সে কোন বনের হরিণ: ১০. প্রায় পনের ষোল দিন হয়ে গেল

সে কোন বনের হরিণ: ১০. প্রায় পনের ষোল দিন হয়ে গেল

১০. প্রায় পনের ষোল দিন হয়ে গেল

প্রায় পনের ষোল দিন হয়ে গেল আব্দুস সাত্তারের কোনো খোঁজ নেই। তাসনিম প্রতিদিন তার বাসায় ফোন করে। কিন্তু কাজের বুয়া জমিলা কিছু বলতে পারে না। আজ মাগরিবের নামাযের পর নসিম হেযাজীর “খুন রাঙা পথ” পড়ছিল।

কাজের বুয়া এসে বলল, আপা, আপনারে সাহেব বোলাইছেন।

তাসনিম বলল, তুমি যাও, আসছি। তারপর বইটা বন্ধ করে যাওয়ার সময় সায়মাকে আব্বর রুমের দিকে যেতে দেখে জিজ্ঞেস করল,কী রে, তোকেও ডেকেছে না কী?

তাসনিম বেডরুমে পড়ছিল, আর সায়মা রিডিংরুমে। কাজের বুয়ার মুখে আবু ডাকছে শুনে সায়মাও যাচ্ছিল। আপুর কথা শুনে বুঝতে পারল, তাকেও ডেকেছে। বলল, হ্যাঁ। জিজ্ঞেস করল, কেন ডেকেছে কিছু বুঝতে পারলি?

তাসনিম যেতে যেতে বলল, দু’জনকে একসঙ্গে যখন ডেকেছে তখন নিশ্চয় কোনো গুরুত্বপূর্ণ কারণ আছে।

সায়মা বলল, আমারও তাই মনে হচ্ছে। তারপর আব্বর রুমে ঢুকে দেখল, আম্মুও আছে।

তাদের দেখে রোকন উদ্দিন সাহেব হাসিমুখে বললেন, আয় বস। বসার পর তাসনিমকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ভেবেছিলাম, তোকে ওমরের হাতে তুলে দেব। তোর মায়ের মুখে শুনলাম, তুই তাকে পছন্দ করিস না। তাই একটা ভালো ছেলের খোঁজে ছিলাম। আল্লাহ মিলিয়ে দিয়েছেন। ছেলের মা বাবা আমেরিকায়। সেটেল্ড। সেখানে তাদের বাড়ি, গাড়ি ও ব্যবসা আছে। সবাই ওখানকার নাগরিক। তাদের একমাত্র ছেলে আবু সাঈদ ডাক্তারী পাশ করে ওখানকার হাসপাতালে জয়েন করেছে। ওরা সবাই ধার্মিক। এরকম ছেলের সঙ্গে বিয়ে হলে তুই সুখী হবি। এখানে তাদের বাড়ি মাগুরা। দিন দশেক হল মা-বাবা ছেলেকে নিয়ে দেশে এসেছেন, ধার্মিক বাংলাদেশী মেয়ে বৌ করে নিয়ে যাবেন বলে। আমার এক বন্ধুর বাড়ি মাগুরায় ওদের গ্রামে। সে সম্বন্ধটা এনেছে। ছেলে ও তার মা বাবা কাল সকালে তোকে দেখতে আসবেন। পছন্দ হলে দু’চার দিনের মধ্যে ছেলের বিয়ে দেবেন। মাসখানেক পর বৌ নিয়ে আমেরিকায় চলে যাবেন। কাল তোরা কোথাও যাবি না, বাসায় থাকবি।

মুমীনা বেগম বললেন, অন্যের কথায় বিশ্বাস করে কিছু করা উচিত নয়। বিশেষ করে বিয়ে শাদীর ব্যাপারে। তুমি ভালো করে খোঁজ খবর নিয়েছ?

