবী।
তা কখন তাদের কাছে ওয়াজ করে?
রাত দশটা থেকে এগারটা পর্যন্ত।
অতরাতে কোথায় ওয়াজ করে?
ওনার ঘরে। পুরুষরা ওনার ঘরের মেঝেয় বসে আর আমরা মেয়েরা দরজার সামনে বারান্দায় বসি। জানেন বড় মা, হাসেম মিয়া বলেন, ম্যানেজার সাহেব আল্লাহর খাস বান্দা।
এসব কথা তোদের মালোকন জানে?
তা বলতে পারব না।
ফরিদার কথা শুনে লুৎফা বেগম ম্যানেজারের উপর খুব সন্তুষ্ট হয়ে দোয়া করলেন, “আল্লাহ তুমি ওকে দুশমনদের হাত থেকে হেফাজত করো, ওর দ্বারা ফায়জুন্নেসাকে হেদায়েত করো।” ভেবে রাখলেন, সময় সুযোগ মতো ম্যানেজারের সঙ্গে আলাপ করবেন।
মাগরিবের নামাযের পরে হাসেম ফায়সালকে দোতলার ড্রইংরুমে নিয়ে এসে বসতে বলে চলে গেল। ফায়সাল আসবাবপত্র দেখে বুঝতে পারল, এ নিচতলার ড্রইংরুমের থেকে আরো উন্নত। প্রায় দশ মিনিট পর ফায়জুন্নেসাকে ঢুকতে দেখে দাঁড়িয়ে সালাম দিল।
ফায়জুন্নেসা সালামের উত্তর দিয়ে বসতে বলে নিজেও বসলেন। তারপর বললেন, শুনলাম আপনি নাকি ওয়াজ নসিহত করে সবাইকে হেদায়েত করে ফেলেছেন?
ফায়সাল বলল, হেদায়েত করার মালিক একমাত্র আল্লাহ। আমি শুধু আল্লাহ ও তাঁর রসুল (দঃ)-এর বাণী সবাইকে শুনিয়েছি। আর এটা করা প্রত্যেক জ্ঞানী মুমিন মুসলমানের কর্তব্য। নচেৎ কাল কেয়ামতের ময়দানে জ্ঞানীদেরকে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। ফ93
আপনিতো ভার্সিটি থেকে পলিটিক্যাল সাইলে মাস্টার্স করেছেন, কুরআন হাদিসের জ্ঞান পেলেন কি করে?
প্রত্যেক মুসলমানের কুরআন হাদিসের জ্ঞান অর্জন করা অবশ্য কর্তব্য। শুধু মাদরাসার ছাত্ররা কুরআন হাদিসের জ্ঞান অর্জন করবে আর স্কুল, কলেজ ও ভার্সিটির ছাত্ররা করবে না, এটা অত্যন্ত ভুল ধারণা। মুসলমান হিসাবে তাদের পাঠ্য বইয়ের পড়ার অবসর সময়ে ধর্মীয় জ্ঞান যেমন অর্জন করতে হবে তেমনি সেই জ্ঞানের অনুশীলনও করতে হবে। আল্লাহর মেহেরবাণীতে আমি তাই করেছি বলে সেই জ্ঞান প্রসার করার চেষ্টা করছি। স্কুল, কলেজ ও ভার্সিটির ছেলেমেয়েরা তা করছে না বলে তারা ধর্মের জ্ঞান যেমন পাচ্ছে না তেমনি অনুশীলনও করছে না। আপনার কথাই ধরুন না, আপনি যদি স্কুল ও কলেজে পড়ার সময় ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করতেন ও অনুশীলন করতেন, তা হলে আপনার ও আপনার বাড়ির সবার জীবন ধারা অন্য রকম হত।
ফায়জুন্নেসা বললেন, এসব কথা এখন থাক। যা বলছি শুনুন, কয়েকদিনের মধ্যে একটা জলমহলের মাছ ধরে বিক্রি করা হবে। খবর পেয়েছি আমাদের শত্রুরা মাছ লুট করতে আসবে। আপনি আমাদের বাহিনী নিয়ে তৈরি থাকবেন যেন তারা তা করতে না পারে।
ফায়সাল মৃদু হেসে বলল, আমি সে কথা জানি এবং সেভাবে প্রস্তুতি নিয়েই আছি। ও নিয়ে আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। ইনশাআল্লাহ আমরা সফলতা লাড করব।
ফায়জুন্নেসা শত্রু পক্ষের খবর জানার জন্য বশির নামে এমন একজনকে নিযুক্ত করেছেন, যার বাড়ি আজিজের গ্রামে এবং সে আজিজের বাড়ির চাকর। বশির আর দশ বার বছরের ছেলে সাগিরের দ্বারা খবরটা পাঠিয়েছে। ম্যানেজার খবর জানে শুনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি জানলেন কি করে? এ ম্যানেজার হিসাবে স্টেটের শত্রু মিত্রের সব খবর রাখা আমার কর্তব্য নয়
হ্যাঁ কর্তব্য। এবার আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।
আপনি যেভাবে জেনেছেন।
আরো অবাক হয়ে ফায়জুন্নেসা বললেন, মানে?
মানে আপনার মতো আমারও গুপ্তচর আছে। এরপর আর কোনো প্রশ্ন করবেন না। কারণ উত্তর দিতে পারব না।
ফায়জুন্নেসা একটু রাগের সঙ্গে বললেন, ভুলে যাচ্ছেন কেন, আপনি আমার বেতনভুক্ত একজন কর্মচারী। কর্মচারীর উচিত নয় মালিককে কোনো প্রশ্ন করতে নিষেধ করা।
আপনিও ভুলে যাচ্ছেন কেন, এতবড় স্টেটের ভালো মন্দের দায়িত্ব যার উপর, সে একজন বেতনভুক্ত কর্মচারী হলেও তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতার উপর মালিকের হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়।
ফায়জুন্নেসা রাগ সামলাতে না পেরে কঠিন কণ্ঠে বললেন, আপনি কিন্তু সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন।
মনে হচ্ছে আমার কথায় অপমান বোধ করে খুব রেগে গেছেন। আমি কিন্তু আপনাকে অসন্তুষ্ট করার জন্য কথাটা বলি নি, বলেছি স্টেটের ভালোর জন্য। প্রত্যেকের জীবনে কিছু না কিছু গোপনীয়তা থাকে। স্বেচ্ছায় না বললে জোর খাটিয়ে জানতে চাওয়া কারো উচিত নয়। আপনি জানেন কি না জানি না, আপনার মেয়ে স্বপ্নার রেজাল্ট বেরিয়েছে, উনি খুব শিঘ্রি ফিরে আসছেন। এখন আপনি নিশ্চয় জানতে চাইবেন, এ কথা আমি জানলাম কি করে? এর উত্তরও আমি দিতে পারব না। এজন্য আমার উপর আপনার অসন্তুষ্ট হওয়া কিংবা জোর করে জানতে চাওয়া উচিত হবে না।
স্বপ্না তিন মাস আগে মাকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিল, তার ফাইন্যাল পরীক্ষা শেষ, রেজাল্ট বেরোবার পর আসবে। চিঠি পড়ে ফায়জুন্নেসা মা লুৎফা বেগমকে কথাটা জানিয়েছিলেন। ওনারা দুজন ছাড়া আর কেউ জানে না, জানা সম্ভবও নয়। এখন ম্যানেজারের মুখে পা খুব শিল্লি ফিরে আসছে শুনে এত অবাক হলেন যে, অনেকক্ষণ কথা বলতে পারলেন না।
ফায়সাল মৃদু হেসে বলল, আমার কথা শুনে খুব অবাক হয়েছেন বুঝতে পারছি। কিন্তু কি করে জানতে পারলাম দয়া করে জিজ্ঞেস করবেন না। ও হ্যাঁ, কিছুদিন থেকে একটা কথা আপনাকে বলব ভাবছি। আশপাশের কয়েকটা গ্রামের মধ্যে মাদরাসা নেই। যার ফলে ছেলেমেয়েরা স্কুল কলেজে পড়লেও ধর্মের জ্ঞান কিছুই পাচ্ছে না। তাই এই গ্রামে একটা মাদরাসা করতে চাই। আপনার অনুমতি পেলে আমি সে ব্যাপারে অগ্রসর হব।
ফায়জুন্নেসার তখন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, স্বপ্না বাড়ি আসার কথা ম্যানেজার জানলেন কি করে? তা হলে উনি কি সত্যিই আল্লাহর খাস বান্দা? দাদির মুখে শুনেছেন, যারা আল্লাহর খাস বান্দা, তাদেরকে আল্লাহ আগে ভাগে অনেক কিছু জানিয়ে দেন। যদি তাই হয়, তা হলে ম্যানেজার কি আমার সম্পর্কে সবকিছু জানেন? গভীরভাবে এইসব চিন্তা করছিলেন বলে ফায়সালের মাদরাসা করার কথা শুনতে পেলেন না।
ওনাকে চুপ করে থাকতে দেখে ফায়সাল বলল, আমার কথার উত্তর দেবেন না?
লুৎফা বেগম ফরিদার মুখে দোতলার ড্রইংরুমে ম্যানেজারের সঙ্গে ফায়জুন্নেসা আলাপ করছে শুনে তাকে দেখার জন্য এসে এতক্ষণ পর্দার আড়াল (থকে তাদের আলাপ শুনছিলেন আর মাঝে মাঝে পর্দা ফাঁক করে ম্যানেজারকে দেখছিলেন। উনি দোতলার বারান্দা থেকে বাড়ির সামনের ক্ষেতে লোকজনদের দদারকী করতে তাকে কয়েকবার দেখেছেন। কাছ থেকে দেখে ওনার অন্তর জুড়িয়ে গেছে। এত সুন্দর ছেলে এর আগে কখনও দেখেন নি। তার কথা বার্তা শুনে মুগ্ধ হয়েছেন। স্বপ্নার খুব শিঘ্রি ফেরার কথা শুনে তিনিও খুব অবাক হয়েছেন। শেষে মাদরাসার কথা শুনে খুব খুশি হলেন। মেয়ে কিছু বলছে না দেখে ভিতরে ঢুকে তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ম্যানেজারের কথার উত্তর দিচ্ছিস না কেন?
মায়ের কথায় ফায়জুন্নেসা সম্বিত ফিরে পেয়ে ফায়সালের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি কি জিজ্ঞেস করেছেন?
ফায়সাল মাদরাসা করার ব্যাপারে যা বলেছিল, আবার বলল।
ফায়জুন্নেসা বললেন, এ ব্যাপারে পরে আলাপ করব। তারপর মাকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি কি ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলবে?
লুৎফা বেগম বললেন, হ্যাঁ।
তা হলে আমি এখন যাই বলে ফায়জুন্নেসা চলে গেলেন।
ওনাদের কথা বার্তায় ফায়সাল যদিও বুঝতে পারল, ইনি ফায়জুন্নেসার মা, তবু বলল, আপনার পরিচয় জানতে পারলে খুশি হতাম।
আমি লুৎফা বেগম, ফায়জুন্নেসার মা।
ফায়সাল প্রথমে দাঁড়িয়ে সালাম দিল, তারপর এগিয়ে এসে কদমবুসি করে বলল, বসুন।
লুৎফা বেগম বসার পর ফায়সাল বসে বলল, আপনাকে দেখার ও আপনার সঙ্গে আলাপ করার ইচ্ছা অনেক দিনের। আজ আল্লাহ সেই ইচ্ছা পূরণ করে ধন্য করলেন, সেজন্য তাঁর শুকরিয়া আদায় করছি।
তার আচরণে লুৎফা বেগম আরো মুগ্ধ হলেন। বললেন, আপনার কথা চাকর-চাকরানিদের কাছে শুনে আমারও আপনাকে দেখার অনেক দিনের ইচ্ছা। ফায়জুন্নেসার সঙ্গে আপনার আলাপ দরজার বাইরে থেকে শুনেছি। তারপর ভিতরে ঢুকে আপনার আচরণ দেখে শুনে মনে হচ্ছে, এখানে চাকরি করতে যে বায়ডাটা দিয়েছেন, তা সত্য নয়। আসল পরিচয় বললে আমিও আপনার মতো খুশি হতাম।
ফায়সাল বুঝতে পারল, ইনি শুধু উচ্চশিক্ষিতা নন, বুদ্ধিমতীও। বলল, আপনাকে আমি খুশি করার চেষ্টা করব। তার আগে আমার একান্ত অনুরোধ আমাকে আপনি করে বলবেন না, তুমি করে বলবেন। আফটার অল আমি তো আপনার নাতির বয়সী।
ঠিক আছে, তাই বলব। এবার তোমার আসল পরিচয়টা বল।
আসল পরিচয় এখন কিছুতেই বলা সম্ভব নয়, সে জন্য ক্ষমা চাইছি। তবে আল্লাহ রাজি থাকলে কিছুদিনের মধ্যে সবাই জানতে পারবেন।
তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে। এখানে চাকরি করতে আসা তোমার আসল উদ্দেশ্য নয়। আসল উদ্দেশ্যটা কি বলতে চাই?
দুঃখিত তাও বলা সম্ভব নয়। সে জন্য আবার ক্ষমা চাইছি।
আমার অনুমান সত্য না মিথ্যে, এতটুকু অন্তত বল।
সত্য।
লুফা বেগমের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে মিলিয়ে গেল। বললেন, শুনেছি, তুমি নাকি অনেক কিছু জান, চৌধুরী বংশের পূর্ব ইতিহাসও জান?
দয়া করে আমাকে আর কোনো প্রশ্ন করবেন না, কারণ আমার পক্ষে উত্তর দেয়া সম্ভব নয়।
লুৎফা বেগম রেগে উঠে বললেন, তোমার সাহস তো কম না, কার কথা অগ্রাহ্য করছ জান?
জি, জানি। মরহুম ইনসান চৌধুরীর বেগম আপনি। ইচ্ছা করলে আমাকে কঠিন শাস্তি দিতে পারেন। আর এটাও জানি, আমার উপর যতই রেগে যান না কেন, এই মুহূর্তে কঠিন শাস্তি কেন, লঘু শাস্তিও দেবেন না।
কি করে বুঝলে?
আপনি বিচক্ষণ মহিলা, আপনার ভালো মন্দ বিচার করার ক্ষমতাও প্রখর। রাগের অভিনয় করে আমাকে ভয় দেখিয়ে আমার না বলা কথাগুলো জানতে চাচ্ছেন।
ম্যানেজারের কথা এনে অংফা বেগম এত অবাক হলেন যে, অনেকক্ষণ কথা বলতে পারলেন না। কারণ তিনি তাই-ই চেয়েছিলেন। সামলে নিয়ে বললেন, সত্যি করে বলতো তুমি মানুষ না অন্য কিছু।
নিজেই পরীক্ষা করে দেখুন না বলে ফায়সাল লুৎফা বেগমের পায়ে হাত রেখে বলল, আমি যে মানুষ এবার বিশ্বাস হল তো?
ঠিক আছে, উঠে বস।
ফায়সাল বসল না, দাঁড়িয়ে উঠে বলল, এবার যাওয়ার অনুমতি দিন।
আর একটু বস, দু’একটা কথা বলব।
ফায়সাল বসার পর বললেন, জেনেছি তুমি এ বাড়ির সবাইকে কুরআন হাদিসের বাণী শুনিয়ে ধর্মের পথে এনেছ; কিন্তু তোমার মালেকিনের জন্য কিছু কর নি কেন? না তাকে খুব ভয় পাও?
মুমিনরা আল্লাহকে ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করে না। মালেকিনের ব্যাপারে একেবারেই যে কিছু করি নি তা নয়। যতটুকু করেছি তার ফলাফল কিছু দিনের মধ্যে দেখতে পাবেন।
শুনে খুশি হলাম বলে লুৎফা বেগম বললেন, এবার তুমি এস।
.
আজ তিন দিন আজিজের গ্রামের মসজিদের ইমাম সাহেবের বাড়িতে সাদা চুল দাড়িওয়ালা একজন বৃদ্ধ মুসাফির রয়েছেন। উনি দিন রাতের মধ্যে বেশিরভাগ সময় মসজিদে ইবাদত বন্দেগী করেন। দিনে রোযা থাকেন। ইমাম সাহেব মসজিদেই ইফতার পাঠান। এশার নামাযের পর ইমাম সাহেবের সঙ্গে ওনার বাড়িতে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া করে আবার মসজিদে চলে আসেন। ইমাম সাহেব এই গ্রামেরই লোক। বয়স প্রায় সত্তরের কাছা-কাছি। উনি কুরআনের হাফেজ ও পরহেজগার। ইমামতি করে কোনো টাকা পয়সা নেন না।
ইমাম সাহেব একদিন জোহরের নামাযের পর একজন সুফি ধরনের বৃদ্ধ লোককে মসজিদে বসে তসবিহ পড়তে দেখে সালাম বিনিময় করে পরিচয় জানতে চাইলেন। তখনও যে সব মুসুল্লি মসজিদে ছিল, তারা ইমাম সাহেবকে একজন অপরিচিত লোকের সঙ্গে আলাপ করতে দেখে কাছে এস বসল।
লোকটি বললেন, আমি মুসাফির মানুষ। আমার নিজস্ব কোনো বাড়ি ঘর নেই। দেশ ভ্রমণ করা ও আল্লাহর ইবাদত করাই আমার একমাত্র কাজ।
মুসাফিরকে ইমাম সাহেবের খুব ভালো লাগল, বললেন, আমার সঙ্গে বাড়িতে চলুন, খাওয়া-দাওয়া করবেন।
মুসাফির ইমাম সাহেবের কানের কাছে মুখ নিয়ে অনুচ্চস্বরে বললেন, রোযা আছি।
কথাটা শুনে ওনার উপর ইমাম সাহেবের ভক্তি বেড়ে গেল। উনিও মুসাফিরের কানে কানে বললেন, তা হলে আমার বাড়িতে ইফতার করবেন, রাতে খানাও খাবেন।
একইভাবে মুসাফির বললেন, আমি কারো বাড়িতে খাই না। তবে আপনাকে পরহেজগার মনে হচ্ছে, তাই আপনার বাড়িতে খাব। কিন্তু যে কয়েকদিন এখানে থাকব, বাজার অনুপাতে আপনাকে টাকা নিতে হবে।
ইমাম সাহেও একইভাবে বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রসুল (দঃ) মুসাফিরের খিদমত করতে বলেছেন। আমি তাদেরকে সন্তুষ্ট করার জন্য আপনার সব রকমের খিদমত করতে চাই। আর আপনি তা থেকে বঞ্চিত করার জন্য বখিলের পরিচয় দিচ্ছেন।
মুসাফির আর কিছু না বলে চুপ করে রইলেন।
ইমাম সাহেব লোকজনদের নিয়ে মসজিদের বাইরে এসে বললেন, তোমরা ওনার সঙ্গে বেয়াদবের মতো কথাবার্তা বলো না। উনি সুফি মানুষ, দেশ ভ্রমণ করে বেড়াচ্ছেন।
একজন মুসুল্পি জিজ্ঞেস করল, আপনারা কানে কানে কি কথা বললেন?
দু’জনের মধ্যে যে কথাবার্তা হয়েছে, ইমাম সাহেব সেসব বলে বললেন, উনি যে অলি-আল্লাহ ধরনের লোক, তা নিশ্চয় বুঝতে পারছ?
মুসুল্লিরা তা স্বীকার করে যে যার পথে চলে গেল। দু’তিন দিনের মধ্যে মুসাফিরের কথা গ্রামময় ছড়িয়ে পড়ল।
আজিজের বাড়ি থেকে মসজিদ বেশ খানিকটা দূরে। তাই কিছু দিন থেকে নামায পড়তে শুরু করলেও মসজিদে না গিয়ে ঘরে পড়েন। তবে জুম্মা পড়তে মসজিদে যান। এক কান দু’কান করে ওনারও কানে কথাটা পড়েছে। ভেবেছেন, জুম্মা পড়তে গিয়ে মুসাফিরের সঙ্গে আলাপ করবেন এবং রাতে খাওয়ার জন্য দাওয়াত দেবেন।
আজ জুম্মাবার। অন্যান্য দিনের চেয়ে নিয়মিত মুসুল্লি ছাড়াও অনেকে এসেছে মুসাফিরকে এক নজর দেখার জন্য। আজিজ ও তার ছেলেও এসেছেন।
প্রতি জুম্মাবারে আযানের পর ইমাম সাহেব কিছুক্ষণ ওয়াজ করেন। আজ ওয়াজ করার শেষে বললেন, মুসাফির হয়তো দু’একদিনের মধ্যে চলে যাবেন। তাই নামাযের পর আপনাদেরকে কিছু বলবেন। সবাই থাকবেন।
নামাযের পর মুসাফির দাঁড়িয়ে প্রথমে সালাম দিলেন। তারপর আল্লাহর প্রশংসা ও রসুল (দঃ)-এর উপর কয়েক মর্তবা দরুদ পাঠ করে বললেন, আমি আল্লাহর এক নাদান বান্দা। আল্লাহ মেহেরবাণী করে আমাকে কিছু এলেম হাসিল করিয়েছেন। আল্লাহ কালামপাকে কলেমা, নামায, রোযা, হজ্ব ও যাকাত যেমন ফরজ করেছেন, তেমনি যারা দ্বীনি এলেম হাসিল করেছেন তাদের উপরও ফরয করেছেন, সেই দ্বীনি এলেম মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার এবং সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করার। সেই ফরয আদায়ের জন্য আমি যেখানেই যাই সেখানেই মানুষকে ধর্মের কথা জানিয়ে অসৎ কাজ করতে নিষেধ করি ও সৎ কাজ করার কথা বলি।
আজকাল মাওলানা হাফেজ ও সাধারণ লোকেরা সুন্নতি পোশাক হিসাবে লম্বা পীরান পরেন যার কুল টাখনুর উপরে পড়ে। এমন কি টাখনুর নিচেও চলে যায়। এতে সুন্নত আদায় হয় না, বরং কঠিন গুনাহ হয়। কারণ পাজামা, লুঙ্গি ও পিরানের ঝুল পায়ের গোচ পর্যন্ত থাকা সুন্নত। আর টাখনুর উপর (টাখনু যেন দেখা যায়) পর্যন্ত পাজামা, লুঙ্গি ও পিরানের ঝুল থাকলে জায়েজ হবে। যে কোনো পোশক টাখনুর নিচে ঝুলিয়ে পরলে মানুষের মনে অহঙ্কার জন্মায়। অহঙ্কার মুসলমানদের জন্য হারাম। হাদিসে আছে, আমাদের নবী করিম (দঃ) বলিয়াছেন, “পায়ের গোড়ালীর নিয়ে পায়জামার যে অংশ ঝুলিতে থাকে, উহা দোযখের অগ্নিতে অবস্থিত।”[৪]
এখন কেউ যদি বলেন, আমি অহঙ্কার বশত গোড়ালীর নিচে ঝুলিয়ে কাপড় পরি না, তবে তাকে বলব, গোড়ালীর উপরে কাপড়ের কুল রেখে পরে দেখুন আপনার মনের অবস্থা কি হয়। অনেক ইমাম সাহেব জামাতে নামায পড়ার সময় ইকামতের আগে মুসুল্লীদের উদ্দেশ্যে বলেন, সবাই গোড়ালীর উপর কাপড়ের ঝুল তুলে নেন। মুসুল্লীরা তাই করে থাকেন। ফলে মুসুল্লীরা মনে করেন, শুধু নামায পড়ার সময় গোড়ালীর উপর কাপড়ের ঝুল থাকা দরকার, অন্য সময় দরকার নেই। তাই নামায শেষ করে তারা কাপড়ের ঝুল গোড়ালীর নিচে আবার ঝুলিয়ে দেন।
আসলে ইমাম সাহেবরা যদি অন্য সময়ে হাদিসের বাণী শুনিয়ে সব সময় গোড়ালীর উপর কাপড়ের ঝুল রেখে পরতে বলতেন, তা হলে হয়তো মুসুল্লীদের ভুল ধারণা হত না।
আর একটা কাজ মুসুল্লীরা করে থাকেন, তা হল নামায পড়ার জন্য মসজিদে এসে সামনের কাতারে জায়গা থাকা সত্ত্বেও নিজের সুবিধেমতো জায়গায়, অর্থাৎ জানালার ধারে অথবা ফ্যানের নিচে নামায পড়তে শুরু করে দেন অথবা বসে থাকেন। ফলে পরে যারা আসেন তারা তাদের গায়ের উপর থেকে সামনের কাতারে যান। এরকম করা মোটই উচিত নয়। এ সম্পকে দু’টো হাদিস বলছি, রসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, “প্রথম সারিকে প্রথম পূর্ণ করিবে অতঃপর তাহার সংলগ্ন পিছনের সারিকে। যাহা কম থাকে তাহা যেন সর্বশেষ সারিতে থাকে।”[৫]
একদা রসুলুল্লাহ (দঃ) বলিলেন, “লোক সর্বদা প্রথম সারি হইতে পিছনে থাকিতে চাহিবে, ফলে আল্লাহও তাহাদিগকে পিছাইতে পিছাইতে দোযখ পর্যন্ত পিছাইয়া দিবেন।”[৬]
এ জামাতে নামায পড়ার সময় গায়ে গা ঠেকিয়ে দাঁড়াতে হবে, ফঁক রেখে দাঁড়ান নিষেধ। হাদিসে আছে, রসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, “তোমরা সারি সমূহে পরস্পরে মিলিয়া মিশিয়া দাঁড়াইবে এবং উহাদিগকে (অপর নামাযীদিগকে) নিকটে নিকটে রাখিবে। তোমাদের ঘাড় সমূহকে সমপর্যায়ে সোজা রাখিবে। সেই আল্লাহর শপথ, যাহার হাতে আমার জীবন রহিয়াছে। নিশ্চয় আমি শয়তানকে দেখি, সে সারির ফাঁক সমূহে প্রবেশ করে যেন কালো ভেড়ার বাচ্চা।” [৭]
অনেকে জেনে না জেনে গরুমের জন্য হোক অথবা অহঙ্কার বশত হোক গায়ে গা না ঠেকিয়ে ফাঁক রেখে দাঁড়ান, এটা উক্ত হাদিস মোতাবেক একেবারেই উচিত নয়।
এবার অন্য কথায় আসি, প্রত্যন্ত অঞ্চলে খ্রিস্টান মিশনারী খুলে হাসপাতাল ও স্কুল প্রতিষ্ঠা করে বিনা পয়সায় গরিবদের চিকিৎসা করাচ্ছে, গরিব ছেলেমেয়েদের বই পুস্তক দিয়ে এমন কি একবেলা খাইয়ে স্কুলে লেখাপড়া করাচ্ছে। আবার অনেক দুঃস্থ মহিলা ও পুরুষকে আর্থিক সাহায্য করছে। তাদের অনেকের চাকরি দিচ্ছে। তারপর অতি কৌশলে তাদেরকে ধর্মান্তরিত করে খ্রিস্টান করছে। আর মুসলমানরা ভাইয়ে ভাইয়ে জমি জায়গা নিয়ে ঝগড়া মারামারি দলাদলি ও মামলা করে অধঃপতনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মুসলমানরা লোভ, হিংসা ও অহঙ্কারের বশবর্তী হয়ে এমন কোনো জঘন্য কাজ নেই যে, করছে না। খ্রিস্টানরা যে কাজ করছে, সেই কাজ মুসলমানদের করতে হবে এবং করা একান্ত উচিত।
যাদের স্বচ্ছল অবস্থা তারা সম্মিলিতভাবে এসব কাজ করে প্রতিটি ঘরে ইসলামের জ্ঞান ছড়িয়ে দিয়ে খ্রিস্টান মিশনারীদের মোকাবেলা করতে হবে। তা না করে যদি শুধু দুনিয়াতে গরিবদের রক্ত শুষে কি করে আরো বড়লোক হবেন, কি করে গরিবদের উপর মাতবরী করবেন, কি করে নিজের শান শওকাত বাড়াবেন, এসব কাজে ব্যস্ত থাকেন, তা হলে কাল হাশরের মাঠে আল্লাহর কাছে খুব কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে আর দুনিয়াতেও তার ফল ভোগ করতে হবে।
একদিন মুসলমানরা কুরআন ও হাদিসের জ্ঞান অর্জন করে ও সেসব অনুসরণ-অনুশীলন করে জ্ঞান-বিজ্ঞানে, শৌর্যে-বীর্যে ও সভ্যতায় পথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি ছিল। আর বর্তমানে মুসলমানরা কুরআন-হাদিসের বাণী ত্যাগ করে ইহুদী-খ্রিস্টানদের পদলেহন করে আত্মতৃপ্ত করছে। ফলে সারা দুনিয়াতে মুসলমানদের উপর আল্লাহর গযব নিপতীত হয়েছে। যাদের পদলেহন করে আত্মতৃপ্ত করছে, সেই ইহুদী ও খ্রিস্টানরা মুসলমান রাষ্ট্রগুলোর প্রশাসকদের উপর প্রভুত্ব করছে? এক মুসলিম রাষ্ট্রের সঙ্গে অন্য মুসলিম রাষ্ট্রের যুদ্ধ বাধিয়ে মুসলমানদের শিরদাঁড়া গুড়িয়ে দিচ্ছে, মুসলমানদের সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে অত্যাচারের স্টিম রোলার চালাচ্ছে। তবু মুসলমানদের হুঁশ হচ্ছে না, তাদেরকেই প্রভুত্বের আসনে বসিয়ে নিজেরা দাসে পরিণত হয়েছে শুধু নিজেদের গদি রক্ষার জন্য।
যাই হোক, মুসলমানদের অবক্ষয়ের কথা বলতে গেলে অনেক কথা বলতে হবে। আপনারা অনেকে না খেয়ে নামায পড়তে এসেছেন। আপনাদের আর কষ্ট দেব না। শেষে আর একটা কথা বলে ইতি টানব, আমাদের মন থেকে হিংসা বিদ্বেষ, দলাদলি ও লোভ-লালসা দূর করে একে অন্যের বিপদে সাহায্য করতে হবে। ইসলামের জ্ঞান অর্জনের জন্য মাদরাসা ও পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মাতব্বরদের ন্যায় বিচার করতে হবে। যদিও অপরাধী বাপ, ভাই বা ছেলে হোক না কেন। মনে রাখবেন প্রতিটি কাজের জন্য, সবাইকে হাশরের মাঠে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। তাই প্রতিটি মুমীন মুসলমানকে মউত, কবর, হাশর ও জাহান্নামের কথা চিন্তা করে দুনিয়াদারী করতে হবে। এসব কাজে মসজিদের ইমাম সাহেবদেরকে অগ্রভূমিকা নিতে হবে। যদি ওনারা মনে করেন, বেতন নিয়ে শুধু নামায পড়াবেন আর মিলাদ পড়িয়ে ইনকাম করে সুখে দিন কাটাবেন, স্বাধীনভাবে দ্বীনের হক কথা বললে মসজিদ কমিটি ছাঁটাই করে অন্য ইমাম রাখবেন, তা হলে বিরাট ভুল করবেন। কারণ এরকম মনে করলে আপনি আল্লাহর গোলাম না হয়ে মসজিদ কমিটির গোলাম হয়ে গেলেন।
প্রায় দেখা যায় প্রতিটি মসজিদের কমিটির সদস্যগণের দ্বীনি এলেম নেই। তাই ওনারা কমজোর ঈমানওয়ালা ইমাম সাহেবদেরকে গোলাম বানিয়ে রেখেছেন। ঐসব ইমাম সাহেবরা স্বাধীনভাবে দ্বীনের কথা বলতে পারেন না চাকরি চলে যাওয়ার ভয়ে। সারা পৃথিবীতে মুসলমানদের অধঃপতনের অন্যতম প্রধান কারণ হল, তারা আল্লাহর গোলামী না করে দুনিয়াদারী হাসিলের জন্য শয়তানের গোলামী করছে। মনে রাখবেন, যারা আল্লাহর গোলামী পরিত্যাগ করে শয়তানের গোলামী করবে, কিছু দিনের জন্য তারা সুখ ভোগ করলেও অচিরে তাদের উপর দুনিয়াতে যেমন আল্লাহ নানারকম বিপদ আপদ ও গযব নাজিল করবেন, তেমনি আখেরাতেও তাদেরকে জাহান্নামে দাখেল করবেন। সবশেষে মুরুব্বীদের ও যারা ছেলেমেয়ের বাবা, তাদের কাছে একান্ত অনুরোধ, আপনারা দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করে সেইমতো নিজেকে ও পরিবারের সবাইকে চালিত করার চেষ্টা করুন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে দ্বীনকে বোঝার ও সেই মতো চলার তওফিক দান করুন, আমিন। এবার আপনারা আসুন।
মুসাফিরের ওয়াজ আজিজের মনে রেখাপাত করল। সবাই চলে যাওয়ার পর বললেন, আজ রাতে আমার বাড়িতে খাবেন আর যে কয়েকদিন এখানে থাকবেন, আমার বাড়িতেই থাকবেন। আপনার কাছ থেকে আরো মূল্যবান কথা শুনব।
মুসাফির বললেন, মাফ করবেন, আমি কারো বাড়িতে খাই না। অপারগ অবস্থায় খেলেও টাকা দিয়ে খাই। আপনি এই গ্রামের মানি, গুণী ও গণ্যমান্য লোক। খাওয়ার জন্য টাকা দিলে আপনাকে অপমান করা হবে। কাল ফজরের নামায পড়ে এখান থেকে চলে যাব। তাই আজ এশার নামাযের পর আপনার বাড়িতে যাব। কিন্তু একথা কাউকে জানাবেন না। তবে আপনার পরিবারের সবাইকে জানাতে পারেন। ওনারা যেন রুমের বাইরে থেকে আমার কথা শুনতে পান, সে ব্যবস্থা করবেন। আবার বলছি, আমার খাওয়ার ব্যবস্থা করবেন না। আমি খাওয়া-দাওয়া করেই যাব।
আজিজ বললেন, খাওয়া-দাওয়া না করলেও আপনি যাবেন শুনে খুব খুশি হয়েছি। তারপর মোসাফাহা ও সালাম বিনিময় করে চলে গেলেন।
মুসাফির যখন আজিজের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছাল তখন রাত প্রায় দশটা। আজিজ বৈঠকখানায় ওনার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। দরজার কাছে এসে সালাম দিতে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে সালামের উত্তর দিলেন। তারপর সাদরে অভ্যর্থনা করে ভিতরে নিয়ে এসে বসালেন। আজিজ ঘরের সবাইকে বলে দিয়েছিলেন, মুসাফির আসার পর তোমরা বৈঠকখানার দরজা জানালার কাছে থেকে ওনার কথা শুনবে। ওনার আসার খবর পেয়ে সবাই বৈঠকখানার বাইরে এসে জমা হল।
মুসাফির বললেন, আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারব না। কয়েকটা কথা বলছি শুনুন, মানুষ সাধারণত ধন-সম্পদ, মান-সম্মান ও সুখ শান্তি কামনা করে। কিন্তু সবাই কি তা পায়? পায় না। ততটুকু পায়, যতটুকু আল্লাহ তার তকদিরে লিখে রেখেছেন। তাই যার যতটুকু আছে, তাতেই সন্তুষ্ট থাকা ও আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা উচিত। হাদিসে আছে, “অল্পে সন্তুষ্টি বৃহৎ সম্পত্তির মালিক।” তাই বলে বড় হবার চেষ্টা করবে না, তা নয়। তবে সেই চেষ্টা সৎ পথে হতে হবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, যারা বড় হতে চায়, তারা সৎ-অসৎ বিচার না করে অবৈধ পথে উপার্জন করছে। অথচ অবৈধ পথে উপার্জন করা হারাম। আপনার বিষয়-সম্পদ অনেক, এসব যদি সৎ পথের উপার্জনে হয়, তা হলে খুবই ভালো, আর যদি অসৎ পথে হয়ে থাকে, তা হলে খুবই খারাপ। বেশিরভাগ মানুষ শয়তানের প্রলোভনে পড়ে যেমন অন্যায় পথে রুজী-রোজগার করে, তেমনি এমন অনেক গর্হিত কাজও করে, যেগুলো আল্লাহ হারাম করেছেন। আর যারা হারাম পথে রুজী-রোজগার করেন তাদের কোনো ইবাদত আল্লাহ কবুল করেন না। তাই সবাইয়ের উচিত সব রকমের অন্যায় পরিত্যাগ করে অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে তাঁর ও তাঁর রসুল (দঃ) এর বিধান মেনে চলা। মনে রাখবেন, শুধু ধন-সম্পদের মালিক হলেই মান-সম্মান ও সুখ-শান্তি পাওয়া যায় না। সবকিছু পাওয়া না পাওয়া আল্লাহপাকের ইচ্ছ। তিনি ইচ্ছা করলে মুহূর্তে ধনীকে গরিব ও গরিবকে ধনী করে দিতে পারেন। আল্লাহ কুরআনপাকে বলিয়াছেন, “আল্লাহ যাকে ইচ্ছা প্রচুর রেযে দান করেন এবং (যাহাকে ইচ্ছা) সংকীর্ণ করিয়া দেন; আর ইহারা পার্থিব জীবনের উপার্জন করে, অথচ এই পার্থিব জীনব আখেরাতের তুলনায় অতি তুচ্ছ সামগ্রী ত্নি কিছুই নহে।”[৮] যাই হোক, এবার আপনাকে অনুরোধ করব, খোকসাবাড়ির চৌধুরীদের সঙ্গে আপনাদের যে বিরোধ অনেক দিন থেকে চলে আসছে, তা মিটিয়ে ফেলুন। নচেৎ আপনি বেঁচে থাকতে যতটা না ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, মারা যাওয়ার পর আপনার বংশধররা আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শুধু তাই নয়, আখেরাতে কি হবে তা আল্লাহ ভালো জানেন।
এতক্ষণ মুসাফিরের কথা শুনে খুশি হলেও শেষের কথা শুনে আজিজের মনে যেমন সন্দেহ হল, তেমনি রেগে গেলেন। রাগের সঙ্গে বললেন, কে আপনি? চৌধুরী বংশের সঙ্গে আমাদের বিরোধের কথা জানলেন কি করে?
মুসাফির মৃদু হেসে বললেন, রাগ করছেন কেন? আমি আল্লার এক নাদান বান্দা। পথভ্রষ্ট মানুষকে পথে ফিরিয়ে আনা আমার কাজ। শুনুন, শুধু চৌধুরী বংশের বিরোধের কথা নয়, বিরোধের উৎপত্তি ও তার পরের সমস্ত ঘটনা, এমন কি ইনসান চৌধুরীর মেয়ে কেন স্বামীর প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন না এবং ওনার স্বামীর মৃত্যু রহস্যও আমি জানি। আরও জানি আপনি মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে হয়েও এত সয়-সম্পদের মালিক হলেন কি করে? আরো জানি, চৌধুরী বংশের প্রথম পুরুষের আদিবাস ছিল ডোমারে। জিনেদের একঘড়া সোনার মোহর পেয়ে খোকসাবাড়ি এসে বসবাস শুরু করেন। সেই জিনেরা চৌধুরী বংশের পরপর তিন পুরুষকে মেরে একই জলমহলে ফেলে রেখেছিল। আমার কথা শুনে যদি মনে করেন, আমি চৌধুরী বংশের লোক অথবা তাদের হয়ে ওকালতি করতে এসেছি, তা হলে ভুল করবেন। আমার কথা বিশ্বাস না হলে আপনার তো গুণ্ডা বাহিনী আছে, তাদের দিয়ে এই বুড়োকে মেরে সেই জলমহলে ফেলে দেবেন। তা হলে সবাই মনে করবে, জিনেরা মুসাফিরকেও মেরে ফেলে রেখেছে। পুলিশ কেসও আর হবে না। মুসাফিরের কথা শুনে রাগ পড়ে গিয়ে আজিজের মনে ভয় ঢুকে গেল। অনেকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলেন না।
মুসাফির ওনার মনের ভাব বুঝতে পেরে বললেন, আর দেরি করতে পারছি, এবার আসি বলে দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, যাওয়ার সময় একটা কথা বলে যাই, বিশ্বাস করা না করা আপনার ব্যাপার। কয়েকদিনের মধ্যে চৌধুরীরা যে জলমহলে মাছ ধরবে, সেখানে আপনার গুণ্ডা বাহিনী পাঠাবেন না। পাঠালে গুণ্ডারা কেউ প্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে পারবে কি না সন্দেহ। আর একটা কথা, যদি আমার প্রতি আপনার সামন্যতম বিশ্বাস থাকে, তা হলে অতি সত্বর চৌধুরীদের ম্যানেজারের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। উনি মানুষ হলেও ওনার চরিত্র ফেরেস্তার মতো। শুনেছেন কিনা জানি না, উনি ম্যানেজার হয়ে আসার পর চৌধুরী বাড়ির আবহাওয়া পাল্টে গেছে। উনি বাড়ির চাকর-চাকরানি থেকে সবাইকেই দ্বীনের পথে এনেছেন। ইনসান চৌধুরীর ডাকসাইটের মেয়ে ফায়জুন্নেসা পর্যন্ত ম্যানেজারের কাছে নত হয়েছেন। উনিও চান আপনাদের সঙ্গে চৌধুরী বংশের মিটমাট হয়ে যাক। আর একটা কথা, মিটমাট হয়ে যাওয়ার পর এ বছরই হজ্ব করে আসুন। আর যা কিছু গর্হিত কাজ করেছেন, সেজন্যে তওবা করে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করে মাফ চাইবেন। কথা শেষ করে রুম থেকে বেরিয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগলেন।
আজিজের মনে তখন ভয়ের ঝড় বইছে। ওনার মনে হল, মুসাফির মানুষ নয়, অন্য কিছু। তা না হলে তার ও চৌধুরী বংশের সবকিছু জানলেন কি করে? এই সব চিন্তা করে ভয়ে কাঁপতে লাগলেন।
আজিজের স্ত্রী জাহেদা স্বামীর সব ক্রিয়াকলাপ জানেন। প্রথম প্রথম প্রতিবাদ করেছিলেন কিন্তু আজিজ রেগে গিয়ে ভীষণ মারধর করতেন। তাই জাহেদা পরে আর প্রতিবাদ করেন নি। আজ বৈঠকখানার বাইরে থেকে মুসাফিরের কথা শুনে তিনিও খুব ভয় পেয়েছেন। মুসাফির চলে যাওয়ার পর ভিতরে এসে স্বামীর ভয়ার্ত মুখ ও তাকে কাঁপতে দেখে সাহস দেয়ার জন্য বললেন, মনে হয়, মুসাফির মানুষ নয়, চৌধুরী বংশের উপর যে জিনের আক্রোশ সেই জিন। উনি আমাদের ভালো চান, তাই এইসব কথা বলে সাবধান করে গেলেন।
জাহেদার সাথে ছেলে মহসীন ও বৌ আমেনাও এসেছে। খোকসাবাড়ির চৌধুরীদের সঙ্গে শত্রুতার কথা মহসীন জানে। কিন্তু শক্রতার কারণ জানে না। একদিন বাবাকে সে কথা জিজ্ঞেস করেছিল। আজিজ বলেছিলেন, ওসব তোর জানার দরকার নেই। আজ মুসাফিরের কথা শুনে শত্রুতার কারণ অল্প কিছু আন্দাজ করতে পারল। তার মনে হল, চৌধুরীরা তাদের সঙ্গে শত্রুতা করে না, বরং বাবাই তাদের সঙ্গে শত্রুতা করে আসছে। মা থেমে যেতে বলল, আমারও তাই মনে হচ্ছে বাবা। মুসাফির যা কিছু করতে বলে গেলেন, তাই করলে হত না?
আজিজ ছেলে বৌকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমরা এখান থেকে যাও। তারা চলে যাওয়ার পর স্ত্রীকে বললেন, আমাকে ধরে ঘরে নিয়ে চল, খুব দুর্বল লাগছে, দাঁড়াতে পারছি না। -.
যে রাতে ফায়জুন্নেসা ও লুফা বেগমের সাথে ফায়সালের আলাপ হয়, তার পরের দিন সকাল থেকে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। চৌধুরী বাড়ির চাকর-চাকরানি থেকে ফায়জুন্নেসা ও ত্যা বেগম পর্যন্ত খুবই উদ্বিগ্ন। ফায়জুন্নেসা গুণ্ডাবাহিনীকে ফায়সালের খোঁজ করতে বললেন। তারা আশপাশের কয়েকটা গ্রামে খোঁজ করেও পেল না। দু’তিন দিন খোঁজ না পেয়ে ফায়জুন্নেসা খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। ভাবলেন, তা হলে কি আজিজের গুণ্ডারা তাকে খুন করে লাশ গুম করে ফেলেছে।
লুৎফা বেগম মেয়েকে বললেন, অত ভালো ছেলে আমি জীবনে দেখি নি।
ফায়জুন্নেসা বললেন, আমিও দেখি নি।
আমার কি মনে হয় জানিস, আজিজের গুণ্ডারা তাকে খুন করেছে।
আমারও তাই মনে হচ্ছে, তবে বিশ্বাস করতে পারছি না। ম্যানেজার মারামারিতে সব বিষয়ে পারদর্শী, নিজেকে রক্ষা করার কলা কৌশলেও পারদর্শী। আজিজের গুণ্ডারা তার সঙ্গে পেরে উঠবে বলে মনে হয় না। নিশ্চয় বিশেষ কোনো কাজে কোথাও গেছেন।
তাও হতে পারে, কিন্তু তাই বলে আমাদেরকে জানিয়ে যাবে না?
হাশেমকে জিজ্ঞেস করেছিস?
করেছি, সেও কিছু জানে না।
পরশু জলমহলে মাছ ধরা হবে, আজিজের গুণ্ডাবাহিনী নিশ্চয় মাছ লুট করতে আসবে। এদিকে ম্যানেজারের কোনো খোঁজ নেই। কি হবে না হবে চিন্তা করেছিস?
ভাবছি, কালকের মধ্যে ম্যানেজারের খোঁজ না পাওয়া গেলে মাছধরা বন্ধ থাকবে।
হ্যাঁ, সেটাই ভালো হবে। আগে ম্যানেজারকে খুঁজে বের করতে হবে। আচ্ছা, ও কোনো বিশেষ কারণে ঢাকা যায় নি তো?
তা কি করে হয়? যে কারণেই যান না কেন, বলে নিশ্চয় যেতেন।
লুৎফা বেগম দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, ওর মতো ছেলের তাই তো করা উচিত, কিন্তু হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যাবে ভাবতেই পারছি না।
ফায়জুন্নেসা বললেন, ভাবছি কাল ঢাকায় ওর বাড়িতে খোঁজ নিতে লোক পাঠাব।
সেটাই ঠিক হবে বলে লুৎফা বেগম মেয়ের কাছ থেকে চলে গেলেন।
পরের দিন ভোরে ফজরের নামায পড়ে লুৎফা বেগম কুরআন তেলাওয়াত করছিলেন। এমন সময় ওনার খাস চাকরানি ফরিদা হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল, ম্যানেজার সাহেব এসেছেন।
শোকর আল হামদুলিল্লাহ বলে লুৎফা বেগম জিজ্ঞেস করলেন, তুই জানলি কি করে?
ফরিদা বলল, হাশেম মিয়া আপনাকে জানাবার জন্য বলল।
তুই গিয়ে হাশেমকে বল, ম্যানেজারকে উপরের বসার ঘরে নিয়ে আসতে।
হাশেম ম্যানেজারকে লুৎফা বেগমের কথা বলে উপরের বসার ঘরে এনে বসতে বলে চলে গেল।
একটু পরে লুৎফা বেগম এলেন।
ফায়সাল সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন?
লুৎফা বেগম বললেন, তুমি আর ভালো থাকতে দিলে কই? তা কাউকে কিছু বলে হঠাৎ কোথায় গিয়েছিলে? এদিকে আমরা তোমার চিন্তায় অস্থির। ফায়জুন্নেসা লোজন দিয়ে কত খোঁজ করাল। আজ যদি না আসতে, কাল ঢাকায় তোমাদের বাড়িতে লোক পাঠাত।
স্টেটের একটা বিশেষ কাজের জন্য হঠাৎ আমাকে এক জায়গায় যেতে হয়েছিল। জানিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় বলে জানাই নি। সে জন্য ক্ষমা চাইছি।
কি এমন বিশেষ কাজে গিয়েছিলে?
পরে বলব, এখন বলতে পারছি না বলে আবার ক্ষমা চাইছি।
তুমি তো ফায়জুন্নেসাকে চেনো, আমি ক্ষমা করলেও সে কি করবে?
আল্লাহ আমাকে ক্ষমা আদায় করার ক্ষমতা দিয়েছেন।
তুমি কি খুব ক্লান্ত?
কেন বলুন তো?
কিছুক্ষণ আলাপ করতে চাই।
না, আমি ক্লান্ত নই। কি আলাপ করতে চান করুন।
তুমি কি চৌধুরী বংশের পূর্ব ইতিহাস জান?
জি, জানি।
কি জান বলতো।
ফায়সাল সবকিছু বলার পর লুৎফা বেগম অবাক কণ্ঠে বললেন, এসব জানলে কি করে?
মাফ করবেন বলতে পারব না। তবে এতটুকু বলতে পারি, আল্লাহর মেহেরবাণীতে আমি চেষ্টা করে জেনেছি।
জিন ও সোনার মহরের কথা বিশ্বাস কর?
জি, করি।
জিনেরা চৌধুরী বংশের পরপর তিন পুরুষ ও জামাই হারেসকে মেরে তাদেরকে একই জলমহলে ফেলে রেখেছিল, বিশ্বাস কর?
জি, করি।
তোমার কি ধারণা, জিনেরা চৌধুরী বংশের সন্তান হিসাবে প্রথমে ফায়জুন্নেসাকে ও পরে তার মেয়ে জেবুন্নেসাকেও মেরে ঐ একই জলমহলে লাশ ফেলে রাখবে?
জি, আমারও তাই-ই ধারণা। তবে জিনেরা এখন আর তা করবে না।
লুৎফা বেগম খুব অবাক হয়ে ফায়সালের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলেন, কেন তা করবে না বলতে পার?
পারি, তবে আপনাকে ওয়াদা করতে হবে সোনার পর আমাকে কোনো প্রশ্ন করতে পারবেন না আর কাউকে এসব কথা বলবেন না।
লুৎফা বেগম আরো কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, বেশ ওয়াদা করলাম।
ফায়সাল বলল, চৌধুরী বংশের প্রথম পুরুষ জয়নুদ্দিন সোনার মোহর ভর্তি ঘড়া নিয়ে এখানে চলে আসার পর জিনেরা ওনাকে স্বপ্নে কিছু কাজ করতে বলেছিল। সেসব কাজ করলে ঘড়ার অর্ধেক সোনার মোহর খরচ হয়ে যাবে। তাই তিনি তা করেন নি। তাই জিনেরা ওনাকে মেরে জলমহলে ফেলে রাখে। তারপর ওনার বংশধর আবসার উদ্দিন ও ইনসান চৌধুরীকেও স্বপ্নে জিনেরা সেই কাজ করতে বলে। কিন্তু ওনারাও খরচের ভয়ে করেন নি। তাই ওনাদেরকেও জিনেরা, মেরে একই জলমহলে ফেলে রাখে। তারপর ফায়জুন্নেসাকেও জিনেরা একই স্বপ্না দেখায়। তিনিও স্বপ্নাকে স্বপ্না মনে করে তা করেন নি বরং পাপের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেন। জিনেরা ওনাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল; কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতিরেকে কোনো কিছুই হয় না। তাই জিনেরা ওনাকে মেরে ফেলার আগে আল্লাহ তার এক নেক বান্দাকে দিয়ে জিনেদের বাধা দেন এবং সেই নেক বান্দা জিনেদের কাছে ওয়াদা করে ফায়জুন্নেসার তিন পূর্বপুরুষ যা করেন নি তিনি তা ফায়জুন্নেসাকে দিয়ে করাবেন। আল্লাহর ইচ্ছায় ফায়জুন্নেসা এখনও বেঁচে আছেন। নচেৎ কবেই ঐ জলমহলে ওনার লাশ পাওয়া যেত। _ ফায়সালের কথা শুনে লুৎফা বেগম বুঝতে পারলেন এই ম্যানেজারই আল্লাহর সেই নেক বান্দা। একে দিয়েই আল্লাহ চৌধুরী বংশের উপর থেকে জিনেদের দুশমনির অবসান করিয়েছেন। মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করার সময় চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল। তার আসল পরিচয় জানার জন্য ওনার মন ব্যাকুল হয়ে উঠলেও ওয়াদার কথা চিন্তা করে কিছু বলতে পারলেন
ফায়সাল লুৎফা বেগমের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলল, আপনি আল্লাহর ঈমানদার বান্দি, তাই স্বামীর ও মেয়েদের কোনো অন্যায় মেনে নিতে না পেরে অনেক প্রতিবাদ করেছেন। ফলে স্বামীর অনেক নির্যাতন সহ্য করেছেন। মেয়েও আপনাকে অনেক অপমান করেছেন। আপনি সেসব সহ্য করে তাদেরকে হেদায়েত করার জন্য সব সময় আল্লাহর দরবারে দোয়া করেন। আল্লাহ তার ইমানদার বান্দা-বান্দিকে নিরাশ করেন না। তবে কখন সেই দোয়ার প্রতিফল বান্দার জন্য মঙ্গল হবে সে খবর তিনিই জানেন এবং সেই সময় দিয়েও থাকেন। এখন যা কিছু জানলেন, তা আপনার নেক দোয়ার প্রতিফল। আপনি আমার জন্য দোয়া করবেন, আল্লাহ যেন আমাকে শয়তানের হাত থেকে রক্ষা করেন ও ঈমানদারীর সঙ্গে জীবন অতিবাহিত করার তওফিক দেন এবং ঈমানের সঙ্গে মৃত্যু দেন।
এবার যাওয়ার অনুমতি দিন বলে ফায়সাল দাঁড়িয়ে উঠে বলল, ভুলেও আপনার মেয়েকে এসব কথা জানাবেন না। তারপর লুৎফা বেগম কিছু বলার আগেই সালাম দিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এল।
ফায়জুন্নেসা ঘুম থেকে উঠেন আটটায়। আজ উঠে কুলসুমের মুখে ম্যানেজার ফিরেছে শুনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। তারপর নাস্তা খেয়ে নিচতলার ড্রইংরুমে এসে ফায়সালকে ডেকে পাঠালেন।
ফায়সাল এসে সালাম দিল।
সালামের উত্তর দিয়ে ফায়জুন্নেসা বসতে বলে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, আপনার মতো ছেলে এরকম একটা কাজ করবেন ভাবতেই পারি নি।
ভুল হয়ে গেছে মাফ করে দিন।
কোথায় ছিলেন এই কদিন।
ফায়সাল যে কথা লুৎফা বেগমকে বলেছিল, সে কথা বলল।
কাজটা কি?
মাফ করবেন, বলতে পারব না।
আমার স্টেটের কাজ, বলতে পারবেন না কেন?
ফায়সাল মুখ নিচু করে চুপ করে রইল।
কি হল উত্তর দিচ্ছেন না কেন?
দয়া করে এ ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। পরে আপনি নিজেই জানতে পারবেন।
ফায়জুন্নেসা রেগে গেলেও সংযত কণ্ঠে বললেন, কোথায় গিয়েছিলেন, ঢাকায়?
মাফ করবেন, তাও বলতে পারব না।
ফায়জুন্নেসা রাগ সহ্য করতে পারলেন না। কড়া স্বরে বললেন, আপনি কি সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন।
সেজন্য আবার মাফ চাইছি।
যা আরো রেগে উঠে ফায়জুন্নেসা বললেন, আপনি শিক্ষিত ছেলে হয়ে মালিকের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কত বড় অন্যায় করছেন বুঝতে পারছেন না?
তা পারব না কেন? একটা সত্য ঘটনা বলছি শোনেন, খলিফা হারুণ-অর রশিদ একদিন খাওয়ার পর চিলিমচিতে হাত ধুচ্ছিলেন, একজন ক্রীতদাস ওনার হাতে পানি ঢালছিল। হঠাৎ হাত ফসকে পানির পাত্রটা চিলিমটিতে পড়ে যায়। চিলিমচির পানি খলিফার চোখে মুখে ছিটকে পড়ে। খলিফা ভীষণ রেগে উঠে ক্রীতদাসের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালেন। ক্রীতদাস জানে এই অপরাধের জন্য খলিফা তাকে কঠিন শাস্তি দেবেন। এমন কি মৃত্যুদণ্ডও দিতে পারেন। সে ছিল আল্লাহর ঈমানদার বান্দা। আর ঈমানদার বান্দারা কোনো শাস্তি বা মৃত্যুকে ভয় করে না। তাই খলিফা অগ্নি দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতে বলল, আল্লাহ রাগকে দমন করতে বলেছেন। আর আমাদের নবী করিম (দঃ) বলিয়াছেন, “ক্রোধ প্রকাশ করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যে তাহা হজম করে, বিচারের দিন আল্লাহ সমস্ত সৃষ্টি জীবকে ডাকিয়া সকলের সামনে তাহাকে যে-কোনো হুর পছন্দ করিয়া লইতে বলিবেন।”[৯]
ক্রীতদাসের কথা শুনে খলিফা মুচকি হেসে বললেন, তোমাকে মাফ করে দিলাম।
ক্রীতদাস আবার বলল, অপরাধীকে যারা ক্ষমা করেন তাদেরকে আল্লাহ ও তার রসুল (দঃ) ভালবাসেন।
এবার খলিফা বললেন, যাও, তোমাকে আযাদ করে দিলাম।
গল্পটা শুনে ফায়জুন্নেসার রাগ পড়ে গেল। বললেন, ঠিক আছে, মাফ করে দিলাম। তবে ভবিষ্যতে এভাবে না জানিয়ে কোথাও যাবেন না। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, কাল জলমহলের মাছ ধরার কথা মনে আছে?
জি, আছে?
আজিজ গুণ্ডাবাহিনী পাঠাবে মাছ লুট করার জন্য, সে ব্যাপারে কি করবেন?
মনে হয় তিনি গুণ্ডাবাহিনী পাঠাবেন না।
আপনার মনে কি হয় না হয় তা জানতে চাই নি, কি প্রস্তুতি নিয়েছেন জানতে চেয়েছি।
প্রতিবারে জলমহলে মাছ ধরার সময় দাঙ্গায় উভয় পক্ষের অনেকেই হতাহত হয়। তাই আমি দাঙ্গা করতে চাই না। সে জন্য যা কিছু করার আমি করব। এ ব্যাপারে আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না। ইনশাআল্লাহ আমি কামিয়াব হব।
কিন্তু আপনি যদি কিছু করতে না পারেন, তা হলে কি বিরাট ক্ষতি আমাদের হবে ভেবেছেন?
জি, ভেবে চিন্তেই কথাটা বলেছি। বললাম না, ইনশাআল্লাহ আমি কামিয়াব হব?
ফায়জুন্নেসা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, শুনুন, আপনি কি করবেন না করবেন, জানি না। আমি চাই, আমাদের বাহিনী তৈরি হয়ে যাবে।
ঠিক আছে, তাই হবে।
হাশেমের কাছে শুনেছি, আপনি নাকি একদিন আজিজদের গ্রামে গিয়েছিলেন সে সময় তার গুণ্ডাবাহিনী খুন করার জন্য আপনার উপর হামলা করেছিল, কথাটা কি সত্য?
জি সত্য।
ওদের হাত থেকে অক্ষত অবস্থায় ফিরে এলেন কি করে?
আল্লাহ ফিরিয়ে এনেছেন।
ফায়জুন্নেসা চিন্তা করলেন, কালই ম্যানেজারের কথার সততা জানা যাবে। অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ঠিক আছে, এবার আপনি আসুন।
ফায়সাল বলল, ছুটি দিতে হবে।
কেন?
বাড়ি যাব।
কবে যাবেন?
পরশু।
কত দিনের ছুটি চান?
পনের দিনের।
ফায়সাল এর আগে এক সপ্তাহের বেশি ছুটি নিয়ে বাড়ি যায় নি। পনের দিনের কথা শুনে ফায়জুন্নেসা বললেন, এবারে এত বেশি দিন কেন?
প্রয়োজন আছে, যদি মনে করেন এত দিন ছুটি দেয়া যাবে না, তা হলে আপনার ইচ্ছা অনুযায়ী দিন।
ঠিক আছে, পনের দিনই মঞ্জুর করলাম।
ধন্যবাদ, বলে ফায়সাল সালাম বিনিময় করে বেরিয়ে এল।
নির্দিষ্ট দিনে জলমহলে নির্বিঘ্নে মাছ ধরে বিক্রি করা হল। আজিজের গুণ্ডাবাহিনী মাছ লুট করতে আসে নি জেনে শুধু লুৎফা বেগম ও ফায়জুন্নেসা নয়, ফায়সালের উপর চৌধুরী বাড়ির সকলের ভক্তিশ্রদ্ধা আগের থেকে অনেক বেড়ে গেল।
ঐ দিন এক সময় ফায়জুন্নেসা মৃণালবাবুকে ডেকে ম্যানেজারের কাজ-কর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করে খুব সন্তুষ্ট হলেন এবং এমন কিছু বিষয় জানতে পারলেন, যা শুনে ভীষণ অবাকও হলেন। হঠাৎ মনে পড়ল, ম্যানেজার বলেছিলেন, “স্বপ্না খুব তাড়াতাড়ি দেশে ফিরবে।” কই আজ আট দশদিন হয়ে গেল স্বপ্না তো এল না? তা হলে কি সে ফিরে এসে ঢাকাতেই আছে? মায়ের কাছে গিয়ে কথাটা বললেন।
লুৎফা বেগম বললেন, ফিরে এসে যদি ঢাকাতে থাকে, তা হলে নিশ্চয় চিঠি দিয়ে জানাত। আমার মন বলছে স্বপ্না এখনও ফেরে নি।
————–
(১) বর্ণনায় : হযরত জরীর (রাঃ) – বুখারী।
(২) সূরা – হুজুরাত, আয়াত -৯, পারা ২৬।
(৩) সূরা-আল-ইমরান, আয়াত-১০৪, পারা-৪।
(৪) বর্ণনায় : হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) – বুখারী।
(৫) বর্ণনায় : হযরত আনাস (রাঃ) -আবুদাউদ।
(৬) বর্ণনায় : হযরত আয়েশা (রাঃ) – আবু দাউদ।
(৭) বর্ণনায় : হযরত আনাস (রাঃ) – আবু দাউদ।
(৮) সূরা রায়ান, আয়াত-২৬, পারা-১৩।
(৯) বর্ণনায় : হযরত সহল (রাঃ) – আবুদাউদ, তিরমিজী।
আগের পর্ব :
১. ট্রেন যখন নীলফামারী স্টেশনে পৌঁছাল
২. পৈত্রিক সূত্রে বিশাল সম্পত্তি
পরের পর্ব :
৪. হারেস মাঝে মাঝে ঢাকা গিয়ে
৫. ফায়জুন্নেসা ফায়সালকে ডেকে পাঠিয়ে
৬. মাস তিনেকের মধ্যে মসজিদ তৈরি