১. ট্রেন যখন নীলফামারী স্টেশনে পৌঁছাল
ট্রেন যখন নীলফামারী স্টেশনে পৌঁছাল তখন বিকেল পাঁচটা। ফায়সাল ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনের বাইরে এসে একজনকে জিজ্ঞেস করল, মসজিদ কোন দিকে বলতে পারেন?
ঐ তো দেখা যাচ্ছে, বলে হাত তুলে দেখিয়ে লোকটা চলে গেল। সাড়ে পাঁচটায় জামাতের সঙ্গে আসরের নামায পড়ে ফায়সাল মসজিদের বাইরে একজন বৃদ্ধ লোকের সঙ্গে সালাম বিনিময় করে বলল, আমি খোকসাবাড়ি যাব, কিভাবে যাব একটু বলে দেবেন?
বৃদ্ধ লোকটির বয়স প্রায় সত্তর বছর, চুলদাড়ি সব পেকে সাদা হয়ে গেছে। তবে জরা এখনও ওনার ধারে কাছে আসে নি। একহারা চেহারা হলেও সুঠাম দেহের অধিকারী। ফায়সালের আপাদমস্তক একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কোথা থেকে আসছেন?
ঢাকা থেকে।
কার বাড়িতে যাবেন?
ইনসান চৌধুরীর বাড়ি।
উনি আপনার আত্মীয়?
বৃদ্ধকে একের পর এক প্রশ্ন করতে শুনে ফায়সাল ক্রমশ বিরক্ত হয়ে উঠলেও তা প্রকাশ না করে বলল, না, উনি আত্মীয় না। এবার কিভাবে যাব বলুন।
বৃদ্ধ তার কথায় কর্ণপাত না করে জিজ্ঞেস করলেন, তা হলে ওনার বাড়িতে যাচ্ছেন কেন?
ফায়সাল আরো বেশি বিরক্ত হয়ে বলল, এসব জেনে কি লাভ আপনার?
লাভ আমার নেই, তবে আপনার আছে?
আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না। ঠিক আছে, আপনাকে বলতে হবে না, অন্যের কাছ থেকে জেনে নেব বলে ফায়সাল হাঁটতে শুরু করল।
এই যে দাদু, রাগ করে চলে যাচ্ছেন কেন? দাঁড়ান। তারপর নিজেই এগিয়ে এসে বললেন, আপনাকে দেখে আমার নাতির কথা মনে পড়ল। তাই ঐ সব, জিজ্ঞেস করে আপনাকে দেখছিলাম।
বৃদ্ধের কথা শুনে ফায়সাল দাঁড়িয়ে পড়েছিল। জিজ্ঞেস করল, আপনার নাতি এখন কোথায়?
নেই। আল্লাহ তাকে দুনিয়া থেকে তুলে নিয়েছেন। তারপর বললেন, খোকসাবাড়ি এখান থেকে প্রায় চার-পাঁচ মাইল। রিকশায় গেলে ত্রিশ চল্লিশ টাকা ভাড়া নেবে। হেঁটে গেলে ঘণ্টা দেড়েক সময় লাগবে। ওখানে কেন যাচ্ছেন বললেন না তো, তবে যে কারণেই যান না কেন, খুব সাবধানে থাকবেন।
ফায়সাল অবাক হয়ে বলল, কেন বলুন তো?
ইনসান চৌধুরী মানুষ না, হাইওয়ান ছিলেন। ওনার নাম হাইওয়ান চৌধুরী হওয়া উচিত ছিল? এমন কোনো জঘন্য কাজ নেই, যা উনি করেন নাই। আপনি
বললেও বুঝতে পারছি, চৌধুরীর স্টেটে চাকরি করার জন্য এসেছেন। এর আগেও কয়েকজন এসেছেন, তাদের মধ্যে শুধু একজনই প্রাণ নিয়ে পালাতে সক্ষম হয়েছেন, বাকিরা পারেন নি। আপনি দেখতে অনেকটা আমার নাতির মতো, তাই এত কিছু বলে সাবধান করলাম। আর আমার কথা যদি শোনেন, তা হলে বলব, ঢাকার ছেলে ঢাকায় ফিরে যান।
কিন্তু ইনসান চৌধুরী তো অনেক বছর আগে মারা গেছেন? ওনার একমাত্র মেয়ে সম্পত্তি দেখাশোনা করার জন্য একজন ম্যানেজার চেয়ে কাগজে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন।
হ্যাঁ, উনি অনেক বছর আগে মারা গেছেন। কিন্তু ওনার মেয়েও বাবার মতো। ইনসান চৌধুরী মেয়ের বিয়ে দিয়ে জামাইকে ঘরজামাই করে রেখেছিলেন। জামাই খুব ভালো ছেলে ছিল। শ্বশুরের জঘন্য কাজের প্রতিবাদ করত বলে ইনসান চৌধুরী জামাই-এর উপর খুব অসন্তুষ্ট ছিলেন। ওনার মেয়েও স্বামীর প্রতি তেমন সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাই বাবা মারা যাওয়ার পর স্বামীকে ওনার প্রেমিকের দ্বারা মেরে ফেলেন। তারপর থেকে মেয়ে বাবার সবকিছু দেখাশোনা করছেন। যে মেয়ে স্বামীকে মেরে ফেলতে পারে, সে মেয়ে কেমন হতে পারে নিশ্চয় বুঝতে পারছেন?
ফায়সাল বৃদ্ধের কথা বিশ্বাস করতে পারল না। বলল, হাদিসে পড়েছি শোনা কথা বিশ্বাস করতে নেই। অনুসন্ধান করে সত্য মিথ্যা যাচাই করতে হয়।
হাদিসটা আমিও জানি। ঠিক আছে যান। আর দেরি করাব না।
ফায়সাল সালাম বিনিময় করে ভাড়া ঠিক করে একটা রিকশায় উঠে বসল।
খোকসাবাড়ি গ্রামে ঢুকে রাস্তার পাশে একটা মসজিদে মাগরিবের আযান হচ্ছে শুনে ফায়সাল রিকশাওয়ালাকে থামতে বলে বলল, আমি নামায পড়ব। সে জন্য আপনাকে পাঁচটাকা বেশি দেব। তারপর জিজ্ঞেস করল, এখান থেকে চৌধুরী বাড়ি কত দূর?
রিকশাওয়ালা বলল, বেশ খানিকটা দূর। পাঁচ টাকা বেশি দিতে হবে না, আমিও নামায পড়ব।
নামায শেষে রিকশায় উঠে ফায়সাল বলল, আপনি নামায পড়েন জেনে খুব খুশি হয়েছি। কবে থেকে নামায পড়েন?
ছোটবেলায় আব্বা নামায ধরিয়েছেন তারপর আর ছাড়ি নি।
সুবহান আল্লাহ, আপনার আব্বা বেঁচে আছেন?
হ্যাঁ বেঁচে আছেন, তবে খুব বুড়ো হয়ে গেছেন।
আপনারা কয় ভাই?
পাঁচ ভাই।
সবাই এক সংসারে আছেন?
না। আব্বা এক এক করে ছেলে বিয়ে দিয়ে ভিন্ন করে দিয়েছেন।
সব ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেছে?
চার জনের হয়েছে। আমি সবার ছোট, আমার এখনও হয় নি।
আপনি তা হলে মা বাবার সংসারে আছেন?
হ্যাঁ, তবে সামনের বছর বিয়ে দিয়ে আব্বা ভিন্ন করে দেবেন।
আপনার তো বয়স হয়েছে, এখনও আপনার বাবা বিয়ে দেন নি কেন?
আমি এখনও দশ হাজার টাকা আব্বার কাছে জমা করতে পারি নি।
টাকার সঙ্গে বিয়ের কি সম্পর্ক? বিয়ে তো দেবেন আপনার বাবা।
তা তো দেবেন, কিন্তু দেন মোহরের টাকা আমাকে যে দিতে হবে। তাই সেই টাকা জোগাড় করছি।
অন্যান্য ভাইয়েরাও তাই করেছেন?
হ্যাঁ।
বাহ! খবু ভালো কথা তো? এরকম কথা কখনও না শুনলেও এটা ইসলামের কথা।
ততক্ষণে তারা চৌধুরী বাড়ির গেটে পৌঁছে গেল। রিকশাওয়ালা বলল, নামুন, এটাই চৌধুরী বাড়ি।
গেটের উপর একটা বাল্ব জ্বলছিল। তার আলোতে ফায়সাল দেখল, অনেক পুরানো বেশ বড় লোহার গেট। ততক্ষণে অন্ধকার নেমেছে। তাই চারপাশে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেল না।
রিকশাওয়ালা অধৈর্য গলায় বলল, কই নামুন। আমাকে এতটা পথ ফিরে যেতে হবে।
ফায়সাল একটা ব্রিফকেসে কাপড় চোপড় ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে এসেছে। সেটা নিয়ে রিকশা থেকে নেমে বলল, গেট তো বন্ধ।
রিকশাওয়ালা বলল, ভিতরে দারোয়ান আছে, ডাকলে খুলে দেবে।
রিকশা বিদায় করে ফায়সাল গেটের কাছে গিয়ে বলল, কে আছেন, গেট খুলুন।
দুতিনবার বলার পর ভিতর থেকে আওয়াজ এল, কে?
আমি ঢাকা থেকে এসেছি, গেট খুলুন।
আপনাকে কি আসতে বলা হয়েছিল?
হ্যাঁ।
নাম বলুন।
ফায়সাল আহম্মদ।
একটু অপেক্ষা করুন।
প্রায় পাঁচ মিনিট পর দারোয়ান গেট খুলে দিতে ফায়সাল ভিতরে ঢুকল।
দারোয়ান তার আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে বলল, আসুন আমার। সঙ্গে। তারপর যেতে যেতে বলল, আপনার তো গতকাল আসার কথা ছিল, তাই না?
হ্যাঁ।
গেট থেকে বাড়িটা বেশ দূরে। দোতলার বারান্দার কার্নিশে আড়াইশ পাওয়ারের বাল্বের আলোতে ফায়সাল দেখতে পেল, দোতলা পাকা বাড়ি। বাড়ির সামনে অনেক খানি ফাঁকা জায়গা। সেখানে বিভিন্ন তরি-তরকারির চাষ করা হয়েছে। পাঁচিলের গা ঘেঁষে সারি সারি অনেকগুলো কাঁচা ঘর।
দারোয়ান তাকে ড্রইংরুমে নিয়ে এসে বলল, আপনি বসুন, মালেকিন কিছুক্ষণের মধ্যে আসবেন। কথা শেষ করে চলে গেল।
ফায়সাল একটা সোফায় বসে ব্রিফকেসটা পাশে রেখে চারপাশে চোখ বোলাল, মেঝেয় দামি কার্পেট বিছান, সোফাসেট ও অন্যান্য সব কিছু অত্যাধুনিক। তিন পাশে দেয়ালে বাংলাদেশের কয়েকজন মনীষীর বাঁধানো ছবি। আর ভিতরে যাওয়ার দরজার উপরে দেয়ালে ত্রিশ ও পয়ত্রিশ বছরের যুবক যুবতীর ওয়েল পেন্টিং। একটা চার পাঁচ বছরের ফুটফুটে মেয়ে যুবতীর হাত ধরে রয়েছে। যুবতীর ফটোতে তার চোখ আটকে গেল। এই অপূর্ব সুন্দরীকে প্রায় মাঝে মাঝে স্বপ্নে দেখে। তাই তার মুখের ছবি আজও মনে গেঁথে আছে। ভালো করে দেখে তার মনে হল, ফটোর মেয়েটি স্বপ্নে দেখা মেয়েটির বড় বোন অথবা মা। তারপর চার পাঁচ বছরের মেয়েটির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে মনে হল, স্বপ্নে দেখা মেয়েটির ছোটবেলার ফটো। এমন সময় ঠক ঠক শব্দ শুনে সেদিকে তাকাতে দেখল, দেয়ালে টাঙ্গানো যুবতী মেয়েটা তার সামনের সোফায় বসে টেবিলে পেপার ওয়েট ঠুকে শব্দ করছে। তবে ফটোর মেয়েটির থেকে এই মেয়েটির বয়স বেশি। তবু খুব অবাক হয়ে সালাম জানাতে ভুলে একবার ফটোর মেয়েটার দিকে আর একবার সোফায় বসা মেয়েটির দিকে তাকাতে লাগল।
পরের পর্ব :
২. পৈত্রিক সূত্রে বিশাল সম্পত্তি
৩. কাগজে বিজ্ঞপ্তি দেখে
৪. হারেস মাঝে মাঝে ঢাকা গিয়ে
৫. ফায়জুন্নেসা ফায়সালকে ডেকে পাঠিয়ে
৬. মাস তিনেকের মধ্যে মসজিদ তৈরি