তা আর নিই নি? আমার চাচাত ভাই আব্দুস সামাদকে তো তুমি চেন। বছর দুই হল সে আমেরিকা গেছে। ওদের কাছাকাছি থাকে। বন্ধু বলার পর তাকে ফোন করেছিলাম। যা বলল, বন্ধুর কথার সঙ্গে সব মিলে গেছে। আরো বলল, আজকালের যুগে এত ভালো ঘর ও ভালো ছেলে লাখে একটা আছে কিনা সন্দেহ। তুমি দেখো তাসনিমের মা, আমাদের তাসনিম সুখে থাকবে।

আব্বু থেমে যেতে তাসনিম বলল, কিন্তু আমি তো এখন বিয়ে করব না। আব্দুস সামাদ চাচা যখন ছেলে ও ছেলের মা বাবার সম্পর্কে ভালো সার্টিফিকেট দিয়েছেন তখন সায়মার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দাও। ওর তো দু’মাস পরে পরীক্ষা। পরীক্ষার পর স্বামীর কাছে চলে যাবে।

রোকন উদ্দিন সাহেব রেগে গিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, সায়মার ব্যাপারে তোকে চিন্তা করতে হবে না। তুই এখন বিয়ে করবি না কেন?

আমি যাকে ভালবাসি, তাকে ছাড়া বিয়ে করব না।

রোকন উদ্দিন সাহেব উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, তুই কী সেই রাজাকারের ছেলের কথা বলছিস?

হ্যাঁ আব্বু, তাকে যদি তোমাদের পছন্দ না হয়, চিরকুমারী থাকব।

রোকন উদ্দিন সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আরো উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, শুনেছ তোমার বড় মেয়ের কথা? ও সেই রাজাকারের ছেলেকে ছাড়া বিয়ে করবে না? তারপর তাসনিমকে বললেন, আমাদের কোনো পুত্র সন্তান নেই। তাই তোদের সব আবদার পূরণ করি। তাই বলে রাজাকারের ছেলের হাতে তোকে দেব, এটা ভাবলি কী করে? দুনিয়া এদিক ওদিক হয়ে গেলেও তা সম্ভব নয়। তারপর স্বর নামিয়ে বললেন, তুই একজন মুক্তিযোদ্ধার মেয়ে হয়ে বাবার মান সম্মানের দিকে একটু খেয়াল করবি না? ওকে ভুলে যা মা, ভুলে যা। ওর হাতে কিছুতেই তোকে তুলে দিতে পারব না।

আব্বুকে নরম হতে দেখে তাসনিমের সাহস বেড়ে গেল। বলল, কেন পারবে আব্বু? রাজাকার ছিলেন তোমার বন্ধু। দোষ করলে তোমার বন্ধু করেছেন। তার ছেলে তো করে নি। তা ছাড়া আমরা যাদেরকে রাজাকার বলে জানি, তিনি। তা ছিলেন না। আমার এক বান্ধবী আছে, তার বাবাকেও গ্রামের লোক রাজাকার বলত। তিনি গ্রামে টিকতে না পেরে সবকিছু বিক্রি করে ঢাকায় এসে বসবাস করছেন। তার মুখে শুনেছি, তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ না দিলেও নিজের ও আশপাশের গ্রামের লোকজনদের পাক বাহিনীর অত্যাচার থেকে রক্ষা করার জন্য বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছেন। তবু তাকে সবাই রাজাকার বলত। জেনেছি, তোমার বন্ধুও তাই করেছেন। এরকম ধরনের রাজাকার অনেক আছেন। যারা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যখন যে দল সরকার হয়েছে, সেসব দলে ভীড়ে বড়বড় পদে কাজ করেছেন এবং এখনও করছেন। একটা জিনিস ভাবছ না কেন? প্রত্যেক সরকারের কমবেশি জনগোষ্ঠী সমর্থক থাকে। যারা সব সময় সরকারের পক্ষে কাজ করে। পাকিস্তান সরকারেরও ছিল। তারা পাকিস্তান সরকারকে সাহায্য করলেও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বাধীন দেশের সরকারের আনুগত্য মেনে। নিয়েছে। একথা জানতে পেরে অথবা বুঝতে পেরে তকালীন প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। তাদের মধ্যে এমন কিছু লোক ক্ষমা পেয়েছে, যারা নাকি স্বাধীনতাি যুদ্ধের বিরোধী ভূমিকা করেছে এবং যুদ্ধকালীন সময়ে দেশের বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করতে সহায়তা করেছে এবং এখনও তারা স্বাধীনতা বিপন্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। এরাই সত্যিকার রাজাকার, এরাই দেশের চিরশত্রু। এদেরকে ধরে ফাঁসিতে ঝোলান উচিত। আর তাদেরকেও ফাঁসিতে ঝোলান উচিত, যারা মুসলমান হয়েও বারকোটি মুসলমানের দেশ থেকে ইসলাম মুছে ফেলার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।

তোমার বন্ধু মুক্তিযুদ্ধ করেন নি, এটাই তার অপরাধ; কিন্তু তিনি তো মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেন নি। বরং যতটা সম্ভব লোকজনদের জান, মাল ও ইজ্জত বাঁচাবার চেষ্টা করেছেন। সেজন্য তার হাজার হাজার টাকা খরচও হয়েছে। সে সব খবর কেন নাও নি? তিনি কী তোমার শত্রু ছিলেন? জেনেছি, স্কুল জীবন থেকে তোমাদের মধ্যে গভীর বন্ধুতু ছিল। তোমার উচ্চ ডিগ্রী নেওয়ার পেছনে তার ও তার বাবার অবদান কম ছিল না। সে সব কথা ভুলে গিয়ে ও তার। কর্মকাণ্ডের খোঁজ খবর না নিয়ে কেবলমাত্র মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন নি বলে এত বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করেছ। বন্ধুত্ব ফিরে পাওয়ার জন্য তিনি সবকিছু জানিয়ে ক্ষমা চাইতে তোমার কাছে রাতের অন্ধকারে কয়েকবার এসেছিলেন; কিন্তু তাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে অপমান করে প্রতিবারেই তাড়িয়ে দিয়েছ। এটা উচিত না অনুচিত হয়েছে, ভেবে দেখেছ কোনো দিন?

তুমি জান কিনা জানি না, হাদিসে আছে, আমাদের নবী (দঃ) বলিয়াছেন, “তিন দিনের অতিরিক্ত কোনো মুসলমানের পক্ষে তাহার ভ্রাতাকে পরিত্যাগ সে কোন বনের হরিণ ৭ করিয়া থাকা হালাল নহে। যে তিন দিবসের অতিরিক্ত তাহাকে পরিত্যাগ করিয়া থাকে অতঃপর তাহার মৃত্যু হয়, সে দোযখে যাইবে(১)।”

আল্লাহ কুরআনে বলিয়াছেন, “মুমিনগণ তো সকলেই (পরস্পর) ভাই, সুতরাং তোমাদের ভ্রাতৃদ্বয়ের মধ্যে সন্ধি করাইয়া দাও এবং আল্লাহকে ভয় কর, যেন তোমাদের প্রতি দয়া বর্ষিত হয়(২)।”

সে হিসাবে আব্দুস সাত্তারের বাবা তোমার ভাই। তার উপর তিনি তোমার বন্ধু ছিলেন। বন্ধু আত্মীয়ের সমান। আত্মীয়তা ছিন্ন করাও কবিরা গুনাহ। হাদিসে আছে, নবী (দঃ) বলিয়াছেন, “বিদ্রোহ ও আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা ব্যতীত আর অন্য কোনো গুনাহ নাই, যাহার জন্য আখিরাতে শান্তি অবধারিত থাকা সত্ত্বেও এই পৃথিবীতে তাহার শাস্তি হয়(৩)।”

আমি তোমাদের মেয়ে। কথা না শুনলে আমাকে তোমরা যা ইচ্ছা তাই শাস্তি দিতে পার। তবু বলব, আব্দুস সাত্তারকে ভাল না বাসলেও তোমার ও তার আব্বার সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার কথা জানার পর যেমন করে হোক সেই সম্পর্ক জোড়া দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতাম এবং এখনও তাই করব। আমার শেষ কথা তোমরা শুনে নাও, একমাত্র মৃত্যু ছাড়া আব্দুস সাত্তারের কাছ থেকে আমাকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। আরা একটা কথা না বলে পারছি না, ছোটবেলায় আমরা যে আলুকে দেখেছি, বড় হয়ে সেই আন্ধুকে আবছা আবছা দেখতাম। মন্ত্রী হওয়ার পর তাও দেখতে পাচ্ছি না। তোমার মুখের উপর অনেক কিছু বলে খুব বড় বেয়াদবি করে ফেললাম। সেজন্য মাফ চাইছি। তারপর সেখানে থেকে নিজের রুমে এসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।

রোকন উদ্দিন সাহেব মেয়ের কথা শুনে এত অভিভূত হলেন যে, কোনো কথা বলতে পারলেন না। তাসনিমের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

সায়মা আবু আম্মুর দিকে ভয়ে ভয়ে একবার তাকিয়ে রিডিংরুমে এসে পড়তে বসল। কিন্তু পড়ায় মনোযোগ দিতে পারল না। ভোলা বইয়ের পাতার দিকে তাকিয়ে আপুর কথাগুলো চিন্তা করতে লাগল। একসময় ভাবল, আপু এত সাহস পেল কোথায়? মনে হয় প্রেমে পড়লে সাহস বেড়ে যায়। কথাটা ভেবে নিজে নিজে হেসে উঠল।

তাসনিমের কথা শুনে রোকন উদ্দিন সাহেবের রাগ পড়ে গেল। সেই সাথে কুরআন-হাদিসের বাণী শুনেও নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। কোনো কথা বলতে না পেরে তার দিকে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। দুই মেয়েকে চলে যেতে দেখেও কিছু বললেন না।

মুমীনা বেগম বড় মেয়ের কথা শুনে খুব খুশী হয়েছেন। স্বামীর মনের অবস্থা অনুমান করতে পেরে বললেন, আমার তো মনে হচ্ছে, তাসনিম খুব ভালো কথা বলেছে। বিয়ের ব্যাপারে এখন আর ওকে কিছু বলল না। তোমার বন্ধু যে। ছেলেটার কথা বলেছেন, কাল তারা এলে সায়মাকে দেখাও, তারা যদি ওকে পছন্দ করে, তা হলে তাসনিম যা বলল, সেই ব্যবস্থা করাই আমি ভালো মনে করি।

রোকন উদ্দিন সাহেব দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, তাসনিম যে এত কুরআন-হাদিসের জ্ঞান রাখে, তা জানতাম না। ওর কথা শুনে মনে হচ্ছে, আব্দুল হামিদের সঙ্গে যা কিছু করেছি তা সত্যিই আমি ভুল করেছি। তাসনিম মস্তবড় গুনাহর থেকে বাঁচার পথ দেখাল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি আব্দুল হামিদের। কাছে ক্ষমা চাইব।

মুমীনা বেগম খুব আনন্দিত হয়ে বললেন ও অনেক আগে থেকে। কুরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা ও ধর্মীয় নানারকম বইপত্র পড়ে, জানবে না কেন? ওতো বেশ কিছুদিন আগে থেকে বোরখা পরে বাইরে যায়।

যারা ধর্মীয় বইপত্র পড়ে, তারা বোরখা পরতে বাধ্য হবে। এখন ওসব কথা থাক। ভাবছি, ওরা কাল এলে সায়মাকেই দেখাব।

আমিও তো তাই বললাম। তবে তার আগে সায়মার মতামত নিতে হবে।

কেন? ও আবার কাউকে ভালবাসে নাকী?

তা জানি না। আজ খাওয়ার পর তাসনিমকে জিজ্ঞেস করলে জানা যাবে। সে রকম কিছু হলে তাসনিম জানবেই।

.

খাওয়ার টেবিলে তাসনিম নেই দেখে রোকন উদ্দিন সাহেব বুঝতে পারলেন, রাগ করেছে। সায়মাকে বললেন, তাসনিমকে ডেকে নিয়ে আয়। না আসতে চাইলে বলবি, না এলে আমিও খাব না।

তাসনিম এশার নামায পড়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। সায়মা এসে জাগিয়ে বলল, আপু, ভাত খাবি চল।

তাসনিম বলল, খেতে ইচ্ছা করছে না। তোরা সবাই খেয়ে নে।

খাওয়ার টেবিল থেকে আলু তোকে ডাকতে পাঠাল।

গিয়ে বল, আমি খাব না।

তুই না খেলে আব্বুও খাবে না বলল।

তাসনিম জানে, সে না খেলে আব্বুও খায় না। তাই বলল, যাচ্ছি, তুই যা। তারপর উঠে বাথরুমে থেকে এসে খাওয়ার টেবিলে এল।

রোকন উদ্দিন সাহেব বললেন, কীরে মা, ছেলেকে বকা দিয়ে নিজেই রাগ করলি?

তাসনিম কিছু না বলে খেতে শুরু করল।

অল্প খেয়ে উঠতে দেখে রোকন উদ্দিন সাহেব বললেন, কিছুই খেলি না যে? বুড়ো ছেলের উপর এখনও রেগে রয়েছিস তা হলে?

তাসনিমের কান্না পাচ্ছিল আব্বুর কথা শুনে। তাই কিছু না বলে বেসিনে হাত মুখ ধুয়ে চলে যাচ্ছিল। আব্বুর গলা শুনতে পেল, একটু পরে আমার কাছে আসবি।

তাসনিম রুমে এসে চিন্তা করল, আব্বুর সুর অন্য রকম মনে হল। তা হলে আল্লাহ কী তার দোয়া কবুল করেছেন? আবার ভাবল, এটা একটা চাল নয় তো? যদি তাই হয়, তা হলে কি বলবে চিন্তা করতে লাগল।

এমন সময় সায়মা এসে বলল, তুই যখন আব্বকে ঐসব কথা বলছিলি তখন যেমন খুব ভয় পেয়েছিলাম, তেমনি তোর সাহস দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম। আমি হলে তো লজ্জায় ও ভয়ে কোনো কথাই বলতে পারতাম না। তবে কথাগুলো বলে খুব ভালো করেছিস। মনে হচ্ছে আব্বুর মন চেঞ্জ হয়েছে।

কী করে বুঝলি?

আলুর কথা শুনে তুই কিছু বুঝতে পারিস নি?

আমাকে বোঝবার জন্য একটা চাল হতে পারে?

আমার কিন্তু তা মনে হচ্ছে না। সত্যিই আব্বুর মন চেঞ্জ হয়েছে।

তোর এরকম হওয়ার কারণ?

তুই চলে আসার পর আব্ব ও আর খেল না। মুখ হাত দুয়ে চলে গেল। আম্মু আমাকে জিজ্ঞেস করল, আমি কাউকে পছন্দ করি কিনা?

তাসনিম কপাল কুঁচকে বলল, তুই কী বললি?

আমি আবার কী বলব? বললাম নেই।

আম্মু আর কিছু জিজ্ঞেস করে নি?

জিজ্ঞেস করে নি, তবে বলল, “তোর আপু যখন এখন বিয়ে করবে না বলছে তখন কাল যারা আসবেন, তাদেরকে তোকে দেখাব।”

তাসনিম চমকে উঠে বলল, সত্যি বলছিস?

সত্যি না মিথ্যে আব্ব তো তোকে তার রুমে যেতে বলেছে, গেলেই জানতে পারবি।

তুই আম্মুকে কিছু বলিস নি?

আপাততঃ এই বিপদ থেকে তুই রক্ষা পাবি ভেবে বলেছি, “আমার কোনো আপত্তি নেই।”

তাসনিম তাকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, তুই আমাকে এত ভালবাসিস? দোয়া করছি, “আল্লাহ তোকে সুখী করুক।” তারপর। তাকে ছেড়ে দিয়ে চোখ মুছে বলল, যাই, আব্ব কেন ডেকেছে শুনে আসি।

তাসনিমকে দেখে রোকন উদ্দিন সাহেব বললেন, আমার কাছে এসে বস। বসার পর তার মাথায় একটা হাত রেখে বললেন, এত কুরআন হাদিস জানিস, আর এটা জানিস না, মা-বাবার মনে কষ্ট দেওয়া বড় গুনাহ?

তাসনিম বলল, তা জানব না কেন? জানি বলেই তো এত কিছু বলে বোঝালাম। নচেৎ তোমাদেরকে না জানিয়ে এতদিনে আমরা বিয়ে করে ফেলতাম।

রোকন উদ্দিন সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তখন যে সব কথা বললি, তা শুনে আমার ভুল ভেঙ্গে গেছে। আমি আব্দুল হামিদের সঙ্গে খুব শিঘ্রী দেখা করে মাফ চাইব।

তাসনিম আলুর দুটো হাত ধরে আপ্লুতকণ্ঠে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, আল্লাহ চাহে তো এবার আমরা আমাদের আব্বকে ছোটবেলার মতো দেখতে পাব। এমন সময় মাকে আসতে দেখে বলল, আম্মু, আব্ব কি বলল। শুনেছ?

মুমীনা বেগম হাসিমুখে বললেন, হ্যাঁ শুনেছি। তোর আব্ব আমাকে আগেই বলেছে। আব্দুস সাত্তারকে কালকেই নিয়ে আসবি। সেদিন কিছু না খেয়ে চলে গেছে।

এত তাড়াতাড়ি ও এত সহজে আব্বুর মন পাল্টে যাবে তাসনিম কল্পনাও করে নি। মনে মনে আবার আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে গিয়ে তার চোখে পানি এসে গেল। সেই অবস্থায় আব্বুর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল।

রোকন উদ্দিন সাহেবের হাত তখনও তাসনিমের মাথায় ছিল। নাড়া দিয়ে। বললেন, হ্যাঁরে মা, তোর আম্মু ঠিক কতা বলেছে।

তাসনিম চোখ মুছে বলল, ও তো এখন ঢাকায় নেই। পনের ষোল দিন হল দেশের বাড়িতে গেছে। ওর আম্মুর খুব কঠিন অসুখ।

রোকন উদ্দিন সাহেব আতঙ্কিত স্বরে বলরেন, তাই নাকী? তা হলে তো দু’একদিনের মধ্যে আমাকে যেতে হবে। ওঁর কাছেও আমি অনেক ঋণী, মাফ চাইতে হবে।

স্বামী থেমে যেতে মুমীনা বেগম বললেন, আমিও তোমার সঙ্গে যাব। উনি আমাকে মায়ের পেটের বোনের মতো মনে করতেন। তুমি দু’একদিনের মধ্যে যাওয়ার ব্যবস্থা কর।

রোকন উদ্দিন সাহেব মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, এর মধ্যে তুই কোনো খবর পাস নি?

না।

ঢাকার বাসায় ফোন করে জানিস নি?

ফোন করেছি, কিন্তু বাসায় কেউ নেই। শুধু কাজের বুয়া জমিলা আছে। সে কিছু বলতে পারে না।

ঠিক আছে, তুই এখন যা। ভেবে দেখি, কবে যাওয়ার ব্যবস্থা করা যায়।

তাসনিম ফিরে এসে সায়মাকে বসে থাকতে দেখে জড়িয়ে ধরে বলল, তোর কথাই ঠিক। আব্ব পাল্টে গেছে। তারপর সব কথা বলল।

সায়মা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, আমার আপু আল্লাহর খাটি বান্দি। তাই, তিনি তার দোয়া কবুল করেছেন। কাল আমাকে দেখতে আসবে, তারা যদি পছন্দ করে ফেলে, তা হলে তো দু’চার দিনের মধ্যে বিয়ে হয়ে যাবে। ছেলেটা কেমন হবে ভেবে খুব ভয় পাচ্ছি। তুই একটু দোয়া করে দে, যেন ছেলেটা ভালো হয়। তোর দোয়া নিশ্চয় আল্লাহ কবুল করবেন।

তাসনিম তাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, তোর সবটাতে দুষ্টমী। ঠিক আছে, দোয়া করছি, শুধু ছেলেটা নয়, তার মা-বাবাও যেন ভালো হয়। তারপর হেসে ফেলে বলল, হলো তো?

এমন সময় ফোন বেজে উঠতে দু’জনেই ঘড়ি দেখল, এগারটা।

সায়মা বলল, নিশ্চয় আব্দুস সাত্তার ভাই? কোনো কারণে সময়ের আগেই ফোন করেছেন।

তাসনিম হেসে উঠে বলল, সাহেব না বলে ভাই বললি যে?

সায়মাও হেসে উঠে বলল, বলব না? কয়েকদিন পরে শুধু ভাই নয় দুলাভাই বলতে হবে তো? তাই এখন থেকে অভ্যাস করছি।

তাসনিম হাসি থামিয়ে ফোন ধরে সালাম দিয়ে বলল, তাসনিম বলছি?

আব্দুস সাত্তার সালামের উত্তর দিয়ে বলল, কেমন আছ?

আনন্দে তাসনিমের বুকের রক্ত ছলকে উঠল। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে সামলাবার চেষ্টা করল।

কী হল? কথা বলছ না কেন? এতদিন যোগাযোগ করি নি বলে খুব রাগ হয়েছে? না অভিমান হয়েছে? যাই হোক না কেন ক্ষমা চাইছি।

তাসনিম বলল, তোমার জান এত শক্ত কেন? আমার উপর ঝড় বইতে শুরু করেছে জেনেও এতদিন একটুও খোঁজ খবর নিলে না।

সে কথা পরে বলব, আগে বল, ঝড়ের বেগ কমেছে, না বেড়েছে?

তার আগে বল খালাআম্মা কেমন আছেন?

আম্মু একটু ভালো; কিন্তু দাদিআম্মা ভালো না। তিনি তার একমাত্র নাতির বৌ দেখে মরতে চান। তাই তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি। ঝড়ের খবর বল।

আজ মাগরিবের নামাযের পর দু’শ মাইল বেগে বয়ে গেছে।

আব্দুস সাত্তার হেসে উঠে বলল, বাজে কথা।

কী? আমি বাজে কথা বলছি?

আহা, চটছ কেন? বাজে কথা মানে ঝড়ের বেগ যা বললে তা ঠিক নয়। বিশ পঁচিশ মাইল হতে পারে, সেই কথা বোঝাতে চেয়েছি।

কী করে বুঝলে?

তোমার গলার স্বরই বলে দিচ্ছে।

তাই যদি হয়, কাল সকালে আসতে পারবে?

কেন পারব না? তা ছাড়া তোমাকে যখন নিয়ে যেতে এসেছি তখন পাঁচশ মাইল বেগে ঝড় বইলেও কাল তোমাদের বাসায় যেতে হবেই। কাল তোমাকে নিয়ে কাজী অফিসে কাবিন করব। পরশু দেশের বাড়ি রওয়ানা দেব। কাল আরো কিছু কাজ সারতে হবে।

তার কথা শুনে আনন্দে তাসনিমের বুকের রক্ত আবার ছলকে উঠল। সামলাবার জন্য বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।

আব্দুস সাত্তার অধৈর্য গলায় বলল, চুপ করে আছ কেন? আমার সঙ্গে যাবে না?

তোমার কী মনে হয়?

একশ পার্সেন্ট সিওর, তুমি যাবে।

তা হলে জিজ্ঞেস করছ কেন?

বিয়ের ব্যাপারে ছেলেকে প্রথমে মেয়ের কাছে প্রস্তাব দিতে হয় বলে।

তার আগে তো মেয়ের গার্জেনদের কাছে প্রস্তাব পাঠাতে হয়?

কাল সকালে গিয়ে তোমার গার্জেনদের কাছে প্রস্তাব দেব। তোমার মতামত নিয়ে দিলে তো ওরা অর্ধচন্দ্র দিয়ে বিদায় করে দেবেন?

গার্জেনরা যদি প্রস্তাব নাচক করে দেন?

তুমি আমার ফরে থাকলে নাচক করে দিলেও রাজি করার জন্য কূটনৈতিক চাল চালব। আশা করি, ইনশাআল্লাহ আমি কামিয়াব হব।

নিজের প্রতি এতই তোমার বিশ্বাস?

নিজের প্রতি যা আছে, আল্লাহর উপর তার চেয়ে লক্ষগুণ বেশি আছে।

ঝড়ের রেজাল্ট শুনবে না?

না বললে শুনব কী করে?

ঝড় বিশ পঁচিশ মাইল বেগে বইতে শুরু করলে, তোমার শেখান কথাগুলো বলতে ঝড় থেমে গিয়ে বৃষ্টি হয়েছে।

বুঝলাম না।

তা হলে তুমিও মাঝে মাঝে কম বোঝ?

তোমার ধারণা ভুল।

কেন? এক্ষুনি তো আমার কথা বুঝতে পার নি বললে?

আমার অনুমান সত্য কিনা জানার জন্য বলেছি।

তা হলে বল, কী বুঝেছ?

আমার শেখান কথাগুলো শুনে তোমার আব্ব মত পাল্টেছেন।

বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাসনিম অনেকক্ষণ কথা বলতে পারল না।

কী হল? আমার অনুমান সত্য কিনা বললে না যে?

সত্য। কিন্তু খবু অবাক হচ্ছি, তুমি বুঝলে কী করে?

এতে অবাক হওয়ার কী আছে? ঝড় অর্থ দুর্যোগ, আর বৃষ্টি অর্থ শান্তি। আর বলা লাগবে?

না।

তা হলে এবার ঝড় বৃষ্টির ঘটনাটা বল।

তাসনিম আমেরিকার ছেলেটার কথা থেকে শুরু করে আব্বুর মত পাল্টান ও তারপর যা কিছু বলেছে বলে বলল, খালাআম্মার অসুখের খবর শুনে আব্বু তোমার আব্ব আম্মুর কাছে মাফ চাইতে দু’একদিনের মধ্যে দেশের বাড়িতে যাবে বলল। আর আম্মু কালকেই তোমাকে বাসায় নিয়ে আসতে বলল।

আব্দুস সাত্তার আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, এতক্ষণ কথাটা না বলে যে অন্যায় করেছ, তার শাস্তির জন্য প্রস্তুত থেক।

শাস্তি দেওয়ার সময়টা না বললে প্রস্তুত থাকব কী করে? বাসর রাতে।

দুষ্ট।

কী? আমি দুষ্টু? নিজে অন্যায় করে আমাকে দুষ্ট বলা হচ্ছে?

শুধু দুষ্টু নয়, অসভ্যও।

অন্যায়টা বেশি হয়ে যাচ্ছে। মনে রেখ, শাস্তির পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে কিন্তু।

শাস্তির ভয় অত দেখিও না। যে নাকি একটা মেয়েকে ভালবেসে দু’বছর মুখোমুখি হতে ভয় পায়, সে কত বড় বীরপুরুষ জানা হয়ে গেছে।

বীরপুরুষ কিনা বাসর রাতে টের পাবে।

আমিও টের পাওয়াব।

তুমি আবার কী টের পাওয়াবে?

বাসর রাতে দাদি আম্মার সেবা শুশ্রুষা করে কাটাব।

তা হলে আমাকে ভীতু বললে কেন? তুমিই তো আমার থেকে আরো বেশি ভীতু?

ঠিক আছে, কে ভীতু আরা কে বীরপুরুষ, বাসর রাতেই বোঝা যাবে।

এমন সময় সায়মা খপ করে তাসনিমের হাত থেকে রিসিভার কেড়ে নিয়ে বলল, এই যে মিস্টার হবু দুলাভাই, এই রুমে যে আপনার একজন ম্যাচিওর অবিবাহিতা হবু শালীও থাকে, তা জেনেও বাসর রাতের গোপন কথাবার্তা বলতে বিবেকে বাধছে না? না বাসর রাতের স্বপ্নে মশগুল হয়ে বাস্তব জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন?

স্বপ্নগুলো বাসর রাতের জন্য রিজার্ভ রেখে যা বলছি শুনুন, কাল সকাল আটটায় আসবেন। সবার সঙ্গে নাস্তা খাবেন। আলু আম্মু আসতে বলেছেন। এখন। সুবোধ ছেলের মতো ফোন রেখে ঘুমিয়ে পড়ুন। তারপর আব্দুস সাত্তারকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রিসিভার ক্যাডেলে রেখে তাসনিমকে জড়িয়ে ধরে বলল, “থ্রি চিয়ার্স ফর তাসনিম আপু, হীপ হপ হুর-রে।”

———–
(১) বর্ণনায় : হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ)-আহমদ, আবু দাউদ
(২) সূরা হুজুরাত, আয়াত-১০, পারা-২৬
(৩) বর্ণনায় : হযরত আবু বাকরাহ (রাঃ)-আবু দাউদ

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত