সে কোন বনের হরিণ: ০৪. আপুর কথায় সায়মা রেগে

সে কোন বনের হরিণ: ০৪. আপুর কথায় সায়মা রেগে

০৪. আপুর কথায় সায়মা রেগে

আপুর কথায় সায়মা রেগে ড্রইংরুমে এসে তখনই উম্মে কুলসুমের বাসায় ফোন করল।

উম্মে কুলসুমের ফুফু রাইসা বেগম ফোন ধরে বললেন, হ্যালো, কে বলছেন?

ভারী গলা শুনে সায়মা মনে করল, নিশ্চয় উম্মে কুলসুমের মা। সালাম দিয়ে বলল, খালাআম্মা, আমি উম্মে কুলসুমের বান্ধবী। ওকে একটু দিন তো?

রাইসা বেগম সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, ও তো বাসায় নেই। আব্দুস সাত্তারের সঙ্গে মার্কেটিং করতে গেছে।

আব্দুস সাত্তার কে?

ওমা, তাও জান না? আব্দুস সাত্তার ওর ছোট ভাইয়া।

শুনে সায়মার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ভাবল, তার অনুমানই ঠিক হল। জিজ্ঞেস করল, আপনি কে?

আমি ওদের ফুফু।

ওর সঙ্গে আমার জরুরী দরকার ছিল। আপনাদের বাসার নাম্বারটা ভুলে গেছি। দয়া করে একটু বলুন না।

তুমি কেমন মেয়ে, বান্ধবীর বাসার নাম্বার ভুলে যাও? এখানে কোনো দিন আস নি?

না ফুফুআম্মা, উম্মে কুলসুম অনেকবার যেতে বলেছে, যাব যাব করেও যাওয়া হয় নি। কত নাম্বার রাজারবাগ যেন বলেছিল?

তুমি তো খুব ভুলো মেয়ে দেখছি। বললে আবার ভুলে যাবে। কাগজ কলম নাও, বলছি।

একটু ধরুন বলে সায়মা কাগজ কলম এনে বলল, বলুন।

…..নাম্বার রায়ের বাজার।

লিখে নিয়ে সায়মা বলল, এবার রাখি ফুফুআম্মা?

রাখ বলে রাইসা বেগম রিসিভার রেখে দিলেন। তারপর রুম থেকে বেরিয়ে উম্মে কুলসুমকে আব্দুস সাত্তারের রুমের দিক থেকে দৌড়ে আসতে দেখে বললেন, দৌড়াচ্ছিস কেন? দাঁড়া বলে জিজ্ঞেস করলেন, তোরা কখন ফিরলি?

এই তো কিছুক্ষণ আগে।

সায়মা নামে তোর এক বান্ধবী এক্ষুনি ফোন করেছিল। ফিরেছিস জানলে ডেকে দিতাম।

উম্মে কুলসুম আতঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, কেন ফোন করেছিল কিছু বলেছে?

সায়মা যেসব কথা বলেছে, রাইসা বেগম বললেন।

উম্মে কুলসুম তাড়াতাড়ি ছোট ভাইয়ার কাছে এসে সে কথা জানাল।

আব্দুস সাত্তার ভেবেছিল, তাদের সম্পর্ক গভীর হওয়ার পর নিজেকে রূপার কাছে প্রকাশ করবে। আজ ফোন নাম্বার দেওয়ার সময় মনে হয়েছিল, আর বোধ হয়। বেশি দিন আড়াল হয়ে থাকতে পারবে না। কিন্তু আজই ওরা জেনে যাবে ভাবে নি।

তাকে চুপ করে থাকতে দেখে উম্মে কুলসুম বলল, কী ভাবছ ছোট ভাইয়া?

ভাবছি, ধরা যখন পড়েই গেলাম তখন আর লুকোচুরি করা ঠিক হবে না।

হ্যাঁ, সেটাই ভালো। আচ্ছা ছোট ভাইয়া, রূপা আপা তোমাকে ভালবাসে কিনা বুঝতে পেরেছ?

পেরেছি, তবে কতটা ভালবাসে বুঝতে পারি নি। বলতো, রূপাকে তোর কেমন মনে হয়?

শুধু ভালো নয়, খুব ভালো। ওঁর মতো মেয়ে দেখেছি বলে মনে হয় না। আব্বু আম্মু দেখলে পছন্দ করবেই।

আব্দুস সাত্তার ছোট একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, তা আমিও জানি। কিন্তু রূপার আব্বা কিছুতেই আমাকে পছন্দ করবেন না।

কেন?

সে অনেক কথা। পরে শুনিস।

উম্মে কুলসুম একটু অবাক হয়ে বলল, তুমি রূপা আপার আব্বাকে চেন তা হলে?

হ্যাঁ চিনি।

পরে নয়, এখনই বল, আমি শুনব।

রূপার আব্বার নাম রোকন উদ্দিন। রোকন উদ্দিনের আব্বা সালাউদ্দিনের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। তোর শ্বশুরবাড়ির পাশের গ্রামে বাড়ি। সালাউদ্দিনের বাস্তুভিটে ছাড়া সামান্য ফসলী জমি ও একটা আম, কাঁঠাল ও সুপারির বাগান ছিল। রোকন উদ্দিনই তার একমাত্র সন্তান। তার উপর খুব ভালো ছাত্র। তাই ছেলেকে লেখাপড়া করাবার জন্য উনি ফসলী জমি ও বাগান দাদাজীর কাছে দশ বছরের জন্য সাফকওলা দিয়ে সেই টাকায় ছেলেকে লেখাপড়া করান। সে সব আর ছাড়িয়ে নিতে পারেন নি। মেয়াদ শেষ হওয়ার পর দাদাজী তাকে ডাকিয়ে এনে বললেন, তুমি তো টাকা ফেরত দিয়ে জমি ও বাগান ফিরিয়ে নিতে পারলে না, দলিল মোতাবেক ওগুলো এখন আমার। তখন উনি করুণ মুখে বললেন, তাতো বটেই। এখন থেকে আপনি ভোগ দখল করবেন, আমি আপত্তি করব কেন? হাইস্কুলে ভর্তির দিন থেকে রোকন উদ্দিনের সঙ্গে আব্বর গভীর বন্ধুত্ব। দু’জনেই তখন ইন্টার পড়তেন। যখন দাদাজী সালাউদ্দিনের সঙ্গে ঐসব। কথা বলছিলেন তখন আব্বুও সেখানে ছিলেন। তিনি জানতেন, ঐ জমির ফসল ও বাগানের আয়ে ওঁদের সংসার চলে। ওগুলো দাদাজী ভোগ দখল করলে ওঁদের সংসার কিভাবে চলবে ভেবে শিউরে উঠলেন। আব্বু সে কথা দাদাজীকে বলে বললেন, আপনি আরো কয়েক বছর ওঁকে সময় দিন। ওঁর ছেলে লেখাপড়া শেষ করে যখন রোজগার করবে তখন টাকা শোধ করে দেবেন। অথবা দলিলটা এখনই ফেরত দিয়ে বলুন, তোমাকে টাকাটা কর্জে হাসানা দিয়েছিলাম। যখন সামর্থ হবে তখন শোধ করে দিও। আর যদি কোনো দিন সামর্থ না হয়, তা হলে শোধ করতে। হবে না। আপনার সম্পত্তি আপনারই থাকবে। কর্জে হাসানা কি জিনিস, আপনি একদিন আমাকে বলেছিলেন, তাই বললাম। এতে যদি আমার বেয়াদবী বা অন্যায় হয়ে থাকে মাফ করে দিন।

আব্বুর কথা শুনে দাদাজীর চোখে পানি এসে গেল। চোখ মুছে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে চুমো খেয়ে বললেন, “আল্লাহ তোকে তাঁর প্রিয় বান্দাদের মধ্যে সামিল করুক।” তারপর সালাউদ্দিনকে দলিটা ফেরত দিয়ে বললেন, তোমার ছেলের বন্ধুর কথা তো শুনলে, ওকে দোয়া করো। আর যে টাকা তোমাকে দিয়েছি, তা কর্জে হাসানা দিয়েছি আজ থেকে মনে করবে।

সালাউদ্দিন যেন হাতে স্বর্গ পেলেন। দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেয়ে আনন্দে তার চোখে পানি এসে গেল। তবু খুব অপমান বোধ করে মাথা নিচের দিকে করে। রইলেন।

দাদাজী তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন, তুমি যখন জমি ও বাগান। সাফ কওলা দিয়ে টাকা নিতে এসেছিলে তখন কর্জে হাসানার মর্তবার কথা জানা থাকা সত্ত্বেও শয়তান সম্পত্তির লোভ মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। এখন আব্দুল হামিদের কথা শুনে আল্লাহ আমার জ্ঞান ফিরিয়ে দিয়েছেন। সে জন্যে তার পাক দরবারে শুকরিয়া জানাচ্ছি। কুরআন পাকে আছে, “মুমিনগণ একে অপরের ভাই” তুমি আমার মুমীন ভাই। অভাব বা বিপদের সুযোগ নিয়ে এক ভাই অন্য ভাইয়ের সম্পত্তি গ্রাস করা কোনো মুমীনের কাজ নয়। বরং অভাব বা বিপদের সময় তাকে সাহায্য করাই প্রত্যেক মুমীনের কর্তব্য। আর ভাইয়ের সাহায্য নেওয়া কোনো অপমানের কাজ নয়।

সালাউদ্দিন আপুত কণ্ঠে বললেন, আপনি আল্লাহর খাটি বান্দা। দোয়া করুন, “আল্লাহ যেন টাকাটা পরিশোধ করার তওফিক দেন।”

তারপর থেকে এম.এ. পাশ করা পর্যন্ত আব্ব, বন্ধু রোকন উদ্দিনকে টাকা দিয়ে অনেক সাহায্য করেছেন। এম.এ. পাশ করার পর আব্ব কলেজে শিক্ষকতা করতে ঢুকলেন; আর রোকন উদ্দিন ঢাকায় এসে ভাগ্যগুণে একটা বড় চাকরিতে ঢুকলেন। চার পাঁচ বছরের মধ্যে দাদাজীর টাকা পরিশোধ করে দেন। এরপর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হতে উনি স্বপরিবারে ভারতে চলে গিয়েছিলেন। সেখানে ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন। ভারতে যাওয়ার সময় আল্লুকেও যেতে বলেছিলেন। কিন্তু আবু যান নি। বরং পাক হানাদারদের সাহায্য করেছিলেন। তবে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কিছু করেন নি। এমন কি যদি উনি জানতে পারতেন, অমুক দিন অমুক গ্রামে পাক সৈন্যরা হামলা করবে। সঙ্গে সঙ্গে সেই গ্রামে লোক পাঠিয়ে গ্রাম ছেড়ে লোকজনদের চলে যেতে বলেছেন।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রোকন উদ্দিন যখন দেশে ফিরলেন তখন আমাদের ও আশপাশের গ্রামের মুক্তিযোদ্ধারা আব্বুকে রাজাকার বলে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। রোকন উদ্দিন মুক্তিবাহিনীর কমান্ডিং অফিসার ছিলেন। তাঁরই হস্তক্ষেপের ফলে আবু বেঁচে গেলেন। কিন্তু সবাই রাজাকার বলত। সে সময়। আব্ব অনেকদিন বাড়ির বাইরে কোথাও যেতেন না। শুধু কলেজে যেতেন, আর লোকজনের দ্বারা চাষ-বাসের কাজ করাতেন। একদিন রোকন উদ্দিন আব্বুর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। আব্বু আগেই জেনেছিলেন, ওঁর জন্যই মুক্তিযোদ্ধারা তাকে। কিছু বলে নি। তার দু’হাত ধরে আলু ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছিলেন এবং নাস্তাপানি খাওয়াবার ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু উনি একগ্লাস পানিও খান নি। দাদাজী মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার ছ’মাস আগে ইন্তেকাল করেন। দাদি বেঁচে ছিলেন। তিনি রোকন উদ্দিনকে বললেন, তোমাকে আমি আব্দুল হামিদের মতো দেখি। ওকে মাফ করে দিয়ে কিছু খাও। নচেৎ আমি দুঃখ পাব।

রোকন উদ্দিন সাহেব বললেন, আমিও আপনাকে মায়ের মতো জানি। আপনার কথায় ওকে মাফ করে দিলাম। তবে একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে রাজাকারের বাড়িতে কিছুতেই খেতে পারব না। সেজন্য আপনার কাছে মাফ চাইছি। তারপর ফিরে আসার সময় বাইরে এসে আব্বকে বলেছিলেন, তুমি জীবনে আর কখনও আমাকে বন্ধু ভাববে না। আমাদের বাড়িতে যেন তোমার পা পড়ে।

সেদিন ওঁর কথায় আব্বু ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলেন। সে সময় আমার বয়স পাঁচ আর তোর দুই কি আড়াই বছর হবে। বড় হয়ে যখন কলেজে পড়ি তখন একদিন আম্মুর মুখে এসব শুনেছিলাম। এখন তুই-ই বল, সেই রোকন উদ্দিন সাহেব কি আমাকে জামাই করবেন?

উম্মে কুলসুম একটু রেগে উঠে বলল, তুমি জেনেশুনে কেন তার মেয়ের প্রেমে পড়লে?

আব্দুস সাত্তার বলল, কেন পড়েছি বলছি শোন, প্রায় তিন বছর আগে গ্রীন সুপার মার্কেটে একদিন রূপাকে দেখে মুগ্ধ হই। তখন থেকে ওর কথা এক মুহূর্তও ভুলতে পারি নি। এর ছ’মাস পর পাবলিক লাইব্রেরীতে দেখি। সেদিন ওর সঙ্গে আমার এক ক্লাসমেটের বোন ছিল। পরে ঐ ক্লাসমেটের বোনের কাছ থেকে ওর বায়োডাটা জেনে মন খুব খারাপ হয়ে যায়। ওকে পাওয়া দুরাশা ভেবে মন থেকে ওর স্মৃতি মুছে ফেলার চেষ্টা করি। কিন্তু কিছুতেই সফল হতে পারলাম না। এভাবে আরো ছ’মাস কেটে গেল। একদিন রাতে ওর কথা মনে পড়তে কিছুতেই ঘুম আসছিল না। হঠাৎ মাথায় একটা চিন্তা খেলে গেল, কোনো রকমে যদি রূপার মন। জয় করতে পারি, তা হলে বিয়ের মাধ্যমে হয়তো আব্বুর সঙ্গে ওর আব্বার সম্পর্কের যে অবনতি হয়েছে, তা আবার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। পরের দিন ঐ। ক্লাসমেটের বোনের মাধ্যমে রূপাদের ফোন নাম্বার জেনে আজ দেড় বছর ওর সঙ্গে ফোনে আলাপ করছি। আলাপ করে ওর মন জয় করতে পেরেছি বলে মনে হয়। কিন্তু কতটা পেরেছি তা জানি না।

কিন্তু উনি যখন তোমার আসল পরিচয় জানতে পারবেন তখন তো তোমাকে ঘৃণা করবেন।

তা করতে পারে, আবার নাও পারে। আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত শত্রুর ছেলে মেয়ের মধ্যে অনেক প্রেমের ঘটনা ঘটেছে। অনেক ক্ষেত্রে যেমন শত্রুতা আরো বেড়েছে, তেমনি শক্রতার অবসানও হয়েছে।

তোমার ক্ষেত্রে যদি প্রথমটা হয়?

তা হতে পারে। তবে চেষ্টা করতে দোষ কি? তকদিরে থাকলে সাকসেসফুল হতে পারি। আব্বুর কাছ থেকে বাধা এলেও আম্মুকে দিয়ে তাকে ম্যানেজ করতে পারব। কিন্তু রূপার আব্বা পাহাড়ের মতো বাধা হয়ে দাঁড়াবেন।

ওটাতো গার্জেনদের ব্যাপার; রূপা আপা যদি তোমাকে ঘৃণা করে, তা হলে কী করবে ভেবেছ?

আব্দুস সাত্তার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, ভাবি নি যে, তা নয়। তাই তো তাকে পরিচয় ও দেখা না দিয়ে প্রেমের বীজ বপন করেছি এবং চারাও যে গজিয়েছে তাও বুঝতে পেরেছি। কিন্তু সেই চারা এতদিনে কত বড় হয়েছে, তা না জানা পর্যন্ত দেখা দিলেও আসল পরিচয় দেব না ভেবেছি।

একটা মহৎ উদ্দেশ্যের কথা বললে বলে বাধা দিলাম না। নচেৎ শুধু রূপের মোহে যদি তুমি তাকে ভালবাসতে, তা হলে নিশ্চয় কঠিন বাধা দিতাম। কারণ আমার ধারণা, রূপা আপা তোমাকে যতই ভালবাসুক না কেন, তিনি যখন জানবেন, তুমি রাজাকারের ছেলে এবং সেই কারণে তার ও আমাদের আব্বুর সঙ্গে শত্রুতা তখন তোমাকে ঘৃণা করবেই। তাই তোমার জন্য আমার খুব ভয় হয়। বড় ভাইয়াকে আল্লাহ দুনিয়া থেকে তুলে নিয়েছেন। এখন তুমিই আমাদের একমাত্র ভাই, রূপা আপার কারণে তোমার কিছু হলে আম্মু, আব্ব, আমরা কেউ-ই সহ্য করতে পারব না। আমি মনে করি, সে রকম পরিস্থিতি আসার আগেই রূপা। আপাকে তোমার পরিচয় দেওয়া উচিত।

আব্দুস সাত্তার বলল, ঠিক আছে, তুই এখন যা। ভেবে দেখি কী করা যায়।

.

আব্দুস সাত্তারের ফুফুর সঙ্গে ফোনে কথা বলার পর সায়মা চিন্তা করল, এখন। আপুকে বললে কিছুতেই বিশ্বাস করবে না। তার চেয়ে কাল সকালে তাকে নিয়ে ওদের বাসায় গিয়ে চাক্ষুস প্রমাণ দেখাবে।

সন্ধ্যের পর থেকে সায়মার মাথা ব্যথা করছিল। তাই দশটায় খাওয়ার পর একটা প্যারাসিটামল খেয়ে শুয়ে পড়ল।

।রূপা আজ বান্ধবী আসমার বাসায় বেড়াতে গিয়েছিল। তার রুমের টেবিলে নসিম হেযাজীর “কায়সার ও কিসরা” নামে একটা বেশ বড় বই দেখে কয়েক পাতা উল্টে বুঝতে পারল, ঐতিহাসিক উপন্যাস। এই ধরণের বই পড়তে তার খুব ভালো লাগে। ফেরার সময় আসমার কাছ থেকে বইটা এনেছিল। সন্ধ্যে থেকে প্রায়। অর্ধেক পড়ে ফেলেছে। খেয়ে এসে সায়মাকে ঘুমাতে দেখে কিছু বলল না। আগেই। তার মাথা ব্যথার কথা শুনেছে। টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে বইটা নিয়ে বসল।

ইসলামকে দুনিয়া থেকে মিটিয়ে দেওয়ার জন্য খৃষ্টান, ইয়াহুদী ও নজুসীদের রাজ্য জয়ের লোভ, যুদ্ধের হানাহানি ও তিন চার জোড়া নায়ক-নায়িকা নিয়ে সুখ-শান্তি, দুঃখ-বেদনা ও বিরহ-মিলনের অদ্ভুত কাহিনী। একবার পড়তে শুরু করলে শেষ না হওয়া পর্যন্ত পড়া ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা কারো হবে না।

রূপা পড়ার মধ্যে ডুবে গিয়ে সময়ের জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। ফোন বেজে উঠতে চমকে উঠে ঘড়ি দেখল, সাড়ে বারটা। সঙ্গে সঙ্গে হার্টবিট বেড়ে গেল। সামলাবার জন্য কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করল। তারপর রিসিভার তুলে সালাম দিল।

সালামের উত্তর দিয়ে আব্দুস সাত্তার খুব নরম সুরে বলল, সেদিন আর কখনও বিরক্ত করব না বলা সত্ত্বেও করলাম। সেজন্য ক্ষমা চাইছি।

রূপা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।

বুঝতে পারছি, আপনি আমার উপর খুব রেগে আছেন; কিন্তু কী করব বলুন, আপনার সঙ্গে কথা না বললে আজও সারা রাত জেগে কাটাতে হত। গত সাত আট দিন একফোঁটা ঘুমাতে পারি নি। প্লীজ, কথা বলুন।

আপনি যে ফ্রড নন, প্রমাণ করতে পারবেন?

ইনশাআল্লাহ পারব। কী প্রমাণ চান বলুন।

কাল আপনার মুখোমুখি হতে চাই।

আব্দুস সাত্তার বুঝতে পারল, সায়মা ঘটনাটা তাকে এখনও বলে নি। বলল, বেশ তো কোথায় কখন হতে চান বলুন।

সকাল আটটায় টি.এস.সির মোড়ে থাকবেন, আমি আসব।

ঠিক আছে, থাকব।

আপনাকে চিনব কী করে?

আপনাকে চিনতে হবে না, আমিই এগিয়ে এসে কথা বলব। এবার একটা। কথা বলব, কিছু মাইন্ড করবেন না বলুন?

মাইন্ড করার মতো কথা বললে, মাইন্ড করাই তো স্বাভাবিক।

না, মানে বলছিলাম কী, আপনি একা আসবেন।

ও এই কথা? আপনি না বললেও আমি একাই আসতাম।

এখনও জেগে ছিলেন মনে হচ্ছে?

হ্যাঁ, একটা বই পড়ছিলাম।

কী বই?

নসিম হেযাজীর কায়সার ও কিসরা।

আমি নসিম হেযাজীর সব বই পড়েছি। ঐতিহাসিক উপন্যাস পড়তে আমার খুব ভালো লাগে। আপনি কী ওঁর সব বই পড়েছেন?

না, এটাই প্রথম।

ওঁর লেখা সব বই আমার কালেকসানে আছে। নিয়ে পড়তে পারেন।

নেব কী করে? আপনি তো ধরাই দেন না।

ইনশাআল্লাহ কাল তো ধরা দিচ্ছি।

এখন তো পড়াশোনা নেই, তবু এতরাত জেগে রয়েছেন কেন?

একটু আগে কী বললাম ভুলে গেলেন?

না, ভুলি নি।

তবু জিজ্ঞেস করলেন কেন?

মানে জেগে জেগে কী করছিলেন, তা জানার জন্য।

আপনাকে ফোন করব বলে।

আমারও তো এখন পড়াশোনা নেই, আরো আগে করতে পারতেন।

তা পারতাম, নিরিবিলিতে অনেকক্ষণ আলাপ করা যাবে না ভেবে করি নি। তা। ছাড়া সায়মা যা চালাক, জেগে থাকলে আপনি কী এতক্ষণ আলাপ করতে পারতেন?

সায়মা খুব চালাক, আর আমি বুঝি খুব বোকা?

না, তা নয়। আপনি আমার মতো।

আপনার মতো মানে?

মানে, আমি বোকাও নই, চালাকও নই। আপনিও তাই।

আমার তো মনে হয় আপনি ভীষণ চালাক।

কী করে বুঝলেন?

ভীষণ চালাক না হলে আজ দেড় দু’বছর আমাকে নাকানি চুবানি খাওয়াতে পারতেন না।

ছি ছি, এ আপনি কী বলছেন? বরং আমিই কুলুর বলদের মত দেড় দু’বছর আপনার পিছনে ঘুরছি।

আর কতদিন ঘুরে আমাকে নাকানী চুবানি খাওয়াবেন?

বার বার একই কথা বলে নিজেকে ছোট করছেন কেন? আপনি কী, তা আমার জানতে বাকি নেই। অন্য কোনো মেয়ে হলে আমার বারটা বাজিয়ে ছাড়ত।

শুনুন, সেদিন আপনাকে ফ্রড বলে ভুল করেছি, সেজন্য ক্ষমা চাইছি।

ক্ষমা চাওয়ার দরকার নেই। আমি আপনার সঙ্গে দীর্ঘদিন যা করেছি, তা অন্য কোনো মেয়ের সঙ্গে করলে শুধু ফ্রড নয়, ইতর, ছোটলোক ও লোফার বলত।

তবু বলুন; ক্ষমা করেছেন?

কাল আমার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর যদি সত্যি সত্যি ফ্রড বলে মনে হয়, তখন কিন্তু ক্ষমা চাওয়ার জন্য অনুশোচনা হবে।

সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার, আপনার মাথা না ঘামালেও চলবে। এখন ক্ষমা করেছেন কিনা বলুন।

আমিও কিন্তু প্রথমে ক্ষমা চাইতে বলেছিলেন, ফ্রড নই প্রমাণ দেখাতে পারলে ক্ষমা করবেন। কথাটা উইথড্র করলেও ক্ষমা করেছেন কিনা বলেন নি।

আপনাকে খুব চালক ভেবেছিলাম, এখন মনে হচ্ছে তা নন। এটাও বুঝতে পারেন নি, ক্ষমা না করলে রিসিভার তুলেই রেখে দিতাম?

আপনার কথা বোধহয় ঠিক। উম্মে কুলসুমও মাঝে মাঝে আমাকে বলে, আমার নাকি বুদ্ধি কম। আপনারও বোঝা উচিত ছিল, ঐদিন অপমানিত হয়েও কেন আজ ফোন করলাম।

ঠিক আছে, কালই প্রমাণ হবে, কে চালাক আর কে বোকা। এবার রাখি, সায়মা নড়াচড়া করছে। মনে হয় বাথরুমে যাওয়ার জন্য ঘুম পাতলা হয়ে আসছে। তা ছাড়া রাত কত হয়েছে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখুন।

দেড়টা বেজে গেছে দেখে আব্দুস সাত্তার সালাম বিনিময় করে লাইন কেটে দিল।

রূপা রিসিভার রেখে পড়ায় মন দিল। বইটা শেষ হতে কয়েক পৃষ্ঠা বাকি থাকতেই ফজরের আজান হল। তাড়াতাড়ি শেষ করে নামায পড়ে কুরআন তেলাওয়াত করতে বসল। কিন্ত ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসতে লাগল। কুরআন তুলে রেখে ভাবল, এখন ঘুমালে আটটা নটার আগে ঘুম ভাঙবে না। আব্দুস সাত্তারের সঙ্গে দেখা করার জন্য, সময় মতো যেতে পারবে না। তাই ঘুমাবার চিন্তা বাদ দিয়ে বাগানে হাঁটার মনস্থ করল।

সায়মা নামায পড়ে তার চোখ মুখ দেখে বলল, মনে হচ্ছে সারারাত পড়ে বইটা শেষ করেছিস?

রূপা মৃদু হেসে বলল, বইটা শেষ না করে কিছুতেই ঘুমাতে পারলাম না। দারুণ ভালো বই। তুইও পড়িস। ভাবছি, এই লেখকের সব বই কিনে নিয়ে আসব।

তাই কিনে আনিস। আমি নসিম হেযাজীর খুব নাম শুনেছি। বইগুলো আমিও পড়ব।

আপাততঃ এটা পড়িস।

কিনেছিস?

না, এক বান্ধবীর কাছ থেকে এনেছি।

ঠিক আছে, পড়ব। তারপর তাকে বেরোতে দেখে বলল, কোথায় যাচ্ছিস? নটা পর্যন্ত ঠেসে একটা ঘুম দে, দেখবি শরীর ঝরঝরে হয়ে গেছে।

আব্দুস সাত্তারের সঙ্গে দেখা করার কথা তাকে জানাতে চায় না। তাই কিছু না বলে রূপা বেরিয়ে গেল। বাগানে এসে ভোরের ঠাণ্ডা মুক্ত বাতাস গায়ে লাগতে প্রাণ। জুড়িয়ে গেল। হাঁটার সময় দীর্ঘ দেড় বছর ধরে শুধু ফোনে কথা বলে যাকে ভালবেসে ফেলেছে, তাকে আজ সামনা-সামনি দেখবে ভেবে রোমাঞ্চিত হতে লাগল। সায়মার কথামতো আসিফ সাহেবই যদি আব্দুস সাত্তার হন, তা হলে সত্যিই সে ভাগ্যবতী। তার মতো সুপুরুষ খুব কম দেখেছে। আর তা যদি না হয়ে আব্দুস সাত্তার অন্য কেউ হন? তিনি যদি কুশ্রী বেঁটে অথবা খুব রোগা হন, তা হলে কি করবে ভাবতে লাগল। প্রায় আধঘণ্টা হাঁটার পর ফেরার সময় একটা ফুটন্ত। গোলাপ দেখতে পেল। ফুলটা আজ রাতে শেষ প্রহরে ফুটেছে, রূপা বুঝতে পারল। ফুলটা তুলতে গেলে হাতে কাটা বিধে গেল। উহ করে উঠে হাতটা টেনে নিল। তখন একটা কবিতা মনে পড়ল;

কাঁটা হেরী ক্ষ্যান্ত কেন কমল তুলিতে,
দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহিতে?

ফুলটা তুলে রুমে এসে টেবিলের ড্রয়ারে রাখল। তারপর গোসল করার জন্য বাথরুমে ঢুকল। সাওয়ার ছেড়ে দিয়ে সাবান মাখার সময় গুনগুনিয়ে উঠল—

তুমি অমাবস্যার রাতের মতো কালো হও,
কিংবা তুমি চাদ হও অথবা সূরয হও,
যা কিছু হও না কেন, তুমিই আমার জীবন মরণ,
বিধাতার বিধান ভেবে তোমারেই করিব বরণ।

গোসল সেরে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আলমারী খুলে অনেকগুলোর মধ্য থেকে। ফিরোজা কালারের সালওয়ার কামিজ ও ওড়না বের করে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এল। তারপর সেজেগুজে মায়ের কাছে এসে বলল, নাস্তা দাও।

দু’জন কাজের মেয়ে থাকা সত্ত্বেও মুমীনা বেগম রান্না নিজের হাতে করেন এবং স্বামী ও মেয়েদের খাওয়ান। প্রথম দিকে রোকন উদ্দিন সাহেব স্ত্রীকে অনেকবার বলেছেন, সংসারের সবকিছু করার জন্য দু’জন বুয়া রাখা হয়েছে, তবু তুমি কিচেনে যাও কেন? তা ছাড়া একসঙ্গে খেতেও বস না। টেবিলে সবকিছু থাকে, প্রয়োজন মতো সবাই নিয়ে খাব। মুমীনা বেগম মৃদু হেসে বলেছেন, নিজের হাতে রান্না করে স্বামী-সন্তানদের খাইয়ে যে কত সুখ, কত শান্তি, তা তুমি পুরুষ। হয়ে বুঝবে না। পরে রূপা ও সায়মা বাবার মতো বলেছে। তাদেরকেও মুমীনা বেগম একই কথা বলেছেন।

ওরা সবাই আটটায় একসঙ্গে নাস্তা করে। এখন সাতটা। তাই রূপা এখন নাস্তা খেতে চাইলে মুমীনা বেগম তার দিকে না তাকিয়েই বললেন, এত সকালে নাস্তা খেতে চাচ্ছিস কেন? কোথাও যাবি নাকি?

রূপা বলল, হ্যাঁ আম্মু। একজনের সঙ্গে আটটায় এ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।

মুমীনা বেগম এবার তার দিকে তাকিয়ে অবাক হলেন। এভাবে সেজেগুজে সায়মাকে বাইরে যেতে দেখলেও রূপাকে কখনও দেখেন নি। জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় এ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে?

টি.এস.সিতে।

দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে কড়াইয়ের ভাজি নাড়তে নাড়তে বললেন, ভাজি হতে দেরি আছে। ডাইনিং টেবিলে যা, রুটি পাঠিয়ে দিচ্ছি। ফ্রিজে মিস্টি আছে, বুয়াকে দিতে বলিস।

নাস্তা খেয়ে রুমে এসে গোলাপ ফুলটা ভ্যানিটি ব্যাগে নিয়ে বেরোবার সময় সায়মার সামনে পড়ে গেল। সে এতক্ষণ রিডিংরুমে পড়ছিল। বেডরুমে একটা খাতার জন্য আসছিল। আপুকে দেখে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে ভাবল, যে আপুকে শতবার বলা সত্ত্বেও সেজেগুজে বাইরে বেরোয় না। তাকে আজ এ কী দেখছে?

সায়মার গায়ের রং রূপার চেয়ে একটু চাপা। সে বাবার রং পেয়েছে। আর রূপা মায়ের। সায়মা সুন্দরী। রূপা তার থেকে অনেক বেশি সুন্দরী। রং একটু চাপা বলে সায়মা হয়তো সাজগোজ পছন্দ করে। আর রূপা খুব সুন্দরী বলে হয়তো সাজগোজ মোটেই পছন্দ করে না। সায়মা সাজগোজ করেও রূপার সৌন্দর্য্যের ধারে কাছে যেতে পারে না। তবে এ নিয়ে তার মনে কোনো ক্ষোভ নেই। আপুকে ভীষণ ভালবাসে। তাই বাইরে কোথাও যাওয়ার সময় সাজগোজ করার জন্য প্রায় চাপ দেয়। রূপা হেসে এড়িয়ে যায়। সেই আপুকে আজ সাজগোজ করে বেরোতে দেখে এত অবাক হল যে, কিছুক্ষণ কথা বলতে না পেরে ফ্যাল ফ্যাল করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

রূপা এগিয়ে এসে তার গাল টিপে দিয়ে মুচকি হেসে বলল, কীরে, অমন করে তাকিয়ে কী দেখছিস?

তোকে দেখছি।

তোর হিংসা হচ্ছে বুঝি?

আপু তুই একথা বলতে পারলি বলে সায়মা তাকে জড়িয়ে ধরে ভিজে গলায় বলল, হিংসা হবে কেন? বরং ভীষণ খুশী হয়েছি। হাদিসে পড়েছি, হিংসা এমন জিনিস, যা নেকীকে লাকড়ীর মতো আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। তাই তোর। রূপ দেখে হিংসা না করে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানাচ্ছিলাম। তারপর তাকে ছেড়ে দিয়ে চোখ মুছে কান্নামুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, কোথায় এবং কেন যাচ্ছিস জানি না। তবে কোনো ছেলের সঙ্গে যদি দেখা করতে যাস, তা হলে নিশ্চিত করে বলতে পারি, সে তোকে পাওয়ার জন্য পাগল হয়ে যাবে।

রূপা বলল, হিংসা করার কথাটা হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। তবু আমার ভুল হয়েছে। ভবিষ্যতে এরকম ভুল আর হবে না। চলি, দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে এগোল।

সায়মা তার পথ আগলে বলল, আমাকে সঙ্গে না নিয়ে তুই কখনও কোথাও যাস না, আজ একা যাচ্ছিস যে?

একা কেন যাচ্ছি ফিরে এসে বলব।

কিন্তু নাস্তা খেয়ে আমি তোকে এক জায়গায় নিয়ে যাব ভেবেছিলাম।

বিকেলে নিয়ে যাস বলে রূপা বেরিয়ে এসে ড্রাইভিং সিটে বসল।

ড্রাইভার আগেই ইনফরমেসান পেয়ে গাড়ি বের করে রেডি হয়েছিল। রূপাকে আসতে দেখে পিছনের দরজা খুলে দিল। ড্রাইভিং সিটে বসতে দরজা লাগিয়ে সরে দাঁড়াল।

টি.এস.সির মোড়ে এসে রূপা সরওয়ার্দি উদ্যানের গেটের দিকে রাস্তায় এক পাশে গাড়ি পার্ক করল। তারপর গাড়ি লক করে নেমে পার্কের গেটের কাছে। আসিফকে দেখে মনে হোঁচট খেল। ভাবল, তা হলে কি সায়মার কথাই ঠিক? যদি তাই হয়, তা হলে তো উনি এগিয়ে এসে কথা বলবেন। এই ভেবে তাকে না দেখার ভান করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল।

আসিফ ওরফে আব্দুস সাত্তার দশ মিনিট আগে এসে এতক্ষণ চিন্তা করছিল, আজ সকালে সায়মা যদি ঘটনাটা রূপার কাছে ফাঁস করে দেয়, তা হলে নিশ্চয় ফ্রড ভাববে, আর এখানে নাও আসতে পারে। আবার ভাবল, সায়মা ফাস না করলেও আসার পর যখন জানতে পারবে আসিফই আব্দুস সাত্তার তখন কী করবে? যদি ফ্রড ভেবে রাগ করে চলে যায়, তা হলে কি করবে? রাস্তার দিকে তাকিয়ে এইসব চিন্তা করছিল। রূপাকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে ধীরে ধীরে তার সামনে এসে সালাম দিল।

রূপা অবাক হওয়ার ভান করে সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আপনি এখানে?

হ্যাঁ, বন্ধু আব্দুস সাত্তার পাঠিয়েছে।

তার কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে রূপার পা থেকে মাথা পর্যন্ত আব্দুস সাত্তারের প্রতি ঘৃণায় রিরি করে উঠল। সেই সাথে প্রচণ্ড রেগে গেল। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে রাগ সামলাল। তারপর বিদ্রুপ কণ্ঠে বলল, আপনি তো বন্ধুর খুব গুণগান করেন, কিন্তু সে যে একটা জঘন্য ধরনের ফ্রড, তা জানেন না বোধহয়?

আব্দুস সাত্তার কিছু না বলে করুণ দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। অল্পক্ষণের মধ্যে তার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠতে মুখ নিচু করে নিল।

রূপা তার চোখে পানি দেখে ফেলেছে। বিদ্রুপ কণ্ঠেই বলল, বন্ধুকে ফ্রড বলেছি বলে খুব দুঃখ পেয়েছেন তাই না?

পানিভরা চোখে মুখ তুলে তার দিকে তাকিয়ে আব্দুস সাত্তার বলল, যদি বলি আমিই আব্দুস সাত্তার। বিশেষ কারণে সেদিন পরিচয় গোপন করে বন্ধু আসিফের নামে পরিচয় দিয়েছিলাম। তারপর আবার মুখ নিচু করে নিল।

রূপা হতভম্ব হয়ে বেশ কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে রইল। তখন তার সমস্ত তনুমনে আনন্দের বান ছুটল।

আব্দুস সাত্তার ভয়ে ভয়ে মুখ তুলে তার মুখের দিকে তাকাতে চোখে চোখ পড়ল। দেখল, সেখানে ঘৃণা বিদ্রুপ বা রাগের লেশমাত্র নেই। যা আছে, তা দেখে বাস্তব জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।

কতক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল রূপা জানতে পারল না। যখন চোখ দুটো পানিতে ঝাপসা হয়ে এল তখন বুঝতে পেরে দৃষ্টি নিচের দিকে করে নিল। কোনো কথা বলতে পারল না।

ততক্ষণে আব্দুস সাত্তারও বাস্তবে ফিরে এল। বলল, চলুন পার্কের ভিতরে গিয়ে বসি। রাস্তার লোকজন আমাদের দিকে তাকিয়ে দেখছে।

ওড়নার খুঁটে চোখ মুছে যেতে যেতে রূপা বলল, অনেক ভুগিয়েছেন। নিজে অপমানিত হয়েছেন, আমাকেও অপমান করেছেন; কড়া মাশুল দিতে হবে।

আব্দুস সাত্তার তার পাশে হাটতে হাটতে বলল, আপনাকে খুশী করার জন্য হাসিমুখে প্রাণটাও উৎসর্গ করতে পারি। এর থেকেও কী আরো বড় মাশুল দিতে হবে?।

রূপা থমকে দাঁড়িয়ে বড় বড় চোখ বের করে বলল, সাবধান করে দিচ্ছি, ভবিষ্যতে যদি এরকম কথা দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করেন, সেদিন আমার মরা মুখ। দেখবেন।

আব্দুস সাত্তার তার মনের খবর জানতে পেরে চমকে উঠে বলল, আমি না হয় ভুল করে কথাটা বলে ফেলেছি, তাই বলে এতবড় কথা বলে প্রতিশোধ নেবেন?

আপনি ভুল করতে পারলে আমি পারি না বুঝি? আপনি যা করেছেন, আমি তার পুনরাবৃত্তি করেছি মাত্র। তবু ক্ষমা চাইছি, আর ওয়াদা করছি, আর কখনও এমন কথা উচ্চারণ করব না।

ভুল আমি প্রথমে করেছি। আমারই ক্ষমা চাওয়া ও ওয়াদা করা উচিত।

ঠিক আছে, ভুল যখন দু’জনেই করেছি তখন দু’জনরেই দু’জনকে ক্ষমা করা উচিত এবং দু’জনকেই ওয়াদাও করা উচিত।এবার এ প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে আসুন এখানে বসা যাক বলে রূপা ছায়া ঢাকা ও ঘাসেভরা জায়গায় বসে পড়ল।

আব্দুস সাত্তার তার সামনে বসে অপলক নয়নে মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ফিরোজা কালারের পোশাক রূপাকে ভীষণ মানিয়েছে। সুন্দরী রূপাকে আরো সৌন্দৰ্য্যময়ী করে তুলেছে। সেদিকে আব্দুস সাত্তারের কোনো খেয়াল নেই। সে তার চোখের তারার দিকে তাকিয়ে আছে।

রূপাও তার চোখের দিকে তাকিয়েছিল। বেশ কিছুক্ষণ পর বলল, চোখের দিকে তাকিয়ে কী দেখছেন?

একই প্রশ্ন যদি আমিও করি?

আপনি আগে বলুন, তারপর আমি।

“তোমার কাজল কালো চোখের দু’টো নীল পাথরের গভীরতায় হারিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে।” এবার তোমারটা বল।

রূপা ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে গোলাপ ফুলটা বের কের তার হাতে দেওয়ার সময় মৃদু হেসে বলল, “আমার কাজল কালো চোখে হয়তো খুঁজে পাবে তোমার প্রিয় মরুদ্যান।”

মারহাবা মারহাবা বলে আব্দুস সাত্তার ফুলটা একবার শুকে নিয়ে পকেট থেকে একটা লাল গোলাপ বের করে তার হাতে দিল।

শুকরিয়া বলে রূপা একবার শুকে বলল, আমারটা আমাদের বাগানের। তোমারটা আমারটার চেয়ে খুব সুন্দর।

আব্দুস সাত্তার বলল, দেশের বাড়িতে বেশ বড় ফুলের বাগান আছে, এখানে নেই। তাই ছাদটাকে ফুলের বাগান বানিয়েছি। এটা সেই বাগানের। তারপর বলল, জান, গত রাতে তোমাকে ফোন করার পর থেকে খুব টেনসানে ছিলাম। সারারাত ঘুমাতে পারি নি। কেবলই মনে হয়েছে, আমাকে দেখার পর যদি ফ্রড ভেবে রাগ করে চলে যাও, তা হলে…..।

থেমে গেলে কেন? তা হলে কী?

তা হলে লজ্জায় ও অপমানে হয়তো মরেই যেতাম। আর তা না হলে নিজের প্রতি খুব ঘৃণা তো হতই, এমনকি নিজের প্রতি বিশ্বাসও হারিয়ে ফেলতাম। সারাজীবন কোনো মেয়েকে গ্রহণ করা তো দূরের কথা, কোনো মেয়ের দিকে মুখ তুলে তাকাতেও পারতাম না। আল্লাহ পাকের অপার করুণা, তিনি আমাকে নিরাশ করেন নি। সেজন্য তার পাক দরবারে শতকোটি শুকরিয়া জানাচ্ছি।

রূপা মৃদু হেসে বলল, প্রথম দিকে যখন ফোন করতে তখন তোমাকে বড়লোকের বখে যাওয়া ছেলে ভেবে রেগে যেতাম, কিছুটা ঘৃণাও করতাম। আব্বকে জানিয়ে শায়েস্তা করতেও চেয়েছিলাম; কিন্তু তোমার গলার স্বরে যেমন মধু ছিল তেমনি তোমার কথাতেও যাদু ছিল। তাই আল্লুকে জানাতে পারি নি। তারপর দিনের পর দিন তোমার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ি। অনেক সময় মনে হয়েছে, অনেক কুশ্রী ও চরিত্রহীন ছেলেদের কণ্ঠস্বর মধুর হয়, কথাতেও যাদু থাকে। যখন সামনা-সামনি হতে চাইলে না, এমন কি ফোনেও নাম ছাড়া কিছুই জানালে না। তখন মন খুব বিগড়ে যায়। ভাবলাম, খুব গরিব ঘরের ছেলে আমাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে পিছে লেগেছে। সায়মা ও আমি কোলেপিঠে। ও সব কিছু জানে। একদিন বলল, ছেলেটা ফ্রড। আব্বকে জানিয়ে জব্ধ করে দে। আমি বললাম, ছেলেটা যাই। হোক, তাকে সম্পূর্ণ না জানা পর্যন্ত আল্লুকে জানান ঠিক হবে না। ও কিন্তু সংসদ ভবন চত্বরের ঘটনার দিন বলেছে, গুলি খাওয়া ছেলেটাই তুমি। গতকাল জুতো কিনতে গিয়ে বাসায় ফিরেও ঐ কথা বলেছে।

আব্দুস সাত্তার জিজ্ঞেস করল, তোমার কিছু মনে হয় নি?

হয়েছে, তবে তেমন জোরাল নয়।

সায়মা সত্যিই খুব চালাক। গতকাল আমরা বাসায় পৌঁছাবার আগেই ফোন করেছিল। ফুফুআম্মা ফোন ধরেছিলেন। খুব চালাকির সঙ্গে তার কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু জেনে নিয়েছে।

ওমা, তাই নাকী? এখন বুঝতে পারছি, এখানে আসার সময় কেন বলেছিল, তোকে নিয়ে এক জায়গায় যাব। আমি বলেছি বিকেলে নিয়ে যাস। মনে হচ্ছে, তোমাদের বাসাতেই নিয়ে যেত। জান, ওর কাছে হেরে গেলাম।

হেরে গেলে বুঝলাম না।

বললাম না, ও বলেছিল, আসিফ সাহেবই তুমি?

হেরে গিয়ে দুঃখ হচ্ছে বুঝি?

তোমার কী তাই মনে হচ্ছে?

না, তবে তোমার মুখে শুনতে চাই।

দুঃখের বিপরীত শব্দটা হচ্ছে।

সায়মার কথা কেন বিশ্বাস কর নি বলবে?

দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, তুমি মিথ্যে অভিনয় করতে পার না।

এখনও কী সে বিশ্বাস আছে?

আছে?

মিথ্যে অভিনয় করলাম, তবু আছে?

শুধু আছে নয়, বরং এখন সেই বিশ্বাস অনেক বেড়ে গেছে।

বুঝলাম না।

তোমাকে সামনাসামনি দেখে ও তোমার কথা শুনে যা জানতে পারলাম, তা চন্দ্র সূর্যের মতো সত্য। অতটুকু মিথ্যে অভিনয় না করলে তা জানতে পারতাম না।

আনন্দে আপ্লুত হয়ে আব্দুস সাত্তার কয়েক সেকেন্ড কিছু বলতে না পেরে চুপ করে রইল। তারপর বলল, তুমি বোধহয় না খেয়ে বেরিয়েছ, চল, কোনো রেষ্টুরেণ্টে যাই।

আমি নাস্তা খেয়েই বেরিয়েছি। আমার তো মনে হচ্ছে, তুমিই না খেয়ে বেরিয়েছ।

তোমার অনুমান ঠিক। আল্লাহ যেন আমাকে অপমানিত না করেন, সেজন্য আজ নফল রোযা রেখেছি।

তার কথা শুনে রূপাও আনন্দে কয়েক সেকেন্ড কথা বলতে পারল না। তারপর ছলছল চোখে বলল, তুমি আমাকে এত ভালবাস?

তোমাকে আমি কতটা ভালবাসি, তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। কথা দাও, কোনো কারণেই আমাকে দূরে সরিয়ে দেবে না?

দিলাম। এবার তুমিও দাও।

আমিও দিলাম।

এতদিন কেন আড়াল হয়েছিলে, সরি ছিলেন বলবেন?

আব্দুস সাত্তার হেসে উঠে বলল, সরি বলার আর দরকার নেই। প্রথম দিকে অল্পক্ষণ আপনি করে বললেও এতক্ষণ দুজনেই তুমি করেই বলেছি।

রূপা লজ্জারাঙা হয়ে বলল, ওমা, তাই নাকী?

তাই আর হবে না? প্রায় দু’বছর যে স্রোত বইছিল আজ মিলিত হয়ে একাকার হয়ে গেছে। তাই মনের অজান্তে দু’জনেই তুমি হয়ে গেছি। আর এটাই চিরাচরিত নিয়ম, তুমি লজ্জা পাচ্ছ কেন? আচ্ছা, তোমার ভালো নাম যাবিন তাসনিম, তাই না?

রূপা মৃদু হেসে বলল, জেনেও জিজ্ঞেস করছ কেন?

অন্যের মুখে দু’বছর আগে জেনেছিলাম, মনে আছে কিনা ঝালাই করে নিলাম।

তোমার মেমোরি খুব প্রখর। সঠিক মনে রেখেছ। অনার্সে নিশ্চয়ই ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছিলে?

তোমার অনুমান ঠিক।

মাস্টার্সের রেজাল্টও নিশ্চয়ই তাই হবে?

আশা তো করি, বাকি আল্লাহর মর্জি। এবার তোমারটা বল।

আমার মেমোরি তোমার মতো অত প্রখর নয়। আল্লাহ রাজি থাকলে সেকেন্ড ক্লাস পেতে পারি। তা হঠাৎ নাম জিজ্ঞেস করলে কেন?

নামের অর্থ জান?

হ্যাঁ, বেহেস্তের সোনালী ঝরণা।

রূপা নাম কে রেখেছেন?

আব্বু।

আর আসল নাম?

আম্মুর কাছে শুনেছি, গ্রামে আব্বুর এক বন্ধু ছিলেন, তিনি রেখেছেন। অবশ্য উনি বলার আগে আম্মুও ঐ নামটা সিলেক্ট করেছিলেন।

আব্দুস সাত্তার বুঝতে পারল, তার আব্বই নামটা রেখেছিলেন। বলল, তোমার আম্মু মনে হয়, ধর্ম সম্বন্ধে অনেক জ্ঞানী এবং ধর্মের বিধি নিষেধ মেনে চলেন?

হ্যাঁ, আব্বুও কিছু কিছু মেনে চলেন।

সোনা, রূপা, ধাতুর নাম। তোমার আব্ব ধার্মিক হয়েও কেন যে তোমার ডাক। নাম রূপা রাখলেন বুঝতে পারছি না। তোমার গায়ের রং সোনালী। সোনা রাখলেও না হয় কিছু সামঞ্জস্য হত। যাক গে, আমি তোমাকে তাসনিম বলে ডাকব।

রূপা হাসিমুখে বলল, বেশ তো তাই ডাকবে। এবার আমি একটা কথা বলি?

বল।

তোমাকে আমি শুধু সাত্তার বলে ডাকব।

না, তা ডাকবে না।

কেন?

সাত্তার শব্দের অর্থ জান?

না।

গোপনকারী। আর এটা আল্লাহর গুণবাচক একটা নাম। আল্লাহর এরকম গুণবাচক নাম নিরানব্বইটা অথবা তার চেয়ে বেশি আছে। শুধু আল্লাহর গুণবাচক নাম ধরে ডাকা অথবা রাখা উচিত নয়। রাখলে শেরেকের তুল্য গোনাহ হবে। তাই ঐসব নামের আগে আব্দুল বা আব্দুস শব্দ যোগ করে নাম রাখতে হবে। যেমন—আব্দুস সুবহান, আব্দুল গফুর, আব্বুর রউফ ইত্যাদি। আর নাম রাখার ব্যাপারে মুসলমানের খুব হুশিয়ার হতে হবে। হাদিসে আছে, “রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, তোমাদের নামের মধ্যে আল্লাহর নিকট সর্বাপেক্ষা উত্তম নাম আব্বুল্লাহ, আব্বুর রহমান। (দু’টো নামেরই অর্থ আল্লাহর দাস)।”(১)

ইসলামী নামসমূহের আংশিক নামে ডাকাও মারাত্মক অন্যায় ও গুনাহর কাজ। যেমন কোনো লোকের নাম আব্বুর রহমান (অর্থাৎ আল্লাহর দাস), তাকে যদি শুধু। “রহমান” নামে ডাকা হয়, তা হলে তাকে আল্লাহ সম্বোধনেই ডাকা হল। আল্লাহর বান্দাকে আল্লাহ সম্বোধনে ডাকা কত জঘন্য অপরাধ ও নাফরমানী, তা চিন্তা করে। দেখ। এরূপ আংশিক নামে যে অন্যকে ডাকবে এবং সে যদি ঐ ডাকে সাড়া দেয়, তা হলে উভয়েই সমান গুনাহগার হবে। বর্তমান যুগে মুসলমানদের মধ্যে অনেকেই চরম বিভ্রান্তি ও গোমরাহীতে নিক্ষিপ্ত হয়ে অধর্ম ও অনাচারে লিপ্ত হয়ে, আধুনিকতার অন্ধমোহে, জেনে না জেনে শিক্ষিত সমাজে ইসলামী, আকীদা ও সাংস্কৃতিকে দুমড়ে মুচড়ে ছেলেমেয়েদের ইসলামী নামের বিপরীতে ডাক নাম রাখতে শুরু করেছে। তাদের দেখাদেখি সর্বস্তরে একরম ডাক নাম রাখা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে ছেলেমেয়েদেরকে কেউ আর আসল নামে ডাকে না। সবাই ডাক নামেই ডাকে। আর ছেলেমেয়েদেরকে কেউ নাম জিজ্ঞেস করলে, তারা ডাক নামটাই বলে। এটা যে বিদেশী ও বিধর্মীদের চক্রান্ত, তাতে কোনো সন্দেহ। নেই। কিছু কিছু নামের উদাহরণ দিচ্ছি, যেমন—রফিকুল ইসলাম (হিমেল), আব্বুর রহমান (বুলেট), আব্দুল মতিন (রাসেল), আবিদা সুলতানা (চকলেট), নূর মোহাম্মদ (নুরু), ওমর ফারুক (ডালিম), মেহের নিগার (নিপা), ফাহিম ফায়সাল (তারা), রওসনারা বেগম (বেদানা), ফরহাদ আহম্মদ (তনু), তোমার নামটাই দেখ না, যাবিন তাসনিম (রূপা)। আবার অনেক পিতামাতা ভালো নামের সঙ্গে ডাক নাম রাখেন, মন্টু, ঝন্টু, রিন্টু, বিল্লী, বিজলী, উর্মি, সোমা, সাগর, সৈকত, অন্তরা, পলাশ, গোলাপ, জবা, যুঁই, চামেলী, চাঁদ, সূর্য, তারা, তোতা, ময়না, টুটুল, সুন্দরী, তুলি, বুলি, উষা, হাসি, মেঘনা, যমুনা ইত্যাদি। বিবেক সম্পন্ন লোক একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন, এসব পশু, পাখি, নদ, নদী, ফল ও ফুলের নাম। মুসলমান নর-নারীর ভালো অর্থবহ ও ফযিলতপূর্ণ ইসলামী নামের স্থলে বা বিপরীতে এরকম ডাক নাম রাখা শুধু খারাপ নয়, গুনাহও। কারণ মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত। সেই আশরাফুল মাখলুকাতের নাম পশু-পাখি, ফল-ফুল, নদ-নদী ও অস্ত্র ইত্যাদির নামের সঙ্গে মিলিয়ে রাখলে এবং সে নামে ডাকলে নিশ্চয় আল্লাহ অসন্তুষ্ট হবেন। তাই মুসলমানদের ফজিলতপূর্ণ ইসলামী নামের বিপরীতে ঐসব নাম রাখা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। এটা বর্জন করা প্রতিটি মুসলমানের কর্তব্য।

অনেকে অজ্ঞতার কারণে ভালো ইসলামী নাম বিকৃত করে ডাকে। যেমন—কামাল হোসেনকে তার মা বাবা বা আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীরা “কামাইল্ল্যা,” মুহাম্মদ আলিকে “মুহাম্মাইদ্যা,” আব্দুল কাদিরকে “কাদিররা,: আবুল বাশারকে “বাশাইররা” ফাতিমা খাতুনকে “ফাতি” এবং নূরজাহান বেগমকে “নূরী” বলে ডাকে। এরূপ বিকৃত নামে ডাকা যে কত বড় অন্যায় ও গুনাহের কাজ, তা কেউ চিন্তা করে দেখে না। আবার অনেক মা-বাবা এমন নাম রাখেন, যা আল্লাহ ও রাসুল (দঃ) এর নামের সাথে সম্পর্কহীন হয়ে পড়ে। যেমন—লাল মিয়া, চান মিয়া, রাজীব চৌধুরী, মদন গাজী, কালু ফকির, অঞ্জলি বেগম, শেফালি বেগম ইত্যাদি। কতকগুলো ভালো নাম ও তার অর্থ বলছি। শোন—আব্দুল আলিম (মহা জ্ঞানীর বান্দা), আব্দুল আজিজ (মহাজ্ঞানীর সেবক), আব্বুর রহিম (করুণাময়ের সেবক), হাবিবুর রহমান (আল্লাহর প্রিয় বান্দা), আতকিয়া ফাওজিয়া (ধার্মিক সফল), আফিয়া আবিদা (পুণ্যবতী এবাদতকারিণী)।

এবার নিশ্চয় বুঝতে পারছ, আমাকে শুধু সাত্তার নামে কেন ডাকতে নিষেধ করলাম? এবং তোমাকে কেন তাসনিম বলে ডাকব বললাম? তুমি কিন্তু তোমাদের বাসায় সবাইকে বলে দেবে, তোমাকে রূপা নামে না ডেকে তাসনিম বলে যেন ডাকে। তারপর বলল, নামের ব্যাপারে বলতে গিয়ে অনেক সময় নষ্ট করলাম, বিরক্ত হও নি তো?

তাসনিম মৃদু হেসে বলল, না। বরং ইসলামের অনেক কিছু না জানা বিষয় জানতে পেরে খুশী হয়েছি।

একটা কথা বলব, মাইন্ড করবে না তো?

মাইন্ড করার প্রশ্নই আসে না।

তোমার কথায় বুঝতে পারলাম, তোমার আব্বু আম্মু নামায পড়েন, তোমরা দু’বোন পড়?

আম্মু আব্বর থেকে বেশি ধার্মিক। তিনি আমাদেরকে ছোটবেলাতেই নামায শিখিয়ে ধরিয়েছেন, কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করতে শিখিয়েছেন এবং ইসলামের অন্যান্য অনেক কিছু শিখিয়েছেন। আজও আমরা সে সব মেনে চলি।

তোমরা ধর্মীয় বই পুস্তক, মানে কুরআন হাদিসের ব্যাখ্যা, বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় বইপত্র পড়?

এসব বই পুস্তক আম্মু প্রচুর পড়েন। আমরাও অবসর সময়ে অল্প কিছু কিছু পড়ি। ইদানিং আমি কুরআন হাদিসের ব্যাখ্যা পড়তে শুরু করেছি। সায়মা পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত। তবু মাঝে মধ্যে আমার পাশে এসে বসে।

মেয়েদের পর্দা সম্বন্ধে কিছু পড় নি অথবা জান নি?

এখনও পড়ি নি। তবে একদম যে জানি না, তা নয়। এস.এস.সি. পর্যন্ত আম্মু স্কুল ড্রেসের সঙ্গে আলাদা রুমাল দিয়ে চুলসহ মাথা ঢেকে দিতেন এবং আলাদা একটা চাদর জড়িয়ে দিতেন। কলেজে ঢোকার পর প্রথম প্রথম ঐভাবে যেতাম। পরে ক্লাসমেটদের হাসি ঠাট্টা সহ্য করতে না পেরে কলেজে ঢোকার আগে মাথার। রুমাল খুলে ফেলতাম। অনার্স পড়ার সময় থেকে আর মাথায় রুমাল দিই না। এজন্য আম্মু খুব রাগারাগি করতেন, এখনও করেন। আবু অবশ্য কখনও কিছু বলেন নি।

কুরআন হাদিসের ব্যাখ্যা যখন পড়ছ, তখন অচিরেই জানতে পারবে, কেন তোমার আম্মু এ ব্যাপারে রাগারাগি করেন। আমি শুধু এতটুকু বলব, মেয়েদের। জন্য পর্দা করা ফরয। অর্থাৎ পর্দা করে মেয়েদের বাইরে বেরোন আল্লাহর হুকুম। আচ্ছা, মেয়েদের কি কি দেখে ছেলেরা প্রলুব্ধ হয় জান?

তাসনিম হেসে ফেলে বলল, জানি। তবু তোমার মুখে শুনতে চাই।

মুখ, বুক ও নিতম্ব। তুমি যেভাবে ওড়না গায়ে দিয়েছ, তাতে বুক ঢাকা পড়লেও মুখ ও নিতম্ব ঢাকা পড়ে নি। তাই ইসলাম বোরখা পরার নির্দেশ দিয়েছে। তবে বড় চাদর বা মোটা কাপড়ে ওড়না দিয়ে মুখ, বুক ও নিতম্ব ঢেকে রাখলে, তাতে কোনো দোষ নেই। এক কথায় পর্দা নারীদের ইজ্জত রক্ষা করে, সম্মান বৃদ্ধি করে, দুষ্ট লোকের নজর থেকে বাঁচায়। যারা বলে পর্দা নারী প্রগতির অন্তরায়, পর্দার কথা বলে তাদেরকে অন্তঃপুরে বাদী দাসী করে রাখতে চায়, তারা মুসলমান নামের অযোগ্য। নারীদের পর্দা করার জন্য আল্লাহ কুরআন পাকে বলিয়াছেন, “তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতা পুত্র, ভগ্নিপুত্র, সেবিকা যারা তাদের অধিকারভুক্ত অনুগত, যৌন কামনা রহিত পুরুষ এবং নারীদের গোপন অঙ্গ সম্বন্ধে অজ্ঞ বালক ব্যতীত কারো নিকটে তাদের আবরণ প্রকাশ না করে এবং তারা যেন তাদের গোপন আবরণ প্রকাশের উদ্দেশ্যে সজোরে পদক্ষেপ না করে।”(২)

যারা প্রগতির কথা বলে মেয়েদেরকে পর্দা ভাঙতে বলে, তারা নারীদের সৌন্দর্য ও রূপ যৌবন উপভোগ করার জন্য বলে। যারা আল্লাহর কুরআনের বিরোধীতা করে তারা ফাসেক। “আর ফাসেকদের স্থান জাহান্নাম।” এটাও কুরআন পাকের কথা। পর্দা করে মেয়েরা লেখাপড়া করতে পারবে, প্রয়োজনে চাকরিও করতে পারবে। আগের যুগে এমন অনেক মহিয়সী নারী ছিলেন, তারা পর্দা করে সবকিছু করেছেন। বর্তমান যুগেও এর অনেক প্রমাণ রয়েছে। এ ব্যাপারে আর বেশি কিছু বলব না। জ্ঞানীরা বলেছেন, “বুদ্ধিমানদের জন্য অল্পই যথেষ্ট।”

তাসনিম বলল, তোমার কথাগুলো খুব ভালো লাগল। আমার মনে হয়, প্রত্যেক বাবা মা যদি মেয়েদের এভাবে বোঝাতেন, তা হলে কোনো মেয়েই বেপর্দা হয়ে চলাফেরা করত না।

তুমিও খুব ভালো কথা বলেছ; কিন্তু দুঃখের ব্যাপার কী জান? আজকাল মা-বাবারাই মেয়েদের বেপর্দায় চলার ইন্ধন যোগাচ্ছে। মেয়েরা বেপর্দায় চলার ও নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশার ফলে প্রতিদিন কত হাজার হাজার মেয়ে লাঞ্ছিতা ও ধর্ষিতা হচ্ছে। তবু ঐসব মা-বাবারা জেনেও আল্লাহর হুকুম মানছে না। এবার এসব কথা থাক বলে আব্দুস সাত্তার চুপ করে গেল।

তাসনিম বলল, তুমি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দাও নি।

আব্দুস সাত্তার মৃদু হেসে বলল, কেন নিজেকে তোমার কাছ থেকে দু’বছর আড়াল করে রেখেছিলাম, তাই জানতে চাচ্ছ, তাই না?

তাসনিমও মৃদু হেসে বলল, জ্বি।

এর দু’টো কারণ। প্রথম কারণ হল, প্রায় তিন বছর আগে তোমাকে প্রথম গ্রীন সুপার মার্কেটে দেখে মুগ্ধ হই। তারপর কিভাবে দ্বিতীয়বার দেখা হল, কিভাবে তার বায়োডাটা ও ফোন নাম্বার জোগাড় করল, বায়োডাটা জানার পর তার মনের অবস্থা এবং কিভাবে তার সঙ্গে ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করে তার মন জয় করল, সবকিছু বলল।

আমার বায়োডাটা জেনে তুমি হতাশ হয়েছিলে কেন? আমি কী এতই দুর্লভ।

আসল কারণটা না বলে আব্দুস সাত্তার বলল, আমি এক অখ্যাত গ্রামের ছেলে। একজন মন্ত্রীর মেয়েকে পাওয়া কুঁড়ে ঘরে ছেড়া কাঁথায় শুয়ে স্বপ্নে রাজকন্যাকে বিয়ে করার মতো নয় কী?

তোমার কথা অবশ্য ঠিক; কিন্তু এটা বোধহয় জান না, এমন অনেক রাজকন্যা ছিল এবং এখনও অনেক ধনীর দুলালী আছে, যারা দীন হীন ছেলেকে ভালবেসে রাজপ্রাসাদ ছাড়তে এতটুকু দ্বিধা করে নি। তাদের মধ্যে যারা রাজপ্রাসাদ ছাড়ার সুযোগ পাই নি, তারা ভালবাসার পাত্রকে না পাওয়ার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে।

তোমার কথাও ঠিক; কিন্তু তারা দুজন দুজনকে গভীরভাবে ভালবাসত। আমার ক্ষেত্রে তো তাদের মতো ছিল না। আমি তোমাকে পাগলের মতো ভালবাসলেও তুমি গ্রাম্য একটা নগণ্য ছেলেকে ভালবাসবে কিনা যথেষ্ট সন্দেহের ব্যাপার নয় কী? তাই তোমার বায়োডাটা জানার পর খুব মুষড়ে পড়লাম। দিন দিন। আমার শরীর ভাঙতে লাগল। ফুফু আম্মা আমার অবস্থা দেখে একদিন বললেন, রাত জেগে পড়ে পড়ে তোর শরীর ভেঙে যাচ্ছে। কয়েকদিন গ্রামের বাড়িতে থেকে আয়। আমিও ভাবলাম, গ্রামের পরিবেশ হয়তো আমাকে কিছুটা শান্তি দিতে। পারবে এবং তোমার স্মৃতিও ভুলিয়ে দিতে পারবে। যদি তাই হয়, তা হলে আর ঢাকায় ফিরব না। এইসব ভেবে বাড়িতে গেলাম। আমাকে দেখে আম্মা বললেন, তোর অবস্থা একি হয়েছে? নিশ্চয় কোনো কঠিন অসুখ বাধিয়েছিস? বললাম, রাত জেগে পড়ে পরীক্ষা দিয়েছি। কয়েকদিন তোমার আদর পেলে ঠিক হয়ে যাব। বেশ কিছুদিন থাকলাম। শরীরের কিছু উন্নতি হলেও তোমার স্মৃতি অক্টোপাসের মতো আমার মনকে জড়িয়েই রইল। তোমাকে এক নজর দেখার জন্য মন পাগল হয়ে। উঠল। ঢাকায় ফিরে এসে বন্ধু আসিফকে সবকিছু বললাম, ও তোমাকে ভুলে যাওয়ার জন্য জোরালো যুক্তি দেখাল। ওর যুক্তিগুলো ভালো ছিল। তাই প্রতিবাদ করি নি। কিন্তু মন কিছুতেই বাগ মানল না। এক মুহূর্তের জন্য তোমাকে ভুলতে পারলাম না। একদিন রাত দশটার সময় তোমার কথা চিন্তা করতে করতে হঠাৎ তোমাকে ফোন করার প্রচণ্ড তাগিদ অনুভব করলাম। আসিফ এর বোনের কাছ। থেকে তোমার বায়োডাটা জানার সময় ফোন নাম্বারও জেনেছিলাম। অনেক আগে জেনে থাকলেও মেধার কারণে মনে ছিল। তোমার আব্ব ফোন ধরলে কি বলবে ভেবে বেশ ভয় ভয় করলেও তখনই ফোন করি। আজও করে চলেছি। কবে যে শেষ হবে অথবা আদৌ শেষ হবে কিনা তা আল্লাহ জানেন। তারপর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, একতরফা ভালবাসার যে কি যন্ত্রণা, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ জানে না।

তার কথা শুনতে শুনতে তাসনিমার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠেছিল। শেষের দিকে কথা ও দীর্ঘনিশ্বাস তাসনিমার কলজেটাকে কেউ যেন ছুরি দিয়ে চিরে। দিল। চোখ মুছে করুণকণ্ঠে বলল, প্লীজ, আমার জন্যে আর এতটুকু দুশ্চিন্তা করো না। একটু আগে কথা দিয়েছি, কোনো কারণেই তোমাকে দূরে ঠেলে দেব না। এখন আবার বলছি, তোমার জন্য সবকিছু ত্যাগ করব, তবু তোমাকে ত্যাগ করব না। শুধু মন্ত্রীর মেয়ে নয়, যদি প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে অথবা কোনো রাজা বাদশার মেয়েও হতাম, তবু এই কথা বলতাম।

আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে আব্দুস সাত্তার বলল, তোমার কথা শুনে এত শান্তি পেলাম, যা তিন বছরের দুঃখ ও যন্ত্রণা সর্ষে পরিমাণ মনে হচ্ছে। আর কী মনে হচ্ছে জান, সারা পৃথিবীর বাদশাহী পেয়েও বুঝি এত সুখ অনুভব করতাম না। তারপর বলল, কেউ কাউকে আনন্দের বা সুখের খবর শোনালে তাকে পুরস্কার দেয়। এখন আমারও তোমাকে কিছু দিতে মন চাইছে। চল মার্কেটে যাই।

তাসনিম আনন্দ বিহ্বল কণ্ঠে বলল, কাল দিলে হয় না?

না তাসনিম না, আজই কিছু না দিলে মনে শান্তি পাব না। এমন সময় সংসদ ভবন চত্বরে যে ছেলে তিনটি রূপা ও সায়মাকে টিজ করেছিল, তাদের আসতে দেখে তাসনিম ভয়ার্ত গলায় বলল, সেদিনের মতো আজ আবার কিছু করবে না তো?

আব্দুস সাত্তার বলল, মনে হচ্ছে তুমি ভয় পেয়েছ? ওদের লীডারকে আমি চিনি। মনে হয় কিছু করবে না। তবু যদি করে, তা হলে উপযুক্ত জওয়াব পাবে। চল ওঠা যাক বলে দাঁড়িয়ে পড়ল। তাসনিম দাঁড়াবার পর দু’জনে পাশাপাশি হেঁটে গেটের দিকে আসতে লাগল।

ওদের সামনা-সামনি এসে আব্দুস সাত্তার সালাম দিয়ে বলল, আপনারা ভালো আছেন ভাই?

সবার আগে মহসিন সালামের উত্তর দিয়ে বলল, জ্বি, ভালো। তারপর বলল, সেদিনের ব্যবহারের জন্য আমি খুব লজ্জিত ও দুঃখিত। প্লীজ, মাফ করে দিন।

আব্দুস সাত্তার তাদের সবার সঙ্গে হাত মুসাফাহা করে বলল, মাফ চাওয়ার দরকার নেই। আপনি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন জেনে খুব খুশী হয়েছি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে ভুল বোঝার ও সঠিক পথে চলার তওফিক দিক।

আর একটু দাঁড়ান সাত্তার ভাই, ওঁর কাছেও মাফ চাইব। সেদিন যদি ওঁর পরিচয় জানতাম তা হলে…….। কথাটা আর শেষ করতে না পেরে মুখ নিচু করে। নিল।

তাসনিম বুঝতে পারল, সে যে মন্ত্রীর মেয়ে ছেলেটা জেনে গেছে। বলল, আমাদের দু’বোনের সঙ্গে যা কিছু করেছেন, তাতে কিছু মনে করি নি। আব্দুস সাত্তার সাহেবকে গুলি করার পর আপনাকে খুব খারাপ ছেলে ভেবেছিলাম। এখন আপনার কথা শুনে খুব ভালো লাগল। আমিও দোয়া করছি, “আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক পথে চলার তওফিক দিক।” তারপর আব্দুস সাত্তারের দিকে তাকিয়ে বলল, চল।

আব্দুস সাত্তার মহসীনকে জিজ্ঞেস করল, আপনি আমার পুরো নাম জানেন?

জানি, আব্দুস সাত্তার।

ভবিষ্যতে পুরো নাম ধরে বলবেন। তারপর কারণটা বুঝিয়ে দিয়ে সালাম বিনিময় করে তাসনিমকে বলল, চল।

গাড়ির কাছে এসে তাসনিম বলল, তুমি গাড়ি নিয়ে আস নি?

না, তুমি ফিরিয়ে দিলে নির্ঘাত এ্যাকসিডেন্ট করতাম, তাই গাড়ি নিয়ে আসি নি।

রোযা রাখার কথা শুনে তাসনিম তার প্রতি আব্দুস সাত্তারের ভালবাসার গভীরতা যতটা না অনুভব করেছিল, এখন গাড়ি নিয়ে না আসার কারণ শুনে আরো বেশি অনুভব করল। কোনো কথা বলতে পারল না। ছলছল চোখে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে তার মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।

ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আব্দুস সাত্তার বলল, তুমি জান না তাসনিম, আমি তোমাকে কত ভালবাসি। তারপর নাও এবার গাড়িতে ওঠ দেখি বলে বলল, আমি কিন্তু ড্রাইভিং করব।

তাসনিম কিছু বলল না। চোখ মুছে গাড়ির চাবি তার হাতে দিল।

গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার পর বলল, পার্কের ঘটনাটা আমাকে খুব অবাক করেছে।

আব্দুস সাত্তার বলল, ছেলেটা হয়তো লীডারের কাছে তোমার পরিচয় পেয়েছে। আর আমাকে তোমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে দেখে ভেবেছে, আমি হয়তো তোমাদের কাছাকাছি একজন।

তাসনিম আব্দুস সাত্তারের ভালবাসার গভীরতার কথা চিন্তা করছিল। তাই আব্দুস সাত্তার যে নিজের পরিচয় এড়িয়ে গেল, তা বুঝতে পারল না।

বায়তুল মোকাররমে এসে আব্দুস সাত্তার গাড়ি পার্ক করে তাসনিমকে নিয়ে আমিন জুয়েলার্সে ঢুকল।

আব্দুস সাত্তারের ফুফা ও ফুফু আমিন জুয়েলার্সের বড় খদ্দের। স্বামী মারা। যাওয়ার পর রাইসা বেগম আব্দুস সাত্তারকে নিয়ে আসেন। তাই আব্দুস সাত্তারকে ম্যানেজার ও দোকানের অন্যান্য সবাই চেনে। একজন অপূর্ব সুন্দরী মেয়েকে নিয়ে ঢুকতে দেখে ম্যানেজার সালাম দিয়ে বলল, আসুন আসুন, অনেকদিন পরে এলেন, কেমন আছেন? আপনার ফুফুআম্মা ভালো আছেন?

আব্দুস সাত্তার সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আলহামদু লিল্লাহ, আল্লাহর রহমতে আমরা ভালো আছি। তা আপনারা কেমন আছেন?

জ্বি ভালো, বলে ম্যানেজার হাসিমুখে বললেন, সঙ্গে নিশ্চয় ভাবি? বিয়ের দাওয়াত না পেলেও আশা করি, অলিমার দাওয়াত পাব?

ম্যানেজারের কথা শুনে তাসনিমের মুখে কেউ যেন কয়েক মুঠো আবির মাখিয়ে দিল। লজ্জায় মাথা নিচু করে নিল।

তার দিকে এক পলক তাকিয়ে নিয়ে আব্দুস সাত্তার বলল, আন্দাজে ঢিল ছোড়া উচিত নয় ভাই। ঢিলটা বেজায়গায় লেগে গেলে কী হত বলুন তো? অবশ্য কাছাকাছি পৌঁছেছে। শুনুন, আমি আপনাদের না জানিয়ে বিয়ে করব এটা ভাবলেন কী করে? আন্দাজে ঢিল মেরে শুধু শুধু এই বেচারীকে লজ্জা দিচ্ছেন। ওসব কথা বাদ দিয়ে ইনার বাম হাতের মধ্যমার মাপের একটা হীরের আংটি দিন। তৈরি না থাকলে আঙ্গুলের মাপটা নিন। দু’একদিনের মধ্যে তৈরি করে দেবেন।

ম্যানেজার বললেন, কয়েকটা তৈরি আছে দেখাচ্ছি, মাপ মতো হয় কিনা দেখুন। আশা করি পছন্দ হবে।

আংটি পছন্দ করে আব্দুস সাত্তার চেকে পেমেন্ট দিল।

ততক্ষণে কেক ও কো-কো এসে গেল। ম্যানেজার বললেন, নিন ভাই।

আব্দুস সাত্তার ইশারা করে তাসনিমকে খেতে বলল, সে মাথা নেড়ে অসম্মতি জানাল।

আব্দুস সাত্তার ম্যানেজারকে বলল, মাফ করবেন, আমরা আজ কিছুই খেতে পারব না। অন্য দিন খাব বলে তাসনিমকে নিয়ে বেরিয়ে এল।

তাসনিম বুঝতে পারল, অখ্যাত পাড়াগাঁয়ের ছেলে বলে পরিচয় দিলেও আব্দুস সাত্তার খুব ধনী ঘরের ছেলে।

দোকান থেকে বেরিয়ে আব্দুস সাত্তার বলল, চল, তোমাকে কিছু খাওয়াই। সেই কোন সকালে নাস্তা খেয়েছিলে, নিশ্চয় খিদে পেয়েছে। দোকানেও কিছু খেলে না?

তুমি রোযা রেখে রয়েছ, আর তোমার সামনে আমি খাব, এটা ভাবলে কী করে? যতই খিদে পাক, তোমার সঙ্গে থাকলে সারাদিন না খেয়ে থাকতে পারব। অন্য দিন আপত্তি করব না। আজ চল, ফেরা যাক। তারপর গাড়িতে উঠে বলল, এত দামি উপহার না দিলে কী হত না?

পার্কে কি বলেছিলাম মনে নেই বুঝি? তারপরও বলছি, আমি যদি সারা পৃথিবীর বাদশাহ হতাম, তা হলে এমন খুশীর দিনে বাদশাহীটাই তোমাকে উপহার দিয়ে দিতাম। তোমার বাম হাতটা দাও পরিয়ে দিই।

আব্দুস সাত্তার আংটি পরিয়ে দেওয়ার পর তাসনিম বলল, তোমার এই উপহার আমার কাছে বাদশাহী তক্তের চেয়ে লক্ষগুণ শ্রেষ্ঠ। আমারও মন চাচ্ছে, এই মুহূর্তে তোমাকে কিছু দেওয়ার; কিন্তু আমার কাছে যে কিছুই নেই। তারপর তার দু’টো। হাত ধরে চুমো খেয়ে গালে চেপে রেখে মুখের দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে রইল।

আব্দুস সাত্তার আনন্দে আপ্লুত হয়ে বলল, তুমি যা দিলে, তার তুলনায় আমারটা অতি নগণ্য। তোমার প্রেমের এই প্রথম উপহার আমার কাছে লক্ষ কোটি টাকার উপহারের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান। তারপর হাত দুটো টেনে। স্টিয়ারিং-এ হুইল ধরে বলল, চল, তোমাকে পৌঁছে দিই।

বাসার কিছুটা দূরে এসে গাড়ি থামাতে দেখে তাসনিম বলল, বাসা চেন মনে হচ্ছে, এখানে থামলে কেন?

আব্দুস সাত্তার গাড়ি থেকে নেমে বলল, এবার তুমি যাও।

তাসনিম অবাক হয়ে বলল, সে কী? আমাদের বাসায় যাবে না?

আজ নয়, অন্য দিন।

কেন? আজ গেলে কী হয়?

কিছু হয় না, তবু যেতে পারছি না। প্লীজ, জিদ করো না। তোমার কথা রাখতে পারলে খুব কষ্ট পাব।

না গেলে আমিও যে খুব কষ্ট পাব, সে কথা মনে হচ্ছে না?

হচ্ছে। তবু যেতে পারছি না। বললাম না, অন্য দিন যাব?

আজ না যাওয়ার কারণ নিশ্চয় আছে?

আছে বলেই তো যেতে পারছি না।

কারণটা বল।

এখন কারণটাও বলতে পারব না।

ভালো হবে না বলছি।

খারাপ হলেও আমি নিরুপায়।

তাসনিম আহত স্বরে বলল, ঠিক আছে, তুমি স্বেচ্ছায় না আসা পর্যন্ত আর কখনও আসার জন্য তোমাকে বলব না। এই কথা বলে গাড়ি ছেড়ে দিল।

আব্দুস সাত্তার তার গাড়ির দিকে তাকিয়ে রইল। অদৃশ্য হয়ে যেতে একটা স্কুটার নিয়ে বাসায় ফিরল।

————–
(১) বর্ণনায় : হযরত ইবনে ওমর (রাঃ) মিশকাত
(২) সূরা-নূর, ৩১নং আয়াত, পারা-১৮

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত