গলির সামনের একটা বাসার দুই তলার বারান্দায় প্রায়ই দেখি বারান্দার গ্রীল ধরে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। চুলগুলো বয়-কাট দেয়া। মেয়েটা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রথম প্রথম মনে হতো মেয়েটা অভদ্র৷ বাড়ির নিচেই মেইন রোড, দোকানের পর দোকান। বাড়ির সামনেই একটা চায়ের দোকান—চায়ের দোকানে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষদের আড্ডা। ভদ্র কোন মেয়ে নিশ্চয়ই সকাল-দুপুর, বিকেল-সন্ধ্যা, রাত সবসময় বারান্দায় থাকবে না, তাছাড়া মেয়েটা পড়াশোনাও বোধহয় করে না।
পড়াশোনা করলে দিনের বেলা অন্তত তাকে দেখা যেত না। মহল্লায় নতুন ভাড়া এসেছে। দোতলার বারান্দা বরাবর ঠিক সামনের দোকানটাই চায়ের দোকান। প্রতিদিন দুই থেকে তিনবার চা খেতে আসি। দোকানের মালিক হাবিব। হাবিব ভাল চা বানায়। সেজন্যই কয়েকটা চায়ের দোকান ফেলে এখানে আসা। দোকানে বসার সিস্টেমটা এমন যে—বসলেই বারান্দার দিকে চোখ চলে যায়। বারান্দায় তাকালেই দেখি মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। আমি কিছুটা বিরক্ত। মেয়েটা মাঝে মধ্যেই দোকানের দিকে তাকায়। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে৷ হাতে রুটি অথবা কলা থাকলে অস্বস্থিতে পড়তে হয়। খাওয়ার সময় কেউ তাকিয়ে থাকলে কি খাওয়া যায়? তাও আবার অপরিচিত একটা মেয়ে!
মেয়েটা বয়সে কম করে হলেও আমার ৫-৬বছরের ছোট হবে। গায়ের রঙ ফর্সা, চুলগুলো ছেলেদের মতো করে কাটায় তাকে দেখতে বিদেশীদের মতন লাগে। মাঝে মাঝে বলতে ইচ্ছা করে- “এই মেয়ে এই বারান্দায় এতো কি? যাও ঘরে যাও!” শেষ পর্যন্ত আর বলা হয়ে ওঠে না। আরো কিছুদিন কেটে গেল। ইদানীং মেয়েটা আমাকে দেখলেই হাসে। শিশু-বাচ্চাদের মতো হাসে। ব্যাপারটা আমার ভাল লাগে না। খুবই বিরক্ত হই। রিমি বাদে মেয়েদের প্রতি আমার আগ্রহ কম। আগ্রহ কম হবার কারণ হচ্ছে- আমাদের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। সম্পর্কটা কিছুদিন হলো দুই পরিবারে বেগ পেয়েছে। বিয়ের কথা-বার্তা চলছে। সবকিছু ঠিক-ঠাক থাকলে এ বছরই বিয়ে হবার কথা।
শেষপর্যন্ত চায়ের দোকান বদলালাম। মানুষের অনেক কিছুই সহ্য করা যায়, কিন্তু একজন অপরিচিত মেয়ে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বাচ্চা-সুলভ হাসি হাসবে তা সহ্য করা যায় না। মাসখানেক কেটে গেল। এরমধ্যে একবারও হাবিবের দোকানে যাইনি। একদিন দুপুরের দিকে সব চায়ের দোকান বন্ধ, হাবিবের দোকানটাই কেবল খোলা ছিলো। দোকানে গিয়ে বারান্দায় মেয়েটাকে দেখতে না পেয়ে মনে মনে খুশি হলাম। হাবিবকে চা দিতে বললাম। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে হাবিবের সাথে কথা বলছি এমন সময় মেয়েটা দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল- ভা ভা… মেয়ের কর্মকান্ডে আমি একদম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম, শুধু যে আমি একাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছি তা না। হাবিব সহ দোকানে বসে থাকা অন্যান্য কাস্টমাররাও ভীষণ অবাক হয়েছে।
মেয়েটা আচমকা অবস্থায় এসে এমন ভাবে ধরেছে যে চায়ের কাপ গায়ে পড়ে বিশ্রী অবস্থা। কিছু বলার আগেই একজন ভদ্রমহিলা এসে মেয়েটাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করল। সে আমাকে ছাড়তে চাইছে না। ভদ্রমহিলা বলল- “সুমনা আয় বলতেছি।” আমি শান্ত গলায় তাকে জিজ্ঞাসা করলাম- “সমস্যা কি?” তিনি কিছু বললেন না। সুমনা শেষপর্যন্ত বাড়ি ফিরল তবে সঙ্গে করে আমাকে নিয়ে। আমি বসে আছি সুমনাদের বসার ঘরে। সুমনা একের পর এক খেলনা বের করে আমার সামনে রাখছে, আপন মনে হাসছে। সুমনার মা বলল- “মেয়েটাকে নিয়ে আর পারি না বাবা।”
— “কি হয়েছে ওর?”
— “বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। বয়স বাড়ছে কিন্তু বুদ্ধির দিক থেকে এখনো চার বছরের বাচ্চাদের মতন। মেয়েটা কথাও বলতে পারে না।”
— “জন্ম থেকেই এমন?”
— “হু। জন্ম থেকেই। অনেক ডাক্তার দেখালাম লাভ হলো না। তোমার শার্ট টা তো চা দিয়ে ভরে গেছে।”
— “সমস্যা নেই খালাম্মা, আমি তাহলে উঠি।”
আমি উঠলাম কিন্তু সুমনা আমাকে ছাড়ছে না। সুমনা আমার হাত ধরে টানছে, কাঁদতে কাঁদতে বলছে- ভা ভা খালাম্মা বলল- “কি বলব বাবা দুঃখের কথা, ওর একটা ভাই ছিলো, দুইবছর আগে রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে। তোমাকে মনে হয় ওর কাছ ওর ভায়ের মত লাগতেছে এই জন্যে ভা ভা বলে ডাকতেছে। রাকিবকেও ভা ভা বলত।”
বিকেল পর্যন্ত সুমনার সাথে খেলে এরপর বাড়ি ফিরলাম। আমার হিসেবে গণ্ডগোল হয়েছে, সুমনা আমার চেয়ে বয়সে ছোট না, সে আমার চেয়ে পাঁচ বছরের বড়। সুমনাদের বাসায় আমি প্রায়ই যাই। ও আমার বয়সে বড় হলেও আমার ছোটবোন। ও এখন আমাকে ভায় ভায় বলে ডাকে। বড় মায়া লাগে।
আমরা দুজন মিলে অনেক কিছু খেলি। রেলগাড়ী ওর বিশেষ পছন্দ। খেলনা রেলগাড়িটা প্রতিবার লাইন ঘুরে আসতেই সুমনা খুশিতে হাত তালি দেয়, লাইনচ্যুত হয়ে ভেঙ্গে গেলে মন খারাপ করে। আমি তাকে অনেকবার দেখিয়েছি কিভাবে রেলগাড়ি জোড়া লাগাতে হয়, সে এখনো পারছে না। হয়তো একদিন পারবে।