স্বপ্নে দেখা সেই মেয়েটি: ২. পৈত্রিক সূত্রে বিশাল সম্পত্তি

স্বপ্নে দেখা সেই মেয়েটি: ২. পৈত্রিক সূত্রে বিশাল সম্পত্তি

২. পৈত্রিক সূত্রে বিশাল সম্পত্তি

ইনসান চৌধুরী পৈত্রিক সূত্রে বিশাল সম্পত্তি পেয়েছেন। কয়েকটা জলমহল ছাড়াও কয়েকশ বিঘে ফসলী জমি, কয়েকটা বাগান ও প্রায় পনের বিশটা বড় বড় পুকুর ওনার দাদা জয়নুদ্দিন খরিদ করেছিলেন। কিংবদন্তী আছে, জয়নুদ্দিনের বাড়ি ছিল ডোমার। তিনি একজন দরিদ্র কৃষক ছিলেন। সব দিন ঘরে অন্ন জুটত না। অভাবের তাড়নায় এক গভীর রাতে একটা দীঘিতে জাল ফেলে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন। সারা রাত জাল ফেলে একটা মাছও জালে পড়ে নি। ফজরের আযানের সময় হতাশ হয়ে শেষবারের মতো জাল ফেলে যখন টানতে শুরু করেন তখন এত ভারি মনে হতে লাগল, যেন জাল ছিঁড়ে যাবে। অনেক কষ্টে জাল তুলতে সক্ষম হন। দেখলেন, একটা পিতলের কলসি জালে উঠেছে। কলসিতে কি আছে দেখার সময় পেলেন না, আযান শুনে সকাল হয়ে গেছে জেনে কাসিটা জালে জড়িয়ে ঘরে নিয়ে এসে ঢাকনা খুলে সোনার মোহর দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। স্নান ফিরে পেয়ে দেখলেন তার বৌ মাথায় পানি দিচ্ছে। ধড়ফড় করে উঠে বসে কলসি দেখতে না পেয়ে বৌকে জিজ্ঞেস করলেন, পিতলের কলসি কোথায়?

সায়রা বানু বললেন, আস্তে কথা বল, বাতাসেরও কান আছে। কলসিতে সোনার মোহর দেখে ঘরের মেঝেয় পুঁতে রেখেছি। তখন তাদের একমাত্র সন্তান আবসার উদ্দিন তিন বছরের। গ্রামের লোকজন জেনে যাওয়ার ভয়ে স্ত্রী, ছেলে ও সব সোনার মোহর নিয়ে খোকসাবাড়িতে এসে বসবাস শুরু করেন এবং কয়েক বছরের মধ্যে এই সব সম্পত্তি করে চৌধুরী উপাধি গ্রহণ করেন। আবসার উদ্দিন যখন কলেজে পড়েন তখন একদিন জয়নুদ্দিনের খোঁজ পাওয়া গেল না। তিন চার দিন পর লোকজন ওনার লাশ একটা জলমহলে ভাসতে দেখে তাদের বাড়িতে খবর দেয়।

ধনী হিসাবে জয়নুদ্দিনের নাম আশপাশের গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছিল। থানার পুলিশদের সঙ্গে ওনার দহরম-মহরম ছিল। তারা লাশ ময়না তদন্ত করার জন্য নীলফামারী হাসপাতালে নিয়ে গেল। ময়নাতদন্তে জানা গেল, গলাটিপে হত্যা করা হয়েছে।

এরকম একজন ধনী ও গণ্যমান্য লোককে কেউ গলাটিপে মারবে, গ্রামের লোক বিশ্বাস করতে পারল না। তাদের ধারণা জিনেদের সোনার মোহরের কলসি নিয়ে জয়নুদ্দিন ডোমার থেকে পালিয়ে এসেছিলেন বলে তারা ওনাকে গলাটিপে মেরে জলমহলে ফেলে দিয়ে গেছে।

এই ঘটনার প্রায় বার বছর পর ওনার একমাত্র সন্তান আবসার উদ্দিনের লাশও ঐ একই জলমহলে পাওয়া যায়। বাবা ও ছেলে একইভাবে মারা যাওয়ার ঘটনায় লোকজন বলাবলি করতে লাগল, ঐ বংশের উপর জিনেদের আক্রোশ আছে। হয়তো ভবিষ্যতেও থাকবে।

আবসার উদ্দিন চৌধুরীর একমাত্র সন্তান ইনসান চৌধুরীর বয়স যখন ত্রিশ বছর তখন একদিন ওনার লাশও ঐ একই জলমহলে পাওয়া যায়। ময়নাতদতে ওই একই রিপোর্ট, গলাটিপে হত্যা করা হয়েছে। তখন থেকে শুধু গ্রামের লোকজনই নয়। চৌধুরী বাড়ির সকলেরও ঐ ধারণা দৃঢ় হয়।

ইনসান চৌধুরীর স্ত্রী লুৎফা বেগম ঢাকার ধনী পরিবারের উচ্চ শিক্ষিত মেয়ে। তিনি ভূত-পেত্নি বা জিন বিশ্বাস করেন না। এই বংশের উপর জিনদের আক্রোশ আছে, স্বামী, শ্বশুর ও দাদা শ্বশুরকে জিনেরা মেরে ফেলেছে তাও বিশ্বাস করেন না। ওনার বিশ্বাস, দাদা শ্বশুর অন্য জায়গা থেকে এসে এখানে এত সম্পত্তি করেছেন, চৌধুরী বংশের এত নাম ডাক, এখানকার অনেকে সহ্য করতে না পেরে একের পর এক এই ঘটনা ঘটিয়ে জিনেদের আক্রোশ বলে রটিয়েছে।

ইনসান চৌধুরী মারা যাওয়ার সময় ওনার মা হাফেজা বেগম বেঁচে ছিলেন। তিনি শাশুড়ির কাছে সোনার মোহর পাওয়ার কথা শুনেছিলেন। তাই স্বামী, শ্বশুর ও ছেলেকে যে জিনেরা মেরে ফেলেছে, সে কথা বিশ্বাস করেন। বৌ লুৎফা বেগম ওসব বিশ্বাস করে না জেনে একদিন তাকে বললেন, ভূত-পেত্নী আছে কি না জানি না। তবে জিন জাতি আছে একথা বিশ্বাস করি। কারণ কুরআনে জিন জাতির কথা উল্লেখ আছে। এমন কি জিন নামে একটা সূরাও আছে। তা ছাড়া জিনেদের সম্পর্কে আমাদের নবী (দঃ)-এর হাদিসে বর্ণনাও আছে। তাই প্রত্যেক মুসলমানকে জিন পৃথিবীতে আছে বিশ্বাস করতেই হবে। তারপর ওনার শশুরের সোনার মোহর পাওয়ার কথা ও নিজের গ্রাম ছেড়ে কেন এখানে চলে • আসেন বললেন।

শাশুড়ির কথা শুনে লুৎফা বেগম কিছুটা বিশ্বাস করতে পারলেও সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারলেন না। তাই জিজ্ঞেস করলেন, জিনেদের আক্রোশ থেকে রেহাই পাওয়ার কি কোনো উপায় নেই?

হাফিজা বেগম বললেন, এই কথা আমিও আমার শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, কোনো পীর সাহেব বা বড় আলেমের কাছে ঘটনাটা বলে তদবির করলে হয়তো জিনেদের আক্রোশ থেকে রেহাই পাওয়া যেত। তিনি স্বামীকে কথাটা বলেও ছিলেন; কিন্তু সোনার মোহর পাওয়ার ঘটনা জানাজানি হয়ে যাবে বলে তদবির করতে রাজি হন নি। কথাটা ইনসানকেও বলেছিলাম, সেও একই কথা বলে তদবির করতে রাজি হয় নি।

লুৎফা বেগম বললেন, এই বংশের পুরুষের উপর জিনেদের আক্রোশ। এখনতো আর কোনো পুরুষ নেই, মনে হয় তারা এই বংশের মেয়েদের উপর কিছু করবে না।

হাফিজা খাতুন বললেন, কি করে সে কথা বলব? আমার তো খুব ভয় হয়, চৌধুরী বংশের একমাত্র প্রদীপ ফায়জুন্নেসাকে নিয়ে। ওর কিছু হলে চৌধুরী সংশের নাম নিশানা দুনিয়া থেকে মুছে যাবে। তাই বলি কি, তুমি তোমার বাবাকে সবকিছু জানিয়ে কোনো পীর সাহেব বা কোনো আলেমের দ্বারা তদবির করাও।

স্বামী ও তার উর্ধ্বতন পুরুষরা যে কারণে জিনেদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তদবির করেন নি, লুৎফা বেগমও সেই একই কারণে কিছু করেন

ইনসান চৌধুরী মারা যাওয়ার কয়েক বছর আগে হারেস নামে একটা ছেলের সঙ্গে একমাত্র মেয়ে ফায়জুন্নেসার বিয়ে দেন। হারেস ঢাকার শিক্ষিত ও সুদর্শন ছেলে। সে প্রথমে চৌধুরী স্টেটের ম্যানেজার ছিল। ইনসান চৌধুরী মেয়ের বিয়ের জন্য এমন পাত্রের খোঁজ করছিলেন, যে নাকি সব দিক থেকে চৌধুরী বংশের উপযুক্ত এবং ঘরজামাই থেকে চৌধুরী স্টেটের ভার নিতে পারবে। ম্যানেজার হারেসকে ওনার পছন্দ হলেও বংশের মর্যাদার কথা ভেবে আল কে সায় পান নি। তারপর যখন জানতে পারলেন, পাশের গ্রামের এক সাধারণ ছেলের সঙ্গে মেয়ের মন দেয়া নেয়া হয়েছে তখন স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ হারেসের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেন। বিয়ের দু’বছরের মধ্যে তাদের একটা মেয়ে হয়। ইনসান চৌধুরী নাতনির নাম রাখেন জেবুন্নেসা। ডাক নাম স্বপ্না।

বিয়ের সময় ফায়জুন্নেসার কোনো প্রতিবাদ করার সাহস ছিল না। তবু মায়ের কাছে মন দেয়া নেয়ার কথা বলেছিল, কিন্তু কাজ হয় নি। কথাটা শুনে লুৎফা বেগম মেয়ের সাথে রাগারাগি করেন। ফলে এক রকম বাধ্য হয়ে সে হারেসকে বিয়ে করে।

হারেস ইনসান চৌধুরীর মেয়ের মন দেয়া-নেয়ার কথা না জানলেও তার উগ্র মেজাজের কথা জানত। তাই ইনসান চৌধুরী যখন তাকে জামাই করার কথা জানালেন তখন বলল, আমি আপনার মেয়ের অনুপযুক্ত। তা ছাড়া ঘরজামাই হয়ে থাকা আমার পক্ষে একেবারেই সম্ভব নয়।

ইনসান চৌধুরী ভাবতেই পারেন নি, হারেস অমত করবে। রাগে অনেকক্ষণ কথা বলতে পারলেন না। একসময় গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, এর পরিণাম চিন্তা করছ?

জি করেছি, আমার চাকরি থাকবে না।

একই কষ্ঠে ইনসান চৌধুরী বললেন, শুধু চাকরি নয়, প্রাণ নিয়ে এখান থেকে ফিরে যেতে পারবে না। তারপর নরম সুরে বললেন, তোমার মতো ছেলেই চৌধুরী বংশের জামাই হওয়ার উপযুক্ত। আমার পরে তুমিই হবে এই বংশের কর্ণধার। তারপর অনেক কিছু প্রলোভন দেখিয়ে হারেসকে রাজি করান।

ইনসান চৌধুরী কাছের জমিগুলো নিজের লোকজন দিয়ে চাষ করালেও দূরের জমিগুলো সেই গ্রামের লোকজনদের পত্তনি দিয়েছেন। যে বছর ফসল না হত, সে বছর ইনসান চৌধুরী নিজের লোকজন দিয়ে জোর-জুলুম করে তাদের কাছে ফসল আদায় করতেন। ফসল দিতে না পারলে গরু-বাছুর, ছাগল নিয়ে চলে আসতেন। এসব ব্যাপার ছাড়াও ইনসান চৌধুরীর মদ ও মেয়ের নেশা ছিল। তবে গ্রামের মেয়েদেরকে নিয়ে কিছু করতেন না। ঢাকা থেকে বাঈজী আনাতেন।

হারেস ম্যানেজার হয়ে আসার পর এইসব দেখে শুনে ইনসান চৌধুরীর উপর দিন দিন খুব অসন্তুষ্ট হয়ে উঠলেও সাহসের অভাবে প্রতিবাদ করতে পারে নি। জামাই হওয়ার পর একবার দূরের এক গ্রামের গরিব চাষি ফসলের ভাগ দেয় নি বলে তাকে লোকজন ধরে এনে এমন মার মেরেছিল যে, সেই গ্রামের লোকেরা তাকে পাটার করে নিয়ে গিয়েছিল। সেদিন হারেস বাধা দিয়েছিল বলে লোকটা বেঁচে গিয়েছিল, নচেৎ মারা যেত।

কথাটা ইনসান চৌধুরী জেনে হারেসকে ভবিষ্যতে এরকম না করার জন্য সাবধান করে দিয়ে বলেছিলেন, আমার অবর্তমানেও করবে না।

সেদিন হারেস শ্বশুরের সামনে মুখে কিছু না বললেও মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল চাষিদের উপরে নির্মম অত্যাচার আর করতে দেবে না।

দিন দিন স্ত্রীর উপরও হারেস অসন্তুষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। সে যেন তাকে ঠিক স্বামীর আসনে গ্রহণ করতে পারে নি। তার কথামতো না চলে, নিজের ইচ্ছা মতো চলে। যখন হারেস স্ত্রীকে সংযত হয়ে চলার জন্য বোঝাত তখন ফায়েজুন্নেসা বলতেন, যারা ঘরজামাই থাকে, তাদের কথা স্ত্রীরা শোনাই না, বরং স্ত্রীদের কথা তাদেরকে মেনে চলতে হয়। এনিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রায়ই কলহ হত।

দিনের পর দিন স্ত্রীর দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে হারেস একদিন শ্বশুরের কাছে স্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করল।

ইনসান চৌধুরী উল্টো জামাইকে দোষারোপ করে বললেন, যে নিজের স্ত্রীকে বশে রাখতে পারে না, সে কাপুরুষ।

শ্বশুরের কথা শুনে হারেস নির্বাক হয়ে ভাবল, চৌধুরী বংশের জামাই হয়ে যে ভুল করেছে, তা জীবনে শুধরাতে পারবে না। চিরকাল তাকে অশান্তির আগুনে জ্বলতে হবে। তবু হাল ছাড়ল না, স্ত্রী কখন কি করে, কোথায় যায়, একটা বিশ্বস্ত চাকর সামসুকে লক্ষ্য রাখতে বলল।

সামসু অনেক দিন থেকে আছে। ফায়জুন্নেসার সবকিছু জানে। বলল, লক্ষ্য রাখার দরকার নেই। মালিকদের সবকিছু শুধু আমি নই, সব চাকর চাকরানিরাও জানে। কিন্তু আমাদের মুখ খোলা নিষেধ। যদি কেউ খোলে, তা হলে তাকে জ্যান্ত কবর দেয়া হয়। এরকম ঘটনা ঘটতে দেখে আমরা যোবা হয়ে থাকি। আপনাকে আমরা সবাই খুব ভক্তি শ্রদ্ধা করি, তাই আপনার জন্য আমরা দুঃখ পাই। তবু মুখ খুলতে পারব না। তবে এতটুকু বলতে পারি, তারপর মালিক কন্যার মন দেয়া নেয়ার কথা বলে বলল, এখনও তার সঙ্গে সম্পর্ক আছে। আমার কথা বিশ্বাস না হলে নিজে লক্ষ্য রাখলে সত্য মিথ্যা জানতে পারবেন।

চাকরের কথা শুনে হারেস সিদ্ধান্ত নিল, সত্য মিথ্যা যাচাই করার দরকার নেই, যেমন করে হোক এখান থেকে পালিয়ে যাবে।

এর কয়েকদিন পর ইনসান চৌধুরীর লাশ জলমহলে পাওয়া গেল।

শশুর মারা যাওয়ার পর হারেসের উপর চৌধুরী স্টেটের ও সংসারের দায় দায়িত্ব পড়ে গেল। পালাবার চিন্তা স্থগিত রেখে সে সব সামলাতে লাগল।

তারপর একদিন মেয়ে যাতে মায়ের মতো না হয় সে জন্যে হারেস হয় বছরের স্বপ্নাকে ঢাকায় এক হোমে রেখে লেখাপড়া করার ব্যবস্থা করে এল।

ফায়জুন্নেসা মনে মনে খুশি হলেও মুখে বলল, কাজটা তুমি ভালো কর নি।

হারেস বলল, তোমার কাছে ভালো না হলেও আমি স্বপ্নার ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই করেছি।

ফায়জুন্নেসা আর কিছু বলল না।

দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কিভাবে চার-পাঁচ বছর কেটে গেল হারেস বুঝতে পারল না।

বাবা মারা যাওয়ার পর ফায়জুন্নেসা বছর দুই একটু সংযত ছিল। তারপর যত দিন যেতে লাগল তত আগের মতো হয়ে উঠল।

চাকরের কাছে স্ত্রীর দুশ্চরিত্রের কথা জানার পর থেকে হারেস আলাদা রুমে খুমতি এবং তার সংশ্রব থেকে দুরে থাকত। এমন কি তার খোঁজ-খবরও রাখত না। ফলে ফায়জুন্নেসা আরো বেপরওয়া হয়ে উঠে।

চাকর সামসু বয়স্ক লোক। হারেসকে ভীষণ ভক্তি শ্রদ্ধা করে। ওনার মনের কষ্টও বোঝে। তাই মালেকিনকে আগের মতো হয়ে উঠতে দেখে একদিন হারেসকে বলল, আগে রাতের অন্ধকারে মালেকিনের প্রেমিক এলেও ইদানিং বেলা তিনটের দিকে আসে। মালেকিন গেস্টরুমে তার সঙ্গে দেখা করেন।

হারেস জিজ্ঞেস করল, প্রতিদিন আসে?

সামসু বলল, না, যেদিন আপনি অন্য গ্রামে তদারকী করতে যান, সেদিন আসে।

হারেস কথাটা সত্য কিনা যাচাই করার জন্য একদিন অন্য গ্রামে যাওয়ার কথা বলে বেলা দশটার দিকে লোকজন সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেল। প্রতিবারে ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে যায়। আজ লোকজনদেরকে শরীর খারাপের অজুহাত দেখিয়ে তাদেরকে নিয়ে ফিরে এল। তারপর স্ত্রীর রুমের জানালার পর্দা সরিয়ে দেখল, নেই। নিচ তলায় এসে গেস্ট রুমের দরজা বন্ধ দেখে নক করল।

ফায়জুন্নেসার প্রেমিকের নাম আজিজ। লম্বা চওড়া শরীর, দেখতে খুব হ্যান্ডসাম। তারা প্রেমকেলীর প্রস্তুতি নেয়ার আগে দরজায় নক হতে শুনে আজিজ ফায়জুন্নেসার দিকে তাকাল।

ফায়জুন্নেসা দরজায় নক হতে শুনে রেগে লাল হয়ে গেল। কারণ সে জানে কারো ঘাড়ে দুটো মাথা নেই যে, এসময়ে এই রুমের দরজা নক করবে। বারবার নক হতে শুনে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে দরজা খুলে স্বামীকে দেখে চমকে উঠল। মুহূর্তের মধ্যে সামলে নিয়ে বলল, এত তাড়াতাড়ি ফিরলে যে?

হারেস তার কথার উত্তর না দিয়ে আজিজের আপাদমস্তক দেখে জিজ্ঞেস করল, আপনি কে? এ সময়ে এখানে কেন?

আজিজ কিছু বলার আগে ফায়জুন্নেসা বলল, ও পাশের গ্রামের ছেলে। আমরা একসঙ্গে স্কুল-কলেজে পড়েছি। ওকে আমিই ডেকে পাঠিয়েছি।

হারেস কিছু না বলে সেখান থেকে নিজের রুমে চলে গেল।

স্বামীর কাছে ধরা পড়ে ফায়জুন্নেসা খুব চিন্তায় পড়ে গেল। ভাবল, হারেস যদি মাকে কথাটা জানায়, তা হলে মা তাকে ছেড়ে কথা বলবে না। তাই একদিন আজিজের কাছে পরামর্শ চাইল।

আজিজ এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল, বলল, তুমি কোনো দুশ্চিন্তা করো না, যা করার আমি করব।

তুমি কি ওকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে চাও?

তুমি বললে তা করতে পারি।

না-না, তা করো না। বরং এমন কিছু কর, সাপও না মরে, লাঠিও না ভাঙ্গে।

ঠিক আছে, কি করব না করব চিন্তা ভাবনা করে তোমাকে জানাব।

কয়েকদিন পরে হারেসের লাশ ঐ একই জলমহলে পাওয়া গেল।

সবাই ভাবল, এটা জিনেদেরই কাজ। তাই কেউ উচ্চ বাচ্য করল না। এমন কি লুৎফা বেগম ও ফায়জুন্নেসাও তাই ভাবলেন।

হারেস মারা যাওয়ার পাঁচ ছমাস পরে ফায়জুন্নেসা আজিজকে ডেকে পাঠিয়ে বলল, তোমাকে আর কিছু করতে হল না।

আজিজ মৃদু হেসে বলল, হ্যাঁ, আমি কিছু করার আগেই জিনেরা করে ফেলল।

তুমি জিনেদের ভয় কর না।

কেন, ভয় করব কেন?

যদি তাদের আক্রোশ তোমার উপর পড়ে?

আমার কাছে এমন জিনিস আছে, জিনেরা আমার ধারে কাছে আসতে সাহস পাবে না। আমার জন্য তুমি কোনো চিন্তা করো না।

তারপর থেকে তাদের গোপন প্রেমলীলা চলতে লাগল। আজিজ প্রেমের ফাদে ফেলে স্টেটের ম্যানেজার করাতে বাধ্য করাল ফায়জুন্নেসাকে।

জামাই মারা যাওয়ার পর চাকরানিদের মুখে আজিজের সঙ্গে মেয়ের সম্পর্কের কথা শুনে লুৎফা বেগম একদিন রাগারাগি করে বলেছিলেন, তুই যে পথে চলছিস, তা শয়তানের পথ। তুই কি আল্লাহকে মানিস না? তাঁকে ভয়ও করিস না? যদি তাই হয়, তা হলে অতি অল্পদিনের মধ্যে তার ফল পাবি। কথায় আছে, আল্লাহর মার দুনিয়ার বার। তিনি ন্যায় বিচারক, তিনি যেমন অত্যন্ত দয়াশীল তেমনি কঠোর আযাবদাতা। তুই যে অন্যায় করেছিস, তার ফল তোকে ভোগ করতেই হবে। তোকে দিয়েই আল্লাহ এই বংশের প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছেন এবং ভবিষ্যতে সেই প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখার জন্য তোকে একটা মেয়েও দিয়েছেন। সেই মেয়ের কথাও চিন্তা করবি না?

মায়ের কথা শুনে ফায়েজুন্নেসা চুপ করে থাকলেও স্বভাবের কোনো পরিবর্তন হল না। কিছুদিন পর আজিজকে স্টেটের ম্যানেজার নিযুক্ত করে।

লুৎফা বেগম চাকরানিদের মুখে সেকথা জানতে পেরে মেয়েকে আরেক দফা বকাবকি ও সাবধান করে নসিহত করেন। কিন্তু ফায়জুন্নেসা মায়ের কথায় কর্ণপাত করে নি।

আজিজ সাধারণ ঘরের ছেলে বলে ইনসান চৌধুরী তার ভালবাসার মূল্য দেন নি। তাই ওনার উপর প্রচণ্ড রাগ ছিল আজিজের। বিয়ের পরেও যখন ফায়জুন্নেসা চিঠি দিয়ে জানাল, তাকে আজীবন ভালবাসবে এবং কিভাবে তাদের গোপন অভিসার চলবে তখন আজিজ চৌধুরী ফায়জুন্নেসার সঙ্গে যোগাযোগ সে চলল। তারপর ইনসান চৌধুরী মারা যাওয়ার পর হারেসকে মেরে ফেলার পরামর্শ দিলে ফায়জুন্নেসা রাজি হয় নি। হারেস মারা যাওয়ার পর ম্যানেজারী করার সময় একদিন ফায়জুন্নেসাকে বিয়ের প্রস্তাব দিল।

ফায়জুন্নেসা বললেন, এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? তোমাকে ম্যানেজার করেছি বলে মাক খুব অসন্তুষ্ট হয়ে আমার সাথে ভীষণ রাগারাগি করেছে। একদিন না একদিন মায়ের রাগ ঠান্ডা হবে। তখন করা যাবে। চিন্তা করো না, আমি তো চিরকাল তোমারই থাকব।

ফায়জুন্নেসার চেয়ে তার বাবার সম্পত্তির উপর আজিজের লোভ বেশি। তাই তার কথা মেনে নেয়।

কয়েক বছর ম্যানেজারী করে আজিজ নিজের আখের গুছিয়ে নিল। তাতেও তার মন ভরল না। সে জানে ফায়জুন্নেসাকে বিয়ে করতে পারলে চৌধুরী স্টেট তার হাতের মুঠোয় চলে আসবে। চৌধুরী বংশের একমাত্র প্রদীপ স্বপ্নাকে কৌশলে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে পারলে পুরো স্টেটের মালিক হয়ে যাবে। ইদানিং যেন ফায়জুন্নেসা আগের মতো তার সঙ্গে অভিসার করছে না। শরীর খারাপের কথা বলে এড়িয়ে যাচ্ছে। ভাবল, তার প্রতি ভালবাসার টান কমে যাচ্ছে। এইসব চিন্তা করে একদিন ফায়জুন্নেসার কাছে বিয়ের কথা তুলে বলল, আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে বলতে পার?

ফায়জুন্নেসা বললেন, মাকে কথাটা বলেছিলাম, শুনে বলল, তোর বাবা যাকে জামাই করল না, তাকে আমি কিছুতেই জামাই করতে পারব না। আর তুই যদি আমার কথা না মানিস, তা হলে যে দিন শুনব তাকে বিয়ে করেছিস, সেদিন। আমার মরা মুখ দেখবি। এখন তুমিই বল, আমি কি করব?

আজিজ বলল, মা যখন আত্মহত্যার কথা বলেছেন তখন আমরাই তাকে পরপারে পাঠিয়ে দিতে পারি।

এখন ফায়জুন্নেসার যৌবন ভাটার দিকে। তা ছাড়া এতদিনে ফায়জুন্নেসা জানতে পেরেছে, আজিজ স্টেটের তহবীল তসরুফ করে আর্থিক অবস্থা ফিরিয়ে ফেলেছে। আরও বুঝতে পেরেছে, বাবা তার সঙ্গে বিয়ে দেয় নি বলে প্রেমের অভিনয় করে সেই অপমানের প্রতিশোধ নিচ্ছে। মেয়ে স্বপ্নার কথা চিন্তা করেও আজিজের প্রতি তার ভালবাসার টান কমতে শুরু করেছে। মাঝে মাঝে মায়ের নসিহতও মনে পড়ে, তুই যে অন্যায়ের পথে চলেছিস, অচিরেই আল্লাহ তার প্রতিফল তোকে দেবেন। তাই আজিজের সঙ্গে অভিসার কমিয়ে দিয়েছে। এখন তার মুখে মাকে পরপারে পাঠাবার কথা শুনে মনে মনে চমকে উঠে চিন্তা করল, তা হলে কি আজিজ হারিসকে মেরে জল মহলে ফেলে দিয়েছে?

তখন তার মন বলে উঠল, আজিজকে চিনতে তুমি ভুল করেছ। স্ত্রী ছেলে মেয়ে থাকা সত্ত্বেও যে তোমাকে দীর্ঘ দিন ভোগ করেছে, সেই রাস্তা পরিষ্কার করার জন্য তোমার স্বামীকে হত্যা করেছে, এখন সমস্ত স্টেট গ্রাস করার জন্য তোমার মাকে হত্যা করার পরামর্শ দিয়ে তোমাকে বিয়ে করতে চাচ্ছে, সে যে কত বড় ধূর্ত পাপী, একবারও কি চিন্তা করবে না?

তাকে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকতে দেখে আজিজ যেন তার মনের কথা বুঝতে পারল। বলল, এতক্ষণ কি ভাবছ? মনে হচ্ছে, আমার পরামর্শ তোমার মনঃপুত হয় নি?

বিবেকের চাবুকে ফায়জুন্নেসার জ্ঞানের চোখ খুলে গেছে। বলল, হ্যাঁ, তুমি ঠিক ধরেছ, তোমার পরামর্শটা আমার মনঃপুত হয় নি। শুধু তাই নয়, তোমার আসল উদ্দেশ্য আমি ধরে ফেলেছি। আজ এখনই তোমাকে বরখাস্থ করলাম। তোমার সঙ্গে আমার আর কোনো সম্পর্ক নেই। তুমি চলে যাও, আর কখনও এমুখো হবে না।

আজিজ খুব রেগে গিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হো হো করে হেসে উঠে বলল, চমৎকার, কি দারুণ তোমার অভিনয়?

ফায়জুন্নেসা রাগের সঙ্গে বলল, না, অভিনয় নয়, যা সত্য তাই বলেছি।

তা হলে তো আমার আসল উদ্দেশ্যের কথা শুনতেই হয়।

নিজেই তো জান, আমার কাছে শুনতে চাচ্ছ কেন? আমি বলব না।

যদি বলি বলতেই হবে।

তুমি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছ? ভুলে যেও না, তুমি চৌধুরী স্টেটের একজন কর্মচারী। মালিকের সঙ্গে বেয়াদবী করার শাস্তি নিশ্চয় জান? কোনো উচ্চ-বাচ্চ্য না করে চলে গেলেই ভালো করবে। নচেৎ বলে থেমে গিয়ে ফায়জুন্নেসা তার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকাল।

এই দৃষ্টির অর্থ আজিজ জানে। ইনসান চৌধুরীর ভয়ালদর্শন কয়েকজন লেঠেল ছিল। আরও ছিল কয়েকজন ভয়ালদর্শন পিস্তলধারী। ইনসান চৌধুরী যার দিকে অগ্রি দষ্টিতে তাকাতেন। হয় লেঠেলরা তাকে লাঠিপেটা করে মেরে ফেলত অথবা পিস্তলধারী কেউ একজন তাকে গুলি করে মেরে ফেলত। সেই সব লেঠেল ও পিস্তলধারীরা এখনও আছে।

এখন ফায়জুন্নেসাকে অগ্নিদৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতে দেখে আজিজ ভয় পেয়ে সেখান থেকে চলে গেল।

তারপর আজিজ আর কখনও চৌধুরী বাড়ির ত্রিসীমানায় না গেলেও একের পর এক তাদের ক্ষতি করে চলেছে। সেও কয়েকজন লেঠেল ও পিস্তলধারী লোক রেখেছে। একবার চৌধুরীদের পত্তনী দেয়া জমির ধান লুট করতে গিয়ে উভয় পক্ষের কয়েকজন লেঠেল ও পিস্তলধারী হতাহত হয়েছে।

আজিজকে বরখাস্থ করার পর ফায়জুন্নেসা বেশ কয়েকজন ম্যানেজার রেখেছেন। তাদেরকে আজিজের অস্ত্রধারী লোকেরা ভয় দেখিয়ে চলে যেতে বাধ্য করেছে। যারা না গিয়ে চ্যালেঞ্জ করেছে, তাদেরকে মেরে ফেলেছে। তাই এবারে সুটিং ও ফাইটিং জানা ম্যানেজার পোস্টের জন্য কাগজে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলেন।

আগের পর্ব :

১. ট্রেন যখন নীলফামারী স্টেশনে পৌঁছাল
পরের পর্ব :
৩. কাগজে বিজ্ঞপ্তি দেখে
৪. হারেস মাঝে মাঝে ঢাকা গিয়ে
৫. ফায়জুন্নেসা ফায়সালকে ডেকে পাঠিয়ে
৬. মাস তিনেকের মধ্যে মসজিদ তৈরি

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